নূর (আলো)
নূর (আলো)
: ২৫৭
اللَّهُ وَلِيُّ الَّذِينَ آمَنُوا يُخْرِجُهُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ ۖ وَالَّذِينَ كَفَرُوا أَوْلِيَاؤُهُمُ الطَّاغُوتُ يُخْرِجُونَهُمْ مِنَ النُّورِ إِلَى الظُّلُمَاتِ ۗ أُولَٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ

আল্লাহ্‌ তাদের অভিভাবক যারা ঈমান আনে , তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোতে নিয়ে যান। আর যারা কুফরী করে তাগূত তাদের অভিভাবক, এরা তাদেরকে আলো থেকে অন্ধকারে নিয়ে যায় [১]। তারাই আগুনের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে।

ফুটনোট

[১] এখানে বলা হয়েছে যে, ইসলাম সর্বাপেক্ষা বড় নেয়ামত এবং কুফর সবচাইতে বড় দুর্ভাগ্য। এতদসঙ্গে কাফের বা বিরুদ্ধবাদীদের সাথে বন্ধুত্ব করার বিপদ সম্পর্কে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, এরা মানুষকে আলো থেকে অন্ধকারে টেনে নেয়।

: ১৭৪
يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَكُمْ بُرْهَانٌ مِنْ رَبِّكُمْ وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكُمْ نُورًا مُبِينًا

হে লোকসকল! তোমাদের রবের কাছ থেকে তোমাদের কাছে প্রমাণ এসেছে [১] এবং আমরা তোমাদের প্রতি স্পষ্ট জ্যোতি [২] নাযিল করেছি।

ফুটনোট

[১] ‘বুরহান’ শব্দের আভিধানিক অর্থ অকাট্য দলীল-প্রমাণ। এ আয়াতে এর দ্বারা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সত্তা ও মহান ব্যক্তিত্বকে বুঝানো হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহান ব্যক্তিত্বের জন্য ‘বুরহান’ শব্দ প্রয়োগ করার তাৎপর্য এই যে, তার বরকতময় সত্তা, অনুপম চরিত্র মাধুর্য, অপূর্ব মু’জিযাসমূহ, তার প্রতি বিস্ময়কর কিতাব আল-কুরআন নাযিল হওয়া ইত্যাদি তার রেসালাতের অকাট্য দলীল ও প্রকৃষ্ট প্রমাণ। যার পরে আর কোন সাক্ষ্য প্রমাণের আবশ্যক হয় না। অতএব, তার মহান ব্যক্তিত্বই তার সত্যতার অকাট্য প্রমাণ।

[২] আলোচ্য আয়াতে (نُوْر) (নূর) শব্দ দ্বারা কুরআন মাজীদকে বোঝানো হয়েছে। যেমন, সূরা আল-মায়েদার ১৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে,

(قَدْ جَاءَكُمْ مِّنَ اللّٰهِ نُوْرٌ وَّكِتٰبٌ مُّبِيْنٌ)

অর্থাৎ তোমাদের কাছে আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে এক উজ্জ্বল আলো তথা এক প্রকৃষ্ট কিতাব অর্থাৎ আল-কুরআন এসেছে। আবার নুর অর্থ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং আল-কুরআনও হতে পারে। তখন এর অর্থ হবে, হেদায়াতের নূর। যে আলোর ছোয়া লাগলে মানুষের হিদায়াত নসীব হয়। তবে তার অর্থ এই নয় যে, রাসূল স ল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানবীয় দৈহিকতা থেকে মুক্ত শুধু নূর ছিলেন, যেমনটি কোন কোন ভ্ৰষ্ট সম্প্রদায় বিশ্বাস করে থাকে।

: ১৫
يَا أَهْلَ الْكِتَابِ قَدْ جَاءَكُمْ رَسُولُنَا يُبَيِّنُ لَكُمْ كَثِيرًا مِمَّا كُنْتُمْ تُخْفُونَ مِنَ الْكِتَابِ وَيَعْفُو عَنْ كَثِيرٍ ۚ قَدْ جَاءَكُمْ مِنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُبِينٌ

হে কিতাবীরা! আমাদের রাসূল তোমাদের নিকট এসেছেন [১], তোমরা কিতাবের যা গোপন করতে তিনি সে সবের অনেক কিছু তোমাদের নিকট প্রকাশ করছেন এবং অনেক কিছু ছেড়ে দিচ্ছেন। অবশ্যই আল্লাহর নিকট থেকে এক জ্যোতি ও স্পষ্ট কিতাব তোমাদের কাছে এসেছে [২]।

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনি তাদের মধ্যকার মতভেদপূর্ণ বিষয়ে সঠিক পথ বলে দেবার পাশাপাশি তারা যে সমস্ত বিষয় গোপন করেছে সেগুলোর অনেকটাই প্রকাশ করে দেন। [ইবন কাসীর] ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, যে ব্যক্তি ‘রাজম’ তথা বিবাহিত ব্যভিচারীকে পাথর মেরে হত্যার কথা অস্বীকার করবে, সে কুরআনের সাথে এমনভাবে কুফরী করল যে সে তা বুঝতেই পারছে না। আল্লাহ্ তা’আলার বাণী, ‘হে কিতাবীরা আমাদের রাসূল তোমাদের নিকট এসেছেন, তোমরা কিতাবের যা গোপন করতে তিনি সে সবের অনেক কিছু তোমাদের নিকট প্রকাশ করছেন’। তারা যে সমস্ত জিনিস গোপন করেছিল, রজমের বিধান ছিল তার একটি। [মুস্তাদরাকে হাকিম: ৪/৩৫৯]

[২] এ আয়াতে উল্লিখিত ‘নুর’ সম্পর্কে আলেমদের বিভিন্ন মন্তব্য রয়েছে। যা মূলত পরস্পর সম্পূরক, বিপরীত নয়। কারও কারও মতে, এখানে ‘নূর’ দ্বারা উদ্দেশ্য, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম। কারও কারও মতে, কিতাব বা কুরআন। বস্তুত রাসূল ও কিতাব একটি অপরটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই রাসূল ও কিতাব উভয় ক্ষেত্রেই ‘নুর’ বিশেষণ ব্যবহার হয়। এখানে নূর দ্বারা উদ্দেশ্য, ইসলামের দিকে আহবানকারী রাসূল, ইসলামের বিধানসম্বলিত কিতাব, অথবা রাসূল ও কিতাব উভয়ই । আল্লাহ্ তা'আলা কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় রাসূল ও কিতাব উভয়কে নূর বিশেষণে বিশেষিত করেছেন। যেমন সূরা আহযাবের ৪৫-৪৬ নং আয়াতে ‘নূর’ ধাতু থেকে উদগত কর্তাবাচক বিশেষ্য ‘মুনীর’ শব্দ দ্বারা রাসূলকে বিশেষিত করা হয়েছে। আবার একাধিক জায়গায় আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর কিতাব কুরআনকে ‘নূর’ দ্বারা বিশেষিত করেছেন। যেমন, সূরা আশ-শূরাঃ ৫২; সূরা আল-আ’রাফ: ১৫৭; সূরা আত-তাগাবুন: ৮; সূরা আন-নিসা: ১৭৪৷

এসব জায়গায় ‘নূর’ দ্বারা আল্লাহ তা’আলা তাঁর অহী তথা শুধু কুরআনুল কারীমকে বুঝিয়েছেন। অন্যত্র অনুরূপভাবে অন্যান্য নবীদের উপর নাযিলকৃত কিতাবকেও তিনি ‘নুর’ আখ্যা দিয়েছেন। যেমন, সূরা আল-আন’আমঃ ৯১; সূরা আল-মায়িদাহ ৪৪, ৪৬।

কুরআনের এসব আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আসমান থেকে নাযিলকৃত আল্লাহর সকল কিতাবই ‘নূর’। লক্ষণীয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য যেরূপ ‘নুর’ শব্দের কর্তাবাচক শব্দ ‘মুনীর’ বিশেষণ ব্যবহার করা হয়েছে, অনুরূপ বিশেষণ আল্লাহ্ তা'আলা কুরআনের জন্য ব্যবহার করেছেন। যেমন, সূরা আলে-ইমরান ১৮৫।
এ থেকে বুঝা যায় যে, রাসূল, নাযিলকৃত অহী এবং সকল আসমানী কিতাব ‘নূর’; যা বান্দাদের প্রতি তাদের রবের পক্ষ থেকে আগমন করেছে, এর মাধ্যমে আল্লাহ তাকেই হিদায়াত করেন, যে তার সন্তুষ্টির অনুসরণ করে, অর্থাৎ তার মনোনীত দ্বীনের আলোকে চলে। কুরআনের অন্যত্র এ ঘোষণা এসেছে, যেমন সূরা আল-মায়িদাহ ৩; সূরা আয-যুমার: ২২; সূরা আল-আনআমঃ ১২২৷
অতএব এ ‘নূর’ হচ্ছে অহীর নূর। এর মাধ্যমে বান্দা তার রবের ইবাদাত সম্পর্কে দিকনির্দেশনা লাভ করে। মানুষের সাথে সম্পর্কের নীতিমালা অর্জন করে। এ নূরই তার সঙ্গীতে পরিণত হয় এবং পথহারা অবস্থায় এ নুর দ্বারাই সে পথের সঠিক দিশা লাভ করে। মোদ্দাকথাঃ নূর অর্থ অহী, এ অহী যেহেতু রাসূলের উপর নাযিল হয়েছে, তাই কখনো তাকে নূর হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে, কখনো কুরআনকে, কখনো তাওরাত ও ইঞ্জিলকে। অতএব আয়াতের অর্থ হচ্ছে, তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে অহী সম্বলিত রাসূল ও স্পষ্ট কিতাব আগমন করেছে।

: ১৬
يَهْدِي بِهِ اللَّهُ مَنِ اتَّبَعَ رِضْوَانَهُ سُبُلَ السَّلَامِ وَيُخْرِجُهُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ بِإِذْنِهِ وَيَهْدِيهِمْ إِلَىٰ صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ

যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির অনুসরণ করে, এ দ্বারা তিনি তাদেরকে শান্তির পথে পারিচালিত করেন [১] এবং তাদেরকে নিজ অনুমতিক্রমে অন্ধকার হতে বের করে আলোর দিকে নিয়ে যান। আর তাদেরকে সরল পথের দিশা দেন।

ফুটনোট

[১] সুদ্দী বলেন, শান্তির পথ হচ্ছে, আল্লাহর পথ যা তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য প্রবর্তন করেছেন এবং সেদিকে আহবান করেছেন। আর যা নিয়ে তিনি তাঁর রাসূলদেরকে পাঠিয়েছেন। সেটিই হচ্ছে, ইসলাম। কোন মানুষ থেকে তিনি এটা ব্যতীত আর কোন আমল গ্রহণ করবেন না। ইয়াহুদীবাদও নয়, খ্রিষ্টবাদও নয়, মাজুসীবাদও নয়। [তাবারী]

: ৪৬
وَقَفَّيْنَا عَلَىٰ آثَارِهِمْ بِعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ التَّوْرَاةِ ۖ وَآتَيْنَاهُ الْإِنْجِيلَ فِيهِ هُدًى وَنُورٌ وَمُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ التَّوْرَاةِ وَهُدًى وَمَوْعِظَةً لِلْمُتَّقِينَ

আর আমরা তাদের পশ্চাতে মারইয়াম-পুত্র ‘ঈসাকে [১] পাঠিয়েছিলাম, তার সামনে তাওরাত থেকে যা বিদ্যমান রয়েছে তার সত্যতা প্রতিপন্নকারীরূপে। আর আমরা তাকে ইঞ্জীল দিয়েছিলাম, এতে রয়েছে হেদায়াত ও আলো; আর তা ছিল তার সামনে অবশিষ্ট তাওরাতের সত্যতা প্রতিপন্নকারী এবং মুত্তাকীদের জন্য হেদায়াত ও উপদেশস্বরূপ।

ফুটনোট

[১] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ “আমি মারইয়াম-পুত্র ঈসার সবচেয়ে বেশী নিকটতম। নবীগণ একে অন্যের বৈমাত্রেয় ভাই; আমার এবং তার মধ্যে কোন নবী নেই।” [বুখারীঃ ৩৪৪২]

:
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَجَعَلَ الظُّلُمَاتِ وَالنُّورَ ۖ ثُمَّ الَّذِينَ كَفَرُوا بِرَبِّهِمْ يَعْدِلُونَ

সকল প্রশংসা আল্লাহ্‌রই [১] যিনি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন,আর সৃষ্টি করেছেন অন্ধকার ও আলো [২]। এরপরও কাফেরগণ তাদের রব-এর সমকক্ষ দাঁড় করায় [৩]

ফুটনোট

সূরা সংক্রান্ত আলোচনাঃ

আয়াত সংখ্যাঃ ১৬৫ ৷

নামকরণঃ এ সূরারই ১৩৬, ১৩৯ ও ১৪২ নং আয়াতসমূহে উল্লেখিত “আল-আন’আম” শব্দ থেকে এ সূরার নামকরণ করা হয়েছে। আল-আন’আম শব্দের অর্থঃ গবাদি পশু।

সূরা নাযিলের প্রেক্ষাপটঃ

এ সূরা মক্কী সূরা বলেই প্রসিদ্ধ। কুরআনের ধারাবাহিকতা অনুসারে এটাই প্রথম মক্কী সূরা। এ সূরার মৌলিক আলোচ্য বিষয় হচ্ছে, তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত। মুফাসসিরগণের মধ্যে মুজাহিদ, কালবী, কাতাদাহ প্রমূখও প্রায় এ কথাই বলেন। আবু ইসহাক ইসফিরায়িনী বলেন, এ সূরাটিতে তাওহীদের সমস্ত মূলনীতি ও পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে। [কুরতুবী, আত-তাফসীরুল মুনীর]

সূরার ফযিলতঃ

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেনঃ সূরা আল-আন’আমের একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, কয়েকখানি আয়াত বাদে গোটা সূরাটিই একযোগে মক্কায় নাযিল হয়েছে। জাবের, ইবন আব্বাস, আনাস ও ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহুম বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর সূরা আল-আন’আম নাযিল হচ্ছিল, তখন এত ফিরিশ্‌তা তার সাথে অবতরণ করেছিলেন যে, তাতে আকাশের প্রান্তদেশ ছেয়ে যায়। [ মুস্তাদরাকে হাকিম: ২/২৭০; ২৪৩১]

উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, সূরা আল-আন’আম কুরআনের উৎকৃষ্ট অংশের অন্তর্গত। [সুনান দারমী ২/৫৪৫; ৩৪০১]

-------------------

[১] এ সূরাটিকে " (اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ) বাক্য দ্বারা আরম্ভ করা হয়েছে। এতে খবর দেয়া হয়েছে যে, সর্ববিধ প্রশংসা আল্লাহর জন্য। এ খবরের উদ্দেশ্য মানুষকে প্রশংসা শিক্ষা দেয়া। যেন বলা হচ্ছে, হে মানুষ! তোমরা তাঁর জন্যই যাবতীয় হামদ ও শোকর নির্দিষ্ট কর, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, আরও সৃষ্টি করেছেন আসমান ও যমীন। তাঁর সাথে কাউকেও সামান্যতম অংশীদারও করবে না। এ বিশেষ পদ্ধতি শিক্ষাদানের মধ্যে এদিকেও ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, পরিপূর্ণ হামদ বা প্রশংসা একমাত্র তাঁরই, যার কোন শরীক নেই। তাকে ব্যতীত আর যে সমস্ত উপাস্যের ইবাদাত করা হয়, তারা এ হামদ প্রাপ্য নয়। [তাবারী] সুতরাং কেউ প্রশংসা করুক বা না করুক, তিনি স্বীয় ওজুদ বা সত্তার পরাকাষ্ঠার দিক দিয়ে নিজেই প্রশংসনীয়। এ বাক্যের পর আসমান ও যমীন এবং অন্ধকার ও আলো সৃষ্টি করার কথা উল্লেখ করে তার প্রশংসনীয় হওয়ার প্রমাণও ব্যক্ত করা হয়েছে যে, যে সত্তা এহেন মহান শক্তি-সামর্থ্য ও বিজ্ঞবান, তিনিই হামদ বা প্রশংসার যোগ্য হতে পারেন। কাতাদা বলেন, এ আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, আল্লাহ তা'আলা আসমানকে যমীনের পূর্বে, অন্ধকারকে আলোর পূর্বে এবং জান্নাতকে জাহান্নামের পূর্বে সৃষ্টি করেছেন। [তাবারী]

[২] এ আয়াতে (سماوات) শব্দটিকে বহুবচনে এবং (ارض) শব্দটিকে একবচনে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও অন্য এক আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আসমানের ন্যায় যমীনও সাতটি। [যেমন, সূরা আত-তালাক: ১২] এমনিভাবে (ظلمات) শব্দটিকে বহুবচনে এবং (نور) শব্দটিকে একবচনে উল্লেখ করার মাঝে ইঙ্গিত রয়েছে যে, (نور) বলে বিশুদ্ধ সরল পথ ব্যক্ত করা হয়েছে এবং তা মাত্র একটিই। আর (ظلمات) বলে ভ্রান্ত পথ ব্যক্ত করা হয়েছে, যা অসংখ্য। তাছাড়া (نور) বা আলো (ظلمات) বা অন্ধকার থেকে উত্তম [বাহরে মুহীত; ইবন কাসীর]

[৩] আলোচ্য আয়াতের উদ্দেশ্য একত্ববাদের স্বরূপ ও সুস্পষ্ট প্রমাণ বর্ণনা করে জগতের ঐসব জাতিকে হুশিয়ার করা যারা মূলতঃ একত্ববাদে বিশ্বাসী নয় কিংবা বিশ্বাসী হওয়া সত্বেও একত্ববাদের তাৎপর্যকে পরিত্যাগ করে বসেছে। অগ্নি উপাসকদের মতে জগতের স্রষ্টা দু’জন - ইয়াৰ্যদান ও আহরামান। তারা ইয়াৰ্যদানকে মঙ্গলের স্রষ্টা এবং আহরামানকে অমঙ্গলের স্রষ্টা বলে বিশ্বাস করে। এ দুটিকেই তারা অন্ধকার ও আলো বলে ব্যক্ত করে। এমনিভাবে নাসারারা একত্ববাদে বিশ্বাসী হওয়ার সাথে সাথে ঈসা আলাইহিস সালাম ও তাঁর মাতা মারইয়াম আলাইহাস সালাম-কে আল্লাহ তা'আলার অংশীদার সাব্যস্ত করেছে। এরপর একত্ববাদের বিশ্বাসকে টিকিয়ে রাখার জন্য তারা ‘একে তিন’ এবং ‘তিনে এক’ এর অযৌক্তিক মতবাদের আশ্রয় নিয়েছে। আরবের মুশরিকরা প্রতিটি পাহাড়ের প্রতিটি বড় পাথরকেও তাদের উপাস্য বানিয়েছে। [আল-মানার] মোটকথা, যে মানবকে আল্লাহ্ তা'আলা আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা করেছিলেন, তারা যখন পথভ্রষ্ট হল, তখন চন্দ্র, সূর্য, তারকারাজি, আকাশ, পানি, বৃক্ষলতা এমনকি পোকা-মাকড়কেও সিজদার যোগ্য উপাস্য, রুযীদাতা ও বিপদ বিদূরণকারী সাব্যস্ত করে নিল। কুরআনুল কারীমের আলোচ্য আয়াত আল্লাহ তা'আলাকে যমীন ও আসমানের স্রষ্টা এবং অন্ধকার ও আলোর উদ্ভাবক বলে উপরোক্ত সব ভ্রান্ত বিশ্বাসের মূলোৎপাটন করেছে। কেননা, অন্ধকার ও আলো, আসমান ও যমীন এবং এতে উৎপন্ন যাবতীয় বস্তু আল্লাহ্ তা'আলার সৃষ্ট। অতএব, এগুলোকে কেমন করে আল্লাহ্ তা'আলার অংশীদার করা যায়? যিনি সৃষ্টি করেন তিনি কি যারা সৃষ্টি করতে পারে না তাদের মত? সুতরাং কিভাবে ইবাদাতে ও সম্মানে তাঁর সমকক্ষ কাউকে দাঁড় করানো যায়? [ ইবন কাসীর, ফাতহুল কাদীর]।

: ১২২
أَوَمَنْ كَانَ مَيْتًا فَأَحْيَيْنَاهُ وَجَعَلْنَا لَهُ نُورًا يَمْشِي بِهِ فِي النَّاسِ كَمَنْ مَثَلُهُ فِي الظُّلُمَاتِ لَيْسَ بِخَارِجٍ مِنْهَا ۚ كَذَٰلِكَ زُيِّنَ لِلْكَافِرِينَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ

যে ব্যাক্তি মৃত ছিল, যাকে আমরা পরে জীবিত করেছি এবং যাকে মানুষের মধ্যে চলার জন্য আলোক দিয়েছি , সে ব্যাক্তি কি ঐ ব্যাক্তির ন্যার যে অন্ধকারে রয়েছে এবং সেখান থেকে আর বের হবার নয়? এভাবেই কাফেরদের জন্য তাদের কাজগুলোকে শোভন করে দেয়া হয়েছে।

ফুটনোট

পনরতম রুকূ’

: ৯১
وَمَا قَدَرُوا اللَّهَ حَقَّ قَدْرِهِ إِذْ قَالُوا مَا أَنْزَلَ اللَّهُ عَلَىٰ بَشَرٍ مِنْ شَيْءٍ ۗ قُلْ مَنْ أَنْزَلَ الْكِتَابَ الَّذِي جَاءَ بِهِ مُوسَىٰ نُورًا وَهُدًى لِلنَّاسِ ۖ تَجْعَلُونَهُ قَرَاطِيسَ تُبْدُونَهَا وَتُخْفُونَ كَثِيرًا ۖ وَعُلِّمْتُمْ مَا لَمْ تَعْلَمُوا أَنْتُمْ وَلَا آبَاؤُكُمْ ۖ قُلِ اللَّهُ ۖ ثُمَّ ذَرْهُمْ فِي خَوْضِهِمْ يَلْعَبُونَ

আর তারা আল্লাহকে তাঁর যথার্থ মর্যাদা দেয়নি,যখন তারা বলে, ‘আল্লাহ্‌ কোন মানুষের উপর কিছুই নাযিল করেননি [১]।বলুন ‘ কে নাযিল করেছে মূসার আনীত কিতাব যা মানুষের জন্য আলো ও হিদায়াতস্বরূপ, যা তোমারা বিভিন্ন পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ করে কিছু প্রকাশ কর ও অনেকাংশ গোপন রাখ এবং যা তোমাদের পিতৃপুরুষগণ ও তোমারা জানতে না তাও তোমাদেরকে শিক্ষা দেয়া হয়েছিলো ?’ বলুন , আল্লাহ্‌ই ; অতঃপর তাদেরকে তাদের আযাচিত সমালোচনার উপর ছেড়ে দিন,তারা খেলা করতে থাকুক। [২]।

ফুটনোট

এগারতম রুকূ’

[১] এ আয়াতে ঐসব লোকের জবাব দেয়া হয়েছে, যারা বলেছিল, আল্লাহ তা'আলা কোন মানুষের প্রতি কখনো কোন গ্রন্থ নাযিলই করেননি, গ্রন্থ ও রাসূলদের ব্যাপারটি মূলতঃ ভিত্তিহীন। কোন কোন মুফাসসিরের মতে, এটি মূর্তিপূজারী কুরাইশদের উক্তি [ইবন কাসীর]। ইবন জারীর তাবারী এ মতকে প্রাধান্য দিয়েছেন। [তাবার] কেননা, তারা কোন গ্রন্থ ও নবীর প্রবক্তা কোন কালেই ছিল না। অন্যান্য মুফাসসিরদের মতে এটি ইয়াহুদীদের উক্তি। আয়াতের বর্ণনা পরম্পরা বাহ্যতঃ এরই সমর্থন করে। এমতাবস্থায় তাদের এ উক্তি ছিল ক্রোধ ও বিরক্তির বহিঃপ্রকাশ, যা স্বয়ং তাদেরও দ্বীনের পরিপন্থী ছিল। [বাগভী] যদি আয়াতে বর্ণিত লোকেরা ইয়াহুদী হয়, তবে এতে আল্লাহ্ তাআলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বলেছেন, যারা এমন বাজে কথা বলেছে, তারা যথোপযুক্তভাবে আল্লাহ্ তা'আলাকে চিনে নি। নতুবা এরূপ ধৃষ্টতাপূর্ণ উক্তি তাদের মুখ থেকে বেরই হত না। যারা সর্বাবস্থায় আসমানী গ্রন্থকে অস্বীকার করে, আপনি তাদেরকে বলে দিন, আল্লাহ তা'আলা কোন মানুষের কাছে যদি গ্রন্থ প্রেরণ না-ই করে থাকেন, তবে যে তাওরাত তোমরা স্বীকার কর, সে তাওরাত কে নাযিল করেছে? তাওরাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পরিচয় ও গুণাবলী সম্পর্কিত কিছু আয়াত ছিল। ইয়াহুদীরা সেগুলো তাওরাত থেকে উধাও করে দিয়েছিল। [তাবারী, বাগভী, মুয়াসসার]।

[২] অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা কোন কিতাব নাযিল না করে থাকলে তাওরাত কে নাযিল করেছে? এ প্রশ্নের উত্তর তারা কি দেবে; আপনিই বলে দিন, আল্লাহ তা'আলাই নাযিল করেছেন। [বাগভী] যখন তাদের বিরুদ্ধে যুক্তি পূর্ণ হয়ে গেছে, তখন আপনার কাজও শেষ হয়ে গেছে। এখন তারা যে ক্রীড়া-কৌতুকে ডুবে আছে, তাতেই তাদেরকে থাকতে দিন।

: ১৫৭
الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ الرَّسُولَ النَّبِيَّ الْأُمِّيَّ الَّذِي يَجِدُونَهُ مَكْتُوبًا عِنْدَهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيلِ يَأْمُرُهُمْ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَاهُمْ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ وَيَضَعُ عَنْهُمْ إِصْرَهُمْ وَالْأَغْلَالَ الَّتِي كَانَتْ عَلَيْهِمْ ۚ فَالَّذِينَ آمَنُوا بِهِ وَعَزَّرُوهُ وَنَصَرُوهُ وَاتَّبَعُوا النُّورَ الَّذِي أُنْزِلَ مَعَهُ ۙ أُولَٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ

‘যারা অনুসরণ করে রাসূলের , উম্মী [১] নবীর , যার উল্লেখ তারা তাদের কাছে তাওরাত ও ইঞ্জীলে লিপিবদ্ধ পায় [২], যিনি তাদের সৎকাজের আদেশ দেন, অসৎকাজ থেকে নিষেধ করেন, তাদের জন্য পবিত্র বস্তু হারাম করেন [৩]। আর তাদেরকে তাদের গুরুভার ও শৃংখল হতে মুক্ত করেন যা তাদের উপর ছিল [৪]।কাজেই যারা তার প্রতি ঈমান আনে , তাকে সম্মান করে, তাকে সাহায্য করে এবং যে নূর তার সাথে নাযিল হয়েছে সেটার অনুসরণ করে , তারাই সফলকাম [৫]।

ফুটনোট

[১] আলোচ্য আয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দু'টি পদবী ‘রাসূল’ ও ‘নবী’ এবং এর সাথে সাথে তৃতীয় একটি বৈশিষ্ট্য ‘উম্মী'-এরও উল্লেখ করা হয়েছে। ইবন আব্বাস বলেন, (اُمِّيْ) উম্মী' শব্দের অর্থ হল নিরক্ষর। যে লেখা-পড়া কোনটাই জানে না। [বাগভী] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও বলেছেন, “আমরা নিরক্ষর জাতি। লিখা জানি না, হিসাব জানি না”। [বুখারী: ১০৮০] সাধারণ আরবদেরকে এ কারণেই কুরআন (اُمِّيِّيْنَ) বা নিরক্ষর জাতি বলে অভিহিত করেছে যে, তাদের মধ্যে লেখা-পড়ার প্রচলন খুবই কম ছিল। কারও কারও মতে উম্মী শব্দটি ‘উম্ম’ শব্দের দিকে সম্পর্কযুক্ত করে বলা হয়েছে। আর উম্ম অর্থ, মা ! অর্থাৎ সে তার মা তাকে যেভাবে প্রসব করেছে সেভাবে রয়ে গেছে। কারও কারও মতে শব্দটি উম্মত শব্দের দিকে সম্পর্কযুক্ত করে বলা হয়েছে। পরে সম্পর্ক করার নিয়মানুসারে তা বর্ণটি পড়ে গেছে। তখন অর্থ হবে, উম্মতওয়ালা নবী। কারও কারও মতে, শব্দটি উম্মুল কুরা’ যা মক্কার এক নাম, সেদিকে সম্বন্ধযুক্ত করে বলা হয়েছে। অর্থাৎ মক্কাবাসী। [বাগভী]

তবে বিখ্যাত মত হচ্ছে যে, উম্মী অর্থ নিরক্ষর। যদিও নিরক্ষর হওয়াটা কোন মানুষের জন্য প্রশংসনীয় গুণ নয়; বরং ক্রটি হিসাবেই গণ্য। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জ্ঞান-গরিমা, তত্ত্ব ও তথ্য অবগতি এবং অন্যান্য গুণবৈশিষ্ট্য ও পরাকাষ্ঠা সত্ত্বেও উম্মী হওয়া তার পক্ষে বিরাট গুণ ও পরিপূর্ণতায় পরিণত হয়েছে। কারণ, শিক্ষাগত, কার্যগত ও নৈতিক পরাকাষ্ঠী যদি কোন লেখাপড়া জানা মানুষের দ্বারা প্রকাশ পায়, তাহলে তা হয়ে থাকে তার সে লেখাপড়ারই ফলশ্রুতি, কিন্তু কোন একান্ত নিরক্ষর ব্যক্তির দ্বারা এমন অসাধারণ, অভূতপূর্ব ও অনন্য তত্ত্ব-তথ্য ও সূক্ষ্ম বিষয় প্রকাশ পেলে, তা তার প্রকৃষ্ট মু'জিযা ছাড়া আর কি হতে পারে?

[২] মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যেসব গুণবৈশিষ্ট্য তাওরাত ও ইঞ্জীলে লিপিবদ্ধ ছিল সেগুলোর কিছু আলোচনা তাওরাত ও ইঞ্জীলের উদ্ধৃতি সাপেক্ষে কুরআনুল কারমেও করা হয়েছে। আর কিছু সে সমস্ত মনীষীবৃন্দের উদ্ধৃতিতে হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে, যারা তাওরাত ও ইঞ্জীলের আসল সংকলন স্বচক্ষে দেখেছেন এবং তাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আলোচনা নিজে পড়েই মুসলিম হয়েছেন। যেমন, কোন এক ইয়াহুদী বালক নবী কারম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমত করত। হঠাৎ সে একবার অসুস্থ হয়ে পড়লে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার অবস্থা জানার জন্য সেখানে গেলেন। তিনি দেখলেন, তার পিতা তার মাথার কাছে দাড়িয়ে তাওরাত তিলাওয়াত করছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ হে ইয়াহুদী, আমি তোমাকে কসম দিচ্ছি সে মহান সত্তার যিনি মূসা আলাইহিস সালামের প্রতি তাওরাত নাযিল করেছেন, তুমি কি তাওরাতে আমার অবস্থা ও গুণবৈশিষ্ট্য এবং আবির্ভাব সম্পর্কে কোন বর্ণনা পেয়েছ? সে অস্বীকার করল। তখন তার ছেলে বললঃ হে আল্লাহর রাসূল! তিনি (অর্থাৎ এই ছেলের পিতা) ভুল বলছেন। তাওরাতে আমরা আপনার আলোচনা এবং আপনার গুণবৈশিষ্ট্য দেখতে পাই। আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন হক মা'বূদ নাই এবং আপনি তার প্রেরিত রাসূল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে নির্দেশ দিলেন যে, এখন এ বালক মুসলিম। তার মৃত্যুর পর তার কাফন-দাফন মুসলিমরা করবে। তার পিতার হাতে দেয়া হবে না। [মুসনাদে আহমাদঃ ৫/৪১১] অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, এক ইয়াহুদী ইসলাম গ্রহণ করার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সে সবগুণ বর্ণনা করেছে যা সে তাওরাতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে দেখেছে। তিনি বলেন, আমি আপনার সম্পর্কে তাওরাতে এ কথাগুলো পড়েছি- “মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহ্‌, তার জন্ম হবে মক্কায়, তিনি হিজরত করবেন ‘তাইবার দিকে; আর তার দেশ হবে সিরিয়া। তিনি কঠোর মেজাজের হবেন না, কঠোর ভাষায় তিনি কথাও বলবেন না, হাটে-বাজারে তিনি হট্টগোলও করবেন না। “অশ্লীলতা ও নির্লজ্জতা থেকে তিনি দূরে থাকবেন " [মুস্তাদরাকঃ ২/৬৭৮ হাদীসঃ ৪২৪২]

কা’আবে আহবার বলেছেনঃ তাওরাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে লেখা রয়েছেঃ “মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল ও নির্বাচিত বান্দা। তিনি না কঠোর মেজাজের লোক, না বাজে বক্তা। না-ইবা তিনি হাটে-বাজারে হট্টগোল করার লোক। তিনি মন্দের প্রতিশোধ মন্দ দ্বারা গ্রহণ করেন না; বরং ক্ষমা করে দেন এবং ছেড়ে দেন। তার জন্ম হবে মক্কায়, আর হিজরত হবে তাইবায়। তার দেশ হবে শাম (সিরিয়া)। আর তার উম্মাত হবে ‘হাম্মদীন’। অর্থাৎ আনন্দবেদনা উভয় অবস্থাতেই আল্লাহ্ তা'আলার প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী। তারা যে কোন উর্ধ্বারোহণকালে তাকবীর বলবে। তারা সূর্যের ছায়ার প্রতি লক্ষ্য রাখবে, যাতে সময় নির্ণয় করে যথাসময়ে সালাত আদায় করতে পারে। তিনি তার শরীরের নিমাংশে লুঙ্গি পরবেন এবং হস্ত-পদাদি ওযুর মাধ্যমে পবিত্র-পরিচ্ছন্ন রাখবেন। তাদের আযানদাতা আকাশে সুউচ্চ স্বরে আহবান করবেন। জিহাদের ময়দানে তাদের সারিগুলো এমন হবে যেমন সালাতে হয়ে থাকে। রাতের বেলায় তাদের তিলাওয়াত ও যিকরের শব্দ এমনভাবে উঠতে থাকবে, যেন মধুমক্ষিকার শব্দ। [সুনান দারামীঃ ৫, ৮, ৯]

ইবন সা’আদ রাহিমাহুল্লাহ সাহাল মওলা খাইসামা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে সনদ সহকারে উদ্ধৃত করেছেন যে, সাহাল বলেনঃ আমি নিজে ইঞ্জলে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গুণ-বৈশিষ্ট্যসমূহ পড়েছি যে- তিনি খুব বেঁটেও হবেন না আবার খুব লম্বাও হবেন না। উজ্জ্বল বর্ণ ও দু'টি কেশ-গুচ্ছধারী হবেন। তার দু’কাঁধের মধ্যস্থলে নবুওয়াতের মোহর থাকবে। তিনি সদকা গ্রহণ করবেন না। গাধা ও উটের উপর সওয়ারী করবেন। ছাগলের দুধ নিজে দুইয়ে নেবেন। তিনি ইসমাঈল আলাইহিস সালামের বংশধর হবেন। তার নাম হবে আহমাদ। [তাবাকাত ইবন সা’আদঃ১/৩৬৩]

আতা ইবন ইয়াসার বলেনঃ আমি আব্দুল্লাহ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা কে বললাম, আমাকে তাওরাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গুণাগুণ কেমন এসেছে তা বর্ণনা করুন, তিনি বললেনঃ "তাওরাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছেঃ “হে নবী, আমি আপনাকে সমস্ত উম্মতের জন্য সাক্ষী, সৎকর্মশীলদের জন্য সুসংবাদদাতা, অসৎকর্মীদের জন্য ভীতি প্রদর্শনকারী এবং উম্মিয়ীন অর্থাৎ আরবদের জন্য রক্ষণা-বেক্ষণকারী বানিয়ে পাঠিয়েছি। আপনি আমার বান্দা ও রাসূল। আমি আপনার নাম মুতাওয়াক্কিল’ রেখেছি। আপনি কঠোর মেজাজও নন, দাঙ্গাবাজও নন। হাটে-বাজারে হট্টগোলকারীও নন। মন্দের প্রতিশোধ মন্দের দ্বারা গ্রহণ করেন না; বরং ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ তা'আলা ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে মৃত্যু দেবেন না; যতক্ষণ না তার মাধ্যমে বাঁকা জাতিকে সোজা করে নেবেন। এমনকি যতক্ষণ না তারা। (لَااِلٰهَ اِلَّااللّٰهُ) অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন মা'বূদ নেই" -এ কালেমার স্বীকৃতিদানকারী হয়ে যাবে, যতক্ষণ না অন্ধ চোখ খুলে দেবেন, বধির কান যতক্ষণ না শোনার যোগ্য বানাবেন এবং বদ্ধ হৃদয় যতক্ষণ না খুলে দেবেন। [বুখারী : ২১২৫; ৪৮৩৮] তাওরাত ও ইঞ্জীল বর্ণিত শেষনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার উম্মাতের গুণ-বৈশিষ্ট্য এবং নিদর্শনসমূহের বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা সম্পর্কে বহু স্বতন্ত্র গ্রন্থ প্রণয়ন করা হয়েছে। রহমতুল্লাহ কীরানভী মুহাজেরে মক্কী রাহিমাহুল্লাহ তার গ্রন্থ ‘ইযহারুল-হক’-এ বিষয়টিকে অত্যন্ত বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও গবেষণাসহ লিখেছেন। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বর্তমান যুগের তাওরাত ও ইঞ্জীলযাতে সীমাহীন বিকৃতি সাধিত হয়েছে-তাতেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বহু গুণাগুণ ও বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ রয়েছে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ তাওরাত ও ইনজীলের নিম্নোক্ত স্থানগুলো দেখুন- এসব স্থানে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যাপারে ইঙ্গিত করা হয়েছে। যেমন, দ্বিতীয় বিবরণ-১৮: ১৫-১৯, মথি-২১: ৩৩-৪৬, যোহন-১: ১৯-২১, ১৪: ১৫-১৭, ২৫-৩০, ১৫: ২৫-২৬, ১৬: ৭-১৫।

[৩] দ্বিতীয় গুণটি এই বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানবজাতির জন্য পবিত্র ও পছন্দনীয় বস্তু-সামগ্ৰী হালাল করবেন; আর পঙ্কিল বস্তুসামগ্রীকে হারাম করবেন। অর্থাৎ অনেক সাধারণ পছন্দনীয় বস্তুসামগ্রী যা শাস্তি স্বরূপ বনী-ইসরাঈলের জন্য হারাম করে দেয়া হয়েছিল, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেগুলোর উপর থেকে বিধি-নিষেধ প্রত্যাহার করে নেবেন। উদাহরণতঃ পশুর চর্বি বা মেদ প্রভৃতি যা বনী-ইসরাঈলের অসদাচরণের শাস্তি হিসাবে হারাম করে দেয়া হয়েছিল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেগুলোকে হালাল সাব্যস্ত করেছেন। আর নোংরা ও পঙ্কিল বস্তু-সামগ্রীর মধ্যে শুকরের মাংস, সুদ এবং যে সমস্ত খাবার আল্লাহ হারাম করেছেন অথচ তারা সেগুলোকে হালাল বলে চালিয়েছিল। [তাবারী] অনুরূপভাবে, রক্ত, মৃত পশু, মদ ও অন্যান্য হারাম জন্তু এর অন্তর্ভুক্ত এবং আল্লাহ হারাম উপায়ে আয় যথা- সুদ, ঘুষ, জুয়া প্রভৃতিও এর অন্তর্ভুক্ত।

[৪] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের তৃতীয় গুণ বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছেঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের উপর চেপে থাকা বোঝা ও প্রতিবন্ধকতাও সরিয়ে দেবেন। (اصر) ইসর’ শব্দের অর্থ এমন ভারী বোঝা যা নিয়ে মানুষ চলাফেরা করতে অক্ষম। আর (اغلال) ‘আগলাল’ (غل) এর বহুবচন ৷ ‘গালুন’ সে হাতকড়াকে বলা হয় যা দ্বারা অপরাধীর হাত তার ঘাড়ের সাথে বেঁধে দেয়া হয় এবং সে একেবারেই নিরুপায় হয়ে পড়ে। (اصر) ‘ইসর’ ও (اغلال) ‘আগলাল’ অর্থাৎ অসহনীয় চাপ ও আবদ্ধতা বলতে এ আয়াতে সে সমস্ত কঠিন ও সাধ্যাতীত কর্তব্যের বিধি-বিধানকে বুঝানো হয়েছে যা প্রকৃতপক্ষে ধর্মের উদ্দেশ্য ছিল না, কিন্তু বনীইসরাঈল সম্প্রদায়ের উপর একান্ত শাস্তি হিসাবে আরোপ করা হয়েছিল। যেমন, বিধর্মী কাফেরদের সাথে জিহাদ করে গনীমতের যে মাল পাওয়া যেত, তা বনীইসরাঈলদের জন্য হালাল ছিল না; বরং আকাশ থেকে একটি আগুন নেমে এসে সেগুলোকে জ্বলিয়ে দিত। শনিবার দিন শিকার করাও তাদের জন্য বৈধ ছিল না। এ সমস্ত কঠিন ও জটিল বিধানসমূহ যা বনী-ইসরাঈলদের উপর আরোপিত ছিল, কুরআনে সেগুলোকে ‘ইসর’ ও ‘আগলাল’ বলা হয়েছে এবং সুসংবাদ দেয়া হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসব কঠিন বিধি-বিধানের পরিবর্তন অর্থাৎ এগুলোকে রহিত করে তদস্থলে সহজ বিধি-বিধান প্রবর্তন করবেন। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ দ্বীন সহজ। [বুখারীঃ ৩৯] কুরাআনুল কারীমে বলা হয়েছে

(وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّيْنِ مِنْ حَرَجٍ)

আল্লাহ্‌ দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোন কঠোরতা আরোপ করেননি’ [সূরা আল-হাজ্জঃ ৭৮]

[৫] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশেষ ও পরিপূর্ণ গুণ-বৈশিষ্ট্যের আলোচনার পর বলা হয়েছেঃ তাওরাত ও ইঞ্জীলে আখেরী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রকৃষ্ট গুণ-বৈশিষ্ট্য ও লক্ষণাদি বাতলে দেয়ার পরিণতি এই যে, যারা আপনার প্রতি ঈমান আনবে এবং আপনার সহায়তা করবে আর সেই নূরের অনুসরণ করবে, যা আপনার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে -অর্থাৎ যারা কুরআনের অনুসরণ করবে, তারাই হল কল্যাণপ্রাপ্ত। এখানে কল্যাণ লাভের জন্য চারটি শর্ত আরোপ করা হয়েছে। প্রথমতঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ঈমান আনা, দ্বিতীয়তঃ তার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান করা, তৃতীয়তঃ তার সাহায্য ও সহায়তা করা এবং চতুর্থতঃ কুরআন অনুযায়ী চলা। শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন বুঝাবার জন্য (وَعَزَّرُوْهُ) ‘আযযারূহু' শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে যা (تعزير) থেকে উদ্ভুত। ‘তাষীর’ অর্থ সস্নেহে বারণ করা ও রক্ষা করা। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু (وَعَزَّرُوْهُ) ‘আযযারূহু" -এর অর্থ করেছেন শ্রদ্ধা ও সম্মান করা। অর্থাৎ রাসূল হিসাবে তার প্রতি ঈমান আনতে হবে, নির্দেশদাতা হিসাবে তার প্রতিটি নির্দেশের অনুসরণ করতে হবে, প্রিয়জন হিসাবে তার সাথে গভীরতম ভালবাসা রাখতে হবে এবং নবুওয়াতের ক্ষেত্রে যেহেতু তিনি পরিপূর্ণ, তাই তার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। অপর এক আয়াতেও বলা হয়েছে

(وَتُعَزِّرُوْهُ وَتُوَقِّرُوْهُ)

অর্থাৎ “তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন কর এবং তাকে পরিপূর্ণ মর্যাদা দান কর”। [সূরা আল-ফাতহঃ ৯] এছাড়া আরো কয়েকটি আয়াতে এই হেদায়াত দেয়া হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহর উপস্থিতিতে এত উচ্চস্বরে কথা বলো না, যা তার স্বর থেকে বেড়ে যেতে পারে। [দেখুন, সূরা হুজুরাতঃ ২] অন্য এক জায়গায় বলা হয়েছেঃ

(يٰٓاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا لَا تُـقَدِّمُوْا بَيْنَ يَدَيِ اللّٰهِ وَرَسُوْلِهٖ)


অর্থাৎ “হে ইমানদারগণ, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল থেকে এগিয়ে যেয়ো না”। অর্থাৎ যদি মজলিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপস্থিত থাকেন এবং তাতে কোন বিষয় উপস্থাপিত হয়, তাহলে তোমরা তার আগে কোন কথা বলো না। এ আয়াতের অর্থ করতে গিয়ে কোন কোন সাহাবী বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্বে কেউ কথা বলবে না এবং তিনি যখন কোন কথা বলেন, তখন সবাই তা নিশুপ বসে শুনবে। অনুরূপভাবে কুরআনের এক আয়াতে বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ডাকার সময় আদবের প্রতি লক্ষ্য রাখবে; এমনভাবে ডাকবে না; নিজেদের মধ্যে একে অপরকে যেভাবে ডেকে থাক। [দেখুন, সূরা হুজুরাতঃ ২] এ আয়াতে শেষে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে, এ নির্দেশের খেলাফ কোন অসম্মানজনক কাজ করা হলে সমস্ত সৎকর্ম ধ্বংস ও বরবাদ হয়ে যাবে। এ কারণেই সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম যদিও সর্বক্ষণ-সর্বাবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কর্মসঙ্গী ছিলেন এবং এমতাবস্থায় সম্মান ও আদবের প্রতি পরিপূর্ণ লক্ষ্য রাখা বড়ই কঠিন হয়ে থাকে; তবুও তাদের অবস্থা এই ছিল যে, এ আয়াতটি নাযিল হওয়ার পর আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল, যিনি আপনার উপর কিতাব নাযিল করেছেন তার শপথ করে বলছি, মৃত্যু পর্যন্ত আপনার সাথে এমনভাবে কথা বলব যেন কোন ভাইয়ের কাছে কেউ গোপন বিষয়ে বলে। [মুস্তাদরাকে হাকেমঃ ২/৪৬২] এমনি অবস্থা ছিল উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুরও দেখুন- বুখারীঃ ৪৮৪৫] আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপেক্ষা আমার কোন প্রিয় ব্যক্তি সারা বিশ্বে ছিল না। আর আমার এ অবস্থা ছিল যে, আমি তার প্রতি পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখতেও পারতাম না। আমার কাছে যদি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আকার-অবয়ব সম্পর্কে কেউ জানতে চায়, তাহলে তা বলতে আমি এজন্য অপারগ যে, আমি কখনো তার প্রতি পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়েও দেখিনি। [ মুসলিমঃ ১২১] উরওয়া ইবন মাসউদকে মক্কাবাসীরা গুপ্তচর বানিয়ে মুসলিমদের অবস্থা জানার জন্য মদীনায় পাঠাল। সে সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুমকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি এমন নিবেদিত প্রাণ দেখতে পেল যে, ফিরে গিয়ে রিপোর্ট দিল যে, আমি কিস্‌রা ও কায়সারের দরবারও দেখেছি এবং সম্রাট নাজ্জাশীর সাথেও সাক্ষাত করেছি, এমনটি আর কোথাও দেখিনি। আমার ধারণা, তোমরা কষ্মিনকালেও তাদের মোকাবেলায় জয়ী হতে পারবে না। [ সহীহ ইবনে হিব্বানঃ ১১/২১৬]

: ৩২
يُرِيدُونَ أَنْ يُطْفِئُوا نُورَ اللَّهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَيَأْبَى اللَّهُ إِلَّا أَنْ يُتِمَّ نُورَهُ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ

তারা তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহ্‌র নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়। কিন্তু আল্লাহ্‌ তাঁর নূর পরিপূর্ণ করা ছাড়া কিছু করতে অস্বীকার করেছেন। যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে [১]।

ফুটনোট

[১] এ আয়াতে বলা হয় যে, তারা গোমরাহী করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না বরং আল্লাহর সত্য দ্বীনকে নিশ্চিহ্ন করারও ব্যর্থ প্রয়াস চালাচ্ছে। তারা দ্বীনের এ আলো, হিদায়াতের এ জ্যোতি, তাওহীদের এ আহবানকে শুধুমাত্র তাদের কথা, ঝগড়া ও মিথ্যাচার দিয়ে মিটিয়ে দিতে চায়। আয়াতে উপমা দিয়ে বলা হচ্ছে যে, এরা মুখের ফুৎকার দিয়ে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়। অথচ এটি তাদের জন্যে অসম্ভব, যেভাবে সূর্যের আলো বা চাঁদের আলোকে কেউ ফুৎকারে মিটিয়ে দিতে পারে না। বরং আল্লাহর অমোঘ ফয়সালা যে, তিনি নিজের নূর তথা দ্বীন ইসলামকে পূর্ণরূপে উদ্ভাসিত করবেন, তা কাফের ও মুশরিকদের যতই মর্মপীড়ার কারণ হোক না কেন? [ইবন কাসীর]

১০ :
هُوَ الَّذِي جَعَلَ الشَّمْسَ ضِيَاءً وَالْقَمَرَ نُورًا وَقَدَّرَهُ مَنَازِلَ لِتَعْلَمُوا عَدَدَ السِّنِينَ وَالْحِسَابَ ۚ مَا خَلَقَ اللَّهُ ذَٰلِكَ إِلَّا بِالْحَقِّ ۚ يُفَصِّلُ الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ

তিনি সূর্যকে দীপ্তিময় ও চঁদকে আলোকময় করেছেন এবং তার জন্য মনযিল নির্দিষ্ট করেছেন যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পার। আল্লাহ্‌ এগুলোকে যথাযথ ভাবেই সৃষ্টি করেছেন [১]। তিনি এসব নিদর্শন বিশদভাবে বর্ণনা করেন এমন সম্প্রদায়ের জন্য যারা জানে।

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ তিনি এগুলো অনাহুত সৃষ্টি করেননি। বরং তিনি অত্যন্ত প্রজ্ঞাময়, তাঁর প্রত্যেকটি কাজই প্রজ্ঞায় পূর্ণ। আসমান ও যমীন সৃষ্টির মাঝে কোন হেকমত নেই এমন কথা শুধুমাত্র কাফেররাই বলতে পারে। [এ ব্যাপারে আরো দেখুন, সূরা সোয়াদঃ ২৭, সূরা আল-মূমিনূনঃ ১১৫-১১৬]

১৪ :
الر ۚ كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ لِتُخْرِجَ النَّاسَ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ بِإِذْنِ رَبِّهِمْ إِلَىٰ صِرَاطِ الْعَزِيزِ الْحَمِيدِ

আলিফ-লাম্-রা, এ কিতাব, আমরা এটা আপনার প্রতি নাযিল করেছি [১] যাতে আপনি মানুষদেরকে তাদের রবের অনুমতিক্রমে বের করে আনতে পারেন অন্ধকার থেকে আলোর দিকে [২], পরাক্রমশালী, সর্বপ্রশংসিত পথের দিকে [৩],

ফুটনোট

৫২ আয়াত, মক্কী

---------------

[১] ‘সূরা ইব্‌রাহীম’ মক্কায়, হিজরতের পূর্বে নাযিল হয়েছে। কতিপয় আয়াত সম্পর্কে মতভেদ আছে যে, মক্কায় হিজরতের পূর্বে নাযিল, না মদীনায় নাযিল হয়েছে। এ সূরার শুরুতে রিসালাত, নবুওয়াত ও এসবের কিছু বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ইব্রাহীম ‘আলাইহিস্ সালাম-এর কাহিনী বর্ণিত হয়েছে এবং এর সাথে মিল রেখেই সূরার নাম ‘সূরা ইব্‌রাহীম’ রাখা হয়েছে।

[১] অর্থাৎ এটা ঐ গ্রন্থ, যা আমরা আপনার প্রতি নাযিল করেছি। এতে নাযিল করার কাজটি আল্লাহ্র দিকে সম্পৃক্ত করা এবং সম্বোধন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দিকে করার দ্বারা এটা বুঝা যায় যে, এ গ্রন্থ আল-কুরআন অত্যন্ত মহান। একে স্বয়ং আল্লাহ্ তা’আলা নাযিল করেছেন। এটি আসমান থেকে নাযিল হওয়া কিতাবাদির মধ্যে অতি সম্মানিত গ্রন্থ। তিনি তা নাযিল করেছেন আরব বা অনারব যমীনের অধিবাসী সকল মানুষের কাছে প্রেরিত রাসূলদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তির উপর। [ইবন কাসীর]

[২] এখানে (ناس) শব্দের অর্থ সাধারণ মানুষ। এতে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সকল যুগের মানুষই বোঝানো হয়েছে। [ফাতহুল কাদীর] (ظلمات) শব্দটি (ظلمة) এর বহুবচন। এর অর্থ অন্ধকার। এখানে (ظلمات) বলে কুফর, শির্ক ও মন্দকর্মের অন্ধকারসমূহ আবার কারও কারও মতে, বিদ’আত। অপর কারও মতে, সন্দেহ। পক্ষান্তরে (نور) বলে ঈমানের আলো বোঝানো হয়েছে। অথবা সুন্নাত বা ইয়াকীন বা দৃঢ়বিশ্বাস বোঝানো হয়েছে। [ফাতহুল কাদীর] (ظلمات) শব্দটি বহুবচন ব্যবহার করা হয়েছে। কেননা, কুফর ও শির্কের প্রকারভেদ অনেক। এমনিভাবে মন্দকর্মের সংখ্যাও গণনার বাইরে। বিদ’আতের সংখ্যাও অনুরূপভাবে প্রচুর। আর যে সন্দেহ মানব ও জ্বীন শয়তান মানুষের মনে তৈরী করে তা বহু রকমের। পক্ষান্তরে (نور) শব্দটি একবচনে আনা হয়েছে। কেননা, ঈমান ও সত্য এক। আয়াতের অর্থ এই যে, আমি এ গ্রন্থ এ জন্য আপনার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে আপনি এর সাহায্যে বিশ্বের মানুষকে কুফর, শির্ক ও মন্দকর্মের অন্ধকার থেকে মুক্তি দিয়ে তাদের রবের আদেশক্রমে ঈমান ও সত্যের আলোর দিকে আনয়ন করেন। যেমন অন্য আয়াতে আল্লাহ্ বলেন, “তিনিই তাঁর বান্দার প্রতি সুস্পষ্ট আয়াত নাযিল করেন, তোমাদেরকে অন্ধকার হতে আলোতে আনার জন্য।” [সূরা আল-হাদীদঃ ৯] [ইবন কাসীর]

[৩] এ আয়াতের শুরুতে যে অন্ধকার ও আলোর উল্লেখ করা হয়েছিল, বলাবাহুল্য তা ঐ অন্ধকার ও আলো নয়, যা সাধারণ দৃষ্টিতে দেখা যায়। তাই তা ফুটিয়ে তোলার জন্য এ বাক্যে বলা হয়েছে যে, ঐ আলো হচ্ছে আল্লাহ্র পথ। যে সুস্পষ্ট পথ আল্লাহ্ মানুষের চলার জন্য প্রবর্তন করেছেন। যে পথে যেতে এবং যে পথে প্রবেশ করতে তিনি মানুষদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। [ফাতহুল কাদীর] এস্থলে আল্লাহ্ শব্দটি পরে এবং তাঁর আগে তাঁর দু’টি গুণবাচক নাম (عزيز) ও (حميد) উল্লেখ করা হয়েছে। (عزيز) শব্দের অর্থ শক্তিশালী ও পরাক্রান্ত এবং (حميد) শব্দের অর্থ ঐ সত্তা, যিনি প্রশংসার হকদার হওয়ার ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ। [ফাতহুল কাদীর]।

তিনি তাঁর যাবতীয় কাজ, কথা, শরী’আত, নির্দেশ ও নিষেধের ক্ষেত্রে প্রশংসিত এবং তাঁর যাবতীয় নির্দেশের ক্ষেত্রে সত্যবাদী। [ইবন কাসীর] আল্লাহ্র এ দু’টি গুণবাচক নাম আসল নামের পূর্বে উল্লেখ করে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, এ পথ পথিককে যে সত্তার দিকে নিয়ে যায়, তিনি প্রবল পরাক্রান্ত এবং প্রশংসার হকদার হওয়ার ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ। ‘হামীদ’ শব্দটির অপর অর্থ, প্রত্যেকের মুখেই তাঁর প্রশংসা, সকল স্থানে ও সকল অবস্থায় তিনি সম্মানিত। [ফাতহুল কাদীর]

১৪ :
وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا مُوسَىٰ بِآيَاتِنَا أَنْ أَخْرِجْ قَوْمَكَ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ وَذَكِّرْهُمْ بِأَيَّامِ اللَّهِ ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِكُلِّ صَبَّارٍ شَكُورٍ

আর অবশ্যই আমরা মূসাকে আমাদের নিদর্শনসহ পাঠিয়েছিলাম [১] এবং বলেছিলাম, ‘আপনার সম্প্রদায়কে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসুন [২], এবং তাদেরকে আল্লাহ্‌র দিনগুলোর দ্বারা উপদেশ দিন [৩]।’ এতে তো নিদর্শন [৪] রয়েছে প্রত্যেক পরম ধৈর্য্যশীল ও পরম কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য [৫]।

ফুটনোট

[১] এ আয়াতে বলা হয়েছেঃ আমি মূসা ‘আলাইহিস্ সালাম-কে আয়াত দিয়ে প্রেরণ করেছি, যাতে তিনি স্বজাতিকে কুফর ও গোনাহর অন্ধকার থেকে দাওয়াত দিয়ে ঈমান ও আনুগত্যের আলোতে নিয়ে আসে। [বাগভী] এখানে আয়াত শব্দের অর্থ তাওরাতের আয়াতও হতে পারে। কারণ, সেগুলো নাযিল করার উদ্দেশ্যই ছিল সত্যের আলো ছড়ানো। আয়াতের অন্য অর্থ মু’জিযাও হয়। এখানে এ অর্থও উদ্দিষ্ট হতে পারে।

[ফাতহুল কাদীর] মুজাহিদ বলেন, এখানে নয়টি বিশেষ নিদর্শন উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। [ইবন কাসীর] মূসা ‘আলাইহিস্ সালাম-কে আল্লাহ্‌ তা’আলা ন’টি মু’জিযা বিশেষভাবে দান করেন।

[২] এ আয়াতে ‘কওম’ তথা ‘সম্প্রদায়’ শব্দ ব্যবহার করে নিজ কওমকে অন্ধকার থেকে আলোতে আনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়বস্তুটিই যখন আলোচ্য সূরার প্রথম আয়াতে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে সম্বোধন করে বর্ণনা করা হয়েছে, তখন সেখানে ‘কওম’ শব্দের পরিবর্তে (ناس) (মানুষ) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। বলা হয়েছেঃ

(لِتُخْرِجَ النَّاسَ مِنَ الظُّلُمٰتِ اِلَي النُّوْرِ)

এতে ইঙ্গিত আছে যে, মূসা ‘আলাইহিস্ সালাম শুধু বনী ইসরাঈল ও মিসরীয় জাতির প্রতি নবীরূপে প্রেরিত হয়েছিলেন, অপরদিকে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নবুওয়াত সমগ্র মানুষের জন্য।

[৩] এরপর আল্লাহ্‌ তা’আলা মূসা ‘আলাইহিস্ সালাম-কে নির্দেশ দেন যে, স্বজাতিকে ‘আইয়্যামুল্লাহ্’ স্মরণ করান। কিন্তু আইয়্যামুল্লাহ্ কি? (أيام) শব্দটি (يوم) এর বহুবচন, এর অর্থ দিন। (اَيَّامَ اللّٰهِ) শব্দটি দু’টি অর্থে ব্যবহৃত হয়। বিভিন্ন শাস্তির দিনগুলো, যেমন কাওমে নূহ, আদ ও সামূদের উপর আযাব নাযিল হওয়ার ঘটনাবলী। [ফাতহুল কাদীর]

এসব ঘটনায় বিরাট জাতিসমূহের ভাগ্য ওলট-পালট হয়ে গেছে এবং তারা পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় ‘আইয়্যামুল্লাহ্’ স্মরণ করানোর উদ্দেশ্য হবে, এসব জাতির কুফরের অশুভ পরিণতির ভয় প্রদর্শন করা এবং হুঁশিয়ার করা। ‘আইয়্যামুল্লাহ্’র অপর অর্থ আল্লাহ্‌ তা’আলার নেয়ামত ও অনুগ্রহও হয়। এ জাতির উপর আল্লাহ্‌র যেসব নেয়ামত দিবারাত্র বর্ষিত হয় এবং যেসব বিশেষ নেয়ামত তাদেরকে দান করা হয়েছে, সেগুলো স্মরণ করিয়ে আল্লাহ্‌র আনুগত্য ও তাওহীদের দিকে আহ্বান করুন; উদাহরণতঃ তীহ্ উপত্যকায় তাদের মাথার উপর মেঘের ছায়া, আহারের জন্য মান্না ও সালওয়ার অবতরণ, পানীয় জলের প্রয়োজনে পাথর থেকে ঝর্ণা প্রবাহিত হওয়া ইত্যাদি। [ইবন কাসীর]

এগুলো স্মরণ করানোর লক্ষ্য হবে এই যে, ভাল মানুষকে যখন কোন অনুগ্রহদাতার অনুগ্রহ স্মরণ করানো হয়, তখন সে বিরোধিতা ও অবাধ্যতা করতে লজ্জা বোধ করে। এখানে দু’টি অর্থই উদ্দেশ্য হতে পারে। বিশেষ করে হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “একদিন মূসা আলাইহিসসালাম তার কাওমকে ‘আইয়্যামুল্লাহ্’ সম্পর্কে নসীহত করছিলেন... আর ‘আইয়্যামুল্লাহ্’ হলো আল্লাহ্‌র নেয়ামত ও বিপদাপদ” [মুসলিমঃ ২৩৮০]

[৪] এখানে (اٰيٰت)-এর অর্থ নিদর্শন ও প্রমাণাদি। অর্থাৎ এসব ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্যে এমন সব নির্দশন রয়েছে যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি আল্লাহ্র একত্ববাদ ও তাঁর ক্ষমতাবান হওয়ার সত্যতা ও নির্ভুলতার প্রমাণ পেতে পারে। [ফাতহুল কাদীর]

এ সংগে এ সত্যের পক্ষেও অসংখ্য সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারে যে, প্রতিদানের বিধান পুরোপুরি হক এবং তার দাবী পূরণ করার জন্য অন্য একটি জগত অর্থাৎ আখেরাতের জগত অপরিহার্য।

[৫] আয়াতে বর্ণিত (صبار) শব্দটি (صبر) থেকে (مبالغة) এর পদ। এর অর্থ অধিক সবরকারী। (شكور) শব্দটি (شكر) থেকে (مبالغة) এর পদ। এর অর্থ অধিক কৃতজ্ঞ। [ফাতহুল কাদীর] বাক্যের অর্থ এই যে, অবিশ্বাসীদের শাস্তি ও আযাব সম্পর্কিত হোক অথবা আল্লাহ্‌র নেয়ামত ও অনুগ্রহ সম্পর্কিত হোক, উভয় অবস্থাতে অতীত ঘটনাবলীতে আল্লাহ্‌র অপার শক্তি ও অসীম রহস্যের বিরাট শক্তি বিদ্যমান ঐ ব্যক্তির জন্য, যে অত্যন্ত সবরকারী এবং অধিক শোকরকারী। সংক্ষেপে শোকর ও কৃতজ্ঞতার স্বরূপ এই যে, আল্লাহ্ প্রদত্ত নেয়ামতকে তাঁর অবাধ্যতা এবং হারাম ও অবৈধ কাজে ব্যয় না করা, মুখেও আল্লাহ্ তা’আলার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং স্বীয় কাজকর্মকেও তাঁর ইচ্ছার অনুগামী করা। সবরের সারমর্ম হচ্ছে স্বভাব বিরুদ্ধ ব্যাপারাদিতে অস্থির না হওয়া, কথায় ও কাজে অকৃতজ্ঞতার প্রকাশ থেকে বেঁচে থাকা এবং দুনিয়াতেও আল্লাহ্‌র রহমত আশা করা, আর আখেরাতে উত্তম পুরস্কার প্রাপ্তিতে বিশ্বাস রাখা। [দেখুন, ইবনুল কাইয়্যেম, উদ্দাতুস সাবেরীন]।

২৪ : ৩৫
اللَّهُ نُورُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۚ مَثَلُ نُورِهِ كَمِشْكَاةٍ فِيهَا مِصْبَاحٌ ۖ الْمِصْبَاحُ فِي زُجَاجَةٍ ۖ الزُّجَاجَةُ كَأَنَّهَا كَوْكَبٌ دُرِّيٌّ يُوقَدُ مِنْ شَجَرَةٍ مُبَارَكَةٍ زَيْتُونَةٍ لَا شَرْقِيَّةٍ وَلَا غَرْبِيَّةٍ يَكَادُ زَيْتُهَا يُضِيءُ وَلَوْ لَمْ تَمْسَسْهُ نَارٌ ۚ نُورٌ عَلَىٰ نُورٍ ۗ يَهْدِي اللَّهُ لِنُورِهِ مَنْ يَشَاءُ ۚ وَيَضْرِبُ اللَّهُ الْأَمْثَالَ لِلنَّاسِ ۗ وَاللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ

আল্লাহ্‌ আসমানসমূহ ও যমীনের নূর [১], তাঁর [২] নূরের উপমা যেন একটি দীপাধার যার মধ্যে আছে এক প্রদীপ, প্রদীপটি একটি কাঁচের আবরণের মধ্যে স্থাপিত, কাঁচের আবরণটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত, তা জ্বালানো হয় বরকতময় যায়তূন গাছের তৈল দ্বারা [৩] যা শুধু পূর্ব দিকের (সূর্যের আলোকপ্রাপ্ত) নয় আবার শুধু পশ্চিম দিকের (সূর্যের আলোকপ্রাপ্তও) নয়, আগুন তাকে স্পর্শ না করলেও যেন তার তৈল উজ্জ্বল আলো দিচ্ছে; নূরের উপর নূর! আল্লাহ্‌ যাকে ইচ্ছে হেদায়েত করেন তাঁর নূরের দিকে। আল্লাহ্‌ মানুষের জন্য উপমাসমূহ বর্ণনা করে থাকেন এবং আল্লাহ্‌ সব কিছু সম্পর্কে সর্বজ্ঞ।

ফুটনোট

[১] নূরের সংজ্ঞাঃ নূর শব্দের আভিধানিক অর্থ আলো। [ফাতহুল কাদীর] কুরআন ও হাদীসে আল্লাহ্‌র জন্য নূর কয়েকভাবে সাব্যস্ত হয়েছে।

এক) আল্লাহ্‌র নাম হিসাবে। যে সমস্ত আলেমগণ এটাকে আল্লাহ্‌র নাম হিসাবে সাব্যস্ত করেছেন তারা হলেন, সুফিয়ান ইবনে উ‘য়াইনাহ খাত্তাবী, ইবনে মান্দাহ, হালিমী, বাইহাকী, ইস্পাহানী, ইবনে আরাবী, কুরতুবী, ইবনু তাইমিয়াহ, ইবনুল কাইয়্যেম, ইবনুল ওয়ায়ীর, ইবনে হাজার, আস-সা‘দী, আল-কাহতানী, আল-হামুদ, আশ-শারবাসী, নূরুল হাসান খান প্রমুখ।

দুই) আল্লাহ্‌র গুণ হিসাবে। আল্লাহ্‌ তা‘আলা নূর নামক গুণ তাঁর জন্য বিভিন্ন ভাবে সাব্যস্ত করেছেন। যেমন-

(ক) কখনো কখনো সরাসরি নূরকে তাঁর দিকে সম্পর্কিত করেছেন। আল্লাহ্‌ বলেনঃ مَثَلُ نُوْرِهٖ كَمِشْكوٰةٍ অর্থাৎ “আল্লাহ্‌র নূরের উদাহরণ হলো ...। অন্য আয়াতে আল্লাহ্‌ বলেনঃ وَاَشْرَقَتِ الْاَرْضُ بِنُوْرِرَبِّهَا অর্থাৎ “আর আলোকিত হলো যমীন তার প্রভূর আলোতে।” [সূরা আয-যুমারঃ ৬৯] হাদীসে এসেছে, ‘আল্লাহ্‌ তা‘আলা তার সৃষ্টিকে অন্ধকারে সৃষ্টি করেছেন। তারপর তিনি তাতে তাঁর নূরের কিছু ঢেলে দিলেন। সুতরাং এ নূরের কিছু অংশ যার উপরই পড়েছে, সে হেদায়াত লাভ করেছে। আর যার উপর পড়েনি সে পথভ্রষ্ট হয়েছে।’ [তিরমিযীঃ ২৬৪২]

(খ) কখনো কখনো আল্লাহ্‌ তা‘আলা তাঁর এ নূরকে তার চেহারার দিকে সম্পর্কযুক্ত করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেনঃ ‘আসমান ও যমীনের যাবতীয় নূর তাঁরই চেহারার আলো। [আবু সাইদ আদ-দারেমী]

তিন) আল্লাহ্‌র নূরকে আসমান ও যমীনের দিকে সম্পর্কযুক্ত করে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ্‌ তা‘আলা বলেনঃ

اَللهُ نُوْرْالسَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضِ

অর্থাৎ “আল্লাহ্‌ আসমান ও যমীনের নূর।” এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ

اللّٰهُمَّ لَكَ ا احَمْدُ أَنْتَ نُوْرُ السَّمٰوَاتِ وَالأَرْضِ وَمَنْ فِيْهِنَّ

অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ্‌, আপনার জন্য সমস্ত প্রশংসা, আপনি আসমান ও যমীনের আলো এবং এ দু’য়ের মধ্যে যা আছে তারও (আলো)...। [বুখারীঃ ১১২০, মুসলিমঃ ১৯৯]

চার) আল্লাহ্‌র পর্দাও নূর। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘তাঁর পর্দা হলো নূর।’ [মুসলিমঃ ২৯৩] আর আল্লাহ্‌র রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম মি‘রাজের রাতে এর নূরই দেখেছিলেন। সাহাবাগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেছিলেনঃ ‘আপনি কি আপনার প্রভূকে দেখেছিলেন? তিনি বললেনঃ নূর! কিভাবে তাকে দেখতে পারি?’ [মুসলিমঃ ২৯১] অপর বর্ণনায় এসেছে, ‘আমি নূর দেখেছি।’ [মুসলিমঃ ২৯২] এ হাদীসের সঠিক অর্থ হলো, আমি কিভাবে তাঁকে দেখতে পাব? সেখানে তো নূর ছিল। যা তাকে দেখার মাঝে বাঁধা দিচ্ছিল। আমি তো কেবল নূর দেখেছি। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, আল্লাহ্‌র পর্দাও নূর। এ নূরের পর্দার কারণেই সবকিছু পুড়ে যাচ্ছে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘যদি তিনি তাঁর পর্দা খুলতেন তবে তাঁর সৃষ্টির যতটুকুতে তাঁর নজর পড়ত সবকিছু তাঁর চেহারার আলোর কারণে পুড়ে যেত।’ [মুসলিমঃ ২৯৩-২৯৫]

সুতরাং আসমান ও যমীনের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য দু‘ধরনের নূরই আল্লাহ্‌র। প্রকাশ্য নূর যেমন- আল্লাহ্‌ তা‘আলা স্বয়ং নূর। তাঁর পর্দা নূরের। যদি তিনি তাঁর সে পর্দা উন্মোচন করেন, তাহলে তাঁর সৃষ্টির যতটুকুতে তাঁর দৃষ্টি পড়বে তার সবকিছুই ভস্ম হয়ে যাবে। তাঁর নূরেই আরশ আলোকিত। তাঁর নূরেই কুরসী, সূর্য, চাদ ইত্যাদি আলোকিত। অনুরূপভাবে তাঁর নূরেই জান্নাত আলোকিত। কারণ, সেখানে তো আর সূর্য নেই।

আর অপ্রকাশ্য নূর যেমন- আল্লাহ্‌র কিতাব নূর [সূরা আল-আ‘রাফঃ ১৫৭], তাঁর শরীয়ত নূর [সূরা আল-মায়েদাঃ ৪৪], তাঁর বান্দা ও রাসূলদের অন্তরে অবস্থিত ঈমান ও জ্ঞান তাঁরই নূর [সূরা আয-যুমারঃ ২২]। যদি এ নূর না থাকত তাহলে অন্ধকারের উপর অন্ধকারে সবকিছু ছেয়ে যেত। সুতরাং যেখানেই তাঁর নূরের অভাব হবে সেখানেই অন্ধকার ও বিভ্ৰান্তি দানা বেঁধে থাকে। আর এজন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দো‘আ করতেনঃ ‘হে আল্লাহ্‌, আমার অন্তরে নূর দিন, আমার শ্রবণেন্দ্রীয়ে নূর দিন, আমার দৃষ্টিশক্তিতে নূর দিন, আমার ডানে নূর দিন, আমার বামে নূর দিন, আমার সামনে নূর দিন, আমার পিছনে নূর দিন, আমার উপরে নূর দিন, আমার নীচে নূর দিন। আর আমার জন্য নূর দিন অথবা বলেছেনঃ আমাকে নূর বানিয়ে দিন। অন্য বর্ণনায় এসেছে, আর আমার জন্য আমার আত্মায় নূর দিন। আমার জন্য বৃহৎ নূরের ব্যবস্থা করে দিন। [বুখারীঃ ৬৩১৬, মুসলিমঃ ৭৬৩]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘হে আল্লাহ্‌, আমাকে নূর দিন, আমার জন্য আমার অস্থি ও শিরা-উপশিরায় নূর দিন। আমার মাংসে নুর দিন, আমার রক্তে নূর দিন, আমার চুলে নূর দিন, আমার শরীরে নূর দিন।’ অপর বর্ণনায় এসেছে, ‘হে আল্লাহ্‌, আমার জন্য আমার কবরে নূর দিন। আমার হাড্ডিতে নূর দিন।’ [তিরমিযীঃ ৩৪১৯] অন্যত্র এসেছে, ‘আর আমার নূর বাড়িয়ে দিন, আমার নূর বাড়িয়ে দিন, আমার নূর বাড়িয়ে দিন। [বুখারীঃ আদাবুল মুফরাদ- ৬৯৫] ‘আমাকে নূরের উপর নূর দান করুন।’ [ফাতহুল বারীঃ ১১/১১৮]

আয়াতে আল্লাহ্‌ তা‘আলা সত্তার জন্য ব্যবহৃত ‘নূর’ শব্দটির অর্থ কোন কোন তাফসীরবিদের মতে ‘মুনাওয়ের' অর্থাৎ ঔজ্জ্বল্যদানকারী। অথবা অতিশয়ার্থবোধক পদের ন্যায় নূরওয়ালাকে নূর বলে ব্যক্ত করা হয়েছে। তখন আয়াতের অর্থ হয় যে, আল্লাহ্‌ তা‘আলা নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যে বসবাসকারী সব সৃষ্টজীবের নূরদাতা। এই নূর বলে হেদায়াতের নূর বুঝানো হয়েছে। [দেখুন- বাগভী] ইবনে কাসীর ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে এর তাফসীর এরূপ বর্ণনা করেছেনঃ

اللّٰهُ هَادِى أَهْلِ السَّمَا وَاتِ وَالْاَرْضِ

অর্থাৎ আল্লাহ্‌ নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের অধিবাসীদের হেদায়াতকারী। [ইবন কাসীর]

[২] مَثَلُ ذُوْرِهٖ এর সর্বনাম দ্বারা কাকে বুঝানো হয়েছে, এ সম্পর্কে তাফসীরবিদগণের কয়েকটি উক্তি এসেছেঃ

(এক) এই সর্বনাম দ্বারা আল্লাহ্‌ তা‘আলাকে বুঝানো হয়েছে। আয়াতের অর্থ এই যে, আল্লাহ্‌র নূর হেদায়াত যা মুমিনের অন্তরে রাখা হয়েছে, তার দৃষ্টান্ত كَمِشْكَاةٍ এটা ইবনে-আব্বাসের উক্তি। অর্থাৎ মুমিনের অন্তরস্থিত কুরআন ও ঈমানের মাধ্যমে সঞ্চিত আল্লাহ্‌র নূরকে তুলনা করে বলা হচ্ছে যে, এ নূরের উদাহরণ হলো এমন একটি তাকের মত যেখানে আল্লাহ্‌র নূর আলোর মত উজ্জল ও সদা বিকিরনশীল। সে হিসেবে আয়াতের প্রথমে আল্লাহ্‌ তা‘আলা নিজের নূর উল্লেখ করেছেন

اللهُ نُوْرُالسَّمٰوٰتِ وَالْاارضِ

অতঃপর মুমিনের অন্তরে অবস্থিত তাঁরই নূর উল্লেখ করেছেন مَثَلُ نُوْرِهٖ -উবাই ইবনে কা‘ব এই আয়াতের কেরাআতও مَثَلُ نُوْرِهٖ এর পরিবর্তে

مَثَلُ نُوْرِمَنْ آمَنَ بِهِ

পড়তেন। সাঈদ ইবনে যুবায়ের এই কেরাআত এবং আয়াতের এই অর্থ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকেও বর্ণনা করেছেন।

(দুই) এই সর্বনাম দ্বারা মুমিনকেই বুঝানো হয়েছে। তখন দৃষ্টান্তের সারমর্ম এই যে, মুমিনের বক্ষ একটি তাকের মত এবং এতে তার অন্তর একটি প্রদীপ সদৃশ। এতে যে স্বচ্ছ যয়তুন তৈলের কথা বলা হয়েছে, এটা মুমিনের স্বভাবে গচ্ছিত রাখা নূরে ঈমানের দৃষ্টান্ত। এর বৈশিষ্ট্য আপনা-আপনি সত্যকে গ্ৰহণ করা। যয়তুন তৈল অগ্নি স্পর্শে প্ৰজ্বলিত হয়ে যেমন অপরকে আলোকিত করে, এমনিভাবে মুমিনের অন্তরে রাখা নূরে-হেদায়াত যখন আল্লাহ্‌র ওহী ও জ্ঞানের সাথে মিলিত হয়, তখন আলোকিত হয়ে বিশ্বকে আলোকিত করে দেয়। সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীগণ এই দৃষ্টান্তকে বিশেষভাবে মুমিনের অন্তরের সাথে সম্পর্কযুক্ত করেছেন। এর কারণও সম্ভবতঃ এই যে, এই নূর দ্বারা শুধু মুমিনই উপকার লাভ করে। নতুবা এই সৃষ্টিগত হেদায়াতের নূর যা সৃষ্টির সময় মানুষের অন্তরে রাখা হয়, তা বিশেষভাবে মুমিনের অন্তরেই রাখা হয় না; বরং প্রত্যেক মানুষের মজ্জায় ও স্বভাবে এই হেদায়াতের নূর রাখা হয়। এরই প্রতিক্রিয়া জগতের প্রত্যেক জাতি, প্রত্যেক ভূখণ্ড এবং প্রত্যেক ধর্মাবলম্বীর মধ্যে পরিদৃষ্ট হয় যে, তারা আল্লাহ্‌র অস্তিত্ব ও তাঁর মহান কুদরতের প্রতি সৃষ্টিগতভাবে বিশ্বাস রাখে এবং তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করে। তারা আল্লাহ্‌ তা‘আলা সম্পর্কিত ধারণা ও ব্যাখ্যায় যত ভুলই করুক, কিন্তু আল্লাহ্‌র অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রত্যেক মানুষ সৃষ্টিগতভাবেই বিশ্বাসী। তবে কিছুসংখ্যক বস্তুবাদীর কথা ভিন্ন। তাদের স্বভাবধর্মই বিকৃত হয়ে গেছে। ফলে তারা আল্লাহ্‌র অস্তিত্বই অস্বীকার করে। একটি সহীহ হাদীস থেকে এই ব্যাপক অর্থের সমর্থন পাওয়া যায়। এতে বলা হয়েছে,

كُلُّ مَوْلُوْدٍ قُوْلَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ

অর্থাৎ “প্রত্যেকটি শিশু ফিতরতের উপর জন্মগ্রহণ করে।’’ [বুখারীঃ ২৪৪, মুসলিমঃ ২৬৫৮] এরপর তার পিতামাতা তাকে ফিতরতের দাবী থেকে সরিয়ে ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করে। এই ফিতরতের অর্থ ঈমানের হেদায়াত। ঈমানের হেদায়াত ও তার নূর প্রত্যেক মানুষকে সৃষ্টি করার সময় তার মধ্যে রাখা হয়। যখন নবী ও তাদের নায়েবদের মাধ্যমে তাদের কাছে ওহীর জ্ঞান পৌঁছে, তখন তারা সহজেই তা গ্ৰহণ করে নেয়। তবে স্বভাবধর্ম বিকৃত কতিপয় লোকের কথা ভিন্ন। তারা নিজেদের কুকর্মের দ্বারা সৃষ্টিগত নূরকে ধ্বংস করে দিয়েছে। সম্ভবতঃ এ কারণেই আয়াতের শুরুতে নূর দান করার কথাটি ব্যাপকাকারে বর্ণনা করা হয়েছে, যাতে ভূমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের অধিবাসীরা সবাই শামিল। এতে মুমিন ও কাফেরেরও প্রভেদ করা হয়নি। কিন্তু আয়াতের শেষে বলা হয়েছে

يَهْدِى اللهُ لِنُوْرِهٖ مَنْ يَّشَآءُ

অর্থাৎ “আল্লাহ্‌ তা‘আলা যাকে ইচ্ছা তাঁর নূরের দিকে পথ প্রদর্শন করেন”। এখানে আল্লাহ্‌র ইচ্ছার শর্তটি সেই সৃষ্টিগত নূরের সাথে সম্পৃক্ত নয়, যা প্রত্যেক মানুষের মধ্যে রাখা হয়; বরং এর সম্পর্ক কুরআনের নূরের সাথে, যা প্রত্যেকের অর্জিত হয় না। যারা আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে তাওফীক পায়, তারাই এই নূর লাভ করে। নতুবা আল্লাহ্‌র তৌফিক ছাড়া মানুষের চেষ্টাও অনর্থক; বরং মাঝে মাঝে ক্ষতিকরও হয়।

(তিন) এখানে نور দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্তরের নূরকে বুঝানো হয়েছে। ইমাম বাগভী বর্ণনা করেন যে, একবার ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কা‘ব আহবারকে জিজ্ঞেস করলেনঃ এই আয়াতের তাফসীরে আপনি কি বলেন? ক‘ব আহবার তাওরাত ও ইঞ্জিলের সুপণ্ডিত মুসলিম ছিলেন। তিনি বললেনঃ এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র অন্তরের দৃষ্টান্ত। মিশকাত তথা তাক মানে তার বক্ষদেশ, زُخَاجَةٍ তথা কাঁচপাত্র মানে তার পবিত্র অন্তর এবং مِصْبَاحٌ তথা প্ৰদীপ মানে নবুয়ত। এই নবুয়তরূপী নূরের বৈশিষ্ট্য এই যে, প্রকাশিত ও ঘোষিত হওয়ার পূর্বেই এতে মানবমণ্ডলীর জন্য আলো ও ঔজ্জ্বল্য ছিল। এরপর ওহী ও ঘোষণা এর সাথে সংযুক্ত হলে এটা এমন নূরে পর্যবসিত হয়, যা সমগ্র বিশ্বকে আলোকোজ্জ্বল করে দেয়। [দেখুন-ইবন কাসীর, কুরতুবী, বাগভী]

[৩] এতে প্রমাণিত হয় যে, যয়তূন ও যয়তূন বৃক্ষ কল্যাণময় ও উপকারী। আলেমগণ বলেনঃ আল্লাহ্‌ তা‘আলা এতে অগণিত উপকারিতা নিহিত রেখেছেন। একে প্রদীপে ব্যবহার করা হয়। এর আলো অন্যান্য তৈলের আলোর চাইতে অধিক স্বচ্ছ হয়। একে রুটির সাথে ব্যবহার করা হয়। এর ফলও ভক্ষিত হয়। এর তৈল সংগ্ৰহ করার জন্য কোন যন্ত্র অথবা মাড়াইকল ইত্যাদির প্রয়োজন হয় না- আপনাআপনিই ফল থেকে তৈল বের হয়ে আসে। [বাগভী] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ “যয়তুন তৈল খাও এবং শরীরে মালিশও কর। কেননা, এটা কল্যাণময় বৃক্ষ।” [তিরমিযীঃ ১৮৫১, ১৮৫২, ইবনে মাজহঃ ৩৩১৯]

২৪ : ৪০
أَوْ كَظُلُمَاتٍ فِي بَحْرٍ لُجِّيٍّ يَغْشَاهُ مَوْجٌ مِنْ فَوْقِهِ مَوْجٌ مِنْ فَوْقِهِ سَحَابٌ ۚ ظُلُمَاتٌ بَعْضُهَا فَوْقَ بَعْضٍ إِذَا أَخْرَجَ يَدَهُ لَمْ يَكَدْ يَرَاهَا ۗ وَمَنْ لَمْ يَجْعَلِ اللَّهُ لَهُ نُورًا فَمَا لَهُ مِنْ نُورٍ

অথবা তাদের কাজ গভীর সাগরের তলের অন্ধকারের মত, যাকে আচ্ছন্ন করে তরংগের উপর তরঙ্গ, যার ঊর্ধ্বে মেঘপুঞ্জ, অন্ধকারপুঞ্জ স্তরের উপর স্তর, এমনকি সে হাত বের করলে তা আদৌ দেখতে পাবে না। আর আল্লাহ্‌ যার জন্য নূর রাখেননি তার জন্য কোন নূরই নেই।
ফুটনোট

৩৩ : ৪৩
هُوَ الَّذِي يُصَلِّي عَلَيْكُمْ وَمَلَائِكَتُهُ لِيُخْرِجَكُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ ۚ وَكَانَ بِالْمُؤْمِنِينَ رَحِيمًا

তিনিই, যিনি তোমাদের প্রশংসা করেন [১] এবং দো'আ ও ক্ষমা চান তোমাদের জন্য তাঁর ফিরিশতাগণ; যেন তিনি তোমাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আনেন আলোর দিকে। আর তিনি মুমিনদের প্রতি পরম দয়ালু।

ফুটনোট

[১] ‘সালাত’ শব্দটি যখন আল্লাহর ক্ষেত্রে বান্দাদের জন্য ব্যবহার করা হয় তখন এর অর্থ হয় রহমত, অনুগ্রহ। আর যখন এটি ফেরেশতাদের পক্ষ থেকে মানুষের জন্য ব্যবহৃত হয় তখন এর অর্থ হয় দো'আ, ইসতিগফার। [ফাতহুল কাদীর]

৩৩ : ৪৬
وَدَاعِيًا إِلَى اللَّهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجًا مُنِيرًا

এবং আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহবানকারী [১] ও উজ্জ্বল প্রদীপরূপে [২]।

ফুটনোট

[১] وَّدَاعِيًا اِلىَ اللّٰهِ এর অর্থ তিনি উম্মতকে আল্লাহর সত্তা ও অস্তিত্ব এবং তাঁর আনুগত্যের প্রতি আহবানকারী। আয়াতে بإذنه শব্দ এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করায় বোঝা যায় যে, তিনি মানবমণ্ডলীকে আল্লাহর দিকে তাঁর অনুমতি সাপেক্ষেই আহবান করেন। [কুরতুবী, সাদী, বাগভী]

[২] আয়াতে وَسِرَاجًامُّنِيْرًا এর মর্মার্থ ‘পবিত্র কুরআন’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। [ইবন কাসীর; কুরতুবী]

৪২ : ৫২
وَكَذَٰلِكَ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ رُوحًا مِنْ أَمْرِنَا ۚ مَا كُنْتَ تَدْرِي مَا الْكِتَابُ وَلَا الْإِيمَانُ وَلَٰكِنْ جَعَلْنَاهُ نُورًا نَهْدِي بِهِ مَنْ نَشَاءُ مِنْ عِبَادِنَا ۚ وَإِنَّكَ لَتَهْدِي إِلَىٰ صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ

আর এভাবে [১] আমরা আপনার প্রতি আমাদের নির্দেশ থেকে রূহকে ওহী করেছি; আপনি তো জানতেন না কিতাব কি এবং ঈমান কি! কিন্তু আমরা এটাকে করেছি নূর, যা দ্বারা আমরা আমাদের বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছে হেদায়াত দান করি; আর আপনি তো অবশ্যই সরল পথের দিকে দিকনির্দেশনা করেন---

ফুটনোট

[১] “এভাবে” অর্থ শুধু শেষ পদ্ধতি নয়, বরং ওপরের আয়াতে যে তিনটি পদ্ধতি উল্লেখিত হয়েছে তার সব কটি। আর "রূহ’ অর্থ অহী [তাবারী] অথবা এখানে রূহ বলে কুরআনকে বোঝানো হয়েছে। কারণ, কুরআন হচ্ছে এমন রূহ যার দ্বারা অন্তরসমূহ জীবন লাভ করে। [জালালাইন]। কুরআন ও হাদীস থেকেই একথা প্রমাণিত যে, এই তিনটি পদ্ধতিতেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হিদায়াত দান করা হয়েছে। হাদীসে এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে অহী আসার সূচনা হয়েছিলো সত্য স্বপ্নের আকারে [বুখারী: ৩] এই ধারা পরবর্তী সময় পর্যন্ত জারি ছিল। তাই হাদীসে তার বহু সংখ্যক স্বপ্নের উল্লেখ দেখা যায়। যার মাধ্যমে হয় তাকে কোনো শিক্ষা দেয়া হয়েছে কিংবা কোনো বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে। তাছাড়া কুরআন মজীদে নবীর একটি স্বপ্নের সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে [সূরা আল-ফাতহ: ২৭] তাছাড়া কতিপয় হাদীসে একথারও উল্লেখ আছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আমার মনে অমুক বিষয়টি সৃষ্টি করে দেয়া হয়েছে, কিংবা আমাকে একথাটি বলা হয়েছে বা আমাকেই নির্দেশ দান করা হয়েছে অথবা আমাকে এ কাজ করতে নিষেধ করা হয়েছে। এ ধরনের সব কিছু অহীর প্রথমোক্ত শ্রেণীর সাথে সম্পর্কিত। বেশীর ভাগ হাদীসে কুদসী এই শ্রেণীরই অন্তর্ভুক্ত। মে'রাজে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দ্বিতীয় প্রকার অহী দ্বারা সম্মানিত করা হয়েছে। কতিপয় হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের নির্দেশ দেয়া এবং তা নিয়ে তার বার বার দরখাস্ত পেশ করার কথা যেভাবে উল্লেখিত হয়েছে তা থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়, সে সময় কথাবার্তা হয়েছিলো যেমনটি তুর পাহাড়ের পাদদেশে মূসা আলাইহিস সালাম ও আল্লাহর মধ্যে হয়েছিলো। এরপর থাকে অহীর তৃতীয় শ্রেণী। এ ব্যাপারে কুরআন নিজেই সাক্ষ্য দান করে যে, কুরআনকে জিবরাঈল আমীনের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পৌছানো হয়েছে [আল-বাকারাহ: ৯৭. আশ-শু'আরা: ১৯২-১৯৫]

৫৭ : ১২
يَوْمَ تَرَى الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ يَسْعَىٰ نُورُهُمْ بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَبِأَيْمَانِهِمْ بُشْرَاكُمُ الْيَوْمَ جَنَّاتٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا ۚ ذَٰلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ

সেদিন আপনি দেখবেন মুমিন নর-নারীদেরকে তাদের সামনে ও ডানে তাদের নূর ছুটতে থাকবে [১]। বলা হবে, ‘আজ তোমাদের জন্য সুসংবাদ জান্নাতের, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, সেখানে তোমরা স্থায়ী হবে, এটাই তো মহাসাফল্য।’

ফুটনোট

[১] আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “তাদেরকে তাদের আমল অনুযায়ী নূর দেয়া হবে। তাদের কারও কারও নূর হবে পাহাড়সম। তাদের মধ্যে সবচেয়ে কম নূরের যে অধিকারী হবে তার নূর থাকবে তার বৃদ্ধাঙ্গুলীতে। যা একবার জ্বলবে আরেকবার নিভবে।” [মুস্তাদরাকে হাকিম ২/৪৭৮]

৫৭ : ১৩
يَوْمَ يَقُولُ الْمُنَافِقُونَ وَالْمُنَافِقَاتُ لِلَّذِينَ آمَنُوا انْظُرُونَا نَقْتَبِسْ مِنْ نُورِكُمْ قِيلَ ارْجِعُوا وَرَاءَكُمْ فَالْتَمِسُوا نُورًا فَضُرِبَ بَيْنَهُمْ بِسُورٍ لَهُ بَابٌ بَاطِنُهُ فِيهِ الرَّحْمَةُ وَظَاهِرُهُ مِنْ قِبَلِهِ الْعَذَابُ

সেদিন মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারীরা যারা ঈমান এনেছে বলবে, ‘তোমরা আমাদের জন্য একটু থাম, যাতে আমরা তোমাদের নূরের কিছু গ্ৰহণ করতে পারি।’ বলা হবে, ‘তোমরা তোমাদের পিছনে ফিরে যাও ও নূরের সন্ধান কর। ‘তারপর উভয়ের মাঝামাঝি স্থাপিত হবে একটি প্রাচীর যাতে একটি দরজা থাকবে, যার ভিতরে থাকবে রহমত এবং বাইরে থাকবে শাস্তি [১]।

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ সেদিন স্মরণীয়, যেদিন আপনি মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে দেখবেন যে, তাদের নূর তাদের অগ্রে ও ডানদিকে ছুটাছুটি করবে। ‘সেদিন' বলে কেয়ামতের দিন বোঝানো হয়েছে। নূর দেয়ার ব্যাপারটি পুলসিরাতে চলার কিছু পূর্বে ঘটবে। এ আয়াতের একটি তাফসীর আবু উমামা বাহেলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি একদিন দামেশকে এক জানাযায় শরীক হন। জানাযা শেষে উপস্থিত লোকদেরকে মৃত্যু ও আখেরাত স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যে তিনি মৃত্যু, কবর ও হাশরের কিছু অবস্থা বর্ণনা করেন। নিম্নে তার বক্তব্যের কিছু অংশ পেশ করা হলঃ

“অতঃপর তোমরা কবর থেকে হাশরের ময়দানে স্থানান্তরিত হবে। হাশরের বিভিন্ন মনযিল ও স্থান অতিক্রম করতে হবে। এক মনযিলে আল্লাহ তা'আলার নির্দেশে কিছু মুখমণ্ডলকে সাদা ও উজ্জ্বল করে দেয়া হবে এবং কিছু মুখমণ্ডলকে গাঢ় কৃষ্ণবৰ্ণ করে দেয়া হবে। অপর এক মনযিলে সমবেত সব মুমিন ও কাফেরকে গভীর অন্ধকার আচ্ছন্ন করে ফেলবে। কিছুই দৃষ্টিগোচর হবে না। এরপর নূর বণ্টন করা হবে। প্রত্যেক মুমিনকে নূর দেয়া হবে। মুনাফিক ও কাফেরকে নূর ব্যতীত অন্ধকারেই রেখে দেয়া হবে। আর এ উদাহরণই আল্লাহ তাঁর কুরআনে পেশ করেছেন। তিনি বলেছেন, “অথবা তাদের কাজ গভীর সাগরের তলের অন্ধকারের মত, যাকে আচ্ছন্ন করে তরঙ্গের উপর তরঙ্গ, যার উর্ধের মেঘপুঞ্জ, অন্ধকারপুঞ্জ স্তরের উপর স্তর, এমনকি সে হাত বের করলে তা আদৌ দেখতে পাবে না। আল্লাহ যাকে নূর দান করেন না তার জন্য কোন নূরই নেই।” [সূরা আন-নূর:৪০]

অত:পর যেভাবে অন্ধ ব্যক্তি চক্ষুম্মান ব্যক্তির চোখ দ্বারা দেখতে পায় না তেমনি কাফের ও মুনাফিক ঈমানদারের নূর দ্বারা আলোকিত হতে পারবে না। মুনাফিকরা ঈমানদারদের বলবে, “তোমরা আমাদের জন্য একটু থাম, যাতে আমরা তোমাদের নূরের কিছু গ্ৰহণ করতে পারি।” এভাবে আল্লাহ মুনাফিকদেরকে ধোঁকাগ্ৰস্থ করবেন। যেমন আল্লাহ বলেছেন, “তারা আল্লাহকে ধোঁকা দেয় আর আল্লাহ তাদেরকে ধোঁকা দিবেন।” [সূরা আন-নিসা: ১৪২] তারপর তারা যেখানে নূর বন্টন হয়েছিল সেখানে ফিরে যাবে, কিন্তু তারা কিছুই পাবেনা। ফলে তারা তখন ঈমানদারদের কাছে ফিরে আসবে, ইত্যবসরে উভয়ের মাঝামাঝি স্থাপিত হবে একটি প্রাচীর যাতে একটি দরজা থাকবে, ওটার ভিতরে থাকবে রহমত এবং বাইরে থাকবে শাস্তি। এভাবেই মুনাফিক ধোঁকাগ্ৰস্ত হতে থাকবে আর মুমিনদের মাঝে নূর বন্টিত হয়ে যাবে। [ইবনে কাসীর]

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, প্রত্যেক মুমিনকে তার আমল পরিমাণে নূর দেয়া হবে। ফলে কারও নূর পর্বতসম, কারও খর্জুর বৃক্ষসম এবং কারও মানবদেহসম হবে। সর্বাপেক্ষা কম নূর সেই ব্যক্তির হবে, যার কেবল বৃদ্ধাঙ্গুলিতে নূর থাকবে; তাও আবার কখনও জ্বলে উঠবে এবং কখনও নিভে যাবে- [ইবনে কাসীর]

৫৭ : ১৯
وَالَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ أُولَٰئِكَ هُمُ الصِّدِّيقُونَ ۖ وَالشُّهَدَاءُ عِنْدَ رَبِّهِمْ لَهُمْ أَجْرُهُمْ وَنُورُهُمْ ۖ وَالَّذِينَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا بِآيَاتِنَا أُولَٰئِكَ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ

আর যারা আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনে, তারাই সিদ্দীক [১]। আর শহীদ্গণ; তাদের জন্য রয়েছে তাদের রবের কাছে তাদের প্রাপ্য পুরস্কার ও নূর [২]। আর যারা কুফরী করেছে এবং আমাদের নিদর্শনসমূহে মিথ্যারোপ করেছে, তারাই জাহান্নামের অধিবাসী।

ফুটনোট

[১] এই আয়াত থেকে জানা গেল যে, প্রত্যেক মুমিনকে সিদ্দীক ও শহীদ বলা যায়। এই আয়াতের ভিত্তিতে কারও কারও মতে যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনয়ন করে, সেই সিদ্দীক ও শহীদ। কিন্তু পবিত্র কুরআনের অন্য একটি আয়াত থেকে বাহ্যতঃ বুঝা যায় যে, প্রত্যেক মুমিন সিদ্দীক ও শহীদ নয়; বরং মুমিনদের একটি উচ্চ শ্রেণীকে সিদ্দীক ও শহীদ বলা হয়। আয়াতটি এই,

وَمَن يُطِعِ اللَّهَ وَالرَّسُولَ فَأُولَٰئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِم مِّنَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِينَ ۚ وَحَسُنَ أُولَٰئِكَ رَفِيقًا

“আর কেউ আল্লাহ্‌ এবং রাসুলের আনুগত্য করলে সে নবী, সত্যনিষ্ঠ, শহীদ ও সৎকর্মপরায়ণ---যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন--তাদের সংগী হবে এবং তারা কত উত্তম সংগী!” [সূরা আন-নিসা: ৬৯] এই আয়াতে নবী-রাসূলগণের সাথে মুমিনদের তিনটি শ্রেণী বিশেষভাবে উল্লেখিত হয়েছে যথা, সিদীক, শহীদ ও ছালেহ। বাহ্যতঃ এই তিনটি ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণী। নতুবা ভিন্ন ভাবে বলার প্রয়োজন ছিল না। এ কারণেই কেউ কেউ বলেনঃ সিদ্দীক ও শহীদ প্রকৃতপক্ষে মুমিনদের বিশেষ উচ্চশ্রেণীর লোকগণকে বলা হয়, যারা মহান গুণগরিমার অধিকারী। [ইবন কাসীর; কুরতুবী] তাছাড়া কোন কোন হাদীস থেকেও এ তিন শ্রেণীর পার্থক্য ফুটে উঠে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “জান্নাতীরা তাদের উপরস্থিত খাস কামরায় অবস্থানকারীদের এমনভাবে দেখবে যেমন তোমরা পূর্ব বা পশ্চিম থেকে ধ্রুব তারাকে আকাশের প্রান্ত দেশে চলতে দেখতে পাও; দু'দলের মর্যাদাগত পার্থক্যের কারণে। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! তা কি নবীদের স্থান যেখানে অন্য কেউ পৌঁছতে পারবে না? তিনি বললেন, অবশ্যই হ্যাঁ, যার হাতে আমার আত্মা, তারা এমন কিছু লোক যারা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছে এবং রাসূলদের সত্যায়ন করেছে।” [বুখারী: ৩২৫৬, মুসলিম: ২৮৩১]

তবে আলোচ্য আয়াতে সব মুমিনকে সিদ্দীক ও শহীদ বলার তাৎপর্য এই যে, প্রত্যেক মুমিনকেও কোনো না কোনো দিক দিয়ে সিদ্দীক ও শহীদ বলে গণ্য এবং তাদের কাতারভুক্ত মনে করা হবে। কোন কোন মুফাসসির বলেন, আলোচ্য আয়াতে কামেল ও ইবাদতকারী মুমিন অর্থ নেওয়া সঙ্গত। নতুবা যে সব মুমিন অসাবধান ও খেয়ালখুশীতে মগ্ন তাদেরকে সিদ্দীক ও শহীদ বলা যায় না। এক হাদিস থেকেও এর সমর্থন পাওয়া যায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন “যারা মানুষের প্রতি অভিসম্পাত করে তারা শহীদদের অন্তর্ভুক্ত হবে না।” [মুসলিম: ২৫৯৮] ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু একবার উপস্থিত জনতাকে বললেনঃ তোমাদের কি হলো যে, তোমরা কাউকে অপরের ইযযতের উপর হামলা করতে দেখেও তাকে বাধা দাও না এবং তাকে খারাপ মনে কর না? জনতা আরয করলঃ আমরা কিছু বললে সে আমাদের ইযযতের উপরও হামলা চালাবে এই ভয়ে আমরা কিছু বলি না। ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেনঃ যারা এমন শিথিল, তারা সেই শহীদদের অন্তর্ভুক্ত হবে না, যারা কেয়ামতের দিন পূর্ববর্তী পয়গম্বরগণের উম্মতদের মোকাবেলায় সাক্ষ্য দিবে। কোন কোন মুফাসসির বলেন, আলোচ্য আয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আমলে যারা ঈমানদার হয়েছে এবং তার পবিত্ৰ সঙ্গলাভে ধন্য হয়েছে, তাদেরকেই বোঝানো হয়েছে।

[২] অর্থাৎ তাদের মধ্য থেকে যে যে মর্যাদার পুরষ্কার ও যে মর্যাদার ‘নূরের’ উপযুক্ত হবে সে তা পাবে। তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ পুরস্কার ও ‘নূর’ লাভ করবে। তাদের প্রাপ্য অংশ এখন থেকেই তাদের জন্য সংরক্ষিত আছে। [ইবন কাসীর]

৫৭ : ২৮
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَآمِنُوا بِرَسُولِهِ يُؤْتِكُمْ كِفْلَيْنِ مِنْ رَحْمَتِهِ وَيَجْعَلْ لَكُمْ نُورًا تَمْشُونَ بِهِ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ۚ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ

হে মুমিনগন ! আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বল কর এবং তাঁর রাসূলের উপর ঈমান আন। তিনি তাঁর অনুগ্রহে তোমাদেরকে দেবেন দ্বিগুন পুরুষ্কার [১] এবং তিনি তোমাদেরকে দেবেন নূর, যার সাহায্যে তোমারা চলবে [২] এবং তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আর আল্লাহ্‌ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

ফুটনোট

[১] এই আয়াতে ঈসা আলাইহিস সালাম-এর প্রতি ঈমানদার কিতাবী মুমিনগণকে সম্বোধন করা হয়েছে। যদিও يٰٓاَيُّهَاالَّذِيْنَ اٰمَنُوا বলে কেবল মুসলিমগণকে সম্বোধন করাই পবিত্র কুরআনের সাধারণ রীতি। কিন্তু আলোচ্য আয়াতে এই সাধারন রীতির বিপরীতে নাসারাদের জন্য يٰٓاَيُّهَاالَّذِيْنَ اٰمَنُوا শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। সম্ভবতঃ এর রহস্য এই যে, পরবর্তী বাক্যে তাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি ঈমান আনার আদেশ দেয়া হয়েছে। কারণ, এটাই ঈসা আলাইহিস সালাম-এর প্রতি বিশুদ্ধ ঈমানের দাবী। তারা যদি তা করে, তবে তারা উপরোক্ত সম্বোধনের যোগ্য হয়ে যাবে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলে তাদেরকে দ্বিগুণ পুরস্কার ও সওয়াব দানের ওয়াদা করা হয়েছে। [দেখুন, ফাতহুল কাদীর; কুরতুবী]

[২] অর্থাৎ পৃথিবীতে জ্ঞান ও দূরদৃষ্টির এমন “নূর” দান করবেন যার আলোতে তোমরা প্রতি পদক্ষেপে স্পষ্ট দেখতে পাবে জ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে জাহেলিয়াতের বাঁকা পথ-সমূহের মধ্যে ইসলামের সরল সোজা পথ কোন্‌টি। আর আখেরাতে এমন “নূর” দান করবেন যার মাধ্যমে পুল সিরাতের অন্ধকার রাস্তা পার হয়ে জান্নাতে যেতে পারবে। [দেখুন, কুরতুবী]

৫৭ :
هُوَ الَّذِي يُنَزِّلُ عَلَىٰ عَبْدِهِ آيَاتٍ بَيِّنَاتٍ لِيُخْرِجَكُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ ۚ وَإِنَّ اللَّهَ بِكُمْ لَرَءُوفٌ رَحِيمٌ

তিনিই তাঁর বান্দার প্রতি সুস্পষ্ট আয়াত নাযিল করেন, তোমাদেরকে অন্ধকার হতে আলোতে আনার জন্য। আর নিশ্চয় আল্লাহ্‌ তোমাদের প্রতি করুণাময়, পরম দয়ালু।
ফুটনোট

৬৪ :
فَآمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَالنُّورِ الَّذِي أَنْزَلْنَا ۚ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ

অতএব তোমরা আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও যে নূর আমরা নাযিল করেছি তাতে ঈমান আন [১]। আর তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে আল্লাহ্ সবিশেষ অবহিত।

ফুটনোট

[১] এখানে নূর বা জ্যোতি বলে কুরআনকে বোঝানো হয়েছে। [কুরতুবী]

৬৫ : ১১
رَسُولًا يَتْلُو عَلَيْكُمْ آيَاتِ اللَّهِ مُبَيِّنَاتٍ لِيُخْرِجَ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ ۚ وَمَنْ يُؤْمِنْ بِاللَّهِ وَيَعْمَلْ صَالِحًا يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ۖ قَدْ أَحْسَنَ اللَّهُ لَهُ رِزْقًا

এক রাসূল, যে তোমাদের কাছে আল্লাহর সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করে, যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করে তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোতে বের করে আনার জন্য। আর যে কেউ আল্লাহর উপর ঈমান আনবে এবং সৎকাজ করবে তিনি তাকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে ; আল্লাহ্‌ তো তাকে উত্তম রিযিক দেবেন।
ফুটনোট

৬৬ :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا تُوبُوا إِلَى اللَّهِ تَوْبَةً نَصُوحًا عَسَىٰ رَبُّكُمْ أَنْ يُكَفِّرَ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيُدْخِلَكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ يَوْمَ لَا يُخْزِي اللَّهُ النَّبِيَّ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ ۖ نُورُهُمْ يَسْعَىٰ بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَبِأَيْمَانِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا أَتْمِمْ لَنَا نُورَنَا وَاغْفِرْ لَنَا ۖ إِنَّكَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

হে মুমিনগণ ! তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা কার---বিশুদ্ধ তাওবা [১]; সম্ভবত তোমাদের রব তোমাদের পাপসমূহ মোচন করে দেবেন এবং তোমাদেরকে প্রবেশ করবেন জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। সেদিন আল্লাহ লাঞ্ছিত করবেন না নবীকে এবং তার সাথে যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে। তাদের নূর তাদের সামনে ও ডানে ধাবিত হবে। তারা বলবে, ‘হে আমাদের রব! আমাদের জন্য আমাদের নূরকে পূর্ণতা দান করুন এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন, নিশ্চয় আপনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।'

ফুটনোট

[১] তাওবার শাব্দিক অর্থ ফিরে আসা। উদ্দেশ্য গোনাহ থেকে ফিরে আসা। কুরআন ও সুন্নাহর পরিভাষায় তওবার অর্থ বিগত গোনাহের জন্যে অনুতপ্ত হওয়া এবং ভবিষ্যতে তার ধারে কাছে না যাওয়ার দৃঢ় সংকল্প করা। আয়াতে বর্ণিত نصوح শব্দটির বিভিন্ন অর্থ হয়ে থাকে। এক. যদি نصحة থেকে উদ্ভূত ধরা হয়, তবে এর অর্থ খাঁটি করা। আর যদি نصاحة থেকে উদ্ভূত ধরা হয়, তবে এর অর্থ বস্ত্র সেলাই করা ও তালি দেয়া। প্রথম অর্থের দিক দিয়ে "তাওবাতুন নাসূহ" এর অর্থ এমন তাওবা, যা রিয়া ও নাম-যশ থেকে খাঁটি-কেবল আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি অর্জন ও আযাবের ভয়ে ভীত হয়ে এবং গোনাহের কারণে অনুতপ্ত হয়ে গোনাহ পরিত্যাগ করা। দ্বিতীয় অর্থের দিক দিয়ে "তাওবাতুন নাসূহ" শব্দটি এই উদ্দেশ্য ব্যক্ত করার জন্যে হবে যে, গোনাহের কারণে সৎকর্মের ছিন্নবস্ত্রে তাওবা তালি সংযুক্ত করে। কোন কোন তাফসীরবিদ বলেনঃ “তাওবাতুন নাসূহ" হল মুখে ক্ষমাপ্রার্থনা করা, অন্তরে অনুশোচনা করা এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ভবিষ্যতে সেই গোনাহ থেকে দূরে রাখা। [দেখুন-কুরতুবী]

৭১ : ১৬
وَجَعَلَ الْقَمَرَ فِيهِنَّ نُورًا وَجَعَلَ الشَّمْسَ سِرَاجًا

‘আর সেখানে চাঁদকে স্থাপন করেছেন আলোকরূপে ও সূর্যকে স্থাপন করেছেন প্রদীপরূপে;
ফুটনোট

৭৭ :
فَإِذَا النُّجُومُ طُمِسَتْ

যখন নক্ষত্ররাজির আলো নির্বাপিত করা হবে,
ফুটনোট

: ১৭৪
يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَكُمْ بُرْهَانٌ مِنْ رَبِّكُمْ وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكُمْ نُورًا مُبِينًا

হে লোকসকল! তোমাদের রবের কাছ থেকে তোমাদের কাছে প্রমাণ এসেছে [১] এবং আমরা তোমাদের প্রতি স্পষ্ট জ্যোতি [২] নাযিল করেছি।

ফুটনোট

[১] ‘বুরহান’ শব্দের আভিধানিক অর্থ অকাট্য দলীল-প্রমাণ। এ আয়াতে এর দ্বারা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সত্তা ও মহান ব্যক্তিত্বকে বুঝানো হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহান ব্যক্তিত্বের জন্য ‘বুরহান’ শব্দ প্রয়োগ করার তাৎপর্য এই যে, তার বরকতময় সত্তা, অনুপম চরিত্র মাধুর্য, অপূর্ব মু’জিযাসমূহ, তার প্রতি বিস্ময়কর কিতাব আল-কুরআন নাযিল হওয়া ইত্যাদি তার রেসালাতের অকাট্য দলীল ও প্রকৃষ্ট প্রমাণ। যার পরে আর কোন সাক্ষ্য প্রমাণের আবশ্যক হয় না। অতএব, তার মহান ব্যক্তিত্বই তার সত্যতার অকাট্য প্রমাণ।

[২] আলোচ্য আয়াতে (نُوْر) (নূর) শব্দ দ্বারা কুরআন মাজীদকে বোঝানো হয়েছে। যেমন, সূরা আল-মায়েদার ১৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে,

(قَدْ جَاءَكُمْ مِّنَ اللّٰهِ نُوْرٌ وَّكِتٰبٌ مُّبِيْنٌ)

অর্থাৎ তোমাদের কাছে আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে এক উজ্জ্বল আলো তথা এক প্রকৃষ্ট কিতাব অর্থাৎ আল-কুরআন এসেছে। আবার নুর অর্থ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং আল-কুরআনও হতে পারে। তখন এর অর্থ হবে, হেদায়াতের নূর। যে আলোর ছোয়া লাগলে মানুষের হিদায়াত নসীব হয়। তবে তার অর্থ এই নয় যে, রাসূল স ল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানবীয় দৈহিকতা থেকে মুক্ত শুধু নূর ছিলেন, যেমনটি কোন কোন ভ্ৰষ্ট সম্প্রদায় বিশ্বাস করে থাকে।

0:00
0:00