জ্ঞান
জ্ঞান
: ২৯
هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُمْ مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا ثُمَّ اسْتَوَىٰ إِلَى السَّمَاءِ فَسَوَّاهُنَّ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ ۚ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ

তিনিই যমীনে যা আছে সব তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন। তারপর [১] তিনি আসমানের প্রতি মনোনিবেশ [২] করে সেটাকে সাত আসমানে বিন্যস্ত করেছেন; আর তিনি সবকিছু সম্পর্কে সবিশেষ অবগত।

ফুটনোট

[১] এখানে যমীন সৃষ্টির পরে আসমান সৃষ্টি করা হয়েছে বলে বর্ণিত হয়েছে। অথচ সূরা আন-নাযিআতের ৩০ নং আয়াত বাহ্যতঃ এর বিপরীত মনে হয়। এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনের সূরা ফুসসিলাতের ১০ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। এখানে শুধু এটা জানাই যথেষ্ট যে, সহীহ সনদে ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, "আল্লাহ্ তা'আলা যমীনকে আসমানের আগেই সৃষ্টি করেছিলেন এবং তার মধ্যে খাবার জাতীয় সবকিছুর ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু সেটাকে আসমান সৃষ্টির পূর্বে প্রসারিত ও সামঞ্জস্য বিধান করেন নি। তারপর তিনি আকাশের প্রতি মনোযোগী হয়ে সেটাকে সাত আসমানে বিন্যস্ত করেন। তারপর তিনি যমীনকে সুন্দরভাবে প্রসারিত ও বিস্তৃত করেছেন। এটাই এ আয়াত এবং সূরা আন-নাযিআতের ৩০ নং আয়াতের মধ্যে বাহ্যতঃ উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তর। আত-তাফসীরুস সহীহ মুজাহিদ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, আল্লাহ্ তা'আলা আসমান সৃষ্টি করার আগেই যমীন সৃষ্টি করেন। যমীন সৃষ্টির পর তা থেকে এক ধোঁয়া বা বাষ্প উপরের দিকে উঠতে থাকে। আর সেটাই আল্লাহ্‌র বাণী: “তারপর তিনি আসমান সৃষ্টির দিকে মনোনিবেশ করলেন এমতাবস্থায় যে, সেটা ছিল ধুম্রাকার" [সূরা ফুসসিলাত: ১১] [ইবনে কাসীর]

[২] পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে (اسْتَوٰى) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, স্থান বিশেষে বিভিন্ন প্রকার অর্থে। সংক্ষিপ্তভাবে বলা যায় তা তিনভাবে ব্যবহৃত হয়েছে:

১) (اسْتَوٰى) শব্দটি যেখানে পূর্ণ ক্রিয়া হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে অর্থাৎ তার পরে (عَلٰى) বা (اِلٰى) কিছুই না আসে তখন তার অর্থ হবে, সম্পূর্ণ হওয়া বা পূর্ণতা লাভ করা। যেমন আল্লাহ্ তা'আলা মূসা ‘আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলেনঃ

(وَلَمَّا بَلَغَ اَشُدَّهٗ وَاسْتَوٰى)

অর্থাৎ আর যখন মূসা যৌবনে পদার্পণ করলেন এবং পূর্ণতা লাভ করলেন। [সূরা আল-কাসাসঃ ১৪]

২) (اسْتَوٰى) শব্দটির সাথে যদি (عَلٰى) আসে তখন তার অর্থ হবে - উপরে উঠা, আরোহণ করা। যেমন আল্লাহ্‌ তা'আলা তার নিজের সম্পর্কে বলেনঃ

(ثُمَّ اسْتَوٰى عَلَى الْعَرْشِ)

অর্থাৎ তারপর তিনি আরশের উপর উঠলেন। অনুরূপভাবে সূরা (طه) তে এসেছেঃ

(اَلرَّحْمٰنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوٰى)

অর্থাৎ দয়াময় (রহমান) আরশের উপর উঠলেন।

(اسْتَوٰى) শব্দটির সাথে যদি (إلٰى) আসে তখন তার অর্থ হবে – ইচ্ছা করা, সংকল্প করা, মনোনিবেশ করা। আর সে অর্থই এ আয়াতে ব্যবহৃত , (ثُمَّ اسْتَوٰى اِلَى السَّمَآءِ)–এর অর্থ করা হবে- আকাশ সৃষ্টির ইচ্ছা করলেন। তবে মুজাহিদ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, এখানেও উপরে উঠার অর্থ হবে।
শেষোক্ত দু'অবস্থায় (اسْتَوٰى) শব্দটি যখন আল্লাহ্ তা'আলার সাথে সম্পৃক্ত হবে তখন তা তাঁর একটি সিফাত বা গুণ হিসেবে গণ্য হবে। আর আল্লাহ্‌র জন্য সে সিফাত বা গুণ কোন প্রকার অপব্যাখ্যা, পরিবর্তন, সদৃশ নির্ধারণ ছাড়াই সাব্যস্ত করা ওয়াজিব।

: ৩২
قَالُوا سُبْحَانَكَ لَا عِلْمَ لَنَا إِلَّا مَا عَلَّمْتَنَا ۖ إِنَّكَ أَنْتَ الْعَلِيمُ الْحَكِيمُ

তারা বলল, ‘ আপনি পবিত্র মহান ! আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন তা ছাড়া আমাদের তো কোন জ্ঞানই নেই। নিশ্চয় আপনিই সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময় ‘।
ফুটনোট

: ১২০
وَلَنْ تَرْضَىٰ عَنْكَ الْيَهُودُ وَلَا النَّصَارَىٰ حَتَّىٰ تَتَّبِعَ مِلَّتَهُمْ ۗ قُلْ إِنَّ هُدَى اللَّهِ هُوَ الْهُدَىٰ ۗ وَلَئِنِ اتَّبَعْتَ أَهْوَاءَهُمْ بَعْدَ الَّذِي جَاءَكَ مِنَ الْعِلْمِ ۙ مَا لَكَ مِنَ اللَّهِ مِنْ وَلِيٍّ وَلَا نَصِيرٍ

আর ইয়াহুদী ও নাসারারা আপনার প্রতি কখনো সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না আপনি তাদের মিল্লাতের অনুসরণ করেন। বলুন নিশ্চয় আল্লাহ্‌র হেদায়াতই প্রকৃত হেদায়াত। আর যদি আপনি তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করেন আপনার কাছে জ্ঞান আসার পরও, তবে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে আপনার কোন অভিভাবক থাকবে না এবং থাকবে না কোন সাহায্যকারীও।
ফুটনোট

: ১৪৫
وَلَئِنْ أَتَيْتَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ بِكُلِّ آيَةٍ مَا تَبِعُوا قِبْلَتَكَ ۚ وَمَا أَنْتَ بِتَابِعٍ قِبْلَتَهُمْ ۚ وَمَا بَعْضُهُمْ بِتَابِعٍ قِبْلَةَ بَعْضٍ ۚ وَلَئِنِ اتَّبَعْتَ أَهْوَاءَهُمْ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَكَ مِنَ الْعِلْمِ ۙ إِنَّكَ إِذًا لَمِنَ الظَّالِمِينَ

আর যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে আপনি যদি তাদের কাছে সমস্ত দলীল নিয়ে আসেন, তবু তারা আপনার কিবলার অনুসরণ করবে না; এবং আপনিও তাদের কিবলার অনুসারী নন [১]। আর তারাও পরস্পরের কিবলার অনুসারী নয়। আপনার নিকট সত্য-জ্ঞান আসার পরও যদি আপনি তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করেন, তাহলে নিশ্চয় আপনি যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবেন।

ফুটনোট

[১] আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে যে, কা'বা কেয়ামত পর্যন্ত আপনার কেবলা থাকবে।
এতে ইয়াহুদী-নাসারাদের সে মতবাদ খণ্ডন করাই ছিল উদ্দেশ্য যে, মুসলিমদের কেবলার কোন স্থিতি নেই, ইতঃপূর্বে তাদের কেবল ছিল কাবা, পরিবর্তিত হয়ে বায়তুল-মুকাদাস হল, আবার তাও বদলে গিয়ে পুনরায় কাবা হল। আবারো হয়ত বায়তুল-মুকাদাসকেই কেবলা বানিয়ে নেবে। [তাফসীরে বাহরে মুহীত]

: ২৪৭
وَقَالَ لَهُمْ نَبِيُّهُمْ إِنَّ اللَّهَ قَدْ بَعَثَ لَكُمْ طَالُوتَ مَلِكًا ۚ قَالُوا أَنَّىٰ يَكُونُ لَهُ الْمُلْكُ عَلَيْنَا وَنَحْنُ أَحَقُّ بِالْمُلْكِ مِنْهُ وَلَمْ يُؤْتَ سَعَةً مِنَ الْمَالِ ۚ قَالَ إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَاهُ عَلَيْكُمْ وَزَادَهُ بَسْطَةً فِي الْعِلْمِ وَالْجِسْمِ ۖ وَاللَّهُ يُؤْتِي مُلْكَهُ مَنْ يَشَاءُ ۚ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ

আর তাদের নবী তাদেরকে বলেছিলেন, ‘আল্লাহ্‌ অবশ্যই তালূতকে তোমাদের রাজা করে পাঠিয়েছেন’। তারা বলল, ‘আমাদের উপর তার রাজত্ব কিভাবে হবে, অথচ আমরা তার চেয়ে রাজত্বের বেশি হকদার এবং তাকে প্রচুর ঐশ্বর্যও দেয়া হয়নি!’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহ্‌ অবশ্যই তাকে তোমাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তিনি তাকে জ্ঞানে ও দেহে সমৃদ্ধ করেছেন’। আর আল্লাহ্‌ যাকে ইচ্ছে স্বীয় রাজত্ব দান করেন আর আল্লাহ্‌ সর্বব্যাপী প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।
ফুটনোট

:
هُوَ الَّذِي أَنْزَلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ مِنْهُ آيَاتٌ مُحْكَمَاتٌ هُنَّ أُمُّ الْكِتَابِ وَأُخَرُ مُتَشَابِهَاتٌ ۖ فَأَمَّا الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ زَيْغٌ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ ابْتِغَاءَ الْفِتْنَةِ وَابْتِغَاءَ تَأْوِيلِهِ ۗ وَمَا يَعْلَمُ تَأْوِيلَهُ إِلَّا اللَّهُ ۗ وَالرَّاسِخُونَ فِي الْعِلْمِ يَقُولُونَ آمَنَّا بِهِ كُلٌّ مِنْ عِنْدِ رَبِّنَا ۗ وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّا أُولُو الْأَلْبَابِ

তিনিই আপনার প্রতি এই কিতাব নাযিল করেছেন যার কিছু আয়াত ‘মুহ্‌কাম’, এগুলো কিতাবের মূল; আর অন্যগুলো ‘মুতাশাবিহ্‌’ [১], সুতরাং যাদের অন্তরে বক্রতা রয়েছে শুধু তারাই ফেৎনা এবং ভুল ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে মুতাশাবিহাতের অনুসরণ করে [২]। অথচ আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্য কেউ এর ব্যাখ্যা জানে না। আর যারা জ্ঞানে সুগভীর [৩] তারা বলে, ‘আমরা এগুলোতে ঈমান রাখি, সবই আমাদের রবের কাছ থেকে এসেছে’ [৪]; এবং জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরা ছাড়া আর কেউ উপদেশ গ্রহণ করে না।

ফুটনোট

[১] আয়াতে আল্লাহ্‌ তা'আলা কুরআনের সুস্পষ্ট ও অস্পষ্ট আয়াতের কথা উল্লেখ করে একটি সাধারণ মুলনীতি ও নিয়মের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। যার দ্বারা অনেক আপত্তি ও বাদানুবাদের অবসান ঘটে। এর ব্যাখ্যা এরূপ, কুরআনুল কারীমে দুই প্রকার আয়াত রয়েছে। এক প্রকারকে ‘মুহকামাত’ তথা সুস্পষ্ট আয়াত এবং অপর প্রকারকে ‘মুতাশাবিহাত’ তথা অস্পষ্ট আয়াত বলা হয়।

ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, মুহকাম হচ্ছে, ঐ সব আয়াতগুলো, যা নাসেখ বা রহিতকারী, যাতে আছে হালাল-হারামের বর্ণনা, শরীআতের সীমারেখা, ফরয-ওয়াজিব, ঈমান ও আমলের বিষয়াদির বর্ণনা। পক্ষান্তরে মুতাশাবিহ আয়াতসমূহ হচ্ছে, যা মানসূখ বা রহিত, যাতে উদাহরণ ও এ জাতীয় বিষয়াদি পেশ করা হয়েছে। [আত-তাফসীরুস সহীহ]

প্রথম প্রকার আয়াতকে আল্লাহ্ তা'আলা ‘উম্মুল কিতাব' আখ্যা দিয়েছেন। এর অর্থ এই যে, এসব আয়াতই সমগ্র শিক্ষার মূল ভিত্তি। এসব আয়াতের অর্থ যাবতীয় অস্পষ্টতা ও জটিলতামুক্ত।

দ্বিতীয় প্রকার আয়াতে বক্তার উদ্দেশ্য অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্ট হওয়ার কারণে এগুলো সম্পর্কে বিশুদ্ধ পন্থা হল, এসব আয়াতকে প্রথম প্রকার আয়াতের আলোকে দেখা। যে আয়াতের অর্থ প্রথম প্রকার আয়াতের বিপক্ষে যায়, তাকে সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে বক্তার এমন উদ্দেশ্য বুঝতে হবে, যা প্রথম প্রকার আয়াতের বিপক্ষে নয়। উদাহরণতঃ ঈসা ‘আলাইহিস সালাম সম্পর্কে কুরআনের সুস্পষ্ট উক্তি এরূপ

(اِنْ هُوَ اِلَّا عَبْدٌ اَنْعَمْنَا عَلَيْهِ)

অর্থাৎ "সে আমার নেয়ামত প্রাপ্ত বান্দা ছাড়া অন্য কেউ নয়। ” [সূরা আয-যুখরুফ ঃ ৫৯] অন্যত্র বলা হয়েছে,

(اِنَّ مَثَلَ عِيْسٰى عِنْدَ اللّٰهِ كَمَثَلِ اٰدَمَ ۭخَلَقَهٗ مِنْ تُرَابٍ)

অর্থাৎ “আল্লাহ্‌র কাছে ঈসার উদাহরণ হচ্ছে আদমের অনুরূপ আল্লাহ্ তাকে সৃষ্টি করেছেন মৃত্তিকা থেকে।" [সূরা আলে-ইমরানঃ ৫৯]

এসব আয়াত এবং এ ধরনের অন্যান্য আয়াত থেকে পরিস্কার বুঝা যায় যে, ঈসা ‘আলাইহিস সালাম আল্লাহ্ তা'আলার মনোনীত এবং তাঁর সৃষ্ট। অতএব তিনি উপাস্য, তিনি আল্লাহ্‌র পুত্র-নাসারাদের এসব দাবী সম্পূর্ণ বানোয়াট। তারা যদি (كَلِمَةُ اللّٰهِ) ‘আল্লাহ্‌র কালেমা’ বা (رُوْحٌ مِنْهُ); ‘তাঁর পক্ষ থেকে রূহ’ শব্দদ্বয় দ্বারা দলীল নেয়ার চেষ্টা করে তখন তাদের বলতে হবে যে, পূর্বে বর্ণিত আয়াতসমূহের আলোকেই এশব্দদ্বয়কে বুঝতে হবে। সে আলোকে উপরোক্ত (كَلِمَةُ اللّٰهِ I رُوْحٌ مِنْهُ) শব্দদ্বয় সম্পর্কে এটাই বলতে হয় যে, ঈসা ‘আলাইহিস সালাম আল্লাহ্‌র নির্দেশে সৃষ্ট হয়েছেন এবং তাঁর পক্ষ থেকে পাঠানো একটি রূহ মাত্র।

[২] বলা হয়েছে, ‘যাদের অন্তরে বক্রতা রয়েছে তারা মুতাশাবিহাতের অনুসরণ করে’। ইবনে আব্বাস বলেন, যাদের অন্তরে বক্রতা রয়েছে এ কথা বলে যাদের অন্তরে সন্দেহ রয়েছে তাদেরকে বোঝানো হয়েছে। তারা মুহকাম আয়াতকে মুতাশাবিহ আয়াতের উপর এবং মুতাশাবিহ আয়াতকে মুহকাম আয়াতের উপর ইচ্ছাকৃত সন্দেহ লাগানোর জন্য নির্ধারণ করে, ফলে তারা নিজেরা সন্দেহে পতিত হয় এবং পথভ্রষ্ট হয়। তারা সঠিক পথ গ্রহণ করতে সচেষ্ট থাকে না। [আত-তাফসীরুস সহীহ] হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদল লোককে কুরআনের আয়াত সম্পর্কে পরস্পর বাদানুবাদে লিপ্ত দেখে বললেন, “তোমাদের পূর্বের লোকেরা এ কারণেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তারা আল্লাহ্‌র কিতাবের একাংশকে অপর অংশের বিপরীতে ব্যবহার করত। আল্লাহ্‌র কুরআন তো এ জন্যই নাযিল হয়েছিল যে, এর একাংশ অপর অংশের সত্যয়ণ করবে। সুতরাং তোমরা এর একাংশকে অপর অংশের কারণে মিথ্যারোপ করো না। এর যে অংশের অর্থ তোমরা জানবে সেটা বলবে, আর যে অংশের অর্থ জানবে না সেটা আলেম বা যারা জানে তাদের কাছে সোপর্দ করো। ” [মুসনাদে আহমাদ ২/১৮৫, নং ৬৭৪১; মুসান্নাফে ইবন আবী শাইবাহ ১১/২১৬২১৭, হাদীস নং ২৩৭০]

[৩] এখন প্রশ্ন হচ্ছে, গভীর জ্ঞানের অধিকারীগণ কি এ সমস্ত মুতাশাবিহাতের অর্থ জানে কি না? কোন কোন মুফাসসির এখানে (تأويل) শব্দের অর্থভেদে এর উত্তর দিয়েছেন। কারণ, (تأويل) শব্দটির এক অর্থ, তাফসীর বা ব্যাখ্যা। অপর অর্থ, সেই প্রকৃত উদ্দেশ্য, যার জন্য আয়াতটি নিয়ে আসা হয়েছে। যদি প্রথম অর্থ উদ্দেশ্য হয়, তবে এর কোন কোন অর্থ মুফাসসিরগণ করেছেন। যা ব্যাখ্যার পর্যায়ে পড়ে। সে হিসেবে ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তাদের অন্তর্ভুক্ত যারা এগুলোর (تأويل) তথা ব্যাখ্যা জানে। [তাবারী]। আর যদি দ্বিতীয় অর্থ উদ্দেশ্য হয়, তখন এর অর্থ আল্লাহ্‌ ব্যতীত আর কেউ জানে না। অধিকাংশ সাহাবী, তাবেয়ী এই দ্বিতীয় অর্থ গ্রহণ করে বলেছেন যে, মুতাশাবিহাতের প্রকৃত উদ্দেশ্য আল্লাহ্‌ ব্যতীত আর কেউ জানে না। যেমন, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, গভীর জ্ঞানের অধিকারী আলেমদের জ্ঞানের দৃঢ়তার পরিচয় এই যে, তারা মুহকাম ও মুতাশাবিহ সব ধরনের আয়াতের উপরই ঈমান এনেছে, অথচ তারা মুতাশাবিহ আয়াতসমূহের (تأويل) তথা প্রকৃত ব্যাখ্যা জানে না’। অনুরূপভাবে উবাই ইবন কা'ব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘গভীর জ্ঞানের অধিকারী আলেমগণ এগুলোর (تأويل) তথা প্রকৃত ব্যাখ্যা জানে না, বরং তারা বলে, আমরা এগুলোতে ঈমান আনি, সবই আমাদের রবের কাছ থেকে এসেছে’। [তাবারী]

[৪] এ আয়াতে আল্লাহ্ তা'আলা বর্ণনা করেন যে, যারা সুস্থ স্বভাবসম্পন্ন তারা অস্পষ্ট আয়াত নিয়ে বেশী তথ্যানুসন্ধান ও ঘাটাঘাটি করে না; বরং তারা সংক্ষেপে বিশ্বাস করে যে, এ আয়াতটিও আল্লাহ্‌র সত্য কালাম। তবে তিনি কোন বিশেষ হেকমতের কারণে এর অর্থ সম্পর্কে আমাদের অবহিত করেননি। প্রকৃতপক্ষে এ পন্থাই বিপদমুক্ত ও সতর্কতাযুক্ত। এর বিপরীতে কিছুসংখ্যক লোক এমনও আছে, যাদের অন্তর বক্র। তারা সুস্পষ্ট আয়াত থেকে চক্ষু বন্ধ করে অস্পষ্ট আয়াত নিয়ে ঘাটাঘাটিতে লিপ্ত থাকে এবং তা থেকে নিজ মতলবের অনুকূলে অর্থ বের করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস পায়। এরূপ লোকদের সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ আয়াতখানি তিলাওয়াত করে বললেন, “যখন তোমরা তাদেরকে দেখবে যারা এ সমস্ত (মুতাশাবিহ) আয়াতের পিছনে দৌড়াচ্ছে, তখন বুঝে নিবে যে, আল্লাহ্‌ এ সমস্ত লোকের কথাই পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেছেন। তখন তাদের থেকে সাবধান থাকবে। " [বুখারী ৪৫৪৭; মুসলিম: ২৬৬৫]

: ১৮
شَهِدَ اللَّهُ أَنَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ وَالْمَلَائِكَةُ وَأُولُو الْعِلْمِ قَائِمًا بِالْقِسْطِ ۚ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ

আল্লাহ্‌ সাক্ষ্য দেন [১] যে, নিশ্চয় তিনি ছাড়া কোন সত্য ইলাহ্‌ নেই। আর ফেরেশতাগণ এবং জ্ঞানীগণও; আল্লাহ্‌ ন্যায়নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। তিনি ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই, (তিনি) পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ যে আল্লাহ্‌ বিশ্ব জাহানের সমস্ত তত্ত্ব, সত্য ও রহস্যের প্রত্যক্ষ জ্ঞান রাখেন, যিনি সমগ্র সৃষ্টিকে আবরণহীন অবস্থায় দেখছেন এবং যার দৃষ্টি থেকে পৃথিবী ও আকাশের কোন একটি বস্তুও গোপন নেই এটি তার সাক্ষ্য। আর তার চেয়ে নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য আর কে দিতে পারে? কারণ পৃথিবীতে ইলাহের স্বত্ব দাবী করার অধিকার ও যোগ্যতা কারও নেই। তিনি নিজেই সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, তিনি ব্যতীত আর কোন হক্ক ইলাহ নেই। তিনি ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত করা যুলুম ও অন্যায়। আল্লাহ্‌ তা'আলার এ সাক্ষ্যের সাথে তিনি আল্লাহ্‌ তাঁর ফেরেশতাদেরকেও শরীক করেছেন। তারাও এ মহৎ সাক্ষ্য দিয়ে থাকে। তারপর আল্লাহ্ তা'আলা আলেম তথা দ্বীনের জ্ঞানে জ্ঞানীদেরকেও এ সাক্ষ্য প্রদানের জন্য গ্রহণ করে সম্মানিত করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি মূলত: আলেম তথা দ্বীনের জ্ঞানে জ্ঞানীদের সম্মান বহুগুণ বৃদ্ধি করে দিয়েছেন। [ইবনুল কাইয়্যেম: মিফতাহু দারিস সা’আদাহ; তাফসীরে সা’দী]

: ১৯
إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللَّهِ الْإِسْلَامُ ۗ وَمَا اخْتَلَفَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ إِلَّا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ ۗ وَمَنْ يَكْفُرْ بِآيَاتِ اللَّهِ فَإِنَّ اللَّهَ سَرِيعُ الْحِسَابِ

নিশ্চয় ইসলামই আল্লাহ্‌র নিকট একমাত্র দ্বীন [১]। আর যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল তারা কেবলমাত্র পরস্পর বিদ্বেষবশতঃ তাদের নিকট জ্ঞান আসার পর মতানৈক্য ঘটিয়েছিল। আর কেউ আল্লাহ্‌র আয়াতসমূহে কুফরী করে, তবে নিশ্চয় আল্লাহ্‌ দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী।

ফুটনোট

[১] সুদ্দী বলেন, ‘আল্লাহ্‌র নিকট মনোনীত দ্বীন হচ্ছে ইসলাম’। এটা পূর্ববর্তী আয়াতে বর্ণিত আল্লাহ্‌, তাঁর ফেরেশতা এবং জ্ঞানীদের সাক্ষ্যের বিষয়। অর্থাৎ তারা এ সাক্ষ্যও দিচ্ছেন যে, আল্লাহ্‌র নিকট একমাত্র দ্বীন হচ্ছে ইসলাম। [তাবারী] কাতাদা বলেন, ইসলাম হচ্ছে, আল্লাহ্‌ ব্যতীত হক্ক কোন মা’বুদ নেই এ সাক্ষ্য দেয়া, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ্‌র কাছ থেকে যা নিয়ে এসেছেন তার সত্যতার স্বীকৃতি প্রদান। আর এটাই হচ্ছে আল্লাহ্‌ প্রদত্ত দ্বীন যা তিনি প্রবর্তন করেছেন, রাসূলদেরকে যা নিয়ে প্রেরণ করেছেন, তাঁর বন্ধুদেরকে যার দিশা দিয়েছেন। এটা ব্যতীত তিনি আর কিছু গ্রহণ করবেন না। এটা অনুপাতে না হলে তিনি কাউকে পুরস্কৃত করবেন না। [তাবারী]

: ৬১
فَمَنْ حَاجَّكَ فِيهِ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَكَ مِنَ الْعِلْمِ فَقُلْ تَعَالَوْا نَدْعُ أَبْنَاءَنَا وَأَبْنَاءَكُمْ وَنِسَاءَنَا وَنِسَاءَكُمْ وَأَنْفُسَنَا وَأَنْفُسَكُمْ ثُمَّ نَبْتَهِلْ فَنَجْعَلْ لَعْنَتَ اللَّهِ عَلَى الْكَاذِبِينَ

অতঃপর আপনার নিকট জ্ঞান আসার পর যে কেউ এ বিষয়ে আপনার সাথে তর্ক করে তাকে বলুন, ‘এস, আমরা আহবান করি আমাদের পুত্রদেরকে ও তোমাদের পুত্রদেরকে, আমাদের নারীদেরকে ও তোমাদের নারীদেরকে, আমাদের নিজেদেরকে ও তোমাদেরকে নিজেদেরকে, তারপর আমরা মুবাহালা (বিনীত প্রার্থনা) করি, অতঃপর মিথ্যাবাদীদের উপর দেই আল্লাহ্‌র লা’নত [১]’

ফুটনোট

[১] এ আয়াতে আল্লাহ্‌ তা'আলা মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মুবাহালা করার নির্দেশ দিয়েছেন। মুবাহালা হলো, যদি সত্য ও মিথ্যার ব্যাপারে দুই পক্ষের মধ্যে বাদানুবাদ হয় এবং যুক্তিতর্কে মীমাংসা না হয়, তবে তারা সকলে মিলে আল্লাহ্‌র কাছে প্রার্থনা করবে, যে পক্ষ এ ব্যাপারে মিথ্যাবাদী, সে যেন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং আল্লাহ্‌র লানতের অধিকারী হয়। মূলত: ‘লা'নত’ অর্থ আল্লাহ্‌র রহমত থেকে দূরে সরে পড়া। আল্লাহ্‌র রহমত থেকে দূরে সরে পড়া মানেই আল্লাহ্‌র ক্রোধে পড়া। এর সারমর্ম দাঁড়ায় এই যে, মিথ্যাবাদীর উপর আল্লাহ্‌র ক্রোধ বর্ষিত হোক। এরূপ করার পর যে পক্ষ মিথ্যাবাদী, সে তার প্রতিফল ভোগ করবে। সে সময় সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদীর পরিচয় অবিশ্বাসীদের দৃষ্টিতেও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এভাবে প্রার্থনা করাকে ‘মুবাহালা’ বলা হয়। এতে বিতর্ককারীরা একত্রিত হয়ে প্রার্থনা করলেই চলে। পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজনকে একত্রিত করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু একত্রিত করলে এর গুরুত্ব বেড়ে যায়।

: ৬৬
هَا أَنْتُمْ هَٰؤُلَاءِ حَاجَجْتُمْ فِيمَا لَكُمْ بِهِ عِلْمٌ فَلِمَ تُحَاجُّونَ فِيمَا لَيْسَ لَكُمْ بِهِ عِلْمٌ ۚ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ

সাবধান, তোমরা তো সে সব লোক, যে বিষয়ে তোমাদের সামান্য জ্ঞান আছে সে বিষয়ে তোমরা তর্ক করেছ, তবে যে বিষয়ে তোমাদের কোন জ্ঞান নেই সে বিষয়ে কেন তর্ক করছ? আর আল্লাহ্‌ জানেন এবং তোমরা জান না।
ফুটনোট

: ১৯০
إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآيَاتٍ لِأُولِي الْأَلْبَابِ

আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টিতে [১], রাত ও দিনের পরিবর্তনে [২] নিদর্শনাবলী রয়েছে [৩] বোধশক্তি সম্পন্ন লোকদের জন্য।

ফুটনোট

বিশতম রুকূ‘

[১] অর্থাৎ আসমান এবং যমীন সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহ্ তা’আলার এক বিরাট নিদর্শন বিদ্যমান। এ দুয়ের মধ্যে অবস্থিত আল্লাহ্ তা’আলার অসংখ্য সৃষ্টিরাজিকেও এ আয়াত দ্বারা বুঝানো হয়েছে। এ বিরাট সৃষ্টজগতের মধ্যে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত প্রতিটি সৃষ্ট বস্তুই স্ব স্ব সৃষ্টিকর্তার নিদর্শনরূপে দাঁড়িয়ে আছে।

[২] চিন্তা-ভাবনার দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, দিন-রাত্রির আবর্তন। আয়াতে উল্লেখিত (اختلاف) শব্দটি আরবী পরিভাষায়, ‘পরে আসা’ এর অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সেমতে বাক্যের অর্থ হবে, রাত্রির গমন এবং দিবসের আগমন। আবার (اختلاف) শব্দ দ্বারা কম-বেশীও বুঝায়। যেমন, শীতকালে রাত্রি হয় দীর্ঘ এবং দিন হয় খাটো, গরমকালে দিন বড় এবং রাত্রি হয় ছোট। অনুরূপভাবে এক দেশ থেকে অন্য দেশে দিবস এবং রাত্রির দৈর্ঘ্যেও তারতম্য হয়ে থাকে। যেমন, উত্তর মেরুর সন্নিকটবর্তী দেশগুলোতে দিবাভাগ উত্তর মেরু থেকে দুরবর্তী দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশী দীর্ঘ হয়। এসব বিষয়ই আল্লাহ্ তা’আলার অপার কুদরাতের অতি উজ্জ্বল নিদর্শন।

[৩] (اٰية) এর বহুবচন হল (اٰيات)। শব্দটি কয়েকটি অর্থেই ব্যবহৃত হয়। যথা- মু’জিযাকে ‘আয়াত’ বলা হয়। অনুরূপভাবে, কুরআনের বাক্যকেও ‘আয়াত’ বলা হয়। তৃতীয় অর্থে দলীল-প্রমাণ ও নিদর্শনাবলীকে বুঝানো হয়ে থাকে। এখানে তৃতীয় অর্থেই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ এসব বিষয়ের মধ্যে আল্লাহ্ তা’আলার বিরাট নিদর্শনাবলী রয়েছে।

: ৮৩
وَإِذَا جَاءَهُمْ أَمْرٌ مِنَ الْأَمْنِ أَوِ الْخَوْفِ أَذَاعُوا بِهِ ۖ وَلَوْ رَدُّوهُ إِلَى الرَّسُولِ وَإِلَىٰ أُولِي الْأَمْرِ مِنْهُمْ لَعَلِمَهُ الَّذِينَ يَسْتَنْبِطُونَهُ مِنْهُمْ ۗ وَلَوْلَا فَضْلُ اللَّهِ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُهُ لَاتَّبَعْتُمُ الشَّيْطَانَ إِلَّا قَلِيلًا

যখন শান্তি বা শংকার কোন সংবাদ তাদের কাছে আসে তখন তারা তা প্রচার করে থাকে [১]। যদি তারা তা রাসূল [২] এবং তাদের মধ্যে যারা নির্দেশ প্রদানের অধিকারী তাদেরকে জানাত, তবে তাদের মধ্যে যারা তথ্য অনুসন্ধান করে তারা সেটার যথার্থতা নির্ণয় করতে পারত [৩]। তোমাদের প্রতি যদি আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত না থাকত তবে তোমাদের অল্প সংখ্যক ছাড়া সকলে শয়তানের অনুসরণ করত।

ফুটনোট

[১] এ আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হচ্ছে যে, কোন শ্রুত কথা যাচাই, অনুসন্ধান ব্যতিরেকে বর্ণনা করা উচিত নয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, ‘কোন লোকের পক্ষে মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে কোন রকম যাচাই না করেই সমস্ত শ্রুত কথা প্রচার করে।’ [মুসলিম: ৫] অপর এক হাদীসে তিনি বলেছেনঃ “যে লোক এমন কোন কথা বর্ণনা করে, যার ব্যাপারে সে জানে যে, সেটি মিথ্যা, তাহলে সে দু’জন মিথ্যাবাদীর একজন মিথ্যাবাদী”। [তিরমিয়ী: ২৬৬২; ইবন মাজাহ ৩৮; মুসনাদে আহমাদ ৪/২৫৫]

[২] আয়াতের দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামও দলীল-প্রমাণের মাধ্যমে হুকুম-আহকাম উদ্ভাবনের দায়িত্বপ্রাপ্ত। তার কারণ, আয়াতে দু’রকম লোকের নিকট প্রত্যাবর্তন করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাদের একজন হলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং অপরজন হচ্ছেন, ‘উলুল আমর’। অতঃপর বলা হয়েছে, ‘তাদের মধ্যে যারা ক্ষমতার অধিকারী তাদেরকে জানাত, তবে তাদের মধ্যে যারা তথ্য অনুসন্ধান করে তারা সেটার যথার্থতা নির্ণয় করতে পারত’। আর এই নির্দেশটি অত্যন্ত ব্যাপক। রাসূল ও আলেম সমাজ এর আওতাভুক্ত।

[৩] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “কুরআন তার একাংশ অপরাংশ দ্বারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করার জন্য নাযিল হয়নি, বরং এর একাংশ অপরাংশের সত্যতা নিরূপন করে। সুতরাং তোমরা এর মধ্যে যা বুঝতে পার তার উপর আমল কর আর যা বুঝতে পারবে না সেটা যারা বুঝে তাদের হাতে ছেড়ে দাও। [ইবন মাজাহঃ ৮৫, মুসনাদে আহমাদ ২/১৮১]

: ১৫৬
وَبِكُفْرِهِمْ وَقَوْلِهِمْ عَلَىٰ مَرْيَمَ بُهْتَانًا عَظِيمًا

আর তাদের কুফরীর জন্য এবং মারইয়ামের বিরুদ্ধে গুরুতর অপবাদের জন্য [১]।

ফুটনোট

[১] মারইয়ামের উপর চাপানো তাদের গুরুতর অপবাদ কি ছিল তা এখানে বর্ণনা করা হয় নি। অন্যত্র এসেছে যে, তারা মারইয়ামকে ব্যভিচারের অপবাদ দিতে ক্রটি করে নি। আল্লাহ বলেন, “তারপর সে সন্তানকে নিয়ে তার সম্প্রদায়ের কাছে উপস্থিত হল; তারা বলল, “হে মারইয়াম! তুমি তো এক অদ্ভুত জিনিস নিয়ে এসেছ”। [সূরা মারইয়াম:২৭]

এখানে অঘটন বলতে তারা ব্যভিচারের দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করছিল। কারণ পরবর্তী আয়াতে মারইয়ামের বাবা খারাপ লোক না হওয়া এবং মা-ও বেশ্যা না হওয়া বলার মাধ্যমে সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। [আদওয়াউল বায়ান]

: ১৫৭
وَقَوْلِهِمْ إِنَّا قَتَلْنَا الْمَسِيحَ عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ رَسُولَ اللَّهِ وَمَا قَتَلُوهُ وَمَا صَلَبُوهُ وَلَٰكِنْ شُبِّهَ لَهُمْ ۚ وَإِنَّ الَّذِينَ اخْتَلَفُوا فِيهِ لَفِي شَكٍّ مِنْهُ ۚ مَا لَهُمْ بِهِ مِنْ عِلْمٍ إِلَّا اتِّبَاعَ الظَّنِّ ۚ وَمَا قَتَلُوهُ يَقِينًا

আর ‘আমরা আল্লাহর রাসূল মারঈয়াম তনয় ‘ঈসা মসীহকে হত্যা করেছি’ তাদের এ উক্তির জন্য। অথচ তারা তাকে হত্যা করেনি এবং ক্রুশবিদ্ধও করেনি; বরং তাদের জন্য (এক লোককে) তার সদৃশ করা হয়েছিল [১]। আর নিশ্চয় যারা তার সম্বন্ধে মতভেদ করেছিল, তারা অবশ্যই এ সম্বন্ধে সংশয়যুক্ত ছিল; এ সম্পর্কে অনুমানের অনুসরণ ছাড়া তাদের কোন জ্ঞানই ছিল না। আর এটা নিশ্চিত যে, তারা তাঁকে হত্যা করেনি,

ফুটনোট

[১] এখানে স্পষ্ট ঘোষণা করা হয়েছে যে, ওরা ঈসা ‘আলাইহিস সালাম-কে হত্যাও করতে পারেনি, শুলেও চড়াতে পারেনি, বরং আসলে ওরা সন্দেহে পতিত হয়েছিল। কিন্তু তাদের সন্দেহ কি ছিল এ ব্যাপারে বিভিন্ন বর্ণনা এসেছে, সব বর্ণনার সার কথা হচ্ছে, ইয়াহুদীরা যখন ঈসা ‘আলাইহিস সালাম-কে হত্যা করতে বদ্ধপরিকর হলো, তখন তার ভক্ত-সহচরবৃন্দ এক স্থানে সমবেত হলেন। ঈসা ‘আলাইহিস সালামও সেখানে উপস্থিত হলেন। তখন চার হাজার ইয়াহুদী দূরাচার একযোগে গৃহ অবরোধ করলো। তখন ঈসা ‘আলাইহিস সালাম স্বীয় ভক্ত অনুচরগণকে সম্বোধন করে বললেন, তোমাদের মধ্য থেকে কেউ এই ঘর থেকে বের হতে ও নিহত হতে এবং আখেরাতে জান্নাতে আমার সাথী হতে প্রস্তুত আছো কি? জনৈক ভক্ত আত্মোৎসর্গের জন্য উঠে দাঁড়ালেন। ঈসা ‘আলাইহিস সালাম নিজের জামা ও পাগড়ী তাঁকে পরিধান করালেন। অতঃপর তাঁকে ঈসা ‘আলাইহিস সালাম-এর সাদৃশ করে দেয়া হলো। যখন তিনি ঘর থেকে বের হলেন, তখন ইয়াহুদীরা ঈসা ‘আলাইহিস সালাম মনে করে তাঁকে বন্দী করে নিয়ে গেল এবং শুলে চড়িয়ে হত্যা করলো। অপরদিকে ঈসা ‘আলাইহিস সালাম-কে আল্লাহ্ তা’আলা আসমানে তুলে নিলেন।
এক বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, ইয়াহুদীরা এক লোককে ঈসা ‘আলাইহিস সালাম-কে হত্যা করার জন্য পাঠিয়েছিল। কিন্তু ইতোপূর্বে আল্লাহ্ তা'আলা তাঁকে আকাশে তুলে নেয়ায় সে তার নাগাল পেল না। বরং ইতিমধ্যে তার নিজের চেহারা ঈসা ‘আলাইহিস সালাম-এর মত হয়ে গেল। ব্যর্থ মনোরথ হয়ে সে যখন ঘর থেকে বেরিয়ে এল তখন অন্যান্য ইয়াহুদীরা তাকেই ঈসা ‘আলাইহিস সালাম মনে করে পাকড়াও করলো, এবং শুলে বিদ্ধ করে হত্যা করলো। উক্ত বর্ণনা দু’টির মধ্যে যে কোনটিই সত্য হতে পারে। কুরআনুল কারীম এ সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু ব্যক্ত করেনি। অতএব, প্রকৃত ঘটনার সঠিক খবর একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাই জানেন। অবশ্য কুরআনুল কারীমের আয়াত ও তাফসীর সংক্রান্ত বর্ণনার সমন্বয়ে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, প্রকৃত ঘটনা ইয়াহুদী-খৃষ্টানদেরও অজ্ঞাত ছিল। তারা চরম বিভ্রান্তির আবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়ে শুধু অনুমান করে বিভিন্ন উক্তি ও দাবী করছিল। ফলে উপস্থিত লোকদের মধ্যেই চরম মতভেদ ও বিবাদের সৃষ্টি হয়েছিল। তাই কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে যে, যারা ঈসা ‘আলাইহিস সালাম সম্পর্কে নানা মত পোষন করে নিশ্চয় এ ব্যাপারে তারা সন্দেহে পতিত হয়েছে। তাদের কাছে এ সম্পর্কে কোন সত্যনির্ভর জ্ঞান নেই। তারা শুধু অনুমান করে কথা বলে। আর তারা যে ঈসা ‘আলাইহিস সালাম-কে হত্যা করেনি, এ কথা সুনিশ্চিত। বরং আল্লাহ্ তা’আলা তাকে নিরাপদে নিজের কাছে তুলে নিয়েছেন।

কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, সম্বিত ফিরে পাওয়ার পর কিছু লোক বললো, আমরা তো নিজেদের লোককেই হত্যা করে ফেলেছি। কেননা, নিহত ব্যক্তির মুখমণ্ডল ঈসা ‘আলাইহিস সালাম-এর মত হলেও তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অন্য রকম। তদুপরি এ ব্যক্তি যদি ঈসা ‘আলাইহিস সালাম হয়, তবে আমাদের প্রেরিত লোকটি গেল কোথায়? আর এ ব্যক্তি আমাদের হলে ঈসা ‘আলাইহিস সালামই বা কোথায় গেলেন? মোটকথা: ঈসা ‘আলাইহিস সালাম সম্পর্কে ইয়াহুদী ও নাসারা যারাই কথা বলে তারাই বিভ্রান্তিতে লিপ্ত। তাদের কাছে এ ব্যাপারে কোন জ্ঞান নেই।

: ১৬২
لَٰكِنِ الرَّاسِخُونَ فِي الْعِلْمِ مِنْهُمْ وَالْمُؤْمِنُونَ يُؤْمِنُونَ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ ۚ وَالْمُقِيمِينَ الصَّلَاةَ ۚ وَالْمُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَالْمُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ أُولَٰئِكَ سَنُؤْتِيهِمْ أَجْرًا عَظِيمًا

কিন্তু তাদের মধ্যে যারা জ্ঞানে মজবুত তারা ও মুমিনগণ আপনার প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে এবং আপনার আগে যা নাযিল করা হয়েছে তাতে ঈমান আনে। আর সালাত প্রতিষ্ঠাকারী, যাকাত প্রদানকারী এবং আল্লাহ ও শেষ দিবসে ঈমান আনয়নকারী, তাদেরকে অচিরেই আমরা মহা পুরস্কার দেব। [১]

ফুটনোট

[১] এ আয়াতে কতিপয় মহান ব্যক্তির জন্য যে বিপুল প্রতিদানের আশ্বাস দেয়া হয়েছে, তা তাঁদের ঈমান ও সৎকর্মের কারণে। তবে অবশ্যই ঈমানের সাথে মৃত্যুর সৌভাগ্য হতে হবে।

: ১৬৬
لَٰكِنِ اللَّهُ يَشْهَدُ بِمَا أَنْزَلَ إِلَيْكَ ۖ أَنْزَلَهُ بِعِلْمِهِ ۖ وَالْمَلَائِكَةُ يَشْهَدُونَ ۚ وَكَفَىٰ بِاللَّهِ شَهِيدًا

কিন্তু আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন আপনার প্রতি যা তিনি নাযিল করেছেন তার মাধ্যমে। তিনি তা নাযিল করেছেন নিজ জ্ঞানে। আর ফেরেশতাগণও সাক্ষী দিচ্ছেন। আর সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট [১]।

ফুটনোট

[১] আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের সমীপে একদল ইয়াহুদী উপস্থিত হলো। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে লক্ষ্য করে বললেনঃ ‘আল্লাহর শপথ! তোমরা সন্দেহাতীতভাবে জান যে, আমি আল্লাহ তা’আলার সত্য রাসূল। তারা অস্বীকার করলো। তখনই উক্ত আয়াত নাযিল হলো- আল্লাহ তা’আলা ঐ কিতাবের (আল কুরআনের) মাধ্যমে -যা তাঁর পরিপূর্ণ জ্ঞানের নিদর্শন- আপনার নবুওয়াতের সাক্ষী দিচ্ছেন। আর ফিরিশতাগণও এর সাক্ষী । অধিকন্তু সর্বজ্ঞানী আল্লাহ্ তা’আলার সাক্ষ্যদানের পর আর কোন সাক্ষ্য-প্রমাণের প্রয়োজন নেই। [তাবারী, আততাফসীরুস সহীহ]

এ আয়াতে কুরআনের সত্যতার উপর সাক্ষ্যদানের পাশাপাশি কুরআন যার উপর নাযিল হয়েছে তার সত্যতার উপরও সাক্ষ্য প্রদান হয়ে গেছে। তাছাড়া অন্যত্র আল্লাহ তা’আলা শুধু কুরআনের জন্যও এ সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন, “আর আমরা সত্য-সহই কুরআন নাযিল করেছি এবং তা সত্য-সহই নাযিল হয়েছে। আমি তো আপনাকে শুধু সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে পাঠিয়েছি”। [সূরা আল-ইসরা: ১০৫]

: ৮০
وَحَاجَّهُ قَوْمُهُ ۚ قَالَ أَتُحَاجُّونِّي فِي اللَّهِ وَقَدْ هَدَانِ ۚ وَلَا أَخَافُ مَا تُشْرِكُونَ بِهِ إِلَّا أَنْ يَشَاءَ رَبِّي شَيْئًا ۗ وَسِعَ رَبِّي كُلَّ شَيْءٍ عِلْمًا ۗ أَفَلَا تَتَذَكَّرُونَ

আর তাঁর সম্প্রদায় তাঁর সাথে বিতর্কে লিপ্ত হল।তিনি বললেন, ‘তোমারা কি আল্লাহ্‌ সম্বদ্ধে আমার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হচ্ছো? অথছ তিনি আমাকে হিদায়েত দিয়েছেন। আমার রব অন্য কোন ইচ্ছে না করলে তোমারা যাকে তাঁর শরীক কর তাকে আমি ভয় করি না, আমার রব জ্ঞান দ্বারা সবকিছু পরিব্যাপ্ত করে আছেন, তবে কি তোমারা উপদেশ গ্রহণ করবে না?’
ফুটনোট

: ৮১
وَكَيْفَ أَخَافُ مَا أَشْرَكْتُمْ وَلَا تَخَافُونَ أَنَّكُمْ أَشْرَكْتُمْ بِاللَّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ عَلَيْكُمْ سُلْطَانًا ۚ فَأَيُّ الْفَرِيقَيْنِ أَحَقُّ بِالْأَمْنِ ۖ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ

‘আর তোমরা যাকে আল্লাহ্‌র শরীক কর আমি তাকে কিরূপে ভয় করব? অথচ তোমারা ভয় করছ না যে, তোমারা আল্লাহ্‌র সাথে শরীক করছ এমন কিছু,যার পক্ষে তিনি তোমাদের কাছে কোন প্রমাণ নাযিল করেন নি। কাজেই যদি তোমারা জান তবে বল, দু দলের মধ্যে কোন দল নিরাপত্তা লাভের বেশী হকদার।’
ফুটনোট

: ৯৭
وَهُوَ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ النُّجُومَ لِتَهْتَدُوا بِهَا فِي ظُلُمَاتِ الْبَرِّ وَالْبَحْرِ ۗ قَدْ فَصَّلْنَا الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ

আর তিনিই তোমাদের জন্য তারকামন্ডল সৃষ্টি করেছেন যেন তা দ্বারা তোমারা স্থলের ও সাগরের অন্ধকারে পথ খুঁজে পাও [১]। অবশ্যই আমারা জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য আয়াতসমূহ বিশদভাবে বিবৃত করেছি [২]।

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ সূর্য ও চন্দ্র ছাড়া অন্যান্য নক্ষত্রও আল্লাহ্ তা'আলার অপরিসীম শক্তির বহিঃপ্রকাশ। এগুলো সৃষ্টি করার পিছনে যে হাজারো রহস্য রয়েছে, তন্মধ্যে একটি এই যে, স্থল ও জলপথে ভ্রমণ করার সময় রাত্রির অন্ধকারে যখন দিক নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ে, তখন মানুষ এসব নক্ষত্রের সাহায্যে পথ ঠিক করে নিতে পারে। [মুয়াসসার] অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেয় যে, আজ বৈজ্ঞানিক কলকজার যুগেও মানুষ নক্ষত্রপুঞ্জের পথ প্রদর্শনের প্রতি অমুখাপেক্ষী নয়। এ আয়াতেও মানুষকে হুশিয়ার করা হয়েছে যে, এসব নক্ষত্রও কোন একজন নির্মাতা ও নিয়ন্ত্রকের নিয়ন্ত্রণাধীন বিচরণ করছে। এরা স্বীয় অস্তিত্ব, স্থায়িত্ব ও কর্মে স্বয়ং-সম্পূর্ণ নয়। যারা শুধু এদের প্রতিই দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বসে আছে এবং নির্মাতার প্রতি দৃষ্টিপাত করে না, তারা অত্যন্ত সংকীর্ণমনা এবং আত্মপ্রবঞ্চিত।

[২] অর্থাৎ আমি শক্তির প্রমাণাদি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করে দিয়েছি বিজ্ঞজনদের জন্য। এতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, যারা এসব সুস্পষ্ট নিদর্শন দেখেও আল্লাহকে চিনে না, তারা বেখবর ও অচেতন। কোন নিদর্শনই তাদের কাজে লাগে না। নবীদের বর্ণনাও তাদের কোন সন্দেহ দূর করতে পারে না। তাদের কাছে এসব বর্ণনা যত স্পষ্ট ও বিস্তারিতভাবেই আসুক না কেন, তারা এর দ্বারা উপকৃত হতে পারে না। [সাদী]

: ৯৯
وَهُوَ الَّذِي أَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجْنَا بِهِ نَبَاتَ كُلِّ شَيْءٍ فَأَخْرَجْنَا مِنْهُ خَضِرًا نُخْرِجُ مِنْهُ حَبًّا مُتَرَاكِبًا وَمِنَ النَّخْلِ مِنْ طَلْعِهَا قِنْوَانٌ دَانِيَةٌ وَجَنَّاتٍ مِنْ أَعْنَابٍ وَالزَّيْتُونَ وَالرُّمَّانَ مُشْتَبِهًا وَغَيْرَ مُتَشَابِهٍ ۗ انْظُرُوا إِلَىٰ ثَمَرِهِ إِذَا أَثْمَرَ وَيَنْعِهِ ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكُمْ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ

আর তিনিই আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন, তারপর তা দ্বারা আমারা সব রকমের উদ্ভিদের চারা উদগম করি; অতঃপর তা থেকে সবুজ পাতা উদ্গত করি। যা থেকে আমারা ঘন সন্নিবিষ্ট শস্যদানা উৎপাদন করি। আরও (নির্গত করি) খেজুর গাছের মথি থেকে ঝুলন্ত কাঁদি , আংগুরের বাগান , যায়তুন ও আনার। একটার সাথে অন্যটার মিল আছে, আবার নেইও। লক্ষ্য করুন, ওগুলো ফলবান হয় এবং সেগুলো পেকে উঠার পদ্ধতির প্রতি। নিশ্চয় মুমিন সম্প্রদায়ের জন্য এগুলোর মধ্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে [১]।

ফুটনোট

[১] উপরোক্ত ৯৫- ৯৯ আয়াতসমূহে প্রথমে অধঃজগতের বস্তুসমূহ সম্পর্কে বর্ণনা এসেছে। কারণ এগুলো আমাদের অধিক নিকটবর্তী। এরপর এগুলোর বর্ণনাকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে, এক. মাটি থেকে উৎপন্ন উদ্ভিদ, বৃক্ষ ও বাগানের বর্ণনা এবং দুই. মানব ও জীবজন্তুর বর্ণনা। এরপর শূন্য জগতের উল্লেখ করা হয়েছে; অর্থাৎ সকাল ও বিকাল। এরপর উর্ধ্ব জগতের সৃষ্ট বস্তু বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্ররাজি। অতঃপর অধঃজগতের বস্তুসমূহ অধিক প্রত্যক্ষ হওয়ার কারণে এগুলোর পূর্ণ বর্ণনা দ্বারা আলোচনা সমাপ্ত করা হয়েছে।

: ১০০
وَجَعَلُوا لِلَّهِ شُرَكَاءَ الْجِنَّ وَخَلَقَهُمْ ۖ وَخَرَقُوا لَهُ بَنِينَ وَبَنَاتٍ بِغَيْرِ عِلْمٍ ۚ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَىٰ عَمَّا يَصِفُونَ

আর তারা জিনকে আলাহর সাথে শরীক সাব্যস্ত করে, অথছ তিনিই এদেরকে সৃষ্টি করেছেন।আর তারা অজ্ঞতাবশত আল্লাহ্‌র প্রতি পুত্র –কন্যা আরোপ করে; তিনি পবিত্র –মহিমান্বিত! এবং তারা যা বলে তিনি তার উর্ধ্বে।
ফুটনোট

: ১০১
بَدِيعُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۖ أَنَّىٰ يَكُونُ لَهُ وَلَدٌ وَلَمْ تَكُنْ لَهُ صَاحِبَةٌ ۖ وَخَلَقَ كُلَّ شَيْءٍ ۖ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ

তিনি আসমান ও যমীনের স্রষ্টা ,তাঁর সন্তান হবে কিভাবে ? তাঁর তো কোন সঙ্গিনী নেই।আর তিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন এবং প্রত্যেক বস্তু সম্বদ্ধে তিনি সবিশেষ অবগত।

ফুটনোট

তেরতম রুকু’

: ১১৯
وَمَا لَكُمْ أَلَّا تَأْكُلُوا مِمَّا ذُكِرَ اسْمُ اللَّهِ عَلَيْهِ وَقَدْ فَصَّلَ لَكُمْ مَا حَرَّمَ عَلَيْكُمْ إِلَّا مَا اضْطُرِرْتُمْ إِلَيْهِ ۗ وَإِنَّ كَثِيرًا لَيُضِلُّونَ بِأَهْوَائِهِمْ بِغَيْرِ عِلْمٍ ۗ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِالْمُعْتَدِينَ

আর তোমাদের কি হয়েছে যে, যাতে আল্লাহর নাম নেয়া হয়েছে তোমরা তা থেকে খাবে না? যা তোমাদের জন্য তিনি হারাম করেছেন তা তিনি বিশদভাবেই তোমাদের কাছে বিবৃত করেছেন [১], তবে তোমরা নিরুপায় হলে তা স্বতন্ত্র [২]। আর নিশ্চিত অনেক অজ্ঞতাবশত নিজেদের খেয়াল –খুশী দ্বারা অন্যকে বিপদ্গামী করে ; নিশ্চয় আপানার রব সীমালঙ্ঘনকারীদের সম্বদ্ধে অধিক জানেন।

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ কোনটি হারাম আর কোনটি হালাল তার বিশদ বিবরণ আল্লাহ তা'আলা তাঁর বান্দাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, “তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত জন্তু, রক্ত, শূকরের গোস্ত , আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে যবেহ্ করা পশু, গলা চিপে মারা যাওয়া জন্তু, প্রহারে মারা যাওয়া জন্তু, উপর থেকে পড়ে মারা যাওয়া জন্তু , অন্য প্রাণীর শিং এর আঘাতে মারা যাওয়া জন্তু এবং হিংস্র পশুতে খাওয়া জন্তু ; তবে যা তোমরা যবেহ্ করতে পেরেছ তা ছাড়া, আর যা মূর্তি পূজার বেদীর উপর বলী দেয়া হয় তা এবং জুয়ার তীর দিয়ে ভাগ নির্ণয় করা, এসব পাপ কাজ। ...অতঃপর কেউ পাপের দিকে না ঝুঁকে ক্ষুধার তাড়নায় বাধ্য হলে তবে নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [সূরা আল-মায়িদাহ ৩] তবে সূরা আল মায়িদার এ আয়াতটি মদীনায় আবতীর্ণ হয়েছে। পক্ষান্তরে সূরা আল-আন’আমের এ আয়াতটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। সে জন্য কুরতুবী বলেন, এখানে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন বলে ‘বিস্তারিত বর্ণনা করবেন’ বুঝানো হয়েছে। [কুরতুবী] তাছাড়া এ সূরাতেই ১৪৫ নং আয়াতে হারাম বস্তুসমূহের কিছু বর্ণনা এসেছে। [আত-তাফসীরুস সহীহ]

[২] অর্থাৎ উপরোক্ত হারামকৃত বস্তুসমূহও তোমাদের অপারগ অবস্থায় খাওয়ার অনুমতি রয়েছে। যেমন কেউ ক্ষুধায় কাতর হয়ে হালাল বস্তু না পেলে নিরুপায় অবস্থায় তার জন্য মৃত বস্তুও খাওয়ার বিধান দেয়া হয়েছে। [ সাদী, আত-তাফসীরুস সহীহ]

: ১৪০
قَدْ خَسِرَ الَّذِينَ قَتَلُوا أَوْلَادَهُمْ سَفَهًا بِغَيْرِ عِلْمٍ وَحَرَّمُوا مَا رَزَقَهُمُ اللَّهُ افْتِرَاءً عَلَى اللَّهِ ۚ قَدْ ضَلُّوا وَمَا كَانُوا مُهْتَدِينَ

অবশ্যই তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যারা নির্বুদ্ধিতার জন্য ও অজ্ঞতাবশত নিজেদের সন্তানদেরকে হত্যা করেছে এবং আল্লাহ্‌র উপর মিথ্যা রটনা করে আল্লাহ্‌ প্রদও জীবিকাকে নিষিদ্ধ গণ্য করেছে।তারা অবশ্যই বিপথগামী হয়েছে এবং তারা হিদায়াতপ্রাপ্ত ছিল না [১]।

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ তারা তাদের পথভ্রষ্টতায় অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল, তাদের কোন কাজেই হিদায়াত নসীব হয় নি। [সা'দী] আর তাদের মধ্যে হিদায়াত পাবার যোগ্যতাও ছিল না। [ফাতহুল কাদীর]

: ১৪৩
ثَمَانِيَةَ أَزْوَاجٍ ۖ مِنَ الضَّأْنِ اثْنَيْنِ وَمِنَ الْمَعْزِ اثْنَيْنِ ۗ قُلْ آلذَّكَرَيْنِ حَرَّمَ أَمِ الْأُنْثَيَيْنِ أَمَّا اشْتَمَلَتْ عَلَيْهِ أَرْحَامُ الْأُنْثَيَيْنِ ۖ نَبِّئُونِي بِعِلْمٍ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ

নর ও মাদী আটটি জোড়া [১], মেষের দুটি ও ছাগলের দুটি; বলুন, ‘নর দুটিই কি তিনি নিষিদ্ধ করেছেন কিংবা মাদী দুটিই অথবা মাদী দুটির গর্ভে যা আছে তা ? তোমারা সত্যবাদী হলে প্রমাণসহ আমাকে অবহিত কর' [২];

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ পূর্বে বর্ণিত গবাদি পশুর মধ্যে উট গরু ও ছাগল মিলিয়ে আট প্রকার। সেগুলোকে তিনিই সৃষ্টি করেছেন। সেগুলোর কোনটিই আল্লাহ হারাম করেননি। [মুয়াসসার]


[২] অর্থাৎ উপরোক্ত আট প্রকার আবার দু‘ শ্রেণীতে বিভক্ত। তন্মধ্যে চারটি ছাগল জাতীয় বা ছোট আকারের। দুটি হচ্ছে নর ও মাদী মেষ। বাকী দু’টি হচ্ছে ছাগলের নর ও মাদী। বলুন হে রাসূল, আল্লাহ্ তা'আলা কি ছাগল জাতীয় পশুর দু'প্রকার নরকে হারাম করেছেন? যদি তারা বলে, হ্যা; তবে তারা মিথ্যা বলবে। কেননা তারা ছাগল ও মেষের প্রতিটি নরকে নিষিদ্ধ মনে করে না। আবার আপনি তাদেরকে আরো জিজ্ঞাসা করুন, আল্লাহ তা'আলা কি ছাগল জাতীয় পশুর দু'প্রকার মাদীকে হারাম করেছেন? যদি তারা হ্যা বলে, তবে তারা মিথ্যা বলবে। কেননা তারা ছাগল ও মেষের প্রত্যেক মাদীকে নিষিদ্ধ মনে করে না। তাদেরকে আরও জিজ্ঞাসা করুন, আল্লাহ্ তা'আলা কি মেষ ও ছাগলের মাদীর গর্ভে যা আছে তা হারাম করেছেন? যদি তারা হ্যা বলে, তবে তারা আবারও মিথ্যা বলবে, কেননা তারা গর্ভে অবস্থিত সকল ভ্রণকেই নিষিদ্ধ মনে করে না। অতএব আমাকে এমন এক জ্ঞান ও প্রমাণের সন্ধান দাও, যা দ্বারা তোমাদের মতের সত্যতা বুঝতে পারি, যদি তোমরা তোমাদের রবের ব্যাপারে যা বলো সে বিষয়ে সত্যবাদী হও। [ মুয়াসসার]

: ১৪৪
وَمِنَ الْإِبِلِ اثْنَيْنِ وَمِنَ الْبَقَرِ اثْنَيْنِ ۗ قُلْ آلذَّكَرَيْنِ حَرَّمَ أَمِ الْأُنْثَيَيْنِ أَمَّا اشْتَمَلَتْ عَلَيْهِ أَرْحَامُ الْأُنْثَيَيْنِ ۖ أَمْ كُنْتُمْ شُهَدَاءَ إِذْ وَصَّاكُمُ اللَّهُ بِهَٰذَا ۚ فَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَىٰ عَلَى اللَّهِ كَذِبًا لِيُضِلَّ النَّاسَ بِغَيْرِ عِلْمٍ ۗ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ

এবং উটের দুটি ও গরুর দুটি। বলুন, ‘নর দুটিই কি তিনি নিষিদ্ধ করেছেন কিংবা মাদী দুটিই অথবা মাদী দুটির গর্ভে যা আছে তা? নাকি আল্লাহ যখন তোমাদেরকে এসব নির্দেশ দান করেন তখন তোমরা উপস্থিত ছিলে?’ কাজেই যে ব্যক্তি না জেনে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য আল্লাহ্‌ সম্বন্ধে মিথ্যা রটনা করে তার চেয়ে বড় যালিম আর কে? নিশ্চয় আল্লাহ যালিম সপ্রদায়কে হিদায়াত করেন না।
ফুটনোট

: ১৪৮
سَيَقُولُ الَّذِينَ أَشْرَكُوا لَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا أَشْرَكْنَا وَلَا آبَاؤُنَا وَلَا حَرَّمْنَا مِنْ شَيْءٍ ۚ كَذَٰلِكَ كَذَّبَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ حَتَّىٰ ذَاقُوا بَأْسَنَا ۗ قُلْ هَلْ عِنْدَكُمْ مِنْ عِلْمٍ فَتُخْرِجُوهُ لَنَا ۖ إِنْ تَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ وَإِنْ أَنْتُمْ إِلَّا تَخْرُصُونَ

যারা শির্ক করেছে অচিরেই তারা বলবে , ‘আল্লাহ্‌ যদি ইচ্ছে করতেন তবে আমরা ও আমাদের পূর্বপুরুষগণ শির্ক করতাম না এবং কোন কিছুই হারাম করতাম না।’ এভাবে তাদের পূর্ববর্তীগণও মিথ্যারোপ করেছিল, অবশেষে তারা আমাদের শাস্তি ভোগ করেছিল। বলুন, ‘তোমাদের কাছে কি কোন জ্ঞান আছে, যা তোমরা আমাদের জন্য প্রকাশ করবে? তোমরা শুধু কল্পনারই অনুসরণ কর এবং শুধু মনগড়া কথা বল [১]।’

ফুটনোট

[১] মহান আল্লাহ এখানে এটাই বলছেন যে, এ এমন একটি খোঁড়া দলীল যা প্রতিটি মিথ্যাপ্রতিপন্নকারী উম্মত তাদের রাসূলদের সাথে ব্যবহার করেছে। এর মাধ্যমে তারা রাসূলদের দাওয়াতকে প্রতিরোধ করতে সচেষ্ট ছিল। কিন্তু এ জাতীয় দলীল-প্রমাণাদি ও যুক্তি-তর্কাদি তাদের কোন কাজে আসে নি। তারা এর মাধ্যমে সাময়িক বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা চালিয়েছে। শেষ পর্যন্ত তাদের উপর আল্লাহর কঠোর শাস্তি আপতিত হয়েছে, আর তারা ধ্বংস হয়েছে। যদি তাদের এসব যুক্তি-তর্ক সঠিক হত, তবে তা সে সমস্ত উম্মতের উপর আল্লাহর শাস্তি আসার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াত। আর যেহেতু তাদের উপর আযাব আপতিত হয়েছিল এবং এটাও জানা কথা যে, আল্লাহ তা'আলা শাস্তির অধিকারী না হলে কাউকে শাস্তি দেন না, এতেই স্পষ্ট হয়ে গেল যে, তাদের এ ধরনের যুক্তি-প্রমাণ অযৌক্তিক, বরং মিথ্যা সন্দেহ। কারণ: যদি তাদের যুক্তি সঠিক হত, তবে তাদের উপর শাস্তি আসত না।

যে কোন যুক্তি-প্রমাণ জ্ঞান ও দলীল নির্ভর হতে হয়, কিন্তু যদি সেটি হয় কেবল অনুমান ও ধারণা নির্ভর, তবে সেটা গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয় না। কেননা, ধারণা কখনো সত্য ও সঠিক পথের দিশা দেয় না। সুতরাং সেটি বাতিল হতে বাধ্য। আর এজন্যই আল্লাহ্ তা'আলা এ আয়াতে কাফেরদের দাবীর বিপরীতে বলছেন যে, ‘তোমাদের কাছে কি কোন জ্ঞান আছে, যা তোমরা আমাদের জন্য প্রকাশ করবে? যদি তাদের কাছে এ ব্যাপারে কোন জ্ঞান থাকত, তবে তাদের মত ভীষণ ঝগড়াটে লোক তা পেশ করা থেকে পিছপা হতো না। তারপরও যখন তারা জ্ঞান-ভিত্তিক দলীল প্রমাণ উপস্থাপনে ব্যর্থ হয়েছে, তখন এটাই প্রমাণ করছে যে, তাদের দাবীর সপক্ষে তাদের কাছে কোন প্রমাণ নেই। বরং তাদের অবস্থা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, “তোমরা শুধু কল্পনারই অনুসরণ কর এবং শুধু মনগড়া কথা বল"। আর যে তার প্রমাণাদি কল্পনা নির্ভর করেছে সে অবশ্যই ভুলের উপর আছে। তদুপরি যদি সে সীমালঙ্ঘন ও অনাচারের আশ্রয় নেয়, তাহলে সেটা যে কেমন অন্যায় তা বলাই বাহুল্য।

চুড়ান্ত প্রমাণাদির মালিক হচ্ছেন আল্লাহ তা'আলা। যার প্রমাণ পেশের পরে আর কারও কোন ওজর-আপত্তি থাকতে পারে না। যার প্রদত্ত প্রমাণের সত্যতার উপর সমস্ত নবী-রাসূল, আসমানী কিতাবসমূহ, নবীদের মতামত, সঠিক বিবেক, সরল-সোজা মনের টান, উত্তম চারিত্রিক গুণাবলীও সাক্ষ্য দিচ্ছে। সুতরাং এ সব অকাট্য প্রমাণের বিপরীতে কাফের ও মুশরিকদের যুক্তি অগ্রহণযোগ্য ও বাতিল। কারণ, হক্কের বিপরীতে বাতিল ছাড়া আর কিছু নেই।

তাছাড়া আল্লাহ্ তা'আলা প্রতিটি সৃষ্টিকেই কোন কিছু করার ও ইচ্ছা করার ক্ষমতা প্রদান করেছেন। যার মাধ্যমে সে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে সক্ষম হয়। আল্লাহ তা'আলা কারও অসাধ্য কোন কিছু তার উপর চাপিয়ে দেন নি। তাছাড়া এমন কিছুও হারাম করেন নি, যা ত্যাগ করা মানুষের জন্য অসম্ভব। সুতরাং এরপরও ভাগ্য ও পূর্ববর্তী ফয়সালার দোহাই দেয়া শুধু অন্যায়ই নয় বরং গোঁড়ামী।

অনুরূপভাবে আল্লাহ তা'আলা বান্দাকে তাদের কাজের জন্য জবরদস্তি করেননি। বরং আল্লাহ তা'আলা তাদের কর্মকাণ্ডকে তাদেরই পছন্দ অনুসারে নির্ধারণ করেছেন। যদি তারা চায় করবে, না চাইলে করবে না। এটা এমন এক বিষয় যার বাস্তবতা অস্বীকার করার জো নেই। যদি কেউ অস্বীকার করে তবে সে অবশ্যই উদ্ধত ও গোঁয়ার। সে যেন একটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুকে অস্বীকার করেছে। প্রতিটি মানুষই ইচ্ছাকৃত নড়াচড়া ও ইচ্ছাবহির্ভুত নড়াচড়ার মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। যদিও সবই আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছার অধীন।

যারা ভাগ্যের দোহাই দিয়ে অন্যায় কাজের পক্ষে দলীল পেশ করে, তারা স্ববিরোধিতায় লিপ্ত। তারা এ দোহাই সব জায়গায় মেনে নেয় না। যদি কেউ তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে কিংবা তাদের সম্পদ হরণ করে বা অনুরূপ কোন কাজ করে, এবং বলে যে, তোমার ভাগ্যে ছিল, তাহলে তারা সেটাকে গ্রহণ করে না। বরং তারা তাদের নিজেদের ঐ সমস্ত ব্যাপারে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে মোটেই পিছপা হয় না। সুতরাং তাদের জন্য আশ্চর্য না হয়ে পারা যায় না, তারা অন্যায় ও অপরাধের সময় শুধু ভাগ্যের দোহাই দেয়, অন্য সময় নয়।

তাদের ভাগ্যের দোহাই দেয়া উদ্দেশ্য নয়, তারা জানে যে এটি কোন প্রমাণও নয়। বরং এর দ্বারা তাদের উদ্দেশ্য হলো, হকের বিরোধিতা করা। তারা হক কথা ও কাজকে আক্রমনকারী মনে করে তা দূর করার জন্য মনে যা আসে তাই বলে, যদিও তারা নিশ্চিত যে তা ভুল। [সা'দী]

:
فَلَنَقُصَّنَّ عَلَيْهِمْ بِعِلْمٍ ۖ وَمَا كُنَّا غَائِبِينَ

অতঃপর অবশ্যই আমরা তাদের কাছে পূর্ণ জ্ঞানের সাথে তাদের কাজগুলো বিবৃত করব, আর আমারা তো অনুপস্থিত ছিলাম না [১]।

ফুটনোট

[১] আল্লাহ তা'আলা এ আয়াতে বলছেন যে, তিনি তার বান্দারা ছোট, বড়, গুরুত্বপূর্ণ, গুরুত্বহীন যা করত বা বলত সবকিছু সম্পর্কে কিয়ামতের মাঠে বিস্তারিত জানাবেন। কারণ, তিনি সবকিছু দেখছেন, কোন কিছুই তাঁর অগোচরে নেই, কোন কিছু সম্পর্কেই তিনি বেখবর নন। বরং তিনি চোখের খিয়ানত ও অন্তরের গোপন ভেদ সম্পর্কেও অবগত। আল্লাহ বলেন, “তার অজানায় একটি পাতাও পড়ে না। মাটির অন্ধকারে এমন কোন শস্যকণাও অংকুরিত হয় না বা রসযুক্ত কিংবা শুষ্ক এমন কোন বস্তু নেই যা সুস্পষ্ট কিতাবে নেই " [সূরা আল-আন’আম: ৫৯] [ইবন কাসীর] সুতরাং আল্লাহ হাশরের মাঠে তাদেরকে যা জানাবেন তা জ্ঞানের ভিত্তিতেই জানাবেন। দুনিয়াতে যা কিছুই ঘটেছে সবই তার জ্ঞানের মধ্যে রয়েছে। সবকিছু তিনি জানার পরও তাঁর ফেরেশতাদের দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছেন। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, “আপনি কি লক্ষ্য করেন না যে, আসমানসমূহ ও যমীনে যা কিছু আছে আল্লাহ তা জানেন? তিন ব্যক্তির মধ্যে এমন কোন গোপন পরামর্শ হয় না যাতে চতুর্থ জন হিসেবে তিনি উপস্থিত থাকেন না এবং পাঁচ ব্যক্তির মধ্যেও হয় না যাতে ষষ্ট জন হিসেবে তিনি উপস্থিত থাকেন না। তারা এর চেয়ে কম হোক বা বেশী হোক তিনি তো তাদের সংগেই আছেন তারা যেখানেই থাকুক না কেন। তারপর তারা যা করে, তিনি তাদেরকে কিয়ামতের দিন তা জানিয়ে দেবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব কিছু সম্পর্কে সম্যক অবগত।" [সূরা আল-মুজাদালাহ:৭] অন্যত্র বলেন, “তিনি জানেন যা যমীনে প্রবেশ করে এবং যা তা থেকে নির্গত হয় আর যা আসমান থেকে নাযিল হয় এবং যা কিছু তাতে উত্থিত হয়” [সূরা সাবা: ২] আরও বলেন, “তিনি জানেন যা কিছু যমীনে প্রবেশ করে ও যা কিছু তা থেকে বের হয় এবং আসমান হতে যা কিছু নামে ও আসমানে যা কিছু উখিত হয়। তোমরা যেখানেই থাক না কেন---তিনি (জ্ঞানে) তোমাদের সংগে আছেন" [সূরা আল-হাদীদ: ৪] আরও বলেন, “আর আপনি যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন এবং আপনি সে সম্পর্কে কুরআন থেকে যা-ই তিলাওয়াত করেন এবং তোমরা যে কাজই কর না কেন, আমরা তোমাদের সাক্ষী থাকি- যখন তোমরা তাতে প্রবৃত্ত হও। আর আসমানসমূহ ও যমীনের অণু পরিমাণও আপনার রবের দৃষ্টির বাইরে নয় এবং তার চেয়ে ক্ষুদ্রতর বা বৃহত্তর কিছুই নেই যা সুস্পষ্ট কিতাবে নেই” [সূরা ইউনুস: ৬১] [আদওয়াউল বায়ান]

: ৫২
وَلَقَدْ جِئْنَاهُمْ بِكِتَابٍ فَصَّلْنَاهُ عَلَىٰ عِلْمٍ هُدًى وَرَحْمَةً لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ

আর অবশ্যই আমারা তাদের নিকট নিয়ে এসেছি এমন এক কিতাব, যা আমরা জ্ঞানের ভিত্তিতে বিশদ ব্যাখ্যা করেছি [২]। আর যা মুমিন সম্প্রদায়ের জন্য হিদায়াত ও রহমতস্বরূপ।

ফুটনোট

[১] আল্লাহ্ তা'আলা এখানে কাফের-মুশরিকদের ওজর আপত্তি তোলার সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনি তাদের কাছে রাসূল পাঠিয়েছেন। তাদের জন্য রাসূলের মাধ্যমে কিতাব দিয়েছেন, যে কিতাবে সবকিছু স্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন। অন্যান্য আয়াতেও এ বিস্তারিত আলোচনার কথা আল্লাহ বর্ণনা করেছেন। [ইবন কাসীর]

: ৮৯
قَدِ افْتَرَيْنَا عَلَى اللَّهِ كَذِبًا إِنْ عُدْنَا فِي مِلَّتِكُمْ بَعْدَ إِذْ نَجَّانَا اللَّهُ مِنْهَا ۚ وَمَا يَكُونُ لَنَا أَنْ نَعُودَ فِيهَا إِلَّا أَنْ يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّنَا ۚ وَسِعَ رَبُّنَا كُلَّ شَيْءٍ عِلْمًا ۚ عَلَى اللَّهِ تَوَكَّلْنَا ۚ رَبَّنَا افْتَحْ بَيْنَنَا وَبَيْنَ قَوْمِنَا بِالْحَقِّ وَأَنْتَ خَيْرُ الْفَاتِحِينَ

‘তোমাদের ধর্মাদর্শ থেকে আল্লাহ আমাদেরকে উদ্ধার করার পর যদি আমরা তাতে ফিরে যাই তবে তো আমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করব। আর আমাদের রব আল্লাহ ইচ্ছে না করলে তাতে ফিরে যাওয়া আমাদের জন্য সমীচীন নয়। সবকিছুই আমাদের রবের জ্ঞানের সীমায় রয়েছে , আমারা আল্লাহ্‌র উপরই নির্ভর করি। হে আমাদের রব! আমাদের ও আমাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে ন্যায্যভাবে ফয়সালা করে দিন এবং আপনিই শ্রেষ্ঠ ফয়সালাকারী।’
ফুটনোট

: ১৮৭
يَسْأَلُونَكَ عَنِ السَّاعَةِ أَيَّانَ مُرْسَاهَا ۖ قُلْ إِنَّمَا عِلْمُهَا عِنْدَ رَبِّي ۖ لَا يُجَلِّيهَا لِوَقْتِهَا إِلَّا هُوَ ۚ ثَقُلَتْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۚ لَا تَأْتِيكُمْ إِلَّا بَغْتَةً ۗ يَسْأَلُونَكَ كَأَنَّكَ حَفِيٌّ عَنْهَا ۖ قُلْ إِنَّمَا عِلْمُهَا عِنْدَ اللَّهِ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ

তারা আপনাকে কিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে (বলে) ‘তা কখন ঘটবে? [১] বলুন, ‘এ বিষয়ের জ্ঞান শুধু আমার রবেরই নিকট। শুধু তিনিই যথাসময়ে সেটার প্রকাশ ঘটাবেন; আসমানসমূহ ও যমীনে সেটা ভারী বিষয় [২]। হঠাৎ করেই তা তোমাদের উপর আসবে [৩]।’ আপনি এ বিষয়ে সবিশেষ জ্ঞানী মনে করে তারা আপনাকে প্রশ্ন করে। বলুন, ‘এ বিষয়ে জ্ঞান শুধু আল্লাহ্‌রই নিকট, কিন্তু অধিকাংশ লোক জানে না [৪]।

ফুটনোট

[১] এ আয়াতগুলো নাযিলের পেছনে বিশেষ একটি ঘটনা কার্যকর ছিল। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, জাবাল ইবন আবি কুশাইর ও শামওয়াল ইবন যায়দ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসাল্লামের নিকট ঠাট্টা ও বিদ্রুপচ্ছলে জিজ্ঞাসা করল যে, আপনি কেয়ামত আগমনের সংবাদ দিয়ে মানুষকে এ ব্যাপারে ভীতি প্রদর্শন করে থাকেন- এ ব্যাপারে যদি আপনি সত্য নবী হয়ে থাকেন, তবে নির্দিষ্ট করে বলুন, কেয়ামত কোন সালের কত তারিখে অনুষ্ঠিত হবে। এ ব্যাপারে তো আমরাও জানি। এ ঘটনার ভিত্তিতেই আয়াতটি নাযিল হয়। [তাবারী]

[২] এর কয়েকটি অর্থ হতে পারে, এক. কিয়ামতের জ্ঞান অত্যন্ত ভারী বিষয়, আসমান ও যমীনের অধিবাসীদের থেকে তা গোপন রাখা হয়েছে। সুতরাং কোন নবী-রাসূল বা ফেরেশতাকেও আল্লাহ সে জ্ঞান দেননি। আর যে কোন জ্ঞান গোপন রাখা হয় তা অন্তরের উপর ভারী হয়ে থাকে। দুই. কিয়ামত এত ভারী সংবাদ যে আসমান ও যমীন সেটাকে সহ্য করতে পারে না। কারণ, আসমানসমূহ ফেটে যাবে, তারকাসমূহ বিক্ষিপ্ত হয়ে যাবে। আর সাগরসমূহ শুকিয়ে যাবে। তিন. কিয়ামতের গুণাগুণ বর্ণনা আসমান ও যমীনের অধিবাসীদের উপর কঠিন। চার. কিয়ামত সম্পর্কে প্রশ্ন করা তাদের জন্য এক ভারী বিষয়। [ফাতহুল কাদীর]

[৩] এ আয়াতে উল্লেখিত (الساعة) শব্দটি আরবী ভাষায় সামান্য সময় বা মুহুর্তকে বলা হয়। আভিধানিকভাবে যার কোন বিশেষ পরিসীমা নেই। আর গাণিতিকদের পরিভাষায় রাত ও দিনের চব্বিশ অংশের এক অংশকে বলা হয় “সা'আহ”, যাকে বাংলায় ঘন্টা নামে অভিহিত করা হয়। কুরআনের পরিভাষায় এ শব্দটি সে দিবসকে বুঝাবার জন্য ব্যবহৃত হয়, যা হবে সমগ্র সৃষ্টির মৃত্যুদিবস এবং সেদিনকেও বলা হয় যাতে সমগ্র সৃষ্টি পুনরায় জীবিত হয়ে আল্লাহ রাববুল আলামীনের দরবারে উপস্থিত হবে। (ايان) (আইয়্যানা) অর্থ কবে। আর (مرسى) (মুরসা) অর্থ অনুষ্ঠিত কিংবা স্থাপিত হওয়া। (يُجَلِّيْهَا) শব্দটি (تجلية) থেকে গঠিত। এর অর্থ প্রকাশিত এবং খোলা। (بغتة) (বাগতাতান) অর্থ অকস্মাৎ। (حفي) (হাফিয়ূন) অর্থ আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেছেন, জ্ঞানী ও অবহিত ব্যক্তি। প্রকৃতপক্ষে এমন লোককে ‘হাফী’ বলা হয়, যে প্রশ্ন করে বিষয়ের পরিপূর্ণ তথ্য অনুসন্ধান করে নিতে পারে। [তাবার] কাজেই আয়াতের মর্ম দাঁড়াল এই যে, এরা আপনার নিকট কেয়ামত সম্পর্কে প্রশ্ন করে যে, তা কবে আসবে? আপনি তাদেরকে বলে দিন, এর নির্দিষ্টতার জ্ঞান শুধুমাত্র আমার পালনকর্তারই রয়েছে। এ ব্যাপারে পূর্ব থেকে কারো জানা নেই এবং সঠিক সময়ও কেউ জানতে পারবে না। নির্ধারিত সময়টি যখন উপস্থিত হয়ে যাবে, ঠিক তখনই আল্লাহ্ তা'আলা তা প্রকাশ করে দেবেন। এতে কোন মাধ্যম থাকবে না। কেয়ামতের ঘটনাটি আসমান ও যমীনের জন্যও একান্ত ভয়ানক ঘটনা হবে। সেগুলোও টুকরো টুকরো হয়ে উড়তে থাকবে। সুতরাং এহেন ভয়াবহ ঘটনা সম্পর্কে পূর্ব থেকে প্রকাশ না করাই বিচক্ষণতার দাবী ৷ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেয়ামতের আকস্মিক আগমন সম্পর্কে বলেছেন, মানুষ নিজ নিজ কাজে পরিব্যস্ত থাকবে। এক লোক খরিদদারকে দেখাবার উদ্দেশ্যে কাপড়ের থান খুলে সামনে ধরে থাকবে, সে (সওদাগর) এ বিষয়টিও সাব্যস্ত করতে পারবে না, এরই মধ্যে কেয়ামত এসে যাবে। এক লোক তার উটনীর দুধ দুইয়ে নিয়ে যেতে থাকবে এবং তখনো তা ব্যবহার করতে পারবে না, এরই মধ্যে কেয়ামত সংঘটিত হয়ে যাবে। কেউ নিজের হাউজ মেরামত করতে থাকবে- তা থেকে অবসর হওয়ার পূর্বেই কেয়ামত সংঘটিত হয়ে যাবে। কেউ হয়ত খাবারের লোকমা হাতে তুলে নেবে, তা মুখে দেবার পূর্বেই কেয়ামত হয়ে যাবে। [বুখারীঃ ৬৫০৬, মুসলিমঃ ২৯৫৪] সুতরাং যেভাবে মানুষের ব্যক্তিগত মৃত্যুর তারিখ ও সময়-ক্ষণ অনির্দিষ্ট ও গোপন রাখার মাঝে বিরাট তাৎপর্য নিহিত রয়েছে, তেমনিভাবে কেয়ামতকেও-যা সমগ্র বিশ্বের সামগ্রিক মৃত্যুরই নামান্তর-তাকে গোপন এবং অনির্দিষ্ট রাখার মধ্যেও বিপুল রহস্য ও তাৎপর্য বিদ্যমান।

[৪] বলা হয়েছে, আপনি লোকদিগকে বলে দিন যে, প্রকৃতপক্ষে কেয়ামতের সঠিক তারিখ সম্পর্কিত জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ ছাড়া তাঁর কোন ফিরিশতা কিংবা নবী-রাসূলগণেরও জানা নেই। তবে হ্যা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসাল্লামকে কেয়ামতের কিছু নিদর্শন ও লক্ষণাদি সম্পর্কিত জ্ঞান দান করা হয়েছে। আর তা হল এই যে, এখন তা নিকটবর্তী। এ বিষয়টি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসাল্লাম বহু বিশুদ্ধ হাদীসে অত্যন্ত পরিস্কারভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেনঃ “আমার আবির্ভাব এবং কেয়ামত এমনভাবে মিশে আছে, যেমন মিশে থাকে হাতের দু'টি আঙ্গুল।” [ বুখারীঃ ৬৫০৩-৬৫০৫, মুসলিমঃ ২৯৫০]

: ১৮৮
قُلْ لَا أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ ۚ وَلَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ ۚ إِنْ أَنَا إِلَّا نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ

বলুন, ‘আল্লাহ যা ইচ্ছে করেন তা ছাড়া আমার নিজের ভালো মন্দের উপরও আমার কোন অধিকার নেই। আমি যদি গায়েবের খবর জানতাম তবে তো আমি অনেক কল্যাণই লাভ করতাম এবং কোন অকল্যাণই আমাকে স্পর্শ করত না। ঈমানদার সম্প্রদায়ের জন্য সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা ছাড়া আমি তো আর কিছুই নই [১]।’

ফুটনোট

[১] এ আয়াতে মুশরিক ও সাধারণ মানুষের সেই ভ্রান্ত আকীদার খণ্ডন করা হয়েছে; যা তারা নবী-রাসূলগণের ব্যাপারে পোষণ করত যে, তারা গায়েবী বিষয়েও অবগত রয়েছেন। তাদের এই শির্কী আকীদার খণ্ডন উপলক্ষে বলা হয়েছে যে, ইলমে-গায়েব এবং সমগ্র বিশ্বের প্রতিটি অণু-পরমাণুর ব্যাপক ইলম শুধুমাত্র আল্লাহ্ তা'আলারই রয়েছে। এটা তাঁরই বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এতে কোন সৃষ্টিকে অংশীদার সাব্যস্ত করা, তা ফিরিশতাই হোক আর নবী ও রাসূলগণই হোক, শির্ক এবং মহাপাপ। তেমনিভাবে প্রত্যেক লাভ-ক্ষতি কিংবা মঙ্গল-অমঙ্গলের মালিক হওয়াও এককভাবে আল্লাহ তা'আলারই গুণ। এতে কাউকে অংশীদার দাঁড় করানোও শির্ক। বস্তুতঃ এই শির্ক বা আল্লাহ রাববুল আলামীনের সাথে কোন অংশীদারিত্বের আকীদাকে খণ্ডন করার জন্যই কুরআন নাযিল হয়েছে এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাব ঘটেছে। তাই এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসাল্লামকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, আপনি ঘোষণা করে দিন যে, আমি আলেমুল-গায়েব নই যে, যাবতীয় পূর্ণ জ্ঞান আমার থাকা অনিবার্য হবে। তাছাড়া আমার যদি গায়বী জ্ঞান থাকতই, তবে আমি প্রত্যেকটি লাভজনক বস্তুই হাসিল করে নিতাম, কোন একটি লাভও আমার হাতছাড়া হতে পারত না। আর প্রতিটি ক্ষতিকর বিষয় থেকে সর্বদা রক্ষিত থাকতাম। কখনো কোন ক্ষতি আমার ধারে-কাছে পর্যন্ত পৌঁছাতে পারত না। অথচ এতদুভয় বিষয়ের কোনটিই বাস্তব নয়। বহু বিষয় রয়েছে, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়ত্ত করতে চেয়েছেন, কিন্তু তা করতে পারেননি। তাছাড়া বহু দুঃখ-কষ্ট রয়েছে যা থেকে আত্মরক্ষার জন্য তিনি ইচ্ছা করেছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাতে পতিত হতে হয়েছে। হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহরাম বেঁধে সাহাবায়ে কেরামের সাথে উমরা করার উদ্দেশ্যে হারাম শরীফের সীমানা পর্যন্ত এগিয়ে যান, কিন্তু হারাম শরীফে প্রবেশ কিংবা উমরা করা তখনো সম্ভব হতে পারেনি; সবাইকে ইহরাম খুলে ফিরে আসতে হয়েছে। তেমনিভাবে ওহুদ যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আহত হন এবং মুসলিমদেরকে সাময়িক পরাজয় বরণ করতে হয়। এমনি আরো বহু অতি প্রসিদ্ধ ঘটনা রয়েছে যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনে সংঘটিত হয়েছে। এ সবগুলো থেকেই প্রমাণিত হচ্ছে যে, তিনি গায়েবের জ্ঞান রাখেন না। শুধু ততটুকুই জানেন, যতটুকু আল্লাহ তাদের জানিয়েছেন। আর আল্লাহ তাদেরকে জানিয়ে দেয়ার পর সেটা জানাকে আর গায়েবের জ্ঞান বলা যাবে না।

: ১১
فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَإِخْوَانُكُمْ فِي الدِّينِ ۗ وَنُفَصِّلُ الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ

অতএব তারা যদি তাওবাহ্ করে, সালাত কায়েম করে ও যাকাত দেয় তবে দ্বীনের মধ্যে তারা তোমাদের ভাই [১]; আর আমরা আয়াতসমূহ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করি এমন সম্প্রদায়ের জন্য যারা জানে [২]।

ফুটনোট

[১] মুশরিকদের উপরোক্ত ঘৃণ্য চরিত্রের প্রেক্ষিতে মুসলিমদের জন্যে তাদের সাথে চিরতরে সম্পর্কচ্ছেদ করে নেয়াই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু না কুরআন যে আদর্শ ও ন্যায় নীতিকে প্রতিষ্ঠা করতে চায় তার আলোকে মুসলিমদের হেদায়াত দেয়ঃ “তবে, তারা যদি তাওবাহ করে, নামায কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে, তবে তারা তোমাদের দ্বীনি ভাই"। এখানে বলা হয় যে, কাফেররা যত শক্রতা করুক, যত নিপীড়ন চালাক, যখন সে মুসলিম হয়, তখন আল্লাহ যেমন তাদের কৃত অপরাধগুলো ক্ষমা করেন, তেমনি সকল তিক্ততা ভুলে তাদের ভ্রাতৃ-বন্ধনে আবদ্ধ করা এবং ভ্রাতৃত্বের সকল দাবী পূরণ করা মুসলিমদের কর্তব্য। এ শর্ত পূরণ করার ফলে তাদের উপর হাত তোলা ও তাদের জান-মাল নষ্ট করাই শুধু তোমাদের জন্য হারাম হয়ে যাবে না, বরং তার অধিক ফায়েদা এই হবে যে, তারা অন্যান্য মুসলিমদের সমান হতে পারবে। কোনরূপ বৈষম্য ও পার্থক্য থাকবে না। এ আয়াত প্রমাণ করে যে, ইসলামী ভ্রাতৃত্বের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার তিনটি শর্ত রয়েছে। প্রথম, কুফর ও শির্ক থেকে তাওবাহ। দ্বিতীয় সালাত কায়েম করা, তৃতীয় যাকাত আদায় করা। আইসারুত তাফসীর কারণ, ঈমান ও তাওবাহ হল গোপন বিষয় এর যথার্থতা সাধারণ মুসলিমের জানার কথা নয়। তাই ঈমান ও তাওবাহর দুই প্রকাশ্য আলামতের উল্লেখ করা হয়, আর তা হল, সালাত ও যাকাত। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ এ আয়াত সকল কেবলানুসারী মুসলিমের রক্তকে হারাম করে দিয়েছে। [তাবারী; ফাতহুল কাদীর] অথাৎ যারা নিয়মিত সালাত কায়েম ও যাকাত আদায় করে এবং ইসলামের বরখেলাফ কথা ও কর্মের প্রমাণ পাওয়া যায় না, সর্বক্ষেত্রে তারা মুসলিমরূপে গণ্য, তাদের অন্তরে সঠিক ঈমান বা মুনাফিকী যাই থাক না কেন। আবু বকর সিদীক রাদিয়াল্লাহু আনহু যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে এ আয়াত থেকে অস্ত্ৰধারনের যৌক্তিকতা প্রমাণ করে সাহাবায়ে কেরামের সন্দেহ নিরসন করেছিলেন। [তাবারী]

[২] এখানে জ্ঞান সম্পন্ন লোক বলতে তাদের বুঝানো হয়েছে, যারা আল্লাহ্‌র নাফরমানী করার পরিণাম জানে ও বুঝে এবং তার ভয়ও তাদের মনে জাগরুক রয়েছে। তাদের জন্যই আগের কথাগুলো বলা হলো, তাদের মাধ্যমেই আয়াত ও আহকাম জানা যাবে, আর তাদের মাধ্যমেই দ্বীন ইসলাম ও শরীআত জানা যাবে। হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে তাদের মধ্যে গণ্য করুন যারা জানে ও সে অনুসারে আমল করে [সা’দী]

: ১২২
وَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنْفِرُوا كَافَّةً ۚ فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ

আর মুমিনদের সকলের একসাথে অভিযানে বের হওয়া সংগত ন্য। অতঃপর তাদের প্রত্যেক দলের এক অংশ কেন বের হয় না, যাতে তারা দ্বীনের গভীর জ্ঞান অর্জন [১] করতে পারে [২] এবং তাদের সম্প্রদায়কে ভিতিপ্রদর্শন করতে পারে, যখন তারা তাদের কাছে ফিরে আসবে [৩], যাতে তারা সতর্ক হয়।

ফুটনোট

[১] বলা হয়েছে (لِّیَتَفَقَّهُوۡا فِی الدِّیۡنِ) “যাতে দ্বীনের মধ্যে বিজ্ঞতা অর্জন করে"। উদ্দেশ্যে হলো দ্বীনকে অনুধাবন করা কিংবা তাতে বিজ্ঞতা অর্জন করা। (تفقه) শব্দের অর্থও তাই। এটি (فقه) থেকে উদ্ভুত। (فقه) অর্থ বুঝা, অনুধাবন করা, সুক্ষ্মভাবে বুঝা।

[২] এ আয়াতটি দ্বীনের এলম হাসিলের মৌলিক দলীল। কুরতুবী। তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীসে এ ব্যাপারে আরও কিছু ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। যেমন, এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি এলেম হাসিল করার উদ্দেশ্যে কোন পথ দিয়ে চলে, আল্লাহ এই চলার সওয়াব হিসাবে তাঁর রাস্তাকে জান্নাতমুখী করে দেবেন। আল্লাহর ফেরেশতাগণ দ্বীনী জ্ঞান আহরণকারীর জন্য নিজেদের পালক বিছিয়ে রাখেন। আলেমের জন্য আসমান-যমীনের সমস্ত সৃষ্টি এবং পানির মৎস্যকুল দো'আ ও মাগফেরাত কামনা করে। অধিকহারে নফল এবাতদকারী লোকের উপর আলেমের ফযীলত অপরাপর তারকারাজির উপর পূর্ণিমা চাঁদের অনুরূপ। আলেমসমাজ নবীগণের ওয়ারিশ। নবীগণ স্বর্ণ, রূপার মীরাস রেখে যান না। তবে এলমের মীরাস রেখে যান। তাই যে ব্যক্তি এলমের মীরাস পায়, সে যেন মহা-সম্পদ লাভ করল। [তিরমিযী: ২৬৮২] অপর হাদীসে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মানুষের মৃত্যু হলে তার সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু তিনটি আমলের সওয়াব মৃত্যুর পরেও অব্যাহত থাকে। সদকায়ে জারিয়া (যেমন, মসজিদ, মাদ্রাসা ও জনকল্যানমূলক প্রতিষ্ঠান)। এমন ইলম যার দ্বারা লোকেরা উপকৃত হয়। (যেমন, শাগরিদ রেখে গিয়ে এলমে দ্বীনের চর্চা অব্যাহত রাখা বা কোন কিতাব লিখে যাওয়া ) নেককার সন্তান-যে তার পিতার জন্য দোআ করে [মুসলিম: ১৬৩১] অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “প্রত্যেক মুসলিমের উপর ইলম শিক্ষা করা ফরয। [ইবন মাজাহ ২২৪; ইবন আবদিল বার, জামেউ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাদলিহি ২৫, ২৬] বলাবাহুল্য, এ হাদীস ও উপরোক্ত অপরাপর হাদীসে উল্লেখিত ইলম’ শব্দের অর্থ দ্বীনের ইলম। তবে অন্যান্য বিষয়ের মত দুনিয়াবী জ্ঞান-বিজ্ঞানও মানুষের জন্য জরুরী। কিন্তু হাদীসসমূহে সে সবের ফযীলত বর্ণিত হয়নি। কারণ, দ্বীনী জ্ঞান অর্জন দু’ভাগে বিভক্ত। ফরযে আইন ও ফরযে কিফায়া। ফরযে আইনঃ শরীআত মানুষের উপর যেসব কাজ ফরয বা ওয়াজিব করে দিয়েছে, সেগুলোর হুকুম আহকাম ও মাসআল মাসায়েল সম্পর্কে জ্ঞান হাসিল করা প্রত্যেক নর-নারীর জন্য ফরয। যেমন, ইসলামের বিশুদ্ধ আকীদাহসমূহের জ্ঞান, পবিত্রতা ও অপবিত্রতার হুকুম-আহকাম, সালাত, সাওম, যাকাত ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান। ফরযে কেফায়াঃ যেমন, অধিকার আদায় করা, হুদুদ প্রতিষ্ঠা করা, মানুষের মধ্যে বিবাদ নিরসন ইত্যাদি। কেননা, সবার পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। প্রত্যেকে এটা করতে গেলে নিজেদের অবস্থাও খারাপ হবে, অন্যদেরও নিজেদের জীবন-জীবিকা অসম্পূর্ণ হবে বা বাতিল হবে। তাই কাউকে না কাউকে সুনির্দিষ্ট করে এর জন্য থাকতে হবে। আল্লাহ যাকে এর জন্য সহজ করে দেন সে এটা করতে পারে। তিনি প্রতিটি মানুষকে পূর্বেই এমন কিছু যোগ্যতা দিয়েছেন যা অন্যদের দেননি। সে হিসেবে প্রত্যেকে তার জন্য যা সহজ হয় তা-ই বহন করবে। [কুরতুবী; বাগভী]

[৩] ইবনে কাসীর বলেন, যখন আল্লাহ্ তা'আলার পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সবাইকে যুদ্ধে বের হওয়ার নির্দেশ দেয়া হলো, বলা হলো যে, “তোমরা হাল্কা ও ভারী সর্বাবস্থায় বেরিয়ে পড়" [সূরা আত-তাওবাহঃ ৪১] এবং বলা হলো, “মদীনাবাসী ও তাদের পার্শ্ববতী মরুবাসীদের জন্য সংগত নয় যে, তারা আল্লাহর রাসূলের সহগামী না হয়ে পিছনে রয়ে যাবে এবং তার জীবনের চেয়ে নিজেদের জীবনকে প্রিয় মনে করবে” [সূরা আত-তাওবাহঃ ১২০] তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন যুদ্ধে বেরিয়ে পড়লে সবার উপরই বের হওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। তারপর এ আয়াত নাযিল করে সে নির্দেশের ব্যাপকতা রহিত করা হয়। তবে রহিত না বলে এটাও বলা যেতে পারে যে, আগের যে সমস্ত আয়াতে যুদ্ধে বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল এ আয়াতে সে নির্দেশের বর্ণনা দেয়া হয়েছে যে, এর দ্বারা প্রতিটি গোত্রের সবাই বের হবার অর্থ, প্রতি গোত্র থেকে সবার বের না হতে পারলে তাদের মধ্য থেকে কিছু লোক বের হবে, যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে থেকে তার উপর যে সমস্ত ওহী নাযিল হয় সেটা গভীরভাবে জানবে, অনুধাবন করবে, তারপর তারা যখন তাদের গোত্রের কাছে ফিরে যাবে তখন তাদেরকে শক্ৰদের অবস্থা ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবহিত করবে। এভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সুনির্দিষ্টভাবে যুদ্ধে বের হওয়া দ্বারা তাদের দুটি কাজই পূর্ণ হবে। (রাসূলের কাছে অবস্থান করে ওহীর জ্ঞান অর্জন ও সেখান থেকে এসে নিজের জাতিকে শক্রদের অবস্থা সম্পর্কে জানানো।) তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর পরে যারাই গোত্র থেকে এভাবে যুদ্ধে বের হবে, তারা দু’টি সুবিধা পাবে না। তারা হয় ওহীর জ্ঞান অর্জনের জন্য, না হয় জিহাদের জন্য বের হবে। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর পর এভাবে যুদ্ধের জন্য বের হওয়া ফরযে কিফায়া। ইবন কাসীর ইবন আব্বাস বলেন, আয়াতের অর্থ, মুমিনদের উচিত নয় যে, তারা সবাই যুদ্ধের জন্য বের হয়ে যাবে, আর রাসূলকে একা রেখে যাবে। যাতে করে তাদের মধ্যে যারা রাসূলের নির্দেশ ও অনুমতি নিয়ে বের হবে, তারা যখন ফিরে আসবে, তখন এ সময়ে রাসূলের কাছে যারা অবশিষ্ট ছিল তারা কুরআনের যা নাযিল হয়েছে তা যারা যুদ্ধে গেছে তাদেরকে জানাবে। তারা বলবে যে, তোমাদের যুদ্ধে যাওয়ার পরে আল্লাহ তোমাদের নবীর উপর কুরআনের যা নাযিল করেছেন তা আমরা শিখেছি। এভাবে যারা বের হয়েছিল তারা অবস্থান করে তাদের যাওয়ার পরে যা নাযিল হয়েছে তা শিখে নেবে। আর অন্য দল তখন যুদ্ধের জন্য বের হবে। আর এটাই হচ্ছে “যাতে তারা দ্বীনের গভীর জ্ঞান অর্জন করতে পারে” এর অর্থ। অর্থাৎ যাতে করে নবীর কাছে যা নাযিল হয়েছে অবস্থান কারীরা তা জেনে নেয় এবং যারা অভিযানে গেছে তারা ফেরৎ আসলে সেটা অবস্থানকারীদের কাছ থেকে জেনে নিতে পারে। এভাবে তারা সাবধান হতে পারে। [ইবন কাসীর]

ইবনে আব্বাস থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, এ আয়াত জিহাদের ব্যাপারে নয়, বরং যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুদার বংশের উপর দুর্ভিক্ষের বদদোআ করেন, তখন তাদের দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। তখন পুরো গোত্রই মদীনায় আসা আরম্ভ করে দিল এবং তারা মুসলিম বলে মিথ্যা দাবী করতে লাগল। এভাবে তারা মদীনার খাবার ও পানীয়ের সংকট সৃষ্টি করে সাহাবীদের কষ্ট দিতে আরম্ভ করল। তখন আল্লাহ তা'আলা আয়াত নাযিল করে জানিয়ে দিলেন যে, তারা মুমিন নয়। ফলে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে তাদের পরিবার-স্বজনদের নিকট ফিরিয়ে দিলেন এবং তাদের কাওমকে এরকম করা থেকে সাবধান করে দিলেন। তখন আয়াতের অর্থ হবে, তারা সবাই যেন নবীর কাছে চলে না আসে। তাদের প্রত্যেক গোত্র থেকে কিছু লোক দ্বীন শেখার জন্য আসতে পারে। অতঃপর তারা যখন তাদের সম্পপ্রদায়ের কাছে ফিরে যাবে তখন তাদের সম্প্রদায়কে সাবধান করতে পারে। ইবন কাসীর]

হাসান বসরী বলেন, এ আয়াতে দ্বীনের গভীর জ্ঞান ও সাবধান করা’র যে কথা বলা হয়েছে এ উভয় কাজটিই যারা অভিযানে বের হয়েছে তাদের জন্য নির্দিষ্ট। তখন অর্থ হবে, কেন একটি দল দ্বীনের গভীর জ্ঞান অর্জন করতে বের হয় না। অর্থাৎ তারা দেখবে ও শিক্ষা নিবে যে, কিভাবে আল্লাহ্ তা'আলা মুশরিকদের উপর তাদেরকে বিজয় দিয়েছেন, আর কিভাবে আল্লাহ তার দ্বীনের সাহায্য করেছেন। আর তারা যখন তাদের কাওমের কাছে ফিরে যাবে তখন তারা তাদের কাওমের তার রাসূল ও মুমিনদের সাহায্য করে থাকেন। ফলে তারা রাসূলের বিরোধিতা থেকে দুরে থাকবে। [বাগভী]

মুজাহিদ বলেন, এর অর্থ, সবাই একসাথে দাওয়াতের জন্য বের হবে না। বরং প্রতিটি বড় দল থেকে কোন ছোট একটি গ্রুপ দ্বীন শেখা এবং তাদের যাওয়ার পরে যা নাযিল হয়েছে তা জানার জন্য জ্ঞানীর কাছে যাবে। তারা জানার পর তাদের সম্প্রদায়ের সবাইকে সাবধান করবে এবং তাদেরকে আল্লাহর দিকে আহবান জানাবে। যাতে তারা আল্লাহর ভয় ও শাস্তি থেকে সাবধান হয়। আর তখনও একটি গ্রুপ কল্যাণের কথা জানার জন্য বসে থাকবে। [বাগভী]

মূলত: ফিকহ হচ্ছে, দ্বীনের আহকাম জানা। [বাগভী] এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে তিনি দ্বীনের ফিকহ প্রদান করেন" [বুখারী:৭১; মুসলিম:১০৩৭] অন্য হাদীসে এসেছে, “মানুষ যেন গুপ্তধন, স্বর্ণ ও রৌপ্যের গুপ্তধনের মত। তাদের মধ্যে যারা জাহেলিয়াতে উত্তম তারা ইসলামেও উত্তম, যদি তারা দ্বীন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করে।" [বুখারী ৩৪৯৩; মুসলিম: ২৫২৬]

১০ :
هُوَ الَّذِي جَعَلَ الشَّمْسَ ضِيَاءً وَالْقَمَرَ نُورًا وَقَدَّرَهُ مَنَازِلَ لِتَعْلَمُوا عَدَدَ السِّنِينَ وَالْحِسَابَ ۚ مَا خَلَقَ اللَّهُ ذَٰلِكَ إِلَّا بِالْحَقِّ ۚ يُفَصِّلُ الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ

তিনি সূর্যকে দীপ্তিময় ও চঁদকে আলোকময় করেছেন এবং তার জন্য মনযিল নির্দিষ্ট করেছেন যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পার। আল্লাহ্‌ এগুলোকে যথাযথ ভাবেই সৃষ্টি করেছেন [১]। তিনি এসব নিদর্শন বিশদভাবে বর্ণনা করেন এমন সম্প্রদায়ের জন্য যারা জানে।

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ তিনি এগুলো অনাহুত সৃষ্টি করেননি। বরং তিনি অত্যন্ত প্রজ্ঞাময়, তাঁর প্রত্যেকটি কাজই প্রজ্ঞায় পূর্ণ। আসমান ও যমীন সৃষ্টির মাঝে কোন হেকমত নেই এমন কথা শুধুমাত্র কাফেররাই বলতে পারে। [এ ব্যাপারে আরো দেখুন, সূরা সোয়াদঃ ২৭, সূরা আল-মূমিনূনঃ ১১৫-১১৬]

১০ :
إِنَّ فِي اخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَمَا خَلَقَ اللَّهُ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَّقُونَ

নিশ্চয় দিন ও রাতের পরিবর্তনে এবং আল্লাহ্‌ আসমানসমূহ ও যমীনে যা সৃষ্টি করেছেন [১] তাতে নিদর্শন রয়েছে এমন সম্প্রদায়ের জন্য যারা তাকওয়া অবলম্বন করে।

ফুটনোট

[১] আসমান ও যমীনে আল্লাহ্ তা'আলা যা সৃষ্টি করেছেন তাতে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে, সেগুলো আল্লাহরই মহিমা ও শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করছে। কুরআনের অন্যান্য আয়াতেও আল্লাহ্ তা'আলা এ বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করেছেন। যেমন, সূরা ইউসুফঃ ১০৫, সূরা ইউনুসঃ ১০১, সূরা সাবাঃ ৯, সূরা আলে ইমরানঃ ১৯০। এগুলোর পরিবর্তনের অর্থ, একটির পর অপরটি এমনভাবে আসা তাদের সুনির্দিষ্ট নিয়মের কোন ব্যঘাত ঘটে না। [ইবন কাসীর] এ ব্যাপারে সূরা আল-আরাফ এর ৫৪, সূরা ইয়াসীন এর ৪০ নং এবং সূরা আল-আন’আমের ৯৬ নং আয়াতেও চাঁদ ও সূর্যের নিয়মানুবর্তিতার কথা বর্ণিত হয়েছে। [ইবন কাসীর]

১০ : ৩৯
بَلْ كَذَّبُوا بِمَا لَمْ يُحِيطُوا بِعِلْمِهِ وَلَمَّا يَأْتِهِمْ تَأْوِيلُهُ ۚ كَذَٰلِكَ كَذَّبَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ ۖ فَانْظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الظَّالِمِينَ

বরং তারা যে বিষয়ে জ্ঞান আয়ত্ত করেনি তাতে মিথ্যারোপ করেছে [১], আর যার প্রকৃত পরিণতি এখনো তাদের কাছে আসেনি [২]। এভাবেই তাদের পূর্ববর্তীরাও মিথ্যা আরোপ করেছিল, কাজেই দেখুন, যালিমদের পরিণাম কি হয়েছে!

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ তারা কুরআনকে এ জন্যই মিথ্যা সাব্যস্ত করার প্রয়াস চালাচ্ছে যে, তারা এটাকে বুঝতে পারেনি, চিনতে পারেনি। [কুরতুবী] তাদের অজ্ঞতাই কুরআনকে মানতে নিষেধ করছে। অন্য আয়াতেও আল্লাহ এ রকম কথা বলেছেন। তিনি বলেন, “আর যখন তারা এটা দ্বারা হেদায়াত পায়নি তখন তারা অচিরেই বলবে, "এ এক পুরোনো মিথ্যা" [সূরা আল-আহকাফ: ১১]

[২] এখানে (تَأْوِيْلُ) এর মর্মার্থ হলো প্রতিফল ও শেষ পরিণতি। অর্থাৎ এরা নিজেদের গাফলতী ও নির্লিপ্ততার দরুন কুরআন সম্পর্কে কোন চিন্তা-ভাবনা করেনি। তারা একটু চিন্তা করতে পারত যে পূর্ববর্তী যে সমস্ত সংবাদ এ কুরআন দিয়েছে তা সত্য কি না? বা ভবিষ্যতের যে সমস্ত সংবাদ দিচ্ছে তা সঠিকভাবে ঘটে কি না? কিন্তু তারা কোন কিছু ভাল করে বুঝার আগে তা অস্বীকার করে বসেছে। ফলে এর প্রতি মিথ্যারোপে লিপ্ত রয়েছে। যদি তারা সত্যিকারভাবে এটা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করত তাহলে অবশ্যই কুরআনকে বুঝতে পারত। আর এটাও বুঝত যে, এটা আল্লাহর বাণী [ফাতহুল কাদীর] আর যে বিষয়ে তাদের জ্ঞান কাজ করে না যেমন পুনরুত্থান, জান্নাত, জাহান্নাম, ইত্যাদি সেগুলোকে তারা অস্বীকার করে বসেছে, সেগুলোর সাথে কুফরি করেছে, অথচ এখনও কিতাবে তাদের উপর যা আপতিত হওয়ার ওয়াদা করা হচ্ছে তার প্রকৃত অবস্থা আসেনি। আর এ মুশরিকরা যেভাবে আল্লাহর ভীতি প্রদর্শনে মিথ্যারোপ করেছে তাদের পূর্বেকার উম্মতরাও তা অস্বীকার করেছিল। [মুয়াসসার]।

১০ : ৮৯
قَالَ قَدْ أُجِيبَتْ دَعْوَتُكُمَا فَاسْتَقِيمَا وَلَا تَتَّبِعَانِّ سَبِيلَ الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ

তিনি বললেন, ‘আপনাদের দুজনের দো’আ কবূল হল, কাজেই আপনারা দৃঢ় থাকুন [১] এবং আপনারা কখনো যারা জানে না তাদের পথ অনুসরণ করবেন না।’

ফুটনোট

[১] দো’আর উপর দৃঢ় থাকার অর্থ হচ্ছে, উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তাড়াতাড়ি না করা। আর তাড়াতাড়ি তখনই করবে না যখন মনে প্রশান্তি আসবে। আর প্রশাস্তি তখনই আসবে যখন গায়েবী ব্যাপারে যা প্রকাশ পাবে তাতে উত্তমভাবে সন্তুষ্টি লাভ হবে। [কুরতুবী]

১০ : ৯৩
وَلَقَدْ بَوَّأْنَا بَنِي إِسْرَائِيلَ مُبَوَّأَ صِدْقٍ وَرَزَقْنَاهُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ فَمَا اخْتَلَفُوا حَتَّىٰ جَاءَهُمُ الْعِلْمُ ۚ إِنَّ رَبَّكَ يَقْضِي بَيْنَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فِيمَا كَانُوا فِيهِ يَخْتَلِفُونَ

আর অবশ্যই আমরা বনী ইসরাইলকে উৎকৃষ্ট আবাসভূমিতে বসবাস করালাম [১] এবং আমরা তাদেরকে উত্তম রিযক দিলাম, অতঃপর তাদের কাছে জ্ঞান আসলে তারা বিভেদ সৃষ্টি করল [২]। নিশ্চয় তারা যে বিষয়ে বিভেদ সৃষ্টি করত [৩] আপনার রব তাদের মধ্যে কিয়ামতের দিনে সেটার ফয়সালা করে দেবেন।

ফুটনোট

[১] এ আয়াতে ফিরআউনের করুণ পরিণতির মোকাবেলায় সে জাতির ভবিষ্যৎ দেখানো হয়েছে, যাদেরকে ফির’আউন হীন ও পদদলিত করে রেখেছিল। বলা হয়েছে, আমি বনী-ইসরাঈলকে উত্তম আবাস দান করেছি। আর এ উত্তম আবাসকে কুরআনুল কারীমে (مُبَوَّاَ صِدۡقٍ) শব্দে ব্যক্ত করেছে। এখানে (صِدْقٍ) অর্থ উপযোগী। [মুয়াসসার] অর্থাৎ এমন আবাসভূমি তাদেরকে দান করা হয়েছে যা তাদের জন্য সর্বদিক দিয়েই কল্যাণকর ও উপযোগী ছিল। অধিকাংশ মুফাসসির ‘উত্তম আবাসভূমি’ বলে সূরা আল-ইসরায় বর্ণিত (اَلَّذِيْ بٰرَكْنَا حَوْلَهٗ) বলে যা বুঝানো হয়েছে তা সবই উদ্দেশ্য নিয়েছেন। [ইবন কাসীর; আদওয়াউল বায়ান] তখন এ স্থানটি অত্যন্ত ব্যাপক এলাকাকে শামিল করবে। অর্থাৎ বায়তুল মাকদিস সংলগ্ন এলাকা, যা বর্তমান ফিলিস্তিন, সিরিয়া, লেবানন ও জর্দানের বেশ কিছু এলাকাকে শামিল করে। এ ছাড়া সাধারণভাবে মিশরও তাদের পদানত হওয়ার কথা। কারণ, ফিরআউন ধ্বংস হওয়ার পর মিশর রাজত্ব যতটুকু ছিল ততটুকু সবটাই মূসা আলাইহিস সালামের আয়ত্বে চলে আসে। [ইবন কাসীর] কিন্তু ইতিহাসে এটা প্রমাণিত হয়নি যে, তারা আবার মিশরে ফিরে গিয়েছিল।

[২] অর্থাৎ তারা এরপর যে সমস্ত বিষয়ে মতভেদ করেছিল তা অজ্ঞতার কারণে নয়। তাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছিল। যার অর্থ হচ্ছে বিভেদ ও মতপার্থক্য না করা। কারণ, জ্ঞান দেয়ার মাধ্যমে আল্লাহ তাদের থেকে সন্দেহ, সংশয় দূর করেছিলেন। কিন্তু তারা মতভেদই করেছিল।[ইবন কাসীর] কোন কোন মুফাসসির বলেন এ আয়াতাংশের অর্থ হচ্ছে, পরবতী পর্যায়ে তারা নিজেদের দ্বীনের মধ্যে যে দলাদলি শুরু করে এবং নতুন নতুন মাযহাব তথা ধমীয় চিন্তাগোষ্ঠির উদ্ভব ঘটায় তার কারণ এ ছিল না যে, তারা প্রকৃত সত্য জানতো না এবং এ না জানার কারণে তারা বাধ্য হয়ে এমনটি করে। বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদেরকে সুস্পষ্টভাবে সত্য দ্বীন, তার মূলনীতি, তার দাবী ও চাহিদা, কুফর ও ইসলামের পার্থক্য সীমা, আনুগত্য ইত্যাদির জ্ঞান দেয়া হয়েছিল। তাদেরকে গোনাহ, আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতা সম্পর্কেও জ্ঞান দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এ সুস্পষ্ট হেদায়াত সত্ত্বেও তারা একটি দ্বীনকে অসংখ্য দ্বীনে পরিণত করে এবং আল্লাহর দেয়া বুনিয়াদগুলো বাদ দিয়ে অন্য বুনিয়াদের ওপর নিজেদের ধমীয় ফেরকার প্রাসাদ নির্মাণ করে। তাদের এ সমস্ত কর্মকাণ্ডের কারণে বায়তুল মুকাদ্দাস ও ফিলিস্তিন এলাকায় অবস্থান কালে বারবার বিভিন্ন বিপর্যয়ে পতিত হয়। মূসা ও হারূন আলাইহিমাসসালামের মৃত্যুর পর ইউসা’ বনি নূন তাদেরকে নিয়ে বায়তুল মুকাদ্দাস এলাকা জয় করেন। তারপর বুখতনসর তাদেরকে সেখান থেকে উৎখাত করে। কন্তিু তারা আবার আল্লাহর দিকে ফিরে আসলে আবার তাদের হাতে বায়তুল মুকাদ্দাস ফিরে আসে। এরপর তারা আবার পথভ্রষ্ট হয়ে পড়লে তারা গ্রীকদের অধীন হয়। ইত্যবসরে আল্লাহ্ তা'আলা তাদের মাঝে ঈসা আলাইহিসসালামকে পাঠালেন। কিন্তু তারা গ্রীক রাজাদেরকে ঈসা আলাইহিসসালামের উপর এই বলে ক্ষেপিয়ে তুলল যে, তিনি প্রজাদের মধ্যে বিদ্রোহ সৃষ্টির পঁয়তারা চালাচ্ছেন। গ্রীকগণ তখন ঈসা আলাইহিসসালামকে ধরার জন্য লোক পাঠাল। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীদের একজনকে আল্লাহ্ তা'আলা ঈসা আলাইহিসসালামের আকৃতি দিয়ে ঈসা আলাইহিসসালামকে আসমানে উঠিয়ে নিলেন। এর ৩০০ বছর পরে গ্রীক সম্রাট কস্টান্টিন নাসারা ধর্মে প্রবেশ করে। সে তখন বিভিন্ন ভিন্নমতাবলম্বী এবং নিজের পক্ষ থেকে জুড়ে দিয়ে নতুন অনেকগুলো আকীদা-বিশ্বাস ও শরীআত প্রবর্তন করল এবং রাষ্ট্রিয় ক্ষমতাবলে সেগুলোকে বিভিন্নভাবে প্রতিষ্ঠিত করল। যারা ঈসা আলাইহিসসালাম আনীত দ্বীনের উপর ছিল তাদেরকে নানাভাবে নির্যাতন করল। তারা বিভিন্নস্থানে পালিয়ে গেল। সে সবস্থানে তার মনমত লোক সেট করল। এবং দেশে দেশে তার মতের লোকদের দ্বারা উপাসনালয় প্রতিষ্ঠা করল। তাদের সে সমস্ত নতুন আকীদার মধ্যে ছিল, ঈসা আলাইহিসসালাম নবী নন। তিনি তিন ইলাহর একজন। তার মধ্যে ঐশ্বরিক এবং মানবিক দু'ধরণের গুণের সমাহার ছিল। তখন থেকে তারা ক্রুশকে পবিত্র চিহ্ন বলে বিবেচনা করল। শুকরের গোস্ত হালাল করল। বিভিন্ন গীর্জায় ঈসা ও মারইয়াম আলাইহিমাসসালামের কল্পিত ছবি স্থাপন করল। এভাবে তারা তাদের দ্বীনকে বিভিন্নভাবে পরিবর্তন করে ফেলল। পরিণতিতে আল্লাহ্ তা'আলা তাদেরকে এ পবিত্র ভূমির উত্তরাধিকার থেকে তাড়িয়ে দিয়ে সেখানে সুস্থ সঠিক আকীদার উপর প্রতিষ্ঠিত মুসলিমদের প্রতিষ্ঠা করেন। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর সময়ে সাহাবাগণ বায়তুল মুকাদ্দাসের অধিকারী হন। [ইবন কাসীর, সংক্ষেপিত]

[৩] তাদের বিভেদ সৃষ্টি সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন যে, ইয়াহুদীগণ একাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছে। আর নাসারাগণ বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছে। আর এ উম্মত তিয়াত্তর দলে বিভক্ত হবে। [সহীহ ইবনে হিব্বানঃ ৬২৪৭, ৬৭৩১]

১১ : ১৪
فَإِلَّمْ يَسْتَجِيبُوا لَكُمْ فَاعْلَمُوا أَنَّمَا أُنْزِلَ بِعِلْمِ اللَّهِ وَأَنْ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ۖ فَهَلْ أَنْتُمْ مُسْلِمُونَ

অতঃপর যদি তারা তোমাদের আহ্বানে সাড়া না দেয় তবে জেনে রাখ, এটা তো আল্লাহ্‌র জ্ঞান অনুসারেই নাযিল করা হয়েছে এবং তিনি ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ্ নেই। অতঃপর তোমরা কি আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম) হবে?
ফুটনোট

১১ : ৪৬
قَالَ يَا نُوحُ إِنَّهُ لَيْسَ مِنْ أَهْلِكَ ۖ إِنَّهُ عَمَلٌ غَيْرُ صَالِحٍ ۖ فَلَا تَسْأَلْنِ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ ۖ إِنِّي أَعِظُكَ أَنْ تَكُونَ مِنَ الْجَاهِلِينَ

আল্লাহ্‌ বললেন, ‘হে নূহ্ ! নিশ্চয় সে আপনার পরিবারভুক্ত নয়। সে অবশ্যই অসৎকর্মপরায়ণ [২]। কাজেই যে বিষয়ে আপনার জ্ঞান নেই সে বিষয়ে আমাকে অনুরোধ করবেন না [৩]। আমি আপনাকে উপদেশ দিচ্ছি, আপনি যেন অজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত না হন।‘

ফুটনোট

[১] এ আয়াতাংশের তাফসীরে ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেনঃ এখানে সে আপনার পরিবারভুক্ত নয়’ বলে বুঝানো হয়েছে যে, যাদেরকে নাজাত দেয়ার ওয়াদা আমি করেছিলাম সে তাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। [ইবন কাসীর] এর কারণ হলো, সে কাফের ছিল। আর মুক্তি বা নাজাতের ব্যাপারে কাফেরের সাথে ঈমানদারের কোন সম্পর্ক থাকতে পারে না। তাছাড়া পূর্ব আয়াতে এসেছে যে, “আপনার পরিবারকেও (তাতে উঠান) কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে পূর্ব সিদ্ধান্ত হয়েছে তাদের ছাড়া”। সে পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুসারে কুফরি ও তার পিতার অবাধ্যতার কারণে ডুবে মরন।‘ [ইবন কাসীর]

[২] এটি হচ্ছে কুফরী ও ঈমানের বিরোধের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপার। এখানে শুধুমাত্র যারা সৎ তাদেরকে রক্ষা করা হবে এবং যারা অসৎ ও নষ্ট হয়ে গেছে তাদেরকে খতম করে দেয়া হবে। তার আমল যেহেতু খারাপ সুতরাং রক্ষা করা যাবে না। সে নিয়্যত ও আমলে আপনার বিপরীত কাজ করেছে। [তাবারী] তাছাড়া এ আয়াতের আরেকটি অর্থও ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত হয়েছে, তা হলো, এখানে (إنه) বলে নূহ আলাইহিসসালামের দোআকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ হে নূহ আপনি যে আপনার কাফের সন্তানের জন্য আমার শরনাপন্ন হয়েছেন এ কাজটা সৎ কাজ নয়। আপনার যে বিষয়ে জ্ঞান নেই সে বিষয়ে কিছু চাওয়া ভাল কাজ নয়। [তাবারী; সা’দী]

[৩] অর্থাৎ যে জিনিসের পরিণাম আপনার জানা নেই যে এটা ভাল-কি মন্দ বয়ে নিয়ে আসবে এমন কাজে আপনি এগিয়ে যাবেন না। এমন কিছু আমার কাছে চাইবেন না। আমি আপনাকে নসীহত করছি এমন এক নসীহত যা দ্বারা আপনি পূর্ণতা লাভ করবেন এবং জাহেলদের কর্মকাণ্ড থেকে নাজাত পাবেন। তখন নূহ আলাইহিস সালাম যা করেছেন সে জন্য ভীষণ লজ্জিত হলেন এবং বললেন, ‘হে আমার রব! যে বিষয়ে আমার জ্ঞান নেই, সে বিষয়ে যাতে আপনাকে অনুরোধ না করি, এ জন্য আমি আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আপনি যদি আমাকে ক্ষমা না করেন এবং আমাকে দয়া না করেন, তবে আমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব। সুতরাং ক্ষমা ও রহমতের দ্বারাই কেউ নাজাত পেতে পারে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে মুক্তি পেতে পারে [সা'দী] আয়াত থেকে প্রমাণিত হচ্ছে, নূহ আলাইহিস সালাম তার সন্তানের নাজাতের জন্য যে ডাক দিয়েছিলেন সেটা যে হারাম ছিল তা তার জানা ছিল না। তিনি মনে করেননি যে, পূর্ববর্তী আয়াতে বর্ণিত “যারা যুলুম করেছে তাদের সম্পর্কে আপনি আমাকে কোন আবেদন করবেন না; তারা তো নিমজ্জিত হবে" সেটা দ্বারা তাকে তার সন্তানের ব্যাপারে দোআ করতে নিষেধ করা হয়েছে। বিশেষ করে তার কাছে দুটি নির্দেশের মধ্যে বিরোধ লেগে গিয়েছিল। তিনি মনে করেছিলেন, তার সন্তানের জন্য নাজাতের আহবান পূর্বোক্ত আল্লাহর পক্ষ থেকে "আর আপনার পরিবারকে" নৌকাতে উঠিয়ে নিন, সে ঘোষণায় তার সন্তান অন্তর্ভুক্ত হবে। সে হিসেবে তিনি নাজাতের আহবান জানিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তাকে জানিয়ে দেয়া হয় যে, সে যালেমদের অন্তর্ভুক্ত, তার জন্য কোন প্রকার দোআ করা যাবে না। তখন তিনি সে অনুসারে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান এবং তার দয়া তলব করেন। [ফাতহুল কাদীর; সা’দী] এতে স্পষ্ট হলো যে, একজন মহান মর্যাদাশালী নবী নিজের চোখের সামনে নিজের কলিজার টুকরা সন্তানকে ডুবে যেতে দেখছেন এবং অস্থির হয়ে সন্তানের গোনাহ মাফ করার জন্য আল্লাহর কাছে আবেদন জানাচ্ছেন। কিন্তু আল্লাহর দরবার থেকে জবাবে তাকে ধমক দেয়া হচ্ছে। কারণ একটিই, সে ছেলের মধ্যে রয়েছে শির্ক ও কুফর। সুতরাং যার কাছে থাকবে শির্ক ও কুফর তার জন্য কেউ কোন সুপারিশ করতেও সক্ষম হবে না। [দেখুন, ইবন তাইমিয়্যা: মাজমু ফাতাওয়া ১/১৩১]

১১ : ৪৭
قَالَ رَبِّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ أَنْ أَسْأَلَكَ مَا لَيْسَ لِي بِهِ عِلْمٌ ۖ وَإِلَّا تَغْفِرْ لِي وَتَرْحَمْنِي أَكُنْ مِنَ الْخَاسِرِينَ

তিনি বললেন, ‘হে আমার রব! যে বিষয়ে আমার জ্ঞান নেই, সে বিষয়ে যাতে আপনাকে অনুরোধ না করি, এ জন্য আমি আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আপনি যদি আমাকে ক্ষমা না করেন এবং আমাকে দয়া না করেন, তবে আমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব [১]।‘

ফুটনোট

[১] উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা একটি মাসআলা জানা গেল যে, দো'আকারীর কর্তব্য হচ্ছে যার জন্য ও যে কাজের জন্য দো'আ করা হবে তা জায়েয হালাল ও ন্যায়সঙ্গত কি না তা জেনে নেয়া। সন্দেহজনক কোন বিষয়ের জন্য দোআ করা নিষিদ্ধ। এ আয়াত থেকে আরো জানা গেল যে, মুমিন ও কাফেরের মধ্যে যতই নিকটাত্মীয়ের সম্পর্ক থাক না কেন ধর্মীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে উক্ত আত্মীয়তার প্রতি লক্ষ্য করা যাবে না। কোন ব্যক্তি যতই সম্ভান্ত বংশীয় হোক না কেন যতই বড় বুযুর্গের সন্তান হোক না কেন, যদি সে ঈমানদার না হয় তবে দ্বীনী দৃষ্টিকোণ হতে তার আভিজাত্য ও নবীর নিকটাত্মীয় হওয়ার কোন মূল্য নেই। ঈমান, তাকওয়া ও যোগ্যতার ভিত্তিতে মানুষের মর্যাদা নির্ধারিত হবে। যার মধ্যে এসব গুণের সমাবেশ হয়েছে সে পর হলেও আপনজন। অন্যথায় আপন আত্মীয় হলেও সে পর। দ্বীনী ক্ষেত্রেও যদি আত্মীয়তার লক্ষ্য রাখা হতো তাহলে ভাইয়ের উপর ভাই কখনো তলোয়ার চালাতো না। বদর ওহুদ ও আহযাবের লড়াই তো একই বংশের লোকদের মধ্যে সংঘটিত হয়েছে। যাতে করে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে ইসলাম ভ্রাতৃত্ব ও জাতীয়তা বংশ, বর্ণ, ভাষা বা আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে গড়ে উঠে না, বরং ঈমান, তাকওয়া ও সৎকর্মশীলতার ভিত্তিতে গড়ে উঠে। তারা যে কোন বংশের, যে কোন গোত্রের, যে কোন বর্ণের, যে কোন দেশের, যে কোন ভাষাভাষী হোক না কেন সবাই মিলে এক জাতি একই ভ্রাতৃত্বের অটুট বন্ধনে আবদ্ধ। তাই আল্লাহর বাণী “সকল মুসলিম ভাই ভাই” [সূরা হুজুরাতঃ ১০] আয়াতের এটাই মর্মকথা। অপরদিকে যারা ঈমান ও সৎকর্মশীলতা হতে বঞ্চিত, তারা ইসলামী ভ্রাতৃত্বের সদস্য নয়।

১২ : ২২
وَلَمَّا بَلَغَ أَشُدَّهُ آتَيْنَاهُ حُكْمًا وَعِلْمًا ۚ وَكَذَٰلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ

আর সে যখন পূর্ণ যৌবনে উপনীত হল তখন আমরা তাকে হিকমত ও জ্ঞান দান করলাম [১]। আর এভাবেই আমরা ইহসানকারীদেরকে পুরস্কৃত করি [২]।

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ যখন ইউসুফ ‘আলাইহিস্ সালাম পূর্ণ শক্তি ও যৌবনে পদার্পণ করলেন, তখন আমি তাকে প্রজ্ঞা ও বুৎপত্তি দান করলাম। ‘শক্তি ও যৌবন’ কোন বয়সে অর্জিত হল, এ সম্পর্কে তাফসীরবিদগণের বিভিন্ন উক্তি রয়েছে। আর ইলম বা বুৎপত্তি দান করার অর্থ এস্থলে নবুওয়াত দান করা। [ইবন কাসীর] মূলতঃ কুরআনের ভাষায় সাধারণভাবে এমন শব্দের মানে হয় “নবুওয়াত দান করা”। ফায়সালা করার শক্তিকে কুরআনের মূল ভাষ্যে বলা হয়েছে “হুকুম”। এ হুকুম অর্থ কর্তৃত্বও হয়। [কুরতুবী]

[২] আমি ইহসানকারীদেরকে এমনিভাবে প্রতিদান দিয়ে থাকি। উদ্দেশ্য এই যে, নিশ্চিত ধ্বংসের কবল থেকে মুক্তি দিয়ে রাজত্ব ও সম্মান পর্যন্ত পৌছানো ছিল ইউসুফ ‘আলাইহিস্ সালাম -এর সদাচরণ, আল্লাহ ভীতি ও সৎকর্মের পরিণতি। এটা শুধু তারই বৈশিষ্ট নয়, যে কেউ এমন সৎকর্ম করবে, সে এমনিভাবে আমার পুরস্কার লাভ করবে। সুতরাং যেভাবে আমি ইউসুফকে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত পার করে সফলতা দিয়েছি তেমনি আপনাকেও হে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমি আপনার কাওমের মুশরিকদের শক্রতা থেকে নাজাত দেব এবং আপনাকে যমীনে প্রতিষ্ঠিত করব। [কুরতুবী]

১২ : ৫০
وَقَالَ الْمَلِكُ ائْتُونِي بِهِ ۖ فَلَمَّا جَاءَهُ الرَّسُولُ قَالَ ارْجِعْ إِلَىٰ رَبِّكَ فَاسْأَلْهُ مَا بَالُ النِّسْوَةِ اللَّاتِي قَطَّعْنَ أَيْدِيَهُنَّ ۚ إِنَّ رَبِّي بِكَيْدِهِنَّ عَلِيمٌ

আর রাজা বলল, ‘তোমরা ইউসুফকে আমার কাছে নিয়ে আস [১]।’ অতঃপর যখন দূত তার কাছে উপস্থিত হল তখন তিনি বললেন, ‘তুমি তোমার মনিবের কাছে ফিরে যাও এবং তাকে জিজ্ঞেস কর, যে নারীরা হাত কেটে ফেলেছিল তাদের অবস্থা কি! নিশ্চয় আমার রব তাদের ছলনা সম্পর্কে সম্যক অবগত [২]।’

ফুটনোট

[১] ঘটনার গতিধারা দেখে বোঝা যায় যে, এ ব্যক্তি স্বপ্নের ব্যাখ্যা নিয়ে ফিরে এসেছে এবং বাদশাহকে তা অবহিত করেছে। [কুরতুবী] বাদশাহ্ বৃত্তান্ত নিশ্চিন্ত ও ইউসুফ 'আলাইহিস্ সালাম-এর গুণ-গরিমায় মুগ্ধ হয়েছেন। [ইবন কাসীর] কিন্তু কুরআনুল কারীম এসব বিষয়ের উল্লেখ করা দরকার মনে করেনি। কারণ, এগুলো আপনা থেকেই বোঝা যায়। পরবর্তী ঘটনা বর্ণনা করে বলা হয়েছেঃ

(وَقَالَ الْمَلِكُ ائْتُوْنِيْ بِهٖ)

অর্থাৎ বাদশাহ্ আদেশ দিলেন যে, ইউসুফ ‘আলাইহিস্ সালাম-কে কারাগার থেকে বাইরে নিয়ে আসো। অতঃপর বাদশাহর জনৈক দূত এ বার্তা নিয়ে কারাগারে পৌঁছল। [ইবন কাসীর]

[২] ইউসুফ ‘আলাইহিস্ সালাম দীর্ঘ বন্দীজীবনের দুঃসহ যাতনায় অতিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন এবং মনে মনে মুক্তি কামনা করছিলেন। কাজেই বাদশাহর প্রেরিত বার্তাকে সুবর্ণ সুযোগ মনে করে তিনি তৎক্ষণাৎ প্রস্তুত হয়ে বের হয়ে আসতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইউসুফ ‘আলাইহিস্ সালাম-এর কাজের প্রশংসা করে বলেনঃ যদি ইউসুফের মত আমি এত বছর জেল খাটতাম, তারপর আমার কাছে বের হওয়ার আহ্বান আসত তাহলে আমি সে ডাকে তৎক্ষণাৎ সাড়া দিতাম। [বুখারীঃ ৬৯৯২, মুসলিমঃ ১৫১] এখানে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম মূলতঃ নিজেকে নম্রভাবে পেশ করে ইউসুফ ‘আলাইহিস্ সালাম-এর মর্যাদা বৃদ্ধি করতে চেয়েছিলেন। কারণ, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও এর চেয়ে বেশী কষ্টের শি'আবে আবী তালেবে কাটিয়েছিলেন। কিন্তু তিনিও আপোষ করেননি।

আল্লাহ্ তা'আলা নবীগণকে যে উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন, তা অন্যের পক্ষে অনুধাবন করাও সম্ভব নয়। ইউসুফ ‘আলাইহিস্ সালাম দূতকে উত্তর দিলেন, তুমি বাদশাহর কাছে ফিরে গিয়ে প্রথমে জিজ্ঞেস কর যে, আপনার মতে ঐ মহিলাদের ব্যাপারটি কিরূপ, যারা হাত কেটে ফেলেছিল? বাদশাহ্ এ ব্যাপারে আমাকে সন্দেহ করেন কি না এবং আমাকে দোষী মনে করেন কি না? এখানে এ বিষয়টিও প্রণিধানযোগ্য যে, ইউসুফ ‘আলাইহিস্ সালাম এখানে হস্তকৰ্তনকারিণী মহিলাদের কথা উল্লেখ করেছেন, আযীয-পত্নীর নাম উল্লেখ করেননি; অথচ সে-ই ছিল ঘটনার মূল কেন্দ্রবিন্দু। বলাবাহুল্য, এতে ঐ নিমকের কদর করা হয়েছে, যা ইউসুফ ‘আলাইহিস্ সালাম আযীযের গৃহে লালিত-পালিত হয়ে খেয়েছিলেন। [কুরতুবী]

১২ : ৬৮
وَلَمَّا دَخَلُوا مِنْ حَيْثُ أَمَرَهُمْ أَبُوهُمْ مَا كَانَ يُغْنِي عَنْهُمْ مِنَ اللَّهِ مِنْ شَيْءٍ إِلَّا حَاجَةً فِي نَفْسِ يَعْقُوبَ قَضَاهَا ۚ وَإِنَّهُ لَذُو عِلْمٍ لِمَا عَلَّمْنَاهُ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ

আর যখন তারা তাদের পিতা যেভাবে আদেশ করেছিলেন সেভাবেই প্রবেশ করল, তখন আল্লাহ্‌র হুকুমের বিপরীতে তা তাদের কোন কাজে আসল না; ইয়া’কূব শুধু তার মনের একটি অভিপ্রায় পূর্ণ করছিলেন [১] আর অবশ্যই তিনি আমাদের দেয়া শিক্ষায় জ্ঞানবান ছিলেন। কিন্তু বেশীর ভাগ মানুষই জানে না [২] ।

ফুটনোট

[১] এ আয়াতে পূর্ববর্তী আয়াতে বর্ণিত বিষয়টিকে আরো স্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ ছেলেরা পিতার আদেশ পালন করে বিভিন্ন দরজা দিয়ে শহরে প্রবেশ করে। ফলে পিতার নির্দেশ কার্যকর হয়ে গেল। অবশ্য এ তদবীর আল্লাহ্‌র কোন নির্দেশকে এড়াতে পারত না, কিন্তু পিতৃ-সুলভ স্নেহ-মমতার চাহিদা ছিল যা, তা তিনি পূর্ণ করেছেন। পূর্ব আয়াতের শেষ ভাগে ইয়াকূব ‘আলাইহিস্ সালাম-এর প্রশংসা করে বলা হয়েছে, ইয়াকূব বড় বিদ্বান ছিলেন, কারণ, আমি তাকে বিদ্যা দান করেছিলাম। এ কারণেই তিনি শরী’আতসম্মত ও প্রশংসনীয় বাহ্যিক তদবীর অবলম্বন করলেও তার উপর ভরসা করেননি। বরং কৌশল ও আল্লাহ্‌র প্রতি নির্ভরশীলতার মধ্যে যথাযথ ভারসাম্য স্থাপন করেছেন।

[২] আলোচ্য দু'আয়াত থেকে কতিপয় নির্দেশ ও মাসআলা জানা যায়-

(এক) বদ নযর লাগা সত্য। [দেখুন- বুখারীঃ ৫৭৪০, মুসলিমঃ ২১৮৭] সুতরাং ক্ষতিকর খাদ্য ও ক্ষতিকর ক্রিয়াকর্ম থেকে আত্মরক্ষার তদবীর করার ন্যায় এ থেকে আত্মরক্ষার তদবীর করাও সমভাবে শরী’আতসিদ্ধ।

(দুই) যদি অন্য কারো কোন গুণ অথবা নেয়ামত দৃষ্টিতে বিস্ময়কর ঠেকে এবং নযর লেগে যাওয়ার আশঙ্কা হয়, তবে তা দেখে (بَارَكَ اللّٰهُ) অথবা (مَاشَاءَ اللّٰهُ) বলা দরকার, যাতে অন্যের কোন ক্ষতি না হয়।

(তিন) নযর লাগা থেকে আত্মরক্ষার জন্য শরী’আতসম্মত যে কোন তদবীর করা জায়েয। তন্মধ্যে দোআ, কুরআন-হাদীসভিত্তিক ঝাঁড়-ফুক দ্বারা প্রতিকার করাও অন্যতম। [কুরতুবী, সংক্ষেপিত]

১২ : ৭৬
فَبَدَأَ بِأَوْعِيَتِهِمْ قَبْلَ وِعَاءِ أَخِيهِ ثُمَّ اسْتَخْرَجَهَا مِنْ وِعَاءِ أَخِيهِ ۚ كَذَٰلِكَ كِدْنَا لِيُوسُفَ ۖ مَا كَانَ لِيَأْخُذَ أَخَاهُ فِي دِينِ الْمَلِكِ إِلَّا أَنْ يَشَاءَ اللَّهُ ۚ نَرْفَعُ دَرَجَاتٍ مَنْ نَشَاءُ ۗ وَفَوْقَ كُلِّ ذِي عِلْمٍ عَلِيمٌ

অতঃপর তিনি তার সহোদরের মালপত্র তল্লাশির আগে তাদের মালপত্র তল্লাশি করতে লাগলেন [১], পরে তার সহোদরের মালপত্রের মধ্য হতে পাত্রটি বের করলেন [২]। এভাবে আমরা ইউসুফের জন্য কৌশল করেছিলাম [৩]। রাজার আইনে তার ভাইকে আটক করা সংগত হতোনা, আল্লাহ্ ইচ্ছে না করলে। আমরা যাকে ইচ্ছে মর্যাদায় উন্নীত করি। আর প্রত্যেক জ্ঞানবান ব্যক্তির উপর আছে সর্বজ্ঞানী [৪]।

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ সরকারী তল্লাশীকারীরা প্রকৃত ষড়যন্ত্র ঢেকে রাখার জন্য প্রথমেই অন্য ভাইদের আসবাবপত্র তালাশ করল। প্রথমেই বিনইয়ামীনের আসবাবপত্র খুলল না, যাতে তাদের সন্দেহ না হয়। [কুরতুবী; ইবন কাসীর]

[২] অর্থাৎ সব শেষে বিনইয়ামীনের আসবাবপত্র খোলা হলে তা থেকে শাহী পাত্রটি বের হয়ে এল। তখন ভাইদের অবস্থা দেখে কে? লজ্জায় সবার মাথা হেঁট হয়ে গেল। তারা বিনইয়ামীনকে খারাপ কথা বলতে লাগল। [কুরতুবী; ইবন কাসীর]

[৩] অর্থাৎ এমনিভাবে আমি ইউসুফের খাতিরে কৌশল করেছি। এ সমগ্র ধারাবাহিক ঘটনাবলীতে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে ইউসুফের সমর্থনে সরাসরি কোন কৌশলটি অবলম্বন করা হয়েছিল তা অবশ্যি এখানে ভেবে দেখার মতো বিষয়। একথা সুস্পষ্ট যে, পেয়ালা রাখার কৌশলটি ইউসুফ নিজেই করেছিলেন। এটাও সুস্পষ্ট, সরকারী কর্মচারীদের চুরির সন্দেহে কাফেলাকে আটকানোও একটি নিয়ম মাফিক কাজ ছিল, যা এ ধরনের অবস্থায় সব সরকারী কর্মচারীই করে থাকে। তাহলে আল্লাহ্‌র সেই কৌশল কোনটি? উপরের আয়াতের মধ্যে অনুসন্ধান চালালে এ ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন জিনিসই এর ক্ষেত্র হিসেবে পাওয়া যেতে পারে না যে, সরকারী কর্মচারীরা নিয়ম বিরোধীভাবে নিজেরাই সন্দেহপূর্ণ অপরাধীদের কাছে চুরির শাস্তি জিজ্ঞেস করলো এবং জবাবে তারাও এমন শাস্তির কথা বললো যা ইবরাহিমী শরীয়াতের দৃষ্টিতে চোরকে দেয়া হতো। এর ফলে দু’টি লাভ হলো। প্রথমত ইউসুফ ইবরাহিমী শরী’আতকে কার্যকর করার সুযোগ পেলেন এবং দ্বিতীয়ত নিজের ভাইকে হাজতে পাঠাবার পরিবর্তে তিনি নিজের কাছে রাখতে পারলেন। তিনি বাদশাহর আইনানুযায়ী ভাইকে গ্রেফতার করতে পারতেন না। কেননা, মিসরের আইনে চোরের এই শাস্তি ছিল না। কিন্তু তারা এখানে ইউসুফ-ভ্রাতাদের কাছ থেকেই ইয়াকূব ‘আলাইহিস্ সালাম-এর শরী’আতানুযায়ী চোরের বিধান জেনে নিয়েছিল। এ বিধান দৃষ্টে বিনইয়ামীনকে আটকে রাখা বৈধ হয়ে গেল। এমনিভাবে আল্লাহ্ তা'আলার ইচ্ছায় ইউসুফ ‘আলাইহিস্ সালাম-এর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হল।

[৪] অর্থাৎ আমি যাকে ইচ্ছা, উচ্চ মর্যাদায় উন্নীত করে দেই, যেমন এ ঘটনায় ইউসুফের মর্যাদা তার ভাইদের তুলনায় উচ্চ করে দেয়া হয়েছে। প্রত্যেক জ্ঞানীর উপরেই তদপেক্ষা অধিক জ্ঞানী বিদ্যমান রয়েছে। উদ্দেশ্য এই যে, আমরা জ্ঞান ও ঈমানের দিক দিয়ে সৃষ্টজীবের মধ্যে একজনকে অন্যজনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করে থাকি। [কুরতুবী] হাসান বসরী বলেন, একজন যত বড় জ্ঞানীই হোক, তার তুলনায় আরো অধিক জ্ঞানী থাকে। মানবজাতির মধ্যে যদি কেউ এমন হয় যে, তার চাইতে অধিক জ্ঞানী আর নেই, তবে এ অবস্থায়ও আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন-এর জ্ঞান সবারই উর্ধ্বে। [ইবন কাসীর]

১৩ :
وَهُوَ الَّذِي مَدَّ الْأَرْضَ وَجَعَلَ فِيهَا رَوَاسِيَ وَأَنْهَارًا ۖ وَمِنْ كُلِّ الثَّمَرَاتِ جَعَلَ فِيهَا زَوْجَيْنِ اثْنَيْنِ ۖ يُغْشِي اللَّيْلَ النَّهَارَ ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ

আর তিনিই যমীনকে বিস্তৃত করেছেন [১] এবং তাতে সুদৃঢ়পর্বত ও নদী সৃষ্টি করেছেন এবং সব রকমের ফল সৃষ্টি করেছেন জোড়ায় জোড়ায় [২]। তিনি দিনকে রাত দ্বারা আচ্ছাদিত করেন [৩]। নিশ্চয় এতে নিদর্শন রয়েছে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য [৪]।

ফুটনোট

[১] পূর্বের আয়াতে উপরস্থিত আসমানের নিদর্শনাবলী বর্ণনা করেছেন। আর এখানে নিচের বা যমীনের নিদর্শনাবলী বর্ণনা করছেন। [ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর] তিনিই ভূমণ্ডলকে বিস্তৃত করেছেন এবং তাতে ভারী পাহাড়-পর্বত ও নদ-নদী সৃষ্টি করেছেন। ভূমণ্ডলের বিস্তৃতি তার গোলাকৃতির পরিপন্থী নয়। কেননা, গোলাকার বস্তু যদি অনেক বড় হয়, তবে তার প্রত্যেকটি অংশ একটি বিস্তৃত পৃষ্ঠের মতই দৃষ্টিগোচর হয়। [ফাতহুল কাদীর] কুরআনুল কারীম সাধারণ মানুষকে তাদের দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী সম্বোধন করে। বাহ্যদর্শী ব্যক্তি পৃথিবীকে একটি বিস্তৃত পৃষ্ঠরূপে দেখে। তাই একে বিস্তৃত করা শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করা হয়েছে। এরপর পৃথিবীর ভারসাম্য বজায় রাখা ও অন্যান্য অনেক উপকারিতার জন্য এর উপর সুউচ্চ ও ভারী পাহাড় প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। এসব পাহাড় একদিকে ভূ-পৃষ্ঠের ভারসাম্য বজায় রাখে এবং অন্যদিকে সমগ্র সৃষ্ট জীবকে পানি পৌঁছাবার ব্যবস্থা করে। পানির বিরাট ভাণ্ডার পর্বত-শৃঙ্গে বরফ আকারে সঞ্চিত রাখা হয়। এর জন্য কোন চৌবাচ্চা নেই এবং তা তৈরি করারও প্রয়োজন নেই। অপবিত্র বা দূষিত হওয়ারও কোন সম্ভাবনা নেই। অতঃপর এ ফল্গুধারা থেকেই কোথাও প্রকাশ্য নদ-নদী ও খাল-বিল নির্গত হয় এবং কোথাও ভূগর্ভেই লুকিয়ে থাকে। অতঃপর কুপের মাধ্যমে এ ফল্গুধারার সন্ধান করে তা থেকে পানি উত্তোলন করা হয়।

[২] অর্থাৎ এ ভূ-পৃষ্ঠ থেকে নানাবিধ ফল-ফসল উৎপন্ন করছেন এবং প্রত্যেক ফল-ফসলের দু’প্রকার সৃষ্টি করছেনঃ লাল-হলুদ, টক-মিষ্টি। [বাগভী] তবে এর অর্থ দুই না হয়ে একাধিক হতে পারে যেগুলোর সংখ্যা কমপক্ষে দুই হবে। তাই বিষয়টি (زَوْجَيْنِ اثْنَيْنِ) শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করা হয়েছে। পৃথিবীর প্রতিটি ফলই দু' প্রকার হয়, রঙের দিক থেকে যেমন, সাদা-কালো, অথবা স্বাদের দিক থেকে যেমন, মিষ্টি-টক, অথবা আকৃতির দিক থেকে যেমন, বড়-ছোট, অথবা অবস্থাগত দিক থেকে যেমন, গরম ও ঠাণ্ডা। [ফাতহুল কাদীর] কারও কারও মতে, (زَوْجَيْنِ) এর অর্থ নর ও মাদী হওয়া [কুরতুবী]

[৩] আল্লাহ্ তা'আলাই রাত্রি দ্বারা দিনকে ঢেকে দেন। অর্থাৎ দিনের আলোর পর রাত্রি নিয়ে আসেন; যেমন কোন উজ্জ্বল বস্তুকে পর্দা দ্বারা আবৃত করে কালো করে দেয়া হয়। ফলে স্বচ্ছ শুভ্র উজ্জ্বল থাকার পর সেটা অন্ধকার কালোতে রূপান্তরিত হয়। [ফাতহুল কাদীর] আবার আরেক অর্থে, তিনি এ দু’টিকে এমন করেছেন যে, এর প্রত্যেকটি অপরটিকে তাড়িয়ে বেড়ায়। [ইবন কাসীর] একটি যাওয়ার সাথে সাথে আরেকটি আসবেই। এভাবে আল্লাহ্ তা'আলা মানুষ ও তাদের বাসস্থান যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন তেমনি তিনি সময়ও নিয়ন্ত্রণ করেন।

[৪] উপরে বিশ্ব-জাহানের যে নিদর্শনাবলীকে সাক্ষী হিসেবে পেশ করা হয়েছে সেগুলোতে কেউ চিন্তাভাবনা করলে অবশ্যই সুস্পষ্ট প্রমাণ পাবে যে, এ বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টা ও পরিচালক একজনই আর মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবন, আল্লাহ্র আদালতে মানুষের হাযির হওয়া এবং পুরষ্কার ও শাস্তি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেসব খবর দিয়েছেন সেগুলো সবই সত্য। [বাগভী; ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর]

১৩ :
وَفِي الْأَرْضِ قِطَعٌ مُتَجَاوِرَاتٌ وَجَنَّاتٌ مِنْ أَعْنَابٍ وَزَرْعٌ وَنَخِيلٌ صِنْوَانٌ وَغَيْرُ صِنْوَانٍ يُسْقَىٰ بِمَاءٍ وَاحِدٍ وَنُفَضِّلُ بَعْضَهَا عَلَىٰ بَعْضٍ فِي الْأُكُلِ ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَعْقِلُونَ

আর যমীনে রয়েছে পরস্পর সংলগ্ন ভূখন্ড [১], আঙ্গুর বাগান, শস্যক্ষেত্র, একই মূল থেকে উদগত বা ভিন্ন ভিন্ন মূল থেকে উদগত খেজুর গাছ [২] যেগুলো একই পানি দ্বারা সেচ করা হয়, আর স্বাদ-রূপের ক্ষেত্রে সেগুলোর কিছু সংখ্যককে আমরা কিছু সংখ্যকের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে থাকি [৩]। নিশ্চয় বোধশক্তি সম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য এতে রয়েছে নিদর্শন [৪]।

ফুটনোট

[১] এখানে আল্লাহ্ তা'আলা নতুন করে অন্য আরেক প্রকার নিদর্শন পেশ করছেন। [ফাতহুল কাদীর] অর্থাৎ সারা পৃথিবীকে তিনি একই ধরনের একটি ভূখণ্ড বানিয়ে রেখে দেননি। বরং তার মধ্যে সৃষ্টি করেছেন অসংখ্য ভূখণ্ড, এ ভূখণ্ডগুলো পরস্পর সংলগ্ন থাকা সত্ত্বেও আকার-আকৃতি, রং, গঠন, উপাদান, বৈশিষ্ট্য, শক্তি ও যোগ্যতা এবং উৎপাদনে পরস্পরের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন পর্যায়ে অবস্থান করছে। এগুলোর কোনটি এমন যে, তাতে শস্য উৎপন্ন হয় আবার কোন কোনটি একেবারে অকেজো ভূমি যাতে কোন কিছুই উৎপন্ন হয়না অথচ এ দু'ধরনের ভূমিই পাশাপাশি অবস্থিত। [দেখুন, ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর] এ বিভিন্ন ভূখণ্ডের সৃষ্টি এবং তাদের মধ্যে নানা প্রকার বিভিন্নতার অস্তিত্ব এত বিপুল পরিমান জ্ঞান ও কল্যাণে পরিপূর্ণ যে, তা গণনা করে শেষ করা যেতে পারে না। এ ভূখণ্ড লাল, অপরটি সাদা, কোনটি হলুদ, কোনটি কালো, কোনটি পাথুরে, কোনটি সমতল, কোনটি বালুময়, কোনটি দো-আঁশ, কোনটি মিহি, অথচ সবগুলোই পাশাপাশি। প্রতিটি তার গুণ ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে আছে। এসব কিছুই প্রমাণ করছে যে, একজন ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন ক্ষমতাধর সত্তা রয়েছেন যিনি এগুলো করেছেন। তিনিই একমাত্র ইলাহ, তাঁর কোন শরীক নেই। তিনিই একমাত্র রব, তিনি ব্যতীত আর কোন রব নেই। [ইবন কাসীর] তাছাড়া কোন কোন ভূমি পাশাপাশি নয় অথচ তাদের মধ্যে একই ধরণের শক্তি, যোগ্যতা পাওয়া যায়। এখানে ‘পাশাপাশি নয়’ এ কথাটি উহ্য থাকতে পারে। [ফাতহুল কাদীর]

[২] কিছু কিছু খেজুর গাছের মূল থেকে একটি খেজুর গাছ বের হয় আবার কিছু কিছুর মূল থেকে একাধিক গাছ বের হয়। [ফাতহুল কাদীর]

[৩] এ আয়াতে আল্লাহ্‌র তাওহীদ এবং তাঁর শক্তি ও জ্ঞানের নিদর্শনাবলী দেখানো ছাড়া আরো একটি সত্যের দিকেও সূক্ষ্ম ইশারা করা হয়েছে। এ সত্যটি হচ্ছে, আল্লাহ্ এ বিশ্ব-জাহানের কোথাও এক রকম অবস্থা রাখেননি। একই পৃথিবী কিন্তু এর ভূখণ্ডগুলোর প্রত্যেকের বর্ণ, আকৃতি ও বৈশিষ্ট্য আলাদা। একই জমি ও একই পানি, কিন্তু তা থেকে বিভিন্ন প্রকার ফল ও ফসল উৎপন্ন হচ্ছে। একই গাছ কিন্তু তার প্রত্যেকটি ফল একই জাতের হওয়া সত্বেও তাদের আকৃতি, আয়তন, স্বাদ, গন্ধ, রূপ ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ আলাদা। একই মূল থেকে দু’টি ভিন্ন গাছ বের হচ্ছে এবং তাদের প্রত্যেকেই নিজের একক বৈশিষ্টের অধিকারী। যে ব্যক্তি এসব বিষয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে সে অবশ্যই এতে একজন ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন সত্তার কার্য সক্রিয় আছে দেখতে পাবে। যিনি তার অসীম ক্ষমতায় এগুলোর মধ্যে পার্থক্য করেছেন। তিনি যেভাবে ইচ্ছা করেছেন সেভাবে সৃষ্টি করেছেন। এজন্যই আল্লাহ্ তা’আলা সবশেষে বলেছেন যে, নিশ্চয় বোধশক্তি সম্পন্ন লোকদের জন্য এতে রয়েছে প্রচুর নিদর্শন। [ইবন কাসীর]

[৪] বলা হচ্ছে, এই যে পরস্পর পাশাপাশি দু’টি ভূমিতে আল্লাহ্ তা'আলা বিভিন্ন প্রকার ফল-ফলাদি উৎপন্ন করেন, তন্মধ্যে একই ফল একই জমিতে একই পানি দ্বারা উৎপন্ন করি তারপরও সেটার স্বাদ দু'রকমের হয়। একটি মিষ্ট অপরটি টক। একটি অত্যন্ত উন্নতমানের অপরটি অনুন্নত পর্যায়ের। একটি চিত্তাকর্ষক অপরটি তেমন নয়। এসব কিছুতে কেউ চিন্তা, গবেষণা ও বিবেক খাটালে যে কেউ অবশ্যই মেনে নিতে বাধ্য হবে যে, এর বিভিন্নতার প্রকৃত কারণ এক মহান প্রজ্ঞাময় সত্তার শক্তি ছাড়া আর কিছু নয়। কেননা, সাধারণত: যে কারণে ফল-ফলাদিতে পার্থক্য সূচিত হয় তা দু’টি। এক. উৎপন্নস্থানের ভিন্নতা, দুই. পানির গড়মিল। কিন্তু যদি জমি ও পানি একই প্রকার হয়, তারপর যদি সেটাতে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থা ও ফল পরিলক্ষিত হয় তবে বিবেকবান মাত্রই এটা বলতে বাধ্য হবে যে, এটা সেই অপার শক্তি ও আশ্চর্যজনক কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত। [ফাতহুল কাদীর]

মুজাহিদ বলেন, এটা মূলত: আদম সন্তানদের জন্য একটি উদাহরণ, তাদের মধ্যে নেককার ও বদকার হয়েছে অথচ তাদের পিতা একজনই। হাসান বসরী বলেন, এ উদাহরণটি আল্লাহ্ তা'আলা আদম সন্তানদের হৃদয়ের জন্য পেশ করেছেন। কারণ, যমীন মহান আল্লাহ্র হাতে একটি কাদামাটির পিণ্ড ছিল। তিনি সেটাকে বিছিয়ে দিলেন, ফলে সেটা পরস্পর পাশাপাশি টুকরায় পরিণত হলো, তারপর তাতে আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হলো, ফলে তা থেকে বের হলো, ফুল, গাছ, ফল ও উদ্ভিদ। আর এ মাটির কোনটি হল খারাপ, লবনাক্ত ও অস্বচ্ছ। অথচ এগুলো সবই একই পানি দিয়ে সিক্ত হয়েছে। অনুরূপভাবে মানুষও আদম ‘আলাইহিস্ সালাম থেকে সৃষ্টি হয়েছে। অতঃপর আসমান থেকে তাদের জন্য স্মরণিকা (কিতাব) নাযিল হলো, কিছু অন্তর নরম হলো এবং বিনীত হলো, আর কিছু অন্তর কঠোর হলো এবং গাফেল হলো। হাসান বসরী বলেন, কুরআনের কাছে কেউ যখন বসে তখন সে সেখান থেকে বেশী বা কম কিছু না নিয়ে বের হয় না। আল্লাহ্ তা'আলা বলেন, “আর আমরা নাযিল করি কুরআন, যা মুমিনদের জন্য আরোগ্য ও রহমত, কিন্তু তা যালিমদের ক্ষতিই বৃদ্ধি করে" [সূরা আল-ইসরাঃ ৮২] এতে অবশ্যই বিবেকবানদের জন্য প্রচুর নিদর্শন রয়েছে। [বাগভী]

১৩ : ৩৭
وَكَذَٰلِكَ أَنْزَلْنَاهُ حُكْمًا عَرَبِيًّا ۚ وَلَئِنِ اتَّبَعْتَ أَهْوَاءَهُمْ بَعْدَمَا جَاءَكَ مِنَ الْعِلْمِ مَا لَكَ مِنَ اللَّهِ مِنْ وَلِيٍّ وَلَا وَاقٍ

আর এভাবেই [১] আমরা কুরআনকে নাযিল করেছি আরবী ভাষায় বিধানরূপে। আর জ্ঞান পাওয়ার পরও যদি আপনি তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করেন তবে আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে [২] আপনার কোন অভিভাবক ও রক্ষক থাকবে না [৩]।

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ যেভাবে আপনার পূর্বে আমরা অনেক নবী-রাসূল পাঠিয়েছি এবং আপনার পূর্বে যখনই প্রয়োজন মনে করেছি তখনই কিতাব পাঠিয়েছি সেভাবে আমরা আপনাকে রাসূল হিসেবে পাঠিয়েছি এবং আমরা আপনাকে কুরআন নামক গ্রন্থখানি দিয়েছি, তাকে আরবী ভাষায় নাযিল করেছি। [ইবন কাসীর; মুয়াসসার]

এ কিতাব আপনার উপর নাযিল করে আমি আপনাকে সম্মানিত করেছি এবং অন্যদের উপর আপনার শ্ৰেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছি। কারণ, এ কুরআনের বৈশিষ্ট্য অন্যগুলোর চেয়ে আলাদা। এটি এমন যে, “বাতিল এতে অনুপ্রবেশ করতে পারে না-সামনে থেকেও না, পিছন থেকেও না। এটা প্রজ্ঞাময়, স্বপ্রশংসিতের কাছ থেকে নাযিলকৃত।” [সূরা ফুসসিলাতঃ ৪২] [ইবন কাসীর]

অথবা আয়াতের অর্থ যেভাবে প্রত্যেক নবী ও রাসূলকে তাদের নিজস্ব ভাষায় কিতাব দিয়েছি তেমনি আপনাকে আরবী ভাষায় এ কুরআন প্রদান করলাম। [কুরতুবী]

[২] অর্থাৎ আল্লাহ্‌র শাস্তি ও পাকড়াও এর বিপরীতে আপনার কোন সাহায্যকারী থাকবে না। [মুয়াসসার]

[৩] তাদের খেয়ালখুশীর কোন শেষ নেই। তবে বিশেষ করে আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করা। [কুরতুবী] রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবশ্যই কারও খেয়াল-খুশী ও কোন মনগড়া মতের অনুসারী হতে পারেন না। এখানে রাসূলের উম্মতদেরকে সাবধান করা হচ্ছে। বিশেষ করে এ উম্মতের আলেম সম্প্রদায়কেই এখানে বেশী উদ্দেশ্য করা হয়েছে। তারা যেন আল্লাহ্‌র নির্দেশ, কুরআন ও সুন্নাহ বোঝার পর অন্য কোন কারণে সেটা বাস্তবায়ন করতে পিছপা না হয়। অন্য কোন মত ও পথের অনুসারী না হয়। অন্যথা তাদের পরিণাম হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের কোন সাহায্যকারী, উদ্ধারকারী ও অভিভাবক থাকবে না। [দেখুন, ইবন কাসীর]

১৩ : ৪৩
وَيَقُولُ الَّذِينَ كَفَرُوا لَسْتَ مُرْسَلًا ۚ قُلْ كَفَىٰ بِاللَّهِ شَهِيدًا بَيْنِي وَبَيْنَكُمْ وَمَنْ عِنْدَهُ عِلْمُ الْكِتَابِ

আর যারা কুফরী করেছে তারা বলে, তুমি আল্লাহ্র পাঠানো নও। বলুন, আল্লাহ্ এবং যাদের কাছে কিতাবের জ্ঞান আছে, তারা আমার ও তোমাদের মধ্যে সাক্ষী হিসেবে যথেষ্ট [১]।

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ আসমানী কিতাবের জ্ঞান রাখে এমন প্রত্যেক ব্যক্তি একথার সাক্ষ্য দেবে যে, যা কিছু আমি পেশ করেছি তা ইতিপূর্বে আগত নবীগণের শিক্ষার পুনরাবৃত্তি ছাড়া আর কিছুই নয় এবং আমি আল্লাহ্রই রাসূল। পবিত্র কুরআনের অন্যান্য স্থানেও আল্লাহ্ তা’আলা আহলে কিতাব তথা ইয়াহূদী ও নাসারাদের মধ্যে যারা সত্যনিষ্ঠ তাদেরকে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সত্যয়নকারীরূপে উল্লেখ করেছেন।

যেমন কুরআনে এসেছেঃ “আল্লাহ্ বললেন, ‘আমার শাস্তি যাকে ইচ্ছে দিয়ে থাকি আর আমার দয়া---তা তো প্রত্যেক বস্তুকে ঘিরে রয়েছে। কাজেই আমি তা নির্ধারিত করব তাদের জন্য যারা তাকওয়া অবলম্বন করে, যাকাত দেয় ও আমার নিদর্শনে ঈমান আনে। ‘যারা অনুসরণ করে বার্তাবাহক উম্মী নবীর, যাঁর উল্লেখ তাওরাত ও ইনজীল, যা তাদের কাছে আছে তাতে লিখিত পায়”। [সূরা আল-আ’রাফঃ ১৫৬-১৫৭]

আরও এসেছে, “বনী ইসরাঈলের পণ্ডিতগণ এ সম্পর্কে জানে---এটা কি তাদের জন্য নিদর্শন নয়?' [সূরা আস-শু’আরাঃ ১৯৭]

১৫ : ৫৩
قَالُوا لَا تَوْجَلْ إِنَّا نُبَشِّرُكَ بِغُلَامٍ عَلِيمٍ

তারা বলল, ‘ভয় করবেন না, আমরা আপনাকে এক জ্ঞানী পুত্রের সুসংবাদ দিচ্ছি [১]।’

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ ইসহাক আলাইহিস সালামের জন্মের সুসংবাদ। কারণ ইসমাঈল আলাইহিসসালাম এর পূর্বেই অন্য স্ত্রীর ঘরে দুনিয়ায় এসেছিলেন। [ইবন কাসীর]

১৬ : ১০
هُوَ الَّذِي أَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً ۖ لَكُمْ مِنْهُ شَرَابٌ وَمِنْهُ شَجَرٌ فِيهِ تُسِيمُونَ

তিনিই আকাশ থেকে বারি বর্ষণ করেন। তাতে তোমাদের জন্য রয়েছে পানীয় এবং তা থেকে জন্মায় উদ্ভিদ যাতে তোমরা পশু চারণ করে থাক [১]।

ফুটনোট

[১] পূর্বের আয়াতসমূহে আল্লাহ্‌ রাববুল আলামীন যমীনে যে সমস্ত প্রাণী চলাফেরা করে তাদেরকে মানুষের উপকারের জন্য সৃষ্টি করেছেন সে ঘোষণা দিয়েছেন। এখানে আকাশ থেকে বৃষ্টি নাযিল করার মাধ্যমে মানুষের কি উপকার সাধিত হয় সেটা বর্ণনা করছেন। [ইবন কাসীর] এর মধ্যে প্রথমেই হচ্ছে পানি। তিনি আকাশ থেকে যে পানি নাযিল করেন সেগুলোকে তিনি সুমিষ্ট করেছেন, লবনাক্ত করেন নি। [ইবন কাসীর] অনুরূপভাবে মানুষের জন্য বৃক্ষের ব্যবস্থা করেছেন। (شجر) শব্দটি প্রায়ই বৃক্ষ অর্থে ব্যবহৃত হয়, যা কাণ্ডের উপর দণ্ডায়মান থাকে। কোন কোন সময় এমন প্রত্যেক বস্তুকেও (شجر) বলা হয় যা ভূ-পৃষ্ঠে উৎপন্ন হয়। ঘাস, লতা-পাতা ইত্যাদিও এর অন্তর্ভুক্ত থাকে। আলোচ্য আয়াতে এ অর্থই বোঝানো হয়েছে। [কুরতুবী]

কেননা, এর পরেই জন্তুদের চলার কথা বলা হয়েছে। ঘাসের সাথেই এর বেশীর ভাগ সম্পর্ক। (تُسِيْمُوْنَ) শব্দটির অর্থ জন্তুকে চারণক্ষেত্রে চরার জন্য ছেড়ে দেয়া। [কুরতুবী; ইবন কাসীর] অর্থাৎ তোমাদের জন্য এমন গাছের ব্যবস্থা করেছেন যাতে তোমাদের জীব-জন্তু চরে বেড়াতে পারে। [ইবন কাসীর]

১৬ : ১১
يُنْبِتُ لَكُمْ بِهِ الزَّرْعَ وَالزَّيْتُونَ وَالنَّخِيلَ وَالْأَعْنَابَ وَمِنْ كُلِّ الثَّمَرَاتِ ۗ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَةً لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ

তিনি তোমাদের জন্য তা [১] দ্বারা জন্মান শস্য, যায়তূন, খেজুর গাছ, আঙ্গুর এবং সব রকমের ফল। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে নিদর্শন [২]।

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ একই পানি দিয়ে আল্লাহ তা'আলা বহু প্রকার ফল-ফলাদি, ভিন্ন ভিন্ন স্বাদে ও গন্ধে, ভিন্ন ভিন্ন আকৃতি ও প্রকৃতিতে উৎপন্ন করেন এটা নিশ্চয়ই এক বিস্ময়কর ব্যাপার। [এ ব্যাপারে আরো দেখুন সূরা আন-নামলঃ ৬০]

[২] এসব আয়াতে আল্লাহ্ তা'আলার নেয়ামত ও অভিনব রহস্য সহকারে জগত সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। যারা এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করে, তারা এমন সাক্ষ্য-প্রমাণ পায়, যার ফলে আল্লাহ্ তা'আলার তাওহীদ যেন চোখের সামনে ফুটে উঠে। এ কারণেই নেয়ামতগুলোর উল্লেখ করে বার বার এ বিষয়ের প্রতি হুশিয়ার করা হয়েছে। এ আয়াতের শেষে বলা হয়েছে যে,

এতে চিন্তাশীলদের জন্য প্রমাণ রয়েছে। কেননা, ফসল ও বৃক্ষ এসবের ফল ও ফুলের যে সম্পর্ক আল্লাহ্ তা'আলার কারিগরি ও রহস্যের সাথে রয়েছে তা কিছুটা চিন্তা-ভাবনার দাবী রাখে। মানুষের চিন্তা করা দরকার যে, শস্য কণা কিংবা আটি মাটির নিচে ফেলে রাখলে এবং পানি দিলে আপনা-আপনি বিরাট মহীরূহে পরিণত হতে পারে না এবং তা থেকে রঙ-বেরঙয়ের ফুল-ফল উৎপন্ন হতে পারে না। যা হয়, তাতে কোন কৃষক-ভূস্বামীর কর্মের দখল নেই। বরং সবই সর্বশক্তিমানের কারিগরি ও রহস্য। তিনি একই পানি দ্বারা সেগুলোকে উৎপন্ন করেন, অথচ সেগুলোর প্রকার, স্বাদ, গন্ধ, রং, প্রকৃতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এগুলো সবই প্রমান করছে যে, তিনি ছাড়া আর কোন সত্য ইলাহ নেই। [ইবন কাসীর] অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন,

“নাকি তিনি, যিনি সৃষ্টি করেছেন আসমানসমূহ ও যমীন এবং আকাশ থেকে তোমাদের জন্য বর্ষণ করেন বৃষ্টি, তারপর আমরা তা দ্বারা মনোরম উদ্যান সৃষ্টি করি, তার গাছ উদগত করার ক্ষমতা তোমাদের নেই। আল্লাহর সাথে অন্য কোন ইলাহ আছে কি? তবুও তারা এমন এক সম্প্রদায় যারা (আল্লাহর) সমকক্ষ নির্ধারণ করে " [সূরা আন-নামল: ৬০]

১৬ : ১২
وَسَخَّرَ لَكُمُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ ۖ وَالنُّجُومُ مُسَخَّرَاتٌ بِأَمْرِهِ ۗ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَعْقِلُونَ

আর তিনিই তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন রাত, দিন [১], সূর্য ও চাঁদকে; এবং নক্ষত্ররাজিও তাঁরই নির্দেশে নিয়োজিত। নিশ্চয় এতে বোধশক্তি সম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে অনেক নিদর্শন [২]।

ফুটনোট

[১] এ আয়াতে আল্লাহ্ তা'আলা তাঁর বান্দাদেরকে তাঁর কিছু নেয়ামত হিসেব করে দেখিয়ে দিচ্ছেন। [ইবন কাসীর] আল্লামা শানকীতী বলেন, এ আয়াতে আল্লাহ বর্ণনা করছেন যে, তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বৃহৎ নেয়ামত নিয়োজিত করেছেন। এগুলোতে যে বিরাট উপকারিতা রয়েছে সেটা তিনি ব্যতীত কেউ পুরোপুরি জানে না। বিবেকবানদের কাছে এগুলোই স্পষ্ট প্রমাণ দিচ্ছে যে, তিনি একজনই একমাত্র ইবাদাত পাওয়ার উপযুক্ত। সে পাঁচটি নেয়ামত হচ্ছে, রাত, দিন, সূর্য, চন্দ্র ও তারকা। কুরআনে বারবার এ নেয়ামতগুলোকে নিয়োজিত করার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে এগুলো উল্লেখ করে একমাত্র আল্লাহর ইবাদাতের প্রতি আহবান জানানো হয়েছে। যেমন,

“নিশ্চয় তোমাদের রব আল্লাহ্ যিনি আসমানসমূহ ও যমীন ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন ; তারপর তিনি আরশের উপর উঠেছেন। তিনিই দিনকে রাত দিয়ে ঢেকে দেন, তাদের একে অন্যকে দ্রুতগতিতে অনুসরণ করে। আর সূর্য, চাদ ও নক্ষত্ররাজি, যা তারই হুকুমের অনুগত, তা তিনিই সৃষ্টি করেছেন। জেনে রাখ, সৃজন ও আদেশ তাঁরই সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহ কত বরকতময় " [সূরা আল-আ’রাফ: ৫৪]

আরও বলেছেন, “আর তিনি তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন সূর্য ও চাঁদকে, যারা অবিরাম একই নিয়মের অনুবর্তী এবং তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন রাত ও দিনকে " [সূরা ইবরাহীম: ৩৩]

আরও বলেছেন, “আর তাদের জন্য এক নিদর্শন রাত, তা থেকে আমরা দিন অপসারিত করি, তখন তারা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। আর সূর্য ভ্রমণ করে তার নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে, এটা পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞের নিয়ন্ত্রণ। আর চাঁদের জন্য আমরা নির্দিষ্ট করেছি বিভিন্ন মনযিল; অবশেষে সেটা শুষ্ক বাকা, পুরোনো খেজুর শাখার আকারে ফিরে যায়।” [সূরা ইয়াসীন: ৩৭-৩৯]

আরও বলেন, “আমরা নিকটবতী আসমানকে সুশোভিত করেছি প্রদীপমালা দ্বারা এবং সেগুলোকে করেছি শয়তানের প্রতি নিক্ষেপের উপকরণ এবং তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছি জ্বলন্ত আগুনের শাস্তি " [সূরা আল-মুলক: ৫]

অন্য আয়াতে বলেছেন, "আর তারা নক্ষত্রের সাহায্যেও পথনির্দেশ পায়” [সূরা আন-নাহল: ১৬] [আদওয়াউল বায়ান]

[২] এখানে বলা হয়েছে যে, দিনরাত ও তারকারাজি আল্লাহ তা'আলার নির্দেশের অনুগত হয়ে চলে। শেষে বলা হয়েছে যে, এগুলোর মধ্যে বুদ্ধিমানদের জন্য অনেক প্রমাণ রয়েছে। যারা আল্লাহ যে সমস্ত ব্যাপারে সাবধান করতে চেয়েছেন সেগুলো বুঝে, যাদেরকে আল্লাহ সেটা বুঝার তাওফীক দিয়েছেন তাদের জন্য এতে আল্লাহর প্রচণ্ড ক্ষমতা ও অপার শক্তির অনেক নিদর্শন রয়েছে। [কুরতুবী; ইবন কাসীর]

১৬ : ১৩
وَمَا ذَرَأَ لَكُمْ فِي الْأَرْضِ مُخْتَلِفًا أَلْوَانُهُ ۗ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَةً لِقَوْمٍ يَذَّكَّرُونَ

আর তিনি তোমাদের জন্য যমীনে যা সৃষ্টি করেছেন, বিচিত্র রঙের করে, নিশ্চয় তাতে সে সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে, যারা উপদেশ গ্রহন করে [১]।

ফুটনোট

[১] আসমানের বিভিন্ন চিহ্ন ও নিদর্শনাবলীর প্রতি দৃষ্টি দেয়ার আহবান জানানোর পর এখানে মাটিতে যে আশ্চর্যজনক বিষয়াদি ও বিভিন্ন বস্তু রয়েছে যেমন, জীবজন্তু, খনিজসম্পদ, উদ্ভিদরাজি ও নিশ্চল রং-বেরং এর ও বিভিন্ন প্রকৃতির সৃষ্টিসমূহ রয়েছে, সেগুলোর যে উপকারসমূহ ও বৈশিষ্ট্যসমূহ রয়েছে এর মধ্যে অবশ্যই তাদের জন্য প্রমাণ রয়েছে, যারা উপদেশ গ্রহণ করে। যারা আল্লাহর নেয়ামতসমূহ স্মরণ করে এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চায়। [ইবন কাসীর]

১৬ : ১৪
وَهُوَ الَّذِي سَخَّرَ الْبَحْرَ لِتَأْكُلُوا مِنْهُ لَحْمًا طَرِيًّا وَتَسْتَخْرِجُوا مِنْهُ حِلْيَةً تَلْبَسُونَهَا وَتَرَى الْفُلْكَ مَوَاخِرَ فِيهِ وَلِتَبْتَغُوا مِنْ فَضْلِهِ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ

আর তিনিই সাগরকে নিয়োজিত করেছেন [১] যাতে তোমরা তা থেকে তাজা (মাছের) গোশত খেতে পার এবং যাতে তা থেকে আহরণ করতে পার রত্নাবলী যা তোমরা ভূষণরূপে পরে থাক [২]; এবং তোমরা দেখতে পাও, তার বুক চিরে নৌযান চলাচল করে [৩] এবং এটা এ জন্যে যে, তোমরা যেন তাঁর অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার এবং তোমরা যেন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর;

ফুটনোট

[১] নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সৃষ্টবস্তু এবং এগুলোতে মানুষের উপকার বর্ণনা করার পর এখন সমুদ্রগর্ভে মানুষের উপকারের জন্য কি কি নিহিত রয়েছে, সেগুলো বর্ণনা করা হচ্ছে। সমুদ্রে মানুষের খাদ্যের চমৎকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখান থেকে মানুষ টাটকা গোশত লাভ করে। [দেখুন, ইবন কাসীর]

[২] এটা সমুদ্রের দ্বিতীয় উপকার। ডুবুরীরা সমুদ্র থেকে মূল্যবান অলঙ্কার সামগ্ৰী বের করে আনে। (حِلْيَةً) এর শাব্দিক অর্থ শোভা, সৌন্দর্য। এখানে ঐসব রত্নরাজি ও মণিমুক্তা বোঝানো হয়েছে, যা সমুদ্রগর্ভ থেকে নির্গত হয় এবং মহিলারা এর দ্বারা অলঙ্কার তৈরী করে বিভিন্ন পন্থায় ব্যবহার করে। এ অলঙ্কার মহিলারা পরিধান করে থাকে; কিন্তু কুরআন পুংলিঙ্গ শব্দ ব্যবহার করে (تَلْبَسُوْنَهَا) বলেছে। এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, মহিলাদের অলঙ্কার পরিধান করা প্রকৃতপক্ষে পুরুষদের দেখার স্বার্থে। [ফাতহুল কাদীর]

[৩] এটা সমুদ্রের তৃতীয় উপকার। (فُلْكَ) শব্দের অর্থ নৌকা। (مَوَاخِرَ) শব্দটি (ماخرة) এর বহুবচন। (مخر) এর অর্থ পানি ভেদ করা। অর্থাৎ ঐসব নৌকা ও সামুদ্রিক জাহাজ, যেগুলো পানির ঢেউ ভেদ করে পথ অতিক্রম করে। [ফাতহুল কাদীর] আয়াতের উদ্দেশ্য এই যে,
আল্লাহ্ তা'আলা সমুদ্রকে দূর-দূরান্তের দেশে সফর করার রাস্তা করেছেন এবং দূর-দূরান্তে সফর করা ও পণ্যদ্রব্য আমদানী-রপ্তানী করা সহজ করে দিয়েছেন। একে জীবিকা উপার্জনের একটি উত্তম উপায় সাব্যস্ত করেছেন। কেননা, সমুদ্রপথের ব্যবসা-বাণিজ্য করা সর্বাধিক লাভজনক।

১৬ : ১৫
وَأَلْقَىٰ فِي الْأَرْضِ رَوَاسِيَ أَنْ تَمِيدَ بِكُمْ وَأَنْهَارًا وَسُبُلًا لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ

আর তিনি যমীনে সুদৃঢ় পর্বত স্থাপন করেছেন, যাতে যমীন তোমাদের নিয়ে হেলে না যায় [১] এবং স্থাপন করেছেন নদ-নদী ও পথসমূহ, যাতে তোমরা তোমাদের গন্তব্যস্থলে পৌছতে পার [২];

ফুটনোট

[১] (رَوَاسِيَ) শব্দটি (رٰاسِيَة) এর বহুবচন। এর অর্থ ভারী পাহাড়। (تَمِيْدَ) শব্দটি (ميد) থেকে উদ্ভুত। এর অর্থ আন্দোলিত হওয়া এবং অস্থিরভাবে টলমল করা। [ফাতহুল কাদীর] আয়াতের অর্থ এই যে, আল্লাহ্ তা'আলা অনেক রহস্যের অধীনে ভূ-মণ্ডলকে নিবিড় ও ভারসাম্যবিহীন উপাদান দ্বারা সৃষ্টি করেননি। তাই এটা কোন দিক দিয়ে ভারী এবং কোন দিক দিয়ে হান্ধা হয়েছে। অন্যথায় এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ছিল, ভূ-পৃষ্ঠের অস্থিরভাবে আন্দোলিত হওয়া। এই অস্থিরতাজনিত নড়াচড়া বন্ধ করা এবং পৃথিবীর উৎপাদনকে ভারসাম্যপূর্ণ করার জন্য আল্লাহ্ তা'আলা পৃথিবীতে পাহাড়ের ওজন স্থাপন করেন- যাতে পৃথিবী অস্থিরভাবে নড়াচড়া করতে না পারে। তাই এখানে (اَنْ تَمِيْدَ) এর পূর্বে (كَرٰاهِيَة) বা (اِنْ) এর পরে (لا) শব্দটি উহ্য ধরে নিয়ে অর্থ করতে হবে। [ফাতহুল কাদীর] এ আয়াত থেকে জানা যায়,

ভূপৃষ্ঠে পর্বত শ্রেণী স্থাপনের উপকারিতা হচ্ছে, এর ফলে পৃথিবীর আবর্তন ও গতি সুষ্ঠ ও সুশৃংখল হয়। কুরআন মজীদের বিভিন্ন জায়গায় পাহাড়ের এ উপকারিতা সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি, পাহাড়ের অন্য যে সমস্ত উপকারিতা আছে সেগুলো একেবারেই গৌণ। মূলত মহাশূন্যে আবর্তনের সময় পৃথিবীকে আন্দোলিত হওয়া থেকে রক্ষা করাই ভূপৃষ্ঠে পাহাড় স্থাপন করার মুখ্য উদ্দেশ্য। [আত-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর]

[২] অর্থাৎ নদ-নদীর সাথে যে পথ তৈরী হয়ে যেতে থাকে। বিশেষ করে পার্বত্য এলাকাসমূহে এসব প্রাকৃতিক পথের গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। অবশ্যি সমতল ভূমিতেও এগুলোর গুরুত্ব কম নয়। উপরে বাণিজ্যিক সফরের কথা বলা হয়েছে। তাই এসব সুযোগ-সুবিধার কথা এখানেও সমীচীন মনে হয়েছে, যেগুলো আল্লাহ তা'আলা পথিকদের পথ অতিক্রম ও মন্যিলে-মকসুদে পৌছার জন্য ভূ-মণ্ডল ও নভোমণ্ডলে সৃষ্টি করেছেন। তাই পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে (وَعَلامَاتٍ) অর্থাৎ আমি পৃথিবীতে রাস্তা চেনার জন্য পাহাড়, নদী, বৃক্ষ, দালান-কোঠা ইত্যাদির সাহায্যে অনেক চিহ্ন স্থাপন করেছি। [ইবন কাসীর] বলাবাহুল্য, ভূ-পৃষ্ঠ যদি একটি চিহ্নবিহীন পরিমণ্ডল হতো তবে মানুষ কোন গন্তব্যস্থানে পৌছার জন্য পথিমধ্যে কতই না ঘুরপাক খেত।

১৬ : ১৬
وَعَلَامَاتٍ ۚ وَبِالنَّجْمِ هُمْ يَهْتَدُونَ

এবং পথ নির্দেশক চিহ্নসমূহও। আর তারা নক্ষত্রের সাহায্যে পথনির্দেশ পায় [১]।

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ দিনের বেলায় পথ খুঁজে পাওয়ার জন্য তিনি যেমন কিছু নিদর্শন রেখেছেন, তেমনি রাতের বেলায় পথ খুঁজে পাওয়ার জন্য রেখেছেন তারকাসমূহ। দিনের বেলায় বিভিন্ন নিদর্শন দেখে আর রাতের বেলায় তারকাদের অবস্থান দৃষ্টে মানুষ বলতে পারে যে, তার গন্তব্যস্থল কোথায় হতে পারে। [জালালাইন, মুয়াসসার] আল্লাহ সমগ্র যমীনকে একই ধারায় সৃষ্টি করেননি। বরং প্রত্যেকটি এলাকাকে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য দ্বারা চিহ্নিত করেছেন। এর অন্যান্য উপকারিতার মধ্যে একটি অন্যতম উপকারিতা হচ্ছে এই যে, মানুষ নিজের পথ ও গন্তব্য আলাদাভাবে চিনে নেয়। সুতরাং তারকারাজি সৃষ্টি করার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে, রাস্তার পরিচয় লাভ। এগুলোর দ্বারা কোন প্রকার ভাগ্য বা সৃষ্টিজগতের পরিচালনার নিয়ম-কানুন নির্ধারণ করা কুফরী। কাতাদা রাহেমাহুল্লাহ বলেনঃ আল্লাহ্ তা'আলা এ তারকাসমূহ তিনটি কারণে সৃষ্টি করেছেন, আকাশের সৌন্দর্য, শয়তানদের বিতাড়নকারী এবং কিছু আলামত যা দ্বারা পথের দিশা পাওয়া সম্ভব হয়। সুতরাং যে কেউ এর বাইরে অন্য কিছু দিয়ে এগুলোর ব্যাখ্যা করবে সে অবশ্যই ভুল করবে, তার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে, এবং এমন বস্তুর পিছনে অযথা দৌড়াবে যার ব্যাপারে তার কোন জ্ঞান নেই। [বুখারীঃ ৬/৩৪১]

১৬ : ২৭
ثُمَّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يُخْزِيهِمْ وَيَقُولُ أَيْنَ شُرَكَائِيَ الَّذِينَ كُنْتُمْ تُشَاقُّونَ فِيهِمْ ۚ قَالَ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ إِنَّ الْخِزْيَ الْيَوْمَ وَالسُّوءَ عَلَى الْكَافِرِينَ

পরে কিয়ামতের দিন তিনি তাদেরকে লাঞ্ছিত করবেন [১] এবং তিনি বলবেন, কোথায় আমার সেসব শরীক [২] যাদের সম্বন্ধে তোমরা ঘোর বিতণ্ডা করতে? যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছিল তারা বলবে [৩], আজ লাঞ্ছনা ও অমঙ্গল কাফিরদের উপর--

ফুটনোট

[১] তাদের গোপন ষড়যন্ত্রসমূহ ফাঁস করে দিয়ে তাদেরকে লজ্জিত করবেন। অনুরূপ কথা সূরা আত-তারেক এর ৯ নং আয়াতে উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, "যে দিন গোপন তথ্যসমূহ ফাঁস করে দেয়া হবে সেদিন তাদের কোন শক্তি বা সাহায্যকারী থাকবে না”। অথচ তারা দুনিয়াতে এ শক্তি-সামর্থ্য ও সাহায্যকারীর কারণে গর্ব ও অহংকার করে বেড়াত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন প্রত্যেক গাদ্দার তথা বিশ্বাসঘাতকের পিছনের অংশে তার বিশ্বাসঘাতকতার পরিমাণ একটি পতাকা লাগিয়ে দেয়া হবে। তাতে বলা থাকবেঃ এটা অমুকের পুত্র অমুকের গাদ্দারীর প্রমাণপত্ৰ”। [বুখারী: ৩১৮৭; মুসলিম:১৭৩৬]

এভাবে আল্লাহ্ তাআলা প্রত্যেক ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্তকারী ও ধোঁকাবাজের যাবতীয় গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়ে তাকে অপমানিত করবেন।

[২] এখানে শরীকদেরকে আল্লাহ তা'আলা তাঁর নিজের দিকে সম্পর্কযুক্ত করার মূল কারণ হচ্ছে ধমকি প্রদান। কারণ, সেদিন আল্লাহ তা'আলার সম্মান, প্রতিপত্তি ও মর্যাদা সবাই সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারবে। আর তখন প্রত্যেকেই বুঝতে পারবে যে, আল্লাহর সাথে যে শরীক নির্ধারণ করেছিলাম তা ছিল বোকামী। [আত-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর]

[৩] এখানে আল্লাহর দ্বীনের জ্ঞানীদের সম্মানিত করা হয়েছে। যখন কাফেরদের বিরুদ্ধে সমস্ত দলীল-প্রমাণাদি স্থাপন করা শেষ হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর আযাবের বাণী প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে, আর কাফেররা ওজর আপত্তি করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে, তখন জানবে যে, তাদের পালানোর কোন জায়গা নেই। তখন দ্বীনের জ্ঞানীরা এ কথা বলবে। তারা বলবে, আজ লাঞ্ছনা ও অমঙ্গল কাফিরদের উপর— [ইবন কাসীরা] তারা হলো আল্লাহর দ্বীন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানী। যারা দুনিয়াতে হক্ক কথা বলতে কখনো পিছপা হতো না তারা আখেরাতেও হক্ক কথা বলার সুযোগ পাবে। এটা তাদের জন্য বড় সম্মানের বিষয়। [ইবন কাসীর]

১৬ : ৫৬
وَيَجْعَلُونَ لِمَا لَا يَعْلَمُونَ نَصِيبًا مِمَّا رَزَقْنَاهُمْ ۗ تَاللَّهِ لَتُسْأَلُنَّ عَمَّا كُنْتُمْ تَفْتَرُونَ

আর আমরা তাদেরকে যে রিযক দান করি তারা তার এক অংশ নির্ধারণ করে [১] তাদের জন্য যাদের সম্বন্ধে তারা কিছুই জানে না [২]। শপথ আল্লাহ্‌র! তোমরা যা মিথ্যা উদ্ভাবন কর সে সম্পর্কে অবশ্যই তোমাদেরকে প্রশ্ন করা হবে।

ফুটনোট

[১] এ আয়াতে আল্লাহ্ তা'আলা মুশরিকদের ঘৃণ্যতম আচরণের বর্ণনা দিচ্ছেন, যারা আল্লাহর সাথে মূর্তি, দেবতা, সমকক্ষের ইবাদত করে থাকে। তারা আল্লাহর দেয়া রিযিকের একাংশ তাদের সেসব প্রতিমা, মূর্তির জন্য নির্ধারণ করে “নিজেদের ধারণা অনুযায়ী বলে, ‘এটা আল্লাহর জন্য এবং এটা আমাদের শরীকদের জন্য।‘ অতঃপর যা তাদের শরীকদের অংশ তা আল্লাহর কাছে পৌছায় না এবং যা আল্লাহর অংশ তা তাদের শরীকদের কাছে পৌছায়, তারা যা মীমাংসা করে তা নিকৃষ্ট!” [সূরা আল-আন’আম: ১৩৬]

অর্থাৎ তাদের জন্য নযরানা, ভেট ও অর্ঘ্য পেশ করার উদ্দেশ্যে নিজেদের উপার্জন ও কৃষি উৎপাদনের একটি নির্দিষ্ট অংশ তাদের উপাস্যদের জন্য আলাদা করে রাখতো। তারপর আল্লাহর অংশের উপর সেগুলোকে প্রাধান্য দিত। তাই আল্লাহ তা'আলা নিজের আত্মার শপথ করে বলছেন যে, অবশ্যই তিনি তাদেরকে তাদের এ মিথ্যাচারের জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। [ইবন কাসীর]

[২] যে তারা কোন লাভ কিংবা ক্ষতি করতে পারে। [তাবারী] অথবা আয়াতের অর্থ, আর তারা এমনসব উপাস্যদের জন্য আল্লাহর দেয়া রিযিকের অংশ নির্ধারণ করে রাখে, যারা তাদের এ অংশ রাখা সম্পর্কে কিছুই জানে না। [সা’দী; মুয়াসসার] অথবা, তারা এমন সব উপাস্যের জন্য রিযিকের কিছু অংশ নির্ধারণ করে রাখে যাদের বাস্তবতা সম্পর্কে তাদের কোন জ্ঞান নেই। [কুরতুবী; ফাতহুল কাদীর]

১৬ : ৭০
وَاللَّهُ خَلَقَكُمْ ثُمَّ يَتَوَفَّاكُمْ ۚ وَمِنْكُمْ مَنْ يُرَدُّ إِلَىٰ أَرْذَلِ الْعُمُرِ لِكَيْ لَا يَعْلَمَ بَعْدَ عِلْمٍ شَيْئًا ۚ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ قَدِيرٌ

আর আল্লাহ্‌ই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন; তারপর তিনি তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন এবং তোমাদের মধ্যে কাউকে প্রত্যাবর্তিত [১] করা হবে নিকৃষ্টতম বয়সে [২]; যাতে জ্ঞান লাভের পরেও তার সবকিছু অজানা হয়ে যায়। নিশ্চয় আল্লাহ্‌ সর্বজ্ঞ, পূর্ণ ক্ষমতাবান [৩]।

ফুটনোট

[১] এখানে আল্লাহ তা'আলা তার বান্দাদের মধ্যে তাঁর কর্মকাণ্ড কিভাবে সম্পন্ন করেন সেটা বর্ণনা করছেন। তিনিই তাদেরকে অস্তিত্বহীন অবস্থা থেকে অস্তিত্ব দিয়েছেন। তারপর তাদেরকে মৃত্যু প্রদান করেন। তাদের মধ্যে আবার কাউকে বৃদ্ধাবস্থায় উপনীত হওয়া পর্যন্ত ছাড় দেন। যেমন, অন্য আয়াতেও বলেছেন, “আল্লাহ্‌, তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেন দুর্বলতা থেকে, দুর্বলতার পর তিনি দেন শক্তি ; শক্তির পর আবার দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য। তিনি যা ইচ্ছে সৃষ্টি করেন এবং তিনিই সর্বজ্ঞ, সর্বক্ষম " [সূরা আর-রূম: ৫৪][ইবন কাসীর]

এখানে (مَّنْ يُّرَدُّ) শব্দ দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, পূর্বেও মানুষের উপর দিয়ে এক প্রকার দুর্বলতা ও শক্তিহীনতার যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে। সেটা ছিল তার প্রাথমিক শৈশবের যুগ। তখন সে কোনরূপ জ্ঞান-বুদ্ধির অধিকারী ছিল না। তার হস্তপদ ছিল দুর্বল ও অক্ষম। সে ক্ষুধা-তৃষ্ণা নিবারণ করতে এবং উঠা-বসা করতে অপরের মুখাপেক্ষী ছিল। এরপর আল্লাহ তা'আলা তাকে যৌবন দান করেছেন। এটা ছিল তার উন্নতির যুগ। এরপর ক্রমান্বয়ে তাকে বার্ধক্যের স্তরে পৌছে দেন। এ স্তরে তাকে দুর্বলতা, শক্তিহীনতা ও ক্ষয়ের ঐ সীমায় প্রত্যাবর্তিত করা হয়, যা ছিল শৈশবে। আল্লাহ্ তা'আলা অন্যত্র বলেন,

“অবশ্যই আমরা সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতম গঠনে, তারপর আমরা তাকে হীনতাগ্রস্তদের হীনতমে পরিণত করি--- " [সূরা আত-তীন: ৪-৫][দেখুন, ফাতহুল কাদীর]

[২] (اَرْذَلِ الْعُمُرِ) বলে বার্ধক্যের সে বয়স বোঝানো হয়েছে, যাতে মানুষের দৈহিক ও মানসিক শক্তি নিস্তেজ হয়ে পড়ে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ বয়স থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করে বলতেনঃ

(اَللّٰهُمَّ اِنِّىْ اَعُوْذُبِكَ مِنْ سُوْءِالْعُمُرِ، وفي رواية: مِنْ اَنْ اُرَدَّ اِلٰى اَرْذَلِ الْعُمُرِ)

অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমি মন্দ বয়স থেকে আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করি। অন্য এক রেওয়ায়েতে আছেঃ অকৰ্মণ্য বয়সে ফিরিয়ে দেয়া থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি। [বুখারীঃ ৪৭০৭] (اَرْذَلِ الْعُمُرِ) এর নির্দিষ্ট কোন সংখ্যা নেই। তবে উল্লেখিত সংজ্ঞাটি অগ্রগণ্য মনে হয়। কুরআনও এর প্রতি

(لِكَيْ لَا يَعْلَمَ بَعْدَ عِلْمٍ شَـيْــــئًا)

বলে ইঙ্গিত করেছে। অর্থাৎ যে বয়সে হুশ-জ্ঞান অবশিষ্ট না থাকে। ফলে জানা বিষয়ও ভুলে যায়। [ফাতহুল কাদীর]

[৩] নিশ্চয় আল্লাহ মহাজ্ঞানী, মহাশক্তিশালী। তিনি জ্ঞান দ্বারা প্রত্যেকের বয়স জানেন এবং শক্তি দ্বারা যা চান, করেন। তিনি ইচ্ছা করলে শক্তিশালী যুবকের উপর অকৰ্মণ্য বয়সের লক্ষণাদি চাপিয়ে দেন এবং ইচ্ছা করলে একশ’ বছরের বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তিকেও শক্ত সমর্থ যুবক করে রাখেন। এসবই লা-শরীক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলার ক্ষমতাধীন।

১৭ : ৩৬
وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ ۚ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَٰئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا

আর যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই তার অনুসরণ করো না [১]; কান, চোখ, হৃদয়- এদের প্রত্যেকটি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে [২]।

ফুটনোট

[১] আয়াতে উল্লেখিত وَلَاتَقفُ শব্দটির সঠিক অর্থ, পিছু নেয়া, অনুসরণ করা। [ফাতহুল কাদীর] সে অনুসারে আয়াতের অর্থ হবে যে বিষয়ে তুমি জাননা সে বিষয়ের পিছু নিওনা। [ফাতহুল কাদীর] ইবন আব্বাস বলেন, এর অর্থ হচ্ছে, বলো না। অপর বর্ণনায় তিনি বলেছেন, যে বিষয় সম্পর্কে তোমার জ্ঞান নেই সে বিষয়ে কাউকে অভিযুক্ত করো না। কাতাদাহ বলেন, যা দেখনি তা বলো না। মুহাম্মাদ ইবনুল হানফিয়া বলেন, মিথ্যা সাক্ষ্য দিও না। [ইবন কাসীর] মোটকথা: যে বিষয় জ্ঞান নেই সে বিষয়ে কথা বলাকে পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে সবচেয়ে বড় গুনাহের মধ্যে গণ্য করা হয়েছে। বলা হয়েছে, “নিশ্চয়ই আমার প্রতিপালক হারাম করেছেন প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীলতা আর পাপ এবং অসংগত বিরোধিতা এবং কোন কিছুকে আল্লাহর শরীক করা---যার কোন সনদ তিনি পাঠাননি, এবং আল্লাহ সম্বন্ধে এমন কিছু বলা যা তোমরা জান না। ” [আল-আরাফঃ ৩৩]

অনুরূপভাবে ধারণা করে কথা বলাও এর অন্তর্ভুক্ত। কুরআন ও হাদীসের বিভিন্ন বর্ণনায় ধারনা করে কথা বলা সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। মহান আল্লাহ বলেন, “তোমরা বিবিধ ধারনা করা থেকে বেঁচে থাক; কেননা কোন কোন ধারনা করা গুনাহের পর্যায়ে পড়ে "[সূরা আল-হুজুরাতঃ ১২]

হাদীসে এসেছে, “তোমরা ধারনা করা থেকে বেঁচে থাক; কেননা ধারনা করে কথা বলা মিথ্যা কথা বলা ৷”[ বুখারীঃ ৫১৪৩, মুসলিমঃ ২৫৬৩]

[২] এ আয়াতের দু'টি অর্থ করা হয়ে থাকেঃ

এক, কেয়ামতের দিন কান, চক্ষু ও অন্তঃকরণ সম্পর্কে তার মালিককে প্রশ্ন করা হবেঃ প্রশ্ন করা হবেঃ তুমি সারা জীবন কি কি শুনেছ? প্রশ্ন করা হবেঃ তুমি সারা জীবন কি কি দেখেছ? প্রশ্ন করা হবেঃ সারা জীবনে মনে কি কি কল্পনা করেছ এবং কি কি বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করেছ? যদি শরীআত বিরোধী কাজ কর্ম করে থাকে, তবে এর জন্য সে ব্যক্তিকে আযাব ভোগ করতে হবে। [ফাতহুল কাদীর]

দুই, কেয়ামতের দিন প্রত্যেক ব্যক্তির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এ ব্যাপারে স্বয়ং সাক্ষ্য দেবে। কারণ আল্লাহ সেগুলোকে প্রশ্ন করবেন। এটা হাশরের ময়দানে গুনাহগারদের জন্য অত্যন্ত লাঞ্ছনার কারণ হবে। সূরা ইয়াসীনে বলা হয়েছেঃ “আজ (কেয়ামতের দিন)। আমি এদের (অপরাধীদের) মুখ মোহর করে দেব। ফলে, তাদের হাত আমার সাথে কথা বলবে এবং তাদের চরণসমূহ সাক্ষ্য দেবে তাদের কৃতকর্মের" [৬৫]। অনুরূপভাবে সূরা আন-নূরে এসেছে, "যেদিন তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে তাদের জিহবা, তাদের হাত ও তাদের পা তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে [২৪]।

১৭ : ৬০
وَإِذْ قُلْنَا لَكَ إِنَّ رَبَّكَ أَحَاطَ بِالنَّاسِ ۚ وَمَا جَعَلْنَا الرُّؤْيَا الَّتِي أَرَيْنَاكَ إِلَّا فِتْنَةً لِلنَّاسِ وَالشَّجَرَةَ الْمَلْعُونَةَ فِي الْقُرْآنِ ۚ وَنُخَوِّفُهُمْ فَمَا يَزِيدُهُمْ إِلَّا طُغْيَانًا كَبِيرًا

আর স্মরণ করুন, যখন আমরা আপনাকে বলেছিলাম যে, নিশ্চয় আপনার রব মানুষকে পরিবেষ্টন করে আছেন [১]। আর আমরা যে দৃশ্য আপনাকে দেখিয়েছি তা [২] এবং কুরআনে উল্লেখিত অভিশপ্ত গাছটিও [৩] শুধু মানুষের জন্য ফিতনাস্বরূপ [৪] নির্ধারণ করেছি। আর আমরা তাদেরকে ভয় দেখাই, কিন্তু এটা তাদের ঘোর অবাধ্যতাই বৃদ্ধি করে।

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ আপনার নবুওয়াতী দাওয়াতের সূচনালগ্নেই যখন মক্কার এ কাফেররা আপনার বিরোধিতা করতে এবং আপনার পথে প্রতিবন্ধকতা দাঁড় করাতে শুরু করেছিল তখনই আমি পরিষ্কার ভাষায় ঘোষণা করেছিলাম, আমি এ লোকদেরকে ঘিরে রেখেছি, এরা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে দেখে নিক, কোন ভাবেই এরা আপনার দাওয়াতের পথ রোধ করতে পারবে না এবং আপনি যে কাজে হাত দিয়েছেন সব রকমের বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও সে কাজ সম্পন্ন হবেই। অথবা আয়াতের অর্থ, আপনি দাওয়াত দিতে থাকুন, তারা আপনার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। কারণ, তারা সবাই আল্লাহর আয়ত্ত্বাধীন। [ইবন কাসীর] আল্লাহ বিরোধীদেরকে ঘিরে রেখেছেন এবং নবীর দাওয়াত আল্লাহর হেফাজতে রয়েছে-একথা মক্কার প্রাথমিক যুগের সূরাগুলোতে বিভিন্ন জায়গায় বলা হয়েছে। যেমন সূরা বুরুজে বলা হয়েছেঃ “কিন্তু এ কাফেররা মিথ্যা বলার ও অস্বীকার করার কাজে লেগেই আছে এবং আল্লাহ সবদিক থেকে তাদেরকে ঘেরাও করে রেখেছেন"। [১৯-২০] এর জন্য আরো দেখুন, সূরা আল-বাকারাহঃ ১৯, সূরা ফুসসিলাতঃ ৫৪ ৷

[২] এ আয়াতে সংখ্যাগরিষ্ঠ তফসীরবিদদের মতে الرؤيا (স্বপ্ন) বলে رؤية (দেখা) বোঝানো হয়েছে। যা ইসরা ও মি'রাজের রাত্ৰিতে সংঘটিত হয়েছিল। [ইবন কাসীর]

[৩] অর্থাৎ “যাক্কুম”। এ সম্পর্কে কুরআনে খবর দেয়া হয়েছে, এ গাছটি জাহান্নামের তলদেশে উৎপন্ন হবে এবং জাহান্নামীদের তা খেতে হবে। একে অভিশপ্ত করার মানে হচ্ছে এই যে, যারা এ গাছ থেকে খাবে তারা অভিশপ্ত হবে। [ফাতহুল কাদীর] যেমন অন্য সূরায় বলা হয়েছে, “নিশ্চয় যাক্কুম গাছ হবে, পাপীর খাদ্য" [সূরা আদ-দোখান: ৪৩-৪৪]

[৪] অর্থাৎ মি'রাজের রাত্ৰিতে যে দৃশ্যাবলী আমি আপনাকে দেখিয়েছিলাম, তা মানুষের জন্য একটি ফেতনা ছিল। আরবী ভাষায় ‘ফেতনা’ শব্দটি অনেক অর্থে ব্যবহৃত হয়। এর এক অর্থ গোমরাহী। আরেক অর্থ পরীক্ষাও হয় এবং অন্য এক অর্থ হাঙ্গামা ও গোলযোগ। এখানে সব অর্থের সম্ভাবনা বিদ্যমান। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা, সুফিয়ান, হাসান, মুজাহিদ রাহে মাহুমুল্লাহ প্রমুখ বলেনঃ এটা ছিল ধর্মত্যাগের ফেতনা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন শবে-মে'রাজে বায়তুল-মুকাদ্দাস, সেখান থেকে আকাশে যাওয়ার এবং প্রত্যুষের পূর্বে ফিরে আসার কথা প্রকাশ করলেন, তখন কোন কোন অপক্ক নও মুসলিম মুরতাদ হয়ে যাবার অবস্থায় পড়ে গিয়েছিল। [তাবারী; ফাতহুল কাদীর]

১৭ : ৮৫
وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الرُّوحِ ۖ قُلِ الرُّوحُ مِنْ أَمْرِ رَبِّي وَمَا أُوتِيتُمْ مِنَ الْعِلْمِ إِلَّا قَلِيلًا

আর আপনাকে তারা রূহ সম্পর্কে প্রশ্ন করে [১]। বলুন, ‘রূহ আমার রবের আদেশঘটিত [২] এবং তোমাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে অতি সামান্যই।

ফুটনোট

দশম রুকু’

[১] এ আয়াতে রূহ সম্পর্কে কাফেরদের পক্ষ থেকে একটি প্রশ্ন এবং আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে এর জওয়াব উল্লেখিত হয়েছে। রূহ শব্দটি অভিধান, বাকপদ্ধতি এবং কুরআনে একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রসিদ্ধ ও সুবিদিত অর্থ তাই, যা এ শব্দ থেকে সাধারণভাবে বোঝা যায়। অর্থাৎ - প্ৰাণ যার বদৌলতে জীবন কায়েম রয়েছে। কুরআন পাকের এ শব্দটি জিবরাঈলের জন্যেও ব্যবহৃত হয়েছে যেমন,

فَاتَّخَذَتْ مِن دُونِهِمْ حِجَابًا فَأَرْسَلْنَا إِلَيْهَا رُوحَنَا فَتَمَثَّلَ لَهَا بَشَرًا سَوِيًّا

“তারপর আমরা তার কাছে আমাদের রূহকে পাঠালাম, সে তার কাছে পূর্ণ মানবাকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করল। ” [মারইয়ামঃ ১৭] এবং ঈসা আলাইহিস সালাম এর জন্যেও কয়েক আয়াতে ব্যবহৃত হয়েছে। এমন কি স্বয়ং কুরআনও ওহীকে রূহ শব্দের মাধ্যমে ব্যক্ত করা হয়েছে। যেমন-

وَكَذَٰلِكَ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ رُوحًا مِّنْ أَمْرِنَا ۚ مَا كُنتَ تَدْرِي مَا الْكِتَابُ وَلَا الْإِيمَانُ وَلَٰكِن جَعَلْنَاهُ نُورًا نَّهْدِي بِهِ مَن نَّشَاءُ مِنْ عِبَادِنَا ۚ وَإِنَّكَ لَتَهْدِي إِلَىٰ صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ

“এভাবে আমি আপনার প্রতি ওহী করেছি রূহ তথা আমার নির্দেশ; আপনি তো জানতেন না কিতাব কি এবং ঈমান কি! পক্ষান্তরে আমি এটাকে করেছি আলো যা দ্বারা আমি আমার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছে পথনির্দেশ করি; আপনি তো দেখান শুধু সরল পথ”। [সূরা আস-শূরাঃ ৫২] কিন্তু এখানে রূহ বলে কি বোঝানো হয়েছে? কোন কোন তফসীরবিদ বর্ণনার পূর্বাপর ধারার প্রতি লক্ষ্য করে প্রশ্নটি ওহী, কুরআন অথবা ওহীবাহক ফেরেশতা জিবরাঈল সম্পর্কে সাব্যস্ত করেছেন। কেননা, এর পূর্বেও

وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِينَ ۙ

অর্থাৎ ৮২ নং আয়াতে এ কুরআনের উল্লেখ ছিল এবং পরবর্তী আয়াতসমূহেও আবার ওহী ও কুরআনের উল্লেখ রয়েছে। এর সাথে মিল রেখে তারা বুঝেছেন যে, এ প্রশ্নেও রূহ বলে ওহী, কুরআন অথবা জিবরাঈলকেই বোঝানো হয়েছে। প্রশ্নের উদ্দেশ্য এই যে, আপনার প্রতি ওহী কিভাবে আসে? কে আনে? কুরআন এর উত্তরে শুধু এতটুকু বলেছে যে, আল্লাহর নির্দেশে ওহী আসে। ওহীর পূর্ণ বিবরণ ও অবস্থা বলা হয়নি। [ফাতহুল কাদীর]

কিন্তু যেসব সহীহ হাদীসে এ আয়াতের শানে-নূযুল বর্ণনা করা হয়েছে, সেগুলোতে প্রায় পরিষ্কার করেই বলা হয়েছে যে, প্ৰশ্নকারীরা প্রাণীর মধ্যস্থিত রূহ সম্পর্কেই প্রশ্ন করেছিল এবং রূহের স্বরূপ অবগত হওয়াই প্রশ্নের উদ্দেশ্য ছিল। অর্থাৎ রূহ কি? মানবদেহে রূহ কিভাবে আগমন করে? কিভাবে এর দ্বারা জীবজন্তু ও মানুষ জীবিত হয়ে যায়? আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ আমি একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মদীনার জনবসতিহীন এলাকায় পথ অতিক্রম করেছিলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে খর্জুর ডালের একটি ছড়ি ছিল। তিনি কয়েকজন ইহুদীর কাছ দিয়ে গমন করছিলেন। তারা পরস্পরে বলাবলি করছিলঃ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগমন করছেন। তাকে রূহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা কর। অপর কয়েকজন নিষেধ করল। কিন্তু কয়েকজন ইহুদী প্রশ্ন করেই বসল। প্রশ্ন শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছড়িতে ভর দিয়ে নিচুপ দাঁড়িয়ে গেলেন। আমি অনুমান করলাম যে, তার প্রতি ওহী নাযিল হবে। কিছুক্ষণ পর ওহী নাযিল হলে তিনি এ আয়াত পাঠ করে শোনালেনঃ

وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الرُّوحِ ۖ قُلِ الرُّوحُ مِنْ أَمْرِ رَبِّي وَمَا أُوتِيتُم مِّنَ الْعِلْمِ إِلَّا قَلِيلًا

তখন তারা পরস্পর বলল, তোমাদেরকে নিষেধ করিনি যে, তাকে প্রশ্ন করো না? [বুখারীঃ ১২৫, মুসলিমঃ ২৭৯৪] অন্য বর্ণনায় আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বৰ্ণনা করেনঃ কোরায়শরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম – কে সঙ্গত অসঙ্গত প্রশ্ন করত। একবার তারা মনে করল যে, ইহুদীরা বিদ্বান লোক। তারা পূর্ববতী গ্রন্থসমূহেরও জ্ঞান রাখে। কাজেই তাদের কাছ থেকে কিছু প্রশ্ন জেনে নেয়া দরকার; যেগুলো দ্বারা মুহাম্মাদের পরীক্ষা নেয়া যেতে পারে। তদনুসারে কুরাইশরা কয়েকজন লোক ইহুদীদের কাছে প্রশ্ন প্রেরণ করল। তারা শিখিয়ে দিল যে, তোমরা তাঁকে রূহ সম্পর্কে প্রশ্ন কর। [মুসনাদে আহমাদ ১/২৫৫, তিরমিয়ীঃ ৩১৪০, ইবনে হিব্বানঃ ৯৯, মুস্তাদরাকে হাকেমঃ ২/৫৩১] এ আয়াতের শানে নুযুল সম্পর্কে ইবনে মাসউদ ও ইবনে আব্বাসের যে দুটি হাদীস উপরে উল্লেখ করা হয়েছে, তন্মধ্যে ইবনে মাসউদের হাদীস অনুযায়ী প্রশ্নটি মদীনায় করা হয়েছিল। এ কারণেই কোন কোন তফসীরবিদ আয়াতটিকে 'মাদানী' সাব্যস্ত করেছেন যদিও সূরা বনী-ইসরাঈলের অধিকাংশই মক্কা। পক্ষান্তরে ইবনে আব্বাসের রেওয়ায়েত অনুসারে প্রশ্নটি মক্কায় করা হয়েছিল। এদিক দিয়ে গোটা সূরার ন্যায় এ আয়াতটিও মক্কী।

[২] রূহ সম্পর্কে বলা হয়েছে, “বলুন! রূহ আমার প্রভুর নির্দেশঘটিত”। এই জওয়াবের ব্যাখ্যায়। তফসীরবিদদের উক্তি বিভিন্নরূপ। কোন কোন মুফাসসির বলেন, এ জওয়াবে যতটুকু বিষয় বলা জরুরী ছিল এবং যতটুকু বিষয় সাধারণ লোকের বোধগম্য ছিল, ততটুকুই বলে দেয়া হয়েছে। রূহের সম্পূর্ণ স্বরূপ সম্পর্কে যে প্রশ্ন ছিল জওয়াবে তা বলা হয়নি। কারণ, তা বোঝা সাধারণ লোকের সাধ্যাতীত ব্যাপার ছিল এবং তাদের কোন প্রয়োজন এটা বোঝার উপর নির্ভরশীলও ছিল না। এই জওয়াব একথা ফুটিয়ে তুলেছে যে, রূহকে সাধারণ বস্তুসমূহের মাপকাঠিতে পরখ করার ফলশ্রুতিতে যেসব সন্দেহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে সেগুলো দূর হয়ে গেল। রূহ সম্পর্কে এতটুকু জ্ঞান মানুষের জন্যে যথেষ্ট। এর বেশী জ্ঞানের উপর তার কোন ধমীয় অথবা পার্থিব প্রয়োজন আটকা নয়। [দেখুন, ফাতহুল কাদীর]

১৭ : ১০৭
قُلْ آمِنُوا بِهِ أَوْ لَا تُؤْمِنُوا ۚ إِنَّ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ مِنْ قَبْلِهِ إِذَا يُتْلَىٰ عَلَيْهِمْ يَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ سُجَّدًا

বলুন, ‘তোমরা কুরআনে ঈমান আন আর নাই ঈমান আন, নিশ্চয় যাদেরকে এর আগে জ্ঞান দেয়া হয়েছে, তাদের কাছে যখন এটা তেলাওআত করা হয় তখনই তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ে।’
ফুটনোট

১৮ :
مَا لَهُمْ بِهِ مِنْ عِلْمٍ وَلَا لِآبَائِهِمْ ۚ كَبُرَتْ كَلِمَةً تَخْرُجُ مِنْ أَفْوَاهِهِمْ ۚ إِنْ يَقُولُونَ إِلَّا كَذِبًا

এ বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞান নেই এবং তাদের পিতৃপুরুষদেরও ছিল না। তাদের মুখ থেকে বের হওয়া বাক্য কি সাংঘাতিক! তারা তো শুধু মিথ্যাই বলে [১]।

ফুটনোট

[১] অৰ্থাৎ তাদের এ উক্তি যে, অমুক আল্লাহর পুত্র অথবা অমুককে আল্লাহ পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেছেন, এগুলো তারা এ জন্য বলছে না যে, তাদের আল্লাহর পুত্র হবার বা আল্লাহর কাউকে পুত্র বানিয়ে নেবার ব্যাপারে তারা কিছু জানে। বরং নিছক নিজেদের ভক্তি শ্রদ্ধার বাড়াবাড়ির কারণে তারা একটি মনগড়া মত দিয়েছে এবং এভাবে তারা যে কত মারাত্মক গোমরাহীর কথা বলছে এবং বিশ্বজাহানের মালিক ও প্ৰভু আল্লাহর বিরুদ্ধে যে কত বড় বেয়াদবী ও মিথ্যাচার করে যাচ্ছে তার কোন অনুভূতিই তাদের নেই। এভাবে তারা নিজেরা যেমন পথভ্রষ্ট হচ্ছে তেমনি ভ্ৰষ্ট করছে তাদের সন্তানসন্ততিদেরকেও। [দেখুন, ফাতহুল কাদীর]

১৮ : ৬৫
فَوَجَدَا عَبْدًا مِنْ عِبَادِنَا آتَيْنَاهُ رَحْمَةً مِنْ عِنْدِنَا وَعَلَّمْنَاهُ مِنْ لَدُنَّا عِلْمًا

এরপর তারা সাক্ষাত পেল আমাদের বান্দাদের মধ্যে একজনের, যাকে আমরা আমাদের কাছ থেকে অনুগ্রহ দান করেছিলাম ও আমাদের কাছ থেকে শিক্ষা দিয়েছিলাম এক বিশেষ জ্ঞান [১]।

ফুটনোট

[১] কুরআনুল কারামে ঘটনার মূল ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা হয়নি; বরং عَبْدً امِّنْ عِبَادِنَآ (আমার বান্দাদের একজন) বলা হয়েছে। বুখারীর হাদীসে তার নাম “খাদির উল্লেখ করা হয়েছে। খাদির অর্থ সবুজ-শ্যামল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার নামকরণের কারণ প্রসঙ্গে বলেন যে, তিনি যেখানে বসতেন, সেখানেই ঘাস উৎপন্ন হয়ে যেত, মাটি যেরূপই হোক না কেন। [বুখারীঃ ৩৪০২] খাদির কি নবী ছিলেন, না ওলী ছিলেন, এ ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তবে গ্রহণযোগ্য আলেমদের মতে, খাদির ‘আলাইহিস সালামও একজন নবী। [ইবন কাসীর]

১৮ : ৬৮
وَكَيْفَ تَصْبِرُ عَلَىٰ مَا لَمْ تُحِطْ بِهِ خُبْرًا

যে বিষয় আপনার জ্ঞানায়ত্ত নয় সে বিষয়ে আপনি ধৈর্য ধারণ করবেন কেমন করে [১] ?’

ফুটনোট

[১] খাদির ‘আলাইহিস সালাম মূসা “আলাইহিস সালাম-কে বললেনঃ আপনি আমার সাথে ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন না। আসল তথ্য যখন আপনার জানা নেই, তখন ধৈর্য ধরবেনই বা কেমন করে? উদ্দেশ্য এই যে, আমি যে জ্ঞান লাভ করেছি, তা আপনার জ্ঞান থেকে ভিন্ন ধরণের। তাই আমার কাজকর্ম আপনার কাছে আপত্তিকর ঠেকবে। আসল তথ্য আপনাকে না বলা পর্যন্ত আপনি নিজের কর্তব্যের খাতিরে আপত্তি করবেন। [ইবন কাসীর]

১৮ : ৯১
كَذَٰلِكَ وَقَدْ أَحَطْنَا بِمَا لَدَيْهِ خُبْرًا

প্রকৃত ঘটনা এটাই , আর তার কাছে যে বৃত্তান্ত ছিল তা আমরা সম্যক অবহিত আছি।
ফুটনোট

১৯ : ৪৩
يَا أَبَتِ إِنِّي قَدْ جَاءَنِي مِنَ الْعِلْمِ مَا لَمْ يَأْتِكَ فَاتَّبِعْنِي أَهْدِكَ صِرَاطًا سَوِيًّا

‘হে আমার পিতা! আমার কাছে তো এসেছে জ্ঞান যা আপনার কাছে আসেনি; কাজেই আমার অনুসরণ করুন, আমি আপনাকে সঠিক পথ দেখাব।
ফুটনোট

১৯ : ৪৩
يَا أَبَتِ إِنِّي قَدْ جَاءَنِي مِنَ الْعِلْمِ مَا لَمْ يَأْتِكَ فَاتَّبِعْنِي أَهْدِكَ صِرَاطًا سَوِيًّا

‘হে আমার পিতা! আমার কাছে তো এসেছে জ্ঞান যা আপনার কাছে আসেনি; কাজেই আমার অনুসরণ করুন, আমি আপনাকে সঠিক পথ দেখাব।
ফুটনোট

২০ : ৫১
قَالَ فَمَا بَالُ الْقُرُونِ الْأُولَىٰ

ফির’আউন বলল, ‘তাহলে অতীত যুগের লোকদের অবস্থা কী [১]?’

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ ব্যাপার যদি এটাই হয়ে থাকে যে, যিনি প্রত্যেকটি জিনিসকে আকৃতি দিয়েছেন এবং তাকে দুনিয়ায় কাজ করার পথ বাতলে দিয়েছেন তিনি ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন রব নেই, তাহলে এ আমাদের সবার বাপ দাদারা, যারা বংশ পরস্পরায় ভিন্ন প্ৰভু ও ইলাহর বন্দেগী করে চলে এসেছে তোমাদের দৃষ্টিতে তাদের অবস্থান কোথায় হবে? তারা সবাই কি গোমরাহ ছিল? তারা সবাই কি আযাবের হকদার হয়ে গেছে? এ ছিল ফির’আউনের কাছে মূসার এ যুক্তির জবাব। হতে পারে সে আসলেই তার পূর্বপুরুষদের ব্যাপারে জানতে চেয়েছিল। [ইবন কাসীর] অথবা ফির’আউন আগের প্রশ্নের উত্তরে হতবাক হয়ে প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য এ প্রশ্ন করেছিল। [ফাতহুল কাদীর] অথবা সে নিজের সভাসদ ও সাধারণ মিসরবাসীদের মনে মূসার দাওয়াতের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ সঞ্চার করাও এর উদ্দেশ্য হতে পারে। সে মূসা আলাইহিসসালামের বিরুদ্ধে লোকদের ক্ষেপিয়ে তুলতে চাচ্ছিল। কারণ, মানুষ তাদের পিতামাতার ব্যাপারে যখন এটা শুনবে যে, তারা জাহান্নামে গেছে, তখন তারা মূসা আলাইহিসসালামের বিরুদ্ধে জোট করতে দ্বিধা করবে না।

২০ : ৫২
قَالَ عِلْمُهَا عِنْدَ رَبِّي فِي كِتَابٍ ۖ لَا يَضِلُّ رَبِّي وَلَا يَنْسَى

মূসা বললেন, ‘এর জ্ঞান আমার রব এর নিকট কিতাবে রয়েছে, আমার রব ভুল করেন না এবং বিস্মৃতও হন না [১]

ফুটনোট

[১] এটি মূসার সে সময় প্রদত্ত একটি অত্যন্ত জ্ঞানগর্ভ জবাব। তিনি বলেন, তারা যাই কিছু ছিল, নিজেদের কাজ করে আল্লাহর কাছে পৌঁছে গেছে। তাদের কার্যাবলী এবং কাজের পেছনে নিহিত অন্তরের ইচ্ছাসমূহ জানার কোন উপায় নেই। কাজেই তাদের ব্যাপারে আমি কোন সিদ্ধান্ত দেই কেমন করে? তাদের সমস্ত রেকর্ড আল্লাহর কাছে সংরক্ষিত আছে। তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ ও তার কারণসমূহের খবর আল্লাহই জানেন। কোন জিনিস আল্লাহর দৃষ্টির বাইরে থাকেনি এবং তাঁর স্মৃতি থেকেও কোন জিনিস বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। আল্লাহই জানেন তাদের সাথে কি ব্যবহার করতে হবে। ছোট বড় কোন কিছুই তাঁর জ্ঞানের বাইরে নেই। সাধারণত: মানুষের জ্ঞানে দু' ধরণের সমস্যা থাকে। এক. সবকিছু জানা সম্ভব হয় না। দুই. জানার পরে ভুলে যাওয়া। কিন্তু আমার রব এ দু'টি থেকে সম্পপূর্ণ মুক্ত। [দেখুন, ইবন কাসীর]

২০ : ৯৮
إِنَّمَا إِلَٰهُكُمُ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ۚ وَسِعَ كُلَّ شَيْءٍ عِلْمًا

তোমাদের ইলাহ তো শুধু আল্লাহই যিনি ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই, সবকিছু তাঁর জ্ঞানের পরিধিভুক্ত।
ফুটনোট

২০ : ১১০
يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلَا يُحِيطُونَ بِهِ عِلْمًا

তাদের সম্মুখে ও পশ্চাতে যা কিছু আছে , তা তিনি অবগত, কিন্তু তারা জ্ঞান দ্বারা তাঁকে বেষ্টন করতে পারে না।
ফুটনোট

২০ : ১১৪
فَتَعَالَى اللَّهُ الْمَلِكُ الْحَقُّ ۗ وَلَا تَعْجَلْ بِالْقُرْآنِ مِنْ قَبْلِ أَنْ يُقْضَىٰ إِلَيْكَ وَحْيُهُ ۖ وَقُلْ رَبِّ زِدْنِي عِلْمًا

সুতরাং প্রকৃত মালিক আল্লাহ্ অতি মহান সর্বোচ্চ সত্ত্বা [১]। আর আপনার প্রতি আল্লাহর ওহী সম্পূর্ণ হওয়ার আগে আপনি কুরআন পাঠে তাড়াহুড়া করবেন না এবং বলুন, ‘হে আমার রব! আমাকে জ্ঞানে সমৃদ্ধ করুন।

ফুটনোট

[১] মহান আল্লাহ্ বলছেন, যখন পুনরুত্থানের দিন, ভাল-মন্দ প্রতিফলের দিন অবশ্যই ঘটবে, তখন আমরা এ কুরআন নাযিল করেছি, যাতে এরা নিজেদের গাফলতি থেকে সজাগ হবে, ভুলে যাওয়া শিক্ষাকে কিছুটা স্মরণ করবে এবং পথ ভুলে কোন পথে যাচ্ছে আর এই পথ ভুলে চলার পরিণাম কি হবে সে সম্পর্কে এদের মনে বেশ কিছুটা অনুভূতি জগবে। সুতরাং সেই মহান হক বাদশাহর জন্যই যাবতীয় মহত্ব। যিনি হক, যাঁর ওয়াদা হক, যার সতর্কীকরণ হক, যার রাসূলরা হক, জান্নাত হক, জাহান্নাম হক। তার থেকে যা কিছু আসে সবই হক। তাঁর আদল ও ইনসাফ হচ্ছে যে, তিনি কাউকে সাবধান না করে রাসূল না পাঠিয়ে শাস্তি দেন না। যাতে করে তিনি মানুষের ওযর আপত্তির উৎস বন্ধ করে দিতে পারেন। ফলে তাদের কোন সন্দেহ বা প্রমাণ অবশিষ্ট না থাকে। [ইবন কাসীর]

২১ : ৫১
وَلَقَدْ آتَيْنَا إِبْرَاهِيمَ رُشْدَهُ مِنْ قَبْلُ وَكُنَّا بِهِ عَالِمِينَ

আর আমরা তো এর আগে ইবরাহিমকে তার শুভবুদ্ধি ও সত্যজ্ঞান দিয়েছিলাম [১] এবং আমরা তার সম্বন্ধে ছিলাম সম্যক পরিজ্ঞাত।

ফুটনোট

পঞ্চম রুকু’

[১] রুশদ এর অর্থ হচ্ছে সঠিক ও বেঠিকের মধ্যে পার্থক্য করে সঠিক কথা বা পথ অবলম্বন করা এবং বেঠিক কথা ও পথ থেকে দূরে সরে যাওয়া। যাকে আরবীতে صلاح বলা যায়। [বাগভী] এ অর্থের প্রেক্ষিতে “রুশদ” এর অনুবাদ “সত্যনিষ্ঠা”ও হতে পারে। কিন্তু যেহেতু রুশদ শব্দটি কেবলমাত্র সত্যনিষ্ঠ নয়। বরং এমন সত্যজ্ঞানের ভাব প্রকাশ করে যা সঠিক চিন্তা ও ভারসাম্যপূর্ণ সুষ্ঠ বুদ্ধি ব্যবহারের ফলশ্রুতি, তাই “শুভবুদ্ধি ও সত্যজ্ঞান” এই দুটি শব্দ একত্রে এর অর্থের কাছাকাছি। তাই অনুবাদ করা হয়েছে, “ইবরাহীমকে তার শুভবুদ্ধি ও সত্যজ্ঞান দান করেছিলাম।” [দেখুন, কুরতুবী] এখানে 'তার' বলার অর্থ, যতটুকু তার জন্য এবং তার মত অন্যান্য রাসূলদের জন্য উপযুক্ত ততটুকু আমরা তাকে দান করেছিলাম। [ফাতহুল কাদীর] সুতরাং সে যে সত্যের জ্ঞান ও শুভবুদ্ধি লাভ করেছিল তা আমরাই তাকে দান করেছিলাম। এটা তার জন্য আমাদের পক্ষ থেকে নির্ধারিত ছিল। যা ছিল আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ।

২১ : ৭৪
وَلُوطًا آتَيْنَاهُ حُكْمًا وَعِلْمًا وَنَجَّيْنَاهُ مِنَ الْقَرْيَةِ الَّتِي كَانَتْ تَعْمَلُ الْخَبَائِثَ ۗ إِنَّهُمْ كَانُوا قَوْمَ سَوْءٍ فَاسِقِينَ

আর লূতকে আমরা দিয়েছিলাম প্রজ্ঞা ও জ্ঞান [১] এবং তাকে উদ্ধার করেছিলাম এমন এক জনপদ থেকে [২] যার অধিবাসীরা লিপ্ত ছিল অশ্লীল কাজে [৩]; নিশ্চয় তারা ছিল এক মন্দ ফাসেক সম্প্রদায়।

ফুটনোট

[১] মূলে “হুকুম ও ইলম” শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। “হুকুম” অর্থ এখানে নবুওয়ত। তাছাড়া এর অন্য অর্থ, প্রজ্ঞা। [ফাতহুল কাদীর] আর “ইলম” এর অর্থ হচ্ছে এমন সত্য যথার্থ ইলাম যা অহীর মাধ্যমে দান করা হয়েছে। অন্য কথায় দ্বীনের জ্ঞান এবং মানুষের মধ্যে যা ঘটবে তার সঠিক ফয়সালা [কুরতুবী] লূতের সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানার জন্যে দেখুন সূরা আল-আ’রাফ ৮০-৮৪, সূরা হুদ ৬৯-৮৩ এবং সূরা আল-হিজর ৫৭-৭৬ আয়াত

[২] যে জনপদ থেকে লুত আলাইহিস সালামকে উদ্ধার করার কথা আলোচ্য আয়াতদ্বয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, সেই জনপদের নাম ছিল সাদৃম। [ইবন কাসীর] এর অধীনে আরও সাতটি জনপদ ছিল। এগুলোকে জিবরাঈল আলাইহিস সালাম ওলট-পালট করে দিয়েছিলেন। শুধু লুত আলাইহিস সালাম ও তার সঙ্গী মুমিনদের বসবাসের জন্যে একটি জনপদ অক্ষত রেখে দেয়া হয়েছিল। [কুরতুবী]

[৩] পুরুষের সাথে পুরুষের কামপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করা ছিল তাদের সর্বপ্রধান নোংরা অভ্যাস, যা থেকে বন্য জন্তুরাও বেঁচে থাকে। কোন কোন তফসীরবিদ বলেনঃ এ ছাড়া অন্যান্য নোংরা অভ্যাসও তাদের মধ্যে ছিল। [দেখুন, কুরতুবী]

২১ : ৭৯
فَفَهَّمْنَاهَا سُلَيْمَانَ ۚ وَكُلًّا آتَيْنَا حُكْمًا وَعِلْمًا ۚ وَسَخَّرْنَا مَعَ دَاوُودَ الْجِبَالَ يُسَبِّحْنَ وَالطَّيْرَ ۚ وَكُنَّا فَاعِلِينَ

অতঃপর আমরা সুলায়মানকে এ বিষয়ের মীমাংসা বুঝিয়ে দিয়েছিলাম এবং তাদের প্রত্যেককে আমরা দিয়েছিলাম প্রজ্ঞা ও জ্ঞান [১]। আর আমরা পর্বত ও পাখিদেরকে দাউদের অনুগত করে দিয়েছিলাম, তারা তার সাথে পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করত [২] , আর আমরাই ছিলাম এ সবের কর্তা।

ফুটনোট

[১] এ আয়াত থেকে পরোক্ষভাবে ন্যায়বিচারের এ মূলনীতি জানা যায় যে, দু’জন বিচারপতি যদি একটি মোকদ্দমার ফায়সালা করে এবং দু'জনের ফায়সালা বিভিন্ন হয়, তাহলে যদিও একজনের ফায়সালাই সঠিক হবে। তবুও দু’জনেই ন্যায়বিচারক বিবেচিত হবেন। তবে এখানে শর্ত হচ্ছে বিচার করার প্রয়োজনীয় যোগ্যতা উভয়ের মধ্যে থাকতে হবে। তাদের কেউ যেন অজ্ঞতা ও অনভিজ্ঞতা সহকারে বিচারকের আসনে বসে না যান। [দেখুন, কুরতুবী] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদীসে একথা আরো বেশী সুস্পষ্ট করে বর্ণনা করে দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “যদি বিচারক নিজের সামর্থ অনুযায়ী ফায়সালা করার পূর্ণ প্রচেষ্টা চালান, তাহলে সঠিক ফায়সালা করার ক্ষেত্রে তিনি দু'টি প্রতিদান পাবেন এবং ভুল ফায়সালা করলে পাবেন একটি প্রতিদান।” [বুখারীঃ ৬৯১৯, মুসলিমঃ ১৭১৬] অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “বিচারক তিন প্রকারের। এদের একজন জান্নাতী এবং দু’জন জাহান্নামী। জান্নাতের অধিকারী হচ্ছেন এমন বিচারক যিনি সত্য চিহ্নিত করতে পারলে সে অনুযায়ী ফায়সালা দেন। কিন্তু যে ব্যক্তি সত্য চিহ্নিত করার পরও সত্য বিরোধী ফায়সালা দেয় সে জাহান্নামী। আর অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি জ্ঞান ছাড়াই লোকদের মোকদ্দমার ফায়সালা করতে বসে যায় সেও জাহান্নামী। ” [আবুদাউদঃ ২৫৭৩, তিরমিয়ীঃ ১৩২২, ইবনে মাজাহঃ ২৩১৫]

[২] আয়াতে مع শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ দাউদ আলাইহিস সালামের সাথে পাহাড় ও পাখীদেরকে অনুগত করা হয়েছিল এবং সে কারণে তারাও দাউদের সাথে আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করতো। একথাটিই কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছেঃ “আমরা তার সাথে পাহাড়গুলোকে অনুগত করে দিয়েছিলাম। সকাল-সন্ধ্যা তারা আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করতো। আর সমবেত পাখিদেরকেও (অনুগত করা হয়েছিল)। তারা প্রত্যেকেই ছিল অধিক আল্লাহ অভিমুখী ।" [সূরা সাদঃ ১৮,১৯] অন্য সূরায় আরও অতিরিক্ত বলা হয়েছেঃ “পাহাড়গুলোকে আমরা হুকুম দিয়েছিলাম যে, তার সাথে সাথে পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণার পুনরাবৃত্তি করো এবং এই একই হুকুম পাখিদেরকেও দিয়েছিলাম।” [সূরা সাবাঃ ১০]

এ বক্তব্যগুলো থেকে যে কথা বুঝা যায় তা হচ্ছে এই যে, দাউদ যখন আল্লাহর প্রশংসা ও মহিমা গীতি গাইতেন তখন তার উচ্চতর ও সুরেলা আওয়াজে পাহাড় ও পাখিরা গেয়ে ফেলত এবং একটা অপূর্ব মূৰ্ছনার সৃষ্টি হতো। তিনি যখন যাবুর পাঠ করতেন, তখন পক্ষীকুল শূন্যে তার সাথে তসবীহ পাঠ করতে থাকত। [ইবন কাসীর] সমধুর কণ্ঠস্বর ছিল একটি বাহ্যিক গুণ এবং পক্ষীকুল ও পর্বতসমূহের তসবীহ পাঠে শরীক হওয়া ছিল আল্লাহর কুদরতের অধীন একটি মু'জেযা। মু'জেযার জন্য পক্ষীকুল ও পর্বতসমূহের মধ্যেও বিশেষ চেতনা সৃষ্টি হতে পারে। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে আবু মূসা আশা আরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু অত্যন্ত সুমধুর কণ্ঠস্বরের অধিকারী ছিলেন। একবার আবু মূসা আশা আরী রাদিয়াল্লাহু আনহু কুরআন তিলাওয়াত করছিলেন। তার কণ্ঠ ছিল অসাধারণ সুরেলা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেদিক দিয়ে যাচ্ছিলেন। তার আওয়াজ শুনে তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন এবং অনেকক্ষণ শুনতে থাকলেন। তার পড়া শেষ হলে তিনি বললেনঃ “এ ব্যক্তি দাউদের সুরেলা কণ্ঠের একটা অংশ পেয়েছে।” [মুসনাদে আহমাদঃ ৫/৩৫৯] আবু মুসা যখন জানতে পারলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার তিলাওয়াত শুনেছেন, তখন আরয করলেনঃ আপনি শুনছেন – একথা আমার জানা থাকলে আমি আরও সুন্দরভাবে তিলাওয়াত করার চেষ্টা করতাম। [ইবনে হিব্বানঃ ৭১৯৭, অনুরূপ মুসলিমঃ ৭৯৩] এ থেকে জানা গেল যে, কুরআন তেলাওয়াতে সুন্দর স্বর ও চিত্তাকর্ষক উচ্চারণ কাম্য ও পছন্দনীয়।

২১ : ৮১
وَلِسُلَيْمَانَ الرِّيحَ عَاصِفَةً تَجْرِي بِأَمْرِهِ إِلَى الْأَرْضِ الَّتِي بَارَكْنَا فِيهَا ۚ وَكُنَّا بِكُلِّ شَيْءٍ عَالِمِينَ

আর সুলাইমানের বশীভূত করে দিয়েছিলাম প্রবল বায়ূকে; সেটা তার আদেশে সে দেশের দিকে প্রবাহিত হত [১] যেখানে আমরা প্রভূত কল্যাণ রেখেছি [২]; আর প্রত্যেক বিষয় সম্পর্কে আমরাই জ্ঞানী ।

ফুটনোট

[১] এ সম্পর্কে অন্যত্র আরো বিস্তারিত আলোচনা এসেছে, বলা হয়েছেঃ “আর সুলাইমানের জন্য আমরা বায়ুকে বশীভূত করে দিয়েছিলাম, সকালে তার চলা এক মাসের পথ পর্যন্ত এবং সন্ধ্যায় তার চলা এক মাসের পথ পর্যন্ত। ” [সূরা সাবাঃ ১২] অন্যত্র আরও বলা হয়েছেঃ “কাজেই আমি তার জন্য বায়ুকে বশীভূত করে দিয়েছিলাম, যা তার হুকুম সহজে চলাচল করতো। যেদিকে সে যেতে চাইতো। ” [সূরা সাদঃ ৩৬] এ থেকে জানা যায় বাতাসকে সুলাইমানের হুকুমের এভাবে অনুগত করে দেয়া হয়েছিল যে, তার রাজ্যের এক মাস দূরত্বের পথ পর্যন্ত যে কোন স্থানে তিনি সহজে সফর করতে পারতেন। যাওয়ার সময়ও সব সময় তার ইচ্ছা অনুযায়ী অনুকূল বাতাস পেতেন আবার ফেরার সময়ও। আল্লাহ্ তাআলা যেমন দাউদ আলাইহিস সালাম এর জন্যে পর্বত ও পক্ষীকুলকে বশীভূত করে দিয়েছিলেন, যারা তার আওয়াজের সাথে তসবীহ পাঠ করত, তেমনি সুলাইমান আলাইহিস সালাম এর জন্য বায়ুকে বশীভূত করে দিয়েছিলেন। বায়ুতে ভর করে তিনি যথা ইচ্ছা দ্রুত ও সহজে পৌঁছে যেতেন। তিনি বায়ুতে তার কাঠের বিছানা পাততেন। তারপর তাতে রাষ্ট্রের যতো প্রয়োজনীয় জিনিস যেমন ঘোড়া, উঁট, তাঁবু, সৈন্য-সামন্ত সবাই উঠানো হতো। তারপর বাতাসকে বলা হত তা বহন করার জন্য। বাতাস তার নিচে ঢুকে তা বহন করে উঠিয়ে নিয়ে যেত। তখন তাদের উপরে পাখি ছায়া দিত, এভাবে তিনি যেখানে চাইতেন সেখানে নিয়ে যেত। যখন তিনি নামতেন তখন তার সাথে তার রাজকীয় সামগ্ৰী সবই থাকত। [ইবন কাসীর]

[২] যেখানে বরকত বা প্রভূত কল্যাণ রেখেছি বলে শাম দেশ তথা সিরিয়া, লেবানন ও ফিলিস্তিন এলাকাকেই বোঝানো হয়েছে। যার আলোচনা আগেই চলে গেছে।

২২ :
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يُجَادِلُ فِي اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّبِعُ كُلَّ شَيْطَانٍ مَرِيدٍ

মানুষের মধ্যে কিছু সংখ্যক না জেনে আল্লাহ্ সম্বন্ধে বিতণ্ডা করে [১] এবং সে প্রত্যেক বিদ্রোহী শয়তানের অনুসরণ করে,

ফুটনোট

[১] এখানে আল্লাহ সম্পর্কে তাদের যে বিতর্কের উপর আলোচনা করা হচ্ছে তা হচ্ছে আখেরাতে বিচারের জন্য তাদেরকে মৃত্যু ও মাটির সাথে মিশে যাওয়ার পর পুনরায় জীবিত করতে পারেন কি না? আল্লাহ এখানে তাদের কর্মকাণ্ডের নিন্দা করছেন, যারা আল্লাহ যা তাঁর নবীর উপর নাযিল করেছেন তার অনুসরণ না করে, শয়তানের দেয়া পথের অনুসরণ করে পুনরুত্থান ও আল্লাহর শক্তিকে অস্বীকার করছে। আর সাধারণত: যারাই রাসূলের উপর আল্লাহর নাযিলকৃত বাণী ও সুস্পষ্ট হকের অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকে, তারাই বাতিলপন্থী নেতা, বিদ'আতের প্রতি আহবানকারীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। [ইবন কাসীর]

২২ :
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنْ كُنْتُمْ فِي رَيْبٍ مِنَ الْبَعْثِ فَإِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ ثُمَّ مِنْ عَلَقَةٍ ثُمَّ مِنْ مُضْغَةٍ مُخَلَّقَةٍ وَغَيْرِ مُخَلَّقَةٍ لِنُبَيِّنَ لَكُمْ ۚ وَنُقِرُّ فِي الْأَرْحَامِ مَا نَشَاءُ إِلَىٰ أَجَلٍ مُسَمًّى ثُمَّ نُخْرِجُكُمْ طِفْلًا ثُمَّ لِتَبْلُغُوا أَشُدَّكُمْ ۖ وَمِنْكُمْ مَنْ يُتَوَفَّىٰ وَمِنْكُمْ مَنْ يُرَدُّ إِلَىٰ أَرْذَلِ الْعُمُرِ لِكَيْلَا يَعْلَمَ مِنْ بَعْدِ عِلْمٍ شَيْئًا ۚ وَتَرَى الْأَرْضَ هَامِدَةً فَإِذَا أَنْزَلْنَا عَلَيْهَا الْمَاءَ اهْتَزَّتْ وَرَبَتْ وَأَنْبَتَتْ مِنْ كُلِّ زَوْجٍ بَهِيجٍ

হে মানুষ! পুনরুত্থান সম্পর্কে যদি তোমরা সন্দেহে থাক তবে অনুধাবন কর---আমরা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি [১] মাটি হতে [২] , তারপর শুক্র [৩] হতে , তারপর ‘আলাকাহ’ [৪] হতে, তারপর পূর্ণাকৃতি অথবা অপূর্ণাকৃতি গোশতপিণ্ড হতে [৫]--- যাতে আমরা বিষয়টি তোমাদের কাছে সুস্পষ্টরূপে প্রকাশ করি। আর আমরা যা ইচ্ছে তা এক নির্দিষ্ট কালের জন্য মাতৃগর্ভ স্থিত রাখি , তারপর আমরা তোমাদেরকে শিশুরূপে বের করি [৬], পরে যাতে তোমরা পরিণত বয়সে উপনীত হও [৭]। তোমাদের মধ্যে কারো কারো মৃত্যু ঘটান হয় এবং তোমাদের মধ্যে কাউকে কাউকে হিন্তম বয়সে [৮] প্রত্যাবৃত্ত করা হয় যার ফলে সে জানার পরেও যেন কিছুই (আর) জানে না। আর আপনি ভূমিকে দেখুন শুস্ক, অতঃপর তাতে আমরা পানি বর্ষণ করলে তা আন্দোলিত ও স্ফীত হয় এবং উদগত করে সব ধরনের সুদৃশ্য উদ্ভিদ [৯];

ফুটনোট

[১] আয়াতটিকে আল্লাহ তা'আলা পুনরুত্থানের উপর প্রথম প্রমাণ হিসেবে পেশ করেছেন। প্রথম সৃষ্টি যার পক্ষে করা সম্ভব তাঁর পক্ষে দ্বিতীয় সৃষ্টি কিভাবে কঠিন হবে? প্রথম সৃষ্টিই প্রমাণ করছে যে, তিনি দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করতে সক্ষম। [ইবন কাসীর] আয়াতে মাতৃগর্ভে মানব সৃষ্টির বিভিন্ন স্তর বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ বলেনঃ মানুষের বীর্য চল্লিশ দিন পর্যন্ত গর্ভাশয়ে সঞ্চিত থাকে। চল্লিশ দিন পর তা জমাট রক্তে পরিণত হয়। এরপর আরো চল্লিশ দিন অতিবাহিত হলে তা মাংসপিণ্ড হয়ে যায়। অতঃপর আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে একজন ফিরিশতা প্রেরিত হয়। সে তাতে রূহ ফুঁকে দেয়। এ সময়েই তার সম্পর্কে চারটি বিষয় লিখে দেয়া হয়ঃ [১] তার বয়স কত হবে, [২] সে কি পরিমাণ রিযিক পাবে, [৩] সে কি কি কাজ করবে এবং [৪] পরিণামে সে ভাগ্যবান হবে, না হতভাগা হবে। [বুখারীঃ ২৯৬৯, মুসলিমঃ ২৬৪৩]

[২] এর অর্থ হচ্ছে মানুষ নামের প্রজাতির সূচনা হয়েছে আদম আলাইহিস সালাম থেকে। তাঁকে সরাসরি মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং তারপর পরবর্তী পর্যায়ে শুক্র থেকেই মানব বংশের ধারাবাহিকতা চলতে থাকে। যেমন অন্যত্র বলা হয়েছেঃ “মানুষের সৃষ্টি শুরু করেন মাটি থেকে তারপর তার বংশ-ধারা চালান একটি নির্যাস থেকে যা বের হয় তুচ্ছ পানির আকারে।” [সূরা আস সাজদাহ, ৭-৮]

[৩] নুতফা শব্দের অর্থ শুক্র বা বীর্য। সাধারণত: নুতফা বলা হয়, অল্প পানিকে। [কুরতুবী] মাটি থেকে আদম সৃষ্টির পর তার বংশধারা জারি রাখা হয়েছে পানির মাধ্যম। আল্লাহ তা'আলা বলেন, “আমরা তো মানুষকে সৃষ্টি করেছি মাটির উপাদান থেকে” [সূরা আল-মুমিনুন: ১২] অন্য আয়াতে বলেন, “তারপর তিনি তার বংশ উৎপন্ন করেন তুচ্ছ তরল পদার্থের নির্যাস হতে”। [সূরা আস-সাজদাহ: ৮]

[৪] আলাকা শব্দের অর্থ শক্ত রক্ত, ঘন তাজা রক্ত। বা প্রচণ্ড লাল বৰ্ণ [কুরতুবী; ফাতহুল কাদীর] মানব সৃষ্টির প্রাথমিক পর্যায়ে যখন শুক্রটি মহিলার গর্ভাশয়ে স্থির হয়ে যায়, তখন সেটা চল্লিশ দিন এ অবস্থায় থাকে। এর সাথে যা জমা হবার তা জমা হয়। তারপর সেটি একটি পর্যায়ে আল্লাহর হুকুমে লাল তাজা রক্তপিণ্ডে পরিণত হয়। এভাবে সেটি চল্লিশ দিন অতিবাহিত করে। তারপর সেটি পরিবর্তিত হয়ে একখণ্ড গোস্তের টুকরোতে পরিণত হয়ে যায়। তখন তাতে কোন রূপ বা সূরত থাকে না। তারপর সেটি বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করতে থাকে। তখন তা থেকে মাথা, দু’হাত, বুক, পেট, দুই রান, দুই পা এবং বাকী অংগ-প্রত্যঙ্গসমূহ। কখনও কখনও সেটি সূরত গ্রহণ করার আগেই গর্ভপাত ঘটে যায়, আবার কখনও পূর্ণ অবয়ব ঘটনের পর সেটির গর্ভপাত হয়ে যায়। [ইবন কাসীর]

[৫] আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, বীর্য যখন কয়েক স্তর অতিক্রম করে মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়, তখন মানব সৃষ্টির কাজে আদিষ্ট ফিরিশতা আল্লাহ তা'আলাকে জিজ্ঞেস করেঃ

يَارَبّ مُخَلَّقَةٍ وَ غَيْرِ مُخَلَّقَةٍ

অর্থাৎ এই মাংসপিণ্ড দ্বারা মানব সৃষ্টি আপনার কাছে অবধারিত কি না? যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে উত্তরে বলা হয়। وَّغَيْرِ مُخَلَّقَةٍ তবে গর্ভাশয়ে সেই মাংসপিণ্ডকে পাত করে দেয়া হয় এবং তা সৃষ্টির অন্যান্য স্তর অতিক্রম করে না। পক্ষান্তরে যদি জবাবে مُخَلَّقَةٍ বলা হয়, তবে ফিরিশতা জিজ্ঞেস করেঃ ছেলে না মেয়ে, হতভাগা না ভাগ্যবান, বয়স কত, কি কর্ম করবে এবং কোথায় মৃত্যুবরণ করবে? এসব প্রশ্নের জবাব তখনই ফিরিশতাকে বলে দেয়া হয়। [ইবনে জরীর, ও ইবনে আবী হাতিম] উল্লেখিত শব্দদ্বয়ের তাফসীর থেকে এই জানা গেল যে, যে বীর্য দ্বারা মানবসৃষ্টি অবধারিত হয়, তা مُّخَلَّقَةٍ । আর যা বিনষ্ট ও পাত হওয়া অবধারিত, তা وَّغَيْرِ مُخَلَّقَةٍ। [ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর] কোন কোন মুফাসসির مُّخَلَّقَةٍ ও وَّغَيْرِ مُخَلَّقَةٍ এর এরূপ তাফসীর করেন যে, যে শিশুর সৃষ্টি পূর্ণাঙ্গ এবং সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সুস্থ, সুঠাম ও সুষম হয়, সে مُّخَلَّقَةٍ অর্থাৎ পূর্ণাকৃতিবিশিষ্ট এবং যার কতক অঙ্গ আসম্পূর্ণ অথবা দৈহিক গড়ন ইত্যাদি আসম, সে وَّغَيْرِ مُخَلَّقَةٍ । [কুরতুবী]

[৬] অর্থাৎ মাতৃগর্ভ থেকে তোমাদেরকে দুর্বল শিশুর আকারে বের করি। এ সময় শিশুর দেহ, শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি, জ্ঞান, নড়াচড়া ও ধারণশক্তি ইত্যাদি সবই দুর্বল থাকে। অতঃপর পর্যায়ক্রমে এগুলোকে শক্তি দান করা হয় এবং পরিশেষে পূর্ণশক্তির স্তরে পৌঁছে যায়। [ইবন কাসীর]

(৭) أشد শব্দটির অর্থ বুদ্ধি, শক্তি ও ভাল-মন্দ পৃথকীকরণে পূর্ণতা। কারও কারও মতে, ত্ৰিশ থেকে চল্লিশ বয়সের মধ্যে। [ফাতহুল কাদীর] উদ্দেশ্য এই যে, পর্যায়ক্রমে উন্নতির ধারা ততক্ষণ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে যতক্ষণ তোমাদের প্রত্যেকটি শক্তি পূর্ণতা লাভ না করে, যা যৌবনকালে প্রত্যক্ষ করা হয়। [ইবন কাসীর]

(৮) এটা সেই বয়সকে বলা হয়, যে বয়সে মানুষের বুদ্ধি, চেতনা ও ইন্দ্রিয়ানুভূতিতে ত্রুটি দেখা দেয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন বয়স থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিম্নোক্ত দোআ অধিক পরিমানে পাঠ করতেনঃ

اللّٰهُمّ إنّي أَعُوذُبِكَ مِنَ الْبُخْلِ، وَأَعُوْذُبِكَ من الُجبْنِ وَأعوذُ بِكَ أنْ أرَدَّ إِلى أَرْذَلِ العُمُر وأعُوذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ الدّنْيٰا وَأَعوذُ بِكَ مِنْ عَذابِ القَبر

হে আল্লাহ্! আমি কৃপণতা থেকে আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আমি ভীরুতা থেকেও আপনার কাছে আশ্রয় নিচ্ছি। অনুরূপভাবে হীনতম বয়সে উপণীত হওয়া থেকেও আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। তদ্রুপ আমি দুনিয়ার ফেতনায় নিপতিত হওয়া থেকে আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি। তাছাড়া আমি কবরের শাস্তি থেকেও আপনার নিকট আশ্রয় চাচ্ছি। ' [বুখারীঃ ৫৮৯৩]

এমন বৃদ্ধাবস্থায় মানুষের নিজের শরীরের ও অংগ-প্রত্যংগের কোন খোঁজ- খবর থাকে না। যে বেক্তি অন্যদেরকে জ্ঞান দিতো বুড়ো হয়ে সে এমন অবস্থায় পৌছে যায়, যাকে শিশুদের অবস্থার সাথে তুলনা করা যায়। যে জ্ঞান,জানা শোনা, অভিজ্ঞতা ও দুরদর্শিতা ছিল তার গর্বের বস্তু তা এমনই অজ্ঞতায় পরিবর্তিত হয়ে যায় যে, একটি ছোট ছেলেও তার কথায় হাসতে থাকে। এভাবে বান্দার শক্তি দু’টি দুর্বল অবস্থা ঘিরে আছে। এক ছোট কালের দুর্বলতা, দুই, সৃষ্টি করেন দুর্বলতা থেকে, দুর্বলতার পর তিনি দেন শক্তি; শক্তির পর আবার দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য। তিনি যা ইচ্ছে সৃষ্টি করেন এবং তিনিই সর্বজ্ঞ, সর্বক্ষম। ” [সূরা আররুম: ৫৪] [সা’দী]

(৯) আয়াতের এ অংশে আল্লাহ তা'আলা পুনরুত্থানের উপর দ্বিতীয় আরেকটি প্রমাণ পেশ করছেন। [কুরতুবী; ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর] অর্থাৎ যেভাবে তিনি মৃত ভূমিকে জীবিত করতে পারেন, যে যমীনে কোন প্ৰাণের স্পন্দন নেই, কোন উদ্ভিদ দেখা যায় না। তারপর তাতে বৃষ্টি বর্ষণ করে তিনি জীবনের উন্মেষ ঘটান, সেভাবে তাঁর পক্ষে পুনরুত্থান ঘটানো কোন কঠিন বিষয় নয়।

২২ :
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يُجَادِلُ فِي اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَلَا هُدًى وَلَا كِتَابٍ مُنِيرٍ

আর মানুষের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহ্ সম্বন্ধে বিতণ্ডা করে, তাদের না আছে জ্ঞান [১] , না আছে পথনির্দেশ [২], না আছে কোন দীপ্তিমান কিতাব [৩]।

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ ব্যক্তিগত জ্ঞান, যা সরাসরি পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জিত হয়। [ফাতহুল কাদীর] তবে জ্ঞান বলতে ব্যাপক জ্ঞান বুঝাই যথাৰ্থ। [ফাতহুল কাদীর]

[২] অর্থাৎ এমন জ্ঞান যা কোন যুক্তির মাধ্যমে অর্জিত হয়, অথবা কোন জ্ঞানের অধিকারীর পথনির্দেশনা দানের মাধ্যমে লাভ করা যায়। [ফাতহুল কাদীর]

[৩] অর্থাৎ এমন জ্ঞান, যা আল্লাহর নাযিল করা কিতাব থেকে লাভ করা যায়। এ আয়াতে তৰ্কশাস্ত্রের বিশেষ কয়েকটি মূলনীতি বর্ণনা করা হয়েছে। কোন তর্ক শুরুর পূর্বে সে বিষয়ে পূর্ণ জ্ঞান থাকা আবশ্যক। এ ধরনের জ্ঞানের তিনটি উৎস থাকে। এক, পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান। যে সমস্ত কাফের ও মুশরিক আল্লাহ সম্পর্কে বাক-বিতণ্ডা করছে তারা যদি দাবী করে যে, আমরা যা বলছি অর্থাৎ কেয়ামত সংঘটিত না হওয়া, পুনরুত্থান না ঘটা, একমাত্র আল্লাহর ইবাদতে বাধ্য না হওয়া আমাদের সরাসরি পর্যবেক্ষণ বা অভিজ্ঞতার ফল। তবে তারা যেন তা পেশ করে। কিন্তু তারা তা কখনো পেশ করতে পারবে না। বরং অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ তাদের দাবীর বিপরীতে আল্লাহর যাবতীয় ওয়াদাকে সত্য বলে প্রমাণ করছে। দুই, দ্বিতীয় যে ধরনের জ্ঞান থাকলে তর্ক করা যায় তা হলো, গ্রহণযোগ্য যুক্তি বা কোন জ্ঞানের অধিকারীর পথনির্দেশ প্রাপ্ত হলে। কাফের ও মুশরিকরা যারা তাওহীদ বা আখেরাত সম্পর্কে বাক-বিতণ্ডায় লিপ্ত ছিল তারা তাদের মতের সমর্থনে এ ধরনের কিছুও পেশ করতে ব্যর্থ ছিল। তিন, তৃতীয় যে ধরনের প্রমাণ যুক্তি-তর্কে পেশ করা হয় তা হলো, পূর্ববর্তী কোন কিতাবলব্ধ জ্ঞান। কাফের মুশরিকদের তাওহীদ ও আখেরাত বিরোধী কর্মকাণ্ডের স্বপক্ষে পূর্ববর্তী গ্রন্থ থেকেও কোন প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। মোটকথা: তাদের তর্কের সপক্ষে কোন সুস্থ বিবেকের প্রমাণ যেমন নেই, তেমনি সহীহ ও স্পষ্টভাষী কোন কিতাব বা নবী-রাসূলদের পেশকৃত জ্ঞানও নেই। তারা শুধু মত ও প্রবৃত্তির অনুসরণ করছে। [ইবন কাসীর]

২২ : ৫৪
وَلِيَعْلَمَ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ أَنَّهُ الْحَقُّ مِنْ رَبِّكَ فَيُؤْمِنُوا بِهِ فَتُخْبِتَ لَهُ قُلُوبُهُمْ ۗ وَإِنَّ اللَّهَ لَهَادِ الَّذِينَ آمَنُوا إِلَىٰ صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ

আর এ জন্যেও যে, যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে তারা যেন জানতে পারে যে, এটা আপনার রব-এর কাছ থেকে পাঠানো সত্য; ফলে তারা তার উপর ঈমান আনে ও তাদের অন্তর তার প্রতি বিনয়াবনত হয়। আর যারা ঈমান এনেছে, আল্লাহ্‌ নিশ্চয় তাদেরকে সরল পথ প্রদর্শনকারী।
ফুটনোট

২২ : ৭১
وَيَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَانًا وَمَا لَيْسَ لَهُمْ بِهِ عِلْمٌ ۗ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ نَصِيرٍ

আর তারা ‘ইবাদত করে আল্লাহ্‌র পরিবর্তে এমন কিছুর যার সম্পর্কে তিনি কোন দলীল নাযিল করেননি এবং যার সম্বন্ধে তাদের কোন জ্ঞান নেই [১]। আর যালেমদের কোন সাহায্যকারী নেই [২]।

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ আল্লাহ্‌র কোন কিতাবে বলা হয়নি, ‘আমি অমুক অমুককে আমার সাথে প্রভুত্বের কর্তৃত্বে শরীক করেছি। কাজেই আমার সাথে তোমরা তাদেরকেও ইবাদাতে শরীক করো।’ সুতরাং তাদের কাছে এ ব্যাপারে কোন দলীল-প্রমাণ নেই। অন্য আয়াতেও আল্লাহ্‌ তা বলেছেন, “আর যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র সাথে অন্য ইলাহকে ডাকে, এ বিষয়ে তার নিকট কোন প্রমাণ নেই; তার হিসাব তো তার রব-এর নিকটই আছে; নিশ্চয়ই কাফেররা সফলকাম হবে না।” [সূরা আল-মুমিনুনঃ ১১৭] আর কোন জ্ঞান মাধ্যমেও তারা এ কথা জানেনি যে, এরা অবশ্যই প্রভুত্বের কর্তৃত্বে অংশীদার এবং এজন্য এরা ইবাদাতলাভের হকদার। সুতরাং এখন যেভাবে বিভিন্ন ধরনের উপাস্য তৈরী করে এদের গুণাবলী ও ক্ষমতা সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের আকীদা তৈরী করে নেয়া হয়েছে এবং প্রয়োজন পূরণের জন্য এদের কাছে প্রার্থনা করা হচ্ছে, এসব কিছু জাহেলী ধারণার অনুসরণ ছাড়া আর কিছু হতে পারে? এ ব্যাপারে তাদের সর্বোচ্চ কথা হচ্ছে, তারা এগুলো তাদের পিতা-প্রপিতা পূর্বপুরুষদেরকে করতে দেখেছে। আর তারা তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করবে। কোন দলীল-প্রমাণ তাদের নেই। কেবল শয়তান তাদের অন্তরে এগুলো সুশোভিত করে দিয়েছে। [ইবন কাসীর]

[২] অর্থাৎ এ নির্বোধরা মনে করছে, আল্লাহ্‌র আযাব নাযিল হলে এ উপাস্যরা দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের সাহায্যকারী হবে। অথচ আসলে তাদের কোনই সাহায্যকারী নেই, এ উপাস্যরা তো নয়ই। কারণ তাদের সাহায্য করার কোন ক্ষমতা নেই। আর আল্লাহ্‌ ও তাদের সাহায্যকারী নন। [ইবন কাসীর]

২৩ : ৮৪
قُلْ لِمَنِ الْأَرْضُ وَمَنْ فِيهَا إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ

বলুন, ‘যমীনে এবং এতে যা কিছু আছে এগুলো(র মালিকানা) কার? যদি তোমরা জান (তবে বল)।’
ফুটনোট

২৩ : ৮৮
قُلْ مَنْ بِيَدِهِ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيْءٍ وَهُوَ يُجِيرُ وَلَا يُجَارُ عَلَيْهِ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ

বলুন, ‘কার হাতে সমস্ত বস্তুর কর্তৃত্ব? যিনি আশ্রয় প্রদান করেন অথচ তাঁর বিপক্ষে কেউ কাউকে আশ্রয় দিতে পারে না [১], যদি তোমরা জান (তবে বল)।’

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ আল্লাহ্‌ তা‘আলা যাকে আযাব, মুসীবত ও দুঃখ-কষ্ট থেকে আশ্রয় দান করেন কারও সাধ্য নেই যে তার কোন অনিষ্ট করে। পক্ষান্তরে আল্লাহ্‌ তা‘আলা যদি কাউকে বালা-মুসিবত, দুঃখ-কষ্টে নিপতিত হতে দেন তবে কারও সাধ্য নেই যে, তার মোকাবেলায় কাউকে আশ্রয় দিয়ে তাঁর আযাব থেকে বাঁচিয়ে নেয়। দুনিয়ার দিক দিয়েও এ কথা সত্য যে, আল্লাহ্‌ যাঁর উপকার করতে চান, তাকে কেউ বাধা দিতে পারে না এবং যাকে কষ্ট ও আযাব দিতে চান, তা থেকেও কেউ তাকে বাঁচাতে পারে না। আখিরাতের দিক দিয়েও এই বিষয়বস্তু নির্ভুল যে, যাকে তিনি আযাব দেবেন, তাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না এবং যাকে জান্নাত ও সুখ দেবেন, তাকে কেউ ফেরাতে পারবে না। তাঁর অনুমতি ব্যতীত কেউ সুপারিশও করতে পারবে না। [দেখুন, সা‘দী]

২৪ : ১৫
إِذْ تَلَقَّوْنَهُ بِأَلْسِنَتِكُمْ وَتَقُولُونَ بِأَفْوَاهِكُمْ مَا لَيْسَ لَكُمْ بِهِ عِلْمٌ وَتَحْسَبُونَهُ هَيِّنًا وَهُوَ عِنْدَ اللَّهِ عَظِيمٌ

যখন তোমরা মুখে মুখে এটা ছড়াচ্ছিলে [১] এবং এমন বিষয় মুখে উচ্চারণ করছিলে যার কোন জ্ঞান তোমাদের ছিল না। আর তোমরা এটাকে তুচ্ছ গণ্য করেছিলে, অথচ আল্লাহ্‌র কাছে এটা ছিল গুরুতর বিষয় [২]।

ফুটনোট

[১] تلقى শব্দের মর্ম এই যে, একে অন্যের কাছে জিজ্ঞাসা ও বর্ণনা করে। এখানে কোন কথা শুনে তার সত্যাসত্য যাচাই না করে সামনে চালু করে দেয়া বুঝানো হয়েছে। অপর قراءة এ পড়া হয় تَلِقُّوْنَهُ তখন এর অর্থ হবে মিথ্যা বানিয়ে বলা। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা এভাবে পড়তেন। [বুখারীঃ ৪১৪৪]

[২] অর্থাৎ তোমরা একে তুচ্ছ ব্যাপার মনে করেছিলে যে, যা শুনলে তাই অন্যের কাছে বলতে শুরু করেছিলে। তোমরা সত্যাসত্য যাচাই না করে এমন কথা চালু করে দিয়েছিলে, যদ্দরুন অন্য মুসলিম দারুণ মর্মাহত হয়, লাঞ্ছিত হয় এবং তার জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘কোন কোন লোক আল্লাহ্‌র অসন্তুষ্টি হয় এমন কথা বলে, অথচ সে জানে না যে, এটা কতদূর গিয়ে গড়াবে (অর্থাৎ সে কোন গুরুত্বের সাথে বলেনি)। অথচ এর কারণে সে জাহান্নামের আসমান ও যমীনের দূরত্বের চেয়েও বেশী গভীরে পৌছবে।’ [বুখারীঃ ৬৪৭৮, মুসলিমঃ ২৯৮৮]

২৪ : ৩৫
اللَّهُ نُورُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۚ مَثَلُ نُورِهِ كَمِشْكَاةٍ فِيهَا مِصْبَاحٌ ۖ الْمِصْبَاحُ فِي زُجَاجَةٍ ۖ الزُّجَاجَةُ كَأَنَّهَا كَوْكَبٌ دُرِّيٌّ يُوقَدُ مِنْ شَجَرَةٍ مُبَارَكَةٍ زَيْتُونَةٍ لَا شَرْقِيَّةٍ وَلَا غَرْبِيَّةٍ يَكَادُ زَيْتُهَا يُضِيءُ وَلَوْ لَمْ تَمْسَسْهُ نَارٌ ۚ نُورٌ عَلَىٰ نُورٍ ۗ يَهْدِي اللَّهُ لِنُورِهِ مَنْ يَشَاءُ ۚ وَيَضْرِبُ اللَّهُ الْأَمْثَالَ لِلنَّاسِ ۗ وَاللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ

আল্লাহ্‌ আসমানসমূহ ও যমীনের নূর [১], তাঁর [২] নূরের উপমা যেন একটি দীপাধার যার মধ্যে আছে এক প্রদীপ, প্রদীপটি একটি কাঁচের আবরণের মধ্যে স্থাপিত, কাঁচের আবরণটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত, তা জ্বালানো হয় বরকতময় যায়তূন গাছের তৈল দ্বারা [৩] যা শুধু পূর্ব দিকের (সূর্যের আলোকপ্রাপ্ত) নয় আবার শুধু পশ্চিম দিকের (সূর্যের আলোকপ্রাপ্তও) নয়, আগুন তাকে স্পর্শ না করলেও যেন তার তৈল উজ্জ্বল আলো দিচ্ছে; নূরের উপর নূর! আল্লাহ্‌ যাকে ইচ্ছে হেদায়েত করেন তাঁর নূরের দিকে। আল্লাহ্‌ মানুষের জন্য উপমাসমূহ বর্ণনা করে থাকেন এবং আল্লাহ্‌ সব কিছু সম্পর্কে সর্বজ্ঞ।

ফুটনোট

[১] নূরের সংজ্ঞাঃ নূর শব্দের আভিধানিক অর্থ আলো। [ফাতহুল কাদীর] কুরআন ও হাদীসে আল্লাহ্‌র জন্য নূর কয়েকভাবে সাব্যস্ত হয়েছে।

এক) আল্লাহ্‌র নাম হিসাবে। যে সমস্ত আলেমগণ এটাকে আল্লাহ্‌র নাম হিসাবে সাব্যস্ত করেছেন তারা হলেন, সুফিয়ান ইবনে উ‘য়াইনাহ খাত্তাবী, ইবনে মান্দাহ, হালিমী, বাইহাকী, ইস্পাহানী, ইবনে আরাবী, কুরতুবী, ইবনু তাইমিয়াহ, ইবনুল কাইয়্যেম, ইবনুল ওয়ায়ীর, ইবনে হাজার, আস-সা‘দী, আল-কাহতানী, আল-হামুদ, আশ-শারবাসী, নূরুল হাসান খান প্রমুখ।

দুই) আল্লাহ্‌র গুণ হিসাবে। আল্লাহ্‌ তা‘আলা নূর নামক গুণ তাঁর জন্য বিভিন্ন ভাবে সাব্যস্ত করেছেন। যেমন-

(ক) কখনো কখনো সরাসরি নূরকে তাঁর দিকে সম্পর্কিত করেছেন। আল্লাহ্‌ বলেনঃ مَثَلُ نُوْرِهٖ كَمِشْكوٰةٍ অর্থাৎ “আল্লাহ্‌র নূরের উদাহরণ হলো ...। অন্য আয়াতে আল্লাহ্‌ বলেনঃ وَاَشْرَقَتِ الْاَرْضُ بِنُوْرِرَبِّهَا অর্থাৎ “আর আলোকিত হলো যমীন তার প্রভূর আলোতে।” [সূরা আয-যুমারঃ ৬৯] হাদীসে এসেছে, ‘আল্লাহ্‌ তা‘আলা তার সৃষ্টিকে অন্ধকারে সৃষ্টি করেছেন। তারপর তিনি তাতে তাঁর নূরের কিছু ঢেলে দিলেন। সুতরাং এ নূরের কিছু অংশ যার উপরই পড়েছে, সে হেদায়াত লাভ করেছে। আর যার উপর পড়েনি সে পথভ্রষ্ট হয়েছে।’ [তিরমিযীঃ ২৬৪২]

(খ) কখনো কখনো আল্লাহ্‌ তা‘আলা তাঁর এ নূরকে তার চেহারার দিকে সম্পর্কযুক্ত করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেনঃ ‘আসমান ও যমীনের যাবতীয় নূর তাঁরই চেহারার আলো। [আবু সাইদ আদ-দারেমী]

তিন) আল্লাহ্‌র নূরকে আসমান ও যমীনের দিকে সম্পর্কযুক্ত করে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ্‌ তা‘আলা বলেনঃ

اَللهُ نُوْرْالسَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضِ

অর্থাৎ “আল্লাহ্‌ আসমান ও যমীনের নূর।” এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ

اللّٰهُمَّ لَكَ ا احَمْدُ أَنْتَ نُوْرُ السَّمٰوَاتِ وَالأَرْضِ وَمَنْ فِيْهِنَّ

অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ্‌, আপনার জন্য সমস্ত প্রশংসা, আপনি আসমান ও যমীনের আলো এবং এ দু’য়ের মধ্যে যা আছে তারও (আলো)...। [বুখারীঃ ১১২০, মুসলিমঃ ১৯৯]

চার) আল্লাহ্‌র পর্দাও নূর। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘তাঁর পর্দা হলো নূর।’ [মুসলিমঃ ২৯৩] আর আল্লাহ্‌র রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম মি‘রাজের রাতে এর নূরই দেখেছিলেন। সাহাবাগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেছিলেনঃ ‘আপনি কি আপনার প্রভূকে দেখেছিলেন? তিনি বললেনঃ নূর! কিভাবে তাকে দেখতে পারি?’ [মুসলিমঃ ২৯১] অপর বর্ণনায় এসেছে, ‘আমি নূর দেখেছি।’ [মুসলিমঃ ২৯২] এ হাদীসের সঠিক অর্থ হলো, আমি কিভাবে তাঁকে দেখতে পাব? সেখানে তো নূর ছিল। যা তাকে দেখার মাঝে বাঁধা দিচ্ছিল। আমি তো কেবল নূর দেখেছি। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, আল্লাহ্‌র পর্দাও নূর। এ নূরের পর্দার কারণেই সবকিছু পুড়ে যাচ্ছে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘যদি তিনি তাঁর পর্দা খুলতেন তবে তাঁর সৃষ্টির যতটুকুতে তাঁর নজর পড়ত সবকিছু তাঁর চেহারার আলোর কারণে পুড়ে যেত।’ [মুসলিমঃ ২৯৩-২৯৫]

সুতরাং আসমান ও যমীনের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য দু‘ধরনের নূরই আল্লাহ্‌র। প্রকাশ্য নূর যেমন- আল্লাহ্‌ তা‘আলা স্বয়ং নূর। তাঁর পর্দা নূরের। যদি তিনি তাঁর সে পর্দা উন্মোচন করেন, তাহলে তাঁর সৃষ্টির যতটুকুতে তাঁর দৃষ্টি পড়বে তার সবকিছুই ভস্ম হয়ে যাবে। তাঁর নূরেই আরশ আলোকিত। তাঁর নূরেই কুরসী, সূর্য, চাদ ইত্যাদি আলোকিত। অনুরূপভাবে তাঁর নূরেই জান্নাত আলোকিত। কারণ, সেখানে তো আর সূর্য নেই।

আর অপ্রকাশ্য নূর যেমন- আল্লাহ্‌র কিতাব নূর [সূরা আল-আ‘রাফঃ ১৫৭], তাঁর শরীয়ত নূর [সূরা আল-মায়েদাঃ ৪৪], তাঁর বান্দা ও রাসূলদের অন্তরে অবস্থিত ঈমান ও জ্ঞান তাঁরই নূর [সূরা আয-যুমারঃ ২২]। যদি এ নূর না থাকত তাহলে অন্ধকারের উপর অন্ধকারে সবকিছু ছেয়ে যেত। সুতরাং যেখানেই তাঁর নূরের অভাব হবে সেখানেই অন্ধকার ও বিভ্ৰান্তি দানা বেঁধে থাকে। আর এজন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দো‘আ করতেনঃ ‘হে আল্লাহ্‌, আমার অন্তরে নূর দিন, আমার শ্রবণেন্দ্রীয়ে নূর দিন, আমার দৃষ্টিশক্তিতে নূর দিন, আমার ডানে নূর দিন, আমার বামে নূর দিন, আমার সামনে নূর দিন, আমার পিছনে নূর দিন, আমার উপরে নূর দিন, আমার নীচে নূর দিন। আর আমার জন্য নূর দিন অথবা বলেছেনঃ আমাকে নূর বানিয়ে দিন। অন্য বর্ণনায় এসেছে, আর আমার জন্য আমার আত্মায় নূর দিন। আমার জন্য বৃহৎ নূরের ব্যবস্থা করে দিন। [বুখারীঃ ৬৩১৬, মুসলিমঃ ৭৬৩]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘হে আল্লাহ্‌, আমাকে নূর দিন, আমার জন্য আমার অস্থি ও শিরা-উপশিরায় নূর দিন। আমার মাংসে নুর দিন, আমার রক্তে নূর দিন, আমার চুলে নূর দিন, আমার শরীরে নূর দিন।’ অপর বর্ণনায় এসেছে, ‘হে আল্লাহ্‌, আমার জন্য আমার কবরে নূর দিন। আমার হাড্ডিতে নূর দিন।’ [তিরমিযীঃ ৩৪১৯] অন্যত্র এসেছে, ‘আর আমার নূর বাড়িয়ে দিন, আমার নূর বাড়িয়ে দিন, আমার নূর বাড়িয়ে দিন। [বুখারীঃ আদাবুল মুফরাদ- ৬৯৫] ‘আমাকে নূরের উপর নূর দান করুন।’ [ফাতহুল বারীঃ ১১/১১৮]

আয়াতে আল্লাহ্‌ তা‘আলা সত্তার জন্য ব্যবহৃত ‘নূর’ শব্দটির অর্থ কোন কোন তাফসীরবিদের মতে ‘মুনাওয়ের' অর্থাৎ ঔজ্জ্বল্যদানকারী। অথবা অতিশয়ার্থবোধক পদের ন্যায় নূরওয়ালাকে নূর বলে ব্যক্ত করা হয়েছে। তখন আয়াতের অর্থ হয় যে, আল্লাহ্‌ তা‘আলা নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যে বসবাসকারী সব সৃষ্টজীবের নূরদাতা। এই নূর বলে হেদায়াতের নূর বুঝানো হয়েছে। [দেখুন- বাগভী] ইবনে কাসীর ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে এর তাফসীর এরূপ বর্ণনা করেছেনঃ

اللّٰهُ هَادِى أَهْلِ السَّمَا وَاتِ وَالْاَرْضِ

অর্থাৎ আল্লাহ্‌ নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের অধিবাসীদের হেদায়াতকারী। [ইবন কাসীর]

[২] مَثَلُ ذُوْرِهٖ এর সর্বনাম দ্বারা কাকে বুঝানো হয়েছে, এ সম্পর্কে তাফসীরবিদগণের কয়েকটি উক্তি এসেছেঃ

(এক) এই সর্বনাম দ্বারা আল্লাহ্‌ তা‘আলাকে বুঝানো হয়েছে। আয়াতের অর্থ এই যে, আল্লাহ্‌র নূর হেদায়াত যা মুমিনের অন্তরে রাখা হয়েছে, তার দৃষ্টান্ত كَمِشْكَاةٍ এটা ইবনে-আব্বাসের উক্তি। অর্থাৎ মুমিনের অন্তরস্থিত কুরআন ও ঈমানের মাধ্যমে সঞ্চিত আল্লাহ্‌র নূরকে তুলনা করে বলা হচ্ছে যে, এ নূরের উদাহরণ হলো এমন একটি তাকের মত যেখানে আল্লাহ্‌র নূর আলোর মত উজ্জল ও সদা বিকিরনশীল। সে হিসেবে আয়াতের প্রথমে আল্লাহ্‌ তা‘আলা নিজের নূর উল্লেখ করেছেন

اللهُ نُوْرُالسَّمٰوٰتِ وَالْاارضِ

অতঃপর মুমিনের অন্তরে অবস্থিত তাঁরই নূর উল্লেখ করেছেন مَثَلُ نُوْرِهٖ -উবাই ইবনে কা‘ব এই আয়াতের কেরাআতও مَثَلُ نُوْرِهٖ এর পরিবর্তে

مَثَلُ نُوْرِمَنْ آمَنَ بِهِ

পড়তেন। সাঈদ ইবনে যুবায়ের এই কেরাআত এবং আয়াতের এই অর্থ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকেও বর্ণনা করেছেন।

(দুই) এই সর্বনাম দ্বারা মুমিনকেই বুঝানো হয়েছে। তখন দৃষ্টান্তের সারমর্ম এই যে, মুমিনের বক্ষ একটি তাকের মত এবং এতে তার অন্তর একটি প্রদীপ সদৃশ। এতে যে স্বচ্ছ যয়তুন তৈলের কথা বলা হয়েছে, এটা মুমিনের স্বভাবে গচ্ছিত রাখা নূরে ঈমানের দৃষ্টান্ত। এর বৈশিষ্ট্য আপনা-আপনি সত্যকে গ্ৰহণ করা। যয়তুন তৈল অগ্নি স্পর্শে প্ৰজ্বলিত হয়ে যেমন অপরকে আলোকিত করে, এমনিভাবে মুমিনের অন্তরে রাখা নূরে-হেদায়াত যখন আল্লাহ্‌র ওহী ও জ্ঞানের সাথে মিলিত হয়, তখন আলোকিত হয়ে বিশ্বকে আলোকিত করে দেয়। সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীগণ এই দৃষ্টান্তকে বিশেষভাবে মুমিনের অন্তরের সাথে সম্পর্কযুক্ত করেছেন। এর কারণও সম্ভবতঃ এই যে, এই নূর দ্বারা শুধু মুমিনই উপকার লাভ করে। নতুবা এই সৃষ্টিগত হেদায়াতের নূর যা সৃষ্টির সময় মানুষের অন্তরে রাখা হয়, তা বিশেষভাবে মুমিনের অন্তরেই রাখা হয় না; বরং প্রত্যেক মানুষের মজ্জায় ও স্বভাবে এই হেদায়াতের নূর রাখা হয়। এরই প্রতিক্রিয়া জগতের প্রত্যেক জাতি, প্রত্যেক ভূখণ্ড এবং প্রত্যেক ধর্মাবলম্বীর মধ্যে পরিদৃষ্ট হয় যে, তারা আল্লাহ্‌র অস্তিত্ব ও তাঁর মহান কুদরতের প্রতি সৃষ্টিগতভাবে বিশ্বাস রাখে এবং তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করে। তারা আল্লাহ্‌ তা‘আলা সম্পর্কিত ধারণা ও ব্যাখ্যায় যত ভুলই করুক, কিন্তু আল্লাহ্‌র অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রত্যেক মানুষ সৃষ্টিগতভাবেই বিশ্বাসী। তবে কিছুসংখ্যক বস্তুবাদীর কথা ভিন্ন। তাদের স্বভাবধর্মই বিকৃত হয়ে গেছে। ফলে তারা আল্লাহ্‌র অস্তিত্বই অস্বীকার করে। একটি সহীহ হাদীস থেকে এই ব্যাপক অর্থের সমর্থন পাওয়া যায়। এতে বলা হয়েছে,

كُلُّ مَوْلُوْدٍ قُوْلَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ

অর্থাৎ “প্রত্যেকটি শিশু ফিতরতের উপর জন্মগ্রহণ করে।’’ [বুখারীঃ ২৪৪, মুসলিমঃ ২৬৫৮] এরপর তার পিতামাতা তাকে ফিতরতের দাবী থেকে সরিয়ে ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করে। এই ফিতরতের অর্থ ঈমানের হেদায়াত। ঈমানের হেদায়াত ও তার নূর প্রত্যেক মানুষকে সৃষ্টি করার সময় তার মধ্যে রাখা হয়। যখন নবী ও তাদের নায়েবদের মাধ্যমে তাদের কাছে ওহীর জ্ঞান পৌঁছে, তখন তারা সহজেই তা গ্ৰহণ করে নেয়। তবে স্বভাবধর্ম বিকৃত কতিপয় লোকের কথা ভিন্ন। তারা নিজেদের কুকর্মের দ্বারা সৃষ্টিগত নূরকে ধ্বংস করে দিয়েছে। সম্ভবতঃ এ কারণেই আয়াতের শুরুতে নূর দান করার কথাটি ব্যাপকাকারে বর্ণনা করা হয়েছে, যাতে ভূমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের অধিবাসীরা সবাই শামিল। এতে মুমিন ও কাফেরেরও প্রভেদ করা হয়নি। কিন্তু আয়াতের শেষে বলা হয়েছে

يَهْدِى اللهُ لِنُوْرِهٖ مَنْ يَّشَآءُ

অর্থাৎ “আল্লাহ্‌ তা‘আলা যাকে ইচ্ছা তাঁর নূরের দিকে পথ প্রদর্শন করেন”। এখানে আল্লাহ্‌র ইচ্ছার শর্তটি সেই সৃষ্টিগত নূরের সাথে সম্পৃক্ত নয়, যা প্রত্যেক মানুষের মধ্যে রাখা হয়; বরং এর সম্পর্ক কুরআনের নূরের সাথে, যা প্রত্যেকের অর্জিত হয় না। যারা আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে তাওফীক পায়, তারাই এই নূর লাভ করে। নতুবা আল্লাহ্‌র তৌফিক ছাড়া মানুষের চেষ্টাও অনর্থক; বরং মাঝে মাঝে ক্ষতিকরও হয়।

(তিন) এখানে نور দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্তরের নূরকে বুঝানো হয়েছে। ইমাম বাগভী বর্ণনা করেন যে, একবার ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কা‘ব আহবারকে জিজ্ঞেস করলেনঃ এই আয়াতের তাফসীরে আপনি কি বলেন? ক‘ব আহবার তাওরাত ও ইঞ্জিলের সুপণ্ডিত মুসলিম ছিলেন। তিনি বললেনঃ এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র অন্তরের দৃষ্টান্ত। মিশকাত তথা তাক মানে তার বক্ষদেশ, زُخَاجَةٍ তথা কাঁচপাত্র মানে তার পবিত্র অন্তর এবং مِصْبَاحٌ তথা প্ৰদীপ মানে নবুয়ত। এই নবুয়তরূপী নূরের বৈশিষ্ট্য এই যে, প্রকাশিত ও ঘোষিত হওয়ার পূর্বেই এতে মানবমণ্ডলীর জন্য আলো ও ঔজ্জ্বল্য ছিল। এরপর ওহী ও ঘোষণা এর সাথে সংযুক্ত হলে এটা এমন নূরে পর্যবসিত হয়, যা সমগ্র বিশ্বকে আলোকোজ্জ্বল করে দেয়। [দেখুন-ইবন কাসীর, কুরতুবী, বাগভী]

[৩] এতে প্রমাণিত হয় যে, যয়তূন ও যয়তূন বৃক্ষ কল্যাণময় ও উপকারী। আলেমগণ বলেনঃ আল্লাহ্‌ তা‘আলা এতে অগণিত উপকারিতা নিহিত রেখেছেন। একে প্রদীপে ব্যবহার করা হয়। এর আলো অন্যান্য তৈলের আলোর চাইতে অধিক স্বচ্ছ হয়। একে রুটির সাথে ব্যবহার করা হয়। এর ফলও ভক্ষিত হয়। এর তৈল সংগ্ৰহ করার জন্য কোন যন্ত্র অথবা মাড়াইকল ইত্যাদির প্রয়োজন হয় না- আপনাআপনিই ফল থেকে তৈল বের হয়ে আসে। [বাগভী] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ “যয়তুন তৈল খাও এবং শরীরে মালিশও কর। কেননা, এটা কল্যাণময় বৃক্ষ।” [তিরমিযীঃ ১৮৫১, ১৮৫২, ইবনে মাজহঃ ৩৩১৯]

২৪ : ৬৪
أَلَا إِنَّ لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۖ قَدْ يَعْلَمُ مَا أَنْتُمْ عَلَيْهِ وَيَوْمَ يُرْجَعُونَ إِلَيْهِ فَيُنَبِّئُهُمْ بِمَا عَمِلُوا ۗ وَاللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ

জেনে রাখ, আসমানসমূহ যমীনে যা কিছু আছে তা আল্লাহ্‌রই; তোমরা যাতে ব্যাপৃত তিনি তা অবশ্যই জানেন। আর যেদিন তাদেরকে তাঁর কাছে ফিরিয়ে নেয়া হবে, সেদিন তিনি তাদেরকে জানিয়ে দেবেন তারা যা করত। আর আল্লাহ্‌ সবকিছু সম্পর্কে সর্বজ্ঞ।
ফুটনোট

২৭ : ১৫
وَلَقَدْ آتَيْنَا دَاوُودَ وَسُلَيْمَانَ عِلْمًا ۖ وَقَالَا الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي فَضَّلَنَا عَلَىٰ كَثِيرٍ مِنْ عِبَادِهِ الْمُؤْمِنِينَ

আর অবশ্যই আমরা দাউদ ও সুলাইমানকে জ্ঞান দান করেছিলাম [১] এবং তারা উভয়ে বলেছিলেন, ‘সকল প্রশংসা আল্লাহ্‌র যিনি আমাদেরকে তাঁর বহু মুমিন বান্দাদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন [২]।’

ফুটনোট

[১] এখানে নবীদের নবুওয়ত-রেসালত সহ যাবতীয় প্রশস্ত জ্ঞান সবই উদ্দেশ্য। [ইবন কাসীর; জালালাইন; সা‘দী] যেমন দাউদ আলাইহিসসালামকে লৌহবর্ম নির্মাণ শিল্প শেখানো হয়েছিল। নবীগণের মধ্যে দাউদ ও সুলাইমান আলাইহিমাসসালাম এই বৈশিষ্টের অধিকারী ছিলেন যে, তাদেরকে নবুওয়ত ও রেসালতের সাথে রাজত্ব দান করা হয়েছিল। তাদেরকে বিচার-ফয়সালার জ্ঞানও প্রদান করা হয়েছিল। সুলাইমানের রাজত্ব এমন নজিরবিহীন যে, শুধু মানুষের উপর নয়- জিন ও জন্তু-জানোয়ারদের উপরও তার শাসন ক্ষমতা ছিল।

[২] আসলে আল্লাহ্‌র দেয়া যে ক্ষমতা তাদেরকে দেয়া হয়েছে তাকে আল্লাহ্‌র ইচ্ছা ও মর্জি অনুযায়ী ব্যবহার করা উচিত। কারণ, এ ক্ষমতার সঠিক ব্যবহার ও অপব্যবহারের জন্য তাদেরকে প্রকৃত মালিকের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। ফির‘আউন শাসন ক্ষমতা ধন-সম্পদ, মান-মর্যাদা, এগুলো লাভ করেছিল এবং দাউদ ও সুলাইমান আলাইহিস সালামও সে ধরনের নেয়ামত লাভ করেছিলেন। কিন্তু অজ্ঞতা তাদের মধ্যে কত বড় ব্যবধান সৃষ্টি করে দিয়েছে তা বর্ণনার জন্যই এখানে সুলাইমান আলাইহিসসালামের ঘটনা উল্লেখ করা হচ্ছে। [আত-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর]

২৭ : ৪০
قَالَ الَّذِي عِنْدَهُ عِلْمٌ مِنَ الْكِتَابِ أَنَا آتِيكَ بِهِ قَبْلَ أَنْ يَرْتَدَّ إِلَيْكَ طَرْفُكَ ۚ فَلَمَّا رَآهُ مُسْتَقِرًّا عِنْدَهُ قَالَ هَٰذَا مِنْ فَضْلِ رَبِّي لِيَبْلُوَنِي أَأَشْكُرُ أَمْ أَكْفُرُ ۖ وَمَنْ شَكَرَ فَإِنَّمَا يَشْكُرُ لِنَفْسِهِ ۖ وَمَنْ كَفَرَ فَإِنَّ رَبِّي غَنِيٌّ كَرِيمٌ

কিতাবের জ্ঞান যার ছিল [১], সে বলল, ‘আপনি চোখের পলক ফেলার আগেই আমি তা আপনাকে এনে দেব।’ অতঃপর সুলাইমান যখন তা সামনে স্থির অবস্থায় দেখলেন তখন তিনি বললেন, ‘এ আমার রব-এর অনুগ্রহ, যাতে তিনি আমাকে পরীক্ষা করেন যে, আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি, না অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। আর যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, সে তো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে নিজেরই কল্যাণের জন্য, আর যে কেউ অকৃতজ্ঞ হবে, সে জেনে রাখুক যে, আমার রব অভাবমুক্ত, মহানুভাব [২]।’

ফুটনোট

[১] বলা হয়েছেঃ ‘কিতাবের জ্ঞান যার কাছে ছিল সে বলল’ এখানে কিতাবের জ্ঞান কার কাছে ছিল তার সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। এ ব্যাক্তি কে ছিল, তার কাছে কোন বিশেষ ধরনের জ্ঞান ছিল এবং যে কিতাবের জ্ঞান তার আয়ত্ত্বাধীন ছিল সেটি কোন কিতাব ছিল, এ সম্পর্কে কোন চূড়ান্ত ও নিশ্চিত কথা বলা সম্ভবপর নয়। কুরআনে বা কোন সহীহ হাদীসে এ বিষয়গুলো সুস্পষ্ট করা হয়নি। তাফসীরকারদের মধ্যে থেকে কেউ কেউ বলেন, সে ছিল একজন ফেরেশতা আবার কেউ কেউ বলেন, একজন মানুষই ছিল। তারপর সে মানুষটিকে চিহ্নিত করার ব্যাপারেও তাদের মধ্যে মতদ্বৈধতা রয়েছে। এভাবে কিতাব সম্পর্কেও মুফাসসিরগণের বিভিন্ন বক্তব্য পেশ করেছেন। কেউ বলেন, এর অর্থ লাওহে মাহফুজ এবং কেউ বলেন, শরী‘আতের কিতাব। কিন্তু এগুলো সবই নিছক অনুমান। আর কিতাব থেকে ঐ অর্জিত জ্ঞান সম্পর্কেও বিনা যুক্তি-প্রমাণে ঐ একই ধরনের অনুমানের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। তবে এ সম্পর্কে এমন সম্ভাবনাও আছে যে, স্বয়ং সুলাইমান আলাইহিসসালামই তিনি। কেননা, আল্লাহ্‌র কিতাবের সর্বাধিক জ্ঞান তারই বেশী ছিল। এমতাবস্থায় গোটা ব্যাপারটাই একটা মু‘জিযা এবং সাবার রাণীকে নবীসুলভ মু‘জিযা দেখানোই উদ্দেশ্য ছিল। কাজেই এ ব্যাপারে আপত্তির কোন কিছু নেই। কিন্তু অধিকাংশ তাফসীরবিদের মতে, এ লোক সুলাইমান আলাইহিসসালামের সহচর ছিলেন, যার নাম ছিলঃ আসেফ ইবন বরখিয়া। সে হিসেবে এটা একটি কারামত ছিল। [দেখুন, ফাতহুল কাদীর] এখানে মু‘জিযা ও কারামাতের মধ্যে কিছু সুনির্দিষ্ট পার্থক্য বর্ণনা করছিঃ

মু‘জিযা নবুওয়তের দাবীর সাথে সম্পৃক্ত। আর কারামতের ব্যাপারে এ দাবী থাকতে পারে না।

মু‘জিযা নবীর ইচ্ছাধীন। তিনি সেটা দেখাতে ও প্রকাশে সমর্থ হন। পক্ষান্তরে কারামত দেখাবার ব্যাপার নয়। আল্লাহ্‌ তা‘আলা কারামতের মাধ্যমে নবীর উম্মতের মধ্যে যাকে ইচ্ছে সম্মানিত করেন। তারা প্ৰকাশ্য সৎকর্মশীল লোকই হয়ে থাকেন। নবীদের মু‘জিযার উপরে তার উম্মাতের কারো কারামত প্রাধান্য পেতে পারে না। অর্থাৎ নবীর মু‘জিযা জাতীয় হবে। নবীকে ছাড়িয়ে কেউ কারামত দেখাতে পারে না।

কারামত মূলতঃ নবীর মু‘জিযারই অংশ। নবীর অনুসরণ না করলে কারামত কখনো হাসিল হতে পারে না। যারা নবীর অনুসরণ করবে না তারা যদি এ ধরণের কিছু দেখায় তবে স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে যে, সেটা কোন যাদু বা সম্মোহনী অথবা ধোঁকার অংশ। [ইমাম আল-লালকায়ী, কারামাতু আওলিয়ায়িল্লাহ এর ভূমিকা; ইবন তাইমিয়্যাহ, আন-নুবুওয়াতঃ ৫০৩; উমর সুলাইমান আল-আশকার; আর-রুসুল ওয়ার রিসালাহ]

[২] অর্থাৎ তিনি কারো কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মুখাপেক্ষী নন। কারো কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ফলে তাঁর সার্বভৌম কর্তৃত্ব সামান্য পরিমাণও বৃদ্ধি পায় না আবার কারো অকৃতজ্ঞতার ফলে তাতে এক চুল পরিমাণ কমতিও হয় না। তিনি নিজস্ব শক্তি বলে সর্বময় কর্তৃত্ব প্রয়োগ করে যাচ্ছেন। বান্দাদের মানা না মানার উপর তাঁর কর্তৃত্ব নির্ভরশীল নয়। কুরআন মজীদে একথাটিই এক জায়গায় মূসার মুখ দিয়ে উদ্ধৃত করা হয়েছেঃ “যদি তোমরা এবং সারা দুনিয়াবাসীরা মিলে কুফরী করো তাহলেও তাতে আল্লাহ্‌র কিছু আসে যায় না, তিনি অমুখাপেক্ষী এবং আপনি সত্তায় আপনি প্রশংসিত।” [সূরা ইবরাহীমঃ ৮] অনুরূপভাবে, নিম্নোক্ত হাদীসে কুদসীতেও এ একই বিষয়বস্তুর অবতারণা করা হয়েছেঃ “মহান আল্লাহ্‌ বলেন, হে আমার বান্দারা যদি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তোমরা সকল মানুষ ও জিন তোমাদের মধ্যকার সবচেয়ে বেশী মুত্তাকী ব্যাক্তির হৃদয়ের মতো হয়ে যাও, তাহলে তার ফলে আমার বাদশাহী ও শাসন কর্তৃত্বে কিছুমাত্র বৃদ্ধি ঘটে না। হে আমার বান্দারা! যদি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তোমরা সকল মানুষ ও জিন তোমাদের মধ্যকার সবচেয়ে বেশী বদকার ব্যাক্তিটির হৃদয়ের মতো হয়ে যাও, তাহলে এর ফলে আমার বাদশাহীতে কোন কমতি দেখা যাবে না। হে আমার বান্দারা! এগুলো তোমাদের নিজেদেরই কর্ম, তোমাদের হিসেবের খাতায় আমি এগুলো গণনা করি, তারপর এগুলোর পুরোপুরি প্রতিদান আমি তোমাদের দিয়ে থাকি। কাজেই যার ভাগ্যে কিছু কল্যাণ এসেছে তার উচিত আল্লাহ্‌র শোকরগুজারী করা এবং যে অন্যকিছু লাভ করেছে সে যেন নিজেকেই ভর্ৎসনা করে”। [মুসলিমঃ ২৫৭৭]

২৭ : ৪২
فَلَمَّا جَاءَتْ قِيلَ أَهَٰكَذَا عَرْشُكِ ۖ قَالَتْ كَأَنَّهُ هُوَ ۚ وَأُوتِينَا الْعِلْمَ مِنْ قَبْلِهَا وَكُنَّا مُسْلِمِينَ

অতঃপর সে নারী যখন আসল, তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হল, ‘তোমার সিংহাসন কি এরূপই?’ সে বলল, ‘মনে হয় এটা সেটাই। আর আমাদেরকে ইতিপূর্বেই প্রকৃত জ্ঞান দান করা হয়েছে এবং আমরা আজ্ঞাবহও হয়ে গেছি [১]।’

ফুটনোট

[১] আয়াতের শেষাংশ অর্থাৎ ‘আমাদেরকে ইতিপূর্বেই প্রকৃত জ্ঞান দান করা হয়েছে এবং আমরা আজ্ঞাবহও হয়ে গেছি’ এটা কার কথা তা নির্ধারণে দুটি মত রয়েছেঃ এক, এটা সাবার রাণীর বক্তব্য। সুতরাং তখন অর্থ হবে, আমাদের কাছে আপনার নবুওয়ত ও ঐশ্বর্যের জ্ঞান আগেই এসেছে তাই আমরা পূর্ব থেকেই আনুগত্য প্রকাশ করে নিয়েছি। এর আরেক অর্থ এটাও হতে পারে যে, অর্থাৎ এ মু‘জিযা দেখার আগেই সুলাইমান আলাইহিস সালামের যেসব গুণাবলী ও বিবরণ আমরা জেনেছিলাম তার ভিত্তিতে আমাদের বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল যে, তিনি নিছক একটি রাজ্যের শাসনকর্তা নন বরং আল্লাহ্‌র একজন নবী। দুই, এটা সুলাইমান আলাইহিসসালামের কথা। তখন অর্থ হবে, আমরা আগে থেকেই আল্লাহ্‌র কুদরত সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকায় তাঁর উপর ঈমান এনেছি। বা আমরা আগে থেকেই জানতাম যে, আপনি আনুগত্য করবেন অথবা আপনার আগমনের পূর্বেই আমাদের জানা ছিল যে, আপনি ইসলাম গ্ৰহণ করেছেন এবং আপনি অনুগত হয়ে আসছেন । [ফাতহুল কাদীর]

২৭ : ৫২
فَتِلْكَ بُيُوتُهُمْ خَاوِيَةً بِمَا ظَلَمُوا ۗ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَةً لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ

সুতরাং এ তো তাদের ঘরবাড়ী---যুলুমের কারণে যা জনশূন্য অবস্থায় পড়ে আছে; নিশ্চয় এতে নিদর্শন রয়েছে, সে সম্প্রদায়ের জন্য যারা জানে [১]।

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ তাদের জন্যই নিদর্শন রয়েছে যারা প্রকৃত অবস্থা জানে। আর যারা আল্লাহ্‌র আযাব ও শাস্তি নাযিল হওয়ার ব্যাপারটি সম্পর্কে সম্যক অবগত। তারা আরও জানে যে, আল্লাহ্‌ তাঁর বন্ধুদের সাথে কি ব্যবহার করেন। তাদের এটাও জানা রয়েছে যে, যুলুমের পরিণতি হচ্ছে, ধ্বংস ও বিপর্যয়, আর ঈমান ও ইনসাফের পরিণতি হচ্ছে নাজাত ও সফলতা। [সা‘দী] কিন্তু মূর্খদের ব্যাপার আলাদা। তারা তো বলবে, সামূদ জাতি যে ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হয় তার সাথে সালেহ ও তার উটনীর কোন সম্পর্ক নেই। এসব তো প্রাকৃতিক কারণে হয়ে থাকে। কিন্তু চিন্তাশীল ও জ্ঞানবান লোক মাত্ৰই জানেন, কোন অন্ধ ও বধির আল্লাহ্‌ এ বিশ্ব-জাহানের উপর রাজত্ব করছেন না বরং এক সর্বজ্ঞ ও পরম বিজ্ঞ সত্তা এখানে সকলের ভাগ্যের নিষ্পত্তি করছেন।

২৭ : ৬৬
بَلِ ادَّارَكَ عِلْمُهُمْ فِي الْآخِرَةِ ۚ بَلْ هُمْ فِي شَكٍّ مِنْهَا ۖ بَلْ هُمْ مِنْهَا عَمُونَ

বরং আখেরাত সম্পর্কে তাদের জ্ঞান তো নিঃশেষ হয়েছে [১]; তারা তো এ বিষয়ে সন্দেহে রয়েছে, বরং এ বিষয়ে তারা অন্ধ [২]।

ফুটনোট

[১] আয়াতে ব্যবহৃত হয়েছে, اِدَّارَكَ শব্দটি। এ শব্দে বিভিন্ন কেরাআত আছে এবং অর্থ সম্পর্কেও নানা উক্তি রয়েছে। কোন কোন তাফসীরকার اِدَّارَكَ শব্দের অর্থ নিয়েছেন تكامل অর্থাৎ পরিপূর্ণ হওয়া এবং فِى الْاٰخِرَةِ কে اِدَّارَكَ এর সাথে সম্পর্কযুক্ত করে আয়াতের অর্থ এই সাব্যস্ত করেছেন যে, আখেরাতে এ সম্পর্কে তাদের জ্ঞান পরিপূর্ণ হয়ে যাবে। কেননা, তখন প্রত্যেক বস্তুর স্বরূপ পরিস্ফুট হয়ে সামনে এসে যাবে। তবে তখনকার জ্ঞান তাদের কোন কাজে লাগবে না। কারণ, দুনিয়াতে তারা আখেরাতকে মিথ্যা বলে বিশ্বাস করত। তখন পরবর্তী বাক্য ‘তারা তো এ বিষয়ে সন্দেহে রয়েছে, বরং এ বিষয়ে তারা অন্ধ’ এর দ্বারা দুনিয়ার বর্তমান অবস্থা বুঝানো উদ্দেশ্য হবে। অর্থাৎ একই আয়াতের প্রথমাংশ আখেরাতের সাথে আর বাকী অংশ দুনিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট। [দেখুন, কুরতুবী; ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর] আবার কেউ কেউ ‘আখেরাতে তাদের জ্ঞান পরিপূর্ণ হওয়া’ কথাটি আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে অস্বীকারের সুরে এবং উপহাস হিসেবে নিয়েছেন। অর্থাৎ আখেরাত সম্পর্কে তাদের জ্ঞান কি পরিপূর্ণতা লাভ করেছে যে, তারা এতো বেপরোয়া হয়ে গেছে? পরবর্তী আয়াতাংশ ‘তারা তো এ বিষয়ে সন্দেহে রয়েছে, বরং এ বিষয়ে তারা অন্ধ’ এর দ্বারা উপরোক্ত অর্থের জোরালো সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে। [দেখুন, কুরতুবী; ফাতহুল কাদীর] কোন কোন তাফসীরকারের মতে, اِدَّارَكَ শব্দের অর্থ ضَلَّ ও غٰابَ এবং فِى الْاٰخِرَةِ শব্দটি عِلْمُهُم এর সাথে সম্পর্কযুক্ত। অর্থাৎ আখেরাতের ব্যাপারে তাদের জ্ঞান উধাও হয়ে গেছে। তারা একে বুঝতে পারেনি। [ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর]

[২] عَمُونْ শব্দটি عم শব্দের বহুবচন। এটা অন্তরের অন্ধত্বকে বুঝায়। অর্থাৎ তারা অন্তর্দৃষ্টি অভাবে কোন দলীল-প্রমাণই প্রত্যক্ষ করছে না। তারা যেন অন্ধই থেকে যাবে। তাদের কাছে কোন দলীল-প্রমাণই কাজে আসবে না। [ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর]

২৭ : ৮৪
حَتَّىٰ إِذَا جَاءُوا قَالَ أَكَذَّبْتُمْ بِآيَاتِي وَلَمْ تُحِيطُوا بِهَا عِلْمًا أَمَّاذَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ

শেষ পর্যন্ত যখন তারা এসে যাবে তখন আল্লাহ্‌ তাদেরকে বলবেন, ‘তোমরা কি আমার নিদর্শন প্রত্যাখ্যান করেছিলে, অথচ তা তোমরা জ্ঞানে আয়ত্ত করতে পারনি [১]? নাকি তোমরা আর কিছু করেছিলে [২]?’

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ কোন তথ্যভিত্তিক গবেষণার মাধ্যমে তোমরা এ আয়াতগুলোর মিথ্যা হবার কথা জানতে পেরেছিলে, এ আয়াতগুলো অস্বীকার করার পেছনে তোমাদের এ কারণ কখনোই ছিল না। তোমরা কোন প্রকার চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা-অনুসন্ধান ছাড়াই আমার আয়াতসমূহ অস্বীকার করেছিলে। [দেখুন, কুরতুবী; ফাতহুল কাদীর] এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, আল্লাহ্‌র আয়াতসমূহে মিথ্যা বলা একটি গুরুতর অপরাধ ও গোনাহ; বিশেষতঃ যখন কেউ চিন্তা-ভাবনাও বোঝা-শোনার চেষ্টা না করেই মিথ্যা বলতে থাকে। এমতাবস্থায় এটা দ্বিগুণ অপরাধ হয়ে যায়। এতে আরও প্রমাণিত হয় যে, যারা ইসলামী শরী‘আতের কোন ইলম যথা আরবী ভাষা বা উসুলে ফিকহ বা এ জাতীয় কিছুর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে তারা নিঃসন্দেহে মূর্খ। মূর্খতাই তাদেরকে এ ধরনের কার্যকলাপে নিপতিত করে। [ফাতহুল কাদীর]

[২] অর্থাৎ যদি এমন না হয়, তাহলে কি তোমরা একথা প্রমাণ করতে পারবে যে, গবেষণা-অনুসন্ধানের পর তোমরা এ আয়াতগুলোকে মিথ্যা পেয়েছিলে এবং সত্যিই কি তোমরা এ আয়াতগুলোয় যা বর্ণনা করা হয়েছে তা প্রকৃত সত্য নয়, এ ধরনের কোন জ্ঞান লাভ করেছিলে? মূলতঃ তোমরা এগুলোতে কোন শ্রম দাওনি। তোমরা তোমাদের কোন কাজে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলে যে, আল্লাহ্‌র আয়াতসমূহের প্রতি নজর দিতে, আর সেগুলোর অর্থের প্রতি চিন্তা গবেষণা করা থেকে তোমাদেরকে বিরত রেখেছিল? [ফাতহুল কাদীর]

২৮ : ১৪
وَلَمَّا بَلَغَ أَشُدَّهُ وَاسْتَوَىٰ آتَيْنَاهُ حُكْمًا وَعِلْمًا ۚ وَكَذَٰلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ

আর যখন মূসা পূর্ণ যৌবনে উপনীত ও পরিণত বয়স্ক হল [১] তখন আমরা তাকে হিকমত ও জ্ঞান দান করলাম [২]; আর এভাবেই আমরা মুহসিনদেরকে পুরস্কার প্রদান করে থাকি।

ফুটনোট

[১] أشدّ শব্দের আভিধানিক অর্থ, শক্তি ও জোরের চরম সীমায় পৌঁছা। মানুষ শৈশবের দুর্বলতা থেকে আস্তে আস্তে শক্তি-সামর্থ্যের দিকে অগ্রসর হয়। তারপর এমন এক সময় আসে, যখন অস্তিত্বে যতটুকু শক্তি আসা সম্ভবপর, সবটুকুই পূর্ণ হয়ে যায়। এই সময়কেই أشدّ বলা হয়। এটা বিভিন্ন ভূখণ্ড ও বিভিন্ন জাতির মেজায অনুসারে বিভিন্ন রূপ হয়ে থাকে। কারও এই সময় তাড়াতাড়ি আসে এবং কারও দেরীতে। কোন কোন মুফাসসির এটাকে ৩৪ বছর বলে মত প্ৰকাশ করেছেন। যাকে আমরা পরিণত বয়স বলে থাকি এখানে সেটাই বোঝানো হয়েছে। এতে দেহের বৃদ্ধি একটি বিশেষ সীমা পর্যন্ত পৌঁছে থেমে যায়। এরপর চল্লিশ বছর পর্যন্ত বিরতিকাল। একে استوى শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করা হয়েছে। এ থেকে জানা গেল যে, استوى তথা পরিণত বয়স ত্ৰিশ বছর থেকে শুরু করে চল্লিশ বছর পর্যন্ত বর্তমান থাকে। [দেখুন, ফাতহুল কাদীর; তাছাড়া সূরা আল-আন‘আমের ১৫২ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় কিছু আলোচনা এসেছে]

[২] হুকুম অর্থ হিকমত, বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা-ধী-শক্তি ও বিচারবুদ্ধি। আর জ্ঞান বলতে বুঝানো হয়েছে দ্বীনী জ্ঞান বা ফিকহ। অথবা নিজের দ্বীন সম্পর্কিত জ্ঞান ও তার পিতৃপুরুষদের দ্বীন। [ফাতহুল কাদীর] কারণ নিজের পিতামাতার সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত থাকার কারণে তিনি নিজের বাপ-দাদা তথা ইউসুফ, ইয়াকুব ও ইসহাক আলাইহিমুস সালামের শিক্ষার সাথে পরিচিত হতে পেরেছিলেন।

২৮ : ৫৬
إِنَّكَ لَا تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَٰكِنَّ اللَّهَ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ ۚ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ

আপনি যাকে ভালবাসেন ইচ্ছে করলেই তাকে সৎপথে আনতে পারবেন না। বরং আল্লাহ্‌ই যাকে ইচ্ছে সৎপথে আনয়ন করেন এবং সৎপথ অনুসারীদের সম্পর্কে তিনিই ভাল জানেন [১]।

ফুটনোট

[১] ‘হেদায়াত’ শব্দটি কয়েক অর্থে ব্যবহৃত হয়। এক, শুধু পথ দেখানো। এর জন্য জরুরী নয় যে, যাকে পথ দেখানো হয় সে গন্তব্যস্থলে পৌছতেই হবে। দুই, পথ দেখিয়ে গন্তব্যস্থলে পৌছে দেয়া। প্রথম অর্থের দিক থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বরং সমস্ত নবীগণ যে হাদী বা পথপ্রদর্শক ছিলেন এবং হেদায়াত যে তাদের ক্ষমতাধীন ছিল, তা বলাই বাহুল্য। কেননা, এই হেদায়াতই ছিল তাদের পরম দায়িত্ব ও কর্তব্য। এটা তাদের ক্ষমতাধীন না হলে তারা নবুওয়াত ও রিসালাতের কর্তব্য পালন করবে কীরূপে? আলোচ্য আয়াতে বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিদায়াতের উপর ক্ষমতাশীল নন। এতে দ্বিতীয় অর্থের হেদায়াত বোঝানো হয়েছে অর্থাৎ গন্তব্যস্থলে পৌছে দেয়া। উদ্দেশ্য এই যে, প্রচার ও শিক্ষার মাধ্যমে আপনি কারও অন্তরে ঈমান সৃষ্টি করে দিবেন এবং মুমিন বানিয়ে দিবেন, এটা আপনার কাজ নয়। এটা সরাসরি আল্লাহ্‌ তা‘আলার ক্ষমতাধীন। এ সংক্রান্ত আলোচনা সূরা আল-ফাতিহার তাফসীরে উল্লেখিত হয়েছে। হাদীসে এসেছে, এই আয়াত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচা আবু তালিব সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আন্তরিক বাসনা ছিল যে, সে কোনরূপেই ইসলাম গ্ৰহণ করুক। এর প্রেক্ষাপটে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলা হয়েছে যে, কাউকে মুমিন-মুসলিম করে দেয়া আপনার ক্ষমতাধীন নয়। [দেখুন, বুখারীঃ ৩৬৭১, মুসলিমঃ ২৪]।

২৮ : ৭৮
قَالَ إِنَّمَا أُوتِيتُهُ عَلَىٰ عِلْمٍ عِنْدِي ۚ أَوَلَمْ يَعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ قَدْ أَهْلَكَ مِنْ قَبْلِهِ مِنَ الْقُرُونِ مَنْ هُوَ أَشَدُّ مِنْهُ قُوَّةً وَأَكْثَرُ جَمْعًا ۚ وَلَا يُسْأَلُ عَنْ ذُنُوبِهِمُ الْمُجْرِمُونَ

সে বলল, ‘এ সম্পদ আমি আমার জ্ঞানবলে পেয়েছি [১]।’ সে কি জানত না আল্লাহ্‌ তার আগে ধ্বংস করেছেন বহু প্রজন্মকে, যারা তার চেয়ে শক্তিতে ছিল প্রবল, জনসংখ্যায় ছিল বেশী [২]? আর অপরাধীদেরকে তাদের অপরাধ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে না [৩]।

ফুটনোট

[১] বাহ্যতঃ বোঝা যায় যে, এখানে ‘ইলম’ দ্বারা অর্থনৈতিক কলাকৌশল বোঝানো হয়েছে। উদাহরণতঃ ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প ইত্যাদি। এর দু’টি অর্থ হতে পারে।

এক, আমি যা কিছু পেয়েছি নিজের যোগ্যতার বলে পেয়েছি। এটা কোন অনুগ্রহ নয়। অধিকার ছাড়াই নিছক দয়া করে কেউ আমাকে এটা দান করেনি। তাই আমাকে এখন এজন্য এভাবে কারো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার প্রয়োজন নেই যে, যেসব অযোগ্য লোককে কিছুই দেয়া হয় নি তাদেরকে দয়া ও অনুগ্রহ হিসেবে আমি এর মধ্য থেকে কিছু দেবো অথবা আমার কাছ থেকে এ সম্পদ যাতে ছিনিয়ে না নেওয়া হয় সেজন্য কিছু দান খয়রাত করে দেবো। মূর্থ কারূন একথা বুঝল না যে, বিচক্ষণতা, কর্মতৎপরতা, শিল্প অথবা ব্যবসা-বানিজ্য -এগুলোও তো আল্লাহ্‌ তা‘আলারই দান ছিল- তার নিজস্ব গুণ-গরিমা ছিল না।

এর দ্বিতীয় অর্থ এও হতে পারে যে, আমার মতে আল্লাহ্‌ এই যে সম্পদরাজি আমাকে দিয়েছেন এটি তিনি আমার গুণাবলী সম্পর্কে জেনেই দিয়েছেন। যদি তাঁর দৃষ্টিতে আমি একজন পছন্দনীয় মানুষ না হতাম, তাহলে তিনি এসব আমাকে কেন দিলেন? আমার প্রতি তাঁর নেয়ামত বর্ষিত হওয়াটাই প্ৰমাণ করে আমি তাঁর প্রিয় পাত্র এবং আমার নীতিপদ্ধতি তিনি পছন্দ করেন।

[২] কারূনের উক্তির আসল জওয়াব তো এটাই যে, যদি স্বীকার করে নেয়া যায় যে, তোমার ধন-সম্পদ তোমার বিশেষ কর্মতৎপরতা ও কারিগরি জ্ঞান দ্বারাই অর্জিত হয়েছে তবুও তো তুমি আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ থেকে মুক্ত হতে পার না। কেননা, এই কারিগরি জ্ঞান ও উপার্জনশক্তিও তো আল্লাহ্‌ তা‘আলার দান। এই জওয়াব যেহেতু অত্যন্ত সুস্পষ্ট, তাই আল্লাহ্‌ তা‘আলা এটা উপেক্ষা করে এই জওয়াব দিয়েছেন যে, ধরে নাও, তোমার অর্থ-সম্পদ তোমার নিজস্ব জ্ঞান-গরিমা দ্বারাই অর্জিত হয়েছে। কিন্তু স্বয়ং এই ধন-সম্পদের কোন বাস্তব ভিত্তি নেই। অর্থের প্রাচুর্য কোন মানুষের শ্ৰেষ্ঠত্বের মাপকাঠি নয় বরং অর্থ সবাবস্থায় তার কাজে লাগে না। প্রমাণ হিসেবে কুরআন অতীত যুগের বড় বড় ধনকুবেরদের দৃষ্টান্ত পেশ করেছে। তারা যখন অবাধ্যতার পথে চলতে থাকে, তখন আল্লাহ্‌র আযাব তাদেরকে হঠাৎ পাকড়াও করে। তখন অগাধ ধন-সম্পদ তাদের কোন কাজে আসেনি। সুতরাং এ ব্যাক্তি যে নিজেকে বড় পণ্ডিত, জ্ঞানী, গুণী ও চতুর বলে দাবী করে বেড়াচ্ছে এবং নিজের যোগ্যতার অহংকারে মাটিতে পা ফেলছে না, সে কি জানে না যে, তার চাইতেও বেশী অর্থ মর্যাদা, প্রতিপত্তি শক্তি ও শান শওকতের অধিকারী লোক ইতিপূর্বে দুনিয়ায় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে এবং আল্লাহ্‌ শেষ পর্যন্ত তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছেন? যোগ্যতা ও নৈপূণ্যই যদি পার্থিব উন্নতির রক্ষাকারী বিষয় হয়ে থাকে তাহলে যখন তারা ধ্বংস হয়েছিল তখন তাদের এ যোগ্যতাগুলো কোথায় গিয়েছিল? আর যদি কারো পার্থিব উন্নতি লাভ অনিবাৰ্যভাবে একথাই প্রমাণ করে যে, আল্লাহ্‌ তার প্রতি সন্তুষ্ট এবং তিনি তার কর্ম ও গুণাবলী পছন্দ করেন তাহলে সর্বনাশ হলো কেন?

[৩] এখানে তাদের প্রশ্ন না করার অর্থ হলো, তাদের অপরাধ কি তা জানার জন্য কোন প্রশ্ন আল্লাহ্‌ তাদেরকে করবেন না। কেননা তাদের অপরাধ সম্পর্কে আল্লাহ্‌ সম্যক খবর রাখেন। তাদেরকে তাদের অপরাধের স্বীকৃতি আদায় এবং অপরাধের কারণেই যে তারা শাস্তির যোগ্য হয়েছে তা প্রমাণের জন্যই শুধু প্রশ্ন করা হবে।

২৮ : ৮০
وَقَالَ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ وَيْلَكُمْ ثَوَابُ اللَّهِ خَيْرٌ لِمَنْ آمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا وَلَا يُلَقَّاهَا إِلَّا الصَّابِرُونَ

আর যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছিল তারা বলল, ‘ধিক তোমাদেরকে ! যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে তাদের জন্য আল্লাহ্‌র পুরস্কারই শ্রেষ্ঠ এবং ধৈর্যশীল ছাড়া তা কেউ পাবে না [১]।’

ফুটনোট

[১] পূর্ব আয়াতে বর্ণিত ‘যারা দুনিয়ার জীবন কামনা করত’ তাদের বিপরীতে এ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছিল’। এতে পরিষ্কার ইঙ্গিত আছে যে, দুনিয়ার ভোগসম্ভার কামনা করা এবং একে লক্ষ্য স্থির করা আলেমদের কাজ নয়। আলেমদের দৃষ্টি সর্বদা আখেরাতের চিরস্থায়ী সুখের প্রতি নিবদ্ধ থাকে। তারা যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকুই দুনিয়ার ভোগসম্ভার উপার্জন করেন এবং তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেন। আয়াতে আল্লাহ্‌র সাওয়াব বলে দুনিয়াতে আল্লাহ্‌ তাদেরকে যা দিয়েছেন যেমন আল্লাহ্‌র ইবাদাত, তাঁর ভালবাসা, তাঁর কাছে যাওয়ার আগ্রহ, তাঁর কাছে প্রত্যাবর্তন ইত্যাদি যেমন বুঝানো হয়েছে, তেমনি আখেরাতের জান্নাত ও তার নেয়ামতও উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। যে নেয়ামতের কোন শেষ নেই। আর যে নেয়ামতের কোন কিছু চিন্তা-ভাবনা করেও মানুষ দুনিয়াতে শেষ করতে পারবে না। মনে যা চাইবে তা পাবে, চোখে যা দেখবে তা-ই তাদের জন্য থাকবে। [সা‘দী]

২৯ :
وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حُسْنًا ۖ وَإِنْ جَاهَدَاكَ لِتُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا ۚ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ

আর আমরা মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে [১]। তবে তারা যদি তোমার উপর বল প্রয়োগ করে আমার সাথে এমন কিছু শরীক করতে যার সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই [২], তাহলে তুমি তাদেরকে মেনো না [৩]। আমারই কাছে তোমাদের ফিরে আসা। অতঃপর তোমরা কি করেছিলে তা আমি তোমাদেরকে জানিয়ে দেব [৪]।

ফুটনোট

[১] হাদীসে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহ্‌র কাছে সবচেয়ে উত্তম আমল কোনটি? তিনি বললেনঃ সময়মত সালাত আদায় করা। বললঃ তারপর কোনটি? তিনি বললেনঃ পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার। বললঃ তারপর কোনটি? তিনি বললেনঃ আল্লাহ্‌র পথে জিহাদ।’ [বুখারীঃ ৫৯৭০]

[২] আয়াতে বর্ণিত ‘যাকে তুমি আমার শরীক হিসেবে জানো না’ বাক্যাংশটিও অনুধাবনযোগ্য। এর মধ্যে তাদের কথা না মানার সপক্ষে একটি শক্তিশালী যুক্তি প্ৰদান করা হয়েছে। এতে শির্কের জঘন্যতা প্ৰকাশ পেয়েছে। কারণ শির্কের সপক্ষে কোন জ্ঞান নেই। কেউ শির্ককে সঠিক বলে প্ৰমাণ করতে পারবে না। [সা‘দী] এটা পিতা-মাতার অধিকার যে, ছেলেমেয়েরা তাদের সেবা করবে, তাদেরকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করবে এবং বৈধ বিষয়ে তাদের কথা মেনে চলবে। কিন্তু শির্কের ব্যাপারে তাদের অনুসরণ করা যাবে না। অনুরূপভাবে কোন গোনাহর কাজেও নয়। যেমনটি রাসূলের হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। [মুয়াসসার] এ অধিকার দেয়া হয়নি যে, মানুষ নিজের জ্ঞানের বিরুদ্ধে পিতামাতার অন্ধ অনুকরণ করবে। শুধুমাত্ৰ বাপ-মায়ের ধর্ম বলেই তাদের ছেলে বা মেয়ের সেই ধর্ম মেনে চলার কোন কারণ নেই। সন্তান যদি এ জ্ঞান লাভ করে যে, তার বাপ-মায়ের ধর্ম ভুল ও মিথ্যা তাহলে তাদের ধর্ম পরিত্যাগ করে তার সঠিক ধর্ম গ্ৰহণ করা উচিত এবং তাদের চাপ প্রয়োগের পরও যে পথের ভ্রান্তি তার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে সে পথ অবলম্বন করা তার উচিত নয়। বাপ-মায়ের সাথে যখন এ ধরনের ব্যবহার করতে হবে তখন দুনিয়ার প্রত্যেক ব্যাক্তির সাথেও এ ব্যবহার করা উচিত। যতক্ষণ না কোন ব্যাক্তির সত্য পথে থাকা সম্পর্কে জানা যাবে ততক্ষণ তার অনুসরণ করা বৈধ নয়।

[৩] অর্থাৎ পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার সাথে সাথে এটাও জরুরী যে, আল্লাহ্‌র নির্দেশাবলীর অবাধ্যতা না হয়, সীমা পর্যন্ত পিতা-মাতার আনুগত্য করতে হবে। তারা যদি সন্তানকে কুফর ও শির্ক করতে বাধ্য করে, তবে এ ব্যাপারে কিছুতেই তাদের আনুগত্য করা যাবে না; যেমন হাদীসে আছে, আল্লাহ্‌র অবাধ্যতা করে কোন মানুষের আনুগত্য করা বৈধ নয়। [মুসনাদে আহমাদঃ ১/১৩১] কোন কোন বর্ণনা মতে আলোচ্য আয়াত সা‘দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। তিনি দশ জন জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবীগণের অন্যতম ছিলেন এবং অতিশয় মাতৃভক্ত ছিলেন। তার মাতা হামনা বিনতে সুফিয়ান পুত্রের ইসলাম গ্রহণের সংবাদ অবগত হয়ে খুবই মর্মাহত হয়। সে পুত্ৰকে শাসিয়ে শপথ করল, আমি তখন পর্যন্ত আহার্য ও পানীয় গ্রহণ করব না, যে পর্যন্ত তুমি পৈতৃক ধর্মে ফিরে না আস। আমি এমনিভাবে ক্ষুধা ও পিপাসায় মৃত্যুবরণ করব, যাতে তুমি মাতৃহন্তা রূপে বিশ্ববাসীর দৃষ্টিতে হেয় প্রতিপন্ন হও। [মুসলিমঃ ১৭৪৮] এই আয়াত সা‘দকে মাতার আবদার রক্ষা করতে নিষেধ করল। অন্য বর্ণনায় এসেছে, সা‘দের জননী একদিন একরাত মতান্তরে তিনদিন তিনরাত শপথ অনুযায়ী অনশন ধর্মঘট অব্যাহত রাখলে সা‘দ উপস্থিত হলেন। মাতৃভক্তি পূর্ববৎ ছিল; কিন্তু আল্লাহ্‌র ফরমানের মোকাবেলায় তা ছিল তুচ্ছ। তাই জননীকে সম্বোধন করে তিনি বললেনঃ আম্মাজান, যদি আপনার দেহে একশ’ আত্মা থাকত, এবং একটি একটি করে বের হতে থাকত, তা দেখেও আমি আমার দ্বীন ত্যাগ করতাম না। এখন আপনি ইচ্ছা করলে পানাহার করুন অথবা মৃত্যুবরণ করুন। আমি আমার দ্বীন ত্যাগ করতে পারি না। এ কথায় নিরাশ হয়ে তার মাতা অনশন ভঙ্গ করল। [বাগভী]

[৪] অর্থাৎ এ দুনিয়ার আত্মীয়তা এবং আত্মীয়দের সাহায্য-সহযোগীতা কেবলমাত্র এ দুনিয়ার সীমা ত্রিসীমা পর্যন্তই বিস্তৃত । সবশেষে পিতা-মাতা ও সন্তান সবাইকে তাদের স্রষ্টার কাছে ফিরে যেতে হবে। সেখানে তাদের প্রত্যেকের জবাবদিহি হবে তাদের ব্যক্তিগত দায়িত্বের ভিত্তিতে । যদি পিতা-মাতা সন্তানকে পথভ্রষ্ট করে থাকে তাহলে তারা পাকড়াও হবে । যদি সন্তান পিতা-মাতার জন্য পথভ্রষ্টতা গ্রহন করে থাকে তাহলে তাকে শাস্তি পেতে হবে। আর সন্তান যদি সঠিক পথ অবলম্বন করে থাকে এবং পিতা-মাতার বৈধ অধিকার আদায় করার ক্ষেত্রেও কোন প্রকার ত্রুটি না করে থাকে কিন্তু পিতা-মাতা কেবলমাত্র পথভ্রষ্টতার ক্ষেত্রে তাদের সহযোগী না হবার কারণে তাকে নির্যাতন করে থাকে, তাহলে তারা আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচতে পারবে না । আল্লাহ বলছেন যে, কিয়ামতের দিন তোমাদের প্রত্যাবর্তন তো আমারই কাছে । তখন আমি তোমাদের কে তোমাদের পিতা-মাতার প্রতি যে সদ্ব্যবহার করেছ এবং তোমাদের দ্বীনের উপর যে দৃঢ়পদ থেকেছ তার জন্য পুরস্কৃত করব । আর আমি তোমাকে সৎবান্দাদের সাথে হাশর করব, তোমার পিতা-মাতার দলে নয় । যদিও তারা দুনিয়াতে তোমার সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলো । কারণ, একজন মানুষের হাশর কিয়ামতের দিন তার সাথেই হবে, যাকে সে ভালোবাসে । অর্থাৎ, দ্বীনী ভালোবাসা। তাই পরবর্তী আয়াতে বলেছেন যে, “আর যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে আমরা অবশ্যই তাদেরকে সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত করবো ।” [ ইবনে কাসীর; আরও দেখুন, ফাতহূল কাদীর ]

২৯ : ২০
قُلْ سِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَانْظُرُوا كَيْفَ بَدَأَ الْخَلْقَ ۚ ثُمَّ اللَّهُ يُنْشِئُ النَّشْأَةَ الْآخِرَةَ ۚ إِنَّ اللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

বলুন, ‘তোমরা যমীনে ভ্রমণ কর অতঃপর প্রত্যক্ষ কর, কিভাবে তিনি সৃষ্টি আরম্ভ করেছেন? তারপর আল্লাহ্‌ সৃষ্টি করবেন পরবতী সৃষ্টি। নিশ্চয় আল্লাহ্‌ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।
ফুটনোট

২৯ : ৪৩
وَتِلْكَ الْأَمْثَالُ نَضْرِبُهَا لِلنَّاسِ ۖ وَمَا يَعْقِلُهَا إِلَّا الْعَالِمُونَ

আর এ সকল দৃষ্টান্ত আমরা মানুষের জন্য দেই; কিন্তু শুধু জ্ঞানী ব্যক্তিরাই এটা বুঝে [১]।

ফুটনোট

[১] মাকড়সার জাল দ্বারা মুশরিকদের উপাস্যদের দৃষ্টান্ত দেয়ার পর এখন বলা হয়েছে যে, আমি সুস্পষ্ট দৃষ্টান্ত দ্বারা তাওহীদের স্বরূপ বর্ণনা করি; কিন্তু এসব দৃষ্টান্ত থেকেও কেবল আলেমগণই জ্ঞান আহরণ করে। অন্যরা চিন্তা-ভাবনাই করে না। ফলে সত্য তাদের সামনে ফোটে না। মূলতঃ কুরআন ও হাদীসের কিছু শব্দ বুঝে নিলে কেউ আল্লাহর কাছে আলেম হয় না, যে পর্যন্ত কুরআন নিয়ে চিন্তা-ভাবনার অভ্যাস গড়ে না তোলে এবং যে পর্যন্ত সে কুরআন অনুযায়ী আমল না করে। আমর ইবন আস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছ থেকে এক হাজার দৃষ্টান্ত শিক্ষা করেছি। মুসনাদে আহমাদ: ৪/২০৩] এটা নিঃসন্দেহে আমর ইবন আস রাদিয়াল্লাহু আনহুর একটি বিরাট শ্রেষ্ঠত্ব। কেননা, আল্লাহ্‌ তা'আলা এই আয়াতে তাদেরকেই আলেম বলেছেন, যারা আল্লাহ্‌ ও রাসূল বর্ণিত দৃষ্টান্তসমূহ বোঝে। আমর ইবনে মুররা বলেন, আমি যখন এমন কোন আয়াতে পৌঁছি, যা আমার বোধগম্য নয়, তখন মনে খুব দুঃখ পাই। কেননা, আল্লাহ্ বলেন: “এ সকল উদাহরণ আমি মানুষের জন্য দেই, কিন্তু জ্ঞানীরাই তা বোঝে।”। [ইবন কাসীর]

২৯ : ৪৯
بَلْ هُوَ آيَاتٌ بَيِّنَاتٌ فِي صُدُورِ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ ۚ وَمَا يَجْحَدُ بِآيَاتِنَا إِلَّا الظَّالِمُونَ

বরং যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে বস্তুত তাদের অন্তরে এটা স্পষ্ট নিদর্শন [১]।

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ বলা হয়েছে যে, “বরং যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে বস্তুত তাদের অন্তরে এটা স্পষ্ট নিদর্শন।” অর্থাৎ এ কুরআন তার যাবতীয় আদেশ-নিষেধ ও সংবাদে হকের উপর প্রমাণবাহ হওয়ার দিক থেকে সুস্পষ্ট নিদর্শন। আলেমগণ এটাকে তাদের বক্ষে সংরক্ষণ করেন। আল্লাহ তা'আলা এটা মুখস্থ, তেলাওয়াত ও তাফসীর সহজ করে দিয়েছেন। এ সবই এ কুরআনের জন্য বিরাট নিদর্শন। যেমন অন্য আয়াতে বলেছেন, “আর অবশ্যই আমরা কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য ; অতএব উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি?” [সূরা আল-কামারঃ ১৭] অনুরূপ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও বলেছেন, “প্রত্যেক নবীকেই এমন কিছু নিদর্শন দেয়া হয়, যা দেখে মানুষ তার উপর ঈমান আনে। আমাকে দেয়া হয়েছে ওহী। যা আল্লাহ আমার কাছে ওহী করেছেন। আমি আশা করব যে তাদের থেকেও বেশী অনুসারী পাব।” [বুখারী: ৪৯৮১; মুসলিম: ১৫২] [ইবন কাসীর] অথবা আয়াতের অর্থ, একজন নিরক্ষরের পক্ষে কুরআনের মতো একটি কিতাব পেশ করা এবং সহসা এমনসব অসাধারণ বিস্ময়কর ঘটনাবলীর প্রকাশ ঘটানো, যেগুলোর জন্য পূর্বাহ্নে প্রস্তুতি গ্ৰহণ করার কোন উদ্যোগ আয়োজন কখনো কারো চোখে পড়েনি, এগুলোই বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ লোকদের দৃষ্টিতে তার নবুওয়াতের প্রমাণ পেশকারী উজ্জ্বলতম নিদর্শন। [আত-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর] পূর্ববর্তী আহলে কিতাবদের কাছেও এটা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়তের প্রমাণ। [তাবারী।]

২৯ : ৬২
اللَّهُ يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ وَيَقْدِرُ لَهُ ۚ إِنَّ اللَّهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ

আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার জন্য ইচ্ছে তার রিযিক বাড়িয়ে দেন এবং যার জন্য ইচ্ছে সীমিত করেন। নিশ্চয় আল্লাহ্ সবকিছু সম্পর্কে সম্যক অবগত।
ফুটনোট

৩০ : ২৯
بَلِ اتَّبَعَ الَّذِينَ ظَلَمُوا أَهْوَاءَهُمْ بِغَيْرِ عِلْمٍ ۖ فَمَنْ يَهْدِي مَنْ أَضَلَّ اللَّهُ ۖ وَمَا لَهُمْ مِنْ نَاصِرِينَ

বরং যালিমরা অজ্ঞতাবশত তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে, কাজেই আল্লাহ্ যাকে পথভ্রষ্ট করেন কে তাকে হিদায়াত দান করবে? আর তাদের কোন সাহাযাকারী নেই।
ফুটনোট

৩০ : ৫৬
وَقَالَ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ وَالْإِيمَانَ لَقَدْ لَبِثْتُمْ فِي كِتَابِ اللَّهِ إِلَىٰ يَوْمِ الْبَعْثِ ۖ فَهَٰذَا يَوْمُ الْبَعْثِ وَلَٰكِنَّكُمْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ

আর যাদেরকে জ্ঞান ও ঈমান দেয়া হয়েছে [১] তারা বলবে, 'অবশ্যই তোমরা আল্লাহর লিখা অনুযায়ী পুনরুত্থানের দিন পর্যন্ত অবস্থান করেছ। সুতরাং এটাই তো পুনরুত্থান দিন, কিন্তু তোমরা জানতে না।'

ফুটনোট

[১] আল্লামা শানকীতী বলেন, এখানে যাদেরকে জ্ঞান ও ঈমান দেয়া হয়েছে বলে, ফেরেশতাগণ, রাসূলগণ, নবীগণ, সৎবান্দাগণ সবই উদ্দেশ্য হতে পারে। [আদওয়াউল বায়ান]

৩১ : ১৫
وَإِنْ جَاهَدَاكَ عَلَىٰ أَنْ تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا ۖ وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا ۖ وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيَّ ۚ ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ

আর তোমার পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার সাথে শির্ক করার জন্য পীড়াপীড়ি করে, যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই [১], তাহলে তুমি তাদের কথা মেনো না এবং দুনিয়াতে তাদের সাথে বসবাস করবে সদ্ভাবে [২] আর যে আমার অভিমুখী হয়েছে তার পথ অনুসরণ কর। তারপর তোমাদের ফিরে আসা আমারই কাছে, তখন তোমরা যা করতে সে বিষয়ে আমি তোমাদেরকে অবিহিত করব।

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ তোমার জানা মতে যে আমার সাথে শরীক নয়। অথবা তুমি আমার কোন শরীক আছে বলে জান না। তুমি তো শুধু এটাই জান যে, আমি এক, আমার কোন শরীক নেই। এমতাবস্থায় কিভাবে তুমি তোমার পিতা-মাতার কথা মানতে পার? অন্যায়কে যেন তুমি প্রশ্ৰয় না দাও। শির্ক গুরুতর অপরাধ হওয়ার কারণেই আল্লাহর নির্দেশ এই যে, যদিও সন্তানের প্রতি পিতা-মাতাকে মান্য করার ও তাদের কৃতজ্ঞতা স্বীকারের বিশেষ তাকীদ রয়েছে এবং আল্লাহ্‌র প্রতি আনুগত্য প্রকাশ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সাথে সাথে পিতা-মাতার প্রতিও তা করার জন্যে সন্তানকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু শির্ক এমন গুরুতর অন্যায় ও মারাত্মক অপরাধ যে, মাতা-পিতার নির্দেশে, এমন কি বাধ্য করার পরও কারো পক্ষে তা জায়েয হয়ে যায় না। যদি কারো পিতা-মাতা তাকে আল্লাহর সাথে অংশী স্থাপনে বাধ্য করতে চেষ্টা করতে থাকেন, এ বিষয়ে পিতা-মাতার কথাও রক্ষা করা জায়েয নয়। যেমনটি হয়েছিল, সা'দ ইবন আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর সাথে তার মায়ের আচরণ। তিনি ইসলাম গ্ৰহণ করলে তার মা শপথ করলেন যে, যতক্ষণ তুমি আবার পূর্ববতী দ্বীনে ফিরে না আসবে ততক্ষণ আমি কোন খাবার গ্রহণ করবনা। কিন্তু সা’দ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তার এ কথা মান্য করলেন না। তার সমর্থনেই এই আয়াত নাযিল হয়। [মুসলিম : ১৭৪৮]

[২] যদি পিতা-মাতা আল্লাহর অংশী স্থাপনে বাধ্য করার চেষ্টা করেন, তখন আল্লাহর নির্দেশ হল তাদের কথা না মানা। এমতাবস্থায় মানুষ স্বভাবতঃ সীমার মধ্যে স্থির থাকে না। এ নির্দেশ পালন করতে গিয়ে সন্তানের পক্ষে পিতা-মাতার প্রতি কটু বাক্য প্রয়োগ ও অশোভন আচরণ করে তাঁদেরকে অপমানিত করার সম্ভাবনা ছিল। ইসলাম তো ন্যায়নীতির জ্বলন্ত প্রতীক-প্রত্যেক বস্তুরই একটি সীমা আছে। তাই অংশীদার স্থাপনের বেলায় পিতা-মাতার অনুসরণ না করার নির্দেশের সাথে সাথে এ হুকুমও প্ৰদান করেছে যে, দ্বীনের বিরুদ্ধে তো তাদের কথা মানবে না, কিন্তু পার্থিব কাজকর্ম যথা শারীরিক সেবা-যত্ন বা ধন-সম্পদ ব্যয় ও অন্যান্য ক্ষেত্ৰে যেন কার্পণ্য প্রদর্শিত না হয়। তাদের প্রতি বেআদবী ও অশালীনতা প্রদর্শন করো না। তাদের কথাবার্তার এমনভাবে উত্তর দিবে না, যাতে অহেতুক মনোবেদনার উদ্রেক করে। মোটকথা, শিরক-কুফরীর ক্ষেত্রে তাদের কথা না মানার কারণে যে মর্মপীড়ার উদ্রেক হবে, তা তো অপারগতা হেতু বরদাশত করবে, কিন্তু প্রয়োজনকে তার সীমার মধ্যেই রাখতে হবে। অন্যান্য ব্যাপারে যেন মনোকষ্টের কারণ না ঘটে। সে সম্পর্কে সচেতন থাকবে। [কুরতুবী, তাবারী, সা’দী]

৩১ : ২০
أَلَمْ تَرَوْا أَنَّ اللَّهَ سَخَّرَ لَكُمْ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَأَسْبَغَ عَلَيْكُمْ نِعَمَهُ ظَاهِرَةً وَبَاطِنَةً ۗ وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يُجَادِلُ فِي اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَلَا هُدًى وَلَا كِتَابٍ مُنِيرٍ

তোমরা কি দেখ না, নিশ্চয় আল্লাহ্ আসমানসমূহ ও যমীনে যা কিছু আছে সবকিছুই তোমাদের কল্যানে নিয়োজিত করেছেন এবং তোমাদের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করেছেন [১]? আর মানুষের মধ্যে কেউ কেউ কোন জ্ঞান, কোন পথনির্দেশ বা কোন দীপ্তিমান কিতাব ছাড়াই আল্লাহ্ সম্বন্ধে বিতণ্ডা করে।

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ আল্লাহ তোমাদের উপর তাঁর প্রকাশ্য-অপ্ৰকাশ্য সকল প্রকারের নেয়ামত পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। প্রকাশ্য নেয়ামত বলতে সেসব নেয়ামতকেই বোঝায়, যা মানুষ তার পঞ্চেন্দ্ৰিয়ের সাহায্যে অনুধাবন করতে পারে। যেমন, মনোরম আকৃতি, মানুষের সুঠাম ও সংবদ্ধ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং প্রত্যেক অংগ এমন সুসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে তৈরী করা যেন তা মানুষের কাজে সর্বাধিক সহায়কও হয় অথচ আকৃতি-প্রকৃতিতেও কোন প্রকারের বিকৃতি না ঘটায়। অনুরূপভাবে জীবিকা, ধন-সম্পদ, জীবনযাপনের মাধ্যমসমূহ, সুস্থতা ও কুশলাবস্থা—এসবই ইন্দ্ৰিয়গ্রাহ্য নেয়ামত ও অনুকম্পাসমূহের অন্তর্ভুক্ত। তদ্রুপ দ্বীন ইসলামকে সহজ ও অনায়াসলব্ধ করে দেয়া, আল্লাহ-রাসূলের অনুসরণ ও আনুগত্য প্রদর্শনের তওফীক প্ৰদান, অন্যান্য দ্বীনের উপর ইসলামের বিজয় ও প্রভাবশীলতা এবং শক্ৰদের মোকাবেলায় মুসলিমদের প্রতি সাহায্য ও সহায়তা- এসবই প্রকাশ্য নেয়ামতসমূহের পর্যায়ভুক্ত। আর গোপনীয় নেয়ামত সেগুলো, যা মানব হৃদয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত-যথা ঈমান, আল্লাহর পরিচয় লাভ এবং জ্ঞান-বুদ্ধি, সচ্চরিত্র, পাপসমূহ গোপন করা ও অপরাধসমূহের ত্বরিৎ শাস্তি আরোপিত না হওয়া ইত্যাদি। অথবা যেসব নেয়ামত মানুষ জানে না এবং অনুভবও করে না সেগুলো গোপন নিয়ামত। মানুষের নিজের শরীরে এবং তার বাইরে দুনিয়ায় তার স্বার্থে কাজ করে যাচ্ছে এমন অগণিত ও অসংখ্য জিনিস রয়েছে কিন্তু মানুষ জানেও না যে, তার স্রষ্টা তার হেফাযত ও সংরক্ষণের জন্য, তাকে জীবিকা দান করার জন্য, তার বৃদ্ধি ও বিকাশ সাধনের জন্য এবং তার কল্যাণার্থে কত রকমের সাজ-সরঞ্জাম যোগাড় করে রেখেছেন। [দেখুন, ফাতহুল কাদীর; বাগভী]

৩১ : ৩৪
إِنَّ اللَّهَ عِنْدَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ وَيُنَزِّلُ الْغَيْثَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْأَرْحَامِ ۖ وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ مَاذَا تَكْسِبُ غَدًا ۖ وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضٍ تَمُوتُ ۚ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ

নিশ্চয় আল্লাহ্ [১], তাঁর কাছেই রয়েছে কিয়ামতের জ্ঞান, তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং তিনি জানেন যা মাতৃগর্ভে আছে। আর কেউ জানে না আগামীকাল সে কি অর্জন করবে এবং কেউ জানে না কোন্‌ স্থানে তার মৃত্যু ঘটবে। নিশ্চয় আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত।

ফুটনোট

[১] এ আয়াতে পাঁচটি বস্তুর জ্ঞান সম্পূর্ণভাবে আল্লাহরই জন্য নির্দিষ্ট থাকা এবং অপর কোন সৃষ্টির সে জ্ঞান না থাকার কথা বলা হয়েছে। সুতরাং এর মাধ্যমেই সূরায়ে লুকমান শেষ করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, কেয়ামত সম্পর্কিত জ্ঞান কেবল আল্লাহরই রয়েছে (অর্থাৎ, কোন বছর কোন তারিখে সংঘটিত হবে) এবং তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন ও মাতৃগর্ভে কি আছে তা তিনিই জানেন (অর্থাৎ, কন্যা না পুত্র, কতদিন বাঁচবে, কি রিফিক পাবে, কোন স্বভাবের অধিকারী হবে ইত্যাদি) এবং আগামীকাল কি অর্জন করবে তা কোন ব্যক্তি জানে না। (অর্থাৎ, ভাল-মন্দ কি লাভ করবে) অথবা কোন স্থানে মারা যাবে, তাও কেউ জানে না। প্রথম তিন বস্তু সম্পর্কিত জ্ঞান যদিও একথা স্পষ্টভাবে বলা হয়নি যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো এগুলোর জ্ঞান নেই। কিন্তু বাক্যবিন্যাস ও প্রকাশভঙ্গি থেকে একথাই বোঝা যায় যে, এসব বস্তুর জ্ঞান কেবল আল্লাহর অসীম জ্ঞান ভাণ্ডারেই সীমিত রয়েছে। অবশ্য অবশিষ্ট বস্তুদ্বয় সম্পর্কে একথা স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো এগুলোর তথ্য ও তত্ত্ব জানা নেই। [দেখুন, তাবারী, কুরতুবী] এ পাঁচ বস্তুকে সূরা আল-আন’আমের ৫৯ নং আয়াতে (অদৃশ্য জগতের চাবিসমূহ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে)। তাছাড়া কিয়ামত কখন সংঘটিত হবে সে ব্যাপারে হাদীসে জিবরীল নামে খ্যাত হাদীসেও অনুরূপ বলা হয়েছে যে, এর জ্ঞান আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে নেই। [দেখুন, বুখারী:৪৭৭৭, মুসলিম:৯, ১০]

৩৩ : ৪০
مَا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِنْ رِجَالِكُمْ وَلَٰكِنْ رَسُولَ اللَّهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ ۗ وَكَانَ اللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًا

মুহাম্মদ তোমাদের মধ্যে কোন পুরুষের পিতা নন [১]; ববং তিনি আল্লাহ্র রাসূল এবং শেষ নবী। আর আল্লাহ্ সর্বকিছু সম্পর্কে সর্বজ্ঞ।

ফুটনোট

[১] উল্লেখিত আয়াতে সেসব লোকের ধারণা অপনোদন করা হয়েছে যারা বর্বর যুগের প্রথা অনুযায়ী যায়েদ বিন হারেসাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সন্তান বলে মনে করতো এবং তিনি যায়নবকে তালাক দেয়ার পর নবীসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে তার বিয়ে সংঘটিত হওয়ায় তার প্রতি পুত্রবধুকে বিয়ে করেছেন বলে কটাক্ষ করত। এ ভ্রান্ত ধারণা অপনোদনের জন্য এটুকু বলাই যথেষ্ট ছিল যে, যায়েদের পিতা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নন বরং তার পিতা হারেসা। কিন্তু এ বিষয়টির প্রতি বিশেষ তাকীদ দেয়াচ্ছলে ঘোষণা করা হয়েছে যে, ‘মুহাম্মাদ তোমাদের মধ্যকার কোন পুরুষের পিতা নন’। যে ব্যক্তি সন্তান-সন্তুতিদের মধ্যে কোন পুরুষ নেই, তার প্রতি এরূপ কটাক্ষ করা কিভাবে যুক্তিসংগত হতে পারে যে, তার পুত্র রয়েছে এবং তার পরিত্যক্ত স্ত্রী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পুত্রবধূ বলে তার জন্য হারাম হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর স্ত্রী খাদিজার গর্ভস্থ তিন পুত্র-সন্তান কাসেম, তাইয়্যোব ও তাহের এবং মারিয়ার গর্ভস্থ এক সন্তান ইব্রাহীম—মোট চার পুত্ৰ-সন্তান ছিলেন। কিন্তু এরা সবাই শৈশবাবস্থায় মারা যান। [দেখুন, কুরতুবী, ফাতহুল কাদীর; বাগভী]

৩৩ : ৫৪
إِنْ تُبْدُوا شَيْئًا أَوْ تُخْفُوهُ فَإِنَّ اللَّهَ كَانَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًا

যদি তোমরা কোন কিছু প্রকাশ করা অথবা তা গোপন রাখ (তবে জেনে রাখ) নিশ্চয় আল্লাহ্ সবকিছু সম্পর্কে সর্বজ্ঞ।
ফুটনোট

৩৩ : ৬৩
يَسْأَلُكَ النَّاسُ عَنِ السَّاعَةِ ۖ قُلْ إِنَّمَا عِلْمُهَا عِنْدَ اللَّهِ ۚ وَمَا يُدْرِيكَ لَعَلَّ السَّاعَةَ تَكُونُ قَرِيبًا

লোকেরা আপনাকে কিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলুন, 'এর জ্ঞান শুধু আল্লাহর নিকটই আছে।' আর কিসে আপনাকে জানাবে, সম্ভবত কিয়ামত শীঘ্রই হয়ে যেতে পারে?
ফুটনোট

৩৪ :
وَيَرَى الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ الَّذِي أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ هُوَ الْحَقَّ وَيَهْدِي إِلَىٰ صِرَاطِ الْعَزِيزِ الْحَمِيدِ

আর যাদেরকে জ্ঞান দেওয়া হয়েছে, তারা জানে যে, আপনার রবের কাছ থেকে আপনার প্রতি যা নাযিল হয়েছে তা-ই সত্য; এবং এটা পরাক্রমশালী প্রশংসিত আল্লাহর পথ নির্দেশ করে।
ফুটনোট

৩৪ : ১৪
فَلَمَّا قَضَيْنَا عَلَيْهِ الْمَوْتَ مَا دَلَّهُمْ عَلَىٰ مَوْتِهِ إِلَّا دَابَّةُ الْأَرْضِ تَأْكُلُ مِنْسَأَتَهُ ۖ فَلَمَّا خَرَّ تَبَيَّنَتِ الْجِنُّ أَنْ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ الْغَيْبَ مَا لَبِثُوا فِي الْعَذَابِ الْمُهِينِ

অতঃপর যখন আমরা সুলাইমানের মৃত্যু ঘটালাম, তখন জিনদেরকে তার মৃত্যুর খবর জানাল শুধু মাটির পোকা, যা তার লাঠি খাচ্ছিল। অতঃপর যখন তিনি পড়ে গেলেন তখন জিনরা -বুঝতে পারল যে, যদি তারা গায়েব জানত, তাহলে তারা লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তিতে আবদ্ধ থাকত না [১]।

ফুটনোট

[১] কারণ, সুলাইমান আলাইহিস সালাম তার ঘরে ইবাদাতে মশগুল ছিলেন। তারপর জিনরা তার জন্য বিল্ডিং বানাচ্ছিল। এমতাবস্থায় আল্লাহ সুলাইমান আলাইহিস সালামের মৃত্যু দিলেন। কিন্তু জিনরা তা জানতেই পারল না। শেষ পর্যন্ত তার লাঠিতে যমীনের পোকা লেগে সেটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর তিনি পড়ে গেলেন। কোন কোন বর্ণনায় দেখা যায় সেটা ছিল পূর্ণ এক বছর পর। তখন জিনরা তাদের ভুল বুঝতে পারল যে, যদি তারা গায়েবের কিছু জানত। তবে এতদিন কষ্ট করত না। [সা’দী]

৩৫ : ২২
وَمَا يَسْتَوِي الْأَحْيَاءُ وَلَا الْأَمْوَاتُ ۚ إِنَّ اللَّهَ يُسْمِعُ مَنْ يَشَاءُ ۖ وَمَا أَنْتَ بِمُسْمِعٍ مَنْ فِي الْقُبُورِ

এবং সমান নয় জীবিত ও মৃত। নিশ্চয় আল্লাহু যাকে ইচ্ছে শোনান; আর আপনি শোনাতে পারবেন না যারা কবরে রয়েছে তাদেরকে।
ফুটনোট

৩৫ : ২৮
وَمِنَ النَّاسِ وَالدَّوَابِّ وَالْأَنْعَامِ مُخْتَلِفٌ أَلْوَانُهُ كَذَٰلِكَ ۗ إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ ۗ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ غَفُورٌ

আর মানুষের মাঝে, জন্তু ও গৃহপালিত জানোয়ারের মাঝেও বিচিত্র বর্ণ রয়েছে অনুরূপ। আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে যারা জ্ঞানী তারাই কেবল তাঁকে ভয় করে [১]; নিশ্চয় আল্লাহ্ প্রবল পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল।

ফুটনোট

[১] বলা হয়েছে যে, কেবল আলেম ও জ্ঞানীগণই আল্লাহকে ভয় করে। আল্লাহর শক্তিমত্তা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও বিজ্ঞানময়তা, ক্ৰোধ, পরাক্রম, সার্বভৌম কর্তৃত্ব-ক্ষমতা ও অন্যান্য গুণাবলী সম্পর্কে যে ব্যক্তি যতবেশী জানবে সে ততবেশী তাঁর নাফরমানী করতে ভয় পাবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলীর ব্যাপারে যতবেশী অজ্ঞ হবে সে তাঁর ব্যাপারে তত বেশী নির্ভীক হবে। এ আয়াতে জ্ঞান অর্থ দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, অংক ইত্যাদি স্কুল-কলেজে পঠিত বিষয়ের জ্ঞান নয়। বরং এখানে জ্ঞান বলতে আল্লাহর গুণাবলীর জ্ঞান বুঝানো হয়েছে। এ জন্য শিক্ষিত ও অশিক্ষিত হবার প্রশ্ন নেই। তাই আয়াতে العلماء বা ‘উলামা’ বলে এমন লোকদের বোঝানো হয়েছে, যারা আল্লাহ তা'আলার সত্তা ও গুণাবলী সম্পর্কে সম্যক অবগত এবং পৃথিবীর সৃষ্টবস্তু সামগ্ৰী, তার পরিবর্তন-পরিবর্ধন ও আল্লাহর দয়া-করুণা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করেন। কেবল আরবী ভাষা, ব্যাকরণ-অলংকারাদি সম্পর্কে জ্ঞানী ব্যক্তিকেই কুরআনের পরিভাষায় 'আলেম” বলা হয় না। যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে না সে যুগের শ্ৰেষ্ঠ পণ্ডিত হলেও এ জ্ঞানের দৃষ্টিতে সে নিছক একজন মুর্খ ছাড়া আর কিছুই নয়। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর গুণাবলী জানে এবং নিজের অন্তরে তাঁর ভীতি পোষণ করে সে অশিক্ষিত হলেও জ্ঞানী। তবে কারও ব্যাপারে তখনই এ আয়াতটির প্রয়োগ ক্ষেত্রে পরিণত হবে যখন তাদের মধ্যে আল্লাহভীতি থাকবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও এক হাদীসে ইঙ্গিত করেছেন। তিনি বলেন, “যদি আমি যা জানি তা তোমরা জানতে তবে হাসতে কম কাঁদতে বেশী। [বুখারী: ৬৪৮৬, মুসলিম: ২৩৫৯] এর কারণ, রাসূল আল্লাহকে সবচেয়ে বেশী জানেন, তার তাকওয়াও সবচেয়ে বেশী। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু একথাই বলেছেন, “বিপুল সংখ্যক হাদীস জানা জ্ঞানের পরিচায়ক নয় বরং বেশী পরিমাণ আল্লাহভীতিই জ্ঞানের পরিচয় বহন করে।” ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, ‘তারাই হচ্ছে আলেম যারা নিশ্চিত বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ সবকিছুর উপর শক্তিমান।' তিনি আরও বলেছেন, ‘সেই ব্যক্তি রহমান সম্পর্কে আলেম যিনি তার সাথে কাউকে শরীক করেন নি, তাঁর হালালকে হালাল করেছেন, হারামকে হারাম করেছেন, তাঁর অসীয়ত বা নির্দেশাবলীর পূর্ণ হিফাযত করেছেন, আর বিশ্বাস করেছেন যে, একদিন তাকে তার সাথে সাক্ষাত করতে হবে এবং তার যাবতীয় কর্মকাণ্ডের হিসাব দিতে হবে।’ হাসান বাসরী রাহে মাহুল্লাহ বলেন, “আল্লাহকে না দেখে বা একান্তে ও জনসমক্ষে যে ভয় করে সেই হচ্ছে আলেম। আল্লাহ যা কিছু পছন্দ করেন সেদিকেই আকৃষ্ট হয় এবং যে বিষয়ে আল্লাহ নারাজ সে ব্যাপারে সে কোন আগ্রহ পোষণ করে না।” সুফিয়ান সাওরী বর্ণনা করেন যে, জ্ঞানী তিন ধরনের হয়। এক. আল্লাহ সম্পর্কে সম্যক অবগত, তাঁর নির্দেশ সম্পর্কেও জ্ঞানী। দুই. আল্লাহ সম্পর্কে সম্যক অবগত, কিন্তু তাঁর নির্দেশ সম্পর্কে অজ্ঞ। সুতরাং যে আল্লাহ সম্পর্কে সম্যক অবগত ও তার নির্দেশ সম্পর্কেও জ্ঞানী সে হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যে আল্লাহকে ভয় করে এবং আল্লাহর ফরয ওয়াজিবের সীমারেখা সম্পর্কে জ্ঞান রাখে। আর যে আল্লাহর নির্দেশ সম্পর্কে জ্ঞানী কিন্তু আল্লাহ সম্পর্কে অজ্ঞ সে হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যে আল্লাহকে ভয় করে কিন্তু তাঁর ফরয ওয়াজিবের সীমারেখা সম্পর্কে জ্ঞান রাখেনা। আর যে আল্লাহর নির্দেশ সম্পর্কে জ্ঞানী অথচ তাঁর সম্পর্কে জ্ঞান রাখেনা সে এ ব্যক্তি যে, আল্লাহকে ভয় করে না কিন্তু আল্লাহর ফরয ওয়াজিবের সীমারেখা সম্পর্কে জ্ঞান রাখে। সারকথা, যার মধ্যে যে পরিমাণ আল্লাহ ভীতি হবে, সে সেই পরিমাণ আলেম হবে। আহমদ ইবনে সালেহ মিসরী বলেন, অধিক বর্ণনা ও অধিক জ্ঞান দ্বারা আল্লাহভীতির পরিচয় পাওয়া যায় না; বরং কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণ দ্বারা এর পরিচয় পাওয়া যায়। সুতরাং যার মধ্যে আল্লাহভীতি নেই, সে আলেম নয়। [দেখুন, তাবারী; বাগভী; কুরতুবী; ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর]

৩৬ : ৭৯
قُلْ يُحْيِيهَا الَّذِي أَنْشَأَهَا أَوَّلَ مَرَّةٍ ۖ وَهُوَ بِكُلِّ خَلْقٍ عَلِيمٌ

বলুন, 'তাতে প্রাণ সঞ্চার করবেন তিনিই যিনি তা প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন [১] এবং তিনি প্রত্যেকটি সৃষ্টি সম্বন্ধে সম্যক পরিজ্ঞাত।'

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ এ দৃষ্টান্ত বর্ণনা করার সময় সে নিজের সৃষ্টিতত্ত্ব ভুলে গেল যে, নিষ্প্রাণ একটি শুক্রবিন্দুতে প্রাণসঞ্চার করে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। যদি সে এই মূল তত্ত্ব বিস্মৃত না হত, তবে এরূপ দৃষ্টান্ত উপস্থিত করে আল্লাহর কুদরতকে অস্বীকার করার ধৃষ্টতা প্রদর্শন করতে পারত না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “বনী ইসরাইলের এক মুসলিম ব্যক্তির মৃত্যু সময় উপস্থিত হলো, সে তার পরিবারপরিজনকে এ বলে আসিয়ত করল যে, যখন আমি মারা যাব তখন তোমরা আমার জন্য কাঠ সংগ্ৰহ করে আমাকে আগুনে পুড়িয়ে দিও। তারপর যখন আগুন আমার গোস্ত খেয়ে ফেলবে এবং আমার হাঁড় পর্যন্ত কঙ্কাল হয়ে যাবে তখন তা নিয়ে গুড়ো করে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিও। তারা তাই করল। তখন আল্লাহ তা'আলা তাকে পুরোপুরি একত্রিত করে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি এমনটি কেন করলে? সে বলল, আপনার ভয়ে। আল্লাহ তখন তাকে ক্ষমা করে দিলেন। [বুখারী: ৩৪৫২, ৩৪৮১, ৩৪৭৮, মুসলিম: ২৭৫৬, ২৭৫৭]

৩৯ : ৪৯
فَإِذَا مَسَّ الْإِنْسَانَ ضُرٌّ دَعَانَا ثُمَّ إِذَا خَوَّلْنَاهُ نِعْمَةً مِنَّا قَالَ إِنَّمَا أُوتِيتُهُ عَلَىٰ عِلْمٍ ۚ بَلْ هِيَ فِتْنَةٌ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لَا يَعْلَمُونَ

অতঃপর যখন কোন বিপদ-আপদ মানুষকে স্পর্শ করে, তখন সে আমাদেরকে ডাকে; তারপর যখন তাকে আমরা আমাদের কোন নিয়ামতের অধিকারী করি তখন সে বলে, 'আমাকে এটা দেয়া হয়েছে কেবল আমার জ্ঞানের কারণে।' বরং এটা এক পরীক্ষা, কিন্তু তাদের বেশীর ভাগই তা জানে না।
ফুটনোট

৪০ :
الَّذِينَ يَحْمِلُونَ الْعَرْشَ وَمَنْ حَوْلَهُ يُسَبِّحُونَ بِحَمْدِ رَبِّهِمْ وَيُؤْمِنُونَ بِهِ وَيَسْتَغْفِرُونَ لِلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا وَسِعْتَ كُلَّ شَيْءٍ رَحْمَةً وَعِلْمًا فَاغْفِرْ لِلَّذِينَ تَابُوا وَاتَّبَعُوا سَبِيلَكَ وَقِهِمْ عَذَابَ الْجَحِيمِ

যারা ‘আরশ ধারণ করে আছে এবং যারা এর চারপাশে আছে, তারা তাদের রবের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে প্ৰশংসার সাথে এবং তাঁর উপর ঈমান রাখে, আর মুমিনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে বলে, 'হে আমাদের রব! আপনি দয়া ও জ্ঞান দ্বারা সবকিছুকে পরিব্যাপ্ত করে রেখেছেন। অতএব যারা তাওবা করে এবং আপনার পথ অবলম্বন করে আপনি তাদেরকে ক্ষমা করুন। আর জাহান্নামের শাস্তি হতে আপনি তাদের রক্ষা করুন।।
ফুটনোট

৪০ : ৪২
تَدْعُونَنِي لِأَكْفُرَ بِاللَّهِ وَأُشْرِكَ بِهِ مَا لَيْسَ لِي بِهِ عِلْمٌ وَأَنَا أَدْعُوكُمْ إِلَى الْعَزِيزِ الْغَفَّارِ

'তোমরা আমাকে ডাকছ যাতে আমি আল্লাহর সাথে কুফরী করি এবং তাঁর সাথে শরীক করি, যে ব্যাপারে আমার কোন জ্ঞান নেই; আর আমি তোমাদেরকে ডাকছি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীলের দিকে।
ফুটনোট

৪০ : ৮৩
فَلَمَّا جَاءَتْهُمْ رُسُلُهُمْ بِالْبَيِّنَاتِ فَرِحُوا بِمَا عِنْدَهُمْ مِنَ الْعِلْمِ وَحَاقَ بِهِمْ مَا كَانُوا بِهِ يَسْتَهْزِئُونَ

অতঃপর তাদের কাছে যখন স্পষ্ট প্রমাণাদিসহ তাদের রাসূলগণ আসলেন, তখন তারা নিজেদের কাছে বিদ্যমান থাকা জ্ঞানে উৎফুল্ল হল। আর তারা যা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করত তা-ই তাদেরকে বেষ্টন করল।
ফুটনোট

৪১ : ৪৭
إِلَيْهِ يُرَدُّ عِلْمُ السَّاعَةِ ۚ وَمَا تَخْرُجُ مِنْ ثَمَرَاتٍ مِنْ أَكْمَامِهَا وَمَا تَحْمِلُ مِنْ أُنْثَىٰ وَلَا تَضَعُ إِلَّا بِعِلْمِهِ ۚ وَيَوْمَ يُنَادِيهِمْ أَيْنَ شُرَكَائِي قَالُوا آذَنَّاكَ مَا مِنَّا مِنْ شَهِيدٍ

কিয়ামতের জ্ঞান শুধু আল্লাহর কাছেই প্রত্যাবর্তিত হয়। তাঁর অজ্ঞাতসারে কোন ফল আবরণ হতে বের হয় না, কোন নারী গর্ভ ধারণ করে না এবং সন্তানও প্রসব করে না [১]। আর যেদিন আল্লাহ্ তাদেরকে ডেকে বলবেন, 'আমার শরীকেরা কোথায়?' তখন তারা বলবে, 'আমরা আপনার কাছে নিবেদন করি যে, এ ব্যাপারে আমাদের থেকে কোন সাক্ষী নেই।'

ফুটনোট

[১] একথা বলে শ্রোতাদেরকে দুটি বিষয় বুঝানো হয়েছে। একটি হচ্ছে, শুধু কিয়ামত নয়, বরং সমস্ত গায়েবী বিষয়ের জ্ঞান আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। গায়েবী বিষয়ে জ্ঞানের অধিকারী আর কেউ নেই। অপরটি হচ্ছে, যে আল্লাহ খুঁটিনাটি বিষয়সমূহের এত বিস্তারিত জ্ঞান রাখেন, কোন ব্যক্তির কাজ কর্ম তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। অতএব তাঁর সার্বভৌম ক্ষমতার আওতায় নিৰ্ভয়ে যা ইচ্ছা তাই করা ঠিক নয়। দ্বিতীয় অর্থ অনুসারে এই বাক্যাংশের সম্পর্ক পরবর্তী বাক্যাংশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। একথাটির পরেই যা বলা হয়েছে সে সম্পর্কে যদি চিন্তা করা হয় তাহলে বক্তব্যের ধারাক্রম থেকে আপনা আপনি একথার ইংগিত পাওয়া যায় যে, কিয়ামতের তারিখ জানার ধান্ধায় কোথায় পড়ে আছ? বরং চিন্তা করো কিয়ামত যখন আসবে তখন নিজের এসব গোমরাহীর জন্য কি দুর্ভোগ পোহাতে হবে। কিয়ামতের তারিখ সম্পর্কে প্ৰশ্নকারী এক ব্যক্তিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একথার মাধ্যমেই জবাব দিয়েছিলেন। একবার সফরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোথাও যাচ্ছিলেন। পথিমথ্যে এক ব্যক্তি দূর থেকে ডাকলো, হে মুহাম্মাদ ! নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হ্যাঁ, কি বলতে চাও, বলো। সে বললোঃ কিয়ামত কবে হবে? তিনি জবাবে বললেনঃ “হে আল্লাহর বান্দা, কিয়ামত তো আসবেই। তুমি সে জন্য কি প্রস্তুতি গ্রহণ করেছো?” [বুখারী: ৬১৬৭, মুসলিম: ২৬৩৯]

৪২ : ১২
لَهُ مَقَالِيدُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۖ يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يَشَاءُ وَيَقْدِرُ ۚ إِنَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ

তাঁরই কাছে আসমানসমূহ ও যমীনের চাবিকাঠি। তিনি যার জন্যে ইচ্ছে তার রিযিক বাড়িয়ে দেন এবং সংকুচিত করেন। নিশ্চয় তিনি সবকিছু সম্পর্কে সর্বজ্ঞ।
ফুটনোট

৪২ : ১৪
وَمَا تَفَرَّقُوا إِلَّا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ ۚ وَلَوْلَا كَلِمَةٌ سَبَقَتْ مِنْ رَبِّكَ إِلَىٰ أَجَلٍ مُسَمًّى لَقُضِيَ بَيْنَهُمْ ۚ وَإِنَّ الَّذِينَ أُورِثُوا الْكِتَابَ مِنْ بَعْدِهِمْ لَفِي شَكٍّ مِنْهُ مُرِيبٍ

আর তাদের কাছে জ্ঞান আসার পর শুধুমাত্র পারস্পরিক বিদ্বেষবশত [১] তারা নিজেদের মধ্যে মতভেদ ঘটায়। আর এক নির্ধারিত কাল পর্যন্ত অবকাশ সম্পর্কে আপনার রবের পূর্ব সিদ্ধান্ত না থাকলে তাদের বিষয় ফয়সালা হয়ে যেত। আর তাদের পর যারা কিতাবের উত্তরাধিকারী হয়েছে, নিশ্চয় তারা সে সম্পর্কে বিভ্ৰান্তিকর সন্দেহে রয়েছে।

ফুটনোট

[১] এই মতভেদ সৃষ্টির চালিকা শক্তি ছিল নিজের নাম ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চিন্তা, পারস্পরিক জিদ ও একগুঁয়েমি, একে অপরকে পরাস্ত করার প্রচেষ্টা এবং সম্পদ ও মর্যাদা অর্জন প্রচেষ্টার ফল। [কুরতুবী, ফাতহুল কাদীর]

৪৩ : ২০
وَقَالُوا لَوْ شَاءَ الرَّحْمَٰنُ مَا عَبَدْنَاهُمْ ۗ مَا لَهُمْ بِذَٰلِكَ مِنْ عِلْمٍ ۖ إِنْ هُمْ إِلَّا يَخْرُصُونَ

তারা আরও বলে, ‘রহমান ইচ্ছে করলে আমরা এদের ইবাদাত করতাম না।’ এ বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞান নেই ; তারা তো শুধু মনগড়া কথা বলছে।
ফুটনোট

৪৩ : ৮৫
وَتَبَارَكَ الَّذِي لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا وَعِنْدَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ

আর তিনি বরকতময়, যার কর্তৃত্বে রয়েছে আসমানসমূহ, যমীন ও এ দু’য়ের মধ্যবর্তী সমস্ত কিছু। আর কিয়ামতের জ্ঞান শুধু তাঁরই আছে এবং তাঁরই কাছে তোমাদেরকে প্রত্যাবর্তিত করা হবে।
ফুটনোট

৪৫ : ১৭
وَآتَيْنَاهُمْ بَيِّنَاتٍ مِنَ الْأَمْرِ ۖ فَمَا اخْتَلَفُوا إِلَّا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ ۚ إِنَّ رَبَّكَ يَقْضِي بَيْنَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فِيمَا كَانُوا فِيهِ يَخْتَلِفُونَ

আর আমারা তাদেরকে দ্বীনের যাবতীয় বিষয়ে সুস্পষ্ট প্রমাণাদি দান করেছিলাম। তাদের কাছে জ্ঞান আসার পরও তারা শুধু পরস্পর বিদ্বেষবশতঃ মতবিরোধ করেছিল। তারা যে সব বিষয়ে মতবিরোধ করত, নিশ্চয় আপনার রব কিয়ামতের দিন তাদের মধ্যে সে সব বিষয়ে ফয়সালা করে দেবেন।
ফুটনোট

৪৫ : ২৪
وَقَالُوا مَا هِيَ إِلَّا حَيَاتُنَا الدُّنْيَا نَمُوتُ وَنَحْيَا وَمَا يُهْلِكُنَا إِلَّا الدَّهْرُ ۚ وَمَا لَهُمْ بِذَٰلِكَ مِنْ عِلْمٍ ۖ إِنْ هُمْ إِلَّا يَظُنُّونَ

আর তারা বলে, ‘একমাত্র দুনিয়ার জীবনই আমাদের জীবন, আমরা মরি ও বাঁচি, আর কাল-ই কেবল আমাদেরকে ধবংস করে [১]।’ বস্তুত এ ব্যাপারে তাদের কোন জ্ঞান নেই, তারা তো শুধু ধারণাই করে।

ফুটনোট

[১] دهر শব্দের অর্থ আসলে মহাকাল, অর্থাৎ জগতের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সময়ের সমষ্টি। কখনও দীর্ঘ সময়কালকেও دهر বলা হয়। কাফেররা বলেছে যে, আল্লাহর আদেশ ও ইচ্ছার সাথে জীবন ও মৃত্যুর কোন সম্পর্ক নেই, বরং এগুলো প্রাকৃতিক কারণের অধীন। মৃত্যু সম্পর্কে তো সকলেই প্রত্যক্ষ করে যে, মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও শক্তি-সামর্থ্য ব্যবহারের কারণে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে এবং দীর্ঘকাল অতিবাহিত হওয়ার পর সম্পূর্ণ নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এরই নাম মৃত্যু। জীবনও তদ্রুপ, কোন ইলাহী আদেশে নয়, বরং উপকরণের প্রাকৃতিক গতিশীলতার মাধ্যমেই তা অর্জিত হয়। মূলত: কাফের ও মুশরিকরা মহাকালের চক্রকেই সৃষ্টিজগত ও তার সমস্ত অবস্থার কারণ সাব্যস্ত করত এবং সবকিছুকে তারই কর্ম বলে অভিহিত করত। অথচ এগুলো সব প্রকৃতপক্ষে সর্বশক্তিমান আল্লাহর কুদরত ও ইচ্ছায় সম্পন্ন হয়ে থাকে। তাই সহীহ হাদীসসমূহে দাহর তথা মহাকালকে মন্দ বলতে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা, কাফেররা যে শক্তিকে দাহর শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করে, প্রকৃতপক্ষে সেই কুদরত ও শক্তি আল্লাহ তা'আলারই। তাই দাহরকে মন্দ বলার ফল প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, বনী আদম ‘দাহর’ তথা মহাকালকে গালি দেয়, অথচ আল্লাহ বলেন, আমিই প্রকৃতপক্ষে মহাকাল, আমিই রাত - দিনের পরিবর্তন ঘটাই। [বুখারী: ৫৭১৩]

৪৬ :
قُلْ أَرَأَيْتُمْ مَا تَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَرُونِي مَاذَا خَلَقُوا مِنَ الْأَرْضِ أَمْ لَهُمْ شِرْكٌ فِي السَّمَاوَاتِ ۖ ائْتُونِي بِكِتَابٍ مِنْ قَبْلِ هَٰذَا أَوْ أَثَارَةٍ مِنْ عِلْمٍ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ

বলুন, ‘তোমরা আমাকে সংবাদ দাও, তোমারা আল্লাহ্‌র পরিবর্তে যাদেরকে ডাক আমাকে দেখাও তো তারা যমীনে কী সৃষ্টি করেছে অথবা আসমানসমূহে তাদের কোন অংশীদারিত্ব আছে কি? এর পূর্ববতী কোন কিতাব অথবা পরম্পরাগত কোন জ্ঞান থাকলে তা তোমরা আমার কাছে নিয়ে আস যদি তোমরা সত্যবাদী হও [১]।’

ফুটনোট

[১] এ আয়াতে মুশরেকদের শির্ক এর দাবি বাতিল করার জন্য তাদের দাবীর সপক্ষে দলিল চাওয়া হয়েছে। কেননা, সাক্ষ্য-প্রমাণ ব্যতীত কোন দাবি গ্ৰহণীয় হয় না। দলিলের যত প্রকার রয়েছে, সবগুলো আয়াতে উল্লেখ করে প্রমাণ করা হয়েছে যে, মুশরেকদের দাবির পক্ষে কোন দলিল নেই। তাই এহেন দলিলবিহীন দাবিতে অটল থাকা নিরেট পথভ্ৰষ্টতা। আয়াতে দলিলকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্ৰথম: যুক্তিভিত্তিক দলিল। এর খণ্ডন বলা হয়েছে

اِرُوْنِىْ مَاذَاخَلَقُوْامِنَ الْاَرْضِاَمْ لَهُمْ شِرْكٌ فِى السَّمٰوٰتِ

“এরা যমীনে কি সৃষ্টি করেছে আমাকে দেখাও অথবা আসমানসমূহে তাদের কোন অংশীদারিত্ব আছে কি?” দ্বিতীয় প্রকার ইতিহাসভিত্তিক দলিল। বলাবাহুল্য আল্লাহর ব্যাপারে কেবল সেই ইতিহাসভিত্তিক দলিল গ্রহণীয় হতে পারে; যা স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। যেমন তাওরাত, ইঞ্জীল; কুরআন ইত্যাদি কিতাব অথবা আল্লাহ মনোনীত নবী ও রাসূলগণের উক্তি। এই দুই প্রকারের মধ্যে প্রথম প্রকারের খণ্ডনে বলা হয়েছে

اِيْتُوْفِى بِكِتٰبٍ مِّنْ قِبْلِ هٰذَآ

অর্থাৎ তোমাদের মূর্তি পূজার কোন দলিল থাকলে কোন ইলাহী কিতাব পেশ কর, যাতে মূর্তি পূজার অনুমতি দেয়া হয়েছে। এর পর দ্বিতীয় প্রকার ঐতিহাসিক দলীল পেশ করার আহবান জানিয়ে বলা হয়েছে, اَوْاَثٰرَةٍمِّنْ عِلْمً অর্থাৎ কিতাব আনতে না পারলে কমপক্ষে রাসূলগণের পরম্পরাগত কোন উক্তি পেশ কর। তাও পেশ করতে না পারলে তোমাদের কথা ও কাজ পথ ভ্ৰষ্টতা বৈ কিছুই নয়। এর পরবর্তী আয়াতে তাদের শির্কের তৃতীয় প্রকার দলীল পেশ করে তা খণ্ডন করা হয়েছে। কারণ, তারা হয়ত বলতে পারে যে, তাদেরকে আমরা আল্লাহর শরীক এজন্যই সাব্যস্ত করি যে, তারা আমাদের আহবানে সাড়া দিয়ে আমাদের কোন উপকার সাধন কিংবা অপকার থেকে আমাদের বাঁচাতে পারবে। তাদের সে দলিল পেশের সম্ভাবনাকে নাকচ করে বলা হয়েছে যে, তারা আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে আহবান করছে তারা কিয়ামত পর্যন্ত তাদের আহবানে সাড়া দিতে পারবে না। সুতরাং তাদের শির্কের সপক্ষে কোন যুক্তি বা দলিলই অবশিষ্ট রইল না। [দেখুন, ইবনে কাসীর]

৪৬ : ২৩
قَالَ إِنَّمَا الْعِلْمُ عِنْدَ اللَّهِ وَأُبَلِّغُكُمْ مَا أُرْسِلْتُ بِهِ وَلَٰكِنِّي أَرَاكُمْ قَوْمًا تَجْهَلُونَ

তিনি বললেন, ‘এ জ্ঞান তো শুধু আল্লাহ্‌রই কাছে। আর আমি যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছি শুধু তা-ই তোমাদের কাছে প্রচার করি, কিন্তু আমি দেখছি, তোমারা এক মূর্খ সম্প্রদায়।
ফুটনোট

৪৭ : ১৬
وَمِنْهُمْ مَنْ يَسْتَمِعُ إِلَيْكَ حَتَّىٰ إِذَا خَرَجُوا مِنْ عِنْدِكَ قَالُوا لِلَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ مَاذَا قَالَ آنِفًا ۚ أُولَٰئِكَ الَّذِينَ طَبَعَ اللَّهُ عَلَىٰ قُلُوبِهِمْ وَاتَّبَعُوا أَهْوَاءَهُمْ

আর তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক আপনার কথা মনোযোগের সাথে শুনে, অবশেষে আপনার কাছ থেকে বের হয়ে যারা জ্ঞানপ্রাপ্ত তাদেরকে বলে, ‘এ মাত্র সে কী বলল?’ এরাই তারা, যাদের অন্তরসমূহে আল্লাহ মোহর করে দিয়েছেন এবং তারা অনুসরণ করেছে নিজেদের খেয়াল-খুশীর।
ফুটনোট

৪৮ : ২৫
هُمُ الَّذِينَ كَفَرُوا وَصَدُّوكُمْ عَنِ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَالْهَدْيَ مَعْكُوفًا أَنْ يَبْلُغَ مَحِلَّهُ ۚ وَلَوْلَا رِجَالٌ مُؤْمِنُونَ وَنِسَاءٌ مُؤْمِنَاتٌ لَمْ تَعْلَمُوهُمْ أَنْ تَطَئُوهُمْ فَتُصِيبَكُمْ مِنْهُمْ مَعَرَّةٌ بِغَيْرِ عِلْمٍ ۖ لِيُدْخِلَ اللَّهُ فِي رَحْمَتِهِ مَنْ يَشَاءُ ۚ لَوْ تَزَيَّلُوا لَعَذَّبْنَا الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا

তারাই তো কুফরী করেছিল এবং বাধা দিয়েছিল তোমাদেরকে মসজিদুল- হারাম হতে ও বাধা দিয়েছিল কুরবানীর জন্য আবদ্ধ পশুগুলোকে যথাস্থানে পৌঁছতে [১]। আর যদি মুমিন পুরুষরা ও মুমিন নারীরা না থাকত, যাদের সম্পর্কে তোমরা জান না যে, তোমরা অজ্ঞাতসারে তাদেরকে পদদলিত করবে, ফলে তাদের কারণে তোমরা অপরাধী ও দোষী সাব্যস্ত হতে, (তবে অবশ্যই তিনি যুদ্ধের অনুমতি দিতেন। কিন্তু আল্লাহ তোমাদেরকে তখন এর অনুমতি দেন নি) [২] যাতে তিনি যাকে ইচ্ছে নিজ অনুগ্রহে প্রবেশ করাবেন [৩]। যদি তারা [৪] পৃথক হয়ে থাকত, তবে অবশ্যই আমারা তাদের মধ্যে কাফিরদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দিতাম [৫]।

ফুটনোট

[১] হাসীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন হুদাইবিয়ার কাছাকাছি ছিলেন, কুরাইশরা কিনানাহ গোত্রের এক লোককে রাসূলের সাথে কথা বলার জন্য পাঠাল। সে এবং তার সাথীরা যখন রাসূলের কাছাকাছি আসল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এ হচ্ছে অমুক। সে এমন এক সম্প্রদায়ের লোক যার ‘হাদঈ’ এর পশুর সম্মান করে। সুতরাং তোমারা সেগুলোকে একত্রিত করে তার সামনে পাঠাও। সাহাবায়ে কিরাম তাই করলেন আর তারা তালবিয়াহ পাঠ করতে করতে তার সামনে আসলেন। সে যখন এ অবস্থা দেখল বলল, সুবহানাল্লাহ ! এসেরকে আল্লাহর ঘর থেকে বাধা দেয়া ঠিক হবে না। তারপর সে ফিরে গিয়ে বললঃ আমি তো হাদঈর উটকে কালাদা (পশুর গলায় পশম বা চুলের মালা) পরানো ও চিনহিত অবস্থায় দেখেছি। আমি চাইনা তাদেরকে আল্লাহর ঘর থেকে বাধা দেয়া হোক’। [বুখারীঃ ২৭৩২]

[২] উপরোক্ত অংশটুকু উহ্য রয়েছে। [জালালাইন]

[৩] অর্থাৎ যুদ্ধ করার অনুমতি না দেয়ার পিছনে দু'টি উদ্দেশ্য কাজ করেছে। এক. দুনিয়াবী উদ্দেশ্য, তা হচ্ছে, মক্কায় যারা এখনও ঈমানদার রয়ে গেছে, কিন্তু তাদের সম্পপর্কে কেউ জানে না, তারা যেন তোমাদের হাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, আর তোমরাই তোমাদের দ্বীনী ভাইদের হত্যার কারণে মনঃকষ্টে না থাক। অপমান বোধ না কর। দুই. আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে, আল্লাহ্ চাচ্ছেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ ঈমান এনে তাঁর রহমতে শামিল হয়ে যাবে। [সা'দী]

[৪] অর্থাৎ যাদের ঈমান সম্পপর্কে তোমাদের জানা নেই, এমন মুমিন নারী ও পুরুষরা যদি আলাদা আলাদা থাকত। আর যুদ্ধের সময় তাদেরকে রক্ষা করা সম্ভব হতো, তবে অবশ্যই তিনি তাদেরকে শাস্তি দিতেন। [সা’দী; মুয়াসসার]

[৫] تزيل শব্দের আসল অর্থ বিচ্ছিন্ন হওয়া। [ফাতহুল কাদীর]

৪৮ : ২৬
إِذْ جَعَلَ الَّذِينَ كَفَرُوا فِي قُلُوبِهِمُ الْحَمِيَّةَ حَمِيَّةَ الْجَاهِلِيَّةِ فَأَنْزَلَ اللَّهُ سَكِينَتَهُ عَلَىٰ رَسُولِهِ وَعَلَى الْمُؤْمِنِينَ وَأَلْزَمَهُمْ كَلِمَةَ التَّقْوَىٰ وَكَانُوا أَحَقَّ بِهَا وَأَهْلَهَا ۚ وَكَانَ اللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًا

যখন কাফিররা তাদের অন্তরে পোষন করেছিল গোত্রীয় অহমিকা --- অজ্ঞতার যুগের অহমিকা [১], তখন আল্লাহ্‌ তাঁর রাসূল ও মুমিনদের উপর স্বীয় প্রশান্তি নাযিল করলেন ; আর তাদেরকে তাকওয়ার কালেমায় [২] সুদৃঢ় করলেন, আর তারাই ছিল এর অধিকতর যোগ্য ও উপযুক্ত। আর আল্লাহ্‌ সবকিছু সম্পর্কে সর্বজ্ঞ।

ফুটনোট

[১] জাহেলী অহমিকা বা সংকীর্ণতার অর্থ হলো, এক ব্যক্তির শুধু তার মর্যাদা রক্ষার জন্য কিংবা নিজের কথার মর্যাদা রক্ষার জন্য জেনে শুনে কোন অবৈধ কাজ করা। মক্কার কাফেররা জানতো এবং মানতো যে, হজ ও উমরার জন্য বায়তুল্লাহর যিয়ারত করার অধিকার সবারই আছে। এ দ্বিনী কর্তব্য পালনে বাধা দেয়ার অধিকার কারো নেই। এটা ছিল আরবের সুপ্রাচীন ও সর্বজন স্বীকৃত আইন। কিন্তু তারা নিজেরা নিজেদেরকে অন্যায় ও অসত্যের অনুসারী এবং মুসলিমদেরকে সম্পূর্ণ ন্যায় ও সত্যের অনুসারী বলে জানা সত্বেও শুধু নিজেদের মর্যাদা রক্ষার খাতিরে মুসলিমদের উমরা করতে বাধা দান করে। এমনকি মুশরিকদের মধ্যেও যারা সত্যানুসারী ছিল তারাও বলছিলো যে, যারা ইহরাম অবস্থায় কুরবানীর উট সাথে নিয়ে উমরা পালন করতে এসেছে তাদেরকে বাধা দেয়া একটি অন্যায় কাজ। কিন্তু কুরাইশ নেতারা শুধু একথা ভেবে বাধা দিতে বদ্ধপরিকর ছিল যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি এত বড় দলবল নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করেন তাহলে সমগ্র আরবে আমাদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হবে। তাছাড়া তারা তাকে আল্লাহর নবী বলে মেনে নিতে কুণ্ঠিত হচ্ছিল। বিসমিল্লাহ লিখতে নিষেধ করেছিল। এ সবই ছিল তাদের জাহেলী সংকীর্ণতা। [দেখুন, বুখারীঃ ২৭৩১,২৭৩২]

৪৯ : ১৬
قُلْ أَتُعَلِّمُونَ اللَّهَ بِدِينِكُمْ وَاللَّهُ يَعْلَمُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ ۚ وَاللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ

বলুন, ‘তোমারা কি তোমাদের দ্বীন সম্পর্কে আল্লাহকে অবগত করাচ্ছ? অথচ আল্লাহ জানেন যা কিছু আছে আসমানসমূহে এবং যা কিছু আছে যমীনে। আর আল্লাহ সবকিছু সম্পর্কে সম্যক অবগত।
ফুটনোট

৫১ : ২৮
فَأَوْجَسَ مِنْهُمْ خِيفَةً ۖ قَالُوا لَا تَخَفْ ۖ وَبَشَّرُوهُ بِغُلَامٍ عَلِيمٍ

এতে তাদের সম্পর্কে তার মনে ভীতির সঞ্চার হল [১]। তারা বলল, ‘ভীত হবেন না।’ আর তারা তাকে এক জ্ঞানী পুত্ৰ সন্তানের সুসংবাদ দিল।

ফুটনোট

[১] ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তাদের না খাওয়ার কারণে তাদের ব্যাপারে শংকাবোধ করতে লাগলেন। কেননা, তখন ভদ্র সমাজে এই রীতি প্রচলিত ছিল যে, আহার্য পেশ করলে মেহমান কিছু না কিছু আহার্য গ্রহণ করত। কোন মেহমান এরূপ না করলে তাকে ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে আগমনকারী শত্রু বলে আশংকা করা হত [কুরতুবী]।

৫৩ : ২৮
وَمَا لَهُمْ بِهِ مِنْ عِلْمٍ ۖ إِنْ يَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ ۖ وَإِنَّ الظَّنَّ لَا يُغْنِي مِنَ الْحَقِّ شَيْئًا

অথচ এ বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞানই নেই, তারা তো শুধু অনুমানেরই অনুসরণ করে ; আর নিশ্চয় অনুমান সত্যের মোকাবিলায় কোনই কাজে আসে না [১]।

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ ফেরেশতারা যে স্ত্রীলোক এবং আল্লাহর কন্যা এ বিশ্বাসটি তারা জ্ঞান অর্জনের কোন একটি মাধ্যম ছাড়া জানতে পেরেছে বলে অবলম্বন করেনি। বরং নিজেদের অনুমান ও ধারণার ওপর ভিত্তি করে এ বিষয়টা স্থির করে নিয়েছে এবং এর ওপর ভিত্তি করেই এ সমস্ত আস্তানা গড়ে নিয়েছে। [ফাতহুল কাদীর]

৫৩ : ৩০
ذَٰلِكَ مَبْلَغُهُمْ مِنَ الْعِلْمِ ۚ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِمَنِ اهْتَدَىٰ

এটাই তাদের জ্ঞানের শেষ সীমা। নিশ্চয় আপনার রব, তিনিই ভাল জানেন কে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে এবং তিনিই ভাল জানেন কে হেদায়াতপ্ৰাপ্ত হয়েছে।
ফুটনোট

৫৩ : ৩২
الَّذِينَ يَجْتَنِبُونَ كَبَائِرَ الْإِثْمِ وَالْفَوَاحِشَ إِلَّا اللَّمَمَ ۚ إِنَّ رَبَّكَ وَاسِعُ الْمَغْفِرَةِ ۚ هُوَ أَعْلَمُ بِكُمْ إِذْ أَنْشَأَكُمْ مِنَ الْأَرْضِ وَإِذْ أَنْتُمْ أَجِنَّةٌ فِي بُطُونِ أُمَّهَاتِكُمْ ۖ فَلَا تُزَكُّوا أَنْفُسَكُمْ ۖ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنِ اتَّقَىٰ

যারা বিরত থাকে গুরুতর পাপ ও অশ্লীল কাজ থেকে, ছোটখাট অপরাধ ব্যতীত [১]। নিশ্চয় আপনার রবের ক্ষমা অপরিসীম ; তিনি তোমাদের সম্পর্কে সম্যক অবগত---যখন তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছিলেন মাটি হতে এবং যখন তোমরা মাতৃগর্ভে ভ্রূণরূপে ছিলে। অতএব তোমরা আত্মপ্ৰশংসা করো না, তিনিই সম্যক জানেন তার সম্পর্কে যে তাকওয়া অবলম্বন করেছে [২]।

ফুটনোট

[১] এতে اللمم শব্দের মাধ্যমে ব্যাতিক্রম প্রকাশ করা হয়েছে। এই ব্যাতিক্রমের সারমর্ম হচ্ছে, ছোটখাট গোনাহে লিপ্ত হওয়া তাদেরকে সৎকর্মর উপাধি থেকে বঞ্চিত করে না। اللَّمَم শব্দের তাফসীর প্রসঙ্গে সাহাবী ও তাবেয়ীগণের কাছ থেকে দু'রকম উক্তি বর্ণিত আছে। (এক) এর অর্থ সগীরা অর্থাৎ ছোটখাট গোনাহ। সূরা আন-নিসার ৩১ নং আয়াতে একে سئات বলা হয়েছে। এই উক্তি ইবনে আব্বাস ও আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম থেকে ইবনে-কাসীর বর্ণনা করেছেন। (দুই) এর অর্থ সেসব গোনাহ, যা কদাচিৎ সংঘটিত হয়, অতঃপর তা থেকে তওবা করত চিরতরে বর্জন করা হয়।[ইবন কাসীর] এই উক্তিও ইবনে-কাসীর প্রথমে মুজাহিদ থেকে এবং পরে ইবনে আব্বাস ও আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকেও বর্ণনা করেছেন। [দেখুন, বুখারী: ৬৬১২]

[২] أجنة শব্দটি جنين এর বহুবচন। এর অর্থ গর্ভস্থত ভ্ৰাণ। [কুরতুবী] আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, “তোমরা নিজেদের পবিত্ৰতা দাবি করো না। কারণ, আল্লাহ-ই ভাল জানেন কে কতটুকু মুত্তাকী”। শ্রেষ্ঠত্ব তাকওয়ার ওপর নির্ভরশীল, বাহ্যিক কাজ-কর্মের ওপর নয়। তাকওয়াও তা-ই ধর্তব্য যা মৃত্যু পর্যন্ত কায়েম থাকে। যয়নব বিনতে আবু সালমা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা-এর পিতামাতা তার নাম রেখেছিলেন ‘বাররা’ যার অর্থ সৎকর্মপরায়ণ। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলোচ্য আয়াত তেলাওয়াত করে এই নাম রাখতে নিষেধ করেন। কারণ, এতে সৎ হওয়ার দাবি রয়েছে। অতঃপর তাঁর নাম পরিবর্তন করে যায়নব রাখা হয়। [মুসলিম: ১৮, ১৯]। অনরূপভাবে, জনৈক ব্যক্তি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সামনে অন্য এক ব্যক্তির প্রশং করলে তিনি নিষেধ করে বললেনঃ তুমি যদি কারও প্রশংসা করতেই চাও, তবে এ কথা বলে করঃ আমার জানা মতে এই ব্যক্তি সৎ, আল্লাহভীরু। সে আল্লাহর কাছেও পাক পবিত্র কিনা আমি জানি না। [বুখারী: ২৬৬২, মুসলিম: ৬৫, মুসনাদে আহমাদ: ৫/৪১,৪৫]

এ আয়াতের শানে নুযুল সম্পর্কে একটি বর্ণনা এসেছে, সাবেত ইবনুল হারিস আনসারী বলেন, ইয়াহূদীদের কোন সন্তান ছোট অবস্থায় মারা গেলে তারা তাকে বলত, সে সিদ্দীকীনের মর্যাদায় পৌঁছে গেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এ কথা পৌঁছলে তিনি বললেন, ইয়াহুদীরা মিথ্যা বলেছে। কোন সন্তান তার মায়ের পেটে থাকতেই তার সৌভাগ্যবান হওয়া বা দূৰ্ভাগা হওয়া লিখে নেয়া হয়েছে। তারপর আল্লাহ তা'আলা উপরোক্ত আয়াত নাযিল করেন। [মুজামুল কাবীর লিত তাবরানী: ২/৮১,৮২ হাদীস নং ১৩৬৮]

৫৩ : ৩৫
أَعِنْدَهُ عِلْمُ الْغَيْبِ فَهُوَ يَرَىٰ

তার কাছে কি গায়েবের জ্ঞান আছে যে, সে প্রত্যক্ষ করে?
ফুটনোট

৫৭ :
هُوَ الْأَوَّلُ وَالْآخِرُ وَالظَّاهِرُ وَالْبَاطِنُ ۖ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ

তিনিই প্রথম ও শেষ ; প্রকাশ্য (উপরে) ও গোপন (নিকটে) আর তিনি সবকিছু সম্পর্কে সম্যক অবগত [১]।

ফুটনোট

[১] ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেনঃ কোন সময় তোমার অন্তরে আল্লাহ তা’আলা ও ইসলাম সম্পর্কে শয়তানী কুমন্ত্রণা দেখা দিলে

هُوَالْاَوَّلُ وَالْاٰخِرُ وَالظَّاهِرُوَالْبَاطِنُ وَهُوَبِكُلِّ شَىْءٍعِلِيْمٌ

আয়াতখানি আস্তে পাঠ করে নাও। [আবু দাউদ: ৫১১০] এই আয়াতের তাফসীর এবং “আউয়াল”, “আখের”, “যাহের” ও “বাতেন” এ শব্দ চারটির অর্থ সম্পর্কে তফসীরবিদগণের বহু উক্তি বর্ণিত আছে। তন্মধ্যে “আউয়াল” শব্দের অর্থ তো প্ৰায় নির্দিষ্ট; অর্থাৎ অস্তিত্বের দিক দিয়ে সকল সৃষ্টজগতের অগ্রে ও আদি। কারণ, তিনি ব্যতীত সবকিছু তাঁরই সৃজিত। তাই তিনি সবার আদি। “আখের” এর অর্থ কারও কারও মতে এই যে, সবকিছু বিলীন হয়ে যাওয়ার পরও তিনি বিদ্যমান থাকবেন। [সা’দী] যেমন

كُلُّ شَيْءٍ هَالِكٌ إِلَّا وَجْهَهُ [সূরা আল-কাসাস: ৮৮]

আয়াতে এর পরিষ্কার উল্লেখ আছে। ইমাম বুখারী বলেন, যাহের’ অর্থ জ্ঞানে তিনি সবকিছুর উপর, অনুরূপ তিনি ‘বাতেন’ অৰ্থাৎ জ্ঞানে সবকিছুর নিকটে। বিভিন্ন হাদীসে এ আয়াতের তাফসীর এসেছে, এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘুমানোর সময় বলতেন, “হে আল্লাহ! সাত আসমানের রব, মহান আরশের রব, আমাদের রব এবং সবকিছুর রব, তাওরাত, ইঞ্জীল ও ফুরকান নাযিলকারী, দানা ও আঁটি চিরে বৃক্ষের উদ্ভবকারী, আপনি ব্যতীত কোন হক্ক মা’বুদ নেই, যাদের কপাল আপনার নিয়ন্ত্রণে এমন প্ৰত্যেক বস্তুর অনিষ্ট হতে আমি আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করি, আপনি অনাদি, আপনার আগে কিছু নেই, আপনি অনন্ত আপনার পরে কিছুই থাকবে না। আপনি সবকিছুর উপরে, আপনার উপরে কিছুই নেই, আপনি নিকটবর্তী, আপনার চেয়ে নিকটবর্তী কেউ নেই, আমার পক্ষ থেকে আপনি আমার ঋণ পরিশোধ করে দিন এবং আমাকে দারিদ্রতা থেকে মুক্তি দিন।” [মুসলিম: ২৭১৩, মুসনাদে আহমাদ ২/৪০৪]

৫৮ :
أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ ۖ مَا يَكُونُ مِنْ نَجْوَىٰ ثَلَاثَةٍ إِلَّا هُوَ رَابِعُهُمْ وَلَا خَمْسَةٍ إِلَّا هُوَ سَادِسُهُمْ وَلَا أَدْنَىٰ مِنْ ذَٰلِكَ وَلَا أَكْثَرَ إِلَّا هُوَ مَعَهُمْ أَيْنَ مَا كَانُوا ۖ ثُمَّ يُنَبِّئُهُمْ بِمَا عَمِلُوا يَوْمَ الْقِيَامَةِ ۚ إِنَّ اللَّهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ

আপনি কি লক্ষ্য করেন না যে, আসমানসমূহ ও যমীনে যা কিছু আছে আল্লাহ তা জানেন? তিন ব্যক্তির মধ্যে এমন কোন গোপন পরামর্শ হয় না যাতে চতুর্থ জন হিসেবে তিনি থাকেন না এবং পাঁচ ব্যক্তির মধ্যেও হয় না যাতে ষষ্ট জন হিসেবে তিনি থাকেন না। তারা এর চেয়ে কম হোক বা বেশী হোক তিনি তো তাদের সঙ্গেই আছেন তারা যেখানেই থাকুক না কেন [১]। তারপর তারা যা করে, তিনি তাদেরকে কিয়ামতের দিন তা জানিয়ে দেবেন। নিশ্চয় আল্লাহ্‌ সব কিছু সম্পর্কে সম্যক অবগত।

ফুটনোট

[১] তবে মনে রাখতে হবে যে, সাথে থাকার অর্থ এ নয় যে, আল্লাহ্ তা'আলা তাঁর কোন সৃষ্টির ভিতরে বা সৃষ্টির সাথে লেগে আছেন। বরং এখানে সাথে থাকার অর্থ, জ্ঞানের মাধ্যমে তাদের সাথে থাকা। কারণ, আয়াতের শেষে “নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছু সম্পর্কে সম্যক অবগত।” এ কথাটি বলে তা স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ তাঁর আরাশের উপর, তাঁর সৃষ্টি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা অবস্থানে রয়েছেন। স্রষ্টাকে সৃষ্টির সাথে লেগে আছে বা প্রবিষ্ট হয়ে আছে মনে করা শির্ক ও কুফারী। এ তাফসীরের অন্যান্য স্থানেও এ বিষয়টি বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। [যেমন সূরা ত্বা-হা: ৪৬; সূরা আশ-শু'আরা: ১৫; সূরা আল-হাদীদ: ৪]

এ সব আয়াতের সব স্থানেই এর অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ তা'আলার জ্ঞান তাঁর বান্দাকে পরিবেষ্টন করে আছে। তার জ্ঞান ও ক্ষমতার বাইরে কেউ নেই। এরই নাম হচ্ছে, সাধারণভাবে আল্লাহ তাঁর বান্দার সাথে থাকা। তবে এর পাশাপাশি আল্লাহ তা'আলা তার মুমিন বান্দাদের সাথে বিশেষভাবেও সাথে থাকেন। আর সে সাথে থাকা বলতে বুঝায় সাহায্য-সহযোগিতা ও প্রতিষ্ঠা করা। [যেমন সূরা আল-বাকারাহ: ১৯৪; সূরা আলআনফাল: ১৯; সূরা আত-তাওবাহঃ ৩৬; ১২৩; সূরা আন-নাহল: ১২৮; সূরা আল-আনকাবূত: ৬৯ ও সূরা মুহাম্মাদ: ৩৫ নং আয়াত] এ সব আয়াতে "সাথে থাকা' সাহায্য-সহযোগিতার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ তিনি সৎ বান্দাদের সম্পর্কে সম্যক জানেন ও তাদেরকে সাহায্য ও সহযোগিতা করেন।

৫৮ : ১১
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا قِيلَ لَكُمْ تَفَسَّحُوا فِي الْمَجَالِسِ فَافْسَحُوا يَفْسَحِ اللَّهُ لَكُمْ ۖ وَإِذَا قِيلَ انْشُزُوا فَانْشُزُوا يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ ۚ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ

হে ঈমানদারগণ ! যখন তোমাদেরকে বলা হয়, মজলিসে স্থান প্রশস্ত করে দাও তখন তোমরা স্থান প্রশস্ত করে দিও, আল্লাহ্‌ তোমাদের জন্য স্থান প্রশস্ত করে দেবেন [১]। আর যখন বলা হয়, “উঠ”, তখন তোমরা উঠে যাবে [২]। তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ্‌ তাদেরকে মর্যাদায় উন্নত করবেন ; আর তোমরা যা কর আল্লাহ্‌ সে সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত [৩]।

ফুটনোট

[১] বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মসজিদে মুনাফিকরা মজলিস পূর্ণ করে বসে থাকত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে আগন্তুকদের জন্য জায়গা করে দিতে বলতেন কিন্তু তারা নির্বিকার থাকত। তখন আল্লাহ্ তা'আলা এ আয়াত নাযিল করে তাদের সাবধান করে দেন। এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তোমাদের কেউ যেন কাউকে উঠিয়ে দিয়ে সেখানে না বসে, বরং জায়গা করে দাও, আল্লাহও তোমাদের জন্য তা করে দেবেন।” [বুখারী: ৬২৭০, মুসলিম: ২১৭৭]

ইসলাম মজলিসের সাথে সম্পর্কিত আরও কিছু শিষ্টাচার নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যেমন: কেউ কারো জন্য নিজের বসার জায়গা ছেড়ে দিতে হবে না বরং অন্যকে জায়গা করে দিবে। [মুসনাদে আহমাদ: ২/৩৩৮, ৪৮৩] অন্য হাদীসে এসেছে, ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, “কাউকে তার জায়গা থেকে উঠিয়ে সেখানে অপর কাউকে বসাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিষেধ করেছেন। বরং তোমরা প্রশস্ত কর এবং বড় করে নাও”। [বুখারী: ২৬৭০]

তাই কোন ব্যক্তি আগমন করলে তার জন্য কি দাঁড়াতে হবে? এ ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে দ্বিমত আছে। কারও কারও মতে, আগমনকারীর জন্য দাঁড়ানোর অনুমতি আছে। তারা তাদের মতের সপক্ষে রাসূলের হাদীস “তোমরা তোমাদের নেতার প্রতি দাঁড়িয়ে যাও” [বুখারী: ৩০৪৩, মুসলিম: ১৭৬৮] কিন্তু অধিকাংশ আলেমগণ এটা করতে নিষেধ করেছেন, তাদের দলীল হলো, রাসূলের হাদীস, “কেউ যদি এটা পছন্দ করে যে, মানুষ তার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে, তবে সে যেন জাহান্নামে তার অবস্থান করে নিল” [তিরমিয়ী: ২৭৫৫] তারা পূর্ববর্তী হাদীসে উত্তরে বলেন, হাদীসের শব্দ হলো, قُومُواإِلى سَيَّدِكُمْ যার অর্থ, তোমরা দাঁড়িয়ে তোমাদের নেতার প্রতি ধাবিত হও। এর অন্য বর্ণনায় এসেছে,

قُومُواإِلى سَيَّدِكُمْ فأنزلُوه

অর্থাৎ “তোমরা তোমাদের নেতার প্রতি ধাবিত হয়ে তাকে নামিয়ে নাও” [মুসনাদে আহমাদ: ৬/১৪১-১৪২] এ বর্ণনা থেকে স্পষ্ট বুঝা গেল যে, এখানে তাকে ঘোড়া থেকে নামিয়ে নেয়ার জন্যই দাঁড়াতে বলা হয়েছে। কারণ; তিনি যুদ্ধে আহত হয়েছিলেন সে জন্য হাঁটতে অক্ষম ছিলেন। ফলে তাকে বাহন থেকে নামিয়ে নেয়ার প্রয়োজন ছিল। সুতরাং কারো জন্য দাঁড়ানোর পক্ষে শক্তিশালী কোন প্রমাণ নেই। কোন কোন আলেম অবশ্য এ ব্যাপারে বিস্তারিত মতামত দিয়েছেন। তাদের মতে, সাধারণ অবস্থায় যেভাবে মানুষ মানুষকে দাঁড়াতে বাধ্য করে সেভাবে জায়েয নেই, তবে কেউ সফর থেকে আসলে বা কোনো ক্ষমতাশীলের ক্ষমতায় প্রবেশ করলে ক্ষমতাশীলের প্রতি সম্মান করতে ও তার নির্দেশ বাস্তবায়ন ও তার সম্মানের দিকে খেয়াল রেখে দাঁড়িয়ে যাওয়া জায়েয এবং এটা হিকমতেরও চাহিদা। যেমনিভাবে সাহাবায়ে কিরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম সা'দ ইবনে মু’আয এর মধ্যে তার নির্দেশ ও ফয়সালা বেশী গ্রহণযোগ্য ও কার্যকর হয়। কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় কাউকে দেখলেই দাঁড়াতে হবে এটা শরীআত সমর্থিত নয়। বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে, “সাহাবায়ে কিরামের নিকট রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রিয় ব্যক্তি কেউ ছিলেন না। কিন্তু তিনি যখন মজলিসে আগমন করতেন তখন তারা দাঁড়াতোনা, কারণ; তারা জানতো যে, তিনি তা অপছন্দ করেন।” [মুসনাদে আহমাদ: ৩/১৩২, তিরমিয়ী: ২৭৫৪]

এমনকি সাহাবায়ে কিরাম যখনই রাসূলের মজলিসে আসতেন তখনই তারা যেখানে বসা শেষ হয়েছে সেখানে বসতেন। [আবু দাউদ: ৪৮২৫, তিরযিমযী: ২৭২৫] তবে সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে যারা রাসূলের নৈকট্যপ্ৰাপ্ত ছিলেন তারা আসলে স্বাভাবিকভাবেই সাহাবায়ে কিরাম তাদের জন্য জায়গা করে দিতেন। আর রাসূলই এ ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, “তোমাদের মধ্যে যারা জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান তারা যেন আমার কাছে থাকে”। [মুসলিম: ৪৩২, আবু দাউদ: ৬৭৪]

সে হিসেবে আবু বকর সাধারনত তার ডান পাশে, উমর বাম পাশে, উসমান ও আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম সামনে বসতেন। কারণ: তারা ওহী লিখতেন। তবে কোন ক্রমেই কারও অনুমতি ব্যতীত দু’জনের মাঝখানে বসে দু'জনের মধ্যে পৃথকীকরণ করা যাবে না। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “কোন লোকের পক্ষে এটা জায়েয নয় যে, সে দু'জনের মাঝে পৃথকীকরণ করে বসবে তাদের অনুমতি ব্যতীত”। [আবু দাউদ: ৪৮৪৫, তিরমিয়ী: ২৭৫২, মুসনাদে আহমাদ: ২/২১৩]

[২] মুজাহিদ বলেন, এখানে “উঠ” বলে যাবতীয় কল্যাণকর কাজ করার জন্য নির্দেশ বুঝানো হয়েছে, অর্থাৎ যখনই তোমাদেরকে শক্রর মোকাবিলায় দাঁড়াতে, অথবা সৎকাজ করতে বা কোন হক আদায় করতে বলা হয় তখনই তোমরা তা করতে সচেষ্ট হবে। কাতাদাহ বলেন, এর অর্থ যখনই তোমাদেরকে কোন কল্যাণকর কাজের আহবান জানানো হয় তখনই তোমরা তার প্রতি সাড়া দিও। [কুরতুবী]

[৩] অর্থাৎ কাউকে তার বসা থেকে সরে অন্যকে বসার জায়গা করে দেয়া বা রাসূল ও দ্বীনী নেতারা যদি কাউকে বের হতে বলে যদি তোমরা কর তবে এটা মনে করো না যে, এর দ্বারা তোমাদের সম্মানের কোন কমতি করা হচ্ছে বা তোমাদেরকে অবমুল্যায়ণ করা হচ্ছে। বরং আল্লাহর নিকট এ নির্দেশ পালনের মধ্যেই সম্মান ও মর্যাদা রয়েছে। আল্লাহ তার এ ত্যাগ কখনো খাটো করে দেখবেন না। তিনি তাকে দুনিয়া ও আখেরাতে পুরস্কৃত করবেন। কেননা; যে কেউ মহান আল্লাহর দিক বিবেচনা করে বিনম্র হয় মহান আল্লাহ তার মর্যাদা বুলন্দ করে দেন। আর তার স্মরণকে উচু করে দেন। আর এ জন্যই পরবর্তী আয়াতাংশে বলা হয়েছে, “তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ তাদেরকে মর্যাদায় উন্নত করবেন। আর আল্লাহ তোমরা যা কর সে সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত।” তিনি ভাল করেই জানেন কারা উঁচু মর্যাদা পাওয়ার অধিকারী আর কারা নয়। [ইবন কাসীর]

আবুত তোফায়েল আমের ইবনে ওয়াসিলা বলেন, উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু নাফে' ইবনে হারেসকে উসফান নামক স্থানে দেখা পেলেন। তিনি তাকে মক্কার গভর্ণর নিযুক্ত করেছিলেন। উমর তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি উপত্যকাবাসী (মক্কা) এর উপর কাকে দায়িত্ব দিয়ে এসেছ? আমের বললেন, আমি ইবনে আবদ্যার উপর তাদের দায়িত্ব দিয়েছি। উমর বললেন, ইবনে আবযা কে? তিনি বললেন, আমাদের এক দাস। উমর বললেন, তাদের উপর তুমি দাসকে দায়িত্বশীল করেছ? তিনি বললেন, হে আমিরুল মুমিনীন ! সে আল্লাহর কিতাবের একজন সুপাঠক, ফারায়েজ সম্পর্কে পণ্ডিত ও বিচারক। তখন উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, তাহলে শোন, আমি তোমাদের নবীকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, “নিশ্চয় আল্লাহ্‌ এ কুরআন দ্বারা কাউকে উচ্চ মর্যাদায় আসীন করবেন আর কাউকে অধঃপতন ঘটাবেন।” [মুসলিম: ৮১৭]

৬০ : ১০
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا جَاءَكُمُ الْمُؤْمِنَاتُ مُهَاجِرَاتٍ فَامْتَحِنُوهُنَّ ۖ اللَّهُ أَعْلَمُ بِإِيمَانِهِنَّ ۖ فَإِنْ عَلِمْتُمُوهُنَّ مُؤْمِنَاتٍ فَلَا تَرْجِعُوهُنَّ إِلَى الْكُفَّارِ ۖ لَا هُنَّ حِلٌّ لَهُمْ وَلَا هُمْ يَحِلُّونَ لَهُنَّ ۖ وَآتُوهُمْ مَا أَنْفَقُوا ۚ وَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ أَنْ تَنْكِحُوهُنَّ إِذَا آتَيْتُمُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ ۚ وَلَا تُمْسِكُوا بِعِصَمِ الْكَوَافِرِ وَاسْأَلُوا مَا أَنْفَقْتُمْ وَلْيَسْأَلُوا مَا أَنْفَقُوا ۚ ذَٰلِكُمْ حُكْمُ اللَّهِ ۖ يَحْكُمُ بَيْنَكُمْ ۚ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ

হে ঈমানদারগণণ [১]! তোমাদের কাছে মুমিন নারীরা হিজরত করে আসলে তোমরা তাদেরকে পরীক্ষা করো [২]; আল্লাহ তাদের ঈমান সম্বন্ধে সম্যক অবগত। অতঃপর যদি তোমরা জানতে পার যে, তারা মুমিন নারী, তবে তাদেরকে কাফিরদের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দিয়ো না। মুমিন নারীগণ কাফিরদের জন্য বৈধ নয় এবং কাফিরগণ মুমিন নারীদের জন্য বৈধ নয়। কাফিররা যা ব্যয় করেছে তা তাদেরকে ফিরিয়ে দিও। তারপর তোমারা তাদেরকে বিয়ে করলে তোমাদের কোন অপরাধ হবে না যদি তোমারা তাদেরকে তাদের মহর দাও। আর তোমরা কাফির নারীদের সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক বজায় রেখো না [৩]। তোমারা যা ব্যয় করেছ তা ফেরত চাইবে এবং কাফিররা যা ব্যয় করেছে তা যেন তারা চেয়ে নেয়। এটাই আল্লাহর বিধান; তিনি তোমাদের মধ্যে ফয়সালা করে থাকেন। আর আল্লাহ্‌ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।

ফুটনোট

[১] আলোচ্য আয়াতগুলো একটি বিশেষ ঘটনা অর্থাৎ হুদায়বিয়ার সন্ধির সাথে সম্পর্কযুক্ত। হাদীসে এসেছে, “যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সন্ধি চুক্তি শেষ করলেন তখন তিনি সাহাবায়ে কিরামকে বললেন, তোমরা উঠ এবং উটগুলোর “নাহর’ বা রক্ত প্রবাহিত কর তারপর মাথা কামিয়ে ফেল। কিন্তু তাদের কেউই এটা শুনছিল না। শেষপর্যন্ত রাসূল এটা তিনবার বললেন। কিন্তু কেউ না শুনাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মে সালামাহ এর কাছে গিয়ে তা বিবৃত করলেন। উম্মে সালামাহ বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ্! আপনি কি এটা বাস্তবে হওয়া চান? তবে আপনি কাউকে কিছু না বলে নিজের উটটি “নাহর’ করুন এবং আপনার মাথা কামানোর জন্য লোক ডেকে তা সম্পাদন করুন। তিনি তাই করলেন। ফলে সবাই তা করতে শুরু করে দিল। আর তখনই কয়েকজন মুমিন নারী এসে উপস্থিত। তখন আল্লাহ্ তা'আলা

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا جَاءَكُمُ الْمُؤْمِنَاتُ مُهَاجِرَاتٍ

এই আয়াত নাযিল করলেন।” [বুখারী: ২৩৭২] এর কারণ হলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও মক্কাবাসীদের মধ্যে অনুষ্ঠিত হুদায়বিয়ার বিখ্যাত শান্তিচুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল এই যে, মক্কা থেকে কোন ব্যক্তি মদিনায় চলে গেলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে ফেরত পাঠিয়ে দিবেন যদিও সে মুসলিম হয়। কিন্তু মদীনা থেকে কেউ মক্কায় চলে গেলে কোরাইশরা তাকে ফেরত পাঠাবে না। এই শর্তের ভাষা ছিল ব্যাপক, যাতে পুরুষ ও নারী উভয়ই বাহ্যত অন্তর্ভুক্ত ছিল। অর্থাৎ কোন মুসলিম পুরুষ অথবা নারী মক্কা থেকে মদীনায় চলে গেলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে ফেরত পাঠাবেন। এই চুক্তি সম্পাদন শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন হুদায়বিয়াতেই অবস্থানরত ছিলেন তখন মুসলিমদের জন্যে অগ্নি পরীক্ষাতুল্য একাধিক ঘটনা সংঘটিত হয়ে যায়। তন্মধ্যে একটি ঘটনা হচ্ছে, সুবাই’আ বিনতে হারেস আল-আসলামিয়্যাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা কাফের সায়ফী ইবনে রাহিবের পত্নী ছিলেন। তখন পর্যন্ত মুসলিম ও কাফেরের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন হারাম ছিল না। এই মুসলিম মহিলা মক্কা থেকে পালিয়ে হুদাইবিয়ায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে উপস্থিত হলেন। সাথে সাথে স্বামীও হাযির। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে দাবি জানাল যে, আমার স্ত্রীকে আমার কাছে প্রত্যাৰ্পণ করা হাোক। কেননা, আপনি এই শর্ত মেনে নিয়েছেন এবং চুক্তিপত্রের কালি এখনও শুকায়নি। [তাফসীরে কুরতুবী: ২০/৪১০]

এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আলোচ্য আয়াতসমূহ অবতীর্ণ হয়েছে। এসব আয়াতে প্রকৃতপক্ষে মুসলিম ও কাফেরদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক নিষিদ্ধ ও হারাম করা হয়েছে। এর পরিণতিতে এ কথাও প্রমাণিত হয় যে, কোন মুসলিম নারী হিজরত করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে পৌছে গেলে তাকে কাফেরদের হাতে ফেরত দেয়া হবে না সে পূর্ব থেকেই মুসলিম হোক; -যেমন উল্লেখিত ভদ্রমহিলা, অথবা হিজরতের পর তার মুসলিমতত্ত্ব প্রমাণিত হোক। তাকে ফেরত না দেয়ার কারণ এই যে, সে তার কাফের স্বামীর জন্যে হালাল নয়। উল্লেখিত আয়াতসমূহ অবতরণের ফলে এ কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, চুক্তিপত্রের উপরোক্ত শর্তটি ব্যাপক অর্থে প্রযোজ্য নয় যে, এই শর্তটির ব্যাপকতা কেবল পুরুষদের ক্ষেত্রে গ্রহণীয়-নারীদের ক্ষেত্রে নয়। আয়াতের ভিত্তিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চুক্তিপত্রের উল্লেখিত এই শর্তের সঠিক মর্ম ব্যাখ্যা করেন এবং তদনুযায়ী সুবাই’আ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে কাফেরদের কাছে ফেরত প্রেরণে বিরত থাকেন। কোন কোন বর্ণনায় অনুরূপ ঘটনা উম্মে কুলসুম বিনতে-উকবার ক্ষেত্রেও ঘটেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে ৷ [বুখারী: ২৭১১, ২৭১২]

[২] আয়াতে মুহাজির নারীকে পরীক্ষা করার কথা বলা হয়েছে। সে পরীক্ষা কি ছিল এ ব্যাপারে বিভিন্ন মত বর্ণিত আছে, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, মুহাজির নারীকে শপথ করানো হত যে, সে স্বামীর প্রতি বিদ্বেষ ও ঘৃণার কারণে আগমন করেনি, মদীনার কোন ব্যক্তির প্রেমে পড়ে আসেনি এবং অন্য কোন পার্থিব স্বার্থের বশবর্তী হয়ে হিজরত করেনি; বরং একান্তভাবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালবাসা ও সস্তুষ্টি লাভের জন্যে আগমন করেছে। যে নারী এই শপথ করত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে মদীনায় বসবাসের অনুমতি দিতেন এবং সে তার স্বামীর কাছ থেকে যে মোহরানা ইত্যাদি আদায় করেছিল, তা তার স্বামীকে ফেরত দিয়ে দিতেন। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, পরীক্ষা ছিল, কালেমা শাহাদাত বলা অর্থাৎ আশাহাদু আল্লাইলাহা ইল্লাল্লাহ, ওয়া আশাহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ বলা। তবে এখানে গ্রহণযোগ্য মত হলো, যা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নারীদের পরীক্ষার পদ্ধতি ছিল সেই আনুগত্যের শপথ, যা পরবর্তী আয়াতসমূহে বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে;

يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِذَا جَاءَكَ الْمُؤْمِنَاتُ يُبَايِعْنَكَ عَلَىٰ أَن لَّا يُشْرِكْنَ بِاللَّهِ شَيْئًا وَلَا يَسْرِقْنَ وَلَا يَزْنِينَ وَلَا يَقْتُلْنَ أَوْلَادَهُنَّ وَلَا يَأْتِينَ بِبُهْتَانٍ يَفْتَرِينَهُ بَيْنَ أَيْدِيهِنَّ وَأَرْجُلِهِنَّ وَلَا يَعْصِينَكَ فِي مَعْرُوفٍ ۙ فَبَايِعْهُنَّ وَاسْتَغْفِرْ لَهُنَّ اللَّهَ ۖ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ

মুহাজির নারীরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাতে আয়াতে বৰ্ণিত বিষয়সমূহের শপথ করত। তিরমিয়ী: ৩৩০৬, অনুরূপ বর্ণনা দেখুন, বুখারী: ৪১৮২, ৪৮৯১, মুসলিম: ১৮৬৬, মুসনাদে আহমাদ: ৬/২৭০]

[৩] كَوَافِر শব্দটি كَافِرَةٌ এর বহুবচন। এখানে মুশরিক নারী বোঝানো হয়েছে। [বাগভী]

৬৪ : ১১
مَا أَصَابَ مِنْ مُصِيبَةٍ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ ۗ وَمَنْ يُؤْمِنْ بِاللَّهِ يَهْدِ قَلْبَهُ ۚ وَاللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ

আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোন বিপদই আপতিত হয় না এবং কেউ আল্লাহর উপর ঈমান রাখলে তিনি তার অন্তরকে সুপথে পরিচালিত করেন। আর আল্লাহ্‌ সবকিছু সম্পর্কে সম্যক অবগত।
ফুটনোট

৬৫ : ১২
اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ وَمِنَ الْأَرْضِ مِثْلَهُنَّ يَتَنَزَّلُ الْأَمْرُ بَيْنَهُنَّ لِتَعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ وَأَنَّ اللَّهَ قَدْ أَحَاطَ بِكُلِّ شَيْءٍ عِلْمًا

তিনি আল্লাহ্‌, যিনি সৃষ্টি করেছেন সাত আসমান এবং অনুরূপ যমীন, তাদের মধ্যে নেমে আসে তাঁর নির্দেশ ; যাতে তোমরা জানতে পার যে, আল্লাহ সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান এবং জ্ঞানে আল্লাহ্‌ সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে আছেন।
ফুটনোট

৬৭ : ২৬
قُلْ إِنَّمَا الْعِلْمُ عِنْدَ اللَّهِ وَإِنَّمَا أَنَا نَذِيرٌ مُبِينٌ

বলুন, ‘এর জ্ঞান শুধু আল্লাহ্‌রই কাছে আছে, আর আমি তো স্পষ্ট সতর্ককারী মাত্র।’
ফুটনোট

৯৬ :
اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ

পড়ুন আপনার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন [১] –

ফুটনোট

সূরা সম্পর্কিত তথ্যঃ

নির্ভরযোগ্য বর্ণনা থেকে প্রমাণিত রয়েছে যে, সূরা আলাক থেকেই ওহীর সূচনা হয় এবং এ সূরার প্রথম পাঁচটি আয়াত مَالَمْ يَعْلَمْ পর্যন্ত সর্ব প্রথম নাযিল হয়। [দেখুন, বুখারী: ৬৯৮২, মুসলিম: ১৬০] অধিকাংশ আলেম এ বিষয়ে একমত। কেউ কেউ সূরা আল-মুদ্দাসসিরকে প্রথম সূরা এবং কেউ সূরা ফাতেহাকে সর্বপ্রথম সূরা বলে অভিহিত করেছেন। তবে প্রথমোক্ত মতটিই বিশুদ্ধ। [আল-ইতকান ফী উলূমিল কুরআন: ১/৯৩]

--------------------------

[১] শুধু বলা হয়েছে, “সৃষ্টি করেছেন।” কাকে সৃষ্টি করেছেন তা বলা হয়নি। এ থেকে আপনা আপনিই এ অর্থ বের হয়ে আসে, সেই রবের নাম নিয়ে পড় যিনি স্রষ্টা সমগ্র বিশ্ব-জাহানের, সমগ্র সৃষ্টিজগতের। [আদ্ওয়াউল বায়ান]

৯৬ :
خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ

সৃষ্টি করেছেন মানুষকে ‘আলাক’ হতে [১]।

ফুটনোট

[১] পূর্বের আয়াতে সমগ্র সৃষ্টিজগত সৃষ্টির বর্ণনা ছিল। এ আয়াতে সৃষ্টিজগতের মধ্য থেকে বিশেষ করে মানব সৃষ্টির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ্ বলেছেন, মানুষকে ‘আলাক’ থেকে সৃষ্টি করেছেন। ‘আলাক’ হচ্ছে ‘আলাকাহ’ শব্দের বহুবচন। এর মানে জমাট বাঁধা রক্ত। সাধারণভাবে বিশ্ব-জাহানের সৃষ্টির কথা বলার পর বিশেষ করে মানুষের কথা বলা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ্ কেমন হীন অবস্থা থেকে তার সৃষ্টিপর্ব শুরু করে তাকে পূৰ্ণাংগ মানুষে রূপান্তরিত করেছেন। [কুরতুবী]

৯৬ :
اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ

পড়ুন, আর আপনার রব মহামহিমান্বিত [১]

ফুটনোট

[১] এখানে পড়ার আদেশের পুনরুল্লেখ করা হয়েছে। কেউ কেউ বলেন, প্রথম আদেশটি নিজে পাঠ করার আদেশ, আর দ্বিতীয়টি অন্যকে পাঠ করানো বা অন্যের নিকট প্রচারের নির্দেশ। [ফাতহুল কাদীর] অতঃপর মহান রব আল্লাহ্র সাথে الأكرم বিশেষণ যোগ করার মধ্যে এ ইঙ্গিত রয়েছে যে, মানুষ সৃষ্টি করা এবং তাদের শিক্ষাদান করার নেয়ামতের মধ্যে আল্লাহ্ তা‘আলার নিজের কোন স্বার্থ ও লাভ নেই; বরং এগুলো তাঁরই অনুগ্রহ, তাঁরই দান। তিনি সর্বমহান দানশীল ও মহামহিমান্বিত। [আদ্ওয়াউল বায়ান, মুয়াস্সার]

৯৬ :
الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ

যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন [১] –

ফুটনোট

[১] মানব সৃষ্টির কথা বর্ণনার পর এখানে মানুষের শিক্ষার প্রসঙ্গটি উল্লেখিত হয়েছে। মহান আল্লাহ্র অশেষ মেহেরবানী যে, তিনি মানুষকে কলমের মাধ্যমে তথা লেখার শিক্ষা দান করেছেন। তা না হলে মানুষের মধ্যে জ্ঞানের উন্নতি, বংশানুক্রমিক ক্ৰমবিকাশ সম্ভব হত না। জ্ঞান, প্রজ্ঞা, পূর্ববর্তীদের জীবন-কাহিনী, আসমানী-কিতাব সব কিছুই সংরক্ষিত হয়েছে লেখনির মাধ্যমে। কলম না থাকলে, দ্বীন এবং দুনিয়ার কোন কিছুই পূর্ণরূপে গড়ে উঠত না। [ফাতহুল কাদীর] হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “আল্লাহ্ তা‘আলা যখন প্রথম সবকিছু সৃষ্টি করেন, তখন আরশে তার কাছে রক্ষিত কিতাবে একথা লিপিবদ্ধ করেন যে, আমার রহমত আমার ক্রোধের উপর প্রবল থাকবে।” [বুখারী: ৩১৯৪, ৭৫৫৩, মুসলিম: ২৭৫১] হাদীসে আরও বলা হয়েছে, “আল্লাহ্ তা‘আলা সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করেন এবং তাকে লেখার নির্দেশ দেন। সেমতে কলম কেয়ামত পর্যন্ত যা কিছু হবে, সব লিখে ফেলে। ” [মুসনাদে আহমাদ: ৫/৩১৭]

৯৬ :
عَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ

শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না [১]।

ফুটনোট

[১] পূর্বের আয়াতে ছিল কলমের সাহায্যে শিক্ষা দানের বর্ণনা। এ আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রকৃত শিক্ষাদাতা আল্লাহ্ তা‘আলা। মানুষ আসলে ছিল সম্পূর্ণ জ্ঞানহীন। আল্লাহ্র কাছ থেকেই সে যা কিছু জ্ঞান লাভ করেছে। [সা‘দী] কলমের সাহায্যে যা শিক্ষা দেয়া হয়েছে, তার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, তিনি এমন সব বিষয় শিক্ষা দিয়েছেন, যা মানুষ জানত না। কেউ কেউ বলেন, এখানে মানুষ বলে আদম আলাইহিস্ সালামকে বোঝানো হয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে বিভিন্ন বস্তুর নাম ও গুনাগুন শিক্ষা দিয়েছেন। যেমনটি সূরা আল-বাকারায় বর্ণনা করা হয়েছে। [ফাতহুল কাদীর]

১০২ :
كَلَّا لَوْ تَعْلَمُونَ عِلْمَ الْيَقِينِ

কখনো নয়! যদি তোমরা নিশ্চিত জ্ঞানে জ্ঞানী হতে--- [১]

ফুটনোট

[১] এখানে لو বা ‘যদি’ শব্দের জওয়াব উহ্য রয়েছে। অর্থাৎ لَمَا أَلْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ উদ্দেশ্য এই যে, তোমরা যদি কেয়ামতের হিসাব-নিকাশে নিশ্চিত বিশ্বাসী হতে, তবে কখনও প্রাচুর্যের বড়াই করতে না এবং উদাসীন হতে না। [সা‘দী]

১০২ :
لَتَرَوُنَّ الْجَحِيمَ

অবশ্যই তোমরা জাহান্নাম দেখবে;
ফুটনোট

0:00
0:00