হযরত ঈসা আঃ
হযরত ঈসা আঃ
: ৮৭
وَلَقَدْ آتَيْنَا مُوسَى الْكِتَابَ وَقَفَّيْنَا مِنْ بَعْدِهِ بِالرُّسُلِ ۖ وَآتَيْنَا عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ الْبَيِّنَاتِ وَأَيَّدْنَاهُ بِرُوحِ الْقُدُسِ ۗ أَفَكُلَّمَا جَاءَكُمْ رَسُولٌ بِمَا لَا تَهْوَىٰ أَنْفُسُكُمُ اسْتَكْبَرْتُمْ فَفَرِيقًا كَذَّبْتُمْ وَفَرِيقًا تَقْتُلُونَ

অবশ্যই আমরা মূসাকে কিতাব দিয়েছি এবং তার পরে পর্যায়ক্রমে রাসূলগণকে পাঠিয়েছি এবং আমরা মারইয়াম-পূত্র ‘ঈসা কে স্পষ্ট প্রমাণ দিয়েছি [১] এবং ‘রুহুল কুদুস’ [২] দ্বারা তাকে শক্তিশালী করেছি। তবে কি যখনি কোন রাসূল তোমাদের কাছে এমন কিছু এনেছে যা তোমাদের মনঃপুত নয় তখনি তোমরা অহংকার করেছো ? অতঃপর (নবীদের) একদলের উপর মিথ্যারোপ করেছো এবং একদলকে করেছো হত্যা ?

ফুটনোট

[১] এ আয়াতে ‘স্পষ্ট প্রমাণ' কি তা ব্যাখ্যা করে বলা হয়নি। তবে অন্য জায়গায় সেটা বলা হয়েছে, যেমন, "আর তাকে বনী ইসরাঈলের জন্য রাসূলরুপে (তিনি বলবেন) নিশ্চয় আমি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট নিদর্শন নিয়ে এসেছি যে, অবশ্যই আমি তোমাদের জন্য কাদামাটি দ্বারা একটি পাখি সদৃশ আকৃতি গঠন করব; তারপর তাতে আমি ফুঁ দেব; ফলে আল্লাহ্‌র হুকুমে সেটা পাখি হয়ে যাবে। আর আমি আল্লাহ্‌র হুকুমে জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্থকে নিরাময় করব এবং মৃতকে জীবিত করব। আর তোমরা তোমাদের ঘরে যা খাও এবং মজুদ কর তা আমি তোমাদেরকে জানিয়ে দেব। " [সূরা আলে ইমরানঃ ৪৯]

[২] কুরআন-হাদীসের বিভিন্ন জায়গায় জিবরাঈল ‘আলাইহিস সালাম-কে "রূহুল কুদুস’ বলা হয়েছে। যেমন, সূরা আশ-শু'আরা: ১৯৩, সূরা মারইয়াম: ১৭।

: ৪৫
إِذْ قَالَتِ الْمَلَائِكَةُ يَا مَرْيَمُ إِنَّ اللَّهَ يُبَشِّرُكِ بِكَلِمَةٍ مِنْهُ اسْمُهُ الْمَسِيحُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ وَجِيهًا فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَمِنَ الْمُقَرَّبِينَ

স্মরণ করুন, যখন ফেরেশ্‌তাগণ বললেন, ‘হে মারিয়াম! নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ আপনাকে তাঁর পক্ষ থেকে একটি কালেমার সুসংবাদ দিচ্ছেন [১]। তার নাম মসীহ্‌, মারিয়াম তনয় ঈসা, তিনি দুনিয়া ও আখেরাতে সম্মানিত এবং সান্নিধ্যপ্রাপ্তগণের অন্যতম হবেন [২]। ’

ফুটনোট

[১] কালেমা দ্বারা এখানে কি বুঝানো হয়েছে? কাতাদা বলেন, কালেমা দ্বারা (كُنْ) বা ‘হও’ শব্দ বোঝানো হয়েছে। [তাবারী] ঈসা ‘আলাইহিস সালামকে ‘কালেমাতুল্লাহ' বলার কারণ হচ্ছে এই যে, তিনি আল্লাহ্‌র কালেমা দ্বারা সৃষ্টি হয়েছেন। কেননা, ঈসা ‘আলাইহিস সালামের জন্মের ব্যাপারটি জাগতিক কোন মাধ্যম বাদেই সংঘটিত হয়েছে। আর আল্লাহ্‌ তাকে তাঁর নিদর্শন ও আশ্চৰ্যতম সৃষ্টি হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। তিনি জিবরাইল আলাইহিস সালামকে মারইয়্যামের নিকট পাঠালেন। জিবরাইল ‘আলাইহিস সালাম তার জামার ফাঁকে ফুঁ দিলেন। এ পবিত্র ফেরেশতার পবিত্র ফুঁ মারইয়ামের গর্ভে প্রবেশ করলে আল্লাহ্ তা'আলা সে ফুঁকটিকে পবিত্র রুহ হিসেবে পরিণত করলেন। আর এ জন্যই তাঁকে সম্মানিত করে ‘রুহুল্লাহ' বলা হয়ে থাকে। [তাফসীরে সা’দী]

[২] অর্থাৎ দুনিয়াতে তার সম্মান হবে অনেক বড়। কারণ, আল্লাহ্‌ তাকে দৃঢ়সংকল্প রাসূলদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। বড় শরীআত ও তার অনুসারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছেন। তার স্মরণকে এমনভাবে সারা দুনিয়াব্যাপী করেছেন যে, প্রাচ্য-প্রাশ্চাত্য তার সুনামে ভরপুর করে দিয়েছেন। অনুরূপভাবে আখেরাতেও তার মর্যাদা হবে অনেক বেশী অন্যান্য নবী-রাসূলদের সাথে তিনিও আল্লাহ্‌র কাছে সুপারিশ করবেন। তাঁকে আল্লাহ্‌ তা'আলা দুনিয়াতে যারা তার সম্পর্কে বিভ্রান্ত হয়েছে তাদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে তার মুখ থেকে সত্য বের করে বিশেষভাবে সম্মানিত করবেন। [তাফসীরে সা’দী]

: ৪৬
وَيُكَلِّمُ النَّاسَ فِي الْمَهْدِ وَكَهْلًا وَمِنَ الصَّالِحِينَ

আর তিনি দোলনায় [১] ও বয়োঃপ্রাপ্ত অবস্থায় মানুষের সাথে কথা বলবেন [২] এবং তিনি হবেন পুণ্যবানদের একজন। ’

ফুটনোট

[১] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘দোলনায় মাত্র তিন জন কথা বলেছেন। ঈসা, জুরাইজের সময়ের এক ছোট বাচ্চা আর একটি বাচ্চা’। [বুখারীঃ ২৪৮২, অনুরূপ ৩৪৩৬; মুসলিমঃ ২৫৫০]

দোলনায় তিনি কি কথা কাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন তা এখানে বর্ণনা করা হয়নি। অন্যত্র বলা হয়েছে যে, তিনি তার কাওমের লোকদেরকে তার নিজের পরিচয় দিয়ে তার মাকে বিব্রত অবস্থা থেকে রেহাই দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “আমি তো আল্লাহ্‌র বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন, আমাকে নবী করেছেন, ‘যেখানেই আমি থাকি না কেন তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন, তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যতদিন জীবিত থাকি ততদিন সালাত ও যাকাত আদায় করতে। ‘আর আমাকে আমার মায়ের প্রতি অনুগত করেছেন এবং তিনি আমাকে করেননি উদ্ধত, হতভাগ্য; ‘আমার প্রতি শান্তি যেদিন আমি জন্ম লাভ করেছি, যেদিন আমার মৃত্যু হবে এবং যেদিন জীবিত অবস্থায় আমি উখিত হব’। [সূরা মারইয়াম: ৩০-৩৩]

[২] আয়াতে বলা হয়েছে যে, ঈসা ‘আলাইহিস সালাম শৈশব ও পৌঢ় বয়সে মানুষের সাথে কথা বলবেন। নিঃসন্দেহে শৈশবে পূর্ণ বয়স্কদের মত জ্ঞানীসুলভ, মেধাসম্পন্ন প্রাঞ্জল ও বিশুদ্ধভাবে কথা বলা একটি মু'জিযা। কিন্তু তার সাথে ‘পৌঢ় বয়সে কথা বলার ব্যাপারটির কি সম্পর্ক থাকতে পারে? অধিকাংশ আলেমদের নিকট এর উত্তর এই যে, মূলত: শৈশব অবস্থায় কথা বলার মু'জিযা বর্ণনা করাই এখানে উদ্দেশ্য। তার সাথে পৌঢ় বয়সেও কথা বলবেন বলা দ্বারা উভয় অবস্থায়ই তার কথা পাণ্ডিত্যপূর্ণ ও জ্ঞানীসুলভ হবে এমনটি বোঝানো হয়েছে। কোন কোন আলেম বলেন, তিনি যেহেতু যুবক বয়সে পৌঢ় হবার পূর্বেই আসমানে উত্থিত হয়েছেন, সেহেতু এ আয়াত দ্বারা বোঝা যায় যে, তিনি পৌঢ় অবস্থায় আবার ফিরে এসে মানুষের সাথে কথা বলবেন। সুতরাং আবার ফিরে আসার ব্যাপারটি এ আয়াতের মাধ্যমেও প্রমাণিত হয়ে গেল। যা আরেকটি অলৌকিক ব্যাপার।

: ৪৭
قَالَتْ رَبِّ أَنَّىٰ يَكُونُ لِي وَلَدٌ وَلَمْ يَمْسَسْنِي بَشَرٌ ۖ قَالَ كَذَٰلِكِ اللَّهُ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ ۚ إِذَا قَضَىٰ أَمْرًا فَإِنَّمَا يَقُولُ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ

সে বলল, ‘হে আমার রব! আমাকে কোন পুরুষ স্পর্শ করেনি, এমতাবস্থায় আমার সন্তান হবে কিভাবে?’ তিনি (আল্লাহ্‌) বললেন, ‘এভাবেই’, আল্লাহ্‌ যা ইচ্ছে সৃষ্টি করেন। তিনি যখন কিছু স্থির করেন তখন বলেন, ‘হও’, ফলে তা হয়ে যায় [১]।

ফুটনোট

[১] এ আয়াতে মারইয়াম আলাইহাস সালাম কর্তৃক ঈসা ‘আলাইহিস সালামকে গর্ভে ধারনের বিষয়টির ইঙ্গিত রয়েছে। এর বিস্তারিত বর্ণনা সূরা মারইয়ামে বর্ণিত হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে, “বর্ণনা করুন এ কিতাবে মারইয়ামের কথা, যখন সে তার পরিবারবর্গ থেকে পৃথক হয়ে নিরালায় পূর্ব দিকে এক স্থানে আশ্রয় নিল, তারপর তাদের থেকে সে পর্দা করল। এরপর আমরা তার কাছে আমাদের রূহকে পাঠালাম, সে তার নিকট পূর্ণ মানবাকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করল। মারইয়াম বলল, আমি তোমার থেকে দয়াময়ের আশ্রয় প্রার্থনা করছি (আল্লাহ্‌কে ভয় কর) যদি তুমি ‘মুত্তাকী হও’, সে বলল, ‘আমি তো তোমার রব-এর দূত, তোমাকে এক পবিত্র পুত্র দান করার জন্য। মারইয়াম বলল, “কেমন করে আমার পুত্র হবে যখন আমাকে কোন পুরুষ স্পর্শ করেনি এবং আমি ব্যভিচারিণীও নই? সে বলল, “এ রূপই হবে।’ তোমার রব বলেছেন, “এটা আমার জন্য সহজসাধ্য এবং আমরা তাকে এজন্যে সৃষ্টি করব যেন সে হয় মানুষের জন্য এক নিদর্শন ও আমাদের কাছ থেকে এক অনুগ্রহ এটা তো এক স্থিরীকৃত ব্যাপার’। তারপর সে তাকে গর্ভে ধারণ করল; [১৬-২২]

এখানেও গর্ভে ধারনের প্রক্রিয়াটি কিভাবে সম্পন্ন হয়েছে সেটা বলা হয়নি। সূরা আল-আম্বিয়ায় বলা হয়েছে যে, “অতঃপর আমরা তার (মারইয়ামের) মধ্যে আমাদের পক্ষ থেকে রূহ ফুঁকে দিয়েছিলাম” [৯১]। আর যিনি রূহ ফুঁকে দেয়ার কাজটি করেছিলেন, তিনি ছিলেন জিবরীল আলাইহিস সালাম। কারণ, সূরা আলে ইমরান ও সূরা মারইয়ামের আয়াতসমূহ থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, মারইয়ামের কাছে যিনি এসেছিলেন, তিনি স্বয়ং জিবরাইল ‘আলাইহিস সালাম। এ সমস্ত বর্ণনা একত্রিত করলে ঈসা ‘আলাইহিস সালামের জন্মকাহিনী স্পষ্ট হয়ে পড়ে।

: ৪৮
وَيُعَلِّمُهُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَالتَّوْرَاةَ وَالْإِنْجِيلَ

আর তিনি তাকে শিক্ষা দেবেন কিতাব, হিকমত, তাওরাত ও ইঞ্জীল। ’
ফুটনোট

: ৪৯
وَرَسُولًا إِلَىٰ بَنِي إِسْرَائِيلَ أَنِّي قَدْ جِئْتُكُمْ بِآيَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ ۖ أَنِّي أَخْلُقُ لَكُمْ مِنَ الطِّينِ كَهَيْئَةِ الطَّيْرِ فَأَنْفُخُ فِيهِ فَيَكُونُ طَيْرًا بِإِذْنِ اللَّهِ ۖ وَأُبْرِئُ الْأَكْمَهَ وَالْأَبْرَصَ وَأُحْيِي الْمَوْتَىٰ بِإِذْنِ اللَّهِ ۖ وَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا تَأْكُلُونَ وَمَا تَدَّخِرُونَ فِي بُيُوتِكُمْ ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَةً لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ

আর তাকে বনী ইসরাঈলের জন্য রাসূলরূপে’ (প্রেরণ করবেন, তিনি বলবেন) ‘নিশ্চয় আমি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট নিদর্শন নিয়ে এসেছি যে, অবশ্যই আমি তোমাদের জন্য কাদামাটি দ্বারা একটি পাখিসদৃশ আকৃতি গঠন করব; তারপর তাতে আমি ফুঁ দেব; ফলে আল্লাহ্‌র হুকুমে সেটা পাখি হয়ে যাবে। আর আমি আল্লাহ্‌র হুকুমে জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্থকে নিরাময় করব এবং মৃতকে জীবিত করব। আর তোমরা তোমাদের ঘরে যা খাও এবং মজুদ কর তা আমি তোমাদেরকে জানিয়ে দেব। নিশ্চয় এতে তোমাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে যদি তোমরা মুমিন হও। ’
ফুটনোট

: ৫২
فَلَمَّا أَحَسَّ عِيسَىٰ مِنْهُمُ الْكُفْرَ قَالَ مَنْ أَنْصَارِي إِلَى اللَّهِ ۖ قَالَ الْحَوَارِيُّونَ نَحْنُ أَنْصَارُ اللَّهِ آمَنَّا بِاللَّهِ وَاشْهَدْ بِأَنَّا مُسْلِمُونَ

যখন ‘ঈসা তাদের থেকে কুফরী উপলব্ধি করলেন তখন তিনি বললেন, ‘আল্লাহ্‌র পথে কারা আমার সাহায্যকারী [১]?’ হাওয়ারীগণ [২] বলল, ‘আমরাই আল্লাহ্‌র সাহায্যকারী। আমরা আল্লাহ্‌তে ঈমান এনেছি। আর আপনি সাক্ষী থাকুন যে নিশ্চয় আমরা মুসলিম।

ফুটনোট

[১] এ আয়াতের দুটি অর্থ হতে পারে। মুজাহিদ বলেনঃ এর অর্থ হল কে আমার অনুসরণ করবে আল্লাহ্‌র পথে? সুফিয়ান সাওরী বলেনঃ এর অর্থ কে আল্লাহ্‌র সাথে আমাকে সহযোগিতা করবে? মুজাহিদের কথা এখানে সবচেয়ে বেশী প্রণিধানযোগ্য। তবে সবচেয়ে স্পষ্ট মত হল, এর অর্থ কে আমাকে সাহায্য করবে আল্লাহ্‌র পথে আহবানের ক্ষেত্রে। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ্জের মৌসুমে ডেকে ডেকে বলতেনঃ ‘এমন কে আছে যে আমাকে আশ্রয় দেবে, যাতে করে আমি আমার প্রভুর বাণী প্রচার করতে পারি। কেননা, কুরাইশরা আমাকে আমার রবের বাণী প্রচারে বাধা দিচ্ছে। [মুসনাদে আহমাদঃ ৩/৩৩৯-৩৪০]

[২] ঈসা ‘আলাইহিস সালামের খাঁটি ভক্তদের উপাধি ছিল হাওয়ারী- তাদের আন্তরিকতা ও মনের স্বচ্ছতার কারণে অথবা যেহেতু তারা সাদা পোষাক পরিধান করতেন এ জন্য তাদেরকে হাওয়ারী নামে অভিহিত করা হত। যেমন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু '‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সার্থীদের উপাধি ছিল সাহাবী। কোন কোন তাফসীরবিদ হাওয়ারীদের সংখ্যা দ্বাদশ উল্লেখ করেছেন। ‘হাওয়ারী’ শব্দটি কোন সময় শুধু সাহায্যকারী অর্থেও ব্যবহৃত হয়। এ অর্থেই এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ ‘প্রত্যেক রাসূলের একজন হাওয়ারী অর্থাৎ খাঁটি সহচর থাকে আমার হাওয়ারী হলেন যুবায়ের’
[বুখারীঃ ২৬৯১, মুসলিমঃ ২৪১৫]

: ৫৫
إِذْ قَالَ اللَّهُ يَا عِيسَىٰ إِنِّي مُتَوَفِّيكَ وَرَافِعُكَ إِلَيَّ وَمُطَهِّرُكَ مِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا وَجَاعِلُ الَّذِينَ اتَّبَعُوكَ فَوْقَ الَّذِينَ كَفَرُوا إِلَىٰ يَوْمِ الْقِيَامَةِ ۖ ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأَحْكُمُ بَيْنَكُمْ فِيمَا كُنْتُمْ فِيهِ تَخْتَلِفُونَ

স্মরণ করুন, যখন আল্লাহ্‌ বললেন, ‘হে ‘ঈসা! নিশ্চয় আমি আপনাকে পরিগ্রহণ করব [১], আমার নিকট আপনাকে উঠিয়ে নিব [২] এবং যারা কুফরী করে তাদের মধ্য থেকে আপনাকে পবিত্র করব। আর আপনার অনুসারিগণকে কেয়ামত পর্যন্ত প্রাধান্য দিব, তারপর আমার কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন। ’ অতঃপর যে বিষয়ে তোমাদের মতান্তর ঘটেছে আমি তোমাদের মধ্যে তা মীমাংসা করে দেব [৩]।

ফুটনোট

ষষ্ঠ রুকু‘

[১] (مُتَوَفِّيْكَ) শব্দের ধাতু (تَوفيق) এবং মূলধাতু (وفي) অভিধানে এর অর্থ পুরোপুরি লওয়া আরবী ভাষার সব অভিধান গ্রন্থেই এ অর্থ রয়েছে। মৃত্যুর সময় মানুষ নির্ধারিত আয়ুপূর্ণ করে ফেলে এবং আল্লাহ্‌ প্রদত্ত আত্মা পুরোপুরি নিয়ে নেয়া হয়। এ কারণে শব্দটি মৃত্যু অর্থেও ব্যবহৃত হয়। মানুষের দৈনন্দিন নিদ্রা মৃত্যুর একটি হাল্কা নমুনা। কুরআনে এ অর্থেও (توفي) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে-

(يَتَوَفَّى الْاَنْفُسَ حِيْنَ مَوْتِهَا وَالَّتِيْ لَمْ تَمُتْ فِيْ مَنَامِهَا)

অর্থাৎ"আল্লাহ্‌ মৃত্যুর সময় প্রাণ নিয়ে নেন। আর যাদের মৃত্যু আসে না, তাদের প্রাণও নিদ্রার সময় নিয়ে নেন। " [সূরা আয-যুমারঃ ৪২]
ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ (مُتَوَفِّيْكَ) এর অর্থ, আমি আপনাকে নিজের কাছে উঠিয়ে নেব এবং শেষ যামানায় স্বাভাবিক মৃত্যুদান করব। এ তাফসীরের সারমর্ম এই যে, (مُتَوَفِّيْكَ) শব্দের অর্থ মৃত্যু; কিন্তু আয়াতের শব্দে (رَافِعُكَ إليّ) প্রথমে ও (مُتَوَفِّيْكَ) পরে হবে। এখানে (مُتَوَفِّيْكَ) কে পূর্বে উল্লেখ করার কারণ এদিকে ইঙ্গিত করা যে, নিজের কাছে উঠিয়ে নেয়া চিরতরে নয়; বরং এ ব্যবস্থা কিছুদিনের জন্য হবে। এরপর তিনি আবার দুনিয়াতে আসবেন, শক্ৰদের পরাজিত করবেন এবং অবশেষে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করবেন। এভাবে আকাশ থেকে পুনর্বার অবতরণ এবং শক্রর বিরুদ্ধে জয়লাভের পর মৃত্যুবরণের ঘটনাটি একাধারে একটি মু'জিযা। এতদসঙ্গে ঈসা ‘আলাইহিস সালামের সম্মান ও মর্যাদার পূর্ণত্বলাভ এবং নাসারাদের এ বিশ্বাসের খণ্ডন যে, ঈসা ‘আলাইহিস সালাম অন্যতম উপাস্য। নতুবা জীবিত অবস্থায় আকাশে উত্থিত হওয়ার ঘটনা থেকে তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাস আরও জোরদার হয়ে যেত যে, তিনিও আল্লাহ্‌ তা'আলার মতই চিরঞ্জীব এবং ভালমন্দের নিয়ামক। এ কারণে প্রথমে (مُتَوَفِّيْكَ) বলে এসব ভ্রান্ত ধারণার মূলোৎপাটন করা হয়েছে। এরপর নিজের দিকে উঠিয়ে নেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

[২] এতে বাহ্যতঃ ঈসা ‘আলাইহিস সালামকেই সম্বোধন করে বলা হয়েছে যে, আপনাকে উপরে উঠিয়ে নেব। সবাই জানেন যে, ঈসা শুধু আত্মার নাম নয়; বরং আত্মা ও দেহ উভয়ের নাম কাজেই আয়াতে দৈহিক উত্তোলন বাদ দিয়ে শুধু আত্মিক উত্তোলন বুঝা সম্পূর্ন ভুল। কুরআনের অন্যত্রও ইয়াহুদীদের ভ্রান্ত বিশ্বাস খণ্ডন প্রসঙ্গে বলা হয়েছে (بَلْ رَّفَعَهُ اللّٰهُ اِلَيْهِ)" অর্থাৎ ইয়াহুদীরা নিশ্চিতই ঈসাকে হত্যা করেনি, বরং “আল্লাহ্‌ তাকে নিজের কাছে তুলে নিয়েছেন " [সূরা আন-নিসাঃ ১৫৮] “নিজের কাছে তুলে নেয়া” সশরীরে তুলে নেয়াকেই বলা হয়।

[৩] আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ্‌ তা'আলা ইয়াহুদীদের বিপক্ষে ঈসা ‘আলাইহিস সালামের সাথে পাঁচটি অঙ্গীকার করেছেনঃ

সর্বপ্রথম অঙ্গীকার এই যে, তার মৃত্যু ইয়াহুদীদের হাতে হত্যার মাধ্যমে হবে না; বরং প্রতিশ্রুত সময়ে স্বাভাবিক পস্থায় হবে। প্রতিশ্রুত সময়টি কেয়ামতের নিকটতম যামানায় আসবে তখন ঈসা ‘আলাইহিস সালাম আকাশ থেকে পৃথিবীতে অবতরণ করবেন। বিভিন্ন সহীহ ও মুতাওয়াতির হাদীসে এর বিবরণ রয়েছে। দ্বিতীয় অঙ্গীকার ছিল যে, ঈসা ‘আলাইহিস সালামকে আপাততঃ উর্ধ্ব জগতে তুলে নেয়া হবে। সাথে সাথে এ অঙ্গীকার পূর্ণ করা হয়। তৃতীয় অঙ্গীকার ছিল শক্ৰদের অপবাদ থেকে মুক্ত করা। এ অঙ্গীকার এভাবে পূর্ণ হয়েছে যে, শেষ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগমন করে ইয়াহুদীদের যাবতীয় অপবাদ দূর করে দেন। উদাহরণতঃ পিতা ব্যতিরেকে জন্মগ্রহণ করার কারণে ইয়াহুদীরা ঈসা ‘আলাইহিস সালামের জন্ম বিষয়ে অপবাদ আরোপ করত। কুরআন এ অভিযোগ খণ্ডন করে বলেছে যে, তিনি আল্লাহ্‌র কুদরত ও নির্দেশে পিতা ব্যতিরেকে জন্মগ্রহণ করেছেন। এটা কোন বিস্ময়কর ব্যাপার নয়। আদমের জন্মগ্রহণ ছিল আরো বেশী বিস্ময়কর ব্যাপার। কারণ, তিনি পিতা ও মাতা উভয় ব্যতিরেকেই জন্মগ্রহণ করেন। ইয়াহুদীরা ঈসা ‘আলাইহিস সালামের বিরুদ্ধে ইলাহ হওয়ার দাবী করার অভিযোগও এনেছিল। কুরআনের অনেক আয়াতে এর বিপরীতে ঈসা ‘আলাইহিস সালামের বন্দেগী ও মানবত্বের স্বীকারোক্তি বর্ণিত হয়েছে। চতুর্থ অঙ্গীকারে বলা হয়েছে, অবিশ্বাসীর বিপক্ষে আপনার অনুসারীদের কেয়ামত পর্যন্ত বিজয়ী রাখা হবে। আয়াতে অনুসরণের অর্থ ঈসা ‘আলাইহিস সালামের নবুওয়াতে বিশ্বাস করা ও স্বীকারোক্তি করা। এর জন্য যাবতীয় বিধি-বিধানে বিশ্বাস করা শর্ত নয়। এভাবে নাসারা ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায় তার অনুসারীদের অন্তর্ভুক্ত। কারণ, মুসলিমরাও ঈসা ‘আলাইহিস সালামের নবুওয়াতে বিশ্বাসী। এটা ভিন্ন কথা যে, এতটুকু বিশ্বাসই আখেরাতের মুক্তির জন্য যথেষ্ট নয়; বরং ঈসা ‘আলাইহিস সালামের যাবতীয় বিধি-বিধানে বিশ্বাস করার উপর আখেরাতের মুক্তি নির্ভরশীল। ঈসা ‘আলাইহিস সালামের অকাট্য বিধানাবলীর মধ্যে একটি ছিল এই যে, পরবর্তীকালে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিও ঈমান আনতে হবে। নাসারারা এটি পালন করেনি। ফলে তারা আখেরাতের মুক্তি থেকে বঞ্চিত। মুসলিমরা এটিও পালন করেছে। ফলে তারা আখেরাতে মুক্তির অধিকারী হয়েছে। পঞ্চম অঙ্গীকার এই যে, কেয়ামতের দিন সব ধর্মীয় মতবিরোধের মীমাংসা করা হবে। সময় এলে এ অঙ্গীকারও পূর্ণ হবে।

: ৫৯
إِنَّ مَثَلَ عِيسَىٰ عِنْدَ اللَّهِ كَمَثَلِ آدَمَ ۖ خَلَقَهُ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ قَالَ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ

নিশ্চয় আল্লাহ্‌র নিকট ‘ঈসার দৃষ্টান্ত আদমের দৃষ্টান্তসদৃশ। তিনি তাকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছিলেন; তারপর তাকে বলেছিলেন, ‘হও’, ফলে তিনি হয়ে যান।
ফুটনোট

: ১৫৭
وَقَوْلِهِمْ إِنَّا قَتَلْنَا الْمَسِيحَ عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ رَسُولَ اللَّهِ وَمَا قَتَلُوهُ وَمَا صَلَبُوهُ وَلَٰكِنْ شُبِّهَ لَهُمْ ۚ وَإِنَّ الَّذِينَ اخْتَلَفُوا فِيهِ لَفِي شَكٍّ مِنْهُ ۚ مَا لَهُمْ بِهِ مِنْ عِلْمٍ إِلَّا اتِّبَاعَ الظَّنِّ ۚ وَمَا قَتَلُوهُ يَقِينًا

আর ‘আমরা আল্লাহর রাসূল মারঈয়াম তনয় ‘ঈসা মসীহকে হত্যা করেছি’ তাদের এ উক্তির জন্য। অথচ তারা তাকে হত্যা করেনি এবং ক্রুশবিদ্ধও করেনি; বরং তাদের জন্য (এক লোককে) তার সদৃশ করা হয়েছিল [১]। আর নিশ্চয় যারা তার সম্বন্ধে মতভেদ করেছিল, তারা অবশ্যই এ সম্বন্ধে সংশয়যুক্ত ছিল; এ সম্পর্কে অনুমানের অনুসরণ ছাড়া তাদের কোন জ্ঞানই ছিল না। আর এটা নিশ্চিত যে, তারা তাঁকে হত্যা করেনি,

ফুটনোট

[১] এখানে স্পষ্ট ঘোষণা করা হয়েছে যে, ওরা ঈসা ‘আলাইহিস সালাম-কে হত্যাও করতে পারেনি, শুলেও চড়াতে পারেনি, বরং আসলে ওরা সন্দেহে পতিত হয়েছিল। কিন্তু তাদের সন্দেহ কি ছিল এ ব্যাপারে বিভিন্ন বর্ণনা এসেছে, সব বর্ণনার সার কথা হচ্ছে, ইয়াহুদীরা যখন ঈসা ‘আলাইহিস সালাম-কে হত্যা করতে বদ্ধপরিকর হলো, তখন তার ভক্ত-সহচরবৃন্দ এক স্থানে সমবেত হলেন। ঈসা ‘আলাইহিস সালামও সেখানে উপস্থিত হলেন। তখন চার হাজার ইয়াহুদী দূরাচার একযোগে গৃহ অবরোধ করলো। তখন ঈসা ‘আলাইহিস সালাম স্বীয় ভক্ত অনুচরগণকে সম্বোধন করে বললেন, তোমাদের মধ্য থেকে কেউ এই ঘর থেকে বের হতে ও নিহত হতে এবং আখেরাতে জান্নাতে আমার সাথী হতে প্রস্তুত আছো কি? জনৈক ভক্ত আত্মোৎসর্গের জন্য উঠে দাঁড়ালেন। ঈসা ‘আলাইহিস সালাম নিজের জামা ও পাগড়ী তাঁকে পরিধান করালেন। অতঃপর তাঁকে ঈসা ‘আলাইহিস সালাম-এর সাদৃশ করে দেয়া হলো। যখন তিনি ঘর থেকে বের হলেন, তখন ইয়াহুদীরা ঈসা ‘আলাইহিস সালাম মনে করে তাঁকে বন্দী করে নিয়ে গেল এবং শুলে চড়িয়ে হত্যা করলো। অপরদিকে ঈসা ‘আলাইহিস সালাম-কে আল্লাহ্ তা’আলা আসমানে তুলে নিলেন।
এক বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, ইয়াহুদীরা এক লোককে ঈসা ‘আলাইহিস সালাম-কে হত্যা করার জন্য পাঠিয়েছিল। কিন্তু ইতোপূর্বে আল্লাহ্ তা'আলা তাঁকে আকাশে তুলে নেয়ায় সে তার নাগাল পেল না। বরং ইতিমধ্যে তার নিজের চেহারা ঈসা ‘আলাইহিস সালাম-এর মত হয়ে গেল। ব্যর্থ মনোরথ হয়ে সে যখন ঘর থেকে বেরিয়ে এল তখন অন্যান্য ইয়াহুদীরা তাকেই ঈসা ‘আলাইহিস সালাম মনে করে পাকড়াও করলো, এবং শুলে বিদ্ধ করে হত্যা করলো। উক্ত বর্ণনা দু’টির মধ্যে যে কোনটিই সত্য হতে পারে। কুরআনুল কারীম এ সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু ব্যক্ত করেনি। অতএব, প্রকৃত ঘটনার সঠিক খবর একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাই জানেন। অবশ্য কুরআনুল কারীমের আয়াত ও তাফসীর সংক্রান্ত বর্ণনার সমন্বয়ে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, প্রকৃত ঘটনা ইয়াহুদী-খৃষ্টানদেরও অজ্ঞাত ছিল। তারা চরম বিভ্রান্তির আবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়ে শুধু অনুমান করে বিভিন্ন উক্তি ও দাবী করছিল। ফলে উপস্থিত লোকদের মধ্যেই চরম মতভেদ ও বিবাদের সৃষ্টি হয়েছিল। তাই কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে যে, যারা ঈসা ‘আলাইহিস সালাম সম্পর্কে নানা মত পোষন করে নিশ্চয় এ ব্যাপারে তারা সন্দেহে পতিত হয়েছে। তাদের কাছে এ সম্পর্কে কোন সত্যনির্ভর জ্ঞান নেই। তারা শুধু অনুমান করে কথা বলে। আর তারা যে ঈসা ‘আলাইহিস সালাম-কে হত্যা করেনি, এ কথা সুনিশ্চিত। বরং আল্লাহ্ তা’আলা তাকে নিরাপদে নিজের কাছে তুলে নিয়েছেন।

কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, সম্বিত ফিরে পাওয়ার পর কিছু লোক বললো, আমরা তো নিজেদের লোককেই হত্যা করে ফেলেছি। কেননা, নিহত ব্যক্তির মুখমণ্ডল ঈসা ‘আলাইহিস সালাম-এর মত হলেও তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অন্য রকম। তদুপরি এ ব্যক্তি যদি ঈসা ‘আলাইহিস সালাম হয়, তবে আমাদের প্রেরিত লোকটি গেল কোথায়? আর এ ব্যক্তি আমাদের হলে ঈসা ‘আলাইহিস সালামই বা কোথায় গেলেন? মোটকথা: ঈসা ‘আলাইহিস সালাম সম্পর্কে ইয়াহুদী ও নাসারা যারাই কথা বলে তারাই বিভ্রান্তিতে লিপ্ত। তাদের কাছে এ ব্যাপারে কোন জ্ঞান নেই।

: ১৫৮
بَلْ رَفَعَهُ اللَّهُ إِلَيْهِ ۚ وَكَانَ اللَّهُ عَزِيزًا حَكِيمًا

বরং আল্লাহ তাকে তাঁর নিকট তুলে নিয়েছেন এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় [১]।

ফুটনোট

[১] “আল্লাহ অতি পরাক্রমশালী, হিকমতওয়ালা (প্রজ্ঞাময়)।“ ইয়াহুদীরা ঈসা ‘আলাইহিস সালাম-কে হত্যা করার যত ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তই করুক না কেন, সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা’আলা যখন তাঁর হেফাযতের নিশ্চয়তা দিয়েছেন তখন তাঁর অসীম কুদরত ও অপার হেকমতের সামনে ওদের অপচেষ্টার কি মূল্য আছে? আল্লাহ্ তা’আলা প্রজ্ঞাময়, তাঁর প্রতিটি কাজে নিগূঢ় রহস্য বিদ্যমান রয়েছে। জড়পূজারী বস্তুবাদীরা যদি ঈসা ‘আলাইহিস সালাম-কে সশরীরে আকাশে উত্তোলনের সত্যটি উপলব্ধি করতে না পারে, তবে তা তাদেরই দুর্বলতার প্রমাণ।

: ১৫৯
وَإِنْ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ إِلَّا لَيُؤْمِنَنَّ بِهِ قَبْلَ مَوْتِهِ ۖ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يَكُونُ عَلَيْهِمْ شَهِيدًا

কিতাবীদের মধ্য থেকে প্রত্যেকে তার মৃত্যুর পূর্বে [১] তার উপর ঈমান আনবেই। আর কেয়ামতের দিন তিনি তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী হবেন [২]।

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ ইয়াহুদীরা ঈর্ষা, বিদ্বেষ ও শক্রতার কারণে তাৎক্ষণিকভাবে যদিও নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে চিন্তা করে না এবং ঈসা ‘আলাইহিস সালাম সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে, এমনকি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়তকেও অস্বীকার করে, কিন্তু তাদের মৃত্যুর পূর্বে এমন এক সময় আসবে, যখন তাদের দৃষ্টির সম্মুখে সত্য উন্মোচিত হবে, তখন তারা যথার্থই বুঝতে পারবে যে, ঈসা ‘আলাইহিস সালাম ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে তাদের ধারণা একান্তই ভ্রান্তিপূর্ণ ছিল। এ আয়াতের (موته) অর্থাৎ ‘মৃত্যুর পূর্বে’ শব্দে ইয়াহুদীদের মৃত্যুর দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এমতাবস্থায় অত্র আয়াতের তাফসীর এই যে, প্রত্যেক ইয়াহুদীই তার অন্তিম মুহুর্তে যখন আখেরাতের দৃশ্যাবলী অবলোকন করবে, তখন ঈসা ‘আলাইহিস সালাম-এর নবুওয়তের সত্যতা ও নিজেদের বাতুলতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে এবং তার প্রতি ঈমান আনয়ন করতে বাধ্য হবে। কিন্তু তখনকার ঈমান তাদের আদৌ কোন উপকারে আসবে না; যেমন লোহিত সাগরে ডুবে মরার সময় ফিরআওনের ঈমান ফলপ্রসূ হয়নি। এ আয়াতের দ্বিতীয় তাফসীর যা সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীগণের বিপুল জামা’আত কর্তৃক গৃহীত ও সহীহ হাদীস দ্বারা সমর্থিত হয়েছে, তা হলো (موته) ‘তার মৃত্যু’ শব্দের সর্বনামে ঈসা ‘আলাইহিস সালাম-এর মৃত্যু বোঝানো হয়েছে। এমতাবস্থায় অত্র আয়াতের তাফসীর হলো, কিতাবীরা এখন যদিও ঈসা ‘আলাইহিস সালাম-এর প্রতি সত্যিকার ঈমান আনে না, ইয়াহুদীরা তো তাকে নবী বলে স্বীকারই করে না, বরং ভণ্ড, মিথ্যাবাদী ইত্যকার আপত্তিকর বিশেষণে ভূষিত করে। অপরদিকে নাসারারা যদিও ঈসা মসীহ্‌ ‘আলাইহিস সালাম-কে ভক্তি ও মান্য করার দাবীদার; কিন্তু তাদের মধ্যে একদল ইয়াহুদীদের মতই ঈসা ‘আলাইহিস সালাম-এর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার এবং মৃত্যুবরণ করার কথায় স্বীকৃতি প্রদান করে চরম মূর্খতার পরিচয় দিচ্ছে। তাদের আরেক দল অতিভক্তি দেখাতে গিয়ে ঈসা ‘আলাইহিস সালাম-কে স্বয়ং আল্লাহ বা আল্লাহর পুত্র বলে ধারণা করে বসেছে। কুরআনুল কারীমের এই আয়াতে ভবিষ্যদ্বানী করা হয়েছে যে, ইয়াহুদী ও নাসারারা বর্তমানে যদিও ঈসা ‘আলাইহিস সালাম-এর প্রতি যথাযথ ঈমান রাখে না, বরং শৈথিল্য বা বাড়াবাড়ি করে, কিন্তু কিয়ামতের নিকটবর্তী যুগে তিনি যখন পুনরায় পৃথিবীতে অবতরণ করবেন, তখন এরাও তাঁর প্রতি পুরোপুরি ঈমান আনয়ন করবে। নাসারারা তখন মুসলিমদের মত সহীহ আকীদা ও বিশ্বাসের সাথে ঈমানদার হবে। ইয়াহুদীদের মধ্যে যারা তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করবে, তাদেরকে নিধন ও নিশ্চিহ্ন করা হবে, অবশিষ্টরা ইসলাম গ্রহণ করবে। তখন সমগ্র দুনিয়া থেকে সর্বপ্রকার কুফরী ধ্যান-ধারণা, আচার-অনুষ্ঠান উৎক্ষিপ্ত হয়ে যাবে; সর্বত্র ইসলামের একচ্ছত্র প্রাধান্য কায়েম হবে। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ঈসা ইবন মারইয়াম ‘আলাইহিস সালাম একজন ন্যায়পরায়ণ শাসকরূপে অবশ্যই অবতরণ করবেন। তিনি দাজ্জালকে কতল করবেন, শুকর নিধন করবেন এবং ক্রুশকে চুরমার করবেন। তখন একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদাত করা হবে।’ আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু আরো বলেন – ‘তোমরা ইচ্ছা করলে এখানে কুরআনুল কারীমের এ আয়াত পাঠ করতে পার যাতে বলা হয়েছেঃ “আহলে-কিতাবদের মধ্যে কেউ অবশিষ্ট থাকবে না, বরং ওরা তাঁর মৃত্যুর পূর্বে অবশ্যই তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে”। [বুখারীঃ ৩৪৪৮]

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ এর অর্থ ঈসা ‘আলাইহিস সালাম-এর মৃত্যুর পূর্বে’। এ বাক্যটি তিনি তিনবার উচ্চারণ করেন। অন্য এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘তখন তোমাদের কেমন লাগবে? যখন ঈসা ‘আলাইহিস সালাম তোমাদের মাঝে আগমন করবেন এবং তোমাদের মধ্য থেকে ঈমাম হবেন’। [বুখারীঃ ৩৪৪৯]

অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ! ‘অবশ্যই ইবন মারইয়াম ‘ফাজ্জ আর রাওহা’ থেকে হজ্জ বা উমরা অথবা উভয়টির জন্যই ইহরাম বাঁধবেন।‘ [মুসলিম: ১২৫২]

অন্য হাদীসে এসেছে, ‘ইবন মারইয়াম দাজ্জালকে ‘বাবে লুদ’ এ হত্যা করবে’। [তিরমিয়ী: ২২৪৪] মোটকথা: কিয়ামতের পূর্বে ঈসা ‘আলাইহিস সালামের আগমনের ব্যাপারটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। যখন তিনি আসবেন তখন সমস্ত বিভ্রান্ত নাসারা ঈসা ‘আলাইহিস সালামের ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সমর্থ হবে।

[২] কাতাদা বলেন, এর অর্থ তিনি সাক্ষ্য দিবেন যে, তিনি তাদের কাছে তার রবের রিসালত পৌছে দিয়েছেন এবং তিনি যে বান্দা এ কথার স্বীকৃতি প্রদান করবেন। [তাবারী]

: ১৬৩
إِنَّا أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ كَمَا أَوْحَيْنَا إِلَىٰ نُوحٍ وَالنَّبِيِّينَ مِنْ بَعْدِهِ ۚ وَأَوْحَيْنَا إِلَىٰ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ وَالْأَسْبَاطِ وَعِيسَىٰ وَأَيُّوبَ وَيُونُسَ وَهَارُونَ وَسُلَيْمَانَ ۚ وَآتَيْنَا دَاوُودَ زَبُورًا

নিশ্চয় আমরা আপনার নিকট ওহী প্রেরণ করেছিলাম [১], যেমন নূহ ও তার পরবর্তী নবীগণের প্রতি ওহী প্রেরণ করেছিলাম [২], আর ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়া’কূব ও তার বংশধরগণ, ঈসা, আইউব, ইউনুস, হারূন ও সুলাইমানের নিকটও ওহী প্রেরণ করেছিলাম এবং দাউদকে প্রদান করেছিলাম যাবূর।

ফুটনোট

তেইশতম রুকূ‘

[১] নবীগণের প্রতি প্রেরিত আল্লাহ তা'আলার বিশেষ নির্দেশ ও বাণীকে ওহী বলা হয়। হারিস ইবন হিশাম রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনার নিকট অহী কিভাবে আসে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ অহী কোন কোন সময় ঘন্টার আওয়াজের মত আমার নিকট আসে। আর ওটাই আমার পক্ষে সবচেয়ে কষ্টদায়ক অহী, এরপর ফেরেশতা আমার থেকে পৃথক হতো এমতাবস্থায় যে, তিনি যা বলেন তা শেষ হতেই তার কাছ থেকে আমি তা আয়ত্ব করে ফেলি। আবার কোন কোন সময় ফেরেশতা মানুষের আকারে এসে আমাকে যে অহী বলেন, আমি তা সাথে সাথে আয়ত্ব করে নেই। [বুখারীঃ ২]

[২] এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, পূর্ববতী নবীগণের প্রতি যেমন আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী নাযিল হয়েছিল, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিও তেমনি আল্লাহ্ তা’আলা ওহী নাযিল করেছেন। অতএব, পূর্ববর্তী নবীগণকে যারা মান্য করে, তারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কেও মান্য করতে বাধ্য। আর যারা তাকে অস্বীকার করে তারা যেন অন্যসব নবীকে এবং তাদের প্রতি প্রেরিত ওহীকেও অস্বীকার করলো।

: ১৭১
يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لَا تَغْلُوا فِي دِينِكُمْ وَلَا تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ إِلَّا الْحَقَّ ۚ إِنَّمَا الْمَسِيحُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ رَسُولُ اللَّهِ وَكَلِمَتُهُ أَلْقَاهَا إِلَىٰ مَرْيَمَ وَرُوحٌ مِنْهُ ۖ فَآمِنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ ۖ وَلَا تَقُولُوا ثَلَاثَةٌ ۚ انْتَهُوا خَيْرًا لَكُمْ ۚ إِنَّمَا اللَّهُ إِلَٰهٌ وَاحِدٌ ۖ سُبْحَانَهُ أَنْ يَكُونَ لَهُ وَلَدٌ ۘ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ ۗ وَكَفَىٰ بِاللَّهِ وَكِيلًا

হে কিতাবীরা! স্বীয় দ্বীনের মধ্যে তোমরা বাড়াবাড়ি করো না [১] এবং আল্লাহর উপর সত্য ব্যতীত কিছু বলো না। মারইয়াম-তনয় ঈসা মসীহ কেবল আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর বাণী [২], যা তিনি মারইয়ামের কাছে পাঠিয়েছিলেন ও তাঁর পক্ষ থেকে রূহ। কাজেই তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলদের উপর ঈমান আন এবং বলো না, ‘তিন [৩] !’ নিবৃত্ত হও, এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর হবে। আল্লাহই তো এক ইলাহ; তাঁর সন্তান হবে - - -তিনি এটা থেকে পবিত্র-মহান। আসমানসমূহে যা কিছু আছে ও যমীনে যা কিছু আছে সব আল্লাহরই; আর কর্মবিধায়করূপে আল্লাহই যথেষ্ট [৪]।

ফুটনোট

[১] (غُلُوّ) শব্দের অর্থ সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া। অর্থাৎ দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করার অর্থ তার ন্যায়সঙ্গত সীমারেখা অতিক্রম করা । আহলে কিতাব অর্থাৎ ইয়াহুদী-নাসারা উভয় জাতিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, দ্বীনের ব্যাপারে কোনরূপ বাড়াবাড়ি করো না। কারণ এ বাড়াবাড়ি রোগে উভয় জাতিই আক্রান্ত হয়েছে। নাসারারা ঈসা ‘আলাইহিস সালাম-কে ভক্তি-শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছে। তাকে স্বয়ং আল্লাহ, আল্লাহর পুত্র অথবা তিনের এক আল্লাহ বানিয়ে দিয়েছে। অপরদিকে ইয়াহুদীরা তাকে অমান্য ও প্রত্যাখ্যান করার দিক দিয়ে বাড়াবাড়ি পথ অবলম্বন করেছে। তারা ঈসা ‘আলাইহিস সালাম-কে আল্লাহর নবী হিসেবে স্বীকার করেনি। বরং তাঁর মাতা মারইয়াম ‘আলাইহিস সালাম-এর উপর মারাত্মক অপবাদ আরোপ করেছে এবং তার নিন্দাবাদ করেছে। দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবড়ি ও সীমালংঘনের কারণে ইয়াহুদী ও নাসারাদের গোমরাহী ও ধ্বংস হওয়ার শোচনীয় পরিণতি বার বার প্রত্যক্ষ হয়েছে। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রিয় উম্মতকে এ ব্যাপারে সংযত থাকার জন্য সতর্ক করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন ‘তোমরা আমার প্রশংসা করতে গিয়ে এমন অতিরঞ্জিত করো না, যেমন নাসারারা ঈসা ইবন মারইয়াম ‘আলাইহিমুস্ সালাম-এর ব্যাপারে করেছে। স্মরণ রাখবে যে, আমি আল্লাহর বান্দা। অতএব, আমাকে আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল বলবে’। [বুখারীঃ ৩৪৪৫]

অর্থাৎ আল্লাহর বান্দা ও মানুষ হিসেবে আমিও অন্য লোকদের সমপর্যায়ের। তবে আমার সবচেয়ে বড় মর্যাদা এই যে, আমি আল্লাহর রাসূল। এর চেয়ে অগ্রসর করে আমাকে আল্লাহ্ তা’আলার কোন বিশেষণে বিশেষিত করা বাড়াবাড়ি বৈ নয়। তোমরা ইয়াহুদী-নাসারাদের মতো বাড়াবাড়ি করো না। হাদীসে এসেছে যে, হজের সময় ‘রমীয়ে জামারাহ’ অর্থাৎ কংকর নিক্ষেপের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা-কে কংকর আনতে আদেশ করলেন। তিনি মাঝারি আকারের পাথরকুচি নিয়ে এলে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত পছন্দ করলেন এবং বললেন, ‘এ ধরণের মাঝারী আকারের কংকর নিক্ষেপ করাই পছন্দনীয়’। বাক্যটি তিনি দু’বার বললেন। তারপর বললেন, ‘তোমরা দ্বীনের মধ্যে বাড়াবাড়ি থেকে দূরে থেকো। কেননা, তোমাদের পূর্ববতী উম্মতসমূহ তাদের দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করার কারণেই ধ্বংস হয়েছে’। [ইবন মাজাহ: ৩০২৯]

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন একটি কাজ করলেন যাতে ‘রুখসত’ বা ছাড় ছিল। কিন্তু কিছু লোক সেটা করতে অপছন্দ করল। সেটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পৌঁছলে তিনি আল্লাহর হামদ ও প্রশংসার পর বললেন, কিছু লোকের এ কি অবস্থা হয়েছে যে, তারা আমি যা করছি তা করা থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়? আল্লাহর শপথ, আল্লাহর ব্যাপারে আমি তাদের থেকে সবচেয়ে বেশী জানি এবং তাদের থেকেও বেশী আল্লাহর ভয় করি। [বুখারী: ৭৩০১]

[২] এখানে ‘কালেমাতুহু’ শব্দে বাতলে দেয়া হয়েছে যে, ঈসা ‘আলাইহিস সালাম আল্লাহর কালেমা। মুফাসসিরগণ এর বিভিন্ন অর্থ বর্ণনা করেছেন-
(এক) ‘কালেমাতুল্লাহ’ অর্থ আল্লাহর সুসংবাদ। এর দ্বারা ঈসা ‘আলাইহিস সালাম-এর ব্যক্তি-সত্তাকে বোঝানো হয়েছে। ইতোপূর্বে আল্লাহ তা’আলা ফিরিশতার মাধ্যমে মারইয়াম ‘আলাইহিস সালামকে ঈসা ‘আলাইহিস সালাম সম্পর্কে যে সুসংবাদ দান করেছিলেন সেখানে ‘কালেমা’ শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে। বলা হয়েছে,

(اِذْ قَالَتِ الْمَلٰۗىِٕكَةُ يٰمَرْيَمُ اِنَّ اللّٰهَ يُبَشِّرُكِ بِكَلِمَةٍ)

“যখন ফিরিশতারা বললো, হে মারইয়াম! নিশ্চয় আল্লাহ তোমাকে সুসংবাদ দিচ্ছেন এক ‘কালেমা’র”। [সূরা আলে-ইমরানঃ ৪৫] (দুই) কারো মতে এখানে ‘কালেমা’ অর্থ নিদর্শন। যেমন অন্য এক আয়াতে শব্দটি নিদর্শন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যথা: (وَصَدَّقَتْ بِكَلِمٰتِ رَبِّهَا) [সূরা আত-তাহরীম: ১২] তাই আল্লাহ্ তা’আলা কর্তৃক মারইয়ামের প্রতি কালেমা পাঠাবার অর্থ হচ্ছে এই যে, আল্লাহ তা’আলা মারইয়াম আলাইহাস সালামের গর্ভাধারকে কোন পুরুষের শুক্ৰকীটের সহায়তা ছাড়াই গর্ভধারণের হুকুম দিলেন। সে হিসেবে ঈসা ‘আলাইহিস সালাম শুধু আল্লাহর কালেমা বা নির্দেশে চিরাচরিত প্রথার বিপরীতে পিতার মাধ্যম ছাড়াই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। (তিন) কাতাদা বলেন, কালেমা দ্বারা (كُنْ) বা ‘হও’ শব্দ বোঝানো হয়েছে। [তাবারী] ঈসা ‘আলাইহিস সালামকে ‘কালেমাতুল্লাহ’ বলার কারণ হচ্ছে এই যে, ঈসা ‘আলাইহিস সালামের জন্মের ব্যাপারটি জাগতিক কোন মাধ্যম বাদেই আল্লাহর কালেমা দ্বারা সংঘটিত হয়েছে। এখানে তাকে ‘আল্লাহর কালাম’ বলে বিশেষভাবে উল্লেখ করে সম্মানিত করাই উদ্দেশ্য। নতুবা সবকিছুই আল্লাহর কালেমার মাধ্যমেই হয়। তাঁর কালেমা ব্যতীত কিছুই হয় না। আল্লাহ ঈসা ‘আলাইহিস সালামকে তাঁর নিদর্শন ও আশ্চৰ্যতম সৃষ্টি হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। তিনি জিবরাইল ‘আলাইহিস সালামকে মারইয়ামের নিকট পাঠালেন। জিবরাইল ‘আলাইহিস সালাম তার জামার ফাঁকে ফু দিলেন। এ পবিত্র ফেরেশতার পবিত্র ফুঁ মারইয়ামের গর্ভে প্রবেশ করলে আল্লাহ তা’আলা সে ফুঁকটিকে পবিত্র রুহ হিসেবে পরিণত করলেন। আর এ জন্যই তাঁকে সম্মানিত করে ‘রুহুল্লাহ’ বলা হয়ে থাকে। [তাফসীরে সা’দী]

[৩] কুরআন নাযিলের সমসাময়িক কালে খৃষ্টানরা যেসব উপদলে বিভক্ত ছিল, তন্মধ্যে ত্রিত্ববাদ সম্পর্কে তাদের ধর্মবিশ্বাস তিনটি ভিন্ন ভিন্ন মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। এক দল মনে করতো- মসীহই আল্লাহ। স্বয়ং আল্লাহই মসীহরূপে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন। দ্বিতীয় দল বলতো -মসীহ পুত্র। তৃতীয় দলের বিশ্বাস ছিল -তিন সদস্যের সমন্বয়ে আল্লাহর একক পরিবার। এ দলটি আবার দু’টি উপদলে বিভক্ত ছিল। এক দলের মতে পিতা, পুত্র ও মারইয়াম এ তিনের সমন্বয়ে এক আল্লাহ। অন্য একদলের মতে মারইয়াম ‘আলাইহিস সালাম-এর পরিবর্তে ‘রূহুল কুদুস’ বা পবিত্র আত্মা জিবরাঈল ‘আলাইহিস সালাম ছিলেন তিন আল্লাহর একজন। মোটকথা, খৃষ্টানরা ঈসা ‘আলাইহিস সালাম-কে তিনের এক আল্লাহ মনে করতো। তাদের ভ্রান্তি অপনোদনের জন্য কুরআনুল কারীমে প্রত্যেকটি উপদলকে ভিন্ন ভিন্নভাবে সম্বোধন করা হয়েছে এবং সম্মিলিতভাবেও সম্বোধন করা হয়েছে। তাদের সামনে স্পষ্ট ও জোরালোভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে, সত্য একটিই। আর তা হলো ঈসা মসীহ ‘আলাইহিস সালাম তার মাতা মারইয়াম ‘আলাইহিস সালাম -এর গর্ভে জন্মগ্রহণকারী একজন মানুষ ও আল্লাহ্ তা’আলার সত্য রাসূল। এর অতিরিক্ত তাঁর সম্পর্কে যা কিছু বলা বা ধারণা করা হয়, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও বাতিল। তাঁর প্রতি ইয়াহুদীদের মত অবজ্ঞা বা ঈর্ষা পোষণ করা অথবা খৃষ্টানদের মত অতিভক্তি প্রদর্শন করা সমভাবে নিন্দনীয় ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কুরআনুল কারীমের অসংখ্য আয়াতে একদিকে ইয়াহুদী-খৃষ্টানদের পথভ্রষ্টতা দৃঢ়ভাবে প্রকাশ করা হয়েছে, অপরদিকে আল্লাহ্ তা’আলার দরবারে ঈসা ‘আলাইহিস সালাম-এর উচ্চ মর্যাদা ও বিশেষ সম্মানের অধিকারী হওয়ার কথাও জোরালোভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে। ফলে অবজ্ঞা ও অতিভক্তি দু’টি পরস্পর বিরোধী ভ্রান্ত মতবাদের মধ্যবর্তী সত্য ও ন্যায়ের সঠিক পথ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

[৪] অর্থাৎ আকাশ ও যমীনের উপর হতে নীচে পর্যন্ত যাকিছু আছে সবই আল্লাহ তা'আলার সৃষ্টি ও তাঁর বান্দা। অতএব, তাঁর কোন অংশীদার বা পুত্র-পরিজন হতে পারে না। আল্লাহ তা’আলা একাই সর্বকার্য সম্পাদনকারী এবং সকলের কার্য সম্পাদনের জন্য তিনি একাই যথেষ্ট; অন্য কারো সাহায্য-সহযোগীতার প্রয়োজন নেই। তিনি একক, তাঁর কোন অংশীদার বা পুত্র-পরিজন থাকতে পারে না। সারকথা, কোন সৃষ্ট ব্যক্তিরই স্রষ্টার অংশীদার হওয়ার যোগ্যতা নেই। আল্লাহ তা’আলার পবিত্র সত্তার জন্য এর অবকাশও নেই, প্রয়োজনও নেই। অতএব, একমাত্র বিবেকবর্জিত, ঈমান হতে বঞ্চিত ব্যক্তি ছাড়া আল্লাহ্ তা’আলার সৃষ্ট কোন জীবকে তাঁর অংশীদার বা পুত্র বলা অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়।

: ১৭২
لَنْ يَسْتَنْكِفَ الْمَسِيحُ أَنْ يَكُونَ عَبْدًا لِلَّهِ وَلَا الْمَلَائِكَةُ الْمُقَرَّبُونَ ۚ وَمَنْ يَسْتَنْكِفْ عَنْ عِبَادَتِهِ وَيَسْتَكْبِرْ فَسَيَحْشُرُهُمْ إِلَيْهِ جَمِيعًا

মসীহ আল্লাহর বান্দা হওয়াকে কখনো হেয় মনে করেন না, এবং ঘনিষ্ঠ ফেরেশ্‌তাগণও করে না। আর কেউ তাঁর ইবাদাতকে হেয় জ্ঞান করলে এবং অহংকার করলে তিনি অচিরেই তাদের সবাইকে তাঁর কাছে একত্র করবেন [১]।

ফুটনোট

চব্বিশতম রুকূ‘

[১] ঈসা ‘আলাইহিস সালাম স্বয়ং এবং আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য লাভকারী ফিরিশতাগণ কখনো আল্লাহর বান্দারূপে পরিচিত হতে লজ্জা বা অপমান বোধ করেন না। কারণ, আল্লাহর দাসত্ব ও গোলামী করা, তার ইবাদাত-বন্দেগী করা, আদেশ-নিষেধ পালন করা অতি মর্যাদা, গৌরব ও সৌভাগ্যের বিষয়। ঈসা মসীহ ‘আলাইহিস সালাম ও জিবরাঈল ‘আলাইহিস সালাম প্রমূখ বিশিষ্ট ফিরিশতাগণ এ সম্পর্কে উত্তমরূপে অবহিত রয়েছেন। তাই এতে তাদের কোন লজ্জা নেই। আসলে আল্লাহ তা’আলা ছাড়া অন্য কারো দাসত্ব বা গোলামী করাই লজ্জা বা অমর্যাদার কাজ। যেমন, নাসারারা ঈসা মসীহ ‘আলাইহিস সালাম-কে আল্লাহর পুত্র ও অন্যতম উপাস্য সাব্যস্ত করেছে এবং মুশরিকরা ফিরিশতাদেরকে আল্লাহর কন্যা ও দেবী সাব্যস্ত করে তাদের মূর্তি তৈরী করে পূজা-আৰ্চনা শুরু করেছে। অতএব, তাদের জন্য চিরস্থায়ী শাস্তি ও অপমান অবধারিত রয়েছে। পক্ষান্তরে যারা সঠিকভাবে ঈমান আনবে এবং একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে তাদের জন্য পুরস্কার রয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘যে বক্তি এ সাক্ষ্য প্রদান করে যে, আল্লাহ ব্যতীত আর সত্য কোন মা’বুদ নেই। তিনি এক এবং তার কোন শরীক নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল আর ঈসা ‘আলাইহিস সালাম আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল এবং সে কালেমা যা তিনি মারইয়াম আলাইহাস সালাম-এর মধ্যে পৌঁছিয়েছেন এবং তার পক্ষ থেকে রূহ বিশেষ। আর এও ঈমান আনে যে, জান্নাত সত্য ও জাহান্নাম সত্য। তার আমল যা-ই হোক না কেন, আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। [বুখারীঃ ৩৪৩৫]

: ১৭
لَقَدْ كَفَرَ الَّذِينَ قَالُوا إِنَّ اللَّهَ هُوَ الْمَسِيحُ ابْنُ مَرْيَمَ ۚ قُلْ فَمَنْ يَمْلِكُ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا إِنْ أَرَادَ أَنْ يُهْلِكَ الْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَأُمَّهُ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا ۗ وَلِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا ۚ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ ۚ وَاللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

যারা বলে, ‘নিশ্চয় মারইয়াম-তনয় মসীহই আল্লাহ’, তারা অবশ্যই কুফরী করেছে [১]। বলুন, ‘আল্লাহ যদি মারইয়াম-তনয় মসীহ, তাঁর মাতা এবং দুনিয়ার সকলকে ধ্বংস করতে ইচ্ছে করেন তবে তাঁকে বাঁধা দেবার শক্তি কার আছে?’ আর আসমানসমূহ ও যমীন এবং এ দুয়ের মধ্যে যা কিছু আছে তার সার্বভৌমত্ব আল্লাহরই। তিনি যা ইচ্ছে সৃষ্টি করেন [২] এবং আল্লাহ সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।

ফুটনোট

[১] আলোচ্য আয়াতে নাসারাদের একটি উক্তির খণ্ডন করা হয়েছে- যা তাদের একদলের বিশ্বাসও ছিল। অর্থাৎ তাদের একদলের বিশ্বাস ছিল যে, ঈসা মসীহ হুবহু আল্লাহ। কিন্তু আয়াতে যে যুক্তি দ্বারা বিষয়টির খণ্ডন করা হয়েছে, তাতে নাসারাদের সব দলের একত্ববাদ বিরোধী ভ্রান্ত বিশ্বাসেরই খণ্ডন হয়ে যায়, তা মসীহ ‘আলাইহিস সালামের আল্লাহর সন্তান হওয়া সংক্রান্ত বিশ্বাসই হোক অথবা তিন ইলাহর অন্যতম ইলাহ হওয়ার বিশ্বাসই হোক। আল্লাহ তা’আলা বলছেন যে, যদি তিনি ঈসা ও তার মা মারইয়ামকে মারতে ইচ্ছা করেন, তবে কি এমন কেউ আছে যে তাদেরকে মৃত্যু থেকে বাঁচাতে পারে? তারা নিজেরাও সেটা করতে সক্ষম নয়। সুতরাং তারা কিভাবে ইলাহ হতে পারে? আল্লাহ তা'আলার সামনে মসীহ ‘আলাইহিস সালাম এতই অক্ষম যে, তিনি নিজেকে রক্ষা করতে পারেন না এবং যে জননীর খেদমত ও হেফাযত তার কাছে প্রাণের চেয়েও প্রিয়, সে জননীকেও রক্ষা করতে পারেন না। সুতরাং তিনিই কিভাবে ইলাহ হতে পারেন। আর তার মা যেহেতু মারা গেছেন সেহেতু কিভাবেই বা তিনি তিন ইলাহর অন্যতম ইলাহ বলে বিবেচিত হবেন? [তাফসীর মুয়াস্সার ও সা’দী]

[২] ‘তিনি যা ইচ্ছে সৃষ্টি করেন’ এ বাক্যে নাসারাদের পূর্বোক্ত ভ্রান্ত বিশ্বাসের কারণকে খণ্ডন করা হয়েছে। কেননা, মসীহকে আল্লাহ মনে করার আসল কারণ তাদের মতে এই ছিল যে, তিনি জগতের সাধারণ নিয়মের বিপরীতে পিতা ছাড়া শুধুমাত্র মায়ের গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণ করেছেন। তিনি মানুষ হলে নিয়মানুযায়ী পিতা-মাতা উভয়ের মাধ্যমে জন্মগ্রহণ করতেন। আলোচ্য বাক্যে এর উত্তর দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহ তা'আলা যাকে ইচ্ছা, যেভাবে ইচ্ছা সৃষ্টি করার পূর্ণ ক্ষমতা রাখেন। যেমন অন্যত্র বলেছেন যে, “ঈসার উদাহরণ তো আদমের মত” [সূরা আলে-ইমরানঃ ৫৯] এ আয়াতেও উক্ত সন্দেহের নিরসন করা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহর সাধারণ নিয়মের বাইরে মসীহ ‘আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা তার ইলাহ হওয়ার প্রমাণ হতে পারে না। লক্ষণীয় যে, আদমকে আল্লাহ তা’আলা পিতা ও মাতা উভয়ের মাধ্যম ছাড়াই সৃষ্টি করেছিলেন। সুতরাং আল্লাহ সবকিছুই করতে পারেন। তিনিই স্রষ্টা, রব ও উপাসনার যোগ্য। অন্য কেউ তার অংশীদার নয়। [সা’দী; মুয়াস্সার; ইবন কাসীর]

: ৭২
لَقَدْ كَفَرَ الَّذِينَ قَالُوا إِنَّ اللَّهَ هُوَ الْمَسِيحُ ابْنُ مَرْيَمَ ۖ وَقَالَ الْمَسِيحُ يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ اعْبُدُوا اللَّهَ رَبِّي وَرَبَّكُمْ ۖ إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ ۖ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنْصَارٍ

যারা বলে, নিশ্চয় আল্লাহ্‌ তিনি তো মার্‌ইয়াম-তনয় মসীহ’, অবশ্যই তারা কুফরী করেছে [১]। অথচ মসীহ বলেছিলেন, ‘হে ইসরাঈল-সন্তানগণ! তোমরা আমার রব ও তোমাদের রব আল্লাহর ইবাদত কর’। নিশ্চয় কেউ আল্লাহর সাথে শরীক করলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত অবশ্যই হারাম করে দিয়েছেন [২] এবং তার আবাস হবে জাহান্নাম। আর যালেমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই।

ফুটনোট

[১] পূর্ববর্তী আয়াতসমূহে বনী-ইসরাঈলের ঔদ্ধত্য ও তাদের অত্যাচার-উৎপীড়ন বর্ণনা করা হয়েছিল যে, আল্লাহ প্রেরিত রাসূল- যারা তাদের অক্ষয় জীবনের বার্তা এবং তাদের দুনিয়া ও আখেরাত সংশোধনের কার্যবিধি নিয়ে আগমন করেছিলেন, তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের পরিবর্তে তারা তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করে। কতক নবীকে তারা মিথ্যারোপ করে এবং কতককে হত্যা করে ফেলে। আলোচ্য আয়াতে বনী-ইসরাঈলের কুটিলতার আরেকটি দিক উল্লেখ করা হয়েছে যে, মূৰ্খরা যেমন ঔদ্ধত্য ও অবাধ্যতার এক প্রান্তে থেকে আল্লাহর নবীদের প্রতি মিথ্যারোপ করেছে এবং কতককে হত্যা করেছে, তেমনি এরাই বক্রতার অপর প্রান্তে পৌঁছে নবীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে বাড়াবাড়ি করে তাদেরকে আল্লাহ্‌তে পরিণত করে দিয়েছে। তারা বলে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ্‌ তিনি তো মারইয়াম তনয় মসীহ’ এ কথা বলে তারা কুফরী করল এবং কাফের হয়ে গেল। ইতিহাস বলে যে, যারা এ ধরণের উক্তি করত তারা হচ্ছে, নাসারাদের মালেকিয়্যা, ইয়া’কুবিয়্যা এবং নাসতুরিয়্যাহ সম্প্রদায়। [ইবন কাসীর] আলোচ্য আয়াতে যদিও এ উক্তিটি শুধু নাসারাদের বলে বর্ণিত হয়েছে। অন্যত্র এ ধরণের বাড়াবাড়ি ও পথভ্রষ্টতা ইয়াহুদী এবং নাসারা উভয়ের ব্যাপারেও বর্ণনা করা হয়েছে,

(وَقَالَتِ الْيَهُوْدُ عُزَيْرُۨ ابْنُ اللّٰهِ وَقَالَتِ النَّصٰرَى الْمَسِيْحُ ابْنُ اللّٰهِ ۭ ذٰلِكَ قَوْلُهُمْ بِاَفْوَاهِهِمْ ۚ يُضَاهِــــُٔـوْنَ قَوْلَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا مِنْ قَبْلُ ۭ قٰتَلَهُمُ اللّٰهُ اَنّٰى يُؤْفَكُوْنَ )

অর্থাৎ “আর ইয়াহুদীরা বলে, ‘উযায়র আল্লাহর পুত্র’, এবং খৃস্টানরা বলে, ‘মসীহ আল্লাহর পুত্র’। ওটা তাদের মুখের কথা। আগে যারা কুফরী করেছিল ওরা তাদের মত কথা বলে। আল্লাহ ওদেরকে ধ্বংস করুন। কোন্‌ দিকে তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে?” [সূরা আত-তাওবাহঃ ৩০]

[২] অর্থাৎ নাসারারা যতই বাড়াবাড়ি করুক এবং ঈসাকে তাদের ইলাহ ঘোষণা করুক, ঈসা এতে কখনও সন্তুষ্ট নন। তিনি নিজেই এর বিপরীত ঘোষণা করেছিলেন। দুনিয়ায় আসার পর দোলনাতেই তার মুখের প্রথম কথা ছিল, (اِنِّىْ عَبْدُ اللّٰهِ) অর্থাৎ আমি তো আল্লাহর বান্দা বা দাস। [সূরা মারইয়াম: ৩০]

তিনি আরও বলেছিলেন, আমার ও তোমাদের রব একমাত্র আল্লাহ। তাঁরই ইবাদাত কর। সরল সঠিক পথ এটিই। [সূরা আলে ইমরান: ৫১; মারইয়াম: ৩৬; আযযুখরুফ: ৬৪]

তাছাড়া যৌবনের পরবর্তী বয়সেও বলেছেন, তোমরা আল্লাহরই ইবাদাত কর, যারা তাঁর সাথে অন্য কারও ইবাদাত করে তাদের জন্যে আল্লাহ জান্নাত হারাম করেছেন এবং তার ঠিকানা হবে জাহান্নামে । যেমন অন্য আয়াতেও আল্লাহ বলেছেন, “আল্লাহ শির্কের গোনাহ কখনও ক্ষমা করবেন না” [সূরা আন-নিসা ৪৮, ১১৬]

অনুরূপভাবে জাহান্নামবাসীরা যখন জান্নাতবাসীদের কাছে খাদ্য ও পানি চাইবে, তখন তারা উত্তরে বলবে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ এ দুটি জিনিস কাফেরদের উপর হারাম করে দিয়েছেন’। [সূরা আল-আরাফ: ৫০]

হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করতে বলেছেন যে, ‘শুধু মুমিন মুসলিমরাই জান্নাতে যাবে’। [মুসলিম: ১১১]

আরও বলেছেন, ‘যতক্ষণ তোমরা ঈমানদার না হবে ততক্ষণ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না’। [মুসলিম: ৫৪] সুতরাং ঈসা ‘আলাইহিস সালাম কখনোও ইলাহ হওয়ার দাবী করেন নি এবং এটা তার পক্ষে শোভনীয়ও নয়। [ইবন কাসীর]

: ৭৫
مَا الْمَسِيحُ ابْنُ مَرْيَمَ إِلَّا رَسُولٌ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ وَأُمُّهُ صِدِّيقَةٌ ۖ كَانَا يَأْكُلَانِ الطَّعَامَ ۗ انْظُرْ كَيْفَ نُبَيِّنُ لَهُمُ الْآيَاتِ ثُمَّ انْظُرْ أَنَّىٰ يُؤْفَكُونَ

মারইয়াম-তনয় মসীহ শুধু একজন রাসূল। তার আগে বহু রাসূল গত হয়েছেন [১] এবং তাঁর মা অত্যন্ত সত্য নিষ্ঠা ছিলেন। তারা দুজনেই খাওয়া-দাওয়া করতেন [২]। দেখনু আমরা তাদের জন্য আয়াতগুলোকে কেমন বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করি; তারপরও দেখুন, তারা কিভাবে সত্যবিমুখ হয়!

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ অন্যান্য নবী যেমন দুনিয়াতে আগমন করার পর কিছুদিন অবস্থান করে চলে গেছেন; কাজেই তিনি উপাস্য হতে পারেন না। তিনি অন্যান্য নবী-রাসূলদের মতই একজন মানুষ। একজন রাসূলের বেশী তো তিনি কিছু নন। তবে আল্লাহ তাকে বনী-ইসরাঈলদের জন্য নিদর্শন বানিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, “তিনি তো কেবল আমারই এক বান্দা, যার উপর আমরা অনুগ্রহ করেছিলাম এবং তাকে বানিয়েছিলাম বনী ইসরাঈলের জন্য দৃষ্টান্ত”। [সূরা আয-যুখরুফ ৫৯] [ইবন কাসীর]

[২] যে ব্যক্তি পানাহারের মুখাপেক্ষী সে পৃথিবীর সবকিছুরই মুখাপেক্ষী। মাটি, বাতাস, পানি, সূর্য এবং জীবজন্তু থেকে সে অমুখাপেক্ষী হতে পারে না। পরমুখাপেক্ষীতার এ দীর্ঘ পরম্পরার প্রতি লক্ষ্য রেখে আমরা মসীহ ও মারইয়ামের উপাস্যতা খণ্ডণকল্পে যুক্তির আকারে এরূপ বলতে পারি, মসীহ ও মারইয়াম পানাহারের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র থেকে মুক্ত ছিলেন না। এ বিষয়টি চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা ও লোক পরম্পরা দ্বারা প্রমাণিত। আর যে পানাহার থেকে মুক্ত নয়, যে সত্তা মানব-মণ্ডলীর মত স্বীয় অস্তিত্ব রক্ষার্থে বস্তুজগতের মুখাপেক্ষী, সে কিভাবে আল্লাহ হতে পারে? এ শক্তিশালী ও সুস্পষ্ট যুক্তিটি জ্ঞানী ও মূখ সবাই সমভাবে বুঝতে পারে। অর্থাৎ পানাহার করা উপাস্য হওয়ার পরিপন্থী- [বাগভী, ইবন কাসীর, সা’দী, আইসারুত তাফাসীর]

: ১১০
إِذْ قَالَ اللَّهُ يَا عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ اذْكُرْ نِعْمَتِي عَلَيْكَ وَعَلَىٰ وَالِدَتِكَ إِذْ أَيَّدْتُكَ بِرُوحِ الْقُدُسِ تُكَلِّمُ النَّاسَ فِي الْمَهْدِ وَكَهْلًا ۖ وَإِذْ عَلَّمْتُكَ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَالتَّوْرَاةَ وَالْإِنْجِيلَ ۖ وَإِذْ تَخْلُقُ مِنَ الطِّينِ كَهَيْئَةِ الطَّيْرِ بِإِذْنِي فَتَنْفُخُ فِيهَا فَتَكُونُ طَيْرًا بِإِذْنِي ۖ وَتُبْرِئُ الْأَكْمَهَ وَالْأَبْرَصَ بِإِذْنِي ۖ وَإِذْ تُخْرِجُ الْمَوْتَىٰ بِإِذْنِي ۖ وَإِذْ كَفَفْتُ بَنِي إِسْرَائِيلَ عَنْكَ إِذْ جِئْتَهُمْ بِالْبَيِّنَاتِ فَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْهُمْ إِنْ هَٰذَا إِلَّا سِحْرٌ مُبِينٌ

স্মরণ করুন,যখন আল্লাহ্‌ বলবেন, ‘ হে মারইয়ামের পুত্র ‘ঈসা ! আপনার প্রতি ও আপনার জননীর প্রতি আমার নেয়ামত [১] স্মরণ করুন,যখন ‘রুহুল কুদুস [২] দিয়ে আমি আপনাকে শক্তিশালী করেছিলাম এবং আপনি দোলনায় থাকা অবস্থায় ও পরিণত বয়সে মানুষের সাথে কথা বলতেন; আপনাকে কিতাব ,হিকমত,তাওরাত ও ইঞ্জীল শিক্ষা দিয়েছিলাম; আপনি কাদামাটি দিয়ে আমার অনুমতিক্রমে পাখির মত আকৃতি গঠন করতেন এবং তাতে ফুঁ দিতেন,ফলে আমার অনুমতিক্রমে তা পাখি হয়ে যেত; জন্মান্ধ ও কুষ্ঠরোগীদেরকে আপনি আমার অনুমতিক্রমে নিরাময় করতেন এবং আমার অনুমতিক্রমে আপনি মৃতকে জীবিত করতেন; আর যখন আমি আপনার থেকে ইসরাঈল-সন্তানকে বিরত রেখেছিলাম [৩]; আপনি যখন তাদের কাছে স্পষ্ট নিদর্শন এনেছিলেন তখন তাদের মধ্যে যারা কুফরী করেছিলো তারা বলেছিল, ‘এটাতো স্পষ্ট জাদু।’

ফুটনোট

[১] আলোচ্য আয়াতসমূহে ঈসা ‘আলাইহিস সালামের ঐসব অনুগ্রহের বিষয় উল্লেখিত হয়েছে, যা বিশেষভাবে ঈসা আলাইহিস সালামকে মু'জিযার আকার দেয়া হয়। এতে একদিকে বিশেষ অনুগ্রহ ও অপরদিকে জবাবদিহির দৃশ্যের অবতারণা করে বনী-ইসরাঈলের ঐ জাতিদ্বয়কে হুশিয়ার করা হয়েছে, যাদের এক জাতি তাকে অপমানিত করে এবং নানা অপবাদ আরোপ করে কষ্ট দেয় এবং অন্য জাতি আল্লাহ' কিংবা 'আল্লাহর পুত্র' আখ্যা দেয়। [আইসারুত তাফসীর]

[২] রুহুল কুদুস অর্থ, পবিত্র আত্মা। এর দ্বারা জীবরিল আলাইহিস সালামকেই উদ্দেশ্য নেয়া হয়ে থাকে। কুরআন ও সুন্নাহয় এ অর্থেই ‘রুহুল কুদুস’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। [যেমন, সুরা বাকারাহ:৮৭, ২৫৩; সূরা মায়েদাহ ১১০; সূরা আন-নাহল: ১০২]

[৩] অর্থাৎ তারা যখন আপনাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল, তখন আমি তাদের হাত থেকে আপনাকে হেফাযত করে আপনাকে আকাশে উঠিয়ে নিয়েছিলাম। অথচ আপনি তাদের কাছে প্রকাশ্য মু'জিযা নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। মুয়াসসার]

: ১১৬
وَإِذْ قَالَ اللَّهُ يَا عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ أَأَنْتَ قُلْتَ لِلنَّاسِ اتَّخِذُونِي وَأُمِّيَ إِلَٰهَيْنِ مِنْ دُونِ اللَّهِ ۖ قَالَ سُبْحَانَكَ مَا يَكُونُ لِي أَنْ أَقُولَ مَا لَيْسَ لِي بِحَقٍّ ۚ إِنْ كُنْتُ قُلْتُهُ فَقَدْ عَلِمْتَهُ ۚ تَعْلَمُ مَا فِي نَفْسِي وَلَا أَعْلَمُ مَا فِي نَفْسِكَ ۚ إِنَّكَ أَنْتَ عَلَّامُ الْغُيُوبِ

আরও স্মরণ করুন, আল্লাহ্‌ যখন বলবেন, ‘হে মারইয়াম –তনয় ‘ঈসা! আপনি কি লোকদেরকে বলেছিলেন যে, তোমরা আল্লাহ্‌ ছাড়া আমাকে আমার জননীকে দুই ইলাহরূপে গ্রহণ কর? ‘তিনি বলবেন, ‘আপনিই মহিমান্বিত! যা বলার অধিকার আমার নেই তা বলা আমার পক্ষে শোভন নয়। যদি আমি তা বলতাম তবে আপনি তো তা জানতেন। আমার অন্তরের কথাতো আপনি জানেন, কিন্তু আপনার অন্তরের কথা আমি জানি না ; নিশ্চয় আপনি অদৃশ্য সম্বদ্ধে সবচেয়ে ভাল জানেন।’

ফুটনোট

ষোলতম রুকু’

: ৩০
وَقَالَتِ الْيَهُودُ عُزَيْرٌ ابْنُ اللَّهِ وَقَالَتِ النَّصَارَى الْمَسِيحُ ابْنُ اللَّهِ ۖ ذَٰلِكَ قَوْلُهُمْ بِأَفْوَاهِهِمْ ۖ يُضَاهِئُونَ قَوْلَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ قَبْلُ ۚ قَاتَلَهُمُ اللَّهُ ۚ أَنَّىٰ يُؤْفَكُونَ

আর ইয়াহূদীরা বলে, ‘উযাইর আল্লাহ্‌র পুত্র’ [১], এবং নাসারারা বলে, ‘ মসীহ্ আল্লাহ্‌র পুত্র।’ এটা তাদের মুখের কথা আগে যারা কুফরী করেছিল তারা তাদের মত কথা বলে। আল্লাহ্‌ তাদেরকে ধ্বংস করুন। কোন্ দিকে তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে [২]!

ফুটনোট

[১] আয়াতের ভাষ্য হতে বুঝা যায় যে, ইয়াহুদীদের সবাই এ কথা বলেছিল। কারও কারও মতে, এটি ইয়াহুদীদের এক গোষ্ঠী বলেছিল। সমস্ত ইয়াহুদীদের আকীদা বিশ্বাস নয়। [কুরতুবী; ফাতহুল কাদীর] কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, সাল্লাম ইবন মিশকাম, নুমান ইবন আওফা, শাস ইবন কায়স ও মালেক ইবনুস সাইফ তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বলল, আমরা কিভাবে আপনার অনুসরণ করতে পারি, অথচ আপনি আমাদের কেবলা ত্যাগ করেছেন, আপনি উযায়েরকে আল্লাহর পুত্র বলে মেনে নেন না? তখন আল্লাহ তা'আলা এ আয়াত নাযিল করলেন। [তাবারী; সীরাতে ইবন হিশাম ১/৫৭০] উযায়ের সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, ইয়াহুদীরা যখন তাওরাত হারিয়ে ফেলেছিল তখন উযায়ের সেটা তার মুখস্থ থেকে পুণরায় জানিয়ে দিয়েছিল। তাই তাদের মনে হলো যে, এটা আল্লাহর পুত্র হবে, না হয় কিভাবে এটা করতে পারল [সা’দী; কুরতুবী; ইবন কাসীর] এটা নিঃসন্দেহে একটি মিথ্যা কথা যে, উযায়ের তাদেরকে মূল তাওরাত তার মুখস্থ শক্তি দিয়ে এনে দিয়েছিল। কারণ উযায়ের কোন নবী হিসেবেও আমাদের কাছে প্রমাণিত হয়নি। এর মাধ্যমে ইয়াহুদীরা তাদের হারিয়ে যাওয়া গ্রন্থের ধারাবাহিকতা প্রমাণ করতে চেষ্টা করে। কিন্তু সেটা তাদের দাবী মাত্র। ঐতিহাসিকভাবে এমন কিছু প্রমাণিত হয়নি। [দেখুন, ড. সাউদ ইবন আবদুল আযীয, দিরাসাতুন ফিল আদইয়ান-আল-ইয়াহুদিয়্যাহ ওয়ান নাসরনিয়্যাহ]

[২] এ আয়াতটি হলো পূর্বের আয়াতের ব্যাখ্যা। পূর্বে আয়াতে মোটামুটিভাবে বলা হয় যে, তারা আল্লাহর উপর ঈমান রাখে না। এখানে তার ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয় যে, ইহুদীরা উযাইরকে আর নাসারারা ঈসা ‘আলাইহিস সালামকে আল্লাহ্‌র পুত্র সাব্যস্ত করে। [ইবন কাসীর] তাই তাদের ঈমান ও তাওহীদের দাবী নিরর্থক। এরপর বলা হয়ঃ “এটি তাদের মুখের কথা”। এর অর্থ তারা মুখে যে কুফর উক্তি করে যাচ্ছে তার পেছনে না কোন দলীল আছে, না কোন যুক্তি। কত মারাত্মক সে উক্তি যা তারা করে যাচ্ছে। অন্য আয়াতেও আল্লাহ তা বলেছেন, “এ বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞান নেই এবং তাদের পিতৃপুরুষদেরও ছিল না। তাদের মুখ থেকে বের হওয়া বাক্য কী সাংঘাতিক তারা তো শুধু মিথ্যাই বলে" [সূরা আল-কাহাফ: ৫] অতঃপর বলা হয়ঃ “এরা পূর্ববর্তী কাফেরদের মত কথা বলে, আল্লাহ এদের ধ্বংস করুন। এরা কোন উল্টা পথে চলে যাচ্ছে। ইবন কাসীরা এর অর্থ হল ইয়াহুদী ও নাসারারা নবীগণকে আল্লাহর পুত্র বলে পুর্ববর্তী কাফের ও মুশরিকদের মতই হয়ে গেল, তারা ফেরেশতা ও লাত মানাত মূর্তিদ্বয়কে আল্লাহর কন্যা সাব্যস্ত করেছিল। [বাগভী]

: ৩১
اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا إِلَٰهًا وَاحِدًا ۖ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ۚ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ

তারা আল্লাহ্‌ ব্যতীত তাদের পন্ডিত ও সংসার-বিরাগিদের [১] কে তাদের রবরূপে গ্রহন করেছে [২] এবং মার্’ইয়াম- পুত্র মসীহ্ কেও। অথচ এক ইলাহের ‘ইবাদাত করার জন্যই তারা আদিষ্ট হয়েছিল। তিনি ব্যতীত অন্য কোন সত্য ইলাহ্ নাই। তারা যে শরীক করে তা থেকে তিনি কত না পবিত্র [৩]!

ফুটনোট

[১] (احبار) -শব্দটি –(حبر) এর বহুবচন। ইয়াহুদীদের আলেমকে (حبر) –বলা হয়। পক্ষান্তরে (رهبان)শব্দটি (راهب) এর বহুবচন। নাসারাদের আলেমকে (راهب) বলা হয়। তারা বেশীরভাগই সংসার বিরাগী হয়ে থাকে [ফাতহুল কাদীর]

[২] এ আয়াতে বলা হয় যে, ইয়াহুদী-নাসারাগণ তাদের আলেম ও যাজক শ্রেণীকে আল্লাহর পরিবর্তে রব ও মাৰুদ সাব্যস্ত করে রেখেছে। অনুরূপ ঈসা আলাইহিস সালামকেও মা’বুদ মনে করে। তাকে আল্লাহর পুত্ৰ মনে করায় তাকে মা’বুদ সাব্যস্ত করার দোষে যে দোষী করা হয়, তার কারণ হল, তারা পরিষ্কার ভাষায় ওদের মা’বুদ না বললেও পূর্ণ আনুগত্যের যে হক বান্দার প্রতি আল্লাহর রয়েছে, তাকে তারা যাজক শ্রেণীর জন্যে উৎসর্গ রাখে। অর্থাৎ তারা যাজক শ্রেণীর আনুগত্য করে চলে; যতই তা আল্লাহর নির্দেশের বিরোধী হোক না কেন? বলাবাহুল্য পাদ্রী ও পুরোহিতগণের আল্লাহ বিরোধী উক্তি ও আমলের আনুগত্য করা তাদেরকে মা’বুদ সাব্যস্ত করার নামান্তর, আর এটি হল প্রকাশ্য কুফরী ও শির্ক। আদী ইবন হাতেম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমি গলায় একটি সোনার ক্রুশ নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসলাম। তখন তিনি বললেনঃ হে আদী, তোমার গলা থেকে এ মূর্তিটি সরিয়ে ফেল এবং তাকে সূরা আত-তাওবাহ্‌র এ আয়াতটি তেলাওয়াত করতে শুনলাম- “তারা আল্লাহ ব্যতীত তাদের পণ্ডিত ও সংসার-বিরাগীদেরকে তাদের পালনকর্তারূপে গ্রহণ করেছে।” আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল, আমরা তো তাদের ইবাদাত করি না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তারা তোমাদের জন্য কোন কিছু হালাল করলে তোমরা সেটাকে হালাল মনে কর আর কোন কিছুকে হারাম করলে তোমরা সেটাকে হারাম হিসাবে গ্রহণ কর। [তিরমিযীঃ ৩০৯৫]

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, শরীআতের মাসায়েল সম্পর্কে অজ্ঞ জনসাধারণের পক্ষে ওলামায়ে কেরামের নির্দেশনার অনুসরণ বা ইজতিহাদী মাসায়েলের ক্ষেত্রে মুজতাহিদ ইমামগণের মতামতের অনুসরণ ততক্ষণই করতে পারবে যতক্ষণ না এর বিপরীতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল থেকে কোন কিছু প্রমাণিত হবে। যখনই কোন কিছু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মতের বিপক্ষে হয়েছে বলে প্রমাণিত হবে তখনি তা ত্যাগ করা ওয়াজিব। অন্যথায় ইয়াহুদী নাসারাদের মত হয়ে যাবে। কারণ ইয়াহুদী-নাসারাগণ আল্লাহর কিতাব এবং আল্লাহর রাসূলের আদেশ নিষেধকে সম্পূর্ণ উপক্ষো করে স্বার্থপর আলেম এবং অজ্ঞ পুরোহিতদের কথা ও কর্মকে নিজেদের ধর্ম বানিয়ে নিয়েছে। আয়াতে তারই নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়েছে। [ফাতহুল কাদীর]

[৩] অর্থাৎ অথচ তাদেরকে তো শুধু এ নির্দেশই দেয়া হচ্ছিল যে, তারা এক ইলাহেরই হালাল করলেই তা হালাল হবে। অনুরূপভাবে যিনি শরীআত প্রবর্তন করলে সেটাই মানা হবে, তিনি হুকুম দিলে সেটা বাস্তবায়িত হবে। তিনি ব্যতীত আর কোন সত্য ইলাহ নেই। তারা যা তাঁর সাথে শরীক করছে তা থেকে তিনি কতই না পবিত্র। তাঁর সন্ততি নেই, তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তিনি ছাড়া কোন রব নেই। [ইবন কাসীর] কিন্তু তারা সে নির্দেশের বিপরীত কাজ করেছে। তার সাথে শরীক করেছে। মহান আল্লাহ তাদের সে সমস্ত অপবাদ ও শরীক থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। তাঁর পূর্ণতার বিপরীত তার জন্য যে সমস্ত অসামঞ্জস্যপূর্ণ গুণ সাব্যস্ত করে তা গ্রহণযোগ্য নয়। [সা'দী]।

১০ : ৬৮
قَالُوا اتَّخَذَ اللَّهُ وَلَدًا ۗ سُبْحَانَهُ ۖ هُوَ الْغَنِيُّ ۖ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ ۚ إِنْ عِنْدَكُمْ مِنْ سُلْطَانٍ بِهَٰذَا ۚ أَتَقُولُونَ عَلَى اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ

তারা বলে, ‘আল্লাহ্‌ সন্তান গ্রহন করেছেন।’ তিনি মহান পবিত্র [১]! তিনি অভাবমুক্ত [২]! যা কিছু আছে আসমানসমূহে ও যা কিছু আছে যমীনে তা তাঁরই। এ বিষয়ে তোমাদের কোন সনদ নেই। তোমরা কি আল্লাহ্‌র উপর এমন কিছু বলছ যা তোমরা জান না [৩]?

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ "আল্লাহ সকল দোষ-ত্রুটিমুক্ত"। উদ্দেশ্য, আল্লাহ তো ক্রটিমুক্ত, কাজেই তাঁর সন্তান আছে একথা বলা কেমন করে সঠিক হতে পারে! এখানে আল্লাহ্ তাঁর জন্য স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, অংশীদার ও সমকক্ষ নির্ধারণ করা থেকে মুক্ত ঘোষণা করেছেন। [কুরতুবী] তিনি এ সব থেকে মুক্ত, তিনি অমুখাপেক্ষী, আর সবাই তার মুখাপেক্ষী। [ইবন কাসীর]

[২] সন্তানের সাথে অভাবমুক্তির সম্পর্ক হচ্ছে, মানুষ চায় সন্তান সন্তুতির মাধ্যমে দুনিয়াতে তার কাজ-কারবারে সাহায্য হবে। আর মৃত্যুর পর সে বেঁচে থাকবে এবং তার না থাকা জনিত অভাব কিছুটা প্রশমিত হবে। আল্লাহ্‌ তো সর্বক্ষম এবং সর্বদা আছেন। সুতরাং সন্তান-সন্ততির মাধ্যমে তাঁর কোন সাহায্যের প্রয়োজন নেই। তাছাড়া তাঁর অবর্তমানে অভাব ঘুচানোর ব্যাপারটি আসছে না। [তাবারী]

[৩] এটা দ্বারা আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে মারাত্মক ভয়প্রদর্শন করা হয়েছে। অর্থাৎ তোমরা আল্লাহর উপর না জেনে কিভাবে কথা বলছ? এর পরিণতি কি হতে পারে তোমরা কি ভেবে দেখেছ? তোমাদেরকে কি তিনি এমনিতে ছেড়ে দিবেন? পবিত্র কুরআনের অন্যান্য স্থানেও একই পদ্ধতিতে আল্লাহর উপর না জেনে কথা বলার উপর প্রচণ্ড ধমকি দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, “তারা বলে, ‘দয়াময় সন্তান গ্রহণ করেছেন।’ তোমরা তো এমন এক বীভৎস বিষয়ের অবতারণা করছ। যাতে আকাশমণ্ডলী বিদীর্ণ হয়ে যাবে, পৃথিবী খণ্ড-বিখণ্ড হবে ও পর্বতমণ্ডলী চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে আপতিত হবে যেহেতু তারা দয়াময়ের প্রতি সন্তান আরোপ করে অথচ সন্তান গ্রহণ করা দয়াময়ের শোভন নয়। আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে এমন কেউ নেই, যে দয়াময়ের কাছে বান্দারূপে উপস্থিত হবে না। তিনি তাদেরকে পরিবেষ্টন করে রেখেছেন এবং তিনি তাদেরকে বিশেষভাবে গণনা করেছেন এবং কিয়ামতের দিন তাদের সবাই তার কাছে আসবে একাকী অবস্থায় " [সূরা মারইয়ামঃ ৮৮-৯৫]

১৯ : ২২
فَحَمَلَتْهُ فَانْتَبَذَتْ بِهِ مَكَانًا قَصِيًّا

অতঃপর সে তাকে গর্ভে ধারণ করল এবং তা সহ দূরের এক স্থানে চলে গেল [১]।

ফুটনোট

[১] দূরবতী স্থানে মানে বাইত লাহ্ম। [কুরতুবী] কাতাদা বলেন, পূর্বদিকে। [তাবারী] মারইয়াম আলাইহাস সালাম হঠাৎ গৰ্ভধারণ করলেন। এ অবস্থায় যদি তিনি নিজের ইতিকাফের জায়গায় বসে থাকতেন এবং লোকেরা তাঁর গর্ভধারণের কথা জানতে পারতো, তাহলে শুধুমাত্র পরিবারের লোকেরাই নয়, সম্প্রদায়ের অন্যান্য লোকেরাও তাঁর জীবন ধারণ কঠিন করে দিতো। তাই তিনি কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হবার পর নীরবে নিজের ইতিকাফ কক্ষ ত্যাগ করে বাইরে বের হয়ে পড়লেন, যাতে আল্লাহর ইচ্ছা পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত নিজ সম্প্রদায়ের তিরস্কার, নিন্দাবাদ ও ব্যাপক দুর্ণাম থেকে রক্ষা পান। [দেখুন, কুরতুবী; ইবন কাসীর] ঈসা আলাইহিস সালামের জন্ম যে পিতা ছাড়াই হয়েছিল। এ ঘটনাটি নিজেই তার একটি বিরাট প্রমাণ। যদি তিনি বিবাহিত হতেন এবং স্বামীর ঔরসে সন্তান জন্মলাভের ব্যাপার হতো তাহলে তো সন্তান প্রসবের জন্য তাঁর শ্বশুরালয়ে বা পিতৃগৃহে না গিয়ে একাকী একটি দূরবতী স্থানে চলে যাওয়ার কোন কারণই ছিল না। সুতরাং নাসারাদের মিথ্যাচার এখানে স্পষ্ট। তারা তাকে বিবাহিত বানিয়ে ছাড়ছে।

১৯ : ৩০
قَالَ إِنِّي عَبْدُ اللَّهِ آتَانِيَ الْكِتَابَ وَجَعَلَنِي نَبِيًّا

তিনি বললেন, ‘আমি তো আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন, আমাকে নবী করেছেন,
ফুটনোট

১৯ : ৩১
وَجَعَلَنِي مُبَارَكًا أَيْنَ مَا كُنْتُ وَأَوْصَانِي بِالصَّلَاةِ وَالزَّكَاةِ مَا دُمْتُ حَيًّا

‘যেখানেই আমি থাকি না কেন তিনি আমাকে বরকতময় [১] করেছেন, তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যতদিন জীবিত থাকি ততদিন সালাত ও যাকাত আদায় করতে [২]

ফুটনোট

[১] এখানে বরকতের মূল কথা হচ্ছে, আল্লাহর দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখা। কারও কারও মতে, বরকত অর্থ, সম্মান ও প্রতিপত্তিতে বৃদ্ধি। অর্থাৎ আল্লাহ আমার সব বিষয়ে প্রবৃদ্ধি ও সফলতা দিয়েছেন। কারও কারও মতে, বরকত অর্থ, মানুষের জন্য কল্যাণকর হওয়া। কেউ কেউ বলেন, কল্যাণের শিক্ষক। কারও কারও মতে, সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ। [ফাতহুল কাদীর] বস্তুত: ঈসা আলাইহিস সালামের পক্ষে সবগুলো অর্থই সম্ভব।

[২] তাকিদ সহকারে কোন কোন কাজের নির্দেশ দেয়া হলে তাকে أوصى শব্দ দ্বারা ব্যক্তি করা হয়। ঈসা আলাইহিস সালাম এখানে বলেছেন যে, আল্লাহ তা’আলা আমাকে সালাত ও যাকাতের ওসিয়ত করেছেন। তাই এর অর্থ এই যে, খুব তাগিদ সহকারে আল্লাহ আমাকে উভয় কাজের নির্দেশ দিয়েছেন। ইমাম মালেক রাহে মাহুল্লাহ এ আয়াতের অন্য অর্থ করেছেন। তিনি বলেন, এর অর্থ, আল্লাহ্ তা'আলা তাকে মৃত্যু পর্যন্ত যা হবে তা জানিয়ে দিয়েছেন। যারা তাকদীরকে অস্বীকার করে তাদের জন্য এ কথা অনেক বড় আঘাত। [ইবন কাসীর]

১৯ : ৩২
وَبَرًّا بِوَالِدَتِي وَلَمْ يَجْعَلْنِي جَبَّارًا شَقِيًّا

‘আর আমাকে আমার মায়ের প্রতি অনুগত করেছেন এবং তিনি আমাকে করেননি উদ্ধত, হতভাগ্য;
ফুটনোট

১৯ : ৩৩
وَالسَّلَامُ عَلَيَّ يَوْمَ وُلِدْتُ وَيَوْمَ أَمُوتُ وَيَوْمَ أُبْعَثُ حَيًّا

‘আমার প্রতি শান্তি যেদিন আমি জন্ম লাভ করেছি [১], যেদিন আমার মৃত্যু হবে এবং যেদিন জীবিত অবস্থায় আমি উত্থিত হব।

ফুটনোট

[১] জন্মের সময় আমাকে শয়তান স্পর্শ করতে পারে নি। সুতরাং আমি নিরাপদ ছিলাম। অনুরূপভাবে মৃত্যুর সময় ও পুনরুত্থানের সময়ও আমাকে পথভ্রষ্ট করতে পারবে না। অথবা আয়াতের অর্থ, সালাম ও সম্ভাষণ জানানো। [ফাতহুল কাদীর] ইবন কাসীর বলেন, এর মাধ্যমে তার বান্দা হওয়ার ঘোষণা দেয়া হচ্ছে। তিনি জানাচ্ছেন যে, তিনি আল্লাহর সৃষ্ট বান্দাদের মধ্য হতে একজন। অন্যান্য সৃষ্টির মত জীবন ও মৃত্যুর অধীন। অনুরূপভাবে অন্যদের মত তিনিও পুনরুখিত হবেন। তবে তার জন্য এ কঠিন তিনটি অবস্থাতেই নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। [ইবন কাসীর]

১৯ : ৩৪
ذَٰلِكَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ ۚ قَوْلَ الْحَقِّ الَّذِي فِيهِ يَمْتَرُونَ

এ-ই মারইয়াম-এর পুত্র ঈসা। আমি বললাম সত্য কথা, যে বিষয়ে তারা সন্দেহ পোষণ করছে [১]

ফুটনোট

[১] ঈসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে নাসারারা তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শনে বাড়াবাড়ি করে ‘আল্লাহর পুত্ৰ’ বানিয়ে দেয়। পক্ষান্তরে ইহুদীরা তার অবমাননায় এতটুকু খৃষ্টতা প্রদর্শন করে যে তাকে জারজ সন্তান বলে আখ্যায়িত করে (নাউযুবিল্লাহ)। আল্লাহ তা'আলা আলোচ্য আয়াতে উভয় প্রকার ভ্রান্ত লোকদের ভ্রান্তি বর্ণনা করে তাকে সঠিক মযাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। [দেখুন, ইবন কাসীর]

২১ : ৯১
وَالَّتِي أَحْصَنَتْ فَرْجَهَا فَنَفَخْنَا فِيهَا مِنْ رُوحِنَا وَجَعَلْنَاهَا وَابْنَهَا آيَةً لِلْعَالَمِينَ

এবং স্মরণ করুন সে নারীকে [১], যে নিজ লজ্জাস্থানের হেফাজত করেছিল, অতঃপর তার মধ্যে আমরা আমাদের রূহ [২] ফুঁকে দিলাম এবং তাকে ও তার পুত্রকে করেছিলাম সৃষ্টিজগতের জন্য এক নিদর্শন।

ফুটনোট

[১] এখানে মারইয়াম আলাইহাস সালামের কথা বলা হয়েছে। [ইবন কাসীর]

[২] এখানে যেভাবে ঈসা আলাইহিসসালাম সম্পর্কে রূহ ফুঁকে দেয়ার কথা বলা হলো অন্যত্র তদ্রুপ আদম আলাইহিস সালাম সম্পর্কেও এসেছে, যেমন বলা হয়েছেঃ “আমি মাটি থেকে একটি মানুষ তৈরী করছি। কাজেই যখন আমি তাকে পূর্ণরূপে তৈরী করে নেবো এবং তার মধ্যে নিজের রূহ ফুঁকে দেবো। তখন (হে ফেরেশতারা !) তোমরা তার সামনে সিজদায় অবনত হয়ে যাবে।" [সূরা সাদঃ ৭১-৭২] আদম আলাইহিসসালামের ব্যাপারে রূহ ফুঁকে দেয়ার কথা যেভাবে বলা হয়েছে তেমনিভাবে ঈসা সম্পর্কে বিভিন্ন স্থানে বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেনঃ “আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর কালেমা, যা মারইয়ামের কাছে পাঠিয়েছিলেন এবং তার পক্ষ থেকে একটি রূহ। ” [সূরা আন-নিসাঃ ১৭১] অন্যত্র বলা হয়েছেঃ “আর ইমরানের মেয়ে মারইয়াম, যে নিজের লজ্জাস্থানের হেফাজত করেছিল, কাজেই ফুঁকে দিলাম আমরা তার মধ্যে আমাদের রূহ। ” [সূরা আত-তাহরীমঃ ১২] এ সংগে এ বিষয়টিও সামনে থাকা দরকার যে, মহান আল্লাহ ঈসা আলাইহিসসালাম ও আদমের আলাইহিসসালামের জন্মকে পরস্পরের সদৃশ গণ্য করেন। তাই অন্য সূরায় আল্লাহ বলেনঃ “ঈসার দৃষ্টান্ত আল্লাহর কাছে আদমের মতো, যাকে আল্লাহ মাটি থেকে তৈরী করেন তারপর বলেন, “হয়ে যাও” এবং সে হয়ে যায়। [সূরা আলে ইমরানঃ ৫৯] এসব আয়াত নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করলে একথা বুঝা যায় যে, স্বাভাবিক সৃষ্টি পদ্ধতির পরিবর্তে যখন আল্লাহ কাউকে নিজের হুকুমের সাহায্যে অস্তিত্বশীল করে জীবন দান করেন তখন একে “নিজের রূহ থেকে ফুঁকে দিয়েছি” শব্দাবলীর সাহায্যে বিবৃত করেন। এ রূহের সম্পর্ক আল্লাহর সাথে সম্ভবত এ জন্য করা হয়েছে যে, এর ফুঁকে দেয়াটা অলৌকিক ধরনের। ফলে সম্মানসূচক এ রূহকে আল্লাহ্ তা'আলা তাঁর নিজের বলে সম্পর্কিত করেছেন, এটি সৃষ্ট রূহ।

২৩ : ৫০
وَجَعَلْنَا ابْنَ مَرْيَمَ وَأُمَّهُ آيَةً وَآوَيْنَاهُمَا إِلَىٰ رَبْوَةٍ ذَاتِ قَرَارٍ وَمَعِينٍ

আর আমরা মারইয়াম-পুত্র ও তার জননীকে করেছিলাম এক নিদর্শন এবং তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছিলাম এক অবস্থানযোগ্য ও প্রস্রবণবিশিষ্ট উচ্চ ভূমিতে [১]।

ফুটনোট

[১] আভিধানিক অর্থে “রাবওয়াহ" এমন সুউচ্চ ভূমিকে বলা হয় যা সমতল এবং আশপাশের এলাকা থেকে উঁচু। অন্যদিকে “যা-তি কারার” মানে হচ্ছে এমন জায়গা যেখানে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি পাওয়া যায় এবং অবস্থানকারী সেখানে স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন যাপন করতে পারে। আর “মাঈন” মানে হচ্ছে বহমান পানি বা নির্বারিণী। [ইবন কাসীর] এখানে কুরআন কোন স্থানটির প্রতি ইংগিত করছে তা নিশ্চয়তা সহকারে বলা কঠিন। বিভিন্নজন এ থেকে বিভিন্ন স্থানের কথা মনে করেছেন। কেউ বলেন, এ স্থানটি ছিল দামেশক। কেউ বলেন, রামলাহ। কেউ বলেন, বাইতুল মাকদিস আবার কেউ বলেন, ফিলিস্তিন। [ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর]

৩৩ :
وَإِذْ أَخَذْنَا مِنَ النَّبِيِّينَ مِيثَاقَهُمْ وَمِنْكَ وَمِنْ نُوحٍ وَإِبْرَاهِيمَ وَمُوسَىٰ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ۖ وَأَخَذْنَا مِنْهُمْ مِيثَاقًا غَلِيظًا

আর স্মরণ করুন, যখন আমরা নবীদের কাছ থেকে অঙ্গীকার গ্রহন করেছিলাম [১] এবং আপনার কাছ থেকেও, আর নূহ, ইব্‌রাহিম, মূসা, ও মারইয়াম পুত্র ঈসার কাছ থেকেও। আর আমরা তাদের কাছ থেকে গ্রহন করেছিলাম দৃঢ় অঙ্গীকার--

ফুটনোট

[৩] উল্লেখিত আয়াতে নবীগণ থেকে যে অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি গ্রহণের কথা আলোচিত হয়েছে তা সমস্ত মানবকুল থেকে গৃহীত সাধারণ অঙ্গীকার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেমন উবাই ইবন কা'ব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে সহীহ সনদে এসেছে, ‘রেসালত ও নবুওয়ত সংক্রান্ত অঙ্গীকার নবী ও রাসূলগণ থেকে স্বতন্ত্ররূপে বিশেষভাবে গ্ৰহণ করা হয়েছে। [আহমাদ: ৫/১৩৫, মিশকাতুল মাসাবীহঃ ১/১৪৪, মুস্তাদরাকে হাকিম: ২/৩২৪, আল-লালকায়ী: আস-সুন্নাহ: ৯৯১, ইবন বাত্তাহ: আল-ইবান্নাহ ২/৬৯,৭১,২১৫,২১৭] নবী আলাইহিস সালামগণ থেকে গৃহীত এ অঙ্গীকার ছিল নবুওয়ত ও রেসালাত বিষয়ক দায়িত্ত্বসমূহ পালন এবং পরস্পর সত্যতা প্রকাশ ও সাহায্য-সহযোগিতা প্ৰদান সম্পর্কিত।

৪৩ : ৬১
وَإِنَّهُ لَعِلْمٌ لِلسَّاعَةِ فَلَا تَمْتَرُنَّ بِهَا وَاتَّبِعُونِ ۚ هَٰذَا صِرَاطٌ مُسْتَقِيمٌ

আর নিশ্চয় ‘ঈসা কিয়ামতের নিশ্চিত নিদর্শন ; কাজেই তোমারা কিয়ামতে সন্দেহ করোনা। আর তোমরা আমারই অনুসরণ কর। এটাই সরল পথ।
ফুটনোট

৪৩ : ৬৫
فَاخْتَلَفَ الْأَحْزَابُ مِنْ بَيْنِهِمْ ۖ فَوَيْلٌ لِلَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْ عَذَابِ يَوْمٍ أَلِيمٍ

অতঃপর তাদের মধ্য থেকে কতগুলো দল মতানৈক্য করল, কাজেই যালিমদের জন্য দুর্ভোগ যন্ত্রণাদায়ক দিনের শাস্তির !
ফুটনোট

৬১ :
وَإِذْ قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيَّ مِنَ التَّوْرَاةِ وَمُبَشِّرًا بِرَسُولٍ يَأْتِي مِنْ بَعْدِي اسْمُهُ أَحْمَدُ ۖ فَلَمَّا جَاءَهُمْ بِالْبَيِّنَاتِ قَالُوا هَٰذَا سِحْرٌ مُبِينٌ

আর স্মরণ করুন, যখন মারইয়াম—পুত্র ‘ঈসা বলেছিলেন, ‘হে বনী ইসরাঈল ! নিশ্চয় আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর রাসূল এবং আমার পূর্ব থেকে তোমাদের কাছে যে তাওরাত রয়েছে আমি তার সত্যায়নকারী এবং আমার পরে আহমাদ নামে [১] যে রাসূল আসবেন আমি তার সুসংবাদদাতা [২]। পরে তিনি [৩] যখন সুস্পষ্ট প্রমাণাদিসহ তাদের কাছে আসলেন তখন তারা বলতে লাগল, এটা তো স্পষ্ট জাদু।’

ফুটনোট

[১] এখানে ঈসা আলাইহিস সালাম কর্তৃক সুসংবাদ প্রদত্ত সেই রাসূলের নাম বলা হয়েছে আহমদ। আমাদের প্রিয় শেষনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নাম মুহাম্মদ, আহমদ এবং আরও কয়েকটি নাম ছিল। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমার কয়েকটি নাম রয়েছে, আমি ‘মুহাম্মাদ’, আমি ‘আহমাদ', আমি ‘মাহী’ বা নিশ্চিহ্নকারী; যার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ কুফারী নিশ্চিহ্ন করে দিবেন। আর আমি ‘হাশির" বা একত্রিতকারী; আমার কদমের কাছে সমস্ত মানুষ জমা হবে। আর আমি ‘আকিব' বা পরিসমাপ্তিকারী ৷ [বুখারী: ৩৫৩২, ৪৮৯৬, মুসলিম: ২৩:৫৪, তিরমিয়ী: ২৮৪০, মুসনাদে আহমাদ: ৪/৮০, ইবনে হিব্বান: ৬৩১৩] তবে রাসূলের নাম এ কয়টিতে সীমাবদ্ধ নয়। অন্য হাদীসে আরও এসেছে, আবু মূসা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই আমাদেরকে তার নাম উল্লেখ করেছেন, তন্মধ্যে কিছু আমরা মুখস্ত করতে সক্ষম হয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, আমি "মুহাম্মাদ’ ‘আহমাদ', হাশির, মুকাফফি (সর্বশেষে আগমনকারী), নাবিইউত তাওবাহ (তাওবাহর নবী), নাবীইউল মালহামাহ, (সংগ্রামের নবী)। [মুসলিম: ২৩৫৫, মুসনাদে আহমাদঃ ৪/৩৯৫, ৪০৪, ৪০৭]

[২] ঈসা আলাইহিস সালাম এর সুসংবাদ প্রদানের কথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীসেও এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীগণ তাকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদেরকে আপনার নিজের সম্পর্কে কিছু বলুন। জবাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “আমি আমার পিতা (পিতৃপুরুষ) ইবরাহীম এর দেয়া, ঈসা এর সুসংবাদ এবং আমার মা যখন আমাকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন তখন তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন যে, তার থেকে একটি আলো বের হয়ে সিরিয়ার বুসরা নগরীর প্রাসাদসমূহ আলোকিত হয়ে গেছে।” [মুস্তাদরাকে হাকিম: ২/৬০০,] অনুরূপ বর্ণনা আরও দেখুন, [মুসনাদে আহমাদ: ৫/২৬২] এমনকি এ সুসংবাদের কথা হাবশার বাদশাহ নাজাসীও স্বীকার করেছিলেন। [দেখুন, মুসনাদে আহমদঃ ১/৪৬১-৪৬২]

[৩] কারও কারও মতে, এখানে তিনি” বলে ঈসা আলাইহিস সালামকে বোঝানো হয়েছে। সে অনুসারে بينات বা স্পষ্ট প্রমাণাদি দ্বারা ঈসা আলাইহিস সালাম এর ইঞ্জীল বোঝানো হবে। তবে অধিকাংশ তাফসীরবিদের মতে, এখানে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বোঝানো হয়েছে। সে হিসেবে بينات বা স্পষ্ট প্রমাণাদি দ্বারা কুরআন বোঝানো হবে। আর এ মতটিই এখানে বেশী প্রাধান্যপ্রাপ্ত মত। [ফাতহুল কাদীর]

৬১ : ১৪
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا أَنْصَارَ اللَّهِ كَمَا قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ لِلْحَوَارِيِّينَ مَنْ أَنْصَارِي إِلَى اللَّهِ ۖ قَالَ الْحَوَارِيُّونَ نَحْنُ أَنْصَارُ اللَّهِ ۖ فَآمَنَتْ طَائِفَةٌ مِنْ بَنِي إِسْرَائِيلَ وَكَفَرَتْ طَائِفَةٌ ۖ فَأَيَّدْنَا الَّذِينَ آمَنُوا عَلَىٰ عَدُوِّهِمْ فَأَصْبَحُوا ظَاهِرِينَ

হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর সাহায্যকারী হও, যেমন মারইয়াম-পুত্র ‘ঈসা হাওয়ারীগণকে বলেছিলেন, ‘আল্লাহর পথে কারা আমার সাহায্যকারী হবে?’ হাওয়ারীগণ বলেছিলেন, ‘আমরাই আল্লাহর পথে সাহায্যকারী [১]।’ তারপর বনী ইসরাঈলের একদল ঈমান আনল এবং একদল কুফরী করল। তখন আমরা যারা ঈমান এনেছিল, তাদের শত্রুদের মুকাবিলায় তাদেরকে শক্তিশালী করলাম, ফলে তারা বিজয়ী হল [২]।

ফুটনোট

[১] حَوَارِيِّيْنَ শব্দটি حَوَارِي এর বহুবচন। এর অর্থ আন্তরিক বন্ধু। ঈসা আলাইহিস সালাম এর অনুসারীদেরকে ‘হাওয়ারী’ বলা হত। [ইবন কাসীর]

[২] এই আয়াতের তাফসীরে আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, ঈসা আলাইহিস সালাম আসমানে উখিত হওয়ার পর নাসারারা তিন দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদল বলল, তিনি ইলাহ ছিলেন এবং আসমানে চলে গেছেন। দ্বিতীয় দল বলল, তিনি ইলাহ ছিলেন না বরং ইলাহর পুত্র ছিলেন। এখন আল্লাহ তাকে আসমানে উঠিয়ে নিয়েছেন এবং শক্ৰদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। তৃতীয় দল বিশুদ্ধ ও সত্যকথা বলল। তারা বলল, “তিনি ইলাহও ছিলেন না, ইলাহর পুত্রও ছিলেন না; বরং আল্লাহর দাস ও রাসূল ছিলেন। আল্লাহ তা'আলা তাকে শক্ৰদের কবল থেকে হেফাযত ও উচ্চ মর্তবা দান করার জন্যে আকাশে উঠিয়ে নিয়েছেন।' মূলত: এরাই ছিল সত্যিকার ঈমানদার। প্রত্যেক দলের সাথে কিছু কিছু জনসাধারণও যোগদান করে এবং পারস্পরিক কলহ বাড়তে বাড়তে যুদ্ধের উপক্রম হয়। ঘটনাচক্রে উভয় কাফের দল মুমিনদের মোকাবিলায় প্রবল হয়ে ওঠে। অবশেষে আল্লাহ তা'আলা সর্বশেষ নবী ও রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে প্রেরণ করেন। তিনি মুমিন দলকে সমর্থন দেন। এভাবে পরিণামে মুমিন দল যুক্তি প্রমাণের নিরীখে বিজয়ী হয়ে যায়। এই তফসীর অনুযায়ী আয়াতে উল্লেখিত الَّذِيْنَ امَنُوْا বা “যারা ঈমান এনেছে” বলে ঈসা আলাইহিসসালাম-এর উম্মতের মুমিনগণকেই বোঝানো হয়েছে, যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাহায্য ও সমর্থনে বিজয়ের গৌরব অর্জন করবে। সে হিসেবে উম্মতে মুহাম্মদী যারা রাসূলের প্রকৃত অনুসারী তারা সর্বদা বিজয়ী থাকবে। [দেখুন: তাফসীরে তাবারী: ২৮/৬০, দ্বিয়া আল-মাকদেসী: আল-মুখতারাহ: ১০/৩৭৬-২৭৮, নং ৪০২]

0:00
0:00