প্রার্থনা
প্রার্থনা
:
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

রহমান, রহীম [১] আল্লাহ্‌র নামে [২]

ফুটনোট

সূরার নাম ও কিছু বৈশিষ্ট্যঃ

সূরা আল-ফাতিহা-ই সর্বপ্রথম কুরআন মজীদের একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা হিসাবে রাসূলের প্রতি নাযিল হয়েছে। [তাবারী, কাশশাফ, আল-ইতকান] সৰ্বপ্রথম অহীর মাধ্যমে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি যে আয়াত বা সূরার অংশ নাযিল হয় তা হচ্ছে সূরা আল-আলাক’-এর প্রাথমিক আয়াত কয়টি। [দেখুন, বুখারী: ৩]

সূরা আল-মুদ্দাসসির-এর প্রাথমিক কতক আয়াত এর কিছুদিন পর নাযিল হয়। [বুখারী ৪৯২২, ৪৯২৪] কিন্তু এই খণ্ড আয়াতসমূহ নাযিল হওয়ার মধ্যে একটিও পূর্ণাঙ্গ সূরা ছিল না। পূর্ণাঙ্গ সূরা প্রথম যা নাযিল হয়েছে, তা হচ্ছে সূরা আল ফাতিহা।

কুরআন মজীদের ১১৪টি সূরার মধ্যে প্রত্যেকটির জন্য একটি নাম নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এই নামকরণ ব্যাপারে কয়েকটি বিশেষ নীতি অনুসরণ করা হয়েছে। কোন কোন সূরার নাম রাখা হয়েছে এর প্রথম শব্দ দ্বারা। কোন সূরায় আলোচিত বিশেষ কোন কথা কিংবা তাতে উল্লেখিত বিশেষ কোন শব্দ নিয়ে তা-ই নাম হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। আবার কোন কোন সূরার নামকরণ করা হয়েছে তার আভ্যন্তরীণ ভাবধারা ও বিষয়বস্তুকে সম্মুখে রেখে। কয়েকটি সূরার নাম রাখা হয়েছে কোন একটি বিশেষ ঘটনার প্রতি খেয়াল রেখে। সূরা আল-ফাতিহার নাম রাখা হয়েছে কুরআনে এর স্থান-মর্যাদা, বিষয়বস্তু-ভাবধারা, এর প্রতিপাদ্য বিষয় ইত্যাদির প্রতি লক্ষ্য রেখে। এদিক দিয়ে সূরা আল-ফাতিহার স্থান সর্বোচ্চ। কেননা অন্যান্য সূরার ন্যায় সূরা আল-ফাতিহার নাম মাত্র একটি নয়, অনেকগুলো। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নাম হচ্ছে, ১. ‘ফাতিহাতুল কিতাব' (فَاتِحَةُ الْكِتَا بِ) কুরআনের চাবি-কাঠি। কেননা, এই সূরা দ্বারাই কুরআনের সূচনা হয়, কুরআনের প্রথম স্থানেই একে রাখা হয়েছে। কুরআন খুলে সর্বপ্রথম এই সূরা-ই পাঠ করতে হয়। কখনও কখনও এই নামের রূপান্তর হয়ে ফাতিহাতুল কুরআন হয়ে থাকে। এতে অর্থের দিক দিয়ে কোন পার্থক্যই সুচিত হয় না। ২. “উম্মুল কিতাব" (اُمُّ الْكِتَا بِ) আরবী ভাষায় ‘উম্ম্‌’ বলা হয় সর্ব ব্যাপক ও কেন্দ্রীয় মর্যাদাসম্পন্ন জিনিসকে। সৈন্য বাহিনীর ঝান্ডাকে বলা হয় উম্ম্‌। কেননা সৈনিকবৃন্দ তারই ছায়াতলে সমবেত হয়ে থাকে। মক্কা নগরের আর এক নাম হচ্ছে, ‘উম্মুল কুরা’-‘জনপদসমূহের মা’। কেননা, হজ্জের মৌসুমে সমস্ত মানুষ-সকল গোত্র ও জাতি এই শহরেই একত্রিত হয়। ইমাম বুখারী কিতাবুত্‌ তাফসীর-এর শুরুতে লিখেছেনঃ এর নাম ‘উম্মুল কিতাব' এজন্য বলা হয়েছে যে, কুরআন লিখতে ও পড়তে তা-ই প্রথম এবং সালাতের কেরাতেও তা-ই প্রথম পাঠ করতে হয়। ৩. “সূরাতুল-হামদ" (سُوْرَةُ الْحَمْد) তা'রীফ ও প্রশংসার সূরা। হামদ এই সূরার প্রথম শব্দ। ইহাতে আল্লাহ্‌র হামদ-তা'রীফ-প্রশংসা ও শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়েছে, সেই জন্য এটি এ সূরার জন্য যথার্থ নাম। ৪. “সূরাতুস-সালাত” (سُوْرَةُ الصَّلَاةِ) - অর্থাৎ সালাতের সূরা। যেহেতু সব সালাতের সব রাক"আতেই এটি পাঠ করতে হয় সেজন্যই এই নামকরণ হয়েছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন,

(لَا صَلاَة لِمَنْ لَمْ يَقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ)

অর্থাৎ, ‘যে ব্যক্তি নামাযে সূরা ফাতিহা পড়বে না, তার সালাত হবে না।’ [বুখারীঃ ৭৫৬, মুসলিমঃ ৩৯৪] ৫. “আস্‌-সাব্‌'য়ুল মাসানী" (السَّبْعُ الْمَثَانِىْ)—'বার বার পাঠ করার সাতটি আয়াত'। সূরা ফাতিহার সাতটি আয়াত রয়েছে এবং তা বার বার পাঠ করা হয় বলে এর আর এক নাম সাব্‌'য়ুল মাসানী’। অথবা সালাতের প্রতি রাক’আতেই তা পড়া হয় বলেই এর এই নাম। [আল-কাশশাফ, বাগভী, তাফসীর ইবন কাসীর, আল-ইতকান, আত-তাফসীরুস সহীহ]

আয়াত সংখ্যা :
এ ব্যাপারে কারও কোন দ্বিমত নেই যে, সূরা ফাতিহার মোট সাতটি আয়াত রয়েছে। এ জন্য হাদীস শরীফে একে সাতটি পুনরাবৃত্তিমূলক আয়াতের সূরা (السَّبْعُ الْمَثَانِىْ) বলা হয়েছে। [বুখারী ৪৭০৩] পবিত্র কুরআনেও একে এ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। [সূরা আল-হিজর:৮৭]

এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জেগেছেঃ সূরার পূর্বে যে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম" উল্লেখিত হয়েছে তা সূরা ফাতিহার মধ্যে গণ্য আয়াত ও এর অংশ, না তা হতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র কোন জিনিস? এর উত্তরে বলা যায়, কোন কোন সাহাবী “বিসমিল্লাহ"কে সূরা ফাতিহার অংশ মনে করতেন। পক্ষান্তরে অপর সাহাবীদের মতে এটি এ সূরার অংশ নয়। তবে মদীনা শরীফে সংরক্ষিত কুরআনে এটিকে সূরা আল-ফাতিহার অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। তাছাড়া অধিকাংশ কেরাআতেও এটিকে সূরার প্রথমে একটি আয়াত ধরা হয়েছে এবং ‘সিরাতাল্লাযীনা আন'আমতা ‘আলাইহিম গাইরিল মাগদূবি ‘আলাইহিম ওলাদ দ্বলীন’ পর্যন্ত পুরোটাকে একই আয়াত ধরা হয়েছে। আর যারা বিসমিল্লাহকে সূরার আয়াত হিসেবে গণ্য করেননি তারা

(صِراطَ الَّذِيْنَ اَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ)

পর্যন্ত এক আয়াত, আর তার পরের অংশ

(غَيْرِ الْمَغْضُوْبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّيْنَ)

কে আলাদা আয়াত সাব্যস্ত করে সাত আয়াত পূর্ণ করেছেন। [বাগভী]

নাযিল হওয়ার স্থানঃ
গ্রহণযোগ্য মত হচ্ছে যে, সূরা আল-ফাতিহা মক্কায় অবতীর্ণ সূরা। অবশ্য কেউ কেউ বলেছেন, এটি মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে। আবার কারও মতে এটা একবার মক্কায় এবং আর একবার মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছিল। তাছাড়া এর অর্ধেক মক্কায় এবং অপর অর্ধেক মদীনায় নাযিল হয়েছে বলেও কেউ কেউ মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এ সব মত গ্রহণযোগ্য নয়। তার বড় প্রমাণ এই যে, সূরা আল-হিজর সর্বসম্মতভাবে মক্কী। তার ৮৭ নং আয়াতে বলা হয়েছেঃ “আমরা আপনাকে সাতটি বার বার পঠনীয় আয়াত ও কুরআনে ‘আযীম প্রদান করেছি।’ এই বার বার পঠনীয় সাতটি আয়াতই হল সূরা আল-ফাতিহা। [বাগভী] তাছাড়া সালাত মক্কায়ই ফরয হয়েছিল এবং সূরা ফাতিহা ছাড়া কখনই সালাত পড়া হয়নি- এটাও সর্বসম্মত কথা।

সূরার ফযীলতঃ
সূরা আল-ফাতিহার ফযীলত বর্ণনায় অসংখ্য হাদীস এসেছে। যেমন হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ্‌ তা’আলা বলেছেন, আমার এবং আমার বান্দার মধ্যে সালাতকে আমি দু’ভাগে বিভক্ত করেছি, আর আমার বান্দার জন্য তা-ই রয়েছে যা সে চায়। বান্দা (اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِيْنَ) বললে আল্লাহ্‌ বলেন, আমার বান্দা আমার প্রশংসা করেছে; আর যখন সে (الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ) বলে তখন আল্লাহ্‌ বলেন, আমার বান্দা আমার গুণ-গান করেছে। আর যখন সে বলে (مٰلِكِ يَوْمِ الدِّيْنِ) তখন আল্লাহ্‌ বলেন, আমার বান্দা আমাকে সম্মানে ভূষিত করেছে। আর যখন সে বলে

(اِيَّاكَ نَعْبُدُ وَاِيَّاكَ نَسْتَعِيْنُ)

তখন আল্লাহ্‌ বলেন, এটা আমার ও আমার বান্দার মধ্যে, আর আমার বান্দার জন্য তা-ই রয়েছে যা সে চায়। আর যখন সে বলে

(اِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَـقِيْمَ ـ صِرَاطَ الَّذِيْنَ اَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ ـ غَيْرِ الْمَغْضُوْبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّيْنَ)

তখন আল্লাহ্‌ বলেন, এটা আমার বান্দার জন্য আর আমার বান্দার জন্য তা-ই রয়েছে যা সে চায়”। [মুসলিম,৩৯৫]

অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ্‌ তা'আলা উম্মুল কুরআন এর অনুরূপ কোন কিছু তাওরাত ও ইঞ্জীলে নাযিল করেননি। আর তা হলো পুনঃ পুনঃ পঠিতব্য সাতটি আয়াত, যা আমি (আল্লাহ্‌) এবং বান্দাদের মাঝে দু'ভাগে বিভক্ত। " [নাসায়ী, ৯১৩, তিরমিযী, ৩১২৫]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও জিবরিল ‘আলাইহিস্‌সালাম উপবিষ্ট ছিলেন। তখন হঠাৎ উপরের দিকে (এক ধরণের) শব্দ শুনা গেল। তখন জিবরিল ‘আলাইহিস সালাম আকাশের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললেন, এটা আকাশের একটি দরজা যা কখনও খোলা হয় নি। ইবন আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, অতঃপর সে দরজা দিয়ে একজন ফেরেশতা অবতরণ করে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললেন, আমি আপনাকে দু’টি নূরের সুসংবাদ দিচ্ছি যা আপনাকে দেয়া হয়েছে, যা আপনার পূর্বে কোন নবীকে দেয়া হয়নি। সূরা আল-ফাতিহা ও সূরা আল-বাকারাহ এর শেষাংশ। এর একটি অক্ষর পাঠের মাধ্যমে চাওয়া বস্তুও তাকে দেয়া হবে। [মুসলিম: ৮০৬]

অনুরূপভাবে আবু সায়ীদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা এক সফরে এক জায়গায় অবতরণ করলাম। সেখানে একটি মেয়ে এসে বলল, এ গ্রামের প্রধানকে সাপে দংশন করেছে, তোমাদের মধ্যে কেউ কি ঝাঁড়-ফুঁক করার মত আছে? তখন মেয়েটির সাথে এক ব্যক্তি গিয়ে তাকে ঝাঁড়-ফুঁক করে এল, আমরা তাকে ঝাঁড়-ফুঁক জানে বলে মনে করতাম না। এতে গ্রাম প্রধান আরোগ্য লাভ করেন। ফলে সে তাকে ত্রিশটি বকরী উপহার দিল এবং আমাদেরকে দুধ পান করাল। আমাদের সঙ্গীকে আমরা বললাম তুমি কি ভাল ঝাঁড়-ফুঁক করতে জান? সে বলল, আমি শুধু উম্মুল কুরআন দ্বারা ফুঁক দিয়েছি। আমরা সবাইকে বললাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পৌঁছে জিজ্ঞেস না করা পর্যন্ত তোমরা এগুলোকে কিছু কর না। অতঃপর মদীনা পৌঁছে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে সব কথা খুলে বললাম। তিনি বললেন, সে কিভাবে জানলো যে, এটি একটি ঝাঁড়-ফুঁক করার বস্তু! তোমরা এগুলো বন্টন করে নাও এবং আমাকে তোমাদের সাথে এক ভাগ দিও। [মুসলিম: ২২০১]

অন্য বর্ণনায় আবু সা’য়ীদ ইবনুল মু'আল্লা বলেন, আমি সালাত আদায় করছিলাম এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে ডাকলেন। আমি সালাত শেষ করেই তার ডাকে সাড়া দিলাম। তখন তিনি আমাকে বললেন, “আমার কাছে আসা হতে তোমাকে কিসে বারণ করেছে? আমি বললাম, হে আল্লাহ্‌র রাসূল! আমি সালাত আদায় করছিলাম। তিনি বললেন, আল্লাহ্‌ তা'আলা কি বলেন নি যে, 'হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলের ডাকে সাড়া দাও; যখন তোমাদেরকে ডাকেন সে বস্তুর দিকে যা তোমাদেরকে জীবন দান করবে”। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘মসজিদ হতে বের হবার পূর্বে আমি তোমাকে কুরআনের সবচেয়ে মহান সূরা শিক্ষা দিব। ... অতঃপর তিনি বললেন, তাহলো, (اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِيْنَ)। এটি হলো সাতটি পূনঃ পূনঃ পঠিতব্য আয়াত এবং মহান কুরআন যা আমাকে দান করা হয়েছে। [বুখারী, ৪৬৪৭]

উপর্যুক্ত হাদীসসমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, এ সূরাটি সবচেয়ে মহান সূরা।

[১] সাধারণত আয়াতের অনুবাদে বলা হয়ে থাকে, পরম করুণাময়, দয়ালু আল্লাহ্‌র নামে শুরু করছি। এ অনুবাদ বিশুদ্ধ হলেও এর মাধ্যমে এ আয়াতখানির পূর্ণভাব প্রকাশিত হয় না। কারণ, আয়াতটি আরও বিস্তারিত বর্ণনার দাবী রাখে। প্রথমে লক্ষণীয় যে, আয়াতে আল্লাহ্‌র নিজস্ব গুণবাচক নামসমূহের মধ্য হতে ‘আর-রাহমান ও আর-রাহীম' এ দু’টি নামই এক স্থানে উল্লিখিত হয়েছে। ‘রহম’ শব্দের অর্থ হচ্ছে দয়া, অনুগ্রহ। এই ‘রহম’ ধাতু হতেই ‘রহমান’ ও ‘রহীম' শব্দদ্বয় নির্গত ও গঠিত হয়েছে। ‘রহমান' শব্দটি মহান আল্লাহ্‌র এমন একটি গুণবাচক নাম যা অন্য কারও জন্য ব্যবহার করা জায়েয নেই। [তাবারী] কুরআন ও হাদীসে এমনকি আরবদের সাহিত্যেও এটি আল্লাহ্‌ ছাড়া আর কারও গুণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি। পক্ষান্তরে ‘রহীম' শব্দটি আল্লাহ্‌র গুণ হলেও এটি অন্যান্য সৃষ্টজগতের কারও কারও গুণ হতে পারে। তবে আল্লাহ্‌র গুণ হলে সেটা যে অর্থে হবে অন্য কারও গুণ হলে সেটা সে একই অর্থে হতে হবে এমন কোন কথা নেই। প্রত্যেক সত্তা অনুসারে তার গুণাগুণ নির্দিষ্ট হয়ে থাকে। এখানে একই স্থানে এ দুটি গুণবাচক নাম উল্লেখ করার বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। কোন কোন তাফসীরকার বলেছেন যে, আল্লাহ্‌ ‘রহমান’ হচ্ছেন এই দুনিয়ার ক্ষেত্রে, আর ‘রাহীম’ হচ্ছেন আখেরাতের হিসেবে। [বাগভী]

[২] নবী করীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি সর্বপ্রথম ‘ইক্‌রা বিসমে' বা সূরা আল-‘আলাক এর প্রাথমিক কয়েকটি আয়াত নাযিল হয়েছিল। এতে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্‌র নাম নিয়ে পাঠ শুরু করতে বলা হয়েছিল। সম্ভবত এজন্যই আল্লাহ্‌র এই প্রাথমিক আদেশ অনুযায়ী কুরআনের প্রত্যেক সূরা’র প্রথমেই তা স্থাপন করে সেটাকে রীতিমত পাঠ করার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে। বস্তুতঃ বিসমিল্লাহ প্রত্যেকটি সূরার উপরিভাগে অর্থ ও বাহ্যিক আঙ্গিকতার দিক দিয়ে একটি স্বর্ণমুকুটের ন্যায় স্থাপিত রয়েছে। বিশেষ করে এর সাহায্যে প্রত্যেক দু’টি সূরার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করাও অতীব সহজ হয়েছে। হাদীসেও এসেছে, “রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূরার শেষ তখনই বুঝতে পারতেন যখন বিসমিল্লাহ নাযিল করা হতো” [আবু দাউদ:৭৮৮]

তবে প্রত্যেক সূরার প্রথমে ও কুরআন পাঠের পূর্বে এ বাক্য পাঠ করার অর্থ শুধু এ নয় যে, এর দ্বারা আল্লাহ্‌র নাম নিয়ে কুরআন তিলাওয়াতে শুরু করার সংবাদ দেয়া হচ্ছে। বরং এর দ্বারা স্পষ্ট কণ্ঠে স্বীকার করা হয় যে, দুনিয়া জাহানের সমস্ত নিয়ামত আল্লাহ্‌র তরফ হতে প্রাপ্ত হয়েছে। এর মাধ্যমে এ কথাও মেনে নেয়া হয় যে, আল্লাহ্‌ তা'আলা আমাদের প্রতি যে দয়া ও অনুগ্রহ করেছেন বিশেষ করে দ্বীন ও শরীয়াতের যে অপূর্ব ও অতুলনীয় নিয়ামত আমাদের প্রতি নাযিল করেছেন, তা আমাদের জন্মগত কোন অধিকারের ফল নয়। বরং তা হচ্ছে আল্লাহ্‌ তা'আলার নিজস্ব বিশেষ মেহেরবানীর ফল।

তাছাড়া এই বাক্য দ্বারা আল্লাহ্‌র নিকট এই প্রার্থনাও করা হয় যে, তিনি যেন অনুগ্রহপূর্বক তাঁর কালামে-পাক বুঝবার ও তদনুযায়ী জীবন যাপন করার তওফীক দান করেন। এ ছোট্ট বাক্যটির অন্তর্নিহিত ভাবধারা এটাই। তাই শুধু কুরআন তিলাওয়াত শুরু করার পূর্বেই নয় প্রত্যেক জায়েয কাজ আরম্ভ করার সময়ই এটি পাঠ করার জন্য ইসলামী শরীয়াতে নির্দেশ করা হয়েছে। কারণ প্রত্যেক কাজের পূর্বে এটি উচ্চারণ না করলে উহার মঙ্গলময় পরিণাম লাভে সমর্থ হওয়ার কোন সম্ভাবনাই থাকে না। নবী করীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার বিভিন্ন কথা ও কাজে এই কথাই ঘোষণা করেছেন। যেমন, তিনি প্রতিদিন সকাল-বিকাল বলতেন

(بِسْمِ اللّٰهِ الَّذِيْ لَا يَضُرُّ مَعَ اسْمِه شَيْئٌ فِي الْاَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ)–

“আমি সে আল্লাহ্‌র নামে শুরু করছি যার নামে শুরু করলে যমীন ও আসমানে কেউ কোন ক্ষতি করতে পারে না, আর আল্লাহ্‌ তো সব কিছু শুনেন ও সবকিছু দেখেন।" [আবুদাউদ: ৫০৮৮, ইবনে মাজাহ ৩৮৬৯]

অনুরূপভাবে যখন তিনি রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের কাছে চিঠি লিখেন তাতে বিসমিল্লাহ্‌ লিখেছিলেন [বুখারী, ৭] তাছাড়া তিনি যে কোন ভাল কাজে বিসমিল্লাহ বলার জন্য নির্দেশ দিতেন। যেমন, খাবার খেতে, [বুখারী ৫৩৭৬, মুসলিম: ২০১৭, ২০২২]

দরজা বন্ধ করতে, আলো নিভাতে, পাত্র ঢাকতে, পান-পাত্র বন্ধ করতে [বুখারী ৩২৮০] কাপড় খুলতে [ইবনে মাজাহ ২৯৭, তিরমিয়ী ৬০৬] স্ত্রী সহবাসের পূর্বে বুখারী: ৬৩৮৮, মুসলিম: ১৪৩৪], ঘুমানোর সময় আবু দাউদ: ৫০৫৪] ঘর থেকে বের হতে [আবুদাউদ: ৫০৯৫] চুক্তিপত্র/ বেচা-কেনা লিখার সময় [সুনানুল কুবরা লিল বাইহাকী: ৫/৩২৮] চলার সময় হোঁচট খেলে [মুসনাদে আহমাদ: ৫/৫৯] বাহনে উঠতে [আবু দাউদ: ২৬০২] মসজিদে ঢুকতে [ইবনে মাজাহ: ৭৭১, মুসনাদে আহমাদ: ৬/২৮৩] বাথরুমে প্রবেশ করতে [ইবনে আবি শাইবাহ: ১/১১] হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করতে [সুনানুল কুবরা লিল বাইহাকী: ৫/৭৯] যুদ্ধ শুরু করার সময় [তিরমিযী: ১৭১৫] শক্র দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ব্যাথা পেলে বা কেটে গেলে নাসায়ী: ৩১৪৯] ব্যাথার স্থানে ঝাড়-ফুক দিতে [মুসলিম: ২২০২] মৃতকে কবরে দিতে [তিরমিযী: ১০৪৬]। এ ব্যাপারে আরও বহু সহীহ হাদীস এসেছে। আবার কোথাও কোথাও ‘বিসমিল্লাহ' বলা ওয়াজিবও বটে যেমন, যবাই করতে [বুখারী: ৯৮৫, মুসলিম: ১৯৬০]
যেহেতু মানুষের শক্তি অত্যন্ত সীমাবদ্ধ, সে যে কাজই শুরু করুক না কেন, তা যে সে নিজে আশানুরূপে সাফল্যজনকভাবে সম্পন্ন করতে পারবে, এমন কথা জোর করে বলা যায় না। এমতাবস্থায় সে যদি আল্লাহ্‌র নাম নিয়ে কাজ শুরু করে এবং আল্লাহ্‌র অসীম দয়া ও অনুগ্রহের প্রতি হৃদয়-মনে অকুণ্ঠ বিশ্বাস জাগরুক রেখে তাঁর রহমত কামনা করে, তবে এর অর্থ এ-ই হয় যে, সংশ্লিষ্ট কাজ সুষ্ঠুরূপে সম্পন্ন করার ব্যাপারে সে নিজের ক্ষমতা যোগ্যতা ও তদবীর অপেক্ষা আল্লাহ্‌র অসীম অনুগ্রহের উপরই অধিক নির্ভর ও ভরসা করে এবং তা লাভ করার জন্য তাঁরই নিকট প্রার্থনা করে ।

:
الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ

সকল ‘হাম্‌দ’ [১] আল্লাহ্‌র [২] , যিনি সৃষ্টিকুলের [৩] রব, [৪]

ফুটনোট

[১] আরবী ভাষায় ‘হাম্‌দ’ অর্থ নির্মল ও সম্ভমপূর্ণ প্রশংসা। গুণ ও সিফাত সাধারণতঃ দুই প্রকার হয়ে থাকে। তা ভালও হয় আবার মন্দও হয়। কিন্তু হাম্‌দ শব্দটি কেবলমাত্র ভাল গুণ প্রকাশ করে। অর্থাৎ বিশ্ব জাহানের যা কিছু এবং যতকিছু ভাল, সৌন্দর্যমাধুর্য, পূর্ণতা মাহাত্ম দান ও অনুগ্রহ রয়েছে তা যেখানেই এবং যে কোন রূপে ও যে কোন অবস্থায়ই থাকুক না কেন, তা সবই একমাত্র আল্লাহ্‌ তা'আলারই জন্য নির্দিষ্ট, একমাত্র তিনিই-তাঁর মহান সত্তাই সে সব পাওয়ার অধিকারী। তিনি ছাড়া আর কোন উপাস্যই এর যোগ্য হতে পারে না। কেননা সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা তিনিই এবং তাঁর সব সৃষ্টিই অতীব সুন্দর। এর অধিক সুন্দর আর কিছুই হতে পারে না-মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। তাঁর সৃষ্টি, লালন-পালন-সংরক্ষণ-প্রবৃদ্ধি সাধনের সৌন্দর্য তুলনাহীন। তাই এর দরুন মানব মনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জেগে উঠা প্রশংসা ও ইচ্ছামূলক প্রশংসাকে ‘হামদ বলা হয়। এখানে এটা বিশেষভাবে জানা আবশ্যক যে, ‘আল-হামদু’ কথাটি ‘আশ-শুক্‌র’ থেকে অনেক ব্যাপক, যা আধিক্য ও পরিপূর্ণতা বুঝায়। কেউ যদি কোন নিয়ামত পায়, তা হলে সেই নিয়ামতের জন্য শুকরিয়া প্রকাশ করা হয়। সে ব্যক্তি যদি কোন নিয়ামত না পায় (অথবা তার পরিবর্তে অন্য কোন লোক নিয়ামতটি পায়) স্বভাবতঃই তার বেলায় এজন্য শুকরিয়া নয়। অর্থাৎ যে ব্যক্তি নিয়ামত পায়, সে-ই শুকরিয়া আদায় করে। যে ব্যক্তি নিয়ামত পায় না, সে শুকরিয়া আদায় করে না। এ হিসেবে ‘আশ-শুক্‌র লিল্লাহ' বলার অর্থ হতো এই যে, আমি আল্লাহ্‌র যে নিয়ামত পেয়েছি, সেজন্য আল্লাহ্‌র শুকরিয়া আদায় করছি। অপরদিকে 'আল-হামদুলিল্লাহ’ অনেক ব্যাপক। এর সম্পর্ক শুধু নিয়ামত প্রাপ্তির সাথে নয়। আল্লাহ্‌র যত নেয়ামত আছে, তা পাওয়া যাক, বা না পাওয়া যাক; সে নিয়ামত কোন ব্যক্তি নিজে পেলো, বা অন্যরা পেলো, সবকিছুর জন্যই যে প্রশংসা আল্লাহ্‌র প্রাপ্য সেটিই হচ্ছে ‘হামদ’। এ প্রেক্ষিতে আল-হামদুলিল্লাহ' বলে বান্দা যেন ঘোষণা করে, হে আল্লাহ্‌! সব নিয়ামতের উৎস আপনি, আমি তা পাই বা না পাই, সকল সৃষ্টিজগতই তা পাচ্ছে; আর সেজন্য সকল প্রশংসা একান্তভাবে আপনার, আর কারও নয়। কেউ আপনার প্রশংসা করলে আপনি প্রশংসিত হবেন আর কেউ প্রশংসা না করলে প্রশংসিত হবেন না, ব্যাপারটি এমন নয়। আপনি স্বপ্রশংসিত। প্রশংসা আপনার স্থায়ী গুণ। প্রশংসা আপনি ভালবাসেন। আপনার প্রশংসা কোন দানের বিনিময়ে হতে হবে এমন কোন বাধ্য-বাধকতা নেই। [ইবন কাসীর] আরও একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, এখানে (اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ) ‘সকল প্রশংসা আল্লাহ্‌র’ এ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। (اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ) ‘আমি আল্লাহ্‌র প্রশংসা করছি’ এ শব্দ ব্যবহৃত হয়নি। এর কারণ সম্ভবত এই যে, ‘আহমাদুল্লাহ' বা ‘আমি আল্লাহ্‌র প্রশংসা করছি’ এ বাক্যটি বর্তমানকালের সাথে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ আমি বর্তমানকালে আল্লাহ্‌র প্রশংসা করছি। অন্যদিকে ‘আল-হামদুলিল্লাহ’ বা ‘সকল প্রশংসা আল্লাহ্‌র’ সর্বকালে (অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতে) প্রযোজ্য। আর এ জন্যই হাদীসে বলা হয়েছে,

(اَفْضَلُ الدُّعَاءِ الْحَمْدُ لِلّٰهِ)

“সবচেয়ে উত্তম দো’আ হলো আল-হামদুলিল্লাহ” [তিরমিযী:৩৩৮৩]

কারণ, তা সর্বকাল ব্যাপী। অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

(وَالْحَمْدُ لِلّٰهِ تَمْلَأُ الْمِيْزَانَ),

“আর ‘আল-হামদুলিল্লাহ' মীযান পূর্ণ করে” [মুসলিম: ২২৩]

এ জন্য অধিকাংশ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম দিন-রাত্রির যিক্‌র ও সালাতের পরের যিক্‌র এর মধ্যে এ “আল হামদুলিল্লাহ" শব্দই শিখিয়েছেন। এ “আল-হামদুলিল্লাহ" পুর্ণমাত্রার প্রশংসা হওয়ার কারণেই আল্লাহ্‌ এতে খুশী হন। বিশেষ করে নেয়ামত পাওয়ার পর বান্দাকে কিভাবে আল্লাহ্‌র প্রশংসা করতে হবে তাও "আল-হামদুলিল্লাহ" শব্দের মাধ্যমে করার জন্যই আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূল শিখিয়ে দিয়েছেন। [দেখুন, ইবনে মাজাহ, ৩৮০৫]

এভাবে “আল-হামদুলিল্লাহ" হলো সীমাহীন প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতার রূপ। আল্লাহ্‌র হামদ প্রকাশ করার ক্ষেত্র, মানুষের মন-মানষ, মুখ ও কর্মকাণ্ড। অর্থাৎ মানুষের যাবতীয় শক্তি দিয়ে আল্লাহ্‌র হামদ করতে হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, মানুষের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহ্‌র ‘হামদ বা প্রশংসা’ শুধু মুখেই সীমাবদ্ধ রাখে। অনেকে মুখে আল-হামদুলিল্লাহ' বলে, কিন্তু তার অন্তরে আল্লাহ্‌র প্রশংসা আসেনি আর তার কর্মকাণ্ডেও সেটার প্রকাশ ঘটে না।

[২] ‘সকল হামদ আল্লাহ্‌র’ এ কথাটুকু দ্বারা এক বিরাট গভীর সত্যের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। পৃথিবীর যেখানেই যে বস্তুতেই যাকিছু সৌন্দর্য ভাল প্রশংসার যোগ্য গুণ বা শ্রেষ্ঠত্ব বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হবে, মনে করতে হবে যে, তা তার নিজস্ব সম্পদ ও স্বকীয় গৌরবের বস্তু নয়। কেননা সেই গুণ মূলতঃই তার নিজের সৃষ্টি নয়; তা সেই আল্লাহ্ তা'আলারই নিরঙ্কুশ দান, যিনি নিজের কুদরতে সকল সৃষ্টিকে সৃষ্টি করেছেন। বস্তুতঃ তিনি হচ্ছেন সমস্ত সৌন্দর্য ও সমস্ত ভালোর মূল উৎস। মানুষ, ফেরেশতা, গ্রহ-নক্ষত্র, বিশ্ব-প্রকৃতি, চন্দ্ৰ-সূৰ্য-যেখানেই যা কিছু সৌন্দর্য ও কল্যাণ রয়েছে, তা তাদের কারো নিজস্ব নয়, সবই আল্লাহ্‌র দান। অতএব এসব কারণে যা কিছু প্রশংসা হতে পারে তা সবই আল্লাহ্‌র প্রাপ্য। এসব সৃষ্টি করার ব্যাপারে যেহেতু আল্লাহ্‌র সাথে কেউ শরীক ছিলনা, কাজেই এসব কারণে যে প্রশংসা প্রাপ্য হতে পারে তাতেও আল্লাহ্‌র সাথে কারো এক বিন্দু অংশীদারিত্ব থাকতে পারে না। সুন্দর, অনুগ্রহকারী, সৃষ্টিকর্তা, লালন-পালনকর্তা, রক্ষাকর্তা ও ক্রমবিকাশদাতা আল্লাহ্‌র প্রতি মানুষ যা কিছু ভক্তি-শ্রদ্ধা ইবাদত-বন্দেগী এবং আনুগত্য পেশ করতে পারে; তা সবই একমাত্র আল্লাহ্‌র সামনেই নিবেদন করতে হবে। কেননা আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্য কোন শক্তিই তার এক বিন্দুরও দাবীদার হতে পারে না। বরং তারই রয়েছে যাবতীয় হাম্‌দ। হাম্‌দ জাতীয় সবকিছু কেবল তাঁরই প্রাপ্য, কেবল তিনিই সেটার একমাত্র যোগ্য। তাছাড়া ভালো বা মন্দ সকল অবস্থায় কেবল এক সত্তারই ‘হামদ’ বা প্রশং করতে হয়। তিনি হচ্ছেন আল্লাহ্ তা'আলা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিক্ষা দিয়েছেন যে, কেউ যদি কোন খারাপ কিছুর সম্মুখীন হয়, তখনও যেন বলে,

(اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ عَلٰى كُلِّ حَالٍ)

বা সর্বাবস্থায় আল্লাহ্‌র জন্যই যাবতীয় হামদ [ইবন মাজাহঃ ৩৮০৩ ]

কুরআন হাদীস হতে সুস্পষ্টরূপে জানা যায় যে, সাধারণভাবে কোন ব্যক্তির গুণ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তার এতখানি প্রশংসাও করা যায় না যাতে তার ব্যক্তিত্বকেই অসাধারণভাবে বড় করে তোলা হয় এবং সে আল্লাহ্‌র সমকক্ষতার পর্যায়ে পৌঁছে যায়। মূলতঃ এইরূপ প্রশংসাই মানুষকে তাদের পূজার কঠিন পাপে নিমজ্জিত করে। সে জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক ঈমানদার ব্যক্তিকে বলেছেন: “যখন বেশী বেশী প্রশংসাকারীদেরকে দেখবে, তখন তাদের মুখের উপর ধূলি নিক্ষেপ কর। ” [মুসলিম: ৩০০২] নতুবা তার মনে গৌরব ও অহংকারী ভাবধারার উদ্রেক হতে পারে। হয়ত মনে করতে পারে যে, সে বহুবিধ গুণ-গরিমার অধিকারী, তার বিরাট যোগ্যতা ও ক্ষমতা আছে। আর কোন মানুষ যখন এই ধরনের খেয়াল নিজের মনে স্থান দেয় তখন তার পতন হতে শুরু হয় এবং সে পতন হতে উদ্ধার হওয়া কিছুতেই সম্ভব হয় না। তাছাড়া মানুষ যখন আল্লাহ্‌ ছাড়া অপর কারো গুণ সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে তার প্রশংসা করতে শুরু করে, তখন মানুষ তার ভক্তি-শ্রদ্ধার জালে বন্দী হয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত সে মানুষের দাসত্ব ও মানুষের পূজা করতে আরম্ভ করে। এই অবস্থা মানুষকে শেষ পর্যন্ত চরম পঙ্কিল শির্কের পথে পরিচালিত করতে পারে। সে জন্যই যাবতীয় ‘হামদ’ একমাত্র আল্লাহ্‌র জন্যই করার শিক্ষা দেয়া হয়েছে।

[৩] ‘আলামীন' বহুবচন শব্দ, একবচনে ‘আলাম’। কোন কোন তাফসীরকার বলেন, ‘আলাম’ বলা হয় সেই জিনিসকে, যা অপর কোন জিনিস সম্পর্কে জানবার মাধ্যম হয়; যার দ্বারা অন্য কোন বৃহত্তর জিনিস জানতে পারা যায়। সৃষ্টিজগতের প্রত্যেকটি অংশ স্বতঃই এমন এক মহান সত্তার অস্তিত্বের নিদর্শন, যিনি তার সৃষ্টিকর্তা, রক্ষাকর্তা, পৃষ্ঠপোষক ও সুব্যবস্থাপক। এই জন্য সৃষ্টিজগতকে ‘আলাম’ এবং বহুবচনে আলামীন বলা হয়। [কাশশাফ] ‘আলামীন' বলতে কি বুঝায়, যদিও এখানে তার ব্যাখ্যা করা হয় নি, কিন্তু অপর আয়াতে তা স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে। আয়াতটি হচ্ছে,

(قَالَ فِرْعَوْنُ وَمَا رَبُّ الْعٰلَمِيْنَ ـ قَالَ رَبُّ السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا اِنْ كُنْتُمْ مُّوْقِنِيْنَ)

“ফিরআউন বললঃ রাব্বুল আলামীন কি? মূসা বললেনঃ যিনি আসমান-যমীন এবং এ দু'টির মধ্যবর্তী সমস্ত জিনিসের রব। " [সূরা আশ-শু'আরা: ২৩-২৪]

এতে ‘আলামীন' এর তাফসীর হয়ে গেছে যে, সৃষ্টি জগতের আর সব কিছুই এর অধীন। আসমান ও যমীনে এত অসংখ্য ‘আলাম’ বিদ্যমান যে, মানুষ আজ পর্যন্ত সেগুলোর কোন সীমা নির্ধারণ করতে সমর্থ হয় নি। মানব-জগত, পশু-জগত, উদ্ভিদ-জগত-এই জগত সমূহের কোন সীমা-সংখ্যা নাই, বরং এগুলো অসীম অতলস্পর্শ জগত-সমুদ্রের কয়েকটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিন্দু মাত্র। মানব-বুদ্ধি সে সম্পর্কে সঠিক ধারণা করতে একেবারেই সমর্থ নয়। [কুরতুবী, ফাতহুল কাদীর]

[৪] 'রব্‌' শব্দের বাংলা অর্থ করা হয় প্রভু-লালন পালনকারী। কিন্তু কুরআনে প্রয়োগভেদে এ শব্দের অর্থঃ-সৃষ্টি করা, সমানভাবে সজ্জিত ও স্থাপিত করা, প্রত্যেকটি জিনিসের পরিমাণ নির্ধারণ করা, পথ প্রদর্শন ও আইন বিধান দেওয়া, কোন জিনিসের মালিক হওয়া, লালন-পালন করা, রিযিক্‌ দান করা ও উচ্চতর ক্ষমতার অধিকারী হওয়া। তাছাড়া ভাঙ্গা গড়ার অধিকারী হওয়া, জীবনদান করা, মৃত্যু প্রদান করা, সন্তান দেয়া, আরোগ্য প্রদান করা ইত্যাদি যাবতীয় অর্থই এতে নিহিত আছে। আর যিনি এক সঙ্গে এই সব কিছু করার ক্ষমতা রাখেন তিনিই হচ্ছেন রব্‌। যেমন পবিত্র কুরআনের সূরা আল-আ’লায় এইরূপ ব্যাপক অর্থে রব্‌ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে,

(سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْاَعْلَى ـ الَّذِيْ خَلَقَ فَسَوّٰى ـ وَالَّذِيْ قَدَّرَ فَهَدٰى)

আপনার রব্‌ এর নামে তাসবিহ্‌ পাঠ করুন, যিনি মহান উচ্চ; যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন ও তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যথাযথ ভাবে সজ্জিত ও সুবিন্যস্ত করে দিয়েছেন; এবং যিনি সঠিক রূপে প্রত্যেকটি জিনিসের পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন। অতঃপর জীবন যাপন পন্থা প্রদর্শন করেছেন”। [সূরা আল-আ’লা: ১-৩]

এই আয়াত হতে নিঃসন্দেহে জানা যায় যে, ‘রব্‌’ তাঁকেই বলতে হবে যাঁর মধ্যে নিজস্ব ক্ষমতা বলে সৃষ্টি করার, সৃষ্টির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সমান ও সজ্জিত করার, প্রত্যেকটির পরিমাণ নির্ধারণ করার এবং হেদায়েত, দ্বীন ও শরীআত প্রদান করার যোগ্যতা রয়েছে। যিনি নিজ সত্তার গুণে মানুষ ও সমগ্র বিশ্ব-ভূবনকে সৃষ্টি করেছেন; শুধু সৃষ্টিই নয়-যিনি প্রত্যেকটি জিনিসকে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ ক্ষমতা দান করেছেন ও তার বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে পরস্পরের সহিত এমনভাবে সংযুক্ত করে সাজিয়ে দিয়েছেন যে, তার প্রত্যেকটি অঙ্গই পূর্ণ সামঞ্জস্য সহকারে নিজ নিজ স্থানে বসে গেছে। রব্‌ তিনিই—যিনি প্রত্যেকটি জিনিসকেই কর্মক্ষমতা দিয়েছেন, সেই সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট কাজ ও দায়িত্বও দিয়েছেন। প্রত্যেকের জন্য নিজের একটি ক্ষেত্র এবং তার সীমা নির্ধারিত করে দিয়েছেন। আল্লাহ্‌ বলেন,

(الَّذِيْ لَهٗ مُلْكُ السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضِ وَلَمْ يَتَّخِذْ وَلَدًا وَّلَمْ يَكُنْ لَّهُ شَرِيْكٌ فِي الْمُلْكِ وَخَلَقَ كُلَّ شَيْءٍ فَقَدَّرَهٗ تَقْدِيْرًا)

“যিনি প্রত্যেকটি জিনিস সৃষ্টি করেছেন, এবং তার পরিমাণ ঠিক করেছেন " [সূরা আল-ফুরকান:২] অতএব এক ব্যক্তি যখন আল্লাহ্‌কে রব্‌ বলে স্বীকার করে, তখন সে প্রকারান্তরে এ কথারই ঘোষণা করে যে, আমার বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ দৈহিক, আধ্যাত্মিক, দ্বীনী ও বৈষয়িক-যাবতীয় প্রয়োজন পূরণ করার দায়িত্ব ও ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ্‌ তা'আলাই গ্রহণ করেছেন। আমার এই সবকিছু একমাত্র তাঁরই মর্জির উপর নির্ভরশীল। আমার সবকিছুর একচ্ছত্র মালিক তিনিই। আর কেউ তার কোন কিছু পূরণ করার অধিকারী নয়।

বস্তুতঃ সৃষ্টিলোকে আল্লাহ্‌র দু'ধরনের রবুবিয়্যাত কার্যকর দেখা যায়: সাধারণ রবুবিয়াত বা প্রকৃতিগত এবং বিশেষ রবুবিয়াত বা শরী’আতগত।

১) প্রকৃতিগত বা সৃষ্টিমূলক- মানুষের জন্ম, তাহার লালন পালন ও ক্রমবিকাশ দান, তার শরীরকে ক্ষুদ্র হতে বিরাটত্বের দিকে, অসম্পূর্ণতা হতে পূর্ণতার দিকে অগ্রসর করা এবং তার মানসিক ক্রমবিকাশ ও উৎকর্ষতা দান।

২) শরীয়াত ভিত্তিক-মানুষের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রকে পথ প্রদর্শন করা, ভাল-মন্দ, পাপ-পুণ্য নির্দেশের জন্য নবী ও রাসূল প্রেরণ। যারা মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তি ও প্রতিভার পূর্ণত্ব বিধান করেন। এদেরই মাধ্যমে তারা হালাল, হারাম ইত্যাদি সম্পর্কে অবহিত হয়। নিষিদ্ধ কাজ হতে দূরে থাকতে এবং কল্যাণ ও মঙ্গলময় পথের সন্ধান লাভ করতে পারে।

অতএব, আল্লাহ্‌ তা'আলার জন্য মানুষের রব্‌ হওয়ার ব্যাপারটি খুবই ব্যাপক। কেননা আল্লাহ্‌ তা'আলা মানুষের রব্‌ হওয়া কেবল এই জন্যই নয় যে, তিনিই মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, তার দেহের লালন পালন করেছেন এবং তাহার দৈহিক শৃঙ্খলাকে স্থাপন করেছেন। বরং এজন্যও তিনি রব্‌ যে, তিনি মানুষকে আল্লাহ্‌র বিধান মুতাবিক জীবন যাপনের সুযোগদানের জন্য নবী প্রেরণ করেছেন এবং নবীর মাধ্যমে সেই ইলাহী বিধান দান করেছেন।

:
الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

দয়াময়, পরম দয়ালু [১]

ফুটনোট

[১] ‘রহমান-রাহীম' শব্দদ্বয়ের কারণে মূল আয়াতের অর্থ এই দাঁড়ায় যে, আল্লাহ্ তা'আলাই সমস্ত এবং সকল প্রকার প্রশংসার একচ্ছত্র অধিকারী কেবল এই জন্য নয় যে তিনি রববুল আলামীন, বরং এই জন্যও যে, তিনি ‘আর-রাহমান’ ও ‘আর-রাহীম’। বিশ্বের সর্বত্র আল্লাহ্‌ তা'আলার অপার অসীম দয়া ও অনুগ্রহ প্রতিনিয়ত পরিবেশিত হচ্ছে। প্রাকৃতিক জগতে এই যে নিঃসীম শান্তি শৃংখলা ও সামঞ্জস্য-সুবিন্যাস বিরাজিত রয়েছে, এর একমাত্র কারণ এই যে, আল্লাহ্‌র রহমত সাধারণভাবে সব কিছুর উপর অজস্র ধারায় বর্ষিত হয়েছে। সকল শ্রেণীর সৃষ্টিই আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ লাভ করেছে। কাফির, মুশরিক, আল্লাহ্‌দ্রোহী, নাস্তিক, মুনাফিক, কাউকেও আল্লাহ্‌ তার রহমত হতে জীবন-জীবিকা ও সাধারণ নিয়মে বৈষয়িক উন্নতি কোন কিছু থেকেই– বঞ্চিত করেন নি। এমন কি, আল্লাহ্‌র অবাধ্যতা এবং তাঁর বিরোধিতা করতে চাইলেও আল্লাহ্‌ নিজ হতে কাউকেও বাধা প্রদান করেন নি; বরং তিনি মানুষকে একটি সীমার মধ্যে যা ইচ্ছে তা করারই সুযোগ দিয়েছেন। এই জড় দুনিয়ার ব্যাপারে এটাই আল্লাহ্‌র নিয়ম। এই জন্যই আল্লাহ্‌ তা'আলা ঘোষণা করেছেন, “আর আমার রহমত সব কিছুকেই ব্যাপ্ত করে আছে। " [সূরা আল-আরাফ: ১৫৬]

কিন্তু এই জড় জগত চূড়ান্তভাবে শেষ হয়ে যাবার পর যে নূতন জগত স্থাপিত হবে, তা হবে নৈতিক নিয়মের বুনিয়াদে স্থাপিত এক আলাদা জগত। সেখানে আল্লাহ্‌র দয়া অনুকম্পা আজকের মত সর্বসাধারণের প্রাপ্য হবে না। তখন আল্লাহ্‌র রহমত পাবে কেবলমাত্র তারাই যারা দুনিয়ায় আখেরাতের রহমত পাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট সঠিক কর্মপন্থা গ্রহণ করেছে। ‘রাববুল আলামীন' বলার পর ‘আর-রাহমান’ ও ‘আর-রাহীম’ শব্দদ্বয় উল্লেখ করায় এই কথাই সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, এ বিশ্ব-লোকের লালন পালন, রক্ষণাবেক্ষন ও ক্রমবিকাশ দানের যে সুষ্ঠু ও নিখুঁত ব্যবস্থা আল্লাহ্‌ তা'আলা করেছেন, তার মূল কারণ সৃষ্টির প্রতি তাঁর অপরিসীম দয়া ও অনুগ্রহ ছাড়া আর কিছুই নয়। অনুরূপভাবে ‘রাহমান’ এর পর "রাহীম' উল্লেখ করে আল্লাহ্‌ তা'আলা এই কথাই বলতে চান যে, দুনিয়াতে আল্লাহ্‌র নিরপেক্ষ ও সাধারণ রহমত লাভ করে কেউ যেন অতিরিক্ত মাত্রায় মেতে না যায় এবং আল্লাহ্‌ ও তাঁর দেয়া দ্বীনকে ভুলে না বসে। কেননা দুনিয়ার জীবনের পর আরও একটি জগত, আরও একটি জীবন নিশ্চিতরূপে রয়েছে, যখন আল্লাহ্‌র রহমত নির্বিশেষে আনুগত্যশীল বান্দাদের জন্যই নির্দিষ্ট হবে। আর প্রকৃতপক্ষে তাদের জীবনই হবে সর্বোতভাবে সাফল্যমণ্ডিত।

:
مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ

বিচার দিনের মালিক [১]।

ফুটনোট

[১] এখানে আল্লাহ্‌কে ‘বিচার দিনের মালিক’ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এই দিনের প্রকৃত রূপটি যে কি এবং জনগণের সম্মুখে এই দিন কি অবস্থা দেখা দিবে তা এখানে প্রকাশ করে বলা হয় নি। অন্যত্র তা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে,

(وَمَآ اَدْرٰىكَ مَا يَوْمُ الدِّيْنِ ـ ثُمَّ مَآ اَدْرٰىكَ مَا يَوْمُ الدِّيْنِ ـ يَوْمَ لَا تَمْلِكُ نَفْسٌ لِّنَفْسٍ شَـيْــــًٔا وَالْاَمْرُ يَوْمَىِٕذٍ لِّلّٰهِ)

“বিচারের দিনটি কি, তা কিসে আপনাকে জানাবে? আবার জিজ্ঞাসা করি, কিসে আপনাকে জানাবে বিচারের দিনটি কি? তাহা এমন একটি দিন, যে দিন কেউই নিজের রক্ষার জন্য কোনই সাহায্যকারী পাবে না, এবং সমগ্র ব্যাপার নিরঙ্কুশ ভাবে আল্লাহ্‌র ইখতিয়ারভুক্ত হবে "[সূরা আল-ইনফিতার: ১৭-১৯] আর (يَوْمُ الدِّيْنِ) বলিতে যে বিচারের দিন, প্রতিফল-তথা শাস্তি বা পুরষ্কারদানের দিন বুঝায়, তা অন্য আয়াতাংশে স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে, (يَوْمَىِٕذٍ يُّوَفِّيْهِمُ اللّٰهُ دِيْنَهُمُ الْحَقَّ), "আজকের দিনে আল্লাহ্‌ লোকদের প্রকৃত কর্মফল পূর্ণ করে দিবেন" [সূরা আন-নূর: ২৫]

মোটকথা: আল্লাহ্‌ তা'আলা ঘোষণা করছেন, তিনি কেবল ‘রাববুল আলামীন, আর-রাহমান ও আর-রাহীমই নন, তিনি ‘মালিকি ইয়াওমিদিন'-ও। অর্থাৎ আল্লাহ্‌ তা'আলা কেবল এই জীবনের লালন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্যই এই বিরাট জগত-কারখানা স্থাপন করেন নি, এর একটি চূড়ান্ত পরিণতিও তিনি নির্ধারিত করেছেন। অর্থাৎ তোমরা কেউ মনে করো না যে, এই জীবনের অন্তরালে কোন জীবন নেই। এই ধারণাও মনে স্থান দিও না যে, সেদিনও তোমাদের তেমনি স্বেচ্ছাচারিতা চলবে যেমন আজ চলছে বলে তোমরা ধারণা করছ বরং সে দিন নিরঙ্কুশভাবে এক আল্লাহ্‌রই একচ্ছত্র কর্তৃত্ব, প্রভুত্ব ও মালিকানা পূর্ণমাত্রায় কার্যকর থাকবে। আজ যেমন তোমরা নিজেদের ইচ্ছামত কাজ করতে পারছ-অন্ততঃ এর পথে প্রাকৃতিক দিক দিয়ে কোন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয় না, সে চূড়ান্ত বিচার দিনে কিন্তু তা কিছু মাত্র চলবে না। সেদিন কেবলমাত্র আল্লাহ্‌র মর্জি কার্যকর হবে। আজ যেমন লোকেরা সত্যের প্রচণ্ড বিরোধিতা করে সুস্পষ্ট অন্যায় ও মারাত্মক যুলুম করেও সুনাম সুখ্যাতিসহ জীবন-যাপন করতে পারছে, সেদিন কিন্তু এসব ধোঁকাবাজী এক বিন্দুও চলবে না। বিচার দিবসের গুরুগম্ভীর পরিবেশ ও পরিস্থিতি সম্পর্কে সামান্য আন্দাজ করা যায় এই কথা হতে যে, বিচারের দিন জিজ্ঞেস করা হবে, “আজকের দিনে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ও প্রভুত্ব কার?” তার উত্তরে সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করা হবে, “তা সবই একমাত্র সার্বভৌম ও শক্তিমান আল্লাহ্‌র জন্য নির্দিষ্ট " [সূরা আল-গাফির:৫৯],

অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, “এটা সে দিনের কথা যেদিন কোন লোকই অন্য কারও জন্য কিছু করতে সক্ষম হবে না। সে দিন সমস্ত কর্তৃত্বই হবে একমাত্র আল্লাহ্‌র জন্য " [সূরা আল-ইনফিতার:১৯] আল্লাহ্‌র এই নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব কার্যকর হবে প্রথম সিংগায় ফুঁক দেয়ার দিন হতেই। বলা হয়েছে, "আর তাঁর নিরঙ্কুশ মালিকানা কার্যকর হবে সিংগায় ফুঁক দেয়ার দিনই "[সূরা আলআন’আম: ৭৩]

:
إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ

আমরা শুধু আপনারই ‘ইবাদাত করি, এবং শুধু আপনারই সাহায্য প্রার্থনা করি,
ফুটনোট

:
اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ

আমাদেরকে সরল পথের হিদায়াত দিন [১]

ফুটনোট

[১] স্নেহ ও করুণা এবং কল্যাণ কামনাসহ কাউকে মঙ্গলময় পথ দেখিয়ে দেয়া ও মনজিলে পৌঁছিয়ে দেয়াকে আরবী পরিভাষায় ‘হেদায়াত' বলে। ‘হেদায়াত’ শব্দটির দুইটি অর্থ। একটি পথ প্রদর্শন করা, আর দ্বিতীয়টি লক্ষ্য স্থলে পৌঁছিয়ে দেয়া। যেখানে এই শব্দের পর দুইটি object থাকবে (الى) থাকবে না, সেখানে এর অর্থ হবে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছিয়ে দেয়া। আর যেখানে এ শব্দের পর (الى) শব্দ আসবে, সেখানে অর্থ হবে পথ-প্রদর্শন। যেমন আল্লাহ্‌ তা'আলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে সম্বোধন করে বলেছেন,

(اِنَّكَ لَا تَهْدِيْ مَنْ اَحْبَبْتَ وَلٰكِنَّ اللّٰهَ يَهْدِيْ مَنْ يَّشَاءُ وَهُوَ اَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِيْنَ)

“নিশ্চয়ই আপনি লক্ষ্যস্থলে—মনজিলে পৌঁছিয়ে দিতে পারবেন না যাকে আপনি পৌঁছাতে চাইবেন। বরং আল্লাহ্‌ই লক্ষ্যস্থলে পৌছিয়ে দেন যাকে তিনি ইচ্ছা করেন " [সূরা আল-কাসাস: ৫৬] এ আয়াতে হেদায়েত শব্দের পর (الى) ব্যবহৃত হয়নি বলে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছিয়ে দেয়া অর্থ হয়েছে এবং তা করা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাধ্যায়ত্ত নয় বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে পথ প্রদর্শন রাসূলে কারীমের সাধ্যায়ত্ত বলে ঘোষণা করা হয়েছে। বলা হয়েছে,

(وَاِنَّكَ لَـــتَهْدِيْ اِلٰى صِرَاطٍ مُّسْتَقِيْمٍ)

“হে নবী! আর আপনি অবশ্যই সরল সঠিক দৃঢ় ঋজু পথ প্রদর্শন করেন "[সূরা আশ-শূরা:৫২]
কিন্তু লক্ষ্যস্থলে পৌঁছিয়ে দেয়ার কাজ কেবলমাত্র আল্লাহ্‌র জন্যই নির্দিষ্ট। তাই তিনি নিজেই ঘোষণা করেছেন,

(وَّلَهَدَيْنٰهُمْ صِرَاطًا مُّسْتَقِيْمًا)

“আর অবশ্যই আমরা তাদেরকে সরল সোজা সুদৃঢ় পথে পৌঁছিয়ে দিতাম। ” [সূরা আন-নিসা ৬৮]

সূরা আল-ফাতিহা’র আলোচ্য আয়াতে হেদায়েত শব্দের পর (الى) শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি। ফলে এর অর্থ হবে সোজা সুদৃঢ় পথে মনজিলের দিকে চালনা করা। অর্থাৎ যেখানে বান্দাহ্‌ আল্লাহ্‌র নিকট প্রার্থনা করে শুধু এতটুকু বলে না যে, হে আল্লাহ্! আপনি আমাদেরকে সোজা সুদৃঢ় পথের সন্ধান দিন। বরং বলে, 'হে আল্লাহ্‌, আপনি আমাদেরকে সরল সুদৃঢ় পথে চলবার তাওফীক দিয়ে মনজিলে পৌছিয়ে দিন। কেননা শুধু পথের সন্ধান পাইলেই যে সে পথ পাওয়া ও তাতে চলে মনজিলে পৌঁছা সম্ভবপর হবে তা নিশ্চিত নয়।

কিন্তু ‘সিরাতে মুস্তাকীম’ কি? সিরাত শব্দের অর্থ হচ্ছে, রাস্তা বা পথ। আর মুস্তাকীম হচ্ছে, সরল সোজা। সে হিসেবে সিরাতে মুসতাকীম হচ্ছে, এমন পথ, যা একেবারে সোজা ও ঋজু, প্রশস্ত ও সুগম; যা পথিককে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌছিয়ে দেয়; যে পথ দিয়ে লক্ষ্যস্থল অতি নিকটবতী এবং মনযিলে মাকছুদে পৌঁছার জন্য যা একমাত্র পথ, যে পথ ছাড়া লক্ষ্যে পৌছার অন্য কোন পথই হতে পারে না। আল্লাহ্‌ বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ আমারও রব তোমাদেরও রব, অতএব একমাত্র তারই দাস হয়ে থাক। এটাই হচ্ছে সিরাতুম মুস্তাকীম-সঠিক ও সুদৃঢ় ঋজু পথ " [সূরা মারইয়াম: ৩৬] অর্থাৎ আল্লাহ্‌কে রব স্বীকার করে ও কেবল তাঁরই বান্দাহ্‌ হয়ে জীবন যাপন করলেই সিরাতুম মুস্তাকীম অনুসরণ করা হবে। অন্যত্র ইসলামের জরুরী বিধি-বিধান বর্ণনা করার পর আল্লাহ্‌ তা'আলা বলেন, “আর এটাই আমার সঠিক দৃঢ় পথ, অতএব তোমরা এই পথ অনুসরণ করে চল। এছাড়া আরও যত পথ আছে, তাহার একটিতেও পা দিও না; কেননা তা করলে সে পথগুলো তোমাদেরকে আল্লাহ্‌র পথ হতে বিচ্ছিন্ন করে দিবে-ভিন্ন দিকে নিয়ে যাবে। আল্লাহ্‌ তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছেন এ উদ্দেশ্যে, যেন তোমরা ধ্বংসের পথ হতে আত্মরক্ষা করতে পার " [সূরা আল-আন আমঃ ১৫৩]

একমাত্র আল্লাহ্‌র নিকট থেকে যে পথ ও বিধি-বিধান পাওয়া যাবে, তাই মানুষের জন্য সঠিক পথ। আল্লাহ্‌ বলেন, “প্রকৃত সত্য-সঠিক-ঋজু-সরল পথ প্রদর্শন করার দায়িত্ব আল্লাহ্‌র উপর, যদিও আরও অনেক বাঁকা পথও রয়েছে। আর আল্লাহ্‌ চাইলে তিনি সব মানুষকেই হেদায়াতের পথে পরিচালিত করতেন। ” [সূরা আন-নাহল:৯]

সিরাতে মুস্তাকীমের তাফসীর কোন কোন মুফাসসির করেছেন, ইসলাম। আবার কারও কারও মতে, কুরআন। [আত-তাফসীরুস সহীহ] বস্তুত: আল্লাহ্‌র প্রদত্ত বিশ্বজনীন দ্বীনের অন্তর্নিহিত প্রকৃত রূপ সিরাতুল মুস্তাকীম' শব্দ হতে ফুটে উঠেছে। আল্লাহ্ তা'আলার দাসত্ব কবুল করে তারই বিধান অনুসারে জীবন যাপন করার পথই হচ্ছে সিরাতুল মুস্তাকীম' এবং একমাত্র এই পথে চলার ফলেই মানুষ আল্লাহ্‌র নিয়ামত ও সন্তোষ লাভ করতে পারে। সে একমাত্র পথই মানব জীবনের প্রকৃত ও চূড়ান্ত সাফল্যের জন্য একান্ত অপরিহার্য। তাই সে একমাত্র পথে চলার তওফীক প্রার্থনা করার শিক্ষা দেয়া হয়েছে এই আয়াতটিতে।
কিন্তু আল্লাহ্‌র নিকট হতে এই পথ কিরূপে পাওয়া যেতে পারে? সে পথ ও পন্থা নির্দেশ করতে গিয়ে আল্লাহ্‌ এর তিনটি সুস্পষ্ট পরিচয় উল্লেখ করেছেন:

১. এই জীবন কিভাবে যাপন করতে হবে তা তাদের নিকট হতে গ্রহণ করতে হবে, যারা উক্ত বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করে আল্লাহ্‌র নিকট হতে নিয়ামত ও অসীম অনুগ্রহ লাভ করেছে।

২. এই পথের পথিকদের উপর আল্লাহ্‌র গজব নাযিল হয় নি, অভিশপ্তও তারা নয়।

৩. তারা পথভ্রান্ত লক্ষ্যভ্রষ্টও নয়। পরবর্তী আয়াতসমূহে এ কথা কয়টির বিস্তারিত আলোচনা আসছে।

:
صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ

তাদের পথ, যাদেরকে আপনি নিয়ামত দিয়েছেন [১], যাদের উপর আপনার ক্রোধ আপতিত হয়নি [২] এবং যারা পথভ্রষ্টও নয় [৩]

ফুটনোট

[১] এটা আল্লাহ্‌র নির্ধারিত সঠিক ও দৃঢ় পথের প্রথম পরিচয়। এর অর্থ এই যে, আল্লাহ্‌র নিকট হতে যে পথ নাযিল হয়েছে, তা অনুসরণ করলে আল্লাহ্‌র রহমত ও নিয়ামত লাভ করা যায়। দ্বিতীয়তঃ তা এমন কোন পথই নয়, যাহা আজ সম্পূর্ণ নূতনভাবে পেশ করা হচ্ছে- পূর্বে পেশ করা হয় নি। বরং তা অতিশয় আদিম ও চিরন্তন পথ। মানুষের এই কল্যাণের পথ অত্যন্ত পুরাতন, ততখানি পুরাতন যতখানি পুরাতন হচ্ছে স্বয়ং মানুষ। প্রথম মানুষ হতেই এটা মানুষের সম্মুখে পেশ করা হয়েছে, অসংখ্য মানুষ এ পথ প্রচার করেছেন, কবুল করার আহবান জানিয়েছেন, এটা বাস্তবায়িত করার জন্য প্রাণপণ সংগ্রাম করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত তারা আল্লাহ্‌র নিকট হতে, অপূর্ব নিয়ামত ও সম্মান লাভের অধিকারী প্রমাণিত হয়েছেন। এই নিয়ামত এই দুনিয়ার জীবনেও তারা পেয়েছেন, আর আখেরাতেও তা তাদের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে রয়েছে। মূলতঃ আল্লাহ্‌র নিয়ামতপ্রাপ্ত লোকদের চলার পথ ও অনুসৃত জীবনই হচ্ছে বিশ্ব মানবতার জন্য একমাত্র পথ ও পন্থা। এতদ্ব্যতীত মানুষের পক্ষে গ্রহণযোগ্য, অনুসরণীয় ও কল্যাণকর পথ আর কিছুই হতে পারে না। কিন্তু আল্লাহ্‌র অনুগ্রহপ্রাপ্ত লোক কারা এবং তাদের পথ বাস্তবিক পক্ষে কি? এর উত্তর অন্য আয়াতে এসেছে, “যা করতে তাদেরকে উপদেশ দেয়া হয়েছিল তারা তা করলে তাদের ভাল হত এবং চিত্তস্থিরতায় তারা দৃঢ়তর হত। এবং তখন আমি আমার কাছ থেকে ‘তাদেরকে নিশ্চয় মহাপুরস্কার প্রদান করতাম এবং তাদেরকে নিশ্চয় সরল পথে পরিচালিত করতাম। আর কেউ আল্লাহ্‌ এবং রাসুলের আনুগত্য করলে সে নবী, সত্যনিষ্ঠ, শহীদ ও সৎকর্মপরায়ণ (যাদের প্রতি আল্লাহ্‌ অনুগ্রহ করেছেন) তাদের সঙ্গী হবে এবং তারা কত উত্তম সঙ্গী! এগুলো আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ। সর্বজ্ঞ হিসেবে আল্লাহ্‌ই যথেষ্ট " [সূরা আন-নিসাঃ ৬৬-৭০] এ আয়াত থেকে সঠিক ও দৃঢ় জীবন পথ যে কোনটি আর আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ প্রাপ্ত লোকগণ যে কোন পথে চলেছেন ও চলে আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ পাবার অধিকারী হয়েছেন তা সুস্পষ্ট ও বিস্তারিতভাবে জানা যায়। তারা হচ্ছেন আম্বিয়া, সিদ্দীক, শহীদ ও সালেহীন। [ইবন কাসীর]

[২] এটা আল্লাহ্‌র নির্ধারিত ‘সিরাতুল মুস্তাকীম' এর দ্বিতীয় পরিচয়। আল্লাহ্‌ তা'আলা যে পথ মানুষের সম্মুখে চিরন্তন কল্যাণ লাভের জন্য উপস্থাপিত করেছেন সে পথ অভিশাপের পথ নয় এবং সে পথে যারা চলে তাদের উপর কখনই আল্লাহ্‌র অভিশাপ বর্ষিত হতে পারে না। সে পথ তো রহমতের পথ বরং সে পথের পথিকদের প্রতি দুনিয়াতে যেমন আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ ও সাহায্য বর্ষিত হয়ে থাকে, আখেরাতেও তারা আল্লাহ্‌র চিরস্থায়ী সন্তোষ লাভের অধিকারী হবে। এই আয়াতাংশের অপর একটি অনুবাদ হচ্ছে, “তাদের পথ নয় যাদের উপর আল্লাহ্‌র অভিশাপ নাযিল হয়েছে। " এরূপ অনুবাদ করলে তাতে ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ ছাড়া আরও একটি পথের ইঙ্গিত মানুষের সামনে উপস্থাপিত হয়, যা আল্লাহ্‌র নিকট হতে অভিশপ্ত এবং সেই পথ হতে মানুষকে রক্ষা করাই এর উদ্দেশ্য মনে হয়। কিন্তু এখানে আল্লাহ্‌ মূলতঃ একটি পথই উপস্থাপিত করেছেন এবং একটি পথেরই ইতিবাচক দুইটি বিশেষণ দ্বারা সেটাকে অত্যধিক সুস্পষ্ট করে তুলেছেন। তাই অনেকেই পূর্বোক্ত প্রথম অনুবাদটিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। উভয় অর্থের জন্য [দেখুন, যামাখশারী; ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর]

প্রথম অনুবাদ বা দ্বিতীয় অনুবাদ যাই হোক না কেন এখানে একথা স্পষ্ট হচ্ছে যে, আল্লাহ্‌র প্রতি ঈমানদার লোকদেরকে প্রকারান্তরে এমন পথ ও পন্থা গ্রহণ হতে বিরত থাকবার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে, যা আল্লাহ্‌র অভিশাপের পথ, যে পথে চলে কোন কোন লোক অভিশপ্ত' হয়েছে।

কিন্তু সে অভিশপ্ত কারা, কারা কোন পথে চলে আল্লাহ্‌র নিকট হতে অভিশপ্ত হয়েছে, তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেয়া আবশ্যক। কুরআন মাজীদ ঐতিহাসিক জাতিদের সম্পর্কে উল্লেখ করতে গিয়ে বলা হয়েছেঃ “আর তাদের উপর অপমান লাঞ্ছনা ও দারিদ্র্যের কষাঘাত হানা হয়েছে এবং তারা আল্লাহ্‌র অভিশাপ প্রাপ্ত হয়েছে। " [সূরা আল-বাকারাহ: ৬১]

পূর্বাপর আলোচনা করলে নিঃসন্দেহে এটা বুঝতে পারা যায় যে, এ কথাটি ইয়াহুদীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে। তাই ‘মাগদুব’ বলতে যে এখানে ইয়াহুদীদের বুঝানো হয়েছে, সে বিষয়ে সমস্ত মুফাসসিরই একমত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীসেও অনুরূপ স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে [দেখুন, মুসনাদে আহমাদ ৫/৩২,৩৩]

[৩] এটি ‘সিরাতুল মুস্তাকীম'-এর তৃতীয় ও সর্বশেষ পরিচয়। অর্থাৎ যারা সিরাতুল মুস্তাকীম এ চলে আল্লাহ্‌র নিয়ামত লাভ করতে পেরেছেন তারা পথভ্রষ্ট নন-কোন গোমরাহীর পথে তারা চলেন না। পূর্বোল্লেখিত আয়াতের ন্যায় এ আয়াতেরও অন্য অনুবাদ হচ্ছে, ‘তাদের পথে নয় যারা পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে, যারা গোমরাহ হয়ে আল্লাহ্‌র উপস্থাপিত পথ হতে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে।’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস থেকে এ পথ-ভ্ৰষ্ট লোকদের পরিচয় জানতে পারা যায় যে, দুনিয়ার ইতিহাসে নাসারাগণ হচ্ছে কুরআনে উল্লেখিত এ গোমরাহ ও পথ-ভ্ৰষ্ট জাতি। [মুসনাদে আহমাদ: ৫/৩২,৩৩, ৭৭]

কোন মুসলিম যখন সূরা ফাতিহা পাঠ করে, তখন সে প্রকারান্তরে এ কথাই ঘোষণা করে যে, “হে আল্লাহ্‌ আমরা স্বীকার করি, আপনার সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে যে জীবন-ধারা গড়ে উঠে তা-ই একমাত্র মুক্তির পথ। এজন্য আপনার নির্ধারিত এ পথে চলে যারা আপনার নিয়ামত পেয়েছেন সেই পথই একমাত্র সত্য ও কল্যাণের পথ, আল্লাহ্‌ সেই পথেই আমাদেরকে চলবার তাওফীক দিন। আর যাদের উপর আপনার অভিশাপ বর্ষিত হয়েছে ও যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে তাদের যেন আমরা অনুসরণ না করি। কেননা, সে পথে প্রকৃতই কোন কল্যাণ নেই। " বস্তুতঃ পবিত্র কুরআন দুনিয়ার বর্তমান বিশ্বমানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ ও একমাত্র সর্বশেষ আল্লাহ্‌র দেয়া গ্রন্থ। এর উপস্থাপিত আদর্শ ও জীবন পথই হচ্ছে বিশ্বমানবতার একমাত্র স্থায়ী ও কল্যাণের পথ। এর বিপরীত সমস্ত জীবনাদর্শকে মিথ্যা প্রমাণ করে একমাত্র এরই উপস্থাপিত আদর্শের ভিত্তিতে নিজেদেরকে গঠন করা মুসলিমদের একমাত্র দায়িত্ব। মুসলিমরা আজও সেই দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ হলে সূরা আল-ফাতিহা তাদের জীবনে সার্থক হবে।

মূলতঃ যারা সূরা আল-ফাতিহার অর্থ বুঝে সূরা আল-ফাতিহা পাঠ শেষ করার পর তাদের মন থেকে দো’আ করবে, আল্লাহ্‌ তা'আলা তাদের দো’আ কবুল করবেন। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

(اِذا قَالَ الْاِمَامُ غَيْرِ الْمَغْضُوْبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ، فَقُوْلُوْ اٰمِيْنَ، فَمَنْ وَافَقَ قَوْلُهٗ قَوْلَ الْمَلَائِكَةِ غُفِرَ لَهٗ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه)

“যখন ইমাম ‘গাইরিল মাগদূবি ‘আলাইহিম ওয়ালাদ দ্বল্লীন’ বলে তখন তোমরা ‘আমীন’ বা ‘হে আল্লাহ্‌ কবুল কর’ একথাটি বল; কেননা যার কথাটি ফেরেশতাদের কথা অনুযায়ী হবে তার পূর্বেরগুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে "[বুখারী ৭৮২,মুসলিম: ৪০৯l

অন্য বর্ণনায় এসেছে,

(وَاِذا قَالَ: غَيْرِ الْمَغْضُوْبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ، فَقُوْلُوْ اٰمِيْنَ، يُجِيْبُكمُ اللّٰهُ)

“যখন ‘ইমাম গাইরিল মাগদূবি ‘আলাইহিম ওয়ালাদ দ্বল্লীন’ বলে তখন তোমরা ‘আমীন’ বা ‘হে আল্লাহ্‌ কবুল কর’ একথাটি বল; এতে আল্লাহ্‌ তোমাদের আহবানে সাড়া দিবেন (দো’আ কবুল করবেন) "[মুসলিম: ৪০৪]

অন্য এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

(مَا حَسَدَتْكُمْ اليَهُوْدُ عَلَى شَيئٍ مَا حَسَدَ تْكُمُ عَلَى السَّلَامِ وَالتَّأْمِيْنِ)

“ইয়াহুদীরা তোমাদেরকে তোমাদের ‘সালাম’ ও ‘আমীন' বলার চেয়ে বেশী কোন বিষয়ের উপর হিংসা করে না।” [ইবনে মাজাহঃ ৮৫৬]

: ৪৫
وَاسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ ۚ وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلَّا عَلَى الْخَاشِعِينَ

আর তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো [১]। আর নিশ্চয় তা বিনয়ীরা ছাড়া [২] অন্যদের উপর কঠিন।

ফুটনোট

[১] মুজাহিদ রাহিমাহুল্লাহ ‘সবর’ এর তাফসীর করেছেন ‘সাওম’। [আত-তাফসীরুস সহীহ] আল্লামা শানকীতী বলেন, ধৈৰ্য্যের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করা সুস্পষ্ট বিষয়। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করলে এক সময় তার উপর আল্লাহ্‌র রহমত নাযিল হবে এবং সে সফলকাম হবে। কিন্তু সালাতের মাধ্যমে কিভাবে সাহায্য প্রার্থনা করবে? এর উত্তর হচ্ছে, সালাতের মাধ্যমে অন্যায় অশ্লীল কাজ থেকে মুক্তি লাভ করা যায়। আল্লাহ্‌ বলেন, “নিশ্চয় সালাত অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে দূরে রাখে। " [সূরা আল-আনকাবুত: ৪৫]

এটা নিশ্চয় এক বিরাট সাহায্য। তাছাড়া সালাতের মাধ্যমে রিযকের মধ্যে প্রশস্তি আসে। আল্লাহ্‌ বলেন, “আর আপনার পরিবারবর্গকে সালাতের আদেশ দিন ও তাতে অবিচল থাকুন, আমরা আপনার কাছে কোন জীবনোপকরণ চাই না; আমরাই আপনাকে জীবনোপকরণ দেই এবং শুভ পরিণাম তো তাকওয়াতেই নিহিত " [সূরা ত্বা-হা: ১৩২]

আর এ জন্যই “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কোন বিষয়ে সমস্যায় পড়তেন বা চিন্তাগ্রস্ত হতেন তখনই তিনি সালাতে দাঁড়িয়ে যেতেন”। [মুসনাদে আহমাদ: ৫/৩৮৮]

সুতরাং যে কোন বিপদাপদে ও সমস্যায় সালাতে দাঁড়িয়ে আল্লাহ্‌র সাথে সম্পর্কটা তাজা করে নেয়ার মাধ্যমে সাহায্য লাভ করা যেতে পারে। সালফে সালেহীন তথা সাহাবা, তাবেয়ীন ও সত্যনিষ্ঠ ইমামগণ থেকে এ ব্যাপারে বহু ঘটনা বর্ণিত আছে। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমার নিকট তার ভাই 'কুছাম' এর মৃত্যুর খবর পৌছল, তিনি তখন সফর অবস্থায় ছিলেন। তিনি তার বাহন থেকে নেমে দুরাকাআত সালাত আদায় করেন এবং এ আয়াত তেলাওয়াত করলেন। তাবারী অনুরূপভাবে আবদুর রহমান ইবনে আউফ রাদিয়াল্লাহু আনহু অসুস্থ অবস্থায় পড়লে একবার এমনভাবে বেহুশ হয়ে যান যে সবাই ধারণা করে বসেছিল যে, তিনি বুঝি মারাই গেছেন। তখন তার স্ত্রী উম্মে কুলসুম মসজিদে গিয়ে আল্লাহ্‌র নির্দেশ অনুসারে সবর ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করলেন। [মুস্তাদরাকে হাকিম: ২/২৬৯]

[২] কুরআন ও সুন্নায় যেখানে (خُشُوْعٌ) বা বিনয়ের প্রতি উৎসাহ প্রদানের বর্ণনা রয়েছে, সেখানে এর অর্থ অক্ষমতা ও অপারগতাজনিত সেই মানসিক অবস্থাকেই বুঝানো হয়েছে, যা আল্লাহ্ তা'আলার মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব এবং তার সামনে নিজের ক্ষুদ্রতা ও দীনতার অনুভূতি থেকে সৃষ্টি হয়। এর ফলে ইবাদাত সহজতর হয়ে যায়। কখনো এর লক্ষণাদি দেহেও প্রকাশ পেতে থাকে। তখন সে শিষ্টাচারসম্পন্ন বিনম্র ও কোমল মন বলে পরিদৃষ্ট হয়। যদি হৃদয়ে আল্লাহ্‌ভীতি ও নম্রতা না থাকে, মানুষ বাহ্যিকভাবে যতই শিষ্টাচারের অধিকারী ও বিনম্র হোক না কেন, প্রকৃত প্রস্তাবে সে বিনয়ের অধিকারী হয় না। বিনয়ের লক্ষণাদি ইচ্ছাকৃতভাবে প্রকাশ করাও বাঞ্ছনীয় নয়। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু একবার এক যুবককে নতশিরে বসে থাকতে দেখে বললেন, মাথা উঠাও, বিনয় হৃদয়ে অবস্থান করে। ইবরাহীম নখয়ী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘মোটা কাপড় পরা, মোটা খাওয়া এবং মাথা নত করে থাকাই বিনয় নয় (خُشُوْعٌ) বা বিনয় অর্থ ‘অধিকারের ক্ষেত্রে ইতর-ভদ্র নির্বিশেষে সবার সংগে একই রকম ব্যবহার করা এবং আল্লাহ্ তাআলা যা ফরয করে দিয়েছেন তা পালন করতে গিয়ে হৃদয়কে শুধু তাঁরই জন্য নির্দিষ্ট ও কেন্দ্রিভূত করে নেয়া। সারকথা, ইচ্ছাকৃতভাবে কৃত্রিম উপায়ে বিনয়ীদের রূপ ধারণ করা শয়তান ও প্রবৃত্তির প্রতারণা মাত্র। আর তা অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ। অবশ্য যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়, তবে তা ক্ষমার্হ।

: ১২৬
وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّ اجْعَلْ هَٰذَا بَلَدًا آمِنًا وَارْزُقْ أَهْلَهُ مِنَ الثَّمَرَاتِ مَنْ آمَنَ مِنْهُمْ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ۖ قَالَ وَمَنْ كَفَرَ فَأُمَتِّعُهُ قَلِيلًا ثُمَّ أَضْطَرُّهُ إِلَىٰ عَذَابِ النَّارِ ۖ وَبِئْسَ الْمَصِيرُ

আর স্মরণ করুন, যখন ইবরাহীম বলেছিলেন, 'হে আমার রব ! এটাকে নিরাপদ শহর করুন এবং এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা আল্লাহ্‌ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান আনে [১] তাদেরকে ফলমূল হতে জীবিকা প্রদান করুন’। তিনি (আল্লাহ্‌) বললেন, যে কুফরী করবে তাকেও কিছু কালের জন্য জীবনোপভোগ করতে দিব, তারপর তাকে আগুনের শাস্তি ভোগ করতে বাধ্য করব। আর তা কত নিকৃষ্ট প্রত্যাবর্তনস্থল !

ফুটনোট

[১] আলোচ্য আয়াতে মুমিন ও কাফের নির্বিশেষে সমগ্র মক্কাবাসীর জন্য শান্তি ও সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের দোআ করা হয়েছে। ইতঃপূর্বে এক দোআয় যখন ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম স্বীয় বংশধরের মুমিন ও কাফের নির্বিশেষে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, তখন আল্লাহ্ তা'আলার পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে, মুমিনদের পক্ষে এ দোআ কবুল হল, যালিম ও মুশরিকদের জন্য নয়। সে দোআটি ছিল নেতৃত্ব লাভের দোআ খলীল ‘আলাইহিস সালাম ছিলেন আল্লাহ্‌র বন্ধুত্বের মহান মর্যাদায় উন্নীত ও আল্লাহ্‌ভীতির প্রতীক। তাই এ ক্ষেত্রে সে কথাটি মনে পড়ে গেল এবং তিনি দোআর শর্ত যোগ করলেন যে, আর্থিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও শান্তির এ দোআ শুধু মুমিনদের জন্য করেছি। আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে এ ভয় ও সাবধানতার মূল্য দিয়ে বলা হয়েছে (وَمَنْ كَفَرَ) অর্থা ৎ পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য আমি সমস্ত মক্কাবাসীকেই দান করব, যদিও তারা কাফের মুশরিক হয়। তবে মুমিনদেরকে দুনিয়া ও আখেরাত সর্বত্রই তা দান করব, কিন্তু কাফেররা আখেরাতে শাস্তি ছাড়া আর কিছুই পাবে না। [ মাআরিফুল কুরআন ]

: ১২৭
وَإِذْ يَرْفَعُ إِبْرَاهِيمُ الْقَوَاعِدَ مِنَ الْبَيْتِ وَإِسْمَاعِيلُ رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا ۖ إِنَّكَ أَنْتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ

আর স্মরণ করুন, যখন ইবরাহীম ও ইসমাঈল কাবাঘরের ভিত্তি স্থাপন করছিলেন, (তারা বলছিলেন) ‘হে আমাদের রব [১]! আমাদের পক্ষ থেকে কবুল করুন [২]। নিশ্চয় আপনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ [৩]।

ফুটনোট

[১] এখানে লক্ষণীয় যে, ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম (رب) শব্দ দ্বারা দো'আ আরম্ভ করেছেন। তিনি এই শব্দের মাধ্যমে দো'আ করার রীতি শিক্ষা দিয়েছেন। কারণ এ জাতীয় শব্দ আল্লাহ্‌র রহমত ও কৃপা আকৃষ্ট করার ব্যাপারে খুবই কার্যকর ও সহায়ক। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, “ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম ইসমাঈলকে বললেন, হে ইসমাঈল। আল্লাহ্‌ আমাকে একটি কাজের নির্দেশ দিয়েছেন। ইসমাঈল বললেন, আপনার রব আপনাকে যা নির্দেশ করেছেন তা বাস্তবায়িত করুন। ইবরাহীম বললেন, তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে? ইসমাঈল বললেন, আমি আপনাকে সাহায্য করব। ইবরাহীম পাশের একটি উচু জায়গা দেখিয়ে বললেন, আল্লাহ্‌ আমাকে এখানে একটি ঘর বানাতে নির্দেশ দিয়েছেন। ইবনে আব্বাস বলেন, তারপর তারা দু’জনে ঘরের ভিত্তি স্থাপন করে তা উচু করছিলেন। ইসমাঈল পাথর নিয়ে আসতেন আর ইবরাহীম ঘর বানাতেন। তারপর যখন ঘর উচু হয়ে গেল তখন ইসমাঈল এ পাথরটি এনে ইবরাহীমের পায়ের নীচে রাখলেন। তখন ইবরাহীম তাতে দাঁড়িয়ে ঘর বানাতে থাকলেন। এমতাবস্থায় তাদের মুখ থেকে এ দোআ বের হচ্ছিল। ” [বুখারী ৩৬৬৪]

[২] ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম আল্লাহ্‌র নির্দেশে সিরিয়ার সুজলা সুফলা সুদর্শন ভূ-খণ্ড ছেড়ে মক্কার বিশুস্ক পাহাড়সমূহের মাঝখানে স্বীয় পরিবার-পরিজনকে এনে রাখেন এবং কা'বা গৃহের নির্মাণে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। এরূপ ক্ষেত্রে অন্য কোন আত্মত্যাগী ইবাদাতকারীর অন্তরে অহংকার দানা বাধতে পারত এবং সে তার ক্রিয়াকর্মকে অনেক মূল্যবান মনে করতে পারত। কিন্তু এখানে ছিলেন আল্লাহ্‌র এমন একজন বন্ধু যিনি আল্লাহ্‌র প্রতাপ এবং মহিমা সম্পর্কে যথার্থভাবে অবহিত। তিনি জানতেন, আল্লাহ্‌র উপযুক্ত ইবাদাত ও আনুগত্য কোন মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। প্রত্যেকেই নিজ নিজ শক্তি-সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করে। তাই আমল যত বড়ই হোক সেজন্য অহংকার না করে কেঁদে কেঁদে এমনি দো'আ করা প্রয়োজন যে, হে আমার রব! আমার এ আমল কবুল হোক। কা'বা গৃহ নির্মাণের আমল প্রসংগে ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম তাই বলেছেন, (رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا) হে রব! আমাদের এ আমল কবুল করুন। কেননা, আপনি শ্রোতা, আপনি সর্বজ্ঞ। [ মা'আরিফুল কুরআন ]

[৩] সন্তানের প্রতি স্নেহ ও মমতা শুধু একটি স্বাভাবিক ও সহজাত বৃত্তিই নয়; বরং এ ব্যাপারে আল্লাহ্ তা'আলারও নির্দেশ রয়েছে। উল্লেখিত আয়াতসমূহ এর প্রমাণ। তিনি সন্তানদের দুনিয়া ও আখেরাতের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য আল্লাহ্‌র কাছে দোআ করেছেন।

: ১২৮
رَبَّنَا وَاجْعَلْنَا مُسْلِمَيْنِ لَكَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِنَا أُمَّةً مُسْلِمَةً لَكَ وَأَرِنَا مَنَاسِكَنَا وَتُبْ عَلَيْنَا ۖ إِنَّكَ أَنْتَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ

‘হে আমাদের রব ! আর আমাদের উভয় কে আপনার একান্ত অনুগত করুন এবং আমাদের বংশধর হতে আপনার এক অনুগত জাতি উত্থিত করুন। আর আমাদের কে ‘‘ইবাদাতের নিয়ম-পদ্ধতি দেখিয়ে দিন [১] এবং আমদের তাওবা কবুল করুন। নিশ্চয় আপনিই বেশী তাওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।

ফুটনোট

[১] আয়াতে বর্ণিত (مَنَاسِكَ) এর অর্থ ইবাদাতও হয়, যেমনটি উপরে করা হয়েছে। কাতাদাহ বলেন, এর অর্থ হচ্ছে, হজের নিয়মাবলী। [তাবারী]

: ১২৯
رَبَّنَا وَابْعَثْ فِيهِمْ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيهِمْ ۚ إِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ

‘হে আমাদের রব! আর আপনি তাদের মধ্য থেকে তাদের কাছে এক রাসূল পাঠান [১], যিনি আপনার আয়াতসমূহ তাদের কাছে তিলাওয়াত করবেন [২] ; তাদেরকে কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দেবেন [৩] এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন [৪] আপনি তো পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’।

ফুটনোট

[১] হাদীসে বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আমি আমার সূচনা বলে দিচ্ছি, আমার পিতা ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম-এর দোআ, ঈসা '‘আলাইহিস সালাম-এর সুসংবাদ এবং আমার মা স্বপ্নে দেখেছিলেন যে, তার থেকে একটি আলো বের হল, যে আলোতে সিরিয়ার প্রাসাদসমূহ আলোকিত হয়েছে। [মুসনাদে আহমাদঃ ৫/২৬২] ঈসা ‘আলাইহিস সালাম-এর সুসংবাদের অর্থ তার এ উক্তি

(وَمُبَشِّرًۢا بِرَسُوْلٍ يَّاْتِيْ مِنْۢ بَعْدِي اسْمُهٗٓ اَحْمَدُ)"

“আমি এমন এক নবীর সুসংবাদদাতা, যিনি আমার পরে আসবেন। তার নাম আহমাদ”। [সূরা আস-সাফঃ ৬] তার জননী গর্ভাবস্থায় স্বপ্নে দেখেন যে, তার পেট থেকে একটি নূর বের হয়ে সিরিয়ার প্রাসাদসমূহ আলোকোজ্জ্বল করে তুলেছে। কুরআনে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আবির্ভাবের আলোচনা প্রসংগে দু’জায়গায়, সূরা আলে-ইমরানের ১৬৪তম আয়াতে এবং সূরা জুমুআয় ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম-এর দোআয় উল্লেখিত ভাষারই পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। এভাবে ইংগিত করা হয়েছে যে, ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম যে নবীর জন্য দোআ করেছিলেন, তিনি হচ্ছেন শেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু '‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

[২] ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালামের দোআর কারণে আমাদের রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রেরণের মূল উদ্দেশ্য তিনটি। তন্মধ্যে প্রথম হচ্ছে, আল্লাহ্‌র আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করা। তিলাওয়াতের আসল অর্থ অনুসরণ করা। কুরআন ও হাদীসের পরিভাষায় এ শব্দটি কুরআন ও অন্যান্য আসমানী কিতাব পাঠ করার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কারণ, যে লোক এসব কালাম পাঠ করে, এর অনুসরণ করাও তার একান্ত কর্তব্য। আসমানী গ্রন্থ ঠিক যেভাবে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে নাযিল হয়, হুবহু তেমনিভাবে পাঠ করা জরুরী। নিজের পক্ষ থেকে তাতে কোন শব্দ অথবা স্বরচিহ্নটিও পরিবর্তন পরিবর্ধন করার অনুমতি নেই। ইমাম রাগেব বলেন, ‘আল্লাহ্‌র কালাম ছাড়া অন্য কোন গ্রন্থ অথবা কালাম পাঠ করাকে সাধারণ পরিভাষায় তিলাওয়াত বলা যায়
না’। [মুফরাদাতুল কুরআন]

[৩] ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালামের দোআ অনুসারে নবী-রাসূলগণের বিশেষ করে আমাদের রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দ্বিতীয় কর্তব্য হচ্ছে আল্লাহ্‌র কিতাব ও হিকমতের শিক্ষা দান। এখানে কিতাব বলে আল্লাহ্‌র কিতাব বুঝানো হয়েছে। হিকমত’ শব্দটি আরবী অভিধানে একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যথা – সত্যে উপনীত হওয়া, ন্যায় ও সুবিচার, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ইত্যাদি। ইমাম রাগেব বলেন, এ শব্দটি আল্লাহ্‌র জন্য ব্যবহৃত হলে এর অর্থ হয় সকল বস্তুর পূর্ণজ্ঞান ও সুদৃঢ় উদ্ভাবন। অন্যের জন্য ব্যবহৃত হলে এর অর্থ হয়, বিদ্যমান বস্তুসমূহের বিশুদ্ধ জ্ঞান, সৎকর্ম, ন্যায়, সুবিচার, সত্য কথা ইত্যাদি। এখন লক্ষ্য করা দরকার যে, আয়াতে হিকমতের অর্থ কি? মূলত: এখানে হিকমত শব্দের অর্থ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ। ইবনে কাসীর ও ইবনে জরীর রাহিমাহুল্লাহ কাতাদাহ থেকে এ ব্যাখ্যাই উদ্ধৃত করেছেন। হিকমত অর্থ কেউ কুরআনের তাফসীর, কেউ দ্বীনের গভীর জ্ঞান, কেউ শরীআতের বিধি-বিধানের জ্ঞান, কেউ এমন বিধিবিধানের জ্ঞান অর্জন বলেছেন, যা শুধু রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বর্ণনা থেকেই জানা যায়। নিঃসন্দেহে এসব উক্তির সারমর্ম হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু '‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ।

[৪] ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালামের দোআ অনুসারে নবী-রাসূলগণ বিশেষ করে আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তৃতীয় কর্তব্য হচ্ছে পরিশুদ্ধি ও পবিত্রকরণ। আয়াতে উল্লেখিত (يُزَكِّيْهِمْ) শব্দটি (زكاة) শব্দ থেকে উদ্ভুত। এর অর্থ পবিত্রতা। বাহ্যিক ও আত্মিক সকল প্রকার পবিত্রতার অর্থেই এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। বাহ্যিক না-পাকী সম্পর্কে সাধারণ মুসলিমরাও ওয়াকিফহাল। আত্মিক না-পাকী হচ্ছে কুফর, শির্ক, আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্যের উপর ভরসা করা, অহংকার, হিংসা, শক্রতা, দুনিয়াপ্রীতি ইত্যাদি। কুরআন ও সুন্নাহতে এসব বিষয়ের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। এ আয়াত থেকে আরও স্পষ্ট হয়ে গেল যে, হেদায়াত ও সংশোধনের ধারা দুটি, আল্লাহ্‌র রাসূল ও আল্লাহ্‌র গ্রন্থ। এ দুটি ব্যতীত কারও হেদায়াত লাভ হতে পারে না।
এ আয়াতসমূহে ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম অনেকগুলো দোআ করেছিলেন।

(১) “আপনার নির্দেশে আমি এই জনমানবহীন প্রান্তরে নিজ পরিবার-পরিজনকে রেখে যাচ্ছি। আপনি একে একটি শান্তিপূর্ণ শহর বানিয়ে দিন-যাতে এখানে বসবাস করা আতংকজনক না হয় এবং জীবনধারণের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র সহজলভ্য হয়”। আল্লাহ্ তা'আলা কবুল করেছেন এবং সে ঊষর মরু প্রান্তর মক্কা নগরীতে পরিণত হয়েছে। (২) ”হে রব! শহরটিকে শান্তির ভূমি করে দিন”। অর্থাৎ হত্যা, লুন্ঠন, কাফেরদের অধিকার স্থাপন, বিপদাপদ থেকে সুরক্ষিত ও নিরাপদ রাখুন। ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম-এর এই দো'আও কবুল হয়েছে। মক্কা মুকাররামা শুধু একটি জনবহুল নগরীই নয়, সারা বিশ্বের প্রত্যাবর্তনস্থলও বটে। বিশ্বের চারদিক থেকে মুসলিমগণ এ নগরীতে পৌছাকে সর্ববৃহৎ সৌভাগ্য মনে করে। নিরাপদ ও সুরক্ষিতও এতটুকু হয়েছে যে, আজ পর্যন্ত কোন শক্রজাতি অথবা শক্রসম্রাট এর উপর অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। আল্লাহ্‌ তা'আলা হারাম শরীফের চতুঃসীমানায় জীব-জন্তুকেও নিরাপত্তা দান করেছেন। এই এলাকায় শিকার করা জায়েয নয়। (৩) ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম-এর তৃতীয় দোআ এই যে, এ শহরের অধিবাসীদের উপজীবিকা হিসেবে যেন ফল-মূল দান করা হয়। মক্কামুকাররমা ও পাশ্ববতী ভূমি কোনরূপ বাগ-বাগিচার উপযোগী ছিল না। দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছিল না পানির নাম -নিশানা। কিন্তু আল্লাহ্‌ তা'আলা ইবরাহীমের দোআ কবুল করেন। মক্কার কাছেই তায়েফে যাবতীয় ফলমূল প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হয় যা মক্কার বাজারেই বেচা-কেনা হয়। এখনো সারা বিশ্ব থেকে ফলমূল মক্কায় নিয়ে আসা হয়। (৪) ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম এর চতুর্থ দোআ হচ্ছে, “হে আমাদের রব! আমাদের উভয়কে আপনার একান্ত অনুগত করুন এবং আমাদের বংশধর হতে আপনার এক অনুগত জাতি উত্থিত করুন। আমাদেরকে ‘ইবাদাতের নিয়ম-পদ্ধতি দেখিয়ে দিন এবং আমাদের প্রতি ক্ষমাশীল হোন। আপনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু”। এ দোআটিও ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম-এর আল্লাহ্‌ সম্পর্কে জ্ঞান ও আল্লাহ্‌ ভীতিরই ফল, আনুগত্যের অদ্বিতীয় কীর্তি স্থাপন করার পরও তিনি এরূপ দোআ করেন যে, আমাদের উভয়কে আপনার আজ্ঞাবহ করুন। কারণ, আল্লাহ্‌ সম্পর্কিত জ্ঞান যার যত বৃদ্ধি পেতে থাকে সে তত বেশী অনুভব করতে থাকে যে, যথার্থ আনুগত্য তার দ্বারা সম্ভব হচ্ছে না। এ দোআতে স্বীয় সন্তান-সন্ততিকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এতে বুঝা যায় যে, যিনি আল্লাহ্‌র পথে নিজের সন্তান-সন্ততিকে বিসর্জন দিতেও এতটুকু কুণ্ঠিত নন, তিনিও সন্তানদের প্রতি কতটুকু আন্তরিকতা ও ভালবাসা রাখেন। আল্লাহ্‌র প্রিয় বান্দারা শারিরিকের চাইতে আত্মিক ও জাগতিকের চাইতে পরলৌকিক আরামের জন্য চিন্তা করেন বেশী। এ কারণেই ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম দোআ করলেন - “আমার সন্তানদের মধ্য থেকে একটি দলকে পূর্ণ আনুগত্যশীল কর"। (৫) ইবরাহীম '‘আলাইহিস সালাম ভবিষ্যত বংশধরদের দুনিয়া ও আখেরাতের সার্বিক মংগলের জন্য আল্লাহ্‌র কাছে দোআ করেছেন যে, আমার বংশধরের মধ্যে একজন নবী প্রেরণ করুন - যিনি আপনার আয়াতসমূহ তাদের তিলাওয়াত করে শোনাবেন, কুরআন ও সুন্নাহ শিক্ষা দেবেন এবং বাহ্যিক ও আত্মিক অপবিত্রতা থেকে তাদের পবিত্র করবেন। দো'আয় নিজের বংশধরের মধ্য থেকেই নবী হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এর কারণ প্রথমতঃ এই যে, এটা তার সন্তানদের জন্য গৌরব-এর বিষয়। দ্বিতীয়তঃ এতে তাদের কল্যাণও নিহিত রয়েছে। কারণ স্বগোত্র থেকে নবী হলে তার চাল-চলন ও অভ্যাস-আচরণ সম্পর্কে তারা উত্তমরূপে অবগত থাকবে। ধোঁকাবাজি ও প্রবঞ্চনার সম্ভাবনা থাকবে না।

: ২৩৮
حَافِظُوا عَلَى الصَّلَوَاتِ وَالصَّلَاةِ الْوُسْطَىٰ وَقُومُوا لِلَّهِ قَانِتِينَ

তোমরা সালাতের প্রতি যত্নবান হবে [১], বিশেষত মধ্যবর্তী সালাতের [২] এবং আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্যে তোমরা দাঁড়াবে বিনীতভাবে;

ফুটনোট

[১] সামাজিক ও তামাদুনিক বিষয় বর্ণনা করার পর সালাতের তাকীদ দিয়ে আল্লাহ্‌ এ ভাষণটির সমাপ্তি টানছেন। কারণ, সালাত এমন একটি জিনিস যা মানুষের মধ্যে আল্লাহ্‌র ভয়, সততা, সৎকর্মশীলতা ও পবিত্রতার আবেগ এবং আল্লাহ্‌র বিধানের আনুগত্যের ভাবধারা সৃষ্টি করে আর এ সঙ্গে তাকে ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখে। মানুষের মধ্যে এ বস্তুগুলো না থাকলে সে কখনো আল্লাহ্‌র বিধানের আনুগত্য করার ক্ষেত্রে অবিচল নিষ্ঠার পরিচয় দিতে পারত না।

[২] কতিপয় হাদীসের প্রমাণ অনুসারে অধিকাংশ আলেমের মতে মধ্যবর্তী সালাতের অর্থ হচ্ছে আসরের সালাত। কেননা, এর একদিকে দিনের দু'টি সালাত – ফজর ও যোহর এবং অপরদিকে রাতের দুটি সালাত - মাগরিব ও এশা রয়েছে। এ সালাতের জন্য তাকীদ এ জন্য দেয়া হয়েছে যে, অনেক লোকেরই এ সময় কাজকর্মের ব্যস্ততা থাকে। আসরের সালাতের গুরুত্ব বর্ণনায় আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘যার আসরের সালাত ছুটে গেল তার যেন পরিবার-পরিজন এবং ধন-সম্পদ সবই ধ্বংস হয়ে গেল’। [বুখারীঃ ৫৫২] আর হাদীসে 'কানেতীন’ বা ‘বিনীতভাবে’ বাক্যটির ব্যাখ্যা করা হয়েছে নীরবতার সাথে। [বুখারীঃ ১২০০]

: ২৩৯
فَإِنْ خِفْتُمْ فَرِجَالًا أَوْ رُكْبَانًا ۖ فَإِذَا أَمِنْتُمْ فَاذْكُرُوا اللَّهَ كَمَا عَلَّمَكُمْ مَا لَمْ تَكُونُوا تَعْلَمُونَ

অতঃপর তোমরা যদি বিপদাশংকা কর, তবে পথচারি অথবা আরোহী অবস্থায় সালাত আদায় করবে [১]। অতঃপর তোমরা যখন নিরাপদ বোধ কর তখন আল্লাহ্‌কে স্মরণ করবে, জেভাবে তিনি তমাদের শিক্ষা দিয়েছেন, যা তোমরা জানতে না।

ফুটনোট

[১] সালেহ বিন খাওয়াত ঐ ব্যক্তি থেকে বর্ণনা করেন যিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে ‘যাতুর রিকা’র যুদ্ধে সালাতুল খাওফ বা ভীতির সালাতে অংশ গ্রহণ করেছিলেন তার থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেনঃ (সাহাবাগণের) একদল সালাত আদায়ের জন্য তাঁর (রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর) সাথে কাতারবন্দী হয়ে দাঁড়ালেন এবং আরেক দল শক্রর মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকলেন। তিনি (রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রথমোক্ত দলের সাথে এক রাকাআত সালাত আদায় করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। মোক্তাদীগণ একা একা দ্বিতীয় রাকাআত পড়ে ফিরে গেলেন এবং শক্রর মুখোমুখী হয়ে দাঁড়ালেন। এবার অপর দলটি এসে দাঁড়ালে তিনি (রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদেরকে সাথে নিয়ে অবশিষ্ট (এক) রাকাআত আদায় করে বসে থাকলেন। (দ্বিতীয় দলের) মুক্তাদীগণ নিজে নিজে দ্বিতীয় রাকাআত শেষ করে বসলে তিনি তাদেরকে সংগে নিয়ে সালাম ফিরালেন। [বুখারীঃ ৪১২৯]

: ২৮৫
آمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مِنْ رَبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ ۚ كُلٌّ آمَنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْ رُسُلِهِ ۚ وَقَالُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا ۖ غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ

রাসূল তার প্রভুর পক্ষ থেকে যা তার কাছে নাযিল করা হয়েছে তার উপর ঈমান এনেছেন এবং মুমিনগণও। প্রত্যেকেই ঈমান এনেছে আল্লাহ্‌র উপর, তাঁর ফেরেশতাগণ, তাঁর কিতাবসমূহ এবং তাঁর রাসূলগণের উপর। আমরা তাঁর রাসূলগণের কারও মধ্যে তারতম্য করি না। আর তারা বলেঃ আমরা শুনেছি ও মেনে নিয়েছি। হে আমাদের রব! আপনার ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং আপনার দিকেই প্রত্তাবর্তনস্থল।
ফুটনোট

: ২৮৬
لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا ۚ لَهَا مَا كَسَبَتْ وَعَلَيْهَا مَا اكْتَسَبَتْ ۗ رَبَّنَا لَا تُؤَاخِذْنَا إِنْ نَسِينَا أَوْ أَخْطَأْنَا ۚ رَبَّنَا وَلَا تَحْمِلْ عَلَيْنَا إِصْرًا كَمَا حَمَلْتَهُ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِنَا ۚ رَبَّنَا وَلَا تُحَمِّلْنَا مَا لَا طَاقَةَ لَنَا بِهِ ۖ وَاعْفُ عَنَّا وَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا ۚ أَنْتَ مَوْلَانَا فَانْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ

আল্লাহ্‌ কারও উপর এমন কোন দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না যা তার সাধ্যাতীত [১]। সে ভাল যা উপার্জন করে তার প্রতিফল তারই, আর মন্দ যা কামাই করে তার প্রতিফল তার উপরই বর্তায়। ‘হে আমাদের রব! যদি আমরা বিস্মৃত হই অথবা ভুল করি তবে আপনি আমাদেরকে পাকড়াও করবেন না। হে আমাদের রব! আমাদের পূর্ববর্তীগণের উপর যেমন বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের উপর তেমন বোঝা চাপিয়ে দিবেন না। হে আমাদের রব! আপনি আমাদেরকে এমন কিছু বহন করাবেন না যার সামর্থ আমাদের নেই। আর আপনি আমাদের পাপ মোচন করুন, আমাদেরকে ক্ষমা করুন, আমাদের প্রতি দয়া করুন, আপনি আমাদের অভিভাবক। অতএব কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য করুন [২]। ’

ফুটনোট

[১] পূর্ববর্তী আয়াতে বলা হয়েছিল যে, তোমাদের অন্তরে যা আছে, প্রকাশ কর কিংবা গোপন রাখ সর্বাবস্থায় আল্লাহ্‌ তা'আলা তোমাদের কাছ থেকে তার হিসাব নেবেন। আয়াতের আসল উদ্দেশ্য ছিল এই যে, তোমরা স্বেচ্ছায় যেসব কাজ করবে, আল্লাহ্‌ তা'আলা তার হিসাব নেবেন। অনিচ্ছাকৃত কু-চিন্তা ও ক্রটি-বিচূতি এর অন্তর্ভুক্তই ছিল না। কিন্তু আয়াতের ভাষা বাহ্যতঃ ব্যাপক ছিল। এতে বোঝা যেত যে, অনিচ্ছকৃত ধারণারও হিসাব নেয়া হবে। এ আয়াত শুনে সাহাবায়ে কেরাম অস্থির হয়ে গেলেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে আরয করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! এতদিন আমরা মনে করতাম যে, আমাদের ইচ্ছাকৃত কাজেরই হিসাব হবে। মনে যেসব অনিচ্ছাকৃত কল্পনা আসে, সেগুলোর হিসাব হবে না। কিন্তু এ আয়াত দ্বারা জানা গেল যে, প্রতিটি কল্পনারও হিসাব হবে। এতে তো শাস্তির কবল থেকে মুক্তি পাওয়া সাংঘাতিক কঠিন মনে হয়। মহানবী রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়াতের সঠিক উদ্দেশ্য জানতেন, কিন্তু উক্ত আয়াতে ব্যবহৃত শব্দের ব্যাপকতার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি নিজের পক্ষ থেকে কিছু বলা সমীচীন মনে করলেন না, বরং ওহীর অপেক্ষায় রইলেন। তিনি সাহাবায়ে কেরামকে আপাততঃ আদেশ দিলেন যে, আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে যে নির্দেশ আসে, তা সহজ হোক কিংবা কঠিন - মুমিনের কাজ হলো তা মেনে নেয়া। সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সাল্লাল্লাহু '‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশমত কাজ করলেন; যদিও তাদের মনে এ সংশয় ছিল যে, অনিচ্ছাকৃত কল্পনা ও কু-চিন্তা থেকে বেঁচে থাকা খুবই কঠিন। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ্ তা'আলা প্রথমে মুসলিমদের আনুগত্যের প্রশংসা করেন এবং বিশেষ ভঙ্গিতে ঐ সন্দেহের নিরসন করে বলেন, আল্লাহ্ তা'আলা কাউকে তার সাধ্যের বহির্ভূত কোন কাজের নির্দেশ দেন না। কাজেই অনিচ্ছাকৃতভাবে যেসব কল্পনা ও কু-চিন্তা অন্তরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে, এরপর সেগুলো কার্যে পরিণত করা না হয়, সেসব আল্লাহ্‌ তা'আলার কাছে মাফযোগ্য। যেসব কাজ ইচ্ছে করে করা হয়, শুধু সেগুলোরই হিসাব হবে। কুরআনে বর্ণিত এ ব্যাখ্যার ফলে সাহাবায়ে কেরামের মানসিক উদ্বেগ দূর হয়ে যায়। [মুসনাদে আহমাদ: ২/৪১২, ১/৩৩২: মুসলিম: ১২৫]

তারপর আল্লাহ্‌ তা'আলা মুসলিমদেরকে একটি বিশেষ দো'আ শিক্ষা দিয়েছেন। যাতে ভুল-ভ্রান্তিবশতঃ কোন কাজ হয়ে যাওয়ার পর ক্ষমা প্রার্থনার পদ্ধতি শিখিয়ে দেয়া হয়েছে এবং পূর্ববর্তী উম্মতদের মত শাস্তিও যেন এ উম্মতের উপর না আসে, তার জন্য বিশেষভাবে দোআ করতে বলা হয়েছে।

[২] আলোচ্য আয়াত দু'টি সূরা বাকারার শেষ আয়াত। সহীহ হাদীসসমূহে এ আয়াত দুটির বিশেষ ফযীলতের কথা বর্ণিত আছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ কেউ রাতের বেলায় এ আয়াত দু’টি পাঠ করলে তা তার জন্য যথেষ্ট। [বুখারীঃ ৪০০৮, ৫০০৮, মুসলিমঃ ৮০৮] অর্থাৎ বিপদাপদ ও বিভিন্ন প্রকার অনিষ্ট থেকে মুক্ত থাকার জন্য যথেষ্ট।

:
رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً ۚ إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ

‘হে আমাদের রব! সরল পথ দেয়ার পর আপনি আমাদের অন্তরসমূহকে সত্য লঙ্ঘনপ্রবণ করবেন না। আর আপনার কাছ থেকে আমাদেরকে করুণা দান করুন, নিশ্চয়ই আপনি মহাদাতা। ’
ফুটনোট

:
رَبَّنَا إِنَّكَ جَامِعُ النَّاسِ لِيَوْمٍ لَا رَيْبَ فِيهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ لَا يُخْلِفُ الْمِيعَادَ

‘হে আমাদের রব! নিশ্চয় আপনি সমস্ত মানুষকে একদিন একত্রে সমাবেত করবেন এতে কোন সন্দেহ নেই [১]; নিশ্চয় আল্লাহ্‌ ওয়াদা খেলাফ করেন না। ’

ফুটনোট

[১] শাফাআতের বিখ্যাত হাদীসে এসেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ্ তা'আলা পূর্বাপর সকল মানুষকে কিয়ামতের দিন এক মাঠে একত্রিত করবেন। অতঃপর তাদের অবস্থা এমন হবে যে, তাদের চক্ষু পরস্পরকে বেষ্টন করবে এবং তারা যে কোন আহবানকারীর আহবান শুনতে পাবে। আর সূর্য তাদের নিকটবর্তী করা হবে। " [বুখারী ৩৩৬১]

: ১৬
الَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا إِنَّنَا آمَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ

যারা বলে, হে আমাদের রব! নিশ্চয় আমরা ঈমান এনেছি; কাজেই আপনি আমাদের গোনাহ্‌সমূহ ক্ষমা করুন এবং আমাদেরকে আগুনের আযাব থেকে রক্ষা করুন। ’
ফুটনোট

: ২৬
قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَنْ تَشَاءُ وَتَنْزِعُ الْمُلْكَ مِمَّنْ تَشَاءُ وَتُعِزُّ مَنْ تَشَاءُ وَتُذِلُّ مَنْ تَشَاءُ ۖ بِيَدِكَ الْخَيْرُ ۖ إِنَّكَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

বলুন, ‘হে সার্বভৌম শক্তির মালিক আল্লাহ্‌! আপনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা প্রদান করেন এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা কেড়ে নেন; যাকে ইচ্ছা আপনি সম্মানিত করেন আর যাকে ইচ্ছা আপনি হীন করেন। কল্যান আপনারই হাতে [১]। নিশ্চয়ই আপনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।

ফুটনোট

[১] আয়াতে আল্লাহ্‌কে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছেঃ “আপনার হাতেই রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ”। আয়াতের প্রথমাংশে রাজত্ব দান করা ও ছিনিয়ে নেয়া এবং সম্মান ও অপমান উভয়দিক উল্লেখ করা হয়েছিল। এতে রয়েছে কল্যাণ ও অকল্যাণ। কিন্তু আয়াতে শুধু আল্লাহ্‌র হাতেই রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ একথা বলা হয়েছে। অকল্যাণ আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে হয় এধরণের শব্দ ব্যবহার করা হয়নি। তার কারণ হল, সহীহ আকীদা অনুসারে আল্লাহ্‌র প্রতি অকল্যাণের সম্পর্ক দেখানো জায়েয নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীসে বলেছেনঃ “অকল্যাণ আপনার পক্ষ থেকে নয়। ’ [মুসলিমঃ ৭৭১] কেননা, আল্লাহ্‌ তা'আলা বান্দার জন্য অকল্যাণ চান না। মানুষের যাবতীয় অকল্যাণ মানুষের হাতের কামাই করা।

: ২৭
تُولِجُ اللَّيْلَ فِي النَّهَارِ وَتُولِجُ النَّهَارَ فِي اللَّيْلِ ۖ وَتُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَتُخْرِجُ الْمَيِّتَ مِنَ الْحَيِّ ۖ وَتَرْزُقُ مَنْ تَشَاءُ بِغَيْرِ حِسَابٍ

‘আপনি রাতকে দিনে এবং দিনকে রাতে প্রবিষ্ট করান; আপনি মৃত থেকে জীবন্তের আবির্ভাব ঘটান, আবার জীবন্ত থেকে মৃতের আবির্ভাব ঘটান। আর আপনি যাকে ইচ্ছা অপরিমিত রিয্‌ক দান করেন। ’
ফুটনোট

: ১১৩
لَيْسُوا سَوَاءً ۗ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ أُمَّةٌ قَائِمَةٌ يَتْلُونَ آيَاتِ اللَّهِ آنَاءَ اللَّيْلِ وَهُمْ يَسْجُدُونَ

তারা সবাই একরকম নয়। কিতাবীদের মধ্যে অবিচলিত এক দল আছে; তারা রাতে আল্লাহ্‌র আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করে এবং তারা সিজ্‌দা করে [১]।

ফুটনোট

[১] আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ এক রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এশার সালাত অনেক দেরী করে আদায় করলেন, তারপর মসজিদের দিকে বের হয়ে দেখতে পেলেন যে, লোকেরা সালাতের অপেক্ষা করছে। তখন তিনি বললেনঃ কোন দ্বীনের কেউই তোমাদের মত এ সময়ে সালাত আদায় করে না। ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তখন এ আয়াত নাযিল হল। [মুসনাদে আহমাদঃ ১/৩৯৬]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, যখন আবদুল্লাহ ইবন সালাম, সা’লাবাহ ইবন সাইয়াহ, উসাইদ ইবন সাইয়াহ ও আসাদ ইবন উবাইদ সহ একদল ইয়াহুদী সম্প্রদায়ের লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর ঈমান আনল, তখন ইয়াহুদী নেতারা বলতে লাগল, মুহাম্মাদের উপর যারা ঈমান এনেছে তারা হচ্ছে আমাদের মধ্যে নিকৃষ্ট লোক। তখন আল্লাহ্ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করেন। [তাবারী; আত-তাফসীরুস সহীহ] অর্থাৎ ইয়াহুদী-নাসারা সবাই যে ক্ষতিগ্রস্ত তা কিন্তু নয়। তাদের মধ্যে যারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর ঈমান এনেছে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে মুক্তি পাবে।

: ১৪৭
وَمَا كَانَ قَوْلَهُمْ إِلَّا أَنْ قَالُوا رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَإِسْرَافَنَا فِي أَمْرِنَا وَثَبِّتْ أَقْدَامَنَا وَانْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ

এ কথা ছাড়া তাদের আর কোন কথা ছিল না, ‘হে আমাদের রব! আমাদের পাপ এবং আমাদের কাজের সীমালংঘন আপনি ক্ষমা করুন, আমাদের পা সুদৃঢ় রাখুন এবং কাফের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য করুন।’
ফুটনোট

: ১৯১
الَّذِينَ يَذْكُرُونَ اللَّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَىٰ جُنُوبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُونَ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَٰذَا بَاطِلًا سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ

যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে আল্লাহ্‌র স্মরণ করে এবং আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা করে, আর বলে, ‘হে আমাদের রব! আপনি এগুলো অনর্থক সৃষ্টি করেননি [১], আপনি অত্যন্ত পবিত্র, অতএব আপনি আমাদেরকে আগুনের শাস্তি হতে রক্ষা করুন।’

ফুটনোট

[১] সারকথা, আল্লাহ্ তা’আলার সৃষ্টি ও সৃষ্টজগতের উপর চিন্তা-গবেষণা করে তাঁর মাহাত্ম্য ও কুদরাত সম্পর্কে অবগত হওয়া একটি মহৎ ও উচ্চ পর্যায়ের ইবাদাত। সেগুলোর মধ্যে গভীর মনোনিবেশ করে তা থেকে কোন শিক্ষা গ্রহণ না করা একান্তই নির্বুদ্ধিতা। উল্লেখিত আয়াতের শেষ বাক্যে আল্লাহ্‌র নিদর্শনসমূহে চিন্তা গবেষণা করার ফলাফল বাতলে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে

(رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هٰذَا بَاطِلاً)

অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলার সীমাহীন সৃষ্টির উপর যে লোক চিন্তা-ভাবনা করে সে লোক সহজেই বুঝে যে, এসব বস্তু-সামগ্রীকে আল্লাহ নিরর্থক সৃষ্টি করেননি; বরং এসবের সৃষ্টির পেছনে হাজারো তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। সে সমস্তকে মানুষের সেবায় নিয়োজিত করে দিয়ে মানুষকে এ চিন্তা-ভাবনা করার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে যে, সমগ্র পৃথিবী তাদের কল্যাণের জন্য তৈরী করা হয়েছে এবং তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদাতের উদ্দেশ্যে। এটাই হল তাদের জীবনের লক্ষ্য। সুতরাং গোটা বিশ্ব-সৃষ্টি নিরর্থক নয় বরং এগুলো সবই বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহ রাববুল আলামীনের অসীম কুদরাত ও হেকমতেরই প্রকৃষ্ট প্রমাণ। উবাইদ ইবনে উমাইর বলেনঃ আমি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বললাম, রাসূলের সবচেয়ে আশ্চর্য কি কাজ আপনি দেখেছেন, তা আমাদেরকে জানান। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, এক রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, ‘হে আয়েশা, আমাকে আমার রবের ইবাদাত করতে দাও’। আমি বললাম, হে রাসূল, আমি আপনার পাশে থাকতে ভালবাসি এবং যা আপনাকে খুশি করে তা করতে ভালবাসি। তারপর আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওযু করলেন এবং সালাত আদায়ে নিবিষ্ট হলেন ও কাঁদতে থাকলেন। আমি বললাম, হে আল্লাহ্‌র রাসূল, আপনি কাঁদছেন অথচ আল্লাহ আপনার পূর্বাপর সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন? উত্তরে তিনি বললেনঃ আমি কি কৃতজ্ঞ বান্দা হব না? এ রাতে আমার উপর একটি আয়াত নাযিল হয়েছে, যে ব্যক্তি তা তেলাওয়াত করল এবং চিন্তা-গবেষণা করল না, তার ধ্বংস অনিবার্য। তারপর তিনি এ আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন। [সহীহ ইবনে হিব্বানঃ ৬২০]

: ১৯২
رَبَّنَا إِنَّكَ مَنْ تُدْخِلِ النَّارَ فَقَدْ أَخْزَيْتَهُ ۖ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنْصَارٍ

‘হে আমাদের রব! আপনি কাউকেও আগুনে নিক্ষেপ করলে তাকে তো আপনি নিশ্চয়ই হেয় করলেন এবং যালেমদের কোন সাহায্যকারী নেই।’
ফুটনোট

: ১৯৩
رَبَّنَا إِنَّنَا سَمِعْنَا مُنَادِيًا يُنَادِي لِلْإِيمَانِ أَنْ آمِنُوا بِرَبِّكُمْ فَآمَنَّا ۚ رَبَّنَا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَكَفِّرْ عَنَّا سَيِّئَاتِنَا وَتَوَفَّنَا مَعَ الْأَبْرَارِ

‘হে আমাদের রব, আমরা এক আহ্‌বায়ককে ঈমানের দিকে আহ্‌বান করতে শুনেছি, ‘তোমরা তোমাদের রবের উপর ঈমান আন।’ কাজেই আমরা ঈমান এনেছি। হে আমাদের রব! আপনি আমাদের পাপরাশি ক্ষমা করুন, আমাদের মন্দ কাজগুলো দূরীভূত করুন এবং আমাদেরকে সৎকর্মপরায়ণদের সহগামী করে মৃত্যু দিন [১]।

ফুটনোট

[১] কাতাদা বলেন, তারা আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে যে আহবান শুনতে পেয়েছে তাতে তারা সুন্দরভাবে সাড়া দিয়েছে এবং এর উপর ধৈর্য ধারণ করেছে। আল্লাহ্ তা’আলা এখানে ঈমানদার মানুষরা যখন আল্লাহ্‌র আহবান শুনে তাতে সাড়া দিয়েছে তখন তাদের কথা কি ছিল তা বর্ণনা করেছেন। পক্ষান্তরে ঈমানদার জিনরা আল্লাহ্‌র আহবান শুনে সে আহবানে যে কথা দিয়ে সাড়া দিয়েছে তা সূরা আল-জিন এ বর্ণনা করেছেন। সেখানে এসেছে, “আমরা এক আশ্চর্যজনক কুরআন শুনেছি যে সঠিক পথের দিশা দেয়, ফলে আমরা তাতে ঈমান এনেছি। আর আমরা আমাদের রবের সাথে কাউকে শরীক করব না”। [সূরা জিন ১-২] সাড়ার ব্যাপারে তাদের কোন পার্থক্য না থাকলেও কথার মধ্যে পার্থক্য ছিল। [তাবারী]

: ১৯৪
رَبَّنَا وَآتِنَا مَا وَعَدْتَنَا عَلَىٰ رُسُلِكَ وَلَا تُخْزِنَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ ۗ إِنَّكَ لَا تُخْلِفُ الْمِيعَادَ

‘হে আমাদের রব! আপনার রাসূলগণের মাধ্যমে আমাদেরকে যা দিতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা আমাদেরকে দান করুন এবং কেয়ামতের দিন আমাদেরকে হেয় করবেন না। নিশ্চয় আপনি প্রতিশ্রুতির ব্যতিক্রম করেন না।’
ফুটনোট

: ৪৩
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَقْرَبُوا الصَّلَاةَ وَأَنْتُمْ سُكَارَىٰ حَتَّىٰ تَعْلَمُوا مَا تَقُولُونَ وَلَا جُنُبًا إِلَّا عَابِرِي سَبِيلٍ حَتَّىٰ تَغْتَسِلُوا ۚ وَإِنْ كُنْتُمْ مَرْضَىٰ أَوْ عَلَىٰ سَفَرٍ أَوْ جَاءَ أَحَدٌ مِنْكُمْ مِنَ الْغَائِطِ أَوْ لَامَسْتُمُ النِّسَاءَ فَلَمْ تَجِدُوا مَاءً فَتَيَمَّمُوا صَعِيدًا طَيِّبًا فَامْسَحُوا بِوُجُوهِكُمْ وَأَيْدِيكُمْ ۗ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَفُوًّا غَفُورًا

হে মুমিনগণ! নেশাগ্রস্ত অবস্থায় [১] তোমরা সালাতের নিকটবর্তী হয়ো না, যতক্ষণ না তোমরা যা বল তা বুঝতে পার [২] এবং যদি তোমরা মুসাফির না হও তবে অপবিত্র অবস্থাতেও নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমরা গোসল কর [৩]। আর যদি তোমরা পীড়িত হও অথবা সফরে থাক বা তোমাদের কেউ শৌচস্থান থেকে আসে অতবা তোমরা নারী সম্ভোগ কর এবং পানি না পাও তবে পবিত্র মাটির দ্বারা তায়াম্মুম কর [৪] সুতরাং মাসেহ কর তোমরা তোমাদের চেহারা ও হাত, নিশ্চয় আল্লাহ পাপ মোচনকারী, ক্ষমাশীল।

ফুটনোট

[১] আল্লাহ রাববুল আলামীন ইসলামী শরীআতকে একটি বৈশিষ্ট্য এই দান করেছেন যে, এর প্রতিটি বিধি-বিধানকে তিনি সরল ও সহজ করেছেন। তারই এক বিশেষ দিক হচ্ছে এই যে, আল্লাহ রাববুল আলামীন যাদের মন-মানসকে একান্ত নিষ্পাপ করে তৈরী করেছিলেন এমন বিশেষ বিশেষ কিছু লোক ছাড়া মদ্যপান ছিল সমগ্র আরববাসীর পুরাতন অভ্যাস। কিন্তু বিশেষ বিশেষ লোকেরা কখনো এই দুষ্ট বস্তুর ধারে কাছেও যেতেন না। যেমন, মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বেও কখনো মদ স্পর্শ করেননি। এছাড়া বলতে গেলে সমগ্র জাতিই ছিল এ বদ অভ্যাসে লিপ্ত। আর এ কথা সর্বজনবিদিত যে, কোন বস্তু একবার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেলে মানুষের পক্ষে তা পরিহার করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে মদ্যপান কিংবা অন্যান্য নেশাজনিত অভ্যাস মানুষকে এমনভাবে কাবু করে বসে যে, তা থেকে বেরিয়ে আসাকে সে মৃত্যুর শামিল মনে করতে থাকে। আল্লাহ তা’আলার নিকট মদ্যপান ও নেশা করা ছিল হারাম। বিশেষতঃ ইসলাম গ্রহণ করার পর মুসলিমদেরকে এর অভিশাপ থেকে রক্ষা করা ছিল আল্লাহ তা’আলার অভিপ্রায়। কিন্তু সহসা একে হারাম করে দেয়া হলে, মানুষের পক্ষে এ নির্দেশ পালন করা একান্তই কঠিন হত। কাজেই প্রথমে এর উপর আংশিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হল এবং এর অশুভ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সতর্কীকরণের মাধ্যমে মানুষের মন-মস্তিস্ককে একে পরিহার করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হল। সুতরাং আলোচ্য আয়াতে শুধুমাত্র এ হুকুমই দেয়া হয়েছে যে, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় সালাতের ধারে কাছেও যেও না। যার মর্ম ছিল এই যে, সালাতের সময় সালাতের প্রতি মনোনিবেশ করা ফরয। এ সময় মদ্যপান করা যাবে না। এতে মুসলিমগণ উপলব্ধি করলেন যে, এটা এমন এক মন্দ বস্তু যা মানুষকে সালাতে বাধা দান করে। কাজেই দেখা গেল অনেকে এ নির্দেশ আসার সাথে সাথেই মদ্যপান পরিহার করলেন এবং অনেকে এর মন্দ দিকগুলো সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করতে আরম্ভ করলেন। শেষ পর্যন্ত সূরা আল-মায়েদার আয়াতে মদের অপবিত্রতা ও হারাম হওয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশ নাযিল হল এবং যে কোন অবস্থায় মদ্যপান সম্পূর্ণভাবে হারাম হয়ে গেল।

[২] আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ মদ হারাম হওয়ার পূর্বে আমাদেরকে এক আনসার দাওয়াত দিল। দাওয়াত শেষে আব্দুর রহমান ইবন আউফ এগিয়ে গিয়ে মাগরিবের সালাতের ইমামতি করলেন। তিনি সূরা আল-কাফেরুন তেলাওয়াত করতে গিয়ে এলোমেলো করে ফেললেন। ফলে এ আয়াত নাযিল হয় যাতে মদ খাওয়ার পর বিবেকের সুস্থতা না ফেরা পর্যন্ত সালাত আদায় করতে নিষেধ করা হয়েছে। [আল-আহাদীসুল মুখতারাহঃ ২/১৮৮ নং- ৫৬৭, অনুরূপ ২/১৮৭ নং ৫৬৬; আবু দাউদঃ ৩৬৭১; তিরমিযী: ৩০২৬]

[৩] অপবিত্র অবস্থা থেকে গোসল করার নিয়ম বর্ণনায় হাদীসে এসেছে, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন জানাবতের গোসল করতেন, তখন প্রথমে দু হাত ধুয়ে নিতেন। তারপর সালাতের অজুর মত অজু করতেন। তারপর পানিতে আঙ্গুল ঢুকিয়ে তা দিয়ে মাথার চুলের গোড়ায় পানি পৌঁছাতেন। তারপর তার মাথায় তিন ক্রোশ পানি দিতেন এবং সারা শরীরে পানি প্রবাহিত করতেন। বুখারী: ২৪৮]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম পা ধোয়া ব্যতীত সালাতের অজুর মত অজু করলেন, তার লজ্জাস্থান ধৌত করলেন, যে সমস্ত ময়লা লেগেছিল তাও ধৌত করলেন, তারপর তার নিজের শরীরে পানি প্রবাহিত করলেন। তারপর দু’ পা সরিয়ে নিয়ে ধৌত করলেন। এটাই ছিল তার অপবিত্রতা থেকে গোসল করার পদ্ধতি। [বুখারী: ২৪৯]

[৪] আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, এক সফরে তিনি তার বোন আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে একটি হার ধার করে নিয়েছিলেন। তিনি সেটা হারিয়ে ফেলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেটা খুঁজতে এক ব্যক্তিকে পাঠান এবং তিনি তা খুঁজে পান। ইত্যবসরে সালাতের ওয়াক্ত হয়ে যায়, কিন্তু তাদের নিকট পানি ছিল না। লোকেরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে অভিযোগ করল। তখন তায়াম্মুমের আয়াত নাযিল হয়। উসাইদ ইবনে হোদাইর রাদিয়াল্লাহু আনহু আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বলেন, আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান প্রদান করুন। যখনি কোন অপছন্দনীয় ব্যাপার আপনার উপর ঘটে গেছে, তখনি তা আপনার এবং উম্মতে মুসলিমার জন্য কল্যাণের কারণ হয়েছে। [বুখারীঃ ৩৩৬, মুসলিমঃ ৩৬৭] মূলতঃ তায়াম্মুমের হুকুম একটি পুরস্কার- যা এ উম্মতেরই বিশেষ বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তা’আলার কতই না অনুগ্রহ যে, তিনি অযু-গোসল প্রভৃতি পবিত্রতার নিমিত্ত এক বস্তুকে পানির স্থলাভিষিক্ত করে দিয়েছেন, যার প্রাপ্তি পানি অপেক্ষাও সহজ। বলাবাহুল্য, ভূমি ও মাটি সর্বত্রই বিদ্যমান। হাদীসে বর্ণিত আছে যে, এ সহজ ব্যবস্থাটি একমাত্র উম্মতে মুহাম্মাদীকেই দান করা হয়েছে।

: ১০১
وَإِذَا ضَرَبْتُمْ فِي الْأَرْضِ فَلَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَنْ تَقْصُرُوا مِنَ الصَّلَاةِ إِنْ خِفْتُمْ أَنْ يَفْتِنَكُمُ الَّذِينَ كَفَرُوا ۚ إِنَّ الْكَافِرِينَ كَانُوا لَكُمْ عَدُوًّا مُبِينًا

তোমরা যখন দেশ-বিদেশে সফর করবে তখন যদি তোমাদের আশংকা হয় যে, কাফেররা তোমাদের জন্য ফিত্‌না সৃষ্টি করবে, তবে সালাত ‘কসর [১]’ করলে তোমাদের কোন দোষ নেই। নিশ্চয়ই কাফেররা তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।

ফুটনোট

পনরতম রুকু‘

[১] কসর শুধু চার রাকাআতের ফরয সালাতের বেলায় হবে। মাগরিব ও ফযরের সালাতে কোন কসর নেই। পূর্ণ সালাতের স্থলে অর্ধেক সালাত আদায় করার ক্ষেত্রে কারো মনে এরূপ ধারণা আনাগোনা করে যে, বোধহয় এতে সালাত পূর্ণ হলো না, এটা ঠিক নয়। কারণ, কসরও শরীআতেরই নির্দেশ। এ নির্দেশ পালনে গোনাহ হয় না; বরং সওয়াব পাওয়া যায়। ইয়া’লা ইবন উমাইয়্যা বলেন, আমি উমর ইবনুল খাত্তাবকে এ আয়াতে বর্ণিত ‘যদি তোমাদের আশংকা হয় যে, কাফেররা তোমাদের জন্য ফিতনা সৃষ্টি করবে’ এটা উল্লেখ করে জিজ্ঞেস করলাম যে, এখন তো মানুষ নিরাপদ হয়েছে তারপরও সালাতের কসর পড়ার কারণ কি? তখন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, তুমি যেটাতে আশ্চর্য হয়েছ, আমিও সেটাতে আশ্চর্যবোধ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সেটা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, “এটা একটি সদকা যেটি আল্লাহ তোমাদের উপর সদকা করেছেন, সুতরাং তোমরা আল্লাহর সদকা গ্রহণ কর”। [মুসলিম: ৬৮৬]

: ১০২
وَإِذَا كُنْتَ فِيهِمْ فَأَقَمْتَ لَهُمُ الصَّلَاةَ فَلْتَقُمْ طَائِفَةٌ مِنْهُمْ مَعَكَ وَلْيَأْخُذُوا أَسْلِحَتَهُمْ فَإِذَا سَجَدُوا فَلْيَكُونُوا مِنْ وَرَائِكُمْ وَلْتَأْتِ طَائِفَةٌ أُخْرَىٰ لَمْ يُصَلُّوا فَلْيُصَلُّوا مَعَكَ وَلْيَأْخُذُوا حِذْرَهُمْ وَأَسْلِحَتَهُمْ ۗ وَدَّ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوْ تَغْفُلُونَ عَنْ أَسْلِحَتِكُمْ وَأَمْتِعَتِكُمْ فَيَمِيلُونَ عَلَيْكُمْ مَيْلَةً وَاحِدَةً ۚ وَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ إِنْ كَانَ بِكُمْ أَذًى مِنْ مَطَرٍ أَوْ كُنْتُمْ مَرْضَىٰ أَنْ تَضَعُوا أَسْلِحَتَكُمْ ۖ وَخُذُوا حِذْرَكُمْ ۗ إِنَّ اللَّهَ أَعَدَّ لِلْكَافِرِينَ عَذَابًا مُهِينًا

আর আপনি যখন তাদের মধ্যে অবস্থান করবেন তারপর তাদের সাথে সালাত কায়েম করবেন [১] তখন তাদের একদল আপনার সাথে যেন দাঁড়ায় এবং তারা যেন সশস্ত্র থাকে। তাদের সিজদা করা হলে তারা যেন তোমাদের পিছনে অবস্থান করে; আর অপর একদল যারা সালাতে শরীক হয়নি তারা আপনার সাথে যেন সালাতে শরীক হয় এবং তারা যেন সতর্ক ও সশস্ত্র থাকে [২]। কাফেররা কামনা করে যেন তোমরা তোমাদের অস্ত্রশস্ত্র ও আসবাবপত্র সম্বন্ধে অসতর্ক হও যাতে তারা তোমাদের উপর একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। যদি তোমরা বৃষ্টির জন্য কষ্ট পাও বা পীড়িত থাক তবে তোমরা অস্ত্র রেখে দিলে তোমাদের কোন দোষ নেই; কিন্তু তোমরা সতর্কতা অবলম্বন করবে। আল্লাহ কাফেরদের জন্য লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন।

ফুটনোট

[১] আয়াতে বর্ণিত সালাতটিকে বলা হয়, ‘সালাতুল খওফ’ বা ভয়-ভীতিকালীন নামায। এ আয়াত নাযিল হওয়ার সময় সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার ‘উসফান’ উপত্যকায় অবস্থান করছিলেন। রাসূল সাহাবাদের নিয়ে যোহরের সালাত আদায় করতে দেখে কাফেরদের কেউ কেউ বলে বসল যে, এ সময় যদি আক্রমণ করা যেতো তবে তাদেরকে জব্দ করা যেতো। তখন তাদের একজন বলল, এরপর তাদের আরেকটি সালাত রয়েছে, যা তাদের কাছে আরও প্রিয়। অর্থাৎ আসরের সালাত। তখন তাদের কেউ কেউ সে সময়ে মুসলিমদের উপর আক্রমণের ইচ্ছা পোষণ করলে, আল্লাহ্ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করে ‘সালাতুল খাওফ’ পড়ার নিয়ম-পদ্ধতি বর্ণনা করে দেন। [মুসান্নাফ ইবন আবী শাইবাহ ২/৪৬৩; মুসান্নাফ আবদির রাযযাক ২/৫০৫; মুসনাদে আহমাদ ৪/৫৯; আবুদাউদ ১২৩৬: নাসায়ী: ১৭৭; মুস্তাদরাকে হাকিম ২/৩০৮]

[২] আয়াতে বলা হয়েছেঃ আপনি যখন তাদের মধ্যে থাকেন-এতে এরূপ মনে করার অবকাশ নেই যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের তিরোধানের পর এখন ‘সালাতুল খওফ’- বা ভয়-ভীতিকালীন নামায- এর বিধান নেই। কেননা, তখনকার অবস্থা অনুযায়ী আয়াতে এ শর্ত বর্ণিত হয়েছে। নবী বিদ্যমান থাকলে ওযর ব্যতীত অন্য কেউ সালাতে ইমাম হতে পারে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর এখন যে ইমাম হবেন, তিনিই তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবেন এবং ‘সালাতুল খওফ’ পড়াবেন। সব ফেকাহবিদের মতে ‘সালাতুল খওফ’-এর বিধান এখনো অব্যাহত রয়েছে, রহিত হয়নি। মানুষের পক্ষ থেকে বিপদাশংকার কারণে ‘সালাতুল খওফ’ পড়া যেমন জায়েয, তেমনিভাবে যদি বাঘ-ভালুক কিংবা অজগর ইত্যাদির ভয় থাকে এবং সালাতের সময়ও সংকীর্ণ হয়, তাহলে তখনো সালাতুল খওফ পড়া জায়েয। আয়াতে উভয় দলের এক এক রাকা’আত পড়ার নিয়ম বর্ণিত হয়েছে। দ্বিতীয় রাকাআতের নিয়ম হাদীসে উল্লেখিত রয়েছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’ রাকা’আতের পর সালাম ফিরিয়েছেন। [বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, বুখারী: ৯৪২: মুসলিম: ৩০৫, ৩০৬; তিরমিযী: ৩০৩৫; আবু দাউদ: ১২৪২]

: ১০৩
فَإِذَا قَضَيْتُمُ الصَّلَاةَ فَاذْكُرُوا اللَّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَىٰ جُنُوبِكُمْ ۚ فَإِذَا اطْمَأْنَنْتُمْ فَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ ۚ إِنَّ الصَّلَاةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ كِتَابًا مَوْقُوتًا

অতঃপর যখন তোমরা সালাত সমাপ্ত করবে তখন দাঁড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করবে [১], অতঃপর যখন তোমরা নিরাপদ হবে তখন যথাযথ সালাত কায়েম করবে [২]; নির্ধারিত সময়ে সালাত কায়েম করা মুমিনদের জন্য অবশ্য কর্তব্য [৩]।

ফুটনোট

[১] ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, আল্লাহ্ তা’আলা যখনই কোন ফরয তার বান্দাদের উপর অবধারিত করে দিয়েছেন তখনই সেটার একটা সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তারপর যারা সেটা করতে সক্ষম হবে না তাদেরকে ভিন্ন পথ বাতলে দিয়েছেন। এর ব্যতিক্রম হচ্ছে, ‘আল্লাহর যিকর’। এই যিকর এর ব্যাপারে যতক্ষণ কেউ সুস্থ বিবেকসম্পন্ন থাকে, ততক্ষণ আল্লাহ তা’আলা কাউকে ওযর আপত্তি পেশ করার সুযোগ দেন নি । সর্বাবস্থায় তাকে যিকর করতে হবে। রাত-দিন, জল-স্থল, সফর-মুকীম, ধনী-দরিদ্র, সুস্থ-অসুস্থ, গোপন-প্রকাশ্য সর্বাবস্থায় আল্লাহর যিকর চালিয়ে যেতে হবে। এ আয়াতের এটাই ভাষ্য। [তাবারী, আত-তাফসীরুস সহীহ]

[২] মুজাহিদ বলেন, এর অর্থ যখন তোমরা নিরাপদ হবে এবং স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করবে, তখন পূর্ণরূপ সালাত আদায় করবে তাবারী অর্থাৎ কেউ যেন মনে না করে বসে যে, তাদের সালাত কমে গেছে বা কম পড়লেও চলবে।

[৩] এখানে নির্ধারিত সময় বলে, সালাতের জন্য আল্লাহ কর্তৃক প্রত্যেক সালাতের জন্য নির্ধারিত ওয়াক্তসমূহকে বোঝানো হয়েছে। এখানে সে ওয়াক্তসমূহ বলে দেয়া হয়নি। পক্ষান্তরে অন্য আয়াতে সেগুলোর বর্ণনা দেয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, “সূর্য হেলে পড়ার পর থেকে রাতের ঘন অন্ধকার পর্যন্ত সালাত কায়েম করুন এবং ফজরের সালাত। নিশ্চয়ই ফজরের সালাত উপস্থিতির সময়”। [সূরা আল-ইসরা: ৭৮]

পাশাপাশি হাদীসে সালাতের ওয়াক্তের বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘সালাতের প্রথম ও শেষ সময় রয়েছে। যোহরের সালাতের প্রথম সময় হচ্ছে যখন সূর্য হেলে যাবে। আর শেষ সময় হচ্ছে, আসরের ওয়াক্ত প্রবেশ করা পর্যন্ত। অনুরূপভাবে আসরের প্রথম ওয়াক্ত হচ্ছে, যখন এর ওয়াক্ত হবে। আর তার শেষ ওয়াক্ত হচ্ছে সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করা পর্যন্ত। তদ্রূপ মাগরিবের প্রথম সময় হচ্ছে যখন সূর্য ডুবে যায়। তার শেষ সময় হচ্ছে, যখন দিগন্ত রেখা চলে যায়। আর এশার প্রথম ওয়াক্ত হচ্ছে, যখন দিগন্ত রেখা চলে যায়। আর শেষ ওয়াক্ত হচ্ছে, মধ্য রাত পর্যন্ত। ফজরের প্রথম ওয়াক্ত হচ্ছে, যখন সুবহে সাদিক উদিত হয়। আর শেষ ওয়াক্ত হচ্ছে, যখন সূর্য উদিত হয়। [তিরমিযী: ১৫১]

: ৩১
يَا بَنِي آدَمَ خُذُوا زِينَتَكُمْ عِنْدَ كُلِّ مَسْجِدٍ وَكُلُوا وَاشْرَبُوا وَلَا تُسْرِفُوا ۚ إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ

হে বনী আদম! প্রত্যেক সালাতের সময় তোমরা সুন্দর পোষাক গ্রহণ কর [১]। আর খাও এবং পান কর কিন্তু অপচয় কর না [২] নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদেরকে পছন্দ করেন না।

ফুটনোট

[১] আয়াতে পোষাককে ‘যীনাত’ বা ‘সাজ-সজ্জা’ শব্দের মাধ্যমে এ জন্যই ব্যক্ত করা হয়েছে যে, সালাতে শধু গুপ্ত অঙ্গ আবৃত করা ছাড়াও সামথ্য অনুযায়ী সাজ-সজ্জার পোষাক পরিধান করা শ্ৰেয়। হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহু সালাতের সময় উত্তম পোষাক পরিধানে অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি বলতেনঃ ‘আল্লাহ্ তা'আলা সৌন্দর্য পছন্দ করেন, তাই আমি প্রতিপালকের সামনে সুন্দর পোষাক পরে হাজির হই।’ যে গুপ্ত-অঙ্গ সর্বাবস্থায় বিশেষতঃ সালাত ও তাওয়াফে আবৃত করা ফরয, তার সীমা কি? কুরআনুল কারম সংক্ষেপে গুপ্ত-অঙ্গ আবৃত করার নির্দেশ দিয়ে এর বিবরণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন যে, পুরুষের গুপ্তাঙ্গ নাভী থেকে হাটু পর্যন্ত এবং মহিলাদের গুপ্তাঙ্গ মুখমন্ডল, হাতের তালু এবং পদযুগল ছাড়া সমস্ত দেহ। হাদীসসমূহে এসব বিবরণ বর্ণিত রয়েছে। এ হচ্ছে গুপ্ত অঙ্গের ফরয সম্পর্কিত বিধান। এটি ছাড়া সালাতই হয় না। সালাতে শুধু গুপ্ত অঙ্গ আবৃত করাই কাম্য নয়; বরং সাজ-সজ্জার পোষাক পরিধান করতেও বলা হয়েছে। যেমন সাদা পোষাক, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের পোষাকাদির মধ্যে সাদা পোষাক পরিধান কর। কেননা, পোষাকাদির মধ্যে তাই উত্তম পোষাক। আর এতে তোমাদের মৃতদেরকে কাফনও দাও। [আবু দাউদঃ ৩৮৭৮, তিরমিয়ীঃ ৯৯৪, ইবন মাজাহঃ ১৪৭২] অনেকে সাজসজ্জার পোষাক পরাকে অহংকারী পোষাক মনে করে থাকে এটা আসলে ঠিক নয়। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যার অন্তরে অনু পরিমাণ অহংকার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এক লোক বললঃ কোন লোক পছন্দ করে তার পোষাক উত্তম হোক, তার জুতা সুন্দর হোক। রাসূল বললেনঃ “অবশ্যই আল্লাহ সুন্দর, সুন্দরকে ভালবাসেন। ”অহংকার হল, হককে না মানা, মানুষকে অবজ্ঞা করা। [ মুসলিমঃ ১৪৭] আবার অহংকার হয় এমন পোষাকও পরা যাবে না যদিও তাতে কারো কারো নিকট বাহ্যিক সুন্দর রয়েছে। যেমনঃ টাখনুর নীচে কাপড় পরা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘যে অহংকার বশে কাপড় টাখনুর নীচে ছেড়ে দিবে আল্লাহ তার দিকে তাকাবেন না।’ [বুখারীঃ ৫৭৮৩] আয়াতের শানে নুযুল হিসেবে এসেছে যে, আরবের মুশরিকরা জাহেলিয়াতে মাসজিদে হারামে কাবার তাওয়াফ করার সময় উলঙ্গ হয়ে তাওয়াফ করত। এ ব্যাপারে তাদের দর্শন ছিল, যে কাপড় পরে গুণাহ করেছি তা দিয়ে তাওয়াফ করা যাবে না। বিশেষতঃ কুরাইশরা এ বিধিবিধানের প্রবর্তন করে। তারাই শুধু তাওয়াফের জন্য কাপড় দিতে পারবে। এতে করে তারা কিছু বাড়তি সুবিধা আদায় করতে পারত। এমনকি মহিলারাও উলঙ্গ তাওয়াফ করত। শয়তান তাদেরকে এভাবে ইবাদাত করতে উদ্বুদ্ধ করত এবং এ কাজকে তাদের মনে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে দিত। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ মহিলা উলঙ্গ অবস্থায় কাবার তাওয়াফ করত আর বলত, কে আমাকে তাওয়াফের কাপড় ধার দেবে? যা তার লজ্জাস্থানে রাখবে। আরও বলতঃ আজ হয় কিছু অংশ প্রকাশ হয়ে পড়বে নয়ত পুরোটাই। আর যা আজ প্রকাশিত হবে তা আর হালাল করব না। তখন এ আয়াত নাযিল হয়- “তোমরা তোমাদের মাসজিদ তথা ইবাদাতের স্থানে সুন্দর পোষাক পরবে।” [মুসলিমঃ ৩০২৮]

[২] এ আয়াত থেকে একটি মাসআলা এরূপ বুঝা যায় যে, জগতে পানাহারের যত বস্তু রয়েছে সেগুলো সব হালাল ও বৈধ। যতক্ষণ পর্যন্ত কোন বিশেষ বস্তুর অবৈধতা ও নিষিদ্ধতা শরীআতের কোন দলীল দ্বারা প্রমাণিত না হয়, ততক্ষণ প্রত্যেক বস্তুকে হালাল ও বৈধ মনে করা হবে। আয়াতে (وَلَاتُسْرِفُوْا) বলে পানাহারের অনুমতি বরং নির্দেশ থাকার সাথে সাথে অপব্যয় করার নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। আয়াতে ব্যবহৃত (اسراف) শব্দের অর্থ সীমালংঘন করা। সীমালংঘন কয়েক প্রকারের হতে পারে। (এক) হালালকে অতিক্রম করে হারাম পর্যন্ত পৌঁছা এবং হারাম বস্তু পানাহার করতে থাকা। এ সীমালংঘন যে হারাম তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। (দুই) আল্লাহর হালালকৃত বস্তুসমূহকে শরীআত সম্মত কারণ ছাড়াই হারাম মনে করে বর্জন করা। হারাম বস্তু ব্যবহার করা যেমন অপরাধ ও গোনাহ, তেমনি হালালকে হারাম মনে করাও আল্লাহর আইনের বিরোধিতা ও কঠোর গোনাহ। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কম খেয়ে দুর্বল হয়ে পড়া, ফলে ফরয কর্ম সম্পাদনের শক্তি না থাকা- এটাও সীমালংঘনের মধ্যে গণ্য। উল্লেখিত উভয় প্রকার অপব্যয় নিষিদ্ধ করার জন্য কুরআনুল কারমের এক জায়গায় বলা হয়েছেঃ “অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই।” [সূরা আল-ইসরাঃ ২৭] অন্যত্র বলা হয়েছেঃ “আল্লাহ তাদেরকে পছন্দ করেন, যারা ব্যয় করার ক্ষেত্রে মধ্যবর্তিতা অবলম্বন করে- প্রয়োজনের চাইতে বেশী ব্যয় করে না এবং কমও করে না।" [সূরা আল-ফুরকানঃ ৬৭] এ আয়াতে পানাহার সম্পর্কে যে মধ্যবর্তিতার নির্দেশ বর্ণিত হয়েছে, তা শুধু পানাহারের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং পরিধান ও বসবাসের প্রত্যেক কাজেই মধ্য পন্থা পছন্দনীয় ও কাম্য। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ সীমালংঘন ও অহংকার না করে খাও, দান কর এবং পরিধান কর। [নাসাঈঃ ৫/৭৯, ইবন মাজাহঃ ৩৬০৫] অনুরূপভাবে ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ যা ইচ্ছা পানাহার কর এবং যা ইচ্ছা পরিধান কর, তবে শুধু দুটি বিষয় থেকে বেঁচে থাক। (এক) তাতে অপব্যয় অর্থাৎ প্রয়োজনের চাইতে বেশী না হওয়া চাই এবং (দুই) গর্ব ও অহংকার না থাকা চাই। [বুখারী] অন্যত্র এটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকেও বর্ণিত হয়েছে। [নাসায়ী: ২৫৫৯] তবে এ ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি স্বাভাবিক সীমা দিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেনঃ ‘আদম সন্তান যে সমস্ত ভাণ্ডার পূর্ণ করে, তন্মধ্যে পেট হল সবচেয়ে খারাপ। আদম সন্তানের জন্য স্বল্প কিছু লোকমাই যথেষ্ট, যা দিয়ে সে তার পিঠ সোজা রাখতে পারে। এর বেশী করতে চাইলে এক-তৃতীয়াংশ খাবারের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ পানীয়ের জন্য এবং এক-তৃতীয়াংশ নিঃশ্বাসের জন্য নির্দিষ্ট করে।’ [তিরমিযীঃ ২৩৮০, ইবন মাজাহঃ ৩৩৪৯, মুসনাদে আহমাদঃ ৪/১৩২]

(وَّكُلُوْا وَاشْرَبُوْا وَلَا تُسْرِفُوْا)

আয়াত থেকে বেশ কয়েকটি মাসআলা জানা যায়। (এক) যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু পানাহার করা ফরয। (দুই) শরীআতের কোন দলীল দ্বারা কোন বস্তুর অবৈধতা প্রমানিত না হওয়া পর্যন্ত সব বস্তুই হালাল। (তিন) আল্লাহ্ তা'আলা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক নিষিদ্ধ বস্তুসমূহকে ব্যবহার করা অপব্যয় ও অবৈধ ৷ (চার) যেসব বস্তু আল্লাহ্ তাআলা হালাল করেছেন, সেগুলোকে হারাম মনে করাও অপব্যয় এবং মহাপাপ। (পাঁচ) পেট ভরে খাওয়ার পরও আহার করা সমীচীন নয়। (ছয়) এতটুকু কম খাওয়াও অবৈধ, যদ্দরুন দুর্বল হয়ে ফরয কর্ম সম্পাদন করতে অক্ষম হয়ে পড়ে। দেখুন, [ কুরতুবী; ফাতহুল কাদীর]

: ২০৬
إِنَّ الَّذِينَ عِنْدَ رَبِّكَ لَا يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِهِ وَيُسَبِّحُونَهُ وَلَهُ يَسْجُدُونَ ۩

নিশ্চয় যারা আপনার রবের সান্নিধ্যে রয়েছে তারা তাঁর ইবাদাতের ব্যাপারে অহঙ্কার [১] করে না। আর তারা তাঁরই তাসবীহ পাঠ করে [২] এবং তাঁরই জন্য সিজদা [৩] করে।

ফুটনোট

[১] যারা আল্লাহর কাছে রয়েছেন তারা আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতাগণ। সে হিসেবে আয়াতের অর্থ হচ্ছে, শ্রেষ্ঠত্বের অহংকার করা ও রবের বন্দেগী থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া শয়তানের কাজ। এর ফল হয় অধঃপতন ও অবনতি। পক্ষান্তরে আল্লাহর সামনে ঝুঁকে পড়া এবং তাঁর বন্দেগীতে অবিচল থাকা একটি ফেরেশতাসুলভ কাজ। এর ফল হয় উন্নতি ও আল্লাহর নৈকট্য লাভ। যদি তোমরা এ উন্নতি চাও তাহলে নিজেদের কর্মনীতিকে শয়তানের পরিবর্তে ফেরেশতাদের কর্মনীতির অনুরূপ করে গড়ে তোল।

[২] আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করে অর্থাৎ আল্লাহ যে ক্রটিমুক্ত, দোষমুক্ত, ভুলমুক্ত সব ধরনের দুর্বলতা থেকে তিনি যে একেবারেই পাক-পবিত্র এবং তিনি যে লা-শরীক, তুলনাহীন ও অপ্রতিদ্বন্দ্ব, এ বিষয়টি সর্বান্তকরণে মেনে নেয়। মুখে তার স্বীকৃতি দেয় ও অংগীকার করে এবং স্থায়ীভাবে সবসময় এর প্রচার ও ঘোষণায় সোচ্চার থাকে।

[৩] এখানে সালাত সংক্রান্ত ইবাদাতের মধ্য থেকে শুধু সিজদার কথা উল্লেখ করার কারণ এই যে, সালাতের সমগ্র আরকানের মধ্যে সিজদার একটি বিশেষ ফযীলত রয়েছে। হাদীসে রয়েছে যে, ‘কোন এক লোক সওবান রাদিয়াল্লাহু আনহুর নিকট নিবেদন করলেন যে, আমাকে এমন একটা আমল বাতলে দিন যাতে আমি জান্নাতে যেতে পারি। সওবান রাদিয়াল্লাহু আনহু নীরব রইলেন; কিছু বললেন না। লোকটি আবার নিবেদন করলেন, তখনও তিনি চুপ করে রইলেন। এভাবে তৃতীয়বার যখন বললেন, তখন তিনি বললেনঃ আমি এ প্রশ্নটিই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে করেছিলাম। তিনি আমাকে ওসীয়ত করেছিলেন যে, অধিক পরিমাণে সিজদা করতে থাক। কারণ, তোমরা যখন একটি সিজদা কর তখন তার ফলে আল্লাহ তা'আলা তোমাদের মর্যাদা এক ডিগ্রি বাড়িয়ে দেন এবং একটি গোনাহ ক্ষমা করে দেন। লোকটি বললেনঃ সওবান রাদিয়াল্লাহু আনহুর সাথে আলাপ করার পর আমি আবুদদারদা রাদিয়াল্লাহু আনহুর সাথে সাক্ষাৎ করে তার কাছেও একই নিবেদন করলাম এবং তিনিও একই উত্তর দিলেন। [মুসলিমঃ ৪৮৮]

অন্য এক হাদীসে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ বান্দা স্বীয় রবের সর্বাধিক নিকটবর্তী তখনই হয়, যখন সে বান্দা সিজদায় অবনত থাকে। কাজেই তোমরা সিজদারত অবস্থায় খুব বেশী করে দোআ-প্রার্থনা করবে। তাতে তা কবুল হওয়ার যথেষ্ট আশা রয়েছে। [মুসলিমঃ ৪৭৯, ৪৮২]

সুরা আল-আ’রাফের শেষ আয়াতটি হল আয়াতে সিজদা। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘কোন আদম সন্তান যখন কোন সিজদার আয়াত পাঠ করে অতঃপর সিজদায়ে তেলাওয়াতে সম্পন্ন করে, তখন শয়তান কাঁদতে কাদতে পালিয়ে যায় এবং বলে যে, আফসোস, মানুষের প্রতি সিজদার হুকুম হল আর সে তা আদায়ও করল, ফলে তার ঠিকানা হল জান্নাত, আর আমার প্রতিও সিজদার হুকুম হয়েছিল, কিন্তু আমি তার না-ফরমানী করেছি বলে আমার ঠিকানা হল জাহান্নাম।’ [মুসলিমঃ ১৩৩]

: ১০৩
خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِمْ بِهَا وَصَلِّ عَلَيْهِمْ ۖ إِنَّ صَلَاتَكَ سَكَنٌ لَهُمْ ۗ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ

আপনি তাদের সম্পদ থেকে ‘সদকা’ গ্রহন করুন [১]। এর দ্বারা আপনি তাদেরকে পবিত্র করবেন এবং পরিশোধিত করবেন। আর আপনি তেদের জন্য দো’আ করুন। আপনার দো’আ তো তোদের জন্য প্রশান্তি কর [২]। আর আল্লাহ্‌ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।

ফুটনোট

[১] মুফাসসিরগণ এ সাদকার প্রকৃতি নির্ধারণ নিয়ে দুটি মত দিয়েছেন। কারও কারও মতে, এ আয়াতে পূর্ববর্তী আয়াতে যাদের তাওবাহ কবুল করা হয়েছে তাদের সদকা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। সেটা ফরয বা নফল যে কোন সদকা হতে পারে। [ফাতহুল কাদীর] এ মতের সমর্থনে ইবন আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত আছে যে, যখন পূর্বোক্ত লোকদের তাওবা কবুল করা হয়, তখন তারা তাদের সম্পদ নিয়ে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! এগুলো আমাদের সম্পদ, এগুলো গ্রহণ করে আমাদের পক্ষ থেকে সদকা দিন এবং আমাদের জন্য ক্ষমার দো'আ করুন। তিনি বললেন, আমাকে এর নির্দেশ দেয়া হয়নি। তখন এ আয়াত নাযিল হয়। [আত-তাফসীরুস সহীহ] তবে অধিকাংশের মতে, নির্দেশটি ব্যাপক, সবার জন্যই প্রযোজ্য। তবে সেটা ফরয সদকা বা যাকাতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। [ফাতহুল কাদীর] এ মতের সমর্থনে বেশ কিছু হাদীস রয়েছে, যাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যাকাত প্রদানকারীদের জন্য দোআ করেছেন।

[২] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ নির্দেশ মোতাবেক সাহাবীদের মধ্যে কেউ যাকাত নিয়ে আসলে তাদের পরিবারের জন্য দোআ করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আবি আওফা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কোন সম্প্রদায়ের লোকেরা যাকাত নিয়ে আসলে তিনি বলতেন, আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা আলে ফুলান’। (হে আল্লাহ! অমুকের বংশধরের জন্য সালাত প্রেরণ করুন) অতঃপর আমার পিতা তার কাছে যাকাত নিয়ে আসলে তিনি দো'আ করলেন, আল্লাহুম্মা সাল্লে 'আলা আলে আবি আওফা"। (হে আল্লাহ! আৰু আওফার বংশধরের জন্য সালাত প্রেরণ করুন) [বুখারী: ১৪৯৭] অন্য বর্ণনায় এসেছে, জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, এক মহিলা এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি আমার ও আমার স্বামীর জন্য দোআ করুন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সাল্লাল্লাহু আলাইকে ওয়া 'আলা যাওজিকে (আল্লাহ তোমার ও তোমার স্বামীর জন্য সালাত প্রেরণ করুন)। [আবু দাউদ: ১৫৩৩]

: ১১২
التَّائِبُونَ الْعَابِدُونَ الْحَامِدُونَ السَّائِحُونَ الرَّاكِعُونَ السَّاجِدُونَ الْآمِرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَالنَّاهُونَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَالْحَافِظُونَ لِحُدُودِ اللَّهِ ۗ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ

তারা [১] তাওবাহকারী, ‘ইবাদাতকারী, আল্লাহ্‌র প্রশংসাকারী, সিয়াম পালনকারী [২] , রুকূ’কারী, সিজদাকারী, সৎকাজের আদেশদাতা, অসৎকাজের নিষেধকারী এবং আল্লাহ্‌র নির্ধারিত সীমারেখা সংরক্ষণকারী [৩]; আর আপনি মুমিনদেরকে শুভ সংবাদ দিন।

ফুটনোট

[১] এ গুণাবলী হলো সেসব মুমিনের যাদের সম্পর্কে পূর্বের আয়াতে বলা হয়েছে- আল্লাহ্‌ জান্নাতের বিনিময়ে তাদের জান-মাল খরিদ করে নিয়েছেন’। আল্লাহ্‌র রাহে জিহাদকারী সবাই এ আয়াতের মর্মভুক্ত। তবে এখানে যে সমস্ত গুণাবলীর উল্লেখ হয়েছে, তা শর্তরূপে নয়। কারণ, আল্লাহর রাহে কেবল জিহাদের বিনিময়েই জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। তবে এ গুণাবলী উল্লেখের উদ্দেশ্য এই যে, যারা জান্নাতের উপযুক্ত, তারা এ সকল গুণের অধিকারী হয়। [কুরতুবী]

[২] অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে আয়াতে উল্লেখিত (السائحون) দ্বারা উদ্দেশ্য সাওম পালনকারীগণ। [কুরতুবী; ইবন কাসীর] আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ ও আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুম বলেন, কুরআন মাজীদে ব্যবহৃত (سائحون) শব্দের অর্থ রোযাদার। [বাগভী; কুরতুবী] তাছাড়া (سائح) বলে জিহাদকারীদেরকেও বুঝায়। তবে মূল শব্দটি (سياحة) যার অর্থঃ দেশ ভ্রমণ। বিভিন্ন ধর্মের লোক দেশ ভ্রমণকে ইবাদাত মনে করতো। অর্থাৎ মানুষ পরিবার পরিজন ও ঘর-বাড়ী ত্যাগ করে ধর্ম প্রচার করার উদ্দেশ্যে দেশ দেশান্তরে ঘুরে বেড়াত। ইসলাম একে বৈরাগ্যবাদ বলে অভিহিত করে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে [ইবন কাসীর] এর পরিবর্তে সিয়াম পালনের ইবাদতকে এর স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে। আবার কতিপয় বর্ণনায় জিহাদকেও দেশ ভ্রমনের অনুরূপ বলা হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘আমার উম্মতের দেশভ্রমণ হলো জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ।’ [আবুদাউদ: ২৪৮৬]

[৩] আলোচ্য আয়াতে মুমিন মুজাহিদের আটটি গুণ উল্লেখ করে নবম গুণ হিসেবে বলা হয়েছে “আর আল্লাহর দেয়া সীমারেখার হেফাযতকারী" মূলতঃ এতে রয়েছে উপরোক্ত সাতটি গুণের সমাবেশ অর্থাৎ সাতটি গুণের মধ্যে যে তাফসীল রয়েছে, তার সংক্ষিপ্ত সার হলো যে, এরা নিজেদের প্রতিটি কর্ম ও কথায় আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা তথা শরী’আতের হুকুমের অনুগত ও তার হেফাযতকারী। [আত-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর]

: ১১৪
وَمَا كَانَ اسْتِغْفَارُ إِبْرَاهِيمَ لِأَبِيهِ إِلَّا عَنْ مَوْعِدَةٍ وَعَدَهَا إِيَّاهُ فَلَمَّا تَبَيَّنَ لَهُ أَنَّهُ عَدُوٌّ لِلَّهِ تَبَرَّأَ مِنْهُ ۚ إِنَّ إِبْرَاهِيمَ لَأَوَّاهٌ حَلِيمٌ

আর ইবরাহীম তাঁর পিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছিল, তাকে এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বলে; তারপর যখন এটা তার কাছে সুস্পষ্ট হল যে, সে আল্লাহ্‌র শত্রু তখন ইবরাহীম তার সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। ইবরাহীম তো কোমল হৃদয় [১] ও সহনশীল।

ফুটনোট

[১] (اواه) শব্দটির অর্থ নির্ধারণে কয়েকটি মত এসেছে। ইবন মাসউদ ও উবাইদ ইবন উমায়রের মতে এর অর্থ, বেশী বেশী প্রার্থনাকারী। হাসান ও কাতাদা বলেন, এর অর্থ আল্লাহর বান্দাদের প্রতি বেশী দরদী। ইবন আব্বাস বলেন, এটি হাবশী ভাষায় মুমিনকে বোঝায়। কালবী বলেন, এর অর্থ যিনি জনমানবশূণ্য ভূমিতে আল্লাহকে আহবান করে। কারও কারও মতে, বেশী বেশী যিকিরকারী। কারও কারও মতে, ফকীহ। আবার কারও কারও মতে বিনয়ী ও বিনম্র। কারও কারও মতে, এর অর্থ এমন ব্যক্তি যে নিজের গোনাহের কথা স্মরণ হলেই ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে। কারও কারও মতে এর অর্থ, যিনি আল্লাহ যা অপছন্দ করেন তা থেকে সর্বদা প্রত্যাবর্তন করতে থাকে। কারও কারও মতে এর অর্থ, যিনি কল্যাণের কথা মানুষদের শিক্ষা দেন। তবে এ শব্দটির মূল অর্থ যে বেশী বেশী আহ্‌ আহ্‌ বলে কোন গোনাহ হয়ে গেলে আফসোস করতে থাকে। মনে ব্যথা অনুভব হতে থাকে এবং এর জন্য তার মন থেকে আফসোসের শব্দ হতে থাকে। [ফাতহুল কাদীর]

১১ : ১১৪
وَأَقِمِ الصَّلَاةَ طَرَفَيِ النَّهَارِ وَزُلَفًا مِنَ اللَّيْلِ ۚ إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّئَاتِ ۚ ذَٰلِكَ ذِكْرَىٰ لِلذَّاكِرِينَ

আর আপনি সালাত কায়েম করুন [১] দিনের দু প্রান্তভাগে ও রাতের প্রথমাংসে [২]। নিশ্চয় সৎকাজ অসৎ কাজকে মিটিয়ে দেয় [৩]। উপদেশ গ্রহণকারীদের জন্য এটা [৪] এক উপদেশ।

ফুটনোট

[১] আয়াতে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লক্ষ্য করে তাকে ও তার সমস্ত উম্মতকে নামায কায়েম রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আলোচ্য আয়াতে সালাত দ্বারা উদ্দেশ্য ফরয সালাত। [কুরতুবী] আর ইকামতে সালাত অর্থ, পূর্ণ পাবন্দীর সাথে নিয়মিতভাবে সালাত সম্পন্ন করা। কোন কোন আলেমের মতে সালাত কায়েম করার অর্থ, সমুদয় সুন্নত ও মুস্তাহাবসহ আদায় করা। কারো মতে এর অর্থ, মুস্তাহাব ওয়াক্তে নামায পড়া। আবার কারো কারো মতে, জামাতের সাথে আদায় করা। মূলতঃ এটা কোন মতানৈক্য নয়। আলোচ্য সবগুলোই একামতে সালাতের সঠিক মর্মার্থ। সূরা আল-বাকারার ৩ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় তার বিস্তারিত আলোচনা চলে গেছে।

[২] নামায কায়েম করার নির্দেশ দানের পর সংক্ষিপ্তভাবে নামাযের ওয়াক্ত বর্ণনা করেছেন যে, “দিনের দু'প্রান্তে অর্থাৎ শুরুতে ও শেষভাগে এবং রাতেরও কিছু অংশে নামায কায়েম করবেন।” দিনের দু'প্রান্তের নামাযের মধ্যে প্রথমভাগের নামায সম্পর্কে সবাই একমত যে, সেটি ফজরের নামায। [তাবারী; বাগভী; কুরতুবী; ইবন কাসীর] কিন্তু শেষ প্রান্তের নামায সম্পর্কে ইবন আব্বাস বলেন তা মাগরিবের নামায। [তাবারী; কুরতুবি ; ইবন কাসির] হাসান বসরি, কাতাদাহ ও দাহহাক আসরের নামাযকেই দিনের শেষ নামায সাব্যস্ত করেছেন। [কুরতুবী ইবন কাসীর] অবশ্য এখানে একটি মত এটাও রয়েছে যে, দিনের দু'প্রান্ত বলে, যোহর ও আসরের সালাত বোঝানো হয়েছে। [কুরতুবী] রাতের কিছু অংশের নামায সম্পর্কে ইবন আব্বাস ও মুজাহিদ বলেন, এটি হচ্ছে, এশার নামায। হাসান বসরী, মুজাহিদ, মুহাম্মদ ইবনে কা’ব, কাতাদাহ, যাহ্‌হাক প্রমুখ তফসীরকারকদের অভিমত হচ্ছে যে, সেটি মাগরিব ও এশার নামায। [ইবন কাসীর] অতএব এ আয়াতে চার ওয়াক্ত নামাযের বর্ণনা পাওয়া গেল। অবশিষ্ট রইল যোহরের নামায। এ ব্যাপারে ইবন কাসীর বলেন, এটি পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয হওয়ার আগের নির্দেশ। আর তখন দু' ওয়াক্ত নামাযই ফরয ছিল। সূর্যোদয়ের আগের নামায এবং সূর্যাস্তের আগের নামায। আর রাতের বেলা রাসূল ও উম্মতের উপর কিয়ামুল লাইল করা ফরয ছিল। [ইবন কাসীর] অথবা যোহরের সালাতের ব্যাপারে কুরআনের অন্যত্র যা এসেছে তা থেকে প্রমাণ নেয়া যায়, তা হচ্ছে, “নামায কায়েম কর, যখন সূর্য ঢলে পড়ে।” [সূরা আল-ইসরাঃ ৩৮]

[৩] এখানে সালাত কায়েম করার নির্দেশ দানের সাথে সাথে তার উপকারিতাও জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে “পুণ্যকাজ অবশ্যই পাপকে মিটিয়ে দেয়”। এখানে পুণ্যকাজ বলতে অধিকাংশ আলেমদের নিকট সালাত বোঝানো হয়েছে। [দেখুন, তাবারী] যদিও সালাত, রোযা, হজ, যাকাত, সদকাহ, সদ্ব্যবহার প্রভৃতি যাবতীয় সৎকাজই উদ্দেশ্য হতে পারে। [কুরতুবী] তবে নিঃসন্দেহে এর মধ্যে সালাত সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও সর্বাগ্রে-গণ্য। অনুরূপভাবে পাপকার্যের মধ্যে সগীরা ও কবীরা যাবতীয় গোনাহ শামিল রয়েছে। কিন্তু কুরআন এবং রাসূলের বিভিন্ন হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, এখানে পাপকার্য দ্বারা সগীরা গোনাহ বুঝানো হয়েছে। এমতাবস্থায় আয়াতের মর্ম হচ্ছে, যাবতীয় নেক কাজ, বিশেষ করে নামায সগীরা গোনাহসমূহ মিটিয়ে দেয়। এ হিসেবে ইমাম কুরতুবী বলেন, আয়াতটি পুণ্যকাজের ব্যাপারে ব্যাপক হলেও গোনাহ ক্ষমা করার ব্যাপারে বিশেষভাবে বিশেষিত। অর্থাৎ সগীরা গোনাহের সাথে সংশ্লিষ্ট। [কুরতুবী] এখানে উল্লেখযোগ্য যে, সৎকাজের দ্বারা পাপ ক্ষমা হয় এ কথা কুরআন ও হাদীসের অন্যান্য স্থানেও বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন, আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ “তোমরা যদি বড় (কবীরা) গোনাহসমূহ হতে বিরত থাক তাহলে তোমাদের ছোট ছোট (সগীরা) গুনাহগুলি মিটিয়ে দেব”। [সূরা আন-নিসাঃ ৩১] অন্য এক হাদীসে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, এক জুম'আ পরবতী জুম'আ পর্যন্ত এবং এক রমযান দ্বারা পরবর্তী রমযান পর্যন্ত মধ্যবর্তী যাবতীয় সগীরা গোনাহসমূহ মিটিয়ে দেয়া হয়, যদি সে ব্যক্তি কবীরা গোনাহ হতে বিরত থাকে।’ [মুসলিমঃ ২৩৩] অর্থাৎ কবীরা গোনাহ তওবা ছাড়া মাফ হয় না, কিন্তু সগীরা গোনাহ নামায, রোজা, দান-সাদকাহ ইত্যাদি পুণ্যকর্ম করার ফলে আপনা-আপনিও মাফ হয়ে যায়। মোটকথা, আলোচ্য আয়াতের মাধ্যমে প্রমাণিত হল যে, নেক কাজ করার ফলেও অনেক গোনাহ মাফ হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন যে, “তোমাদের থেকে কোন মন্দ কাজ হলে পরে সাথে সাথে নেক কাজ কর, তাহলে উহার ক্ষতিপূরণ হয়ে যাবে।” [তিরমিয়ীঃ ১৯৮৭, মুস্তাদরাকে হাকেমঃ ১৭৮] অন্য হাদীসে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ “কোন এক ব্যক্তি জনৈক মহিলাকে চুমু দিয়ে ফেলল। তারপর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে এ কথা উল্লেখ করলো। তখন তার এ ঘটনা উপলক্ষে উক্ত আয়াত নাযিল করা হলো। অর্থাৎ আপনি সালাত কায়েম করুন দিনের দু প্রান্তভাগে ও রাতের প্রথমাংশে। সৎকাজ অবশ্যই অসৎকাজ মিটিয়ে দেয়। যারা উপদেশ গ্রহণ করে, এটা তাদের জন্য এক উপদেশ”। তখন লোকটি জিজ্ঞেস করলো হে আল্লাহর রাসূল! এ হুকুম কি কেবল আমার জন্য, না সকলের জন্য? তিনি বললেনঃ আমার উম্মতের যে কেউ নেক আমল করবে, এ হুকুম তারই জন্য”। [বুখারীঃ ৪৬৮৭] অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “তোমাদের কারো বাড়ীর সামনে যদি কোন নদী থাকে আর দৈনিক পাঁচবার তাতে গোসল করা হয় তাহলে তার কি কোন ময়লা বাকী থাকবে?” সাহাবায়ে কেরাম বললেনঃ “তার কোন ময়লাই অবশিষ্ট থাকবে না"। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ এটাই হলো পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের উদাহরণ। আল্লাহ এর মাধ্যমে গুণাহসমূহ ক্ষমা করে দেন। [বুখারীঃ ৫২৮, মুসলিমঃ ২৭৬৩] তবে মনে রাখতে হবে যে, সৎকাজ দ্বারা শুধুমাত্র সগীরা বা ছোট গুণাহ মাফ হয়। কবীরা গুণাহের জন্য তাওবা জরুরী। কারণ হাদীসে বলা হয়েছে, যদি সে ব্যক্তি কবীরা গোনাহ হতে বিরত থাকে। [মুসলিম: ২৩৩]

[৪] “এটা শব্দ দ্বারা কুরআন মজীদের প্রতি ইঙ্গিত হতে পারে [কুরতুবী] অথবা ইতিপূর্বে বর্ণিত বিধি-নিষেধের প্রতিও ইশারা হতে পারে। [বাগভী| সে মতে আয়াতের মর্ম হচ্ছে-এই কুরআন অথবা এতে বর্ণিত হুকুম-আহকামসমূহ ঐসব লোকের জন্য স্মরণীয় হেদায়েত ও নসীহত, যারা উপদেশ শুনতে ও মানতে প্রস্তুত। তবে এ কুরআন থেকে হেদায়াত নিতে হলে নফসকে বশ করা এবং সবর করার প্রয়োজন পড়ে। তাই পরবর্তী আয়াতে সবরের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। [সা’দী]

১২ : ১০১
رَبِّ قَدْ آتَيْتَنِي مِنَ الْمُلْكِ وَعَلَّمْتَنِي مِنْ تَأْوِيلِ الْأَحَادِيثِ ۚ فَاطِرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ أَنْتَ وَلِيِّي فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ ۖ تَوَفَّنِي مُسْلِمًا وَأَلْحِقْنِي بِالصَّالِحِينَ

‘হে আমার রব! আপনি আমাকে রাজ্য দান করেছেন এবং স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দিয়েছেন। হে আসমানসমূহ ও যমীনের সষ্টা! আপনিই দুনিয়া ও আখিরাতে আমার অভিভাবক। আপনি আমাকে মুসলিম হিসেবে মৃত্যু দিন এবং আমাকে সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত করুন [১]।’

ফুটনোট

[১] পিতা-মাতা ও ভাইদের সাথে সাক্ষাতের ফলে যখন জীবনে শান্তি এল, তখন সরাসরি আল্লাহ্‌র প্রশংসা, তাঁর কাছে দো'আয় মশগুল হয়ে গেলেন এবং বললেনঃ “হে আমার পালনকর্তা! আপনি আমাকে রাষ্ট্রক্ষমতা দান করেছেন এবং আমাকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিখিয়েছেন। হে আসমান ও যমীনের স্রষ্টা! আপনিই দুনিয়া ও আখেরাতে আমার কাৰ্যনির্বাহী। আমাকে পূর্ণ আনুগত্যশীল অবস্থায় দুনিয়া থেকে উঠিয়ে নিন এবং আমাকে পরিপূর্ণ সৎ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত রাখুন।” ‘পরিপূর্ণ সৎ বান্দা’ নবীগণই হতে পারেন। এ দো’আয় ‘খাতেমা বিলখায়ের’ অর্থাৎ অন্তিম সময়ে পূর্ণ আনুগত্যশীল হওয়ার প্রার্থনাটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। আল্লাহ্ তা'আলার প্রিয়জনদের বৈশিষ্ট্য এই যে, তারা দুনিয়া ও আখেরাতে যত উচ্চ মর্যাদাই লাভ করুন এবং যত প্রভাব-প্রতিপত্তি ও পদমর্যাদাই তাদের পদচুম্বন করুক, তারা কখনো গর্বিত হন না; বরং সর্বদাই এসব অবস্থা বিলুপ্ত হওয়ার অথবা হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা করতে থাকেন। তাই তারা দো’আ করতে থাকেন, যাতে আল্লাহ্-প্রদত্ত বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ নেয়ামতসমূহ জীবনের শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত অব্যাহত থাকে, বরং সেগুলো আরো যেন বৃদ্ধি পায়।

১৪ : ৩৫
وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّ اجْعَلْ هَٰذَا الْبَلَدَ آمِنًا وَاجْنُبْنِي وَبَنِيَّ أَنْ نَعْبُدَ الْأَصْنَامَ

আর স্মরণ করুন [১], যখন ইবরাহীম বলেছিলেন, ‘হে আমার রব! এ শহরকে নিরাপদ করুন [২] এবং আমাকে ও আমার পুত্রদেরকে মূর্তি পূজা হতে দূরে রাখুন [৩]।

ফুটনোট

[১] সাধারণ অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করার পর এবার আল্লাহ্ কুরাইশদের প্রতি যেসব বিশেষ অনুগ্রহ করেছিলেন সেগুলোর কথা বলছেন। এ সংগে একথাও বলা হচ্ছে যে, তোমাদের প্রপিতা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কোন ধরনের প্রত্যাশা নিয়ে তোমাদের এখানে আবাদ করেছিলেন, তার দো’আর জবাবে আমি তোমাদের প্রতি কোন ধরনের অনুগ্রহ বর্ষণ করেছিলাম এবং এখন তোমরা নিজেদের প্রপিতার প্রত্যাশা ও নিজেদের রবের অনুগ্রহের জবাবে কোন ধরনের ভ্রষ্টতা ও দুষ্কর্মের অবতারণা করে যাচ্ছো। তিনি তো এ ঘরকে একমাত্র আমার ইবাদতের জন্য তৈরী করেছিলেন। এ ইবরাহীম যার জন্য এ এলাকা আবাদ হয়েছে তিনি তো প্রচণ্ডভাবেই আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কিছুর ইবাদাতের বিরোধিতা করে গেছেন। তিনিই তো মক্কার জন্য নিরাপত্তার দো’আ করেছেন। [আল-বাহরুল মুহীত; ইবন কাসীর]

[২] এখানে ইবরাহীম ‘আলাইহিস্ সালাম-এর দু’টি দো’আ উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রথম দো’আঃ

(رَبِّ اجْعَلْ هٰذَا الْبَلَدَ اٰمِنًا)

-অর্থাৎ হে আমার রব! এ (মক্কা) নগরীকে শান্তির আলয় করে দাও। সূরা আল-বাকারায়ও [১২৬ নং আয়াতে] এ দো’আর উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে (بلد) শব্দটি (الف) ও (لام) ব্যতীত (بلدا) বলা হয়েছে। এর অর্থ অনির্দিষ্ট নগরী। এর কারণ হিসেবে কোন কোন মুফাসসির যা বলেন তা এই যে, এ দো’আটি যখন করা হয়েছিল, তখন মক্কা নগরীর পত্তন হয়নি। তাই ব্যাপক অর্থবোধক ভাষায় দো'আ করেছিলেন যে, এ জায়গাকে একটি শান্তির নগরীতে পরিণত করে দিন। এরপর মক্কায় যখন জনবসতি স্থাপিত হয়ে যায়, তখন এ আয়াতে বর্ণিত দো’আটি করেন। কারণ এর পরে তার দু ছেলে ইসমাঈল ও ইসহাকের কথা উল্লেখ করেছেন। যা দ্বারা বোঝা যায় যে, দো’আটি পরেই করা হয়েছে। কারণ ইসমাঈল আলাইহিস সালাম ইসহাকের চেয়ে তের বছরের বড় ছিলেন। আর প্রথম যখন দো’আ করেছিলেন তখন ইসমাঈল ও তার মা-এ দু’জনই ছিলেন। আর ইসমাঈল তখন ছিলেন দুগ্ধপোষ্য শিশু। [আল-বাহরুল মুহীত; ইবন কাসীর]

কোন কোন মুফাসসির বলেন, সূরা বাকারার আয়াতে সে দেশ ও দেশের বাসিন্দা সবার নিরাপত্তা চাওয়া হয়েছে, পক্ষান্তরে এ সূরায় শুধু দেশের নিরাপত্তা চাওয়া হয়েছে। [ফাতহুল কাদীর] এ ক্ষেত্রে মক্কাকে নির্দিষ্ট করে প্রথমে যে দো’আ করেন তা হচ্ছে, ‘একে শান্তির আবাসস্থল করে দিন।’ আল্লাহ্ তা’আলা নবীর এ দো’আ কবুল করেছেন। তিনি অন্যত্র বলেন, “তারা কি দেখে না আমরা ‘হারাম’কে নিরাপদ স্থান করেছি, অথচ এর চারপাশে যেসব মানুষ আছে, তাদের উপর হামলা করা হয়।” [সূরা আল-আনকাবূত: ৬৭]

এখানে লক্ষণীয় যে, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সবকিছুর আগে নিরাপত্তার জন্য দো’আ করেছেন। কারণ, যদি কোন স্থানে নিরাপত্তার অভাব হয়, সেখানে দ্বীন- দুনিয়ার কোন কাজই সঠিকভাবে আঞ্জাম দেয়া সম্ভব হয় না। [ফাতহুল কাদীর]

[৩] দ্বিতীয় দো’আ এই যে, আমাকে ও আমার সন্তান-সন্ততিকে মূর্তিপূজা থেকে বাঁচিয়ে রাখুন। নবীগণ নিষ্পাপ। কিন্তু এখানে ইবরাহীম ‘আলাইহিস্ সালাম দো’আ করতে গিয়ে নিজেকেও অন্তর্ভুক্ত করেন। এর কারণ এই যে, স্বভাবজাত ভীতির প্রভাবে নবীগণ সর্বদা শংকা অনুভব করতেন। অথবা আসল উদ্দেশ্য ছিল সন্তান-সন্ততিকে মূর্তিপূজা থেকে বাঁচানোর দো’আ করা। সন্তানদেরকে এর গুরুত্ব বোঝাবার জন্য নিজেকেও দো’আয় শামিল করে নিয়েছেন। আল্লাহ্ তা’আলা স্বীয় বন্ধুর দো’আ কবুল করেছেন। ফলে তার সন্তানরা শির্ক ও মূর্তিপূজা থেকে নিরাপদ থাকে। [তাবারী; কুরতুবী] তবে তার বংশধরদের মধ্যে মূর্তিপূজা হবে না এমনটি বলা হয়নি এবং ইবরাহীম ‘আলাইহিস্ সালামও এমন দো’আ করেননি। কারণ, মক্কাবাসীরা সাধারণভাবে ইবরাহীম ‘আলাইহিস্ সালাম-এরই বংশধর। তাদের মধ্যে মূর্তিপূজা বিদ্যমান ছিল। প্রত্যেক দো’আকারীর উচিত তার নিজের ও পিতামাতা ও তার সন্তান-সন্তুতিদের জন্য এ দো’আ করা। [ইবন কাসীর]

১৪ : ৩৬
رَبِّ إِنَّهُنَّ أَضْلَلْنَ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ ۖ فَمَنْ تَبِعَنِي فَإِنَّهُ مِنِّي ۖ وَمَنْ عَصَانِي فَإِنَّكَ غَفُورٌ رَحِيمٌ

‘হে আমার রব! এ সব মূর্তি তো বহু মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে [১]। কাজেই যে আমার অনুসরণ করবে সে আমার দলভুক্ত, কিন্তু কেউ আমার অবাধ্য হলে আপনি তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু [২]।

ফুটনোট

[১] এখানে পূর্ব আয়াতে বর্ণিত দো’আর কারণ বর্ণনা করে বলা হয়েছে যে, মূর্তিপূজা থেকে আমাদের অব্যাহতি কামনার কারণ এই যে, এ মূর্তি অনেক মানুষকে পথ ভ্রষ্টতায় লিপ্ত করেছে। ইবরাহীম ‘আলাইহিস্ সালাম স্বীয় পিতা ও জাতির অভিজ্ঞতা থেকে একথা বলেছিলেন। মূর্তিপূজা তাদেরকে সর্বপ্রকার মঙ্গল ও কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করে দিয়েছিল। অর্থাৎ মূর্তিগুলো মানুষকে আল্লাহ্‌র দিক থেকে ফিরিয়ে নিয়ে নিজেদের ভক্তে পরিণত করেছে। মূর্তি যেহেতু অনেকের পথভ্রষ্টতার কারণ হয়েছে তাই পথভ্রষ্ট করার কাজকে তার কৃতকর্ম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। [কুরতুবী]

[২] অর্থাৎ তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি আমার অনুসারী হবে তথা ঈমান ও সৎকর্ম সম্পাদনকারী হবে, সে তো আমারই। উদ্দেশ্য, তার প্রতি যে দয়া ও কৃপা করা হবে, তা বলাই বাহুল্য। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি অবাধ্যতা করে, তার জন্য আপনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, দয়ালু। এখানে অবাধ্যতার অর্থ যদি কর্মগত অবাধ্যতা অর্থাৎ মন্দকৰ্ম নেয়া হয়, তবে আয়াতের অর্থ স্পষ্ট যে, আপনার কৃপায় তারও ক্ষমা আশা করা যায়। আর যদি অবাধ্যতার অর্থ কুফরী ও অস্বীকৃতি নেয়া হয়, তবে কাফের ও মুশরিকের ক্ষমা না হওয়া নিশ্চিত ছিল এবং ওদের জন্য সুপারিশ না করার নির্দেশ ইবরাহীম ‘আলাইহিস্ সালাম-কে পূর্বেই দেয়া হয়েছিল। এমতাবস্থায় তাদের ক্ষমার আশা ব্যক্ত করার সঠিক অর্থ হলোঃ নবীসুলভ দয়া প্রকাশ করা। প্রত্যেক নবীর আন্তরিক বাসনা এটাই ছিল যে, প্রত্যেক কাফের ঈমান আনুক, তাই আল্লাহ্ তা’আলাকে “আপনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, দয়ালু” -একথা বলে তিনি এই স্বভাবসুলভ বাসনা প্রকাশ করে দিয়েছেন মাত্র। একথা বলেননি যে, এদের সাথে ক্ষমা ও দয়ার ব্যবহার করুন। ঈসা ‘আলাইহিস্ সালামও স্বীয় উম্মতের কাফেরদের সম্পর্কে এরূপ বলেছিলেনঃ

(وَاِنْ تَغْفِرْ لَهُمْ فَاِنَّكَ اَنْتَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ)

[সূরা আল-মায়েদাঃ ১১৮] অর্থাৎ “আপনি যদি তাদেরকে ক্ষমা করেন, তবে আপনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাবান”। আপনি সবই করতে পারেন। আপনার কাজে কেউ বাধাদানকারী নেই। [দেখুন, ইবন কাসীর] আব্দুল্লাহ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইবরাহীম আলাইহিস সালামের এ কথা ‘হে রব! এ মুর্তিগুলো অনেক মানুষকে পথভ্রষ্ট করেছে’ এ আয়াতাংশ এবং ঈসা আলাইহিস সালামের যদি আপনি তাদেরকে আযাব দেন তবে তারা তো আপনারই বান্দা' আয়াতাংশ তেলাওয়াত করেন। তারপর তিনি তার দু'হাত উপরে উঠালেন এবং বললেন, হে আল্লাহ! আমার উম্মত, হে আল্লাহ! আমার উম্মত, হে আল্লাহ! আমার উম্মত। আর কাঁদতে থাকলেন। তখন আল্লাহ্ তাআলা জিবরীলকে বললেন, হে জিবরীল তুমি মুহাম্মাদের কাছে যাও, -অথচ তোমার রব জানেন - তাকে জিজ্ঞেস কর, কেন তিনি কাঁদছেন? তখন জিবরীল এসে রাসূলকে জিজ্ঞেস করলেন। তিনিও জিবরীলকে প্রশ্নোত্তর জানালেন। তখন আল্লাহ বললেন, জিবরীল যাও, মুহাম্মাদের কাছে এবং তাকে বল, আমরা অবশ্যই আপনার উম্মতের ব্যাপারে আপনাকে সন্তুষ্ট করব এবং আপনার জন্য খারাপ কোন কিছু করব না। মুসলিম: ২০২]

১৪ : ৩৭
رَبَّنَا إِنِّي أَسْكَنْتُ مِنْ ذُرِّيَّتِي بِوَادٍ غَيْرِ ذِي زَرْعٍ عِنْدَ بَيْتِكَ الْمُحَرَّمِ رَبَّنَا لِيُقِيمُوا الصَّلَاةَ فَاجْعَلْ أَفْئِدَةً مِنَ النَّاسِ تَهْوِي إِلَيْهِمْ وَارْزُقْهُمْ مِنَ الثَّمَرَاتِ لَعَلَّهُمْ يَشْكُرُونَ

হে আমাদের রব! আমি আমার বংশধরদের কিছু সংখ্যককে বসবাস করালাম [১] অনুর্বর উপত্যকায় [২] আপনার পবিত্র ঘরের কাছে [৩], হে আমাদের রব! এ জন্য যে, তারা যেন সালাত কায়েম করে [৪]। অতএব আপনি কিছু লোকের অন্তর তাদের প্রতি অনুরাগী করে দিন [৫] এবং ফল-ফলাদি দিয়ে তাদের রিযকের ব্যবস্থা করুন [৬], যাতে তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে [৭]।

ফুটনোট

[১] এখানে ইবরাহীম আলাইহিসসালাম কিভাবে তার স্ত্রী ও একমাত্র সন্তানকে এ মরুপ্রান্তরে রেখে গেলেন সে ঘটনাটি সহীহ বর্ণনার উপর নির্ভর করে বর্ণনা করা প্রয়োজন। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ নারী জাতি সর্বপ্রথম ইসমাঈল আলাইহিসসালাম এর মাতা হাজেরা থেকেই কোমরবন্ধ বানানো শিখেছে। হাজেরা সারা থেকে আপন গর্ভের নিদর্শনাবলী গোপন করার উদ্দেশ্যেই কোমরবন্ধ লাগাতেন। অতঃপর উভয়ের মনোমালিণ্য চরমে পৌছলে আল্লাহর আদেশে ইবরাহীম আলাইহিসসালাম হাজেরা ও তার শিশুপুত্র ইসমাইলকে সাথে নিয়ে নির্বাসন দানের জন্য বের হলেন। পথে হাজেরা শিশুকে দুধ পান করাতেন। শেষ পর্যন্ত ইবরাহীম আলাইহিসসালাম তাদের উভয়কে নিয়ে যেখানে কাবাঘর অবস্থিত সেখানে এসে উপস্থিত হলেন এবং মসজিদের উচু অংশে যমযমের উপরিস্থত এক বিরাট বৃক্ষতলে তাদেরকে রাখলেন। তখন মক্কায় না ছিল কোন জনমানব, না ছিল পানির কোনরূপ ব্যবস্থা। অতঃপর সেখানেই তাদেরকে রেখে গেলেন এবং একটি থলের মধ্যে কিছু খেজুর আর একটি মশকে স্বল্প পরিমাণ পানি দিয়ে গেলেন। তারপর ইবরাহীম আলাইহিসসালাম নিজ গৃহ অভিমুখে ফিরে চললেন। ইসমাঈলের মাতা তার পিছু পিছু ছুটে আসলেন এবং চিৎকার করে বলতে লাগলেন, হে ইবরাহীম! কোথায় চলে যাচ্ছেন? আর আমাদেরকে রেখে যাচ্ছেন এমন এক ময়দানে, যেখানে না আছে কোন সাহায্যকারী না আছে পানাহারের কোন বস্তু। তিনি বার বার এ কথা বলতে লাগলেন। কিন্ত ইবরাহীম আলাইহিসসালাম সেদিকে ফিরেও তাকালেন না। তখন হাজেরা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, এর আদেশ কি আপনাকে আল্লাহ দিয়েছেন? তিনি জবাব দিলেন, হ্যাঁ। হাজেরা বললেন, তাহলে আল্লাহ আমাদের ধ্বংস ও বরবাদ করবেন না। তারপর তিনি ফিরে আসলেন। ইবরাহীমও সামনে চললেন। শেষ পর্যন্ত যখন তিনি গিরিপথের বাঁকে এসে পৌছলেন, যেখানে স্ত্রী-পুত্র আর তাকে দেখতে পাচ্ছিল না, তখন তিনি কাবা ঘরের দিকে মুখ করে দাঁড়ালেন এবং দু’হাত তুলে এ দোআ করলেনঃ

“হে আমাদের রব ! আমি আমার বংশধরদের কিছু সংখ্যককে বসবাস করালাম অনুর্বর উপত্যকায় আপনার পবিত্র ঘরের কাছে, হে আমাদের রব ! এ জন্যে যে, তারা যেন সালাত কায়েম করে। অতএব আপনি কিছু লোকের অন্তর তাদের প্রতি অনুরাগী করে দিন এবং ফল-ফলাদি দিয়ে তাদের রিযকের ব্যবস্থা করুন, যাতে তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।" তখন ইসমাঈলের মা ইসমাঈলকে দুধ খাওয়াতেন আর নিজে ঐ মশক থেকে পানি পান করতেন। পরিশেষে মশকে যা পানি ছিল তা ফুরিয়ে গেল। তখন তিনি নিজেও তৃষ্ণার্ত হলেন এবং তার শিশুপুত্রটিও পিপাসায় কাতর হয়ে পড়ল। তিনি শিশুর প্রতি দেখতে লাগলেন, শিশুর বুক ধড়ফড় করছে কিংবা বলেছেন, সে জমিনে ছটফট করছে। শিশুপুত্রের দিকে তাকানো তার পক্ষে অসহনীয় হয়ে উঠল। তিনি সরে পড়লেন এবং তাঁর অবস্থানের সংলগ্ন পর্বত সাফা’কেই একমাত্র নিকটতম পর্বত হিসেবে পেলেন তারপর তিনি এর উপর উঠে দাঁড়িয়ে ময়দানের দিকে মুখ করলেন, এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখলেন কাউকে দেখা যায় কি না? কিন্তু না কাউকে তিনি দেখলেন না। তখন দ্রুত সাফা পর্বত থেকে নেমে পড়লেন। যখন তিনি নিচু ময়দানে পৌছলেন তখন আপন কামিজের এক দিক তুলে একজন শ্রান্ত-ক্লান্ত ব্যক্তির ন্যায় দৌড়ে চললেন। শেষে ময়দান অতিক্রম করলেন, মারওয়া পাহাড়ের নিকট এসে গেলেন এবং তার উপর উঠে দাঁড়ালেন। তারপর চারদিকে নজর করলেন, কাউকে দেখতে পান কি না? কিন্তু কাউকে দেখলেন না তিনি অনুরূপভাবে সাতবার করলেন। ... তারপর যখন তিনি শেষবার মারওয়ার পাহাড়ের উপর উঠলেন, একটি আওয়াজ শুনলেন। তখন নিজেকেই নিজে বললেন, একটু অপেক্ষা কর। তিনি কান দিলেন। আবারও শব্দ শুনলেন। তখন বললেন, তোমার আওয়াজ তো শুনছি। যদি তোমার কাছে উদ্ধার করার মত কিছু থাকে আমাকে উদ্ধার কর। অকস্মাৎ তিনি, যমযম যেখানে অবস্থিত সেখানে একজন ফেরেশতাকে দেখতে পেলেন। সে ফেরেশতা আপন পায়ের গোড়ালি দ্বারা আঘাত করলেন। কিংবা তিনি বলেছেন-আপন ডানা দ্বারা আঘাত হানলেন। ফলে (আঘাতের স্থান থেকে) পানি উপচে উঠতে লাগল। হাজেরা এর চার পাশে বাঁধ দিয়ে তাকে হাউযের আকার দান করলেন এবং অঞ্জলি ভরে তার মশকটিতে পানি ভরতে লাগলেন। হাজেরার অঞ্জলি ভরার পরে পানি উছলে উঠতে লাগল। ... তারপর হাজেরা পানি পান করলেন এবং শিশুপুত্রকেও দুধ পান করালেন। তখন ফেরেশতা তাকে বললেন, ধ্বংসের কোন আশংকা আপনি করবেন না। কেননা, এখানেই আল্লাহর ঘর রয়েছে। এই শিশু তার পিতার সাথে মিলে এটি পুনঃ নিৰ্মাণ করবে এবং আল্লাহ তার পরিজনকে কখনও ধ্বংস করবেন না। ঐ সময় বায়তুল্লাহ জমিন থেকে টিলার ন্যায় উচু ছিল। বন্যার পানি আসতো এবং ডান বাম থেকে ভেঙ্গে নিয়ে যেতো।

হাজেরা এভাবেই দিন-যাপন করছিলেন। শেষ পর্যন্ত “জুরহুম” গোত্রের একদল লোক তাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে গেল। কিংবা তিনি বলেছেন, ‘জুরহুম' গোত্রের কিছু লোক ‘কাদা’ এর পথে এ দিক দিয়ে আসছিল। তারা মক্কার নিচুভূমিতে অবতরণ করল এবং দেখতে পেল কতগুলো পাখি চক্রাকারে উড়ছে। তখন তারা বলল, নিশ্চয় এ পাখিগুলো পানির উপরই ঘুরছে। অথচ আমরা এ ময়দানে বহুকাল কাটিয়েছি। কিন্তু কোন পানি এখানে ছিল না। তারপর তারা একজন বা দু'জন লোক সেখানে পাঠাল। তারা গিয়েই পানি দেখতে পেল। ফিরে এসে সবাইকে পানির খবর দিল। সবাই সেদিকে অগ্রসর হলো। বর্ণনাকারী বলেনঃ

ইসমাঈলের মাতা পানির কাছে বসা ছিলেন। তারা তাকে জিজ্ঞেস করল, আমরা আপনার নিকটবর্তী স্থানে বসবাস করতে চাই; আপনি আমাদেরকে অনুমতি দিবেন কি? তিনি জবাব দিলেন, হ্যাঁ, তবে এ পানির উপর তোমাদের কোন অধিকার থাকবে না। তারা হ্যাঁ বলে সম্মতি জানালো।

ইবনে আব্বাস বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, এ ঘটনা ইসমাঈলের মাতার জন্য এক সুবর্ণ সুযোগ এনে দিল, তিনিও মানুষের সাহচর্য কামনা করছিলেন। ফলে আগন্তুক দলটি সেখানে বসতি স্থাপন করলো এবং পরিবার-পরিজনের কাছে খবর পাঠালো, তারাও এসে সেখানে বসবাস শুরু করল। শেষ পর্যন্ত সেখানে তাদের কয়েকটি খান্দান জন্ম নিল। ইসমাঈলও বড় হলেন, তাদের থেকে আরবী শিখলেন। জওয়ান হলে তিনি তাদের অধিক আগ্রহের বস্তু ও প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলেন। যখন তিনি যৌবনপ্রাপ্ত হলেন, তখন তারা তাদেরই এক মেয়েকে তার সঙ্গে বিয়ে দিল। বিয়ের পরে ইসমাঈলের মাতা মারা গেলেন। ... (ইতিমধ্যে ইবরাহীম আলাইহিসসালাম দু’বার এসে ইসমাঈল ও স্ত্রীর খোজ নিলেন এবং এ ব্যাপারে দিক নির্দেশনা দিলেন)

পুনরায় ইবরাহীম আলাইহিসসালাম আল্লাহর ইচ্ছায় কিছু দিন এদের থেকে দূরে রইলেন। এরপর আবার তাদের কাছে আসলেন। ইসমাঈল আলাইহিসসালাম যমযমের কাছে একটি গাছের নীচে বসে নিজের তীর মেরামত করছিলেন। পিতাকে যখন আসতে দেখলেন, দাঁড়িয়ে তার দিকে এগিয়ে গেলেন। অতঃপর একজন পিতা-পুত্রের সঙ্গে সাক্ষাত হলে যা করে তারা তা-ই করলেন।

তারপর ইবরাহীম আলাইহিসসালাম বললেনঃ হে ইসমাঈল। আল্লাহ আমাকে একটি কাজের হুকুম দিয়েছেন। ইসমাঈল আলাইহিসসালাম জবাব দিলেন, আপনার পরওয়ারদিগার আপনাকে যা আদেশ করেছেন তা করে ফেলুন।

ইবরাহীম আলাইহিসসালাম বললেনঃ তুমি আমাকে সাহায্য করবে কি? ইসমাঈল আলাইহিসসালাম বললেন, হ্যাঁ। আমি অবশ্যই আপনার সাহায্য করব ইবরাহীম আলাইহিসসালাম বললেন, আল্লাহ আমাকে এখানে এর চারপাশ ঘেরাও করে একটি ঘর বানানোর নির্দেশ দিয়েছেন। এ বলে তিনি উচু টিলাটির দিকে ইশারা করলেন এবং স্থানটি দেখালেন। তখনি তারা উভয়ে কাবা ঘরের দেয়াল উঠাতে লেগে গেলেন। ইসমাঈল আলাইহিসসালাম পাথর যোগান দিতেন এবং ইবরাহীম আলাইহিসসালাম গাথুনি করতেন। যখন দেয়াল উচু হয়ে গেল, তখন ইসমাঈল আলাইহিসসালাম মাকামে ইবরাহীম নামক মশহুর পাথরটি আনলেন এবং ইবরাহীম আলাইহিসসালামের জন্য তা যথাস্থানে রাখলেন। ইবরাহীম আলাইহিসসালাম এর উপর দাঁড়িয়ে ইমারত নির্মাণ করতে লাগলেন এবং ইসমাঈল তাকে পাথর যোগান দিতে লাগলেন। আর উভয়ে এ দো'আ করতে থাকলেনঃ

“হে আমাদের রব! আমাদের থেকে (এ কাজটুকু) কবুল করুন। নিশ্চয়ই আপনি সবকিছু শুনেন ও জানেন"। আবার তারা উভয়ে ইমারত নির্মাণ করতে লাগলেন। তারা কাবা ঘরের চারদিকে ঘুরছিলেন এবং উভয়ে এ দো'আ করছিলেনঃ

“হে আমাদের প্রভু! আমাদের এ শ্রমটুকু কবুল করে নিন। নিশ্চয়ই আপনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।" (সূরা আল-বাকারাহঃ ১২৭), [বুখারীঃ ৩৩৬৪]

[২] ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ পান যে, দুগ্ধপোষ্য শিশু ও তার জননীকে শুষ্ক প্রান্তরে ছেড়ে আপনি শামে চলে যান, তখন তিনি আবেদন করেছিলেন যে, তাদেরকে ফলমূল দান করুন; যদিও তা অন্য জায়গা থেকে আনা হয়। এ কারণেই মক্কা মুকাররামায় আজ পর্যন্ত চাষাবাদের তেমন ব্যবস্থা না থাকলেও সারা বিশ্বের ফলমূল এত অধিক পরিমাণে সেখানে পৌছে থাকে যে, অন্যান্য অনেক শহরেই সেগুলো পাওয়া দুস্কর।

[৩] এ আয়াতাংশ থেকে কেউ কেউ প্রমাণ নিতে চেষ্টা করেছেন যে, বায়তুল্লাহ শরীফের ভিত্তি ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর পূর্বে স্থাপিত হয়েছিল। কোন কোন মুফাসসির এ আয়াতের এবং বিভিন্ন বর্ণনার ভিত্তিতে বলেনঃ

সর্বপ্রথম আদম 'আলাইহিস সালাম বায়তুল্লাহ নিৰ্মাণ করেন। নূহের মহাপ্লাবনের পর ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে এই ভিত্তির উপরেই বায়তুল্লাহ পূননির্মাণের আদেশ দেয়া হয়। জিবরাঈল আলাইহিস সালাম প্রাচীন ভিত্তি দেখিয়ে দেন। [কুরতুবী] তবে সহীহ কোন দলীল সরাসরি এটা প্রমাণ করে না যে, ইবরাহীম আলাইহিসসালামের পূর্বে কেউ কা'বা ঘর বানিয়েছে। বিভিন্ন দুর্বল বর্ণনায় আদম আলাইহিসসালাম এবং পরবর্তী ধ্বংসপ্রাপ্ত কিছু জাতির

মক্কায় আসার কথা এসেছে, কিন্তু সেগুলো সহীহ হাদীসের বিপরীতে টিকে না। যেখানে সরাসরি সহীহ হাদীসে এসেছে যে, “প্রথম মাসজিদ বাইতুল্লাহিল হারাম তারপর বাইতুল মাকদিস, আর এ দুয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান হলো চল্লিশ বছরের”। [দেখুনঃ মুসলিমঃ ৫২০] ইবরাহীম আলাইহিস সালাম নির্মিত এই প্রাচীর জাহেলিয়াত যুগে বিধ্বস্ত হয়ে গেলে কুরাইশরা তা নতুনভাবে নির্মান করে। এ নির্মাণকাজে আবু তালেবের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও নবুওয়তের পূর্বে অংশগ্রহণ করেন। [মুসলিমঃ ৩৪০] এতে বায়তুল্লাহর বিশেষণ (محرّم) উল্লেখ করা হয়েছে। এর অর্থ সম্মানিতও হতে পারে এবং সুরক্ষিতও। বায়তুল্লাহ শরীফের মধ্যে উভয় বিশেষণই বিদ্যমান। এটি যেমন চিরকাল সম্মানিত, তেমনি চিরকাল শক্রর কবল থেকে সুরক্ষিত। [কুরতুবী]

[৪] ইবরাহীম আলাইহিস সালাম দো'আর প্রারম্ভে পুত্র ও তার জননীর অসহায়তা ও দুর্দশা উল্লেখ করার পর সর্বপ্রথম সালাত কায়েমকারী করার দোআ করেন। ইবন জারীর বলেন, এখানে বায়তুল্লাহকে কেন হারাম বা সম্মানিত/সুরক্ষিত করা হয়েছে তার কারণ বর্ণনা করা হয়েছে আর সেটা হচ্ছে, যাতে মানুষ সেখানে সালাত আদায় করতে সমর্থ হয়। [তাবারী; ইবন কাসীর] তাছাড়া সালাত সবচেয়ে উত্তম ইবাদাত। [আল-বাহরুল মুহীত]এর দ্বারা দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় মঙ্গল সাধিত হয়। যে এ সালাত ঠিকভাবে কায়েম রাখতে পারবে সে দ্বীন কায়েম রাখতে পারবে। [সা'দী] এ থেকে বোঝা গেল যে, পিতা যদি সন্তানকে সালাতের অনুবতী করে দেয়, তবে এটাই সন্তানদের পক্ষে পিতার সর্ববৃহৎ সহানুভূতি ও হিতাকাংখা হবে।

[৫] (اَفْىِٕدَةً) শব্দটি (فؤاد) এর বহুবচন। এর অর্থ অন্তর। এখানে (اَفْىِٕدَةً) শব্দটি (نكرة) এবং তার সাথে (من) অব্যয় ব্যবহার করা হয়েছে, যা (تبعيض) ও (تقليل) এর অর্থে আসে। তাই অর্থ এই যে, কিছু সংখ্যক লোকের অন্তর তাদের দিকে আকৃষ্ট করে দিন। [কুরতুবী ফাতহুল কাদীর] কোন কোন তাফসীরবিদ বলেনঃ যদি এ দো’আয় কিছু সংখ্যক অর্থবোধক অব্যয় ব্যবহার করা না হত; তবে সারা বিশ্বের মুসলিম, অমুসলিম, ইয়াহুদী, নাসারা এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সব মানুষ মক্কায় ভীড় করত, যা তাদের জন্য কষ্টের কারণ হয়ে দাড়াত। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম দো'আয় বলেছেনঃ কিছু সংখ্যক লোকের অন্তর তাদের দিকে আকৃষ্ট করে দিন। যাতে করে শুধু মুসলিমরাই এখানে আসে। [ইবন কাসীর]

[৬] যাতে করে তারা এ ফল-মুল খেয়ে আপনার ইবাদতের জন্য শক্তি লাভ করতে পারে। ইবন কাসীরা আল্লাহ্ তা'আলা এ দোআ কবুল করেছেন। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,

“আমরা কি তাদেরকে এক নিরাপদ হারামে প্রতিষ্ঠিত করিনি, যেখানে সর্বপ্রকার ফলমূল আমদানী হয় আমাদের দেয়া রিযকস্বরূপ" [সূরা আল-কাসাস ৭৫]

এ দোআর প্রভাবেই মক্কা মুকাররামা কোন কৃষিপ্রধান অথবা শিল্পপ্রধান এলাকা না হওয়া সত্বেও সারা বিশ্বের দ্রব্যসামগ্রী এখানে প্রচুর পরিমাণে আমদানী হয়, যা বোধ হয় জগতের অন্য কোন বৃহত্তম শহরেও পাওয়া যায় না। এ দোআর বরকতেই সব যুগে সব ধরনের ফল, ফসল ও অন্যান্য জীবন ধারণ সামগ্রী সেখানে পৌঁছে থাকে। [কুরতুবী]

(৭) এতে ইঙ্গিত করেছেন যে, সন্তানদের জন্য আর্থিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দোআ এ কারণে করা হয়েছে, যাতে তারা কৃতজ্ঞ হয়ে কৃতজ্ঞতার সওয়াবও অর্জন করে। এভাবে সালাতের অনুবর্তিতা দ্বারা দোআ শুরু করে কৃতজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে শেষ করা হয়েছে। মাঝখানে আর্থিক সুখ-শান্তির প্রসঙ্গ আনা হয়েছে। এতে শিক্ষা রয়েছে যে, মুসলিমের এরূপই হওয়া উচিত। তার ক্রিয়াকর্ম, ধ্যান-ধারণার উপর আখেরাতের কল্যাণ চিন্তা প্রবল থাকা দরকার এবং সংসারের কাজ ততটুকুই করা উচিত, যতটুকু নেহায়েত প্রয়োজন।

১৪ : ৩৮
رَبَّنَا إِنَّكَ تَعْلَمُ مَا نُخْفِي وَمَا نُعْلِنُ ۗ وَمَا يَخْفَىٰ عَلَى اللَّهِ مِنْ شَيْءٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ

‘হে আমাদের রব! আপনি তো জানেন যা আমরা গোপন করি ও যা আমরা প্রকাশ করি; আর কোন কিছুই আল্লাহ্‌র কাছে গোপন নেই, না যমীনে না আসমানে [১]।

ফুটনোট

[১] এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলার সর্বব্যাপী জ্ঞানের প্রসঙ্গ টেনে দো’আ সমাপ্ত করা হয়েছে। অর্থ এই যে, আপনি আমার আন্তরিক অবস্থা ও বাহ্যিক আবেদন নিবেদন সবকিছু সম্পর্কে ওয়াকিফহাল। আপনি আমার এ দো’আর উদ্দেশ্য ভাল করেই জানেন। আপনি জানেন যে, আমি এ দো’আ দ্বারা কেবল আপনার জন্য ইখলাস ও সন্তুষ্টিই কামনা করছি। [তাবারী; ইবন কাসীর] ‘আন্তরিক অবস্থা’ বলতে ঐ দুঃখ, মনোবেদনা ও চিন্তা-ভাবনা বোঝানো হয়েছে, যা একজন দুগ্ধপোষ্য শিশু ও তার জননীকে উন্মুক্ত প্রান্তরে নিঃসম্বল, ফরিয়াদরত অবস্থায় ছেড়ে আসা এবং তাদের বিচ্ছেদের কারণে স্বাভাবিকভাবে দেখা দিয়েছিল। [কুরতুবী] আর ‘বাহ্যিক আবেদন-নিবেদন' বলে স্পষ্টত:

ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর দো’আই বোঝানো হয়েছে। আয়াতের শেষে আল্লাহ্ তা'আলার জ্ঞানের বিস্তৃতি বর্ণনা করে বলা হয়েছে যে, আমাদের বাহ্যিক ও আন্তরিক অবস্থাই কেন বলি, সমস্ত ভূ-মণ্ডল ও নভোমণ্ডলে কোন অবস্থাই তাঁর অজ্ঞাত নয়। অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমি মুখে যা কিছু বলছি তা আপনি শুনছেন এবং যেসব আবেগ-অনুভূতি আমার হৃদয় অভ্যন্তরে লুকিয়ে আছে তাও আপনি জানেন।

১৪ : ৩৯
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي وَهَبَ لِي عَلَى الْكِبَرِ إِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ ۚ إِنَّ رَبِّي لَسَمِيعُ الدُّعَاءِ

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্‌রই, যিনি আমাকে আমার বার্ধক্যে ইসমা’ঈল ও ইসহাককে দান করেছেন। নিশ্চয় আমার রব দো’আ শ্রবণকারী [১]।

ফুটনোট

[১] এ আয়াতের বিষয়বস্তুও পূর্ববতী দো'আর পরিশিষ্ট। কেননা, দো'আর অন্যতম শিষ্টাচার হচ্ছে দো'আর সাথে সাথে আল্লাহ তা'আলার প্রশংসা ও গুণ বর্ণনা করা। ইবরাহীম 'আলাইহিস সালাম এস্থলে বিশেষভাবে আল্লাহ তা'আলার একটি নেয়ামতের শোকর আদায় করেছেন, নেয়ামতটি এই যে, ঘোর বার্ধক্যের বয়সে আল্লাহ তা'আলা তার দো'আ কবুল করে তাকে সুসন্তান ইসমাঈল ও ইসহাক দান করেছেন। এ প্রশংসা বর্ণনায় এদিকেও ইঙ্গিত রয়েছে যে, নিঃসঙ্গ ও নিঃসহায় অবস্থায় জনশূন্য প্রান্তরে পরিত্যক্ত শিশুটি আপনারই দান। আপনিই তার হেফাযত করুন। অবশেষে

(اِنَّ رَبِّيْ لَسَمِيْعُ الدُّعَاءِ)

বলে প্রশংসা বর্ণনা সমাপ্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ নিশ্চয় আমার রব দো’আ শ্রবণকারী তথা কবুলকারী।

১৪ : ৪০
رَبِّ اجْعَلْنِي مُقِيمَ الصَّلَاةِ وَمِنْ ذُرِّيَّتِي ۚ رَبَّنَا وَتَقَبَّلْ دُعَاءِ

‘হে আমার রব! আমাকে সালাত কয়েমকারী করুন এবং আমার বংশধরদের মধ্য হতেও। হে আমাদের রব! আর আমার দো’আ কবূল করুন [১]।

ফুটনোট

[১] প্রশংসা বর্ণনার পর আবার দো’আয় মশগুল হয়ে যানঃ

(رَبِّ اجْعَلْنِيْ مُقِيْمَ الصَّلٰوةِ وَمِنْ ذُرِّيَّتِيْ رَبَّنَا وَتَقَبَّلْ دُعَاءِ)

এতে নিজের জন্য ও সন্তানদের জন্য সালাত কায়েম রাখার দো’আ করেন। অতঃপর কাকুতি-মিনতি সহকারে আবেদন করেন যে, হে আমার পালনকর্তা! আমার দো’আ কবুল করুন। এখানে সালাতে কায়েম রাখার অর্থ, সালাতের হিফাযতকারী এবং এর সীমারেখা যথাযথভাবে কায়েম করা বুঝানো হয়েছে। [ইবন কাসীর]

১৪ : ৪১
رَبَّنَا اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ يَقُومُ الْحِسَابُ

‘হে আমার রব! যেদিন হিসেব অনুষ্ঠিত হবে সেদিন আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে এবং মুমিনদেরকে ক্ষমা করুন [১]।’

ফুটনোট

[১] সবশেষে একটি ব্যাপক অর্থবোধক দো’আ করলেন,
‘হে আমার রব! আমাকে আমার পিতা-মাতাকে এবং সব মুমিনকে ক্ষমা করুন ঐদিন, যেদিন হাশরের ময়দানে সারাজীবনের কাজকর্মের হিসাব নেয়া হবে। এতে তিনি মাতা-পিতার জন্যও মাগফেরাতের দো'আ করেছেন। অথচ পিতা অর্থাৎ আযর যে কাফের ছিল, তা কুরআনুল কারীমেই উল্লেখিত রয়েছে। সম্ভবতঃ এ দো’আটি তখন করেছেন, যখন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-কে কাফেরদের জন্য দো’আ করতে নিষেধ করা হয়নি। [ইবন কাসীর]

১৫ : ৯৮
فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَكُنْ مِنَ السَّاجِدِينَ

কাজেই আপনি আপনার রবের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন এবং আপনি সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হোন [১];

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ এ আয়াত থেকে আরও জানা গেল যে, কেউ যদি শত্রুর অন্যায় আচরণে মনে কষ্ট পায় এবং হতোদ্যম হয়ে পড়ে, তবে এর আত্মিক প্রতিকার হচ্ছে আল্লাহ তা'আলার তাসবীহ ও ইবাদাতে মশগুল হয়ে যাওয়া। আল্লাহ তা'আলা স্বয়ং তার কষ্ট দূর করে দেবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা-ই করতেন। হাদীসে এসেছে, “যখনই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন কাজে সমস্যা অনুভব করতেন তখনই সালাতে দাঁড়িয়ে যেতেন" [আবুদাউদঃ ১৩১৯, মুসনাদে আহমাদঃ ৫/৩৮৮]

অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “আল্লাহ্ তা'আলা বলেনঃ হে আদম সন্তান! দিনের প্রারম্ভে চার রাকাআত সালাত আদায়ে অপারগ হয়ো না। কারণ এতে করে আমি তোমাকে শেষ পর্যন্ত যথেষ্ট করব।” [আবু দাউদঃ ১২৮৯, মুসনাদে আহমাদঃ ৫/২৮৬]

১৬ : ৪৮
أَوَلَمْ يَرَوْا إِلَىٰ مَا خَلَقَ اللَّهُ مِنْ شَيْءٍ يَتَفَيَّأُ ظِلَالُهُ عَنِ الْيَمِينِ وَالشَّمَائِلِ سُجَّدًا لِلَّهِ وَهُمْ دَاخِرُونَ

তারা কি লক্ষ্য করে না আল্লাহ্‌র সৃষ্ট বস্তুর প্রতি, যার ছায়া [১] ডানে ও বামে ঢলে পড়ে একান্ত অনুগত হয়ে আল্লাহ্‌র প্রতি সিজদাবনত হয়?

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ দেহ বিশিষ্ট সমস্ত জিনিসের ছায়া থেকে এ আলামতই জাহির হচ্ছে যে, পাহাড়-পর্বত, গাছ-পালা, জন্তু-জানোয়ার বা মানুষ সবাই একটি বিশ্বজনীন আইনের শৃংখলে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতার ক্ষেত্রে কারোর সামান্যতম অংশও নেই। কোন জিনিসের ছায়া থাকলে বুঝতে হবে, সেটি একটি জড় বস্তু। আর জড় বস্তু হওয়ার অর্থ হলো, সেটি একটি সৃষ্টি এবং সৃষ্টিকর্তার অনুগত গোলাম। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। ছায়ার সিজদা সংক্রান্ত আলোচনা এর পূর্বে সূরা আর-রাদের ১৫ নং আয়াতে করা হয়েছে।

১৬ : ৪৯
وَلِلَّهِ يَسْجُدُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ مِنْ دَابَّةٍ وَالْمَلَائِكَةُ وَهُمْ لَا يَسْتَكْبِرُونَ

আর আল্লাহ্‌কেই সিজদা করে যা কিছু আছে আসমানসমূহে ও যমীনে, যত জীবজন্তু আছে সেসব এবং ফিরিশতাগণও, তারা অহংকার করে না।
ফুটনোট

১৭ : ৭৮
أَقِمِ الصَّلَاةَ لِدُلُوكِ الشَّمْسِ إِلَىٰ غَسَقِ اللَّيْلِ وَقُرْآنَ الْفَجْرِ ۖ إِنَّ قُرْآنَ الْفَجْرِ كَانَ مَشْهُودًا

সূর্য হেলে পড়ার পর থেকে রাতের ঘন অন্ধকার পর্যন্ত সালাত কায়েম করুন [১] এবং ফজরের সালাত [২]। নিশ্চয় ফজরের সালাত উপস্থিতির সময় [৩]

ফুটনোট

নবম রুকু’

[১] আলোচ্য আয়াতসমূহে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সময় মত সালাত কায়েম করার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। [ইবন কাসীর] পূর্বের আয়াতসমূহে আল্লাহ সংক্রান্ত আকীদা, আখেরাতের জন্য পুনরুত্থান ও প্রতিফল বিষয়াদি বর্ণিত হয়েছে। এখানে সবচেয়ে উত্তম ইবাদাত সম্পর্কে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। [ফাতহুল কাদীর] পর্বত সমান সমস্যা ও সংকটের আলোচনা করার পর পরই সালাত কায়েম করার হুকুম দেয়ার মাধ্যমে মহান সর্বশক্তিমান আল্লাহ এ মর্মে একটি সূক্ষ্ম ইঙ্গিত করেছেন যে, এ অবস্থায় একজন মুমিনের জন্য যে অবিচলতার প্রয়োজন হয় তা সালাত কায়েমের মাধ্যমেই অর্জিত হতে পারে। শক্ৰদের দুরভিসন্ধি ও উৎপীড়ন থেকে আত্মরক্ষার উত্তম প্রতিকার হচ্ছে সালাত কায়েম করা। সূরা হিজারের আয়াতে আরও স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছেঃ “আমি জানি যে, কাফেরদের পীড়াদায়ক কথাবার্তা শুনে আপনার অন্তর সংকুচিত হয়ে যায়। অতএব আপনি আপনার পালনকর্তার প্রশংসা দ্বারা তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন এবং সেজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান।” [৯৭-৯৮] এ আয়াতে আল্লাহর যিকর, প্রশংসা, তসবীহ ও সালাতে মশগুল হয়ে যাওয়াকে শক্ৰদের উৎপীড়নের প্রতিকার সাব্যস্ত করা হয়েছে। আল্লাহর যিকর ও সালাত বিশেষভাবে এ থেকে আত্মরক্ষার প্রতিকার। এ ব্যাখ্যাও অবাস্তব নয় যে, শক্ৰদের উৎপীড়ন থেকে আত্মরক্ষা করা আল্লাহর সাহায্যের উপর নির্ভরশীল এবং আল্লাহর সাহায্য লাভ করার উত্তম পন্থা হচ্ছে সালাত। যেমন কুরআন পাক বলেঃ “সবর ও সালাত দ্বারা সাহায্য প্রার্থনা কর। ” [সূরা আল-বাকারাহঃ ৪৫]

[২] আয়াতে قرآن শব্দ এসেছে, যার অর্থঃ পড়া। আরও এসেছে فجر শব্দ, "ফজর’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, ভোর হওয়া বা প্ৰভাতের উদয় হওয়া। অর্থাৎ একেবারে সেই প্রথম লগ্নটি যখন প্ৰভাতের শুভ্ৰতা রাতের আধার চিরে উকি দিতে থাকে। তাই এ শব্দদ্বয়ের অর্থ দাঁড়ায়, ফজরের কুরআন পাঠ। কুরআন মজীদে সালাতের প্রতিশব্দ হিসেবে সালাতের বিভিন্ন অংশের মধ্য থেকে কোন একটির নাম নিয়ে সমগ্ৰ সালাতটি ধরা হয়েছে। যেমন তাসবীহ, যিকির, হামদ(প্ৰশংসা), কিয়াম (দাঁড়ানো) রুকূ, সিজদাহ ইত্যাদি। এখানে قرآن শব্দ বলে সালাত বোঝানো হয়েছে। কেননা, কুরআন পাঠ নামায্যের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কাজেই আয়াতের দ্বারা ফজরের সালাতকেই বুঝানো হয়েছে। [ফাতহুল কাদীর]

অধিকাংশ তাফসীরবিদদের মতে এ আয়াতটি পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের জন্যে একটি পূর্ণাঙ্গ নির্দেশ। কেননা, دلوك শব্দের অর্থ আসলে ঝুকে পড়া। সূর্যের ঝুকে পড়া তখন শুরু হয়, যখন সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ে, সূর্যাস্তকেও دلوك বলা যায়। কিন্তু অধিকাংশ সাহাবী ও তাবেয়ীগণ এস্থলে শব্দের অর্থ সূর্যের ঢলে পড়াই নিয়েছেন। আর غسق শব্দের অর্থ রাত্রির অন্ধকার সম্পূর্ণ হয়ে যাওয়া। এভাবে

أَقِمِ الصَّلَاةَ لِدُلُوكِ الشَّمْسِ إِلَىٰ غَسَقِ اللَّيْلِ وَقُرْآنَ الْفَجْرِ ۖ

এর মধ্যে চারটি সালাত এসে গেছেঃ যোহর, আসর, মাগরিব ও এশা। এর পরবর্তী বৰ্ণনা الْفَجْرِ قُرْآنَ দ্বারা ফজরের সালাতকে বুঝানো হয়েছে। এ আয়াতে সংক্ষেপে মি'রাজের সময় যে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করা হয়েছিল তার সময়গুলো কিভাবে সংগঠিত ও বিন্যস্ত করা হবে তা বলা হয়েছে। নির্দেশ দেয়া হয়েছে, একটি সালাত পড়ে নিতে হবে সূর্যোদয়ের আগে। আর বাকি চারটি সালাত সূর্য ঢলে পড়ার পর থেকে নিয়ে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত পড়ে নিতে হবে। তারপর এ হুকুমটি ব্যাখ্যা করার জন্য জিবরীল আলাইহিস সালামকে পাঠানো হয়েছে। তিনি এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নামাযগুলোর সঠিক সময়ের শিক্ষা দান করেছেন। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “জিবরীল দু’বার আমাকে বায়তুল্লাহর কাছাকাছি জায়গায় সালাত পড়ান। প্রথম দিন যোহরের সালাত ঠিক এমন সময় পড়ান যখন সূর্য সবেমাত্র হেলে পড়েছিল এবং ছায়া জুতার একটি ফিতার চাইতে বেশী লম্বা হয়নি। তারপর আসরের সালাত পড়ান এমন এক সময় যখন প্রত্যেক জিনিসের ছায়া তার দৈর্ঘ্যের সমপরিমাণ ছিল। এরপর মাগরিবের সালাত এমন সময় পড়ান যখন রোযাদার রোযার ইফতার করে। তারপর পশ্চিমাকাশের লালিমা খতম হবার পরপরই এশার সালাত পড়ান। আর ফজরের সালাত পড়ান। ঠিক যখন রোযাদারের উপর খাওয়া দাওয়া হারাম হয়ে যায় তেমনি সময়। দ্বিতীয় দিন তিনি আমাকে যোহরের সালাত এমন সময় পড়ান যখন প্রত্যেক জিনিসের ছায়া তার দৈর্ঘ্যের সমান ছিল। আসরের সালাত পড়ান এমন সময় যখন প্রত্যেক জিনিসের ছায়া তার দৈর্ঘের দ্বিগুণ ছিল। মাগরিবের সালাত পড়ান এমন সময় যখন সাওমপালনকারী সাওমের ইফতার করে। এশার সালাত পড়ান এমন সময় যখন রাতের তিনভাগের একভাগ অতিক্রান্ত হয়ে গেছে এবং ফজরের সালাত পড়ান আলো চারদিকে ভালভাবে ছড়িয়ে পড়ার পর। তারপর জিব্রীল আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলেন, হে মুহাম্মাদ! এই হচ্ছে নবীদের সালাত আদায়ের সময় এবং এ দু'টি সময়ের মাঝখানেই হচ্ছে সালাতের সঠিক সময়। ” [তিরমিয়ীঃ ১৫৯, আবুদাউদঃ ৩৯৩]

কুরআন মজীদের বিভিন্ন জায়গায়ও পাঁচ সালাতের এ ওয়াক্তসমূহের প্রতি ইংগিত করা হয়েছে। যেমন সূরা হূদে বলা হয়েছেঃ “সালাত কায়েম করো দিনের দুই প্রান্তে (অর্থাৎ ফজর ও মাগরিব) এবং কিছু রাত পার হয়ে গেলে (অর্থাৎ এশা)। [১১৪] সূরা ‘ত্বা-হা’য়ে বলা হয়েছেঃ “আর নিজের রবের হামদ (প্রশংসা) সহকারে তাঁর তাসবীহ (পবিত্রতা বর্ণনা) করতে থাকো সূর্যোদয়ের পূর্বে (ফজর) ও সূর্যাস্তের পূর্বে (আসর) এবং রাতের সময় আবার তাসবীহ করো (এশা) আর দিনের প্রান্তসমূহে (অর্থাৎ সকাল, যোহর ও মাগরিব)”। [১৩০] তারপর সূরা রূমে বলা হয়েছেঃ “কাজেই আল্লাহর তাসবীহ করো যখন তোমাদের সন্ধ্যা হয় (মাগরিব) এবং যখন সকাল হয় (ফজর)। তাঁরই জন্য প্রশংসা আকাশসমূহে ও পৃথিবীতে এবং তাঁর তাসবীহ করো দিনের শেষ অংশে (আসর) এবং যখন তোমাদের দুপুর (যোহর) হয়। "[১৭-১৮] তবে যদিও আলোচ্য আয়াতসমূহে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের নির্দেশই সংক্ষেপে বৰ্ণিত হয়েছে কিন্তু এর পূর্ণ তাফসীর ও ব্যাখ্যা কেবলমাত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা ও কাজের মাধ্যমেই সাব্যস্ত হয়েছে। [ইবন কাসীর] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাখ্যা গ্ৰহণ না করা পর্যন্ত কোন ব্যক্তি সালাত আদায়ই করতে পারে না। জানি না, যারা কুরআনকে হাদীস ও রাসূলের বর্ণনা ছাড়াই বোঝার দাবী করে, তারা সালাত কিভাবে পড়ে? এমনিভাবে এ আয়াতে সালাতে কুরআন পাঠের কথাও সংক্ষেপে উল্লেখিত হয়েছে। এর বিবরণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা ও কাজ দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে।

[৩] مشهو د শব্দটি شهد ধাতু থেকে উদ্ভূত। এর অর্থ উপস্থিত হওয়া। হাদীসসমূহের বর্ণনা অনুযায়ী এ সময় দিবা-রাত্রির উভয় দল ফেরেশতা সালাতে উপস্থিত হয়। তাই একে مشهو د বলা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “রাতের ফেরেশতা এবং দিনের ফেরেশতাগণ এ সময় উপস্থিত হয়। ” [তিরমিয়ী ৩১৩৫]

অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ "জামাতের সালাতের ফযীলত একাকী সালাতের চেয়ে পচিশ গুণ বেশী। রাতের ফেরেশতা এবং দিনের ফেরেশতাগণ ফজরের সালাতে একত্রিত হন। " [বুখারীঃ ৬৪৮, মুসলিমঃ ৬৪৯]

১৭ : ৭৯
وَمِنَ اللَّيْلِ فَتَهَجَّدْ بِهِ نَافِلَةً لَكَ عَسَىٰ أَنْ يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَحْمُودًا

আর রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ [১] আদায় করুন, এটা আপনার জন্য অতিরিক্ত [২]। আশা করা যায় আপনার রব আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন প্রশংসিত স্থানে [৩]।

ফুটনোট

[১] تهجد শব্দটি নিদ্ৰা যাওয়া ও জাগ্রত হওয়া এই পরস্পর বিরোধী দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়। [ফাতহুল কাদীর] আয়াতের অর্থ এই যে, রাত্রির কিছু অংশে কুরআন পাঠসহ জাগ্রত থাকুন। কেননা به এর সর্বনাম দ্বারা কুরআন বোঝানো হয়েছে। [ফাতহুল কাদীর] আর কুরআন পাঠসহ জাগ্রত থাকার অর্থ সালাত পড়া। এ কারণেই শরীআতের পরিভাষায় রাত্রিকালীন সালাতকে “তাহাজ্জুদ” বলা হয়। সাধারণতঃ এর অর্থ, এরূপ নেয়া হয় যে কিছুক্ষণ নিদ্ৰা যাওয়ার পর যে সালাত পড়া হয় তাই তাহাজ্জুদের সালাত। হাসান বসরী বলেনঃ এশার পরে পড়া হয় এমন প্রত্যেক সালাতকে তাহাজ্জুদ বলা যায়। [ইবন কাসীর] তবে প্রচলিত পদ্ধতির কারণে কিছুক্ষণ নিদ্ৰা যাওয়ার পর পড়ার অর্থেই অনেকে তাহাজ্জুদ বুঝে থাকেন। সাধারণতঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম শেষ রাত্রে জাগ্রত হয়ে তাহাজ্জুদের সালাত পড়তেন। তাই এভাবে পড়াই উত্তম হবে। তাহাজ্জুদের সালাতের ব্যাপারে বহু হাদীসে অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। এক হাদীসে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “রমযানের সাওমের পর সবচেয়ে উত্তম হলো আল্লাহর মাস মুহররামের সাওম আর ফরয সালাতের পর সবচেয়ে উত্তম সালাত হলো, রাতের সালাত”। [মুসলিমঃ ১১৬৩]

[২] نافلة শব্দের আভিধানিক অর্থ অতিরিক্ত। এ কারণেই যেসব সালাত, দান-সদকা ওয়াজিব ও জরুরী নয়- করলে সওয়াব পাওয়া যায় এবং না করলে গোনাহ নাই, সেগুলোকে নফল বলা হয়। আয়াতে নামাযে তাহাজ্জুদের সাথে نافلة শব্দ সংযুক্ত হওয়ায় এটাই বোঝা যায় যে, তাহাজ্জুদের সালাত বিশেষভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর জন্যে নফল। অথচ সমগ্র উম্মতের জন্যেও নফল। এজন্যেই কোন কোন তফসীরবিদ এখানে نافلة শব্দটিকে উম্মতের ওপর তো শুধু পাঁচ ওয়াক্ত সালাতই ফরয; কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর তাহাজ্জুদও একটি অতিরিক্ত ফরয। অতএব, এখানে نافلة শব্দের অর্থ অতিরিক্ত ফরয। নফলের সাধারণ অর্থে নয়। [তাবারী] আবার কোন কোন মুফাসসির বলেন, এখানে نافلة শব্দটি তার সাধারণ অর্থ অতিরিক্ত অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে, তখন অর্থ হবেঃ আপনার যাবতীয় পূর্ব ও পরের গুণাহ মাফ হয়ে যাওয়ার কারণে আপনার জন্য তাহাজ্জুদের সালাত অতিরিক্তই রয়ে গেল। [ইবন কাসীর] আপনার উম্মাতের জন্য সেটার প্রয়োজনীয়তা হলো, গোনাহ মাফ পাওয়া। কিন্তু আপনার জন্য তা মর্যাদা বৃদ্ধি কারক। কিন্তু নফল হওয়া সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাহাজ্জুদ ত্যাগ করতেন না। এ ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন যে,

أَفَلا أَكُونُ عَبْداً شكُوراً

অর্থাৎ “আমি কি কৃতজ্ঞ বান্দা হবো না? [মুসলিমঃ ২৮১৯]

[৩] আলোচ্য আয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মাকামে মাহমুদের ওয়াদা দেয়া হয়েছে। মাকামে মাহমুদ শব্দদ্বয়ের অর্থ, প্রশংসনীয় স্থান। এই মাকাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্যেই বিশেষভাবে নির্দিষ্ট-অন্য কোন নবীর জন্যে নয়। এর তাফসীর প্রসঙ্গে বিভিন্ন উক্তি বর্ণিত আছে। সহীহ হাদীস সমূহে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত আছে যে, এ হচ্ছে “বড় শাফা আতের মাকাম”। [ফাতহুল কাদীর]। হাশরের ময়দানে যখন সমগ্ৰ মানব জাতি একত্রিত হবে এবং প্রত্যেক নবীর কাছেই শাফাআতের দরখাস্ত করবে, তখন সব নবীই শাফা’আত করতে অপারগতা প্রকাশ করবেন। তখন কেবল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামাই সমগ্ৰ মানবজাতির জন্যে শাফাআত করবেন। এ সম্পর্কে দিন লোকেরা দলে দলে বিভক্ত হবে। প্রত্যেক উম্মত তার নিজের নবীর কাছে যাবে। তারা বলবে, হে অমুক (নবী)!! আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য শাফা’আত করুন। হে অমুক (নবী)!! আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য শাফা’আত করুন। (কিন্তু তারা কেউ শাফা’আত করতে রাযী হবেন না)। শেষ পর্যন্ত শাফা’আতের দায়িত্ব এসে পড়বে নবী (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর উপর। আর এই দিনেই আল্লাহ তাকে মাকামে মাহমুদে দাঁড় করাবেন। [বুখারীঃ ৪৭১৮]

অপর এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি আযান শুনার পর বলবে “আল্লাহুম্মা রাব্বা হাযিহিদ দাওয়াতিত তাম্মাতি ওয়াস সালাতিল কায়েমাহ, আতি মুহাম্মদানিল ওয়াসিলাতা ওয়াল ফাদীলাহ ওয়াব’আসাহু মাকামাম মাহমুদানিল্লাযী ওয়াদতাহ্” তার জন্য আমার শাফা’আত হালাল হয়ে যাবে। [বুখারীঃ ৪৭১৯]

অন্য এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত তিনি এ আয়াতে مَقامٌ مَحْمُود “মাকামে মাহমুদ তথা প্রশংসিত স্থান” সম্পর্কে বলেছেনঃ “এটা সে স্থান যেখান থেকে আমি আমার উম্মাতের জন্য শাফা’আত করব। ” [মুসনাদে আহমাদঃ ২/৪৪১, ৫২৮]

১৭ : ৮০
وَقُلْ رَبِّ أَدْخِلْنِي مُدْخَلَ صِدْقٍ وَأَخْرِجْنِي مُخْرَجَ صِدْقٍ وَاجْعَلْ لِي مِنْ لَدُنْكَ سُلْطَانًا نَصِيرًا

আর বলুন, ‘হে আমার রব! আমাকে প্রবেশ করার সত্যতার সাথে এবং আমাকে বের করান সত্যতার সাথে [১] এবং আপনার কাছ থেকে আমাকে দান করুন সাহায্যকারী শক্তি। ’

ফুটনোট

[১] উপরোক্ত অনুবাদটি বাগভীর অনুকরণে করা হয়েছে। অন্য অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর সন্তোষ যেভাবে হয় সেভাবে প্রবেশ করানো এবং আল্লাহর সন্তোষ যাতে রয়েছে সেভাবে বের করা। মূলত: مدخل ও خحرج এর অর্থ প্রবেশ করার স্থান ও বহিগর্মনের স্থান। উভয়ের সাথে صدق বিশ্লেষণ যুক্ত হওয়ার অর্থ এই যে, এই প্রবেশ ও বহিগর্মন সব আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী উত্তম পন্থায় হোক। কেননা, আরবী ভাষায় صدق এমন কাজের জন্যে ব্যবহৃত হয়, যা বাহ্যতঃ ও আভ্যন্তরীন উভয় দিক দিয়ে সঠিক ও উত্তম হবে। কোন কোন মুফাসসির বলেনঃ এখানে ‘প্ৰবেশ করার স্থান’ বলে মদীনা এবং ‘বহিৰ্গমনের স্থান’ বলে মক্কা বোঝানো হয়েছে। [তাবারী] উদ্দেশ্য এই যে, হে আল্লাহ, মদীনায় আমার প্রবেশ উত্তমভাবে সম্পন্ন হোক। সেখানে কোন অগ্ৰীতিকর ঘটনা যেন না ঘটে এবং মক্কা থেকে আমার বের হওয়া উত্তমভাবে সম্পন্ন হোক। এই তাফসীরটি অনেক তাবেয়ীন থেকে বর্ণিত হয়েছে।

১৭ : ৮১
وَقُلْ جَاءَ الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ ۚ إِنَّ الْبَاطِلَ كَانَ زَهُوقًا

আর বলুন, ‘হক এসেছে ও বাতিল বিলুপ্ত হয়েছে; ‘নিশ্চয় বাতিল বিলুপ্ত হওয়ারই ছিল [১]।

ফুটনোট

[১] এ আয়াতটি হিজরতের পর মক্কা বিজয়ের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উচ্চারণ করেছিলেন। ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মক্কায় প্রবেশ করেন, তখন বায়তুল্লাহর চতুর্পার্শ্বে তিনশ ষাটটি মূর্তি স্থাপিত ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সেখানে পৌঁছেন, তখন তাঁর মুখে এ আয়াতটি উচ্চারিত হচ্ছিল, এবং তিনি স্বীয় ছড়ি দ্বারা প্রত্যেক মূর্তির বক্ষে আঘাত করে যাচ্ছিলেন। [বুখারীঃ ২৪৭৮, ৪৭২০, মুসলিমঃ ১৭৮১] সুতরাং সত্য প্রতিষ্ঠিত হলে মিথ্যা অপসৃত হবেই। অন্য আয়াতে আল্লাহ তা'আলা বলেন, “কিন্তু আমি সত্য দ্বারা আঘাত হানি মিথ্যার উপর; ফলে তা মিথ্যাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয় এবং তৎক্ষণাৎ মিথ্যা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। [সূরা আল-আম্বিয়াঃ ১৮]

আরো বলেন, “বলুন, ‘সত্য এসেছে এবং অসত্য না পারে নূতন কিছু সৃজন করতে, আর না পারে পুনরাবৃত্তি করতে’ । [সূরা সাবাঃ ৪৯]

আরো বলেনঃ “আল্লাহ মিথ্যাকে মুছে দেন এবং নিজ বাণী দ্বারা সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেন। অন্তরে যা আছে সে বিষয়ে তিনি তো সবিশেষ অবহিত ”। [সূরা আশ-শূরাঃ ২৪]

১৭ : ১১০
قُلِ ادْعُوا اللَّهَ أَوِ ادْعُوا الرَّحْمَٰنَ ۖ أَيًّا مَا تَدْعُوا فَلَهُ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَىٰ ۚ وَلَا تَجْهَرْ بِصَلَاتِكَ وَلَا تُخَافِتْ بِهَا وَابْتَغِ بَيْنَ ذَٰلِكَ سَبِيلًا

বলুন, ‘তোমরা ‘আল্লাহ্’ নামে ডাক বা ‘রহমান’ নামে ডাক, তোমরা যে নামেই ডাক সকল সুন্দর নামই তো তাঁর। আর আপনি সালাতে স্বর খুব উচ্চ করবেন না আব্র খুব ক্ষীণও করবেন না; বরং এ দুয়ের মধ্যপথ অবলম্বন করুন [১]।

ফুটনোট

[১] এ আয়াত নাযিল হওয়ার কারণ হিসেবে এসেছে যে, মক্কায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সালাতে উঁচুস্বরে তেলাওয়াত করতেন, তখন মুশরিকরা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করত এবং কুরআন, জিবরাঈল ও স্বয়ং আল্লাহ্ তাআলাকে উদ্দেশ্য করে ধৃষ্টতাপূর্ণ কথাবার্তা বলত এর জওয়াবে আয়াতের শেষাংশ অবতীর্ণ হয়েছে। [বুখারীঃ ৪৭২২, মুসলিমঃ ৪৪৬] এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সশব্দ ও নিঃশব্দ উভয়ের মধ্যবতী পন্থা অবলম্বন করার শিক্ষা দেয়া হয়েছে। কেননা, মধ্যবতীর্ণ শব্দে পাঠ করলেই প্রয়োজন পূর্ণ হয়ে যেত এবং সশব্দে পাঠ করলে মুশরিকরা নিপীড়নের যে সুযোগ পেত, তা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

কোন কোন মুফাসসির বলেন, এ আয়াতে সালাতে কুরআন তেলাওয়াতের আদব বর্ণনা করে বলা হয়েছে যে, খুব উচ্চঃস্বরে না হওয়া চাই এবং এমন নিঃশব্দেও না হওয়া চাই যে, মুক্তাদীরা শুনতে পায় না। বলাবাহুল্য এ বিধান বিশেষ করে সশব্দে পঠিত সালাতসমূহের জন্যে। যোহর ও আসরের নামাযে নিঃশব্দে পাঠ করা মুতাওয়াতির হাদীস দ্বারা প্রমাণিত । জাহরী বা উচ্চঃস্বরে পড়তে হয় এমন সালাত বলতে ফজর, মাগরিব ও এশার সালাত বোঝায়। তাহাজ্জুদের সালাতও এর অন্তর্ভুক্ত। যেমন, এক হাদীসে রয়েছে, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাহাজ্জুদের সময় আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ও ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু – এর কাছ দিয়ে গেলে আবু বকরকে নিঃশব্দে এবং ওমরকে উচ্চঃস্বরে তেলাওয়াতরত দেখতে পান। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বকর রাদি'আল্লাহু আনহু – কে বললেনঃ আপনি এত নিঃশব্দে তেলাওয়াত করেন কেন? তিনি আরয করলেনঃ যাকে শোনানো উদ্দেশ্য তাকে শুনিয়ে দিয়েছি। আল্লাহ্ তা'আলা গোপনতম আওয়াযও শ্রবণ করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ সামান্য শব্দ সহকারে পাঠ করুন। অতঃপর ওমরকে বললেনঃ আপনি এত উচ্চঃস্বরে তেলাওয়াত করেন কেন? তিনি আরয করলেনঃ আমি নিদ্রা ও শয়তানকে বিতাড়িত করে দেয়ার জন্যে উচ্চঃস্বরে পাঠ করি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে আদেশ দিলেন, যে একটু অনুচ্চ শব্দে পাঠ করুন। [তিরমিয়ীঃ ৪৪৭] তবে তাহাজুদের সালাতে ইচ্ছা করলে কেরাত উচ্চস্বরে পড়তে পারে আবার ইচ্ছা করলে নিচুস্বরেও পড়তে পারে। এ ব্যাপারে ধরাবাধা কোন নিয়ম নেই। [দেখুনঃ তিরমিয়ীঃ ৪৪৮] তবে এ আয়াতে বর্ণিত “সালাত” শব্দটির অর্থ সম্পর্কে আরো কিছু মত রয়েছে। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন, এ আয়াতে সালাত বলতে দোআ বুঝানো হয়েছে। [বুখারীঃ ৪৭২৩, মুসলিমঃ ৪৪৭] সুতরাং সে অনুসারে দো'আ করতে স্বর খুব উচু করতে নিষেধ করা হয়েছে।

১৭ : ১১১
وَقُلِ الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي لَمْ يَتَّخِذْ وَلَدًا وَلَمْ يَكُنْ لَهُ شَرِيكٌ فِي الْمُلْكِ وَلَمْ يَكُنْ لَهُ وَلِيٌّ مِنَ الذُّلِّ ۖ وَكَبِّرْهُ تَكْبِيرًا

বলুন। ‘প্রশংসা আল্লাহ্রই যিনি কোন সন্তান গ্রহণ করেননি [১] , তাঁর সার্বভৌমত্বে কোন অংশীদার নেই [২] এবং দুর্দশাগ্রস্ততা থেকে বাঁচতে তাঁর অভিভাবকের প্রয়োজন নেই [৩]। আর আপনি সসম্ভ্রমে তাঁর মাহাত্ম্য ঘোষণা করুন।

ফুটনোট

[১] এখানে প্রত্যক্ষভাবে রাসূলকে নির্দেশ দেয়া হলেও নির্দেশটি সমস্ত উম্মতের জন্যও প্রযোজ্য। সবাইকে তাওহীদের ঘোষণা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করার আদেশ করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে তাওহীদের এ অংশের নির্দেশ সম্বলিত আয়াতসমূহ এসেছে। [যেমন, সূরা ইখলাস, সূরা আল জিনঃ ৩, সূরা আল-মু'মিনূনঃ ৯১, সূরা আল-আনআমঃ ১০১, সূরা আল-বাকারাহ ১১৬, সূরা ইউনুসঃ ৬৮, সূরা আল-কাহফঃ ৪, সূরা মারইয়ামঃ ৮৮-৯২, সূরা আল আম্বিয়াঃ ২৬, সূরা আল-ফুরকানঃ ২] এ সমস্ত আয়াতে যে সত্যটি তুলে ধরা হয়েছে তা হলো, দয়াময় আল্লাহর জন্য সন্তান গ্রহণ অসম্ভব। সন্তান তো তারাই আশা করে যারা তাদের অবর্তমানে তাদের কাজকারবার দেখাশুনা, তাদের নাম টিকিয়ে রাখা, তাদের চাহিদা পূরণ, তাদের কর্মকাণ্ডে সাহায্য-সহযোগিতার প্রয়োজন পড়ে। মহান আল্লাহ তা’আলা এ সমস্ত কিছু থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। তিনি সর্বদা আছেন ও থাকবেন। তার কোন অভাব নেই। সবাই তাঁর মুখাপেক্ষী। সুতরাং আল্লাহর কোন সন্তান হতে পারে না। এতে ইয়াহুদী ও নাসারাদের দাবীর রদ করা হয়েছে। [দেখুন, ফাতহুল কাদীর]

[২] এখানে আরও যে সমস্ত কারণে মানুষ তাওহীদ থেকে বিচ্যুত হয় তা হচ্ছে, কোন কোন মানুষ মনে করে থাকে যে, যদি তার সন্তান নাও থাকে তার রাজত্বে ও রবুবিয়াতে অন্য কেউ শরীক আছে। সুতরাং তাদেরকেও সন্তুষ্ট করা উচিত। যেমন, মাজুস সম্প্রদায় মনে করে থাকে। তারা দু’জন ইলাহ নির্ধারণ করে থাকে। [ফাতহুল কাদীর] অনুরূপভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেও অনেকে এ ধরনের বিশ্বাস করে থাকে।

[৩] এখানে সে সমস্ত মুশরিকদের কথা বলা হয়েছে যারা বিভিন্ন দেবতা ও জ্ঞানী গুণী মহামানবদের সম্পর্কে বিশ্বাস করতো যে, আল্লাহ নিজের সার্বভৌম কর্তৃত্বের বিভিন্ন বিভাগ এবং নিজের রাজত্বের বিভিন্ন এলাকা তাদের ব্যবস্থাপনায় দিয়ে দিয়েছেন। এখানে তাদের এ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে প্রমাণ পেশ করা হয়েছে যে, আল্লাহ এমন নন যে, তিনি কোন কাজ করতে গিয়ে অপর কাজ করতে অপারগ হয়ে পড়েন। সুতরাং তার সহকারী কেন লাগবে? সুতরাং তাদের যে বিশ্বাস ছিল, আল্লাহ নিজে তাঁর সার্বভৌম কর্তৃত্বের বোঝা বহন করতে অক্ষম, তাই তিনি নিজের জন্য কোন সাহায্যকারী ও নির্ভর তালাশ করে বেড়াচ্ছেন। এটা একান্ত ভ্ৰান্ত ধারণা ও বিশ্বাস। তাই বলা হয়েছে, আল্লাহ অক্ষম নন। তাঁর কোন ডেপুটি, সহকারী ও সাহায্যকারীর প্রয়োজন নেই। [দেখুন, ইবন কাসীর]

১৯ :
قَالَ رَبِّ أَنَّىٰ يَكُونُ لِي غُلَامٌ وَكَانَتِ امْرَأَتِي عَاقِرًا وَقَدْ بَلَغْتُ مِنَ الْكِبَرِ عِتِيًّا

তিনি বললেন, ‘হে আমার রব! কেমন করে আমার পুত্র হবে যখন আমার স্ত্রী বন্ধ্যা ও আমি বার্ধক্যের শেষ সীমায় উপনীত।
ফুটনোট

১৯ : ১০
قَالَ رَبِّ اجْعَلْ لِي آيَةً ۚ قَالَ آيَتُكَ أَلَّا تُكَلِّمَ النَّاسَ ثَلَاثَ لَيَالٍ سَوِيًّا

যাকারিয়্যা বললেন, ‘হে আমার রব! আমাকে একটি নিদর্শন দিন। তিনি বললেন, ‘আপনার নিদর্শন এ যে, আপনি সুস্থ [১] থাকা সত্ত্বেও কারো সাথে তিন দিন কথাবার্তা বলবেন না।

ফুটনোট

[১] سويًّا শব্দের অর্থ সুস্থ। শব্দটি একথা বোঝানোর জন্য যুক্ত করা হয়েছে যে, যাকারিয়্যা আলাইহিস সালাম এর কোন মানুষের সাথে কথা না বলার এ অবস্থাটি কোন রোগবশতঃ ছিল না। এ কারণেই আল্লাহর যিকর ও ইবাদতে তার জিহবা তিন দিনই পূর্ববৎ খোলা ছিল; বরং এ অবস্থা মু'জেযা ও গর্ভসঞ্চারের নিদর্শন স্বরূপই প্রকাশ পেয়েছিল। [ইবন কাসীর]

২০ : ২৫
قَالَ رَبِّ اشْرَحْ لِي صَدْرِي

মুসা বললেন [১] , ‘হে আমার রব! আমার রব! আমার বক্ষ সম্প্রসারিত করে দিন [২]।

ফুটনোট

দ্বিতীয় রুকু’

[১] মূসা আলাইহিস সালাম যখন আল্লাহর কালাম লাভের গৌরব অর্জন করলেন এবং নবুওয়াত ও রেসালাতের দায়িত্ব লাভ করলেন, তখন তিনি নিজ সত্তা ও শক্তির উপর ভরসা ত্যাগ করে স্বয়ং আল্লাহ তা'আলারই দারস্থ হলেন। কারণ, তারই সাহায্যে এই মহান পদের দায়িত্ব পালন করা সম্ভবপর। এ কাজে যেসব বিপদাপদ ও বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হওয়া অপরিহার্য, সেগুলো হাসিমুখে বরণ করার মনোবলও আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকেই পাওয়া যেতে পারে। অর্থাৎ আমার মনে এ মহান দায়িত্বভার বহন করার মতো হিম্মত সৃষ্টি করে দিন। আমার উৎসাহ-উদ্দীপনা বাড়িয়ে দিন। আমাকে এমন ধৈর্য, দৃঢ়তা, সংযম, সহনশীলতা, নির্ভীকতা ও দুর্জয় সংকল্প দান করুন যা এ কাজের জন্য প্রয়োজন। ইবন কাসীর বলেন, এর কারণ, তাকে আল্লাহ এমন এক গুরু দায়িত্ব দিয়ে পাঠাচ্ছেন এমন এক লোকের কাছে, যে তখনকার সময়ে যমীনের বুকে সবচেয়ে বেশী অহংকারী, দাম্ভিক, কুফরিতে চরম, সৈন্য-সামন্ত যার অগণিত। বহু বছর থেকে যার রাজত্ব চলে আসছে, তার ক্ষমতার দম্ভে সে দাবী করে বসেছে যে, আল্লাহকে চেনে না। তার প্রজারা তাকে ছাড়া আর কাউকে ইলাহ বলে মানে না। তিনি তার ঘরেই ছোট বেলায় লালিত-পালিত হয়েছিলেন। তাদেরই একজনকে হত্যা করে পালিয়েছিলেন। এতকিছুর পর আবার তার কাছেই ফিরে যাচ্ছেন তাওহীদের দাওয়াত নিয়ে। একমাত্র আল্লাহর ইবাদাতের দাওয়াত দিতে যাচ্ছেন। সুতরাং তার তো প্রচুর দো'আ করা প্রয়োজন। [ইবন কাসীর] তাই তিনি আল্লাহর দরবারে পাঁচটি বিষয়ে দো'আ করলেন। যার বর্ণনা সামনে আসছে।

[২] প্রথম দোআ, হে আমার রব, আমার বক্ষ ঈমান ও নবুওয়াত দিয়ে প্রশস্ত ও আলোকিত করে দিন। [কুরতুবী] অন্য আয়াতে বলেছেন “এবং আমার বক্ষ সংকুচিত হয়ে পড়ছে”। [সূরা আশ-শু'আরা: ১৩] এভাবে তিনি তার অপারগতা ও প্রার্থনা প্ৰকাশ করলেন। [ফাতহুল কাদীর] অর্থাৎ অন্তরে এমন প্রশস্ততা দান করুন যেন নবুওয়াতের জ্ঞান বহন করার উপযোগী হয়ে যায়। ঈমানের দাওয়াত মানুষের কাছে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে তাদের পক্ষ থেকে যে কটু কথা শুনতে হয়, তা সহ্য করাও এর অন্তর্ভুক্ত।

২০ : ২৬
وَيَسِّرْ لِي أَمْرِي

‘এবং আমার কাজ সহজ করে দিন [১]।

ফুটনোট

[১] দ্বিতীয় দোআ, আমার কাজ সহজ করে দিন। এই উপলব্ধি ও অন্তর্দৃষ্টিও নবুওয়াতেরই ফলশ্রুতি ছিল যে, কোন কাজের কঠিন হওয়া অথবা সহজ হওয়া বাহ্যিক চেষ্টাচরিত্রের অধীন নয়। এটাও আল্লাহ তা’আলারই দান। তিনি যদি ইচ্ছা করেন তবে কারো জন্য কঠিনতর ও গুরুতর কাজ সহজ করে দেন এবং তিনি ইচ্ছা করলে সহজতর কাজও কঠিন হয়ে যায়। এ কারণেই হাদীসে মুসলিমদেরকে নিম্নোক্ত দো'আ শিক্ষা দেয়া হয়েছে। তারা নিজেদের কাজের জন্য আল্লাহর কাছে এভাবে দো'আ করবেঃ "হে আল্লাহ! আপনি যা সহজ করে দেন তা ব্যতীত কোন কিছুই সহজ নেই। আর আপনি চাইলে পেরেশানীযুক্ত কাজও সহজ করে দেন।" [সহীহ ইবনে হিব্বানঃ ৩/২৫৫, হাদীস নং ৯৭৪]

২০ : ২৭
وَاحْلُلْ عُقْدَةً مِنْ لِسَانِي

‘আর আমার জিহবার জড়তা দূর করে দিন---
ফুটনোট

২০ : ২৮
يَفْقَهُوا قَوْلِي

‘যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে [১]।

ফুটনোট

[১] তৃতীয় দোআ, আমার জিহবার জড়তা দূর করে দিন, যাতে লোকেরা আমার কথা বুঝতে পারে। কারণ রিসালাত ও দাওয়াতের জন্য স্পষ্টভাষী ও বিশুদ্ধভাষী হওয়াও একটি জরুরী বিষয়। মূসা ‘আলাইহিস সালাম হারূনকে রিসালাতের কাজে সহকারী করার যে দো'আ করেছেন, তাতে একথাও বলেছেন যে, “হারূন আমার চাইতে অধিক বিশুদ্ধভাষী।” [সূরা আল-কাসাসঃ ৩৪] এ থেকে জানা যায় যে, ভাষাগত কিছু একটা সমস্যা তার মধ্যে ছিল। এছাড়া ফির’আউন মূসা “আলাইহিস সালাম- এর চরিত্রে যেসব দোষারোপ করেছিল; তন্মধ্যে একটি ছিল এই, “সে তার বক্তব্য পরিস্কারভাবে ব্যক্ত করতে পারে না”। [সূরা আয-যুখরুফঃ ৫২]। মূসা 'আলাইহিস্ সালাম তার দোআয় জিহবার জড়তা এতটুকু দূর করার প্রার্থনা জানিয়েছিলেন, যতটুকুতে লোকেরা তার কথা বুঝতে পারে। বলাবাহুল্য, সে পরিমাণ জড়তা দূর করে দেয়া হয়েছিল। [দেখুন, ইবন কাসীর]

২০ : ২৯
وَاجْعَلْ لِي وَزِيرًا مِنْ أَهْلِي

‘আর আমার জন্য করে দিন একজন সাহায্যকারী আমার সজনদের মধ্য থেকে [১];

ফুটনোট

[১] চতুর্থ দো’আ, আমার পরিবারবর্গ থেকেই আমার জন্য একজন উযীর করুন। এই দো"আটি রিসালাতের করণীয় কাজ আঞ্জাম দেয়ার জন্য উপায়াদি সংগ্ৰহ করার সাথে সম্পর্ক রাখে। মূসা 'আলাইহিস সালাম সাহায্য করতে সক্ষম এমন একজন উযীর নিযুক্তিকে সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান উপায় সাব্যস্ত করেছেন। ইবন আব্বাস বলেন, সাথে সাথে হারূনকে নবী হিসেবে গ্রহণ করেছেন। [ইবন কাসীর] অভিধানে উযীরের অর্থই বোঝা বহনকারী। রাষ্ট্রের উযীর তার বাদশাহর বোঝা দায়িত্ব সহকারে বহন করেন। তাই তাকে উযীর বলা হয়। [ফাতহুল কাদীর] এ থেকে মূসা 'আলাইহিস সালাম-এর পরিপূর্ণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায় যে, তিনি তার উপর অর্পিত বিরাট দায়িত্ব পালন করার জন্য একজন উযীর চেয়ে নিয়েছেন। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “আল্লাহ তা’আলা যখন কোন ব্যক্তির হাতে রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতা অৰ্পণ করেন এবং চান যে, সে ভাল কাজ করুক এবং সুচারুরূপে রাষ্ট্র পরিচালনা করুক, তখন তার সাহায্যের জন্য একজন সৎ উযীর দান করেন। রাষ্ট্রপ্রধান কোন জরুরী কাজ ভুলে গেলে তিনি তাকে স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি যে কাজ করতে চান, উযীর তাতে সাহায্য করেন।’ [নাসায়ীঃ ৪২০৪]

২০ : ৩০
هَارُونَ أَخِي

‘আমার ভাই হারুনকে;
ফুটনোট

২০ : ৩১
اشْدُدْ بِهِ أَزْرِي

‘তার দ্বারা আমার শক্তি সুদৃঢ় করুন,
ফুটনোট

২০ : ৩২
وَأَشْرِكْهُ فِي أَمْرِي

‘এবং তাকে আমার কাজে অংশীদার করুন [১],

ফুটনোট

[১] পঞ্চম দোআ হচ্ছে, হারুনকে নবুওয়াত ও রিসালাতেও শরীক করুন। মূসা 'আলাইহিস সালাম তার দো'আয় প্রথমে অনির্দিষ্টভাবে বলেছেন যে, উযীর আমার পরিবারভুক্ত লোক হওয়া চাই। অতঃপর নির্দিষ্ট করে বলেছেন যে, আমি যাকে উযীর করতে চাই, তিনি আমার ভাই হারূন- যাতে রিসালাতের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদিতে আমি তার কাছ থেকে শক্তি অর্জন করতে পারি। হারূন আলাইহিস সালাম মুসা আলাইহিস সালাম থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন এবং মূসার পূর্বেই মারা যান। বর্ণিত আছে, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা একবার উমরায় বের হলে পথিমধ্যে এক বেদুঈনের মেহমান হলেন। তিনি তখন দেখলেন, তাদের একজন তার সাথীদের প্রশ্ন করছে, দুনিয়াতে কোন ভাই তার ভাইয়ের সবচেয়ে বড় উপকার করেছে? তারা বলল, জানি না। লোকটা বলল, মূসা। যখন সে তার ভাইয়ের জন্য নবুওয়াত চেয়ে নিল। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, আমি বললাম, সত্য বলেছে। আর এজন্যই আল্লাহ তার প্রশংসায় বলেছেন, “আর আল্লাহর কাছে তিনি মর্যাদাবান।” [সূরা আল-আহ যাব: ৬৯] [ইবন কাসীর]

২০ : ৩৩
كَيْ نُسَبِّحَكَ كَثِيرًا

‘যাতে আমরা আপনার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করতে পারি প্রচুর,
ফুটনোট

২০ : ৩৪
وَنَذْكُرَكَ كَثِيرًا

‘এবং আমরা আপনাকে স্মরণ করতে পারি বেশি পরিমাণ [১]।

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ হারূনকে উযীর ও নবুওয়াতে অংশীদার করলে এই উপকার হবে যে, আমরা বেশী পরিমাণে আপনার যিকর ও পবিত্রতা বর্ণনা করতে পারব। তিনি বুঝতে পারলেন যে, সমস্ত ইবাদাতের প্রাণ হচ্ছে যিকির। তাই তিনি তার ভাইকে সহ এটা করার সুযোগ দানের দো'আ করলেন। [সা’দী]

২০ : ৩৫
إِنَّكَ كُنْتَ بِنَا بَصِيرًا

‘আপনি তো আমাদের সম্যক দ্রষ্টা।’
ফুটনোট

২০ : ১৩০
فَاصْبِرْ عَلَىٰ مَا يَقُولُونَ وَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ قَبْلَ طُلُوعِ الشَّمْسِ وَقَبْلَ غُرُوبِهَا ۖ وَمِنْ آنَاءِ اللَّيْلِ فَسَبِّحْ وَأَطْرَافَ النَّهَارِ لَعَلَّكَ تَرْضَىٰ

কাজেই তারা যা বলে , সে বিষয়ে আপনি ধৈর্য ধারণ করুন [১] এবং সূর্যোদয়ের আগে ও সূর্যাস্তের আগে আপনার রব এর সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন এবং রাতে পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন, এবং দিনের প্রান্তসমূহেও [২], যাতে আপনি সন্তুষ্ট হতে আপ্রেন [৩]।

ফুটনোট

[১] মক্কাবাসীরা ঈমান থেকে গা বাঁচানোর জন্য নানারকম বাহানা খুঁজত এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের শানে অশালীন কথাবার্তা বলত। কেউ জাদুকর, কেউ কবি এবং মিথ্যাবাদী বলত। [ফাতহুল কাদীর] কুরআনুল করীম এখানে তাদের এসব যন্ত্রণাদায়ক কথাবার্তার দু'টি প্রতিকার বর্ণনা করেছে। (এক) আপনি তাদের কথাবার্তার প্রতি ভ্ৰক্ষেপ করবেন না; বরং সবর করবেন। (দুই) আল্লাহর ইবাদাতে মশগুল হয়ে যান।

وَسِبِّحْ بِحَمْدِرَبِّكَ

বাক্যে একথা বলা হয়েছে।

[২] অর্থাৎ যেহেতু মহান আল্লাহ এখনই তাদেরকে ধ্বংস করতে চান না এবং তাদের জন্য একটি অবকাশ সময় নির্ধারিত করে ফেলেছেন, তাই তাঁর প্রদত্ত এ অবকাশ সময়ে তারা আপনার সাথে যে ধরনের আচরণই করুক না কেন আপনাকে অবশ্যি তা বরদাশত করতে হবে এবং সবরের সাথে তাদের যাবতীয় তিক্ত ও কড়া কথা শুনেও নিজের সত্যবাণী প্রচার ও স্মরণ করিয়ে দেবার দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে। আপনি সালাত থেকে এ সবর, সহিষ্ণুতা ও সংযমের শক্তি লাভ করবেন। এ নির্ধারিত সময়গুলোতে আপনার প্রতিদিন নিয়মিত এ সালাত পড়া উচিত।

“রবের সপ্ৰশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা” করা মানে হচ্ছে সালাত। যেমন সামনের দিকে আল্লাহ্ নিজেই বলেছেনঃ “নিজের পরিবার পরিজনকে সালাত পড়ার নির্দেশ দিন এবং নিজেও নিয়মিত তা পালন করতে থাকুন।” সালাতের সময়গুলোর প্রতি এখানেও পরিষ্কার ইশারা করা হয়েছে। সূর্য উদয়ের পূর্বে ফজরের সালাত। সূর্য অস্ত যাবার আগে আসরের সালাত। আর রাতের বেলা হচ্ছে এশা ও তাহাজ্জুদের সালাত। দিনের প্রান্তগুলো অবশ্যি তিনটিই হতে পারে। একটি প্রান্ত হচ্ছে প্রভাত, দ্বিতীয় প্রান্তটি সূর্য ঢলে পড়ার পর এবং তৃতীয় প্ৰান্তটি হচ্ছে সন্ধ্যা। কাজেই দিনের প্রান্তগুলো বলতে ফজর, যোহর ও মাগরিবের সালাত হতে পারে। সহীহ হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ‘তোমরা তোমাদের রবকে স্বচ্ছভাবে দেখতে পাবে যেমনিভাবে তোমরা এ (পূর্নিমার চাঁদ) কে দেখতে পাচ্ছ। দেখতে তোমাদের কোন সমস্যা হবে না। সুতরাং তোমরা যদি সূর্যোদয়ের পূর্বে ও সূর্যাস্তের পূর্বে তোমাদের সালাতগুলো আদায়ের ব্যাপারে কোন প্রকার ব্যাঘাত সৃষ্টি করা হতে মুক্ত হতে পার তবে তা কর; অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম (তোমরা সূর্যোদয়ের পূর্বে এবং সূর্যাস্তের পূর্বে তোমাদের প্রভূর সপ্ৰশংস পবিত্রতা ঘোষণা কর) এ আয়াতটি বললেন। [বুখারীঃ ৫৭৩] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেনঃ “যে ব্যক্তি সূর্যোদয়ের পূর্বে এবং সূর্যাস্তের পূর্বে সালাত আদায় করবে সে জাহান্নামে যাবে না। ” অর্থাৎ ফজর ও আসার। [মুসলিমঃ ৬৩৪] [ইবন কাসীর]

[৩] অর্থাৎ তাসবীহ ও ইবাদাত এজন্যে করুন যাতে আপনার জন্য এমন কিছু অর্জিত হয়, যাতে আপনি সন্তুষ্ট হতে পারেন। মুমিনের সঠিক সস্তুষ্টি আসবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে। হাদীসে এসেছে, “আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ হে জান্নাতবাসী! তারা বলবেঃ হাজির হে আমাদের প্রভু, হাজির। তারপর তিনি বলবেনঃ তোমরা কি সন্তুষ্ট হয়েছ? তারা বলবেঃ কেন আমরা সন্তুষ্ট হব না, অথচ আপনি আমাদেরকে যা দিয়েছেন, সৃষ্টি জগতের কাউকে তা দেননি। তারপর তিনি বলবেনঃ আমি তোমাদেরকে তার থেকেও উত্তম কিছু দেব। তারা বলবেঃ এর থেকে উৎকৃষ্ট আর কিইবা আছে। তিনি বলবেনঃ আমি তোমাদের উপর এমনভাবে সন্তুষ্ট হব, যার পরে আর কখনো অসন্তুষ্ট হব না। [বুখারীঃ ৬৫৪৯, ৭৫১৮, মুসলিমঃ ২৮২৯]

২২ : ১৮
أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ يَسْجُدُ لَهُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ وَالشَّمْسُ وَالْقَمَرُ وَالنُّجُومُ وَالْجِبَالُ وَالشَّجَرُ وَالدَّوَابُّ وَكَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ ۖ وَكَثِيرٌ حَقَّ عَلَيْهِ الْعَذَابُ ۗ وَمَنْ يُهِنِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِنْ مُكْرِمٍ ۚ إِنَّ اللَّهَ يَفْعَلُ مَا يَشَاءُ ۩

আপনি কি দেখেন না যে, আল্লাহকে সিজদা করে যারা আছে আসমানসমূহে ও যারা আছে যমীনে , আর সূর্য, চাঁদ, নক্ষত্রমণ্ডলী, পর্বতরাজি, বৃক্ষলতা, জীবজন্তু [১] এবং সিজদা করে মানুষের মধ্যে অনেকে [২]? আবার অনেকের প্রতি অবধারিত হয়েছে শাস্তি [৩]। আল্লাহ্ যাকে হেয় করেন [৪] তার সম্মানদাতা কেউই নেই; নিশ্চয় আল্লাহ্ যা ইচ্ছে তা করেন।

ফুটনোট

[১] সমগ্র সৃষ্টজগত স্রষ্টার আজ্ঞাধীন ও ইচ্ছাধীন। কারো কারো মতে এখানে সিজদা করার দ্বারা আনুগত্য করা বোঝানো হয়েছে। [ফাতহুল কাদীর] সৃষ্টজগতের এই আজ্ঞানুবর্তিতা দুই প্রকার- (এক) সৃষ্টিগত ব্যবস্থাপনার অধীনে বাধ্যতামূলক আনুগত্য। মুমিন, কাফের, জীবিত, মৃত, জড়পদার্থ ইত্যাদি কেউ এই আনুগত্যের আওতা বহির্ভূত নয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে সবাই সমভাবে আল্লাহ তা'আলার আজ্ঞাধীন ও ইচ্ছাধীন। বিশ্ব-চরাচরের কোন কণা অথবা পাহাড় আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতিরেকে এতটুকুও নড়াচড়া করতে পারে না। (দুই) সৃষ্টজগতের ইচ্ছাধীন আনুগত্য। অর্থাৎ স্ব-ইচ্ছায় আল্লাহ তা’আলার বিধানাবলী মেনে চলা। আয়াতে এ প্রকার আনুগত্যই বোঝানো হয়েছে। আসমান যমীনে যত কিছু আছে যেমন ফেরেশতা, যাবতীয় জীব-জন্তু সবাই আল্লাহকে সিজদা করে বা তাঁর আনুগত্য করে। অনুরূপভাবে সূর্য, চন্দ্র ও তারকাসমূহও আল্লাহর আনুগত্য ও সিজদা করে। সূর্য, চন্দ্র ও তারকাসমূহকে আলাদাভাবে বর্ণনা করার কারণ হচ্ছে, আল্লাহ ব্যতীত এ গুলোর ইবাদাত করা হয়েছিল, তাই জানিয়ে দেয়া হলো যে, তোমরা এদের পূজা কর, অথচ এরা আল্লাহর জন্য সিজদা করে। অন্য আয়াতে সেটা স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, “তোমরা সূর্যকে সিজদা করো না, চাঁদকেও নয় ; আর সিজদা কর আল্লাহকে, যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন , যদি তোমরা কেবলমাত্র তাঁরই ইবাদাত কর।” [সূরা ফুসসিলাত: ৩৭] [ইবন কাসীর] যদি প্রশ্ন করা হয় যে, ইচ্ছাধীন আনুগত্য তো শুধু বিবেকবান মানুষ, জিন ইত্যাদির মধ্যে হতে পারে। জীবজন্তু, উদ্ভিদ ও জড়পদার্থের মধ্যে তো বিবেক ও চেতনাই নেই। এমতাবস্থায় এগুলোর মধ্যে ইচ্ছাধীন আনুগত্য কিভাবে হবে? এর উত্তর এই যে, কুরআনুল কারীমের বহু আয়াত ও বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত আছে যে, বিবেক, চেতনা ও ইচ্ছা থেকে কোন সৃষ্টবস্তুই মুক্ত নয়। সবার মধ্যেই কম-বেশী এগুলো বিদ্যমান আছে। জন্তু-জানোয়ারের বিবেক ও চেতনা সাধারণতঃ অনুভব করা হয়। উদ্ভিদের বিবেক ও চেতনাও সামান্য চিন্তা ও গবেষণা দ্বারা চেনা যায়, কিন্তু জড় পদার্থের বিবেক ও চেতনা এতই অল্প ও লুক্কায়িত যে, সাধারণ মানুষ তা বুঝতেই পারে না। কিন্তু তাদের স্রষ্টা ও মালিক বলেছেন যে, তারাও বিবেক ও চেতনার অধিকারী। যেমন আল্লাহ বলেন, “এমন কিছু নেই। যা তাঁর সপ্ৰশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে না” [সূরা আল-ইসরা: ৪৪] তাছাড়া সূর্য আরশের নিচে সিজদা করার কথা হাদীসে এসেছে। আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি কি জান, সূর্য কোথায় যায়? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল বেশী জানেন। তিনি বললেন, এটা যায় তারপর আরাশের নিচে সিজদা করে। অতঃপর অনুমতি গ্ৰহণ করে। অচিরেই এমন এক সময় আসবে যখন তাকে বলা হবে, যেখান থেকে এসেছি সেখানেই ফিরে যাও। [বুখারী: ৩১৯৯] আবুল আলীয়া বলেন, আকাশের যত তারকা আছে, সূর্য ও চাঁদ সবই যখন ডুবে তখন আল্লাহর জন্য সিজদা করে, যতক্ষণ সেগুলোকে অনুমতি না দেয়া হয়, ততক্ষণ সেগুলো ফিরে আসে না। তারপর তাদের উদিত হওয়ার স্থানে উদিত হয়। আর পাহাড় ও গাছের সিজদা হচ্ছে ডানে ও বামে তাদের ছায়া পড়া। [ইবন কাসীর] কাজেই আলোচ্য আয়াতে সে আনুগত্যকে সিজদা শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করা হয়েছে, তা ইচ্ছাধীন আনুগত্য। আয়াতের অর্থ এই যে, মানব জাতি ছাড়াও (জিনসহ) সব সৃষ্টবস্তু স্বেচ্ছায় ও স্বজ্ঞানে আল্লাহ্ তা'আলার দরবারে সিজদা করে অর্থাৎ আজ্ঞা পালন করে।

তবে মানব ও জিন জাতিকে আল্লাহ্ তা'আলা বিবেক ও চেতনার একটি পূর্ণস্তর দান করেছেন। এ কারণেই তাদেরকে আদেশ ও নিষেধের অধীন করা হয়েছে। মানব জাতিই সর্বাধিক বিবেক ও চেতনা লাভ করেছে। এ জন্য তারা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে- (এক) মুমিন, অনুগত ও সিজদাকারী এবং (দুই) কাফের, অবাধ্য ও সিজদার প্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শনকারী। সিজদার তাওফীক না দিয়ে আল্লাহ তা'আলা শেষোক্ত দলকে হেয় করেছেন। [সা'দী] হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যখন আদম৷ সন্তান সিজদার আয়াত পড়ে (এবং সিজদা করে), শয়তান তখন দূরে গিয়ে কাঁদতে থাকে। সে বলতে থাকে, আদম সন্তানকে সিজদা করতে বলা হয়েছে সে সিজদা করেছে, তার জন্য নির্ধারিত হল জান্নাত। আর আমাকে সিজদা করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল আর আমি তা করতে অস্বীকার করেছি, ফলে আমার জন্য নির্ধারিত হলো জাহান্নাম ' [মুসলিম: ৮১] এ আয়াতটি সিজদার আয়াত। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, ‘সুরা আল-হজ্জে দু'টি সাজদাহ রয়েছে। ' [মুস্তাদরাকে হাকিম: ৩৪৭২]

[২] অর্থাৎ এমন বহু মানুষ রয়েছে যারা নিছক বাধ্য হয়েই নয় বরং ইচ্ছাকৃতভাবে, সানন্দে ও আনুগত্যশীলতা সহকারেও তাঁকে সিজদা করে। [ইবন কাসীর] পরবর্তী বাক্যে তাদের মোকাবিলায় মানব সম্পপ্রদায়ের অন্য যে দলের কথা বলা হচ্ছে তারা স্বেচ্ছায় আল্লাহর সামনে মাথা নত হতে অস্বীকার করে এবং অহংকার করে। [ইবন কাসীর] কিন্তু অন্যান্য স্বাধীন ক্ষমতাহীন সৃষ্টির মতো তারাও প্রাকৃতিক আইনের বাঁধন মুক্ত নয়। কিন্তু তারাও ইচ্ছে করলেই যা ইচ্ছে তা করে বেড়াতে পারে না। তাদেরকেও জন্ম, মৃত্যু, জ্বরা, রোগ-শোক ইত্যাদিতে আল্লাহর নিয়মনীতির বাইরে চলার সুযোগ দেয়া হয়নি। সে হিসেবে আনুগত্যের ব্যাপকতা ও বাধ্যতামূলক সিজদার মধ্যে তারাও শামিল রয়েছে। নিজেদের ক্ষমতার পরিসরে বিদ্রোহের নীতি অবলম্বনের কারণে তারা আযাবের অধিকারী হয়।

[৩] তাদের অনেকের উপর আযাব অবধারিত হওয়ার কারণ হচ্ছে, তারা আনুগত্য করেনি। তারা সিজদা করেনি। [কুরতুবী]

[৪] অর্থাৎ তাকে আল্লাহ কাফের ও দূর্ভাগা বানিয়ে অপমানিত করেছেন। সুতরাং তাকে সম্মান দেয়ার আর কেউ নেই যে সে তার দ্বারা সৌভাগ্যশালী ও সম্মানিত হতে পারে। আল্লাহ যা ইচ্ছে তা করতে পারেন। দূৰ্ভাগা হওয়া, সৌভাগ্যশালী হওয়া, সম্মানিত বা অপমানিত হওয়া এ সবই আল্লাহর ইচ্ছাধীন। [ফাতহুল কাদীর] যে ব্যক্তি চোখ মেলে প্রকাশ্য ও উজ্জ্বল সত্য দেখে না এবং যে তাকে বুঝায় তার কথাও শোনে না সে নিজেই নিজের জন্য লাঞ্ছনা ও অবমাননার ডাক দেয়। সে নিজে যা প্রার্থনা করে, আল্লাহ তার ভাগ্যে তাই লিখে দেন। তারপর আল্লাহই যখন তাকে সত্য অনুসরণ করার মর্যাদা দান করেননি তখন তাকে এ মর্যাদায় অভিষিক্ত করার ক্ষমতা আর কার আছে?

২২ : ২৬
وَإِذْ بَوَّأْنَا لِإِبْرَاهِيمَ مَكَانَ الْبَيْتِ أَنْ لَا تُشْرِكْ بِي شَيْئًا وَطَهِّرْ بَيْتِيَ لِلطَّائِفِينَ وَالْقَائِمِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ

আর স্মরণ করুন যখন আমরা ইবরাহীমের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম [১] ঘরের স্থান [২], তখন বলেছিলাম, ‘আমার সাথে কোন কিছু শরীক করবেন না [৩] এবং আমার ঘরকে তাওয়াফকারী, সালাতে দণ্ডায়মান, এবং রুকু ও সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখুন [৪]

ফুটনোট

চতুর্থ রুকু’

[১] এ আয়াতে যারা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও ইবাদাত করে তাদের ব্যাপারে সাবধান করা হয়েছে। যারা আল্লাহর সাথে এমন ঘরে শির্ক করে যার ভিত্তি রচিত হয়েছিল তাওহীদের উপর। আল্লাহ জানিয়ে দিচ্ছেন যে, তিনি ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে সেটার স্থান দেখিয়ে দিলেন, তার কাছে সমৰ্পন করলেন এবং তা তৈরী করার অনুমতি দিলেন। [ইবন কাসীর] অভিধানে بوأ শব্দের অর্থ বর্ণনা করা। [জালালাইন] অপর অর্থ, তৈরী করা, কারণ সেটার স্থান অপরিচিত ছিল। [মুয়াসসার] আয়াতের অর্থ এইঃ একথা উল্লেখযোগ্য ও স্মর্তব্য যে, আমি ইবরাহীম 'আলাইহিস সালাম-কে বায়তুল্লাহর অবস্থানস্থলের ঠিকানা বর্ণনা করে দিয়েছি। আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ যখন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-কে ঘর বানানোর নির্দেশ দেয়া হলো, তিনি বিবি হাজেরা ও ইসমাঈলকে নিয়ে তা বানাতে বের হলেন, যখন মক্কার উপত্যকায় আসলেন তখন তিনি তার মাথার উপর ঘরের স্থানটুকুতে মেঘের মত দেখলেন, যাতে মাথার মত ছিল, সে মাথা থেকে ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম-কে বলা হলঃ হে ইবরাহীম! আপনি আমার ছায়ায় বা আমার পরিমাণ স্থানে ঘর বানান, এর চেয়ে কমাবেন না, বাড়াবেনও না। তারপর যখন ঘর বানানো শেষ করলেন, তখন তিনি বের হয়ে চলে গেলেন এবং ইসমাঈল ও হাজেরাকে ছেড়ে গেলেন, আর এটাই আল্লাহর বাণীঃ وَاِذْبَوَّاُنَالِاِبْرٰهِيْمَ আয়াতের মর্মার্থ। [মুস্তাদরাকে হাকিমঃ ২/৫৫১]

[২] مَكَانَ الْبَيْتِ শব্দে ইঙ্গিত রয়েছে যে, বায়তুল্লাহ্ ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল। বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে যে, এর প্রথম নির্মাণ আদম 'আলাইহিস সালাম-কে পৃথিবীতে আনার পূর্বে অথবা সাথে সাথে হয়েছিল। আদম 'আলাইহিস সালাম ও তৎপরবতী নবীগণ বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করতেন। কিন্তু এ সমস্ত বর্ণনা খুব শক্তিশালী নয়। সহীহ বৰ্ণনানুসারে ইবরাহীম আলাইহিসসালামই প্রথম কা'বা শরীফ নির্মাণ করেছিলেন। তখন আয়াতের অর্থ হবে, আমরা তাকে হবু ঘরের স্থান দেখিয়েছিলাম। এ অর্থ হবে না যে, সেখানে ঘর ছিল আর তা নষ্ট হয়ে যাবার পরে আবার তা ইবরাহীম আলাইহিসসালামকে নির্মাণের জন্য দেখিয়ে দেয়া হয়েছিল। ইবনে কাসীর রাহেমাহুল্লাহ বলেন, এ আয়াত থেকেই অনেকে প্রমাণ করেছেন যে, ইবরাহীম আলাইহিস সালামই প্রথম আল্লাহর ঘর নির্মাণ করেছেন। তার পূর্বে সেটি নির্মিত হয়নি। এর সপক্ষে প্রমাণ হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক হাদীস, আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! কোন মসজিদটি প্রথম নির্মিত হয়েছে? তিনি বললেন, মাসজিদুল হারাম। আমি বললাম, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, বাইতুল মুকাদ্দাস। আমি বললাম, এ দুয়ের মাঝখানে কত সময়? তিনি বললেন, চল্লিশ বছর। [বুখারী: ৩৩৬৬; মুসলিমঃ ৫২০]

[৩] অর্থাৎ ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-কে এই ঘরের কাছেই পুনর্বাসিত করার পর কতগুলো আদেশ দেয়া হয়। তন্মধ্যে প্রথম নির্দেশটি ছিল সর্বকালের সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ। আর তা হলো, ‘আমার সাথে কাউকে শরীক করবেন না।” ইবন কাসীর বলেন, এর অর্থ, একমাত্র আমার জন্যই এ ঘরটি বানাবেন। অথবা এ ঘরে শুধু আমাকেই ডাকবেন। অথবা এর অর্থ, আমার সাথে কাউকে শরীক করবেন না। [ফাতহুল কাদীর]

[৪] দ্বিতীয় আদেশ এরূপ দেয়া হয় যে, আমার গৃহকে পবিত্র রাখুন। পবিত্র করার অর্থ কুফর ও শির্ক থেকে পবিত্র রাখা। [ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর] অনুরূপভাবে বাহ্যিক ময়লা-আবর্জনা থেকেও পবিত্র রাখা। [ফাতহুল কাদীর] ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-কে একথা বলার উদ্দেশ্য অন্য লোকদেরকে এ ব্যাপারে সচেষ্ট করা। কারণ, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম নিজেই শির্ক ও কুফারী থেকে মুক্ত ছিলেন, তিনি আল্লাহর ঘরকে ময়লা-আবর্জনামুক্ত করতেন। এতদসত্ত্বেও যখন তাকে একাজ করতে বলা হয়েছে, তখন অন্যদের এ ব্যাপারে কতটুকু যত্নবান হওয়া উচিত, তা সহজেই অনুমেয়। আয়াত থেকে আরও স্পষ্ট হচ্ছে যে, এখানে কাবাঘরের সেবার দাবীদার তৎকালীন কাফের মুশরিকদের সাবধান করা হচ্ছে যে, এ ঘর নির্মাণের জন্য তোমাদের পিতার উপর শর্ত দেয়া হয়েছিল যে, তিনি এটাকে শির্কমুক্ত রাখবেন। তোমরা সে শর্তটি পূর্ণ করতে পারনি। বরং শির্ক দ্বারা কলুষিত করেছ। [ফাতহুল কাদীর] এ নির্দেশের সাথে কাদের জন্য ঘরটি পবিত্র রাখবেন তাদের কথাও জানিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা হচ্ছেন, তাওয়াফকারী ও সালাতে দণ্ডায়মানকারী, রুকুকারী ও সিজদাকারী লোকদের জন্য। বিশেষ করে তাওয়াফ এ ঘর ছাড়া আর কোথাও জায়েয নেই, আর সালাত এ ঘর ব্যতীত অন্য কোন দিকে মুখ করে পড়া (নফল ও যুদ্ধের সময়কার সালাত ব্যতীত) জয়েয নেই। অনুরূপভাবে রুকু ও সিজদা বলার কারণে ইবাদাতের মধ্যে এ দু'টি রুকনের গুরুত্ব প্রকাশ পাচ্ছে। [ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর]

২২ : ৭৭
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا ارْكَعُوا وَاسْجُدُوا وَاعْبُدُوا رَبَّكُمْ وَافْعَلُوا الْخَيْرَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ ۩

হে মুমিনগণ! তোমরা রুকূ‘ কর, সিজদা কর এবং তোমাদের রব-এর ‘ইবাদত কর ও সৎকাজ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার [১]।

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ সফল হতে হলে এ কাজগুলো করতে হবে। সালাত কায়েম করতে হবে, রুকু ও সিজদার মাধ্যমে, এ দু‘টি সালাতেরই গুরুত্বপূর্ণ রুকন। আর এ ইবাদতই হচ্ছে চক্ষু শীতলকারী, চিন্তান্বিত অন্তরের জন্য সান্ত্বনা। আর আল্লাহ্‌র রুবুবিয়াতে বিশ্বাসের এটাই দাবী যে, বান্দা একমাত্র তাঁরই ইবাদাত করবে এবং যাবতীয় কল্যাণের কাজ করবে। [সা‘দী]

২৩ : ২৬
قَالَ رَبِّ انْصُرْنِي بِمَا كَذَّبُونِ

নূহ বলেছিলেন, ‘হে আমার রব! আমাকে সাহায্য করুন, কারণ তারা আমার প্রতি মিথ্যারোপ করেছে [১]।’

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ আমার প্রতি এভাবে মিথ্যা আরোপ করার প্রতিশোধ নিন। যেমন অন্যত্র বলা হয়েছেঃ “কাজেই নূহ নিজের রবকে ডেকে বললেনঃ আমাকে দমিত করা হয়েছে, এখন আপনিই এর বদলা নিন।” [সূরা আল-কামারঃ ১০] অন্যত্র বলা হয়েছেঃ “আর নূহ বললোঃ হে আমার রব! এ পৃথিবীতে কাফেরদের মধ্য থেকে একজন অধিবাসীকেও ছেড়ে দিবেন না। যদি আপনি তাদেরকে থাকতে দেন তাহলে তারা আপনার বান্দাদেরকে গোমরাহ করে দেবে এবং তাদের বংশ থেকে কেবল দুষ্কৃতকারী ও সত্য অস্বীকারকারীরই জন্ম হবে।” [সূরা নূহঃ ২৬-২৭]

২৩ : ১১৮
وَقُلْ رَبِّ اغْفِرْ وَارْحَمْ وَأَنْتَ خَيْرُ الرَّاحِمِينَ

আর বলুন, ‘হে আমার রব! ক্ষমা করুন ও দয়া করুন, আর আপনিই তো সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু।’
ফুটনোট

২৪ : ৩৬
فِي بُيُوتٍ أَذِنَ اللَّهُ أَنْ تُرْفَعَ وَيُذْكَرَ فِيهَا اسْمُهُ يُسَبِّحُ لَهُ فِيهَا بِالْغُدُوِّ وَالْآصَالِ

সে সব ঘরে [১] যাকে সমুন্নত করতে [২] এবং যাতে তাঁর নাম স্মরণ করতে আল্লাহ্‌ নির্দেশ দিয়েছেন [৩], সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে [৪],

ফুটনোট

[১] পূর্ববর্তী আয়াতে আল্লাহ্‌ তা‘আলা মানুষের অন্তরে নিজের হেদায়াতের আলো রাখার একটি বিশেষ দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন এবং শেষে বলেছেনঃ এই নূর দ্বারা সে-ই উপকার লাভ করে, যাকে আল্লাহ্‌ চান ও তাওফীক দেন। [ইবন কাসীর] আলোচ্য আয়াতে এমন মুমিনদের আবাসস্থল ও স্থান বর্ণনা করা হয়েছে যে, এরূপ মুমিনদের আসল আবাসস্থল, যেখানে তারা প্রায়ই বিশেষতঃ পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের সময় দৃষ্টিগোচর হয়- সেসব গৃহ, যেগুলোকে উচ্চ রাখার জন্য এবং যেগুলোতে আল্লাহ্‌র নাম উচ্চারণ করার জন্য আল্লাহ্‌ তা‘আলা আদেশ করেছেন। এসব গৃহে সকাল-সন্ধ্যায় অর্থাৎ সর্বদা এমন লোকেরা আল্লাহ্‌ তা‘আলার পবিত্ৰতা বর্ণনা করে, যাদের বিশেষ গুণাবলী পরবর্তী আয়াতে বর্ণিত হচ্ছে। অধিকাংশ তাফসীরবিদের মতে এসব গৃহ হচ্ছে মসজিদ। অধিকাংশ মুফাসসিরগণ এ তাফসীরকেই অগ্ৰাধিকার দিয়েছেন। [দেখুন-কুরতুবী, বাগভী]

[২] কোন কোন মুফাসসির এর অর্থ নিয়েছেন মু‘মিনদের ঘর এবং সেগুলোকে উন্নত করার অর্থ সেগুলোকে নৈতিক দিক দিয়ে উন্নত করা, নৈতিক মান রক্ষার জন্য তাতে মসজিদের ব্যবস্থা করা। এ অর্থের সমর্থনে আমরা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে একটি হাদীস পাই যাতে তিনি বলেছেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে বাসগৃহের মধ্যেও মসজিদ অর্থাৎ সালাত আদায় করার বিশেষ জায়গা তৈরী করার এবং তাকে পবিত্র রাখার জন্য আদেশ করেছেন। [ইবনে মাজহঃ ৭৫৮, ৭৫৯]

তবে অধিকাংশ মুফাসসির এ “ঘরগুলো”কে মসজিদ অর্থে গ্রহণ করেছেন এবং এগুলোকে উন্নত করার অর্থ নিয়েছেন এগুলো নির্মাণ ও এগুলোকে মর্যাদা প্ৰদান করা। “সেগুলোর মধ্যে নিজের নাম স্মরণ করতে আল্লাহ্‌ নির্দেশ দিয়েছেন।” এ শব্দগুলো বাহ্যত মসজিদ সংক্রান্ত ব্যাখ্যার বেশী সমর্থক দেখা যায়। তখন আয়াতের অর্থ হবে, আল্লাহ্‌ তা‘আলা মসজিদসমূহকে সমুন্নত করার অনুমতি দিয়েছেন। অনুমতি দেয়ার মানে আদেশ করা এবং উচ্চ করা মানে সম্মান করা। উচ্চ করার দু’টি অর্থ করা হয়ে থাকে-

[১] ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেনঃ উচ্চ করার অর্থ আল্লাহ্‌ তা‘আলা মসজিদসমূহে অনৰ্থক কাজ ও কথাবার্তা বলতে নিষেধ করেছেন।
হাসান বসরী রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ رِفْعُ مَسَا جِدَ বলে মসজিদসমূহের সম্মান, ইযযত ও সেগুলোকে নাপাকী ও নোংরা বস্তু থেকে পবিত্র রাখা বুঝানো হয়েছে। আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, “মসজিদে থুথু ফেলা গোনাহ আর তার কাফফারা হলো তা দাফন করা, মিটিয়ে দেয়া”। [বুখারীঃ ৪১৫, মুসলিমঃ ৫৫২]

[২] ইকরিমা ও মুজাহিদ বলেনঃ رفع বলে মসজিদ নির্মাণ বুঝানো হয়েছে; যেমন কা‘বা নির্মাণ সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছেঃ

وَ اِذْ يَرْ فَعُ اِبْرٰحٖمُ الْقًو اعِدَمِنَ الْبَيْتِ

এখানে رفع قو اعد বলে ভিত্তি নির্মাণ বুঝানো হয়েছে। উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেনঃ আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, “যে আল্লাহ্‌র জন্য মসজিদ বানায়, আল্লাহ্‌ তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর বানাবেন”। [বুখারীঃ ৪৫০, মুসলিমঃ ৫৩৩]

প্রকৃত কথা এই যে, تُرْفَعَ শব্দের অর্থ মসজিদ নির্মাণ করা, পাক-পবিত্র রাখা এবং মসজিদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা ইত্যাদি সবই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। [দেখুন-তাবারী, ইবন কাসীর, কুরতুবী] এ কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম রসুন ও পেঁয়াজ খেয়ে মুখ না ধুয়ে মসজিদে গমন করতে নিষেধ করেছেন। উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেনঃ “আমি দেখেছি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে ব্যাক্তির মুখে রসুন বা পেঁয়াজের দুৰ্গন্ধ অনুভব করতেন, তাকে মসজিদ থেকে বের করে ‘বাকী’ নামক স্থানে পাঠিয়ে দিতেন এবং বলতেনঃ যে ব্যাক্তি রসুন-পেঁয়াজ খেতে চায়, সে যেন উত্তম রূপে পাকিয়ে খায় যাতে দুৰ্গন্ধ নষ্ট হয়ে যায়।” [মুসলিমঃ ৫৬৭]

[৩] আবু উমামাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বৰ্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ “যে ব্যাক্তি গৃহে অযু করে ফরয সালাত আদায়ের জন্য মসজিদের দিকে যায়, তার সওয়াব সেই ব্যক্তির সমান, যে ইহরাম বেঁধে গৃহ থেকে হজ্জের জন্য যায়। যে ব্যাক্তি এশরাকের সালাত আদায়ের জন্য গৃহ থেকে অযু করে মসজিদের দিকে যায়, তার সওয়াব উমরাকারীর অনুরূপ। এক সালাতের পর অন্য সালাত ইল্লিয়্যীনে লিখিত হয় যদি উভয়ের মাঝখানে কোন অপ্রয়োজনীয় কাজ না করে।” [আবু দাউদঃ ৫৫৮] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেনঃ “যারা অন্ধকারে মসজিদে গমন করে, তাদেরকে কেয়ামতের দিন পরিপূর্ণ নূরের সুসংবাদ শুনিয়ে দাও।” [আবু দাউদঃ ৫৬১, তিরমিযীঃ ২২৩]

[৪] আল্লাহ্‌র নাম স্মরণ করা দ্বারা এখানে তাসবীহ (পবিত্রতা বর্ণনা), তাহমীদ (প্ৰশংসা বর্ণনা), নফল সালাত, কুরআন তিলাওয়াত, ওয়াজ-নসীহত, দ্বীনী শিক্ষা ইত্যাদি সর্বপ্রকার যিকর বুঝানো হয়েছে। [তাবারী, সা‘দী, মুয়াসসার]

২৪ : ৫৮
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لِيَسْتَأْذِنْكُمُ الَّذِينَ مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ وَالَّذِينَ لَمْ يَبْلُغُوا الْحُلُمَ مِنْكُمْ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ ۚ مِنْ قَبْلِ صَلَاةِ الْفَجْرِ وَحِينَ تَضَعُونَ ثِيَابَكُمْ مِنَ الظَّهِيرَةِ وَمِنْ بَعْدِ صَلَاةِ الْعِشَاءِ ۚ ثَلَاثُ عَوْرَاتٍ لَكُمْ ۚ لَيْسَ عَلَيْكُمْ وَلَا عَلَيْهِمْ جُنَاحٌ بَعْدَهُنَّ ۚ طَوَّافُونَ عَلَيْكُمْ بَعْضُكُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ ۚ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمُ الْآيَاتِ ۗ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ

হে মুমিনগণ! তোমাদের মালিকানাধীন দাস-দাসীরা এবং তোমাদের মধ্যে যারা বয়ঃপ্রাপ্ত হয়নি তারা যেন তোমাদের কক্ষে প্রবেশ করতে তিন সময় অনুমতি গ্রহণ করে, ফজরের সালাতের আগে, দুপুরে যখন তোমরা তোমাদের পোষাক খুলে রাখ তখন এবং ‘ইশার সালাতের পর; এ তিন সময় তোমাদের গোপনীয়তার সময়। এ তিন সময় ছাড়া (অন্য সময় বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করলে) তোমাদের এবং তাদের কোন দোষ নেই [১]। তোমাদের এককে অন্যের কাছে তো যেতেই হয়। এভাবে আল্লাহ্‌ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ বিবৃত করেন। আর আল্লাহ্‌ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।

ফুটনোট

[১] এ আয়াতে বিশেষ তিনটি সময়ে অনুমতি চাওয়ার বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। এই তিনটি সময় হচ্ছে ফযরের সালাতের পূর্বে, দুপুরের বিশ্রাম গ্রহণের সময় এবং এশার সালাতের পরবর্তী সময়। এই তিন সময়ে মাহরাম, আত্মীয়স্বজন এমনকি বুদ্ধিসম্পন্ন অপ্ৰাপ্তবয়স্ক বালক-বালিকা এবং দাসদাসীদেরকেও আদেশ করা হয়েছে, তারা যেন কারো নির্জন কক্ষে অনুমতি ব্যতীত প্রবেশ না করে। কেননা, এসব সময়ে মানুষ স্বাধীন ও খোলাখুলি থাকতে চায়, অতিরিক্ত বস্ত্রও খুলে ফেলে এবং মাঝে মাঝে স্ত্রীর সাথে খোলাখুলি মেলামেশায় মশগুল থাকে। এসব সময় কোন বুদ্ধিমান বালক অথবা গৃহের কোন নারী অথবা নিজ সন্তানদের মধ্য থেকে কেউ অনুমতি ব্যতীত প্রবেশ করলে প্রায়ই লজ্জার সম্মুখীন হতে হয় ও অত্যন্ত কষ্ট বোধ হয়, কমপক্ষে সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তির খোলাখুলিভাবে থাকা ও বিশ্রামে বিঘ্ন সৃষ্টি হওয়া তো বলাই বাহুল্য। তাই আলোচ্য আয়াতসমূহে তাদের জন্য বিশেষ অনুমতি চাওয়ার বিধানাবলী বৰ্ণিত হয়েছে। এসব বিধানের পর একথাও বলা হয়েছে যে,

لَيْسَ عَلَيْهِمْ جُنَاحٌ مبَعْدَهُنَّ

অর্থাৎ এসব সময় ছাড়া একে অপরের কাছে অনুমতি ব্যতীত যাতায়াত করায় কোন দোষ নেই। [কুরতুবী]

২৫ : ৬০
وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اسْجُدُوا لِلرَّحْمَٰنِ قَالُوا وَمَا الرَّحْمَٰنُ أَنَسْجُدُ لِمَا تَأْمُرُنَا وَزَادَهُمْ نُفُورًا ۩

আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘সিজদাবনত হও ‘রাহমান’ -এর প্রতি,’ তখন তারা বলে, ‘রাহমান আবার কি [১]? তুমি কাউকে সিজদা করতে বললেই কি আমরা তাকে সিজদা করব?’ আর এতে তাদের পলায়নপরতাই বৃদ্ধি পায়।

ফুটনোট

[১] মক্কার কাফেররা এ নামটি যে জানত না তা নয়। তারা এ নামটি জানত তবে আল্লাহ্‌র জন্য নির্দিষ্ট করতে দ্বিধা করত। তারা এ নামটিকে কোন কোন মানুষকেও প্রদান করত। অথচ এ নামটি এমন এক নাম যা শুধুমাত্র মহান রাব্ববুল আলামীনের জন্যই নির্দিষ্ট। কোন ক্রমেই অন্য কারো জন্য এ নামটিকে নাম হিসেবে বা গুণ হিসেবে ব্যবহার করা জায়েয নেই। কিন্তু তারা হঠকারিতাবশতঃ প্রশ্ন করল যে, রহমান কে এবং কি? হুদায়বিয়ার সন্ধির দিনও তারা এমনটি অস্বীকার করে বলেছিলঃ “আমরা রহমান বা রহীম কি জিনিস তা জানিনা; বরং যেভাবে তুমি আগে লিখতে, সেভাবে ‘বিসমিকা আল্লাহুম্মা’ লিখা।” [মুসলিমঃ ১৭৮৪] সূরা আল-ইসরার ১১০ নং আয়াতেও আল্লাহ্‌ তা‘আলা কাফেরদেরকে উদ্দেশ্য করে তাঁর এ নামের তাৎপর্য বর্ণনা করে বলেছেন যে, “আল্লাহ্‌কে ডাক বা রহমানকে ডাক, যেভাবেই ডাক এগুলো তাঁর সুন্দর নামসমূহের অন্তর্গত’’।

২৫ : ৬৪
وَالَّذِينَ يَبِيتُونَ لِرَبِّهِمْ سُجَّدًا وَقِيَامًا

এবং তারা রাত অতিবাহিত করে তাদের রব-এর উদ্দেশ্যে সিজদাবনত হয়ে ও দাঁড়িয়ে থেকে [১];

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ তারা রাত্রি যাপন করে তাদের পালনকর্তার সামনে সিজদারত অবস্থায় ও দণ্ডায়মান অবস্থায়। ইবাদাতে রাত্রি জাগরণের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করার কারণ এই যে, এই সময়টি নিদ্রা ও আরামের। এতে সালাত ও ইবাদাতের জন্য দণ্ডায়মান হওয়া যেমন বিশেষ কষ্টকর, তেমনি এতে লোকদেখানো ও নামযশের আশংকাও নেই। উদ্দেশ্য এই যে, তারা দিবারাত্ৰি আল্লাহ্‌র ইবাদাতে মশগুল থাকে। কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে তাদের জীবনের এ দিকগুলো সুস্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে। যেমন অন্য সূরায় বলা হয়েছেঃ “তাদের পিঠ বিছানা থেকে আলাদা থাকে, নিজেদের রবকে ডাকতে থাকে আশায় ও আশংকায়।” [সূরা আস-সাজদাহঃ ১৬] অন্যত্র আরো বলা হয়েছেঃ “এ সকল জান্নাতবাসী ছিল এমন সব লোক যারা রাতে সামান্যই ঘুমাতো এবং ভোর রাতে মাগফিরাতের দো‘আ করতো।’’ [সূরা আয-যারিয়াতঃ ১৭-১৮]

আরো বলা হয়েছেঃ “যে ব্যক্তি হয় আল্লাহর হুকুম পালনকারী, রাতের বেলা সিজদা করে ও দাঁড়িয়ে থাকে, আখেরাতকে ভয় করে এবং নিজের রবের রহমতের প্রত্যাশা করে তার পরিনাম কি মুশরিকের মতো হতে পারে ?” [সূরা আয যুমারঃ ৯] হাদীসে সালাতুত তাহাজ্জুদের অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “নিয়মিত তাহাজ্জুদ আদায় কর। কেননা এটা তোমাদের পূর্ববর্তী সকল নেককারদের অভ্যাস ছিলো। এটা তোমাদেরকে আল্লাহ্‌ তা’আলার নৈকট্য দানকারী, মন্দ কাজের কাফফারা এবং গোনাহ থেকে নিবৃত্তকারী।” [সহীহ ইবনে খুযাইমাহঃ ১১৩৫] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেনঃ “যে ব্যক্তি এশার সালাত জামা’আতে আদায় করে, সে যেন অর্ধরাত্রি ইবাদাতে অতিবাহিত করে এবং যে ব্যক্তি ফজরের সালাত জামা’আতের সাথে আদায় করে, তাকে অবশিষ্ট অর্ধরাত্রিও ইবাদাতে অতিবাহিতকারী হিসেবে গণ্য করা হবে।” [মুসলিমঃ ৬৫৬]

২৬ : ৮৩
رَبِّ هَبْ لِي حُكْمًا وَأَلْحِقْنِي بِالصَّالِحِينَ

‘হে আমার রব! আমাকে প্রজ্ঞা দান করুন এবং সৎকর্মশীলদের সাথে মিলিয়ে দিন।
ফুটনোট

২৬ : ৮৪
وَاجْعَلْ لِي لِسَانَ صِدْقٍ فِي الْآخِرِينَ

‘আর আমাকে পরবর্তীদের মধ্যে যশস্বী করুন [১],

ফুটনোট

[১] এ আয়াতের অর্থ এই যে, আল্লাহ্‌ আমাকে এমন সুন্দর তরিকা ও উত্তম নিদর্শন দান করুন, যা কেয়ামত পর্যন্ত মানবজাতি অনুসরণ করে এবং আমাকে উৎকৃষ্ট আলোচনা ও সদগুণাবলী দ্বারা স্মরণ করে। [ফাতহুল কাদীর, বাগভী, কুরতুবী]

২৬ : ৮৫
وَاجْعَلْنِي مِنْ وَرَثَةِ جَنَّةِ النَّعِيمِ

‘এবং আমাকে সুখময় জান্নাতের অধিকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন,
ফুটনোট

২৬ : ৮৬
وَاغْفِرْ لِأَبِي إِنَّهُ كَانَ مِنَ الضَّالِّينَ

‘আর আমার পিতাকে ক্ষমা করুন, তিনি তো পথভ্রষ্টদের শামিল ছিলেন [১]।

ফুটনোট

[১] পবিত্র কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে

مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَن يَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ وَلَوْ كَانُوا أُولِي قُرْبَىٰ مِن بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ

‘‘আত্মীয়-স্বজন হলেও মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নবী এবং মু’মিনদের জন্য সংগত নয় যখন এটা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, নিশ্চিতই ওরা জাহান্নামী”। [সূরা আত-তাওবাঃ ১১৩] কুরআনুল করীমের এই ফরমান জারি হওয়ার পর এখন যার মৃত্যু কুফরের উপর নিশ্চিত ও অবধারিত; তার জন্য মাগফেরাতের দো‘আ করা অবৈধ ও হারাম। কিন্তু এ আয়াতে আল্লাহ্‌ তা‘আলা ইবরাহীম ‘আলাইহিসসালাম-এর দো‘আ উল্লেখ করে বলেছেনঃ

وَاغْفِرْ لِأَبِي إِنَّهُ كَانَ مِنَ الضَّالِّينَ

“আর আমার পিতাকে ক্ষমা করে দিন তিনি তো পথভ্রষ্টদের শামিল ছিলেন”। তা থেকে প্রশ্ন দেখা দেয় যে, উপরোক্ত নিষেধাজ্ঞার পর ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম তার মুশরিক পিতার জন্য কেন মাগফেরাতের দো‘আ করলেন? আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন নিজেই কুরআনুল কারীমে এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেনঃ

وَمَا كَانَ اسْتِغْفَارُ إِبْرَاهِيمَ لِأَبِيهِ إِلَّا عَن مَّوْعِدَةٍ وَعَدَهَا إِيَّاهُ فَلَمَّا تَبَيَّنَ لَهُ أَنَّهُ عَدُوٌّ لِّلَّهِ تَبَرَّأَ مِنْهُ ۚ إِنَّ إِبْرَاهِيمَ لَأَوَّاهٌ حَلِيمٌ

[সূরা আত-তাওবাঃ ১১৪] -অর্থাৎ “ ইবরাহীম তাঁর পিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন, তাকে এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বলে; তারপর যখন এটা তাঁর কাছে সুস্পষ্ট হল যে, সে আল্লাহ্‌র শত্রু তখন ইবরাহীম তার থেকে নিজেকে বিমুক্ত ঘোষণা করলেন। ইবরাহীম তো কোমল হৃদয় ও সহনশীল।”

২৬ : ৮৭
وَلَا تُخْزِنِي يَوْمَ يُبْعَثُونَ

‘এবং আমাকে লাঞ্ছিত করবেন না পুনরুত্থানের দিনে [২]

ফুটনোট

[২] অর্থাৎ ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম বললেনঃ ‘হে আমার রব! যেদিন সমস্ত সৃষ্টিজগতকে পুনরুত্থান করা হবে, সেই কেয়ামতের দিন আমাকে লজ্জিত করবেন না।’ হাদীসে এসেছে, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কেয়ামতের দিন তার পিতা আজরকে তার মুখে ধুলিমলিন কুৎসিত অবস্থায় দেখতে পাবেন। তখন ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম তাকে বলবেনঃ আমি কি আপনাকে বলিনি যে, আমার অবাধ্য হবেন না? তখন তার বাবা তাকে বলবেনঃ আমি আজ তোমার অবাধ্য হব না। তখন ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম বলবেনঃ হে রব! আপনি আমাকে পুনরুত্থান দিনে লজ্জিত না করার ওয়াদা করেছেন। আমার পিতার ধ্বংসের চেয়ে লজ্জাজনক ব্যাপার আর কি হতে পারে? তখন আল্লাহ্‌ তা‘আলা বলবেনঃ আমি কাফেরদের উপর জান্নাত হারাম করে দিয়েছি। তারপর বলা হবেঃ হে ইবরাহীম! আপনার পায়ের নীচে কি? তখন তিনি তাকালে দেখতে পাবেন বিদঘুটে কুৎসিত হায়েনা জাতীয় এক প্রাণী। তখন তার চার পা ধরে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (অর্থাৎ সে এমন ঘৃণিত হবে যে, ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম তার জন্য কথা বলতে চাইবেন না।) [বুখারীঃ ৩৩৫০]

২৬ : ৮৮
يَوْمَ لَا يَنْفَعُ مَالٌ وَلَا بَنُونَ

‘যে দিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোন কাজে আসবে না;
ফুটনোট

২৬ : ৮৯
إِلَّا مَنْ أَتَى اللَّهَ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ

‘সে দিন উপকৃত হবে শুধু সে, যে আল্লাহ্‌র কাছে আসবে বিশুদ্ধ অন্তঃকরণ নিয়ে।’
ফুটনোট

২৬ : ১১৭
قَالَ رَبِّ إِنَّ قَوْمِي كَذَّبُونِ

নূহ বললেন, ‘হে আমার রব! আমার সম্প্রদায় তো আমার উপর মিথ্যারোপ করেছে।
ফুটনোট

২৬ : ১১৮
فَافْتَحْ بَيْنِي وَبَيْنَهُمْ فَتْحًا وَنَجِّنِي وَمَنْ مَعِيَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ

‘কাজেই আপনি আমার ও তাদের মধ্যে স্পষ্ট মীমাংসা করে দিন এবং আমাকে ও আমার সাথে যেসব মুমিন আছে, তাদেরকে রক্ষা করুন [১]।’

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ নূহ ‘আলাইহিস সালাম দো‘আ করলেন যে, হে আল্লাহ্‌! আপনি আমার ও আমার জাতির মধ্যে ফায়সালা করে দিন এবং আমাকে ও আমার সাখী ঈমানদারদেরকে রক্ষা করুন। [দেখুন-মুয়াসসার] অন্যান্য সূরাসমূহেও নূহ ‘আলাইহিস সালাম-এর এ দো‘আ এবং আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে তার জবাব উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, সূরা আল-কামারঃ ১০-১8।

২৬ : ২১৯
وَتَقَلُّبَكَ فِي السَّاجِدِينَ

এবং সিজদাকারীদের মাঝে আপনার উঠাবসা [১]।

ফুটনোট

[১] এর কয়েকটি অর্থ হতে পারে। এক, আপনি যখন জামায়াতের সাথে নামায পড়ার সময় নিজের মুকতাদীদের সাথে উঠা-বসা ও রুকূ’-সিজদা করেন তখন আল্লাহ্‌ আপনাকে দেখতে থাকেন। দুই, রাতের বেলা উঠে যখন নিজের সাথীরা (যাদের বৈশিষ্ট্যসূচক গুণ হিসেবে “সিজদাকারী” শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে) তাদের আখেরাত গড়ার জন্য কেমন তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে তা দেখার উদ্দেশ্যে ঘোরাফেরা করতে থাকেন তখন আপনি আল্লাহ্‌র দৃষ্টির আড়ালে থাকেন না। তিন, আপনি নিজের সিজদাকারী সাথীদেরকে সংগে নিয়ে আল্লাহ্‌র বান্দাদের সংশোধন করার জন্য যেসব প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন আল্লাহ্‌ তা অবগত আছেন। চার, সিজদাকারী লোকদের দলে আপনার যাবতীয় তৎপরতা আল্লাহ্‌র নজরে আছে। তিনি জানেন আপনি কিভাবে তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন, কিভাবে ও কেমন পর্যায়ে তাদের আত্মশুদ্ধি করছেন এবং কিভাবে ভেজাল সোনাকে খাঁটি সোনায় পরিণত করেছেন। [দেখুন-তবারী, বাগভী]

২৯ : ৪৫
اتْلُ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِنَ الْكِتَابِ وَأَقِمِ الصَّلَاةَ ۖ إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَىٰ عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ ۗ وَلَذِكْرُ اللَّهِ أَكْبَرُ ۗ وَاللَّهُ يَعْلَمُ مَا تَصْنَعُونَ

আপনি [১] তেলাওয়াত করুন কিতাব থেকে যা আপনার প্রতি ওহী করা হয় [২] এবং সালাত কায়েম করুন [৩]। নিশ্চয় সালাত বিরত রাখে অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে [৪]। আর আল্লাহ্র স্মরণই তো সর্বশ্রেষ্ঠ [৫]। তোমরা যা কর আল্লাহ্ তা জানেন।

ফুটনোট

[১] আপাত দৃষ্টিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করা হয়েছে কিন্তু আসলে সমস্ত মুসলিমদেরকেই উদ্দেশ্য করা হয়েছে। এতে দুটি অংশ আছে, কুরআন তেলাওয়াত ও সালাত কায়েম করা। কারণ এ দু'টি জিনিসই মুমিনকে এমন সুগঠিত চরিত্র ও উন্নতর যোগ্যতার অধিকারী করে যার সাহায্যে সে বাতিলের প্রবল বন্যা এবং দুস্কৃতির ভয়াবহ ঝঞ্ঝার মোকাবিলায় সঠিক পথে থাকতে পারে। [দেখুন, আত-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর]

[২] কুরআন তেলাওয়াতের এ শক্তি মানুষ তখনই অর্জন করতে পারে যখন সে কুরআনের শুধুমাত্র শব্দগুলো পাঠ করেই ক্ষান্ত হয় না। বরং তার শিক্ষাগুলোও সঠিকভাবে অনুধাবন করে হৃদয়ের প্রতিটি তন্ত্রীতে সেগুলোকে সঞ্চারিত করে যেতে থাকে। আসলে যে তেলাওয়াতের পরে মানুষের মন-মানস, চিন্তা-চেতনা ও চরিত্র-কর্মনীতিতে কোন পরিবর্তন আসে না বরং কুরআন পড়ার পরও কুরআন যা নিষেধ করে মানুষ তা সব করে যেতে থাকে তা একজন মুমিনের কুরআন তেলাওয়াত হতেই পারে না। মূলত: কুরআনের হারামকৃত জিনিসকে যে হালাল করে নিয়েছে যে কুরআনের প্রতি ঈমানই আনেনি। এ অবস্থাটিকে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি ছোট্ট বাক্যের মধ্য দিয়ে অত্যন্ত চমৎকারভাবে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেছেনঃ “কুরআন তোমার পক্ষে বা বিপক্ষে প্রমাণ স্বরূপ।” [মুসলিম: ২২৩]

[৩] কুরআন তেলাওয়াতের পর দ্বিতীয় যে কাজটির প্রতি উম্মতকে অনুবর্তী করার নির্দেশ এখানে দেয়া হয়েছে তা হলো, সালাত। সালাতকে অন্যান্য ফরয কর্ম থেকে পৃথক করার এই রহস্যও বর্ণিত হয়েছে যে, সালাত স্বকীয়ভাবেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এবং দ্বীনের স্তম্ভ। এর উপকারিতা এই যে, যে ব্যক্তি সালাত কায়েম করে, সালাত তাকে অশ্লীল ও গৰ্হিত কার্য থেকে বিরত রাখে। [ইবন কাসীর] আয়াতে ব্যবহৃত “ফাহ্শা’ শব্দের অর্থ এমন সুস্পষ্ট মন্দ কাজ, যাকে প্রত্যেক বুদ্ধিমান ব্যক্তিই মন্দ এমন কথা ও কাজকে বলা হয়, যার হারাম ও অবৈধ হওয়ার ব্যাপারে শরীআত বিশারদগণ একমত ৷ [বাগভী; ফাতহুল কাদীর] ‘ফাহ্শা’ ও ‘মুনকার’ শব্দদ্বয়ের মধ্যে যাবতীয় অপরাধ এবং প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য গোনাহ দাখিল হয়ে গেছে। যেগুলো স্বয়ং নিঃসন্দেহরূপে মন্দ এবং সৎকর্মের পথে সর্ববৃহৎ বাধা। সালাতের মাধ্যমে এ সকল বাধা দূরীভূত হয়।

[৪] এখানে কেউ কেউ সন্দেহ করে যে, অনেক মানুষকে সালাতের আনুবর্তী হওয়া সত্ত্বেও বড় বড় গুনাহে লিপ্ত থাকতে দেখা যায়। এটা আলোচ্য আয়াতের পরিপন্থী নয় কি? এর কয়েকটি জওয়াব দেয়া হয়। এক. প্রকৃত সালাত আদায়কারীকে সালাত অবশ্যই অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে দূরে রাখবে। হাসান ও কাতাদাহ বলেন, যার সালাত তাকে অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে দূরে রাখল না সে সালাত দ্বারা আল্লাহ থেকে দূরেই রয়ে গেল! [তাবারী] দুই. ইবন কাসীর বলেন, এর অর্থ যারা নিয়মিত সালাত আদায় করবে, তাদের এ অবস্থাটি তৈরী হবে। হাদীসে এসেছে, এক লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলল, অমুক লোক রাতে সালাত আদায় করে, আর সকাল হলে চুরি করে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, অচিরেই তার সালাত তাকে তা থেকে নিষেধ করবে। [মুসনাদে আহমাদ: ২/৪৪৭]

[৫] অর্থাৎ আল্লাহ্র স্মরণ সর্বশ্রেষ্ঠ। এর কয়েকটি অর্থ হতে পারে। এক, আল্লাহ্‌র যিকির সবচেয়ে বড় ইবাদাত। সালাত বড় ইবাদাত হবার কারণ হচ্ছে, এতে আল্লাহর যিকির থাকে। সুতরাং যে সালাতে যিকির বেশী সে সালাত বেশী উত্তম। [ইবন কাসীর; মুয়াসসার] দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ্‌র স্মরণ অনেক বড় জিনিস, সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ। মানুষের কোন কাজ এর চেয়ে বেশী বড় নয়। [তাবারী] এর তৃতীয় অর্থ হচ্ছে, তোমার আল্লাহ্‌কে স্মরণ করার চাইতে আল্লাহ কর্তৃক তোমাকে স্মরণ করা অনেক বেশী বড় জিনিস। [তাবারী] কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন: “তোমরা আমাকে স্মরণ করো আমি তোমাদের স্মরণ করবো।” [সূরা আল-বাকারাহ: ১৫২] কাজেই বান্দা যখন সালাতে আল্লাহকে স্মরণ করবে তখন অবশ্যই আল্লাহও তাকে স্মরণ করবেন। আর বান্দার আল্লাহকে স্মরণ করার তুলনায় আল্লাহর বান্দাকে স্মরণ করা অনেক বেশী উচ্চমানের। বান্দা যখন আল্লাহকে স্মরণ করে, তখন আল্লাহ ওয়াদা অনুযায়ী স্মরণকারী বান্দাকে ফেরেশতাদের সমাবেশেও স্মরণ করেন। আল্লাহর এ স্মরণ ইবাদতকারী বান্দার সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত। এ স্থলে অনেক সাহাবী ও তাবেয়ী থেকে এই অর্থই বর্ণিত আছে। এই অর্থের দিক দিয়ে এতে এদিকেও ইঙ্গিত আছে যে, সালাত পড়ার মধ্যে গোনাহ থেকে মুক্তির আসল কারণ হল আল্লাহ্ স্বয়ং সালাত আদায়কারীর দিকে অভিনিবেশ করেন এবং ফেরেশতাদের সমাবেশে তাকে স্মরণ করেন। [দেখুন, বাগভী]

৩০ : ১৭
فَسُبْحَانَ اللَّهِ حِينَ تُمْسُونَ وَحِينَ تُصْبِحُونَ

কাজেই [১] তোমরা আল্লাহ্‌র পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর যখন তোমরা সন্ধ্যা কর এবং যখন তোমরা ভোর কর,

ফুটনোট

[১] এখানে ف শব্দটি পূর্ববতী বাক্যের জন্য কারণ সূচক। [আত-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর] তাই অনুবাদ করা হয়েছে, “কাজেই”। আয়াতে তাসবীহ, তাহমীদ দ্বারা যিকর উদ্দেশ্য হতে পারে। [সা’দী] তাছাড়া সালাত উত্তমরূপেই আয়াতের মধ্যে দাখিল আছে বলা যায়। [কুরতুবী]] এ কারণেই কোন কোন আলেম বলেন, এই আয়াতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ও সেসবের সময়ের বর্ণনা আছে। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমাকে কেউ জিজ্ঞেস করল, কুরআনে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের স্পষ্ট উল্লেখ আছে কি? তিনি বললেন, “হ্যাঁ। অতঃপর তিনি প্রমাণ হিসেবে এই আয়াত পেশ করলেন।

فَسُبْحٰنَ اللّٰهِ حِيْنَ تُمْسُوْنَ

এর অর্থ মাগরিবের সালাত, وَحِيْنَ تُصْبِحُوْنَ শব্দে ফজরের সালাত, عشياً দ্বারা আসরের সালাত এবং حين تظهرون শব্দে যোহরের সালাত উল্লেখিত হয়েছে। অন্য এক আয়াতে

وَمِنْ م بَعْدِصِاوٰةِالْعِشَآءِ

[সূরা আন-নূর:৫৮] এশার সালাতের কথা এসেছে।” [মুস্তাদরাকে হাকিম: ২/৪৪৫, নং ৩৫৪১] অবশ্য হাসান বসরী রাহেমাহুল্লাহর মতে حِيْنَ تُمْسُوْنَ শব্দে মাগরিব ও এশা উভয় সালাতই উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। [বাইহাকী, সুনানুল কুবরা: ১/৩৫৯] সে হিসেবে এ সূরাতেই সমস্ত সালাতের উল্লেখ আছে বলা যায়। এ ছাড়াও সালাতের ওয়াক্ত সম্পর্কে কুরআন মজিদে আরো যেসব ইশারা করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে: “সালাত কায়েম করো সূর্য ঢলে পড়ার পর থেকে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত এবং ফজরের সময় কুরআন পাঠ করো।” [সূরা আল-ইসরা:৭৮] আরো এসেছে, “আর সালাত কায়েম করো দিনের দুই মাথায় এবং রাতের কিছু অংশে।” [সূরা হূদ, ১১৪] অন্যত্র এসেছে, “আর তোমার রবের প্রশংসা সহকারে তাঁর মহিমা ও পবিত্ৰতা ঘোষণা করো সূর্য উদিত হবার আগে এবং তার অস্ত যাবার আগে। আর রাতের কিছু সময়ও আল্লাহর মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করো এবং দিনের প্রান্তভাগেও " [সূরা ত্বা-হা, ১৩০] এভাবে সারা দুনিয়ার মুসলিমরা আজ যে পাঁচটি সময়ে সালাত পড়ে থাকে কুরআন মজীদ বিভিন্ন স্থানে সে সময়গুলোর প্রতি ইংগিত করেছে।

৩০ : ১৮
وَلَهُ الْحَمْدُ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَعَشِيًّا وَحِينَ تُظْهِرُونَ

এবং বিকেলে, আর যখন তোমরা দুপুরে উপনীত হও। আর তাঁরই জন্য সমস্ত প্রশংসা আসমানে ও যমীনে।
ফুটনোট

৩২ : ১৫
إِنَّمَا يُؤْمِنُ بِآيَاتِنَا الَّذِينَ إِذَا ذُكِّرُوا بِهَا خَرُّوا سُجَّدًا وَسَبَّحُوا بِحَمْدِ رَبِّهِمْ وَهُمْ لَا يَسْتَكْبِرُونَ ۩

শুধু তারাই আমাদের আয়াতসমূহের উপর ঈমান আনে, যারা সেটার দ্বারা উপদেশপ্রাপ্ত হলে সিজ্‌দায় লুটিয়ে পড়ে এবং তাদের রবের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে, আর তারা অহংকার করে না।
ফুটনোট

৩২ : ১৬
تَتَجَافَىٰ جُنُوبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ خَوْفًا وَطَمَعًا وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ

তাদের পার্শ্বদেশ শয্যা হতে দূরে থাকে [১] তারা তাদের রবকে ডাকে আশংকা ও আশায় [২] এবং আমরা তাদেরকে যে রিযিক দান করেছি তা থেকে তারা ব্যয় করে।

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ আয়েশ-আরাম করে রাত কাটাবার পরিবর্তে তারা নিজেদের রবের ইবাদাত করে। তাদের অবস্থা এমনসব দুনিয়াপূজারীদের মতো নয় যাদের দিনের পরিশ্রমের কষ্ট দূর করার জন্য রাতে নাচ-গান, শরাব পান ও খেলা তামাশার মতো আমোদ প্রমোদের প্রয়োজন হয়। এর পরিবর্তে তাদের অবস্থা হচ্ছে এই যে, সারা দিন নিজেদের দায়িত্ব পালন করে কাজ শেষে এসে দাঁড়ায় তারা নিজেদের রবের সামনে। তাঁকে স্মরণ করে রাত কাটিয়ে দেয়। তাঁর ভয়ে কাঁপতে থাকে এবং তাঁর কাছেই নিজেদের সমস্ত আশা-আকাংখা সমৰ্পণ করে। [দেখুন, মুয়াসসার, কুরতুবী, বাগভী]

[২] আয়াতে মুমিনগণের এক গুণ এই বলে বর্ণনা করা হয়েছে যে, তাদের শরীরের পার্শ্বদেশ শয্যা থেকে আলাদা থাকে এবং শয্যা পরিত্যাগ করে আল্লাহর যিকর ও দো'আয় আত্মনিয়োগ করে। কেননা, এরা মহান আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও শাস্তিকে ভয় করে এবং তাঁর করুণা ও পূণ্যের আশা করে থাকে। আশা-নিরাশাপূর্ণ এ অবস্থা তাদেরকে যিকর ও দো’আর জন্য ব্যাকুল করে রাখে। অধিকাংশ মুফাসসিরগণের মতে শয্যা পরিত্যাগ করে যিকর ও দো'আয় আত্মনিয়োগ করার অর্থ তাহাজ্জুদ ও নফল সালাত যা ঘুম থেকে উঠার পর গভীর রাতে পড়া হয়। হাদীসের অপরাপর বর্ণনা থেকেও এর সমর্থন পাওয়া যায়। মা'আয ইবনে জাবাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একদা নবীজীর সঙ্গে সফরে ছিলাম, সফরকালে একদিন আমি আরজ করলাম; ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাকে এমন কোন আমল বলে দিন যার মাধ্যমে আমি জান্নাত লাভ করতে পারি এবং জাহান্নাম থেকে অব্যাহতি পেতে পারি। তিনি বললেন, তুমি তো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বস্তু প্রার্থনা করেছ। কিন্তু আল্লাহ পাক যার জন্যে তা সহজ করে দেন তার পক্ষে তা লাভ করা অতি সহজ। অতঃপর বললেন, সে আমল এই যে, আল্লাহর ইবাদাত করবে এবং তাঁর সাথে কোন অংশীদার স্থাপন করবে না। সালাত প্রতিষ্ঠা করবে, যাকাত প্ৰদান করবে, সাওম রাখবে এবং বায়তুল্লাহ শরীফের হজ সম্পন্ন করবে। অতঃপর তিনি বললেন, এসো, তোমাকে পুণ্য দ্বারের সন্ধান দিয়ে দেই, (তা এই যে,) সাওম হচ্ছে ঢাল স্বরূপ (যা শাস্তি থেকে মুক্তি দেয়)। আর সদকা মানুষের পাপানল নির্বাপিত করে দেয়। অনুরূপভাবে মানুষের গভীর রাতের সালাত; এই বলে কোরআন মজীদের উল্লেখিত আয়াত তেলাওয়াত করেন। [তিরমিয়ী: ২৬১৬, ইবনে মাজাহঃ ৩৯৭৩, মুসনাদে আহমাদ: ৫/২৩১]

সাহাবী আবুদ্দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, প্রখ্যাত তাবেয়ী কাতাদাহ ও যাহহাক রাহেমাহুমাল্লাহ বলেন যে, সেসব লোকও শয্যা থেকে শরীরের পার্শ্বদেশ পৃথক হয়ে থাকা গুণের অধিকারী, যারা এশা ও ফজর উভয় সালাত জামা'আতের সাথে আদায় করেন। প্রখ্যাত সাহাবী আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত আছে, উল্লেখিত আয়াত যারা এশার সালাতের পূর্বে শয্যা গ্ৰহণ না করে, এশার জামাতের জন্য প্রতীক্ষারত থাকেন, তাদের সম্পর্কেই নাযিল হয়েছে। [আবু দাউদ: ১৩২১, তিরমিয়ী: ৩১৯৬] ইবনে-কাসীর ও অন্যান্য তাফসীরকারগণ বলছেন যে, এসব বক্তব্যের মধ্যে পরস্পর কোন বিরোধ নেই। প্রকৃতপক্ষে এরা সকলেই এ আয়াতের অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে শেষরাতের সালাতই সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী।

৩৮ : ১৮
إِنَّا سَخَّرْنَا الْجِبَالَ مَعَهُ يُسَبِّحْنَ بِالْعَشِيِّ وَالْإِشْرَاقِ

নিশ্চয় আমরা অনুগত করেছিলাম পর্বতমালাকে, যেন এগুলো সকাল- সন্ধ্যায় তার সাথে আমার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে,
ফুটনোট

৩৮ : ৩৫
قَالَ رَبِّ اغْفِرْ لِي وَهَبْ لِي مُلْكًا لَا يَنْبَغِي لِأَحَدٍ مِنْ بَعْدِي ۖ إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ

তিনি বললেন, ‘হে আমার রব! আমাকে ক্ষমা করুন এবং আমাকে দান করুন এমন এক রাজ্য [১] যা আমার পর আর কারও জন্যই প্রযোজ্য হবে না। নিশ্চয় আপনি পরম দাতা।'

ফুটনোট

[১] অধিকাংশ তাফসীরবিদের মতে এ দোআর অর্থ এই যে, আমার পরেও কেউ যেন এরূপ সাম্রাজ্যের অধিকারী না হয়। সুতরাং বাস্তবেও তাই দেখা যায় যে, সুলাইমান আলাইহিস সালাম-কে যেরূপ সাম্রাজ্য দান করা হয়েছিল, তেমন রাজত্বের অধিকারী পরবর্তীকালে কেউ হতে পারেনি। কেননা, বাতাস অধীনস্থ হওয়া, জিন জাতি বশীভূত হওয়া এগুলো পরবর্তীকালে কেউ লাভ করতে পারেনি। সুলাইমান আলাইহিস সালাম জিনদের উপর যেরূপ সর্বব্যাপী রাজত্ব কায়েম করেছিলেন তদ্রুপ কেউ কায়েম করতে পারেনি। এক হাদীসে এসেছে, এক দুষ্ট জিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সালাত নষ্ট করতে চাইলে তিনি সেটাকে বেঁধে রাখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সুলাইমান আলাইহিস সালামের এ দোআর কথা স্মরণ করে তার সম্মানে তা করা ত্যাগ করেন। [দেখুন, বুখারী: ৩৪২৩]

৩৯ :
أَمَّنْ هُوَ قَانِتٌ آنَاءَ اللَّيْلِ سَاجِدًا وَقَائِمًا يَحْذَرُ الْآخِرَةَ وَيَرْجُو رَحْمَةَ رَبِّهِ ۗ قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ ۗ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُولُو الْأَلْبَابِ

যে ব্যক্তি রাতের বিভিন্ন প্রহরে [১] সিজ্‌দাবনত হয়ে ও দাঁড়িয়ে আনুগত্য প্রকাশ করে, আখিরাতকে ভয় করে [২] এবং তার রবের অনুগ্রহ প্রত্যাশা করে, (সে কি তার সমান, যে তা করে না?) বলুন, 'যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান?' বোধশক্তি সম্পন্ন লোকেরাই শুধু উপদেশ গ্ৰহণ করে।

ফুটনোট

[১] اٰنَآءَالَّيْلِ এর অর্থ রাত্রির প্রহরসমূহ। অর্থাৎ রাত্রির শুরুভাগ, মধ্যবর্তী ও শেষাংশ। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন: যে ব্যক্তি হাশরের ময়দানে সহজ হিসাব কামনা করে, তার উচিত হবে আল্লাহ যেন তাকে রাত্রির অন্ধকারে সেজদারত ও দাঁড়ানো অবস্থায় পান। তার মধ্যে আখেরাতের চিন্তা এবং রহমতের প্রত্যাশাও থাকা দরকার। কেউ কেউ মাগরিব ও এশার মধ্যবর্তী সময়কেও آناءاليل বলেছেন [ইবন কাসীর, তাবারী।]

[২] তবে মৃত্যুর সময় আশাকে প্রাধান্য দিতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যাক্তির মৃত্যুর সময় তার কাছে প্রবেশ করে বললেন, তোমার কেমন লাগছে? লোকটি বলল, আমি আশা করছি এবং ভয়ও পাচ্ছি। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এ দুটি বস্তু অর্থাৎ আশা এবং ভয় যে অন্তরে এ সময় একত্রিত হবে আল্লাহ তাকে তার আশার বিষয়টি দিবেন এবং ভয়ের বিষয়টি থেকে দূরে রাখবেন [তিরমিয়ী: ৯৮৩]

৪১ : ৩৭
وَمِنْ آيَاتِهِ اللَّيْلُ وَالنَّهَارُ وَالشَّمْسُ وَالْقَمَرُ ۚ لَا تَسْجُدُوا لِلشَّمْسِ وَلَا لِلْقَمَرِ وَاسْجُدُوا لِلَّهِ الَّذِي خَلَقَهُنَّ إِنْ كُنْتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ

আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে রাত ও দিন, সূর্য ও চাঁদ। তোমরা সূর্যকে সিজ্‌দা করো না, চাঁদকেও নয় [১]; আর সিজ্‌দা কর আল্লাহ্‌কে, যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন, যদি তোমরা কেবলমাত্র তাঁরই ইবাদত কর।

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ এসব আল্লাহর প্রতিভূ নয় যে এগুলোর আকৃতিতে আল্লাহ নিজেকে প্রকাশ করছেন বলে মনে করে তাদের ইবাদত করতে শুরু করবে। বরং এগুলো আল্লাহর নিদর্শন এসব নিদর্শন নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করলে তোমরা বিশ্ব জাহান ও তার ব্যবস্থাপনার সত্যতা ও বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারবে এবং এ কথাও জানতে পারবে যে নবী-রাসূল আলাইহিমুস সালাম আল্লাহ সম্পর্কে যে তাওহীদের শিক্ষা দিচ্ছেন তাই প্রকৃত সত্য। সূর্য ও চাঁদের উল্লেখের পূর্বে দিন ও রাতের উল্লেখ করা হয়েছে এ বিষয়ে সাবধান করে দেয়ার জন্য যে রাতের বেলা সূর্যের অদৃশ্য হওয়া ও চাঁদের আবির্ভূত হওয়া এবং দিনের বেলা চাঁদের অদৃশ্য হওয়া ও সূর্যের আবির্ভূত হওয়া সুস্পষ্ট ভাবে এ কথা প্রমাণ করে যে, এ দুটির কোনটিই আল্লাহ বা আল্লাহ প্রতিভূ নয়। উভয়েই তাঁর একান্ত দাস। তারা আল্লাহর আইনের নিগড়ে বাধা পড়ে আবর্তন করছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চাঁদ ও সূর্য সম্পর্কে মানুষের আকীদা-বিশ্বাসকে পরিশুদ্ধ করার জন্য বিভিন্নভাবে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সন্তান ইব্রাহীম মারা গেলে সেদিনই সূর্যগ্রহণ হয়। লোকেরা বলাবলি করতে লাগলো যে, ইব্রাহীমের মৃত্যুর কারণেই সূর্যগ্রহণ হয়েছে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন যে, সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ করো মৃত্যু বা জীবনের জন্য হয় না। বরং এ দুটি আল্লাহর নিদর্শনাবলী থেকে দুটি নিদর্শন; যা তিনি তাঁর বান্দাদের দেখিয়ে থাকেন। সুতরাং যখন তোমরা এরূপ কিছু দেখবে, তখন সালাতের দিকে ধাবিত হবে ৷ [বুখারী: ১০৫৮]

৪৮ : ২৯
مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ ۚ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ ۖ تَرَاهُمْ رُكَّعًا سُجَّدًا يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِنَ اللَّهِ وَرِضْوَانًا ۖ سِيمَاهُمْ فِي وُجُوهِهِمْ مِنْ أَثَرِ السُّجُودِ ۚ ذَٰلِكَ مَثَلُهُمْ فِي التَّوْرَاةِ ۚ وَمَثَلُهُمْ فِي الْإِنْجِيلِ كَزَرْعٍ أَخْرَجَ شَطْأَهُ فَآزَرَهُ فَاسْتَغْلَظَ فَاسْتَوَىٰ عَلَىٰ سُوقِهِ يُعْجِبُ الزُّرَّاعَ لِيَغِيظَ بِهِمُ الْكُفَّارَ ۗ وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ مِنْهُمْ مَغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيمًا

মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল ; আর তার সহচরগণ কাফেরদের প্রতি কঠোর, তাদের পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল ; আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় আপনি তাদেরকে রুকু ও সিজদায় অবনত দেখবেন। তাদের লক্ষণ তাদের মুখমণ্ডলে সিজদার প্রভাবে পরিস্ফুট ; এটাই তাওরাতে তাদের দৃষ্টান্ত। আর ইঞ্জীলে তাদের দৃষ্টান্ত হচ্ছে এমন একটি চারাগাছ, যা থেকে নিৰ্গত হয় কচিপাতা, তারপর তা শক্ত ও পুষ্ট হয় এবং পরে কাণ্ডের উপর দাঁড়ায় দৃঢ়ভাবে যা চাষীর জন্য আনন্দদায়ক। এভাবে আল্লাহ মুমিনদের সমৃদ্ধি দ্বারা কাফিরদের অন্তর্জ্বালা সৃষ্টি করেন। যারা ঈমান আনে এবং সৎকাজ করে আল্লাহ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ক্ষমা ও মহাপ্রতিদানের [১]।

ফুটনোট

[১] منهم অব্যয়টি এখানে সবার মতে বর্ণনামূলক। অর্থ এই যে, যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে, আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে ক্ষমা ও মহাপুরস্কারের ওয়াদা দিয়েছেন। এ থেকে প্রথমতঃ জানা গেল যে, সব সাহাবায়ে কেরামই ঈমান এনেছেন সৎকর্ম করতেন। দ্বিতীয়তঃ তাদের সবাইকে ক্ষমা ও মহাপুরষ্কারের ওয়াদা দেয়া হয়েছে। তিনি তাদের উপর সস্তুষ্টি হয়েই এ ঘোষণা দিয়েছেন। আল্লাহর সন্তুষ্টির এই ঘোষণা নিশ্চয়তা দেয় যে, তারা সবাই মৃত্যু পর্যন্ত ঈমান ও সৎকর্মের উপর কায়েম থাকবেন। কারণ, আল্লাহ আলীম ও খবীর তথা সর্বজ্ঞ। যদি কারও সম্পর্কে তার জানা থাকে যে, সে ঈমান থেকে কোনো না কোনো সময় মুখ ফিরিয়ে নেবে, তবে তার প্রতি আল্লাহ স্বীয় সস্তুষ্টি ঘোষণা করতে পারেন না। ইবন আবদুল বার রাহেমাহুল্লাহ বলেন, “আল্লাহ যার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান, তার প্রতি এরপর কখনও অসন্তুষ্ট হন না।’ এই আয়াতের ভিত্তিতেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, বাই’আতে-রিদওয়ানে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কেউ জাহান্নামে যাবে না। [আবু দাউদ: ৪০৩৪] [আরো দেখুন- ইবন কাসীর]

৫০ : ৩৯
فَاصْبِرْ عَلَىٰ مَا يَقُولُونَ وَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ قَبْلَ طُلُوعِ الشَّمْسِ وَقَبْلَ الْغُرُوبِ

অতএব তারা যা বলে তাতে আপনি ধৈর্য ধারণ করুন এবং আপনার রবের সপ্ৰশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন সূর্যোদয়ের আগে ও সূর্যাস্তের আগে [১],

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলার তসবীহ (পবিত্ৰতা বর্ণনা) করা। মুখে হোক কিংবা সালাতের মাধ্যমে হোক। এ কারণেই কেউ কেউ বলেন, সূর্যোদয়ের পূর্বে তসবিহ করার অর্থ ফজরের সালাত এবং সূর্যাস্তের পূর্বে তসবীহ করার মানে আছরের সালাত। [ফাতহুল কাদীরা] এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, চেষ্টা কর, যাতে তোমার সূর্যোদয়ের পূর্বের এবং সূর্যাস্তের পূর্বের সালাতগুলো ছুটে না যায়, অর্থাৎ, ফজর ও আছরের সালাত। এর প্রমাণ হিসেবে তিনি উপরোক্ত আয়াত তেলাওয়াত করেন। [বুখারী: ৫৭৩] তাছাড়া সে সব তসবিহাও আয়াতের অন্তর্ভুক্ত, যেগুলো সকাল-বিকাল পাঠ করার প্রতি সহীহ হাদীসসমূহে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে।

৫০ : ৪০
وَمِنَ اللَّيْلِ فَسَبِّحْهُ وَأَدْبَارَ السُّجُودِ

আর তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন রাতের একাংশে এবং সালাতের পরেও [১]।

ফুটনোট

[১] মুজাহিদ বলেন, এখানে فسبح বলে ফরয সালাত বোঝানো হয়েছে এবং وَاَنْبَارَالسُّجُوْدِ বা সালাতের পশ্চাতে বলে সেই সব তসবিহ বোঝানো হয়েছে, যেগুলোর ফযিলত প্রত্যেক ফরয সালাতের পর হাদীসে বর্ণিত আছে। [কুরতুবী,কাগভী] রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরয সালাতের পর ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ ৩৩ বার আল্লাহু আকবার এবং একবার লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুয়া 'আলা কুল্লি শাইয়িন কাদির’ পাঠ করবে, তার গোনাহ মাফ করা হবে। যদিও তা সমুদ্রের ঢেউয়ের সমান হয়। [মুয়াত্তা:৪৩৯, মুসলিম: ৯৩৯]

৫১ : ১৭
كَانُوا قَلِيلًا مِنَ اللَّيْلِ مَا يَهْجَعُونَ

তারা রাতের সামান্য অংশই অতিবাহিত করত নিদ্রায় [১],

ফুটনোট

[১] يَهْجَعُوْنَ শব্দটি هجوع থেকে উদ্ভূত। এর অর্থ রাত্রিতে নিদ্রা যাওয়া। এখানে মুমিন মুত্তাকীদের এই গুণ বৰ্ণনা করা হয়েছে যে, তারা আল্লাহ তা'আলার ইবাদতে রাত্রি অতিবাহিত করে, কম নিদ্রা যায় এবং অধিক জাগ্রত থাকে। যারা তাদের রাতসমূহ পাপ-পঙ্কিলতা ও অশ্লীল কাজ-কর্মে ডুবে থেকে কাটায় এবং তারপরও মাগফিরাত প্রার্থনা করার চিন্তাটুকু পর্যন্ত তাদের মনে জাগে না। এরা তাদের শ্রেণীভুক্ত ছিল না। কোন কোন মুফাসসির বলেন: এখানে ما শব্দটি “না’ বোধক অর্থ দেয় এবং আয়াতের অর্থ এই যে, তারা রাত্রির অল্প অংশে নিদ্রা যায় না এবং সেই অল্প অংশে সালাত, দো'আ ইত্যাদি ইবাদতে অতিবাহিত করে। এই অর্থের দিক দিয়ে যে ব্যক্তি রাত্রির শুরুতে অথবা শেষে অথবা মধ্যস্থলে যে কোন অংশে ইবাদত করে নেয় সে এই আয়াতের অন্তর্ভুক্ত। এ কারণেই আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, “যে ব্যক্তি মাগরিব ও এশার মধ্যবর্তী সময়ে সালাত পড়ে সে এই আয়াতের অন্তর্ভুক্ত ৷” [আবু দাউদ: ১৩২২] ইমাম আবু জাফর বাকের রাহেমাহুল্লাহ বলেনঃ যে ব্যক্তি এশার সালাতের পূর্বে নিদ্রা যায় না, আয়াতে তাকেও বোঝানো হয়েছে। [ইবনে কাসীর]

৫১ : ১৮
وَبِالْأَسْحَارِ هُمْ يَسْتَغْفِرُونَ

আর রাতের শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করত [১],

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ মুমিন মুত্তাকীগণ রাত্রির শেষ প্রহরে গোনাহের কারণে ক্ষমাপ্রার্থনা করে। তারা রাতের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আল্লাহর ইবাদাতে ব্যয় করতো এবং এরপরও রাতের শেষাংশে আপন প্রভুর কাছে এই বলে ক্ষমা প্রার্থনা করতো যে, আপনার যতটুকু ইবাদাত বন্দেগী করা আমাদের কর্তব্য ছিল তা করতে আমাদের ত্রুটি হয়েছে। [ইবনে কাসীর]

রাতের শেষ প্রহরে ক্ষমাপ্রার্থনা করার ফয়ীলতা অন্য এক আয়াতেও বর্ণিত হয়েছেঃ وَالْمُسْتَغْفِرِينَ بِالْأَسْحَارِ [সূরা আলে ইমরান :১৭] হাদীসে বর্ণিত আছে যে, আল্লাহ তা'আলা প্রত্যেক রাত্রির শেষ তৃতীয়াংশে দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন। তখন তিনি ঘোষণা করেনঃ কোন তওবাকারী আছে কি, যার তওবা আমি কবুল করব? কোন ক্ষমাপ্রার্থনাকারী আছে কি, যাকে আমি ক্ষমা করব? [বুখারী: ১১৪৫, ৬৩২১, ৭৪৯৪ মুসলিম: ৭৫৮]

৫২ : ৪৮
وَاصْبِرْ لِحُكْمِ رَبِّكَ فَإِنَّكَ بِأَعْيُنِنَا ۖ وَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ حِينَ تَقُومُ

আর আপনি ধৈর্যধারণ করুন আপনার রবের সিদ্ধান্তের উপর ; নিশ্চয় আপনি আমাদের চক্ষুর সামনেই রয়েছেন [১]। আপনি আপনার রবের সপ্ৰশংসা পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন যখন আপনি দণ্ডায়মান হন [২],

ফুটনোট

[১] শক্ৰদের শক্রতা-বিরোধিতার পরিপ্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে সূরার উপসংহারে প্রথমে বলা হয়েছে যে, আপনি আমার দৃষ্টিতে আছেন। অর্থাৎ আল্লাহর চোখে আপনার হেফাযতে আছে। আপনাকে তিনি তাদের প্রত্যেক অনিষ্ট থেকে বাঁচিয়ে রাখবেন। [দেখুন, কুরতুবী] অন্য এক আয়াতে আছে وَاللّٰهُ يَعْصِحُكَ مِنَ النَّاسِ “আল্লাহ মানুষের অনিষ্ট থেকে আপনার হেফাযত করবেন।” [সূরা আল-মায়িদাহ':৬৭]

[২] এরপর আল্লাহ তা'আলার সপ্ৰশংস পবিত্ৰতা ঘোষণায় আত্মনিয়োগ করার আদেশ দেয়া
হয়েছে, যা মানবজীবনের আসল লক্ষ্য এবং প্রত্যেক বিপদ থেকে বেঁচে থাকার প্ৰতিকারও। বলা হয়েছে, আল্লাহর সপ্ৰশংস পবিত্ৰতা ঘোষণা করুন যখন আপনি দণ্ডায়মান হন। এখানে تقوم বা “দণ্ডায়মান হন”। একথাটির কয়েকটি অর্থ হতে পারে এবং এখানে সবগুলো অর্থ গ্রহণীয় হওয়া অসম্ভব নয়। একটি অর্থ হচ্ছে, আপনি যখনই কোন মজলিস থেকে উঠবেন আল্লাহর প্রশংসা ও তাসবীহ করে উঠবেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও এ নির্দেশ পালন করতেন এবং মুসলিমদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে তারা যেন কোন মজলিস থেকে উঠার সময় আল্লাহর প্রশংসা ও তাসবীহ পাঠ করে। এভাবে সেই মজলিসে যেসব কথাবার্তা হয়েছে তার কাফফারা হয়ে যায়। হাদীসে এসেছে, যে ব্যক্তি কোন মজলিসে বসল এবং সেখানে অনেক বাকবিতণ্ডা করল সে

سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوبُ إِلَيْكَ

যদি ঊঠে যাওয়ার সময় বলে “হে আল্লাহ্‌ ! আমি আপনার প্রশংসাসহ তাসবীহ পাঠ করছি। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি ছাড়া কোন হক্ক মা’বুদ নেই। আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি এবং আপনার কাছে তাওবা করছি।” [তিরমিয়ী: ৩৪৩৩, মুসনাদে আহমাদ: ২/৪৯৪] তাহলে সেখানে যেসব ভুল ত্রুটি হবে আল্লাহ তা মাফ করে দেবেন। আতা ইবনে আবী রাবাহ রাহেমাহুল্লাহ বলেন, তুমি যখন মজলিস থেকে ওঠ, তখন তাসবীহ ও তাহমীদ কর। তুমি এই মজলিসে কোন সৎকাজ করে থাকলে তার পুণ্য অনেক বেড়ে যাবে। পক্ষান্তরে কোন পাপ কাজ করে থাকলে এই বাক্য তার কাফফারা হয়ে যাবে। এর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, যখন তোমরা ঘুম থেকে জেগে বিছানা ছাড়বে। তখন তাসবীহসহ তোমার রবের প্রশংসা কর। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটিও নিজে আমল করতেন এবং ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর একথাগুলো বলার জন্য সাহাবীদের শিক্ষা দিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি রাত্রে জাগ্রত হয়ে এই বাক্যগুলো পাঠ করে, সে যে দো’আই করে, তা-ই কবুল হয়। বাক্যগুলো এইঃ

لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ، وَلَهُ الْحَمْدُ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ‏.‏ الْحَمْدُ لِلَّهِ، وَسُبْحَانَ اللَّهِ، وَلاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ، وَاللَّهُ أَكْبَرُ، وَلاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِاللَّهِ‏.

‘(একমাত্র লা-শরীক আল্লাহ ব্যতীত হক কোন ইলাহ নেই, তাঁর জন্যই যাবতীয় রাজত্ব, তাঁরই জন্য যাবতীয় প্রশংসা। আর তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান। পবিত্র ও মহান আল্লাহ, সমস্ত প্ৰশংসা আল্লাহরই, তিনি ব্যতীত আর কোন হক ইলাহ নেই, এবং তিনিই মহান। আর আল্লাহ ব্যতীত কোন বাঁচার পথ নেই, কোন শক্তিও নেই)” তারপর বলল, হে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করে দিন, অথবা দো'আ করল, তার দোআ কবুল করা হবে। তারপর যদি সে ওযু করে সালাত পড়ে, তবে তার সালাত কবুল করা হবে। [বুখারী: ১১৫৪],

এর তৃতীয় অর্থ হচ্ছে, আপনি যখন সালাতের জন্য দাঁড়াবেন তখন আল্লাহর হামদ ও তাসবীহ দ্বারা তার সূচনা করুন। এ হুকুম পালনের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, তাকবীর তাহরীমার পর সালাত শুরু করবে একথা বলে,

سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ تَبَارَكَ اسْمُكَ وَتَعَالَى جَدُّكَ وَلاَ إِلَهَ غَيْرُكَ [মুসলিম: ৩৯৯]

এর চতুর্থ অর্থ হচ্ছে, যখন আপনি আল্লাহর পথে আহবান জানানোর জন্য প্রস্তুত হবেন তখন আল্লাহর প্রশংসা ও তাসবীহ দ্বারা তার সূচনা করুন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ নির্দেশটিও স্থায়ীভাবে পালন করতেন। তিনি সবসময় আল্লাহর প্রশংসা দ্বারা তার খুতবা শুরু করতেন। তাফসীর বিশারদ ইবনে জারীর এর আরো একটি অর্থ বর্ণনা করেছেন। সে অর্থটি হচ্ছে, আপনি যখন দুপুরের আরামের পর উঠবেন তখন সালাত পড়বেন। অৰ্থাৎ যোহরের সালাত। [কুরতুবী]

৫২ : ৪৯
وَمِنَ اللَّيْلِ فَسَبِّحْهُ وَإِدْبَارَ النُّجُومِ

আর তাঁর পবিত্ৰতা ঘোষণা করুন রাতের বেলা [১] ও তারকার অস্ত গমনের পর [২]।

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ রাত্রে পবিত্ৰতা ঘোষণা করুন। এর অর্থ মাগরিব, ইশা এবং তাহাজ্জুদের সালাত। সাথে সাথে এর দ্বারা কুরআন তিলাওয়াত, সাধারণ তাসবীহ পাঠ এবং আল্লাহর যিকরও বুঝানো হয়েছে। [দেখুন, কুরতুবী]

[২] অর্থাৎ তারকা অস্তমিত হওয়ার পর। এখানে ফজরের সালাত ও তখনকার তাসবীহ পাঠ বোঝানো হয়েছে। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, এখানে ফজরের সালাতের পূর্বের দু' রাকাআত সুন্নাত সালাতকে বুঝানো হয়েছে। এ দু' রাকাআত সালাতের ব্যাপারে হাদীসে বহু তাগীদ দেয়া হয়েছে। [কুরতুবী] হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন সুন্নাত সালাতের ব্যাপারে ফজরের দু' রাকাআত সুন্নাত সালাতের চেয়ে বেশী গুরুত্ব দিতেন না। [বুখারী: ১১৬৯, মুসলিম: ৯৪] অপর হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “ফজরের দু' রাকাআত সালাত দুনিয়া ও তাতে যা আছে তার থেকেও উত্তম”। [মুসলিমঃ ৯৬]

৫৩ : ৬২
فَاسْجُدُوا لِلَّهِ وَاعْبُدُوا ۩

অতএব আল্লাহকে সিজদা কর এবং তাঁর ‘ইবাদাত কর [১]।

ফুটনোট

[১] এসব আয়াতের দাবি এই যে, তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে বিনয় ও নম্রতা সহকারে নত হও এবং সেজদা কর ও একমাত্র তাঁরই ইবাদত কর। [মুয়াসসার] ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত আছে যে, সূরা নাজমের এই আয়াত পাঠ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেজদা করলেন এবং তার সাথে সব মুসলিম, মুশরিক, জিন ও মানব সেজদা করল। [বুখারী: ৪৮৬২] অপর এক হাদীসে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বৰ্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূরা নজম পাঠ করত তেলাওয়াতের সেজদা আদায় করলে তার সাথে উপস্থিত সকল মুমিন ও মুশরিক সেজদা করল, একজন কোরাইশী বৃদ্ধ ব্যতীত। সে একমুষ্টি মাটি তুলে নিয়ে কপালে স্পর্শ করে বললঃ আমার জন্য এটাই যথেষ্ট। [বুখারী: ১০৬৭, ১০৭০, মুসলিম: ৫৭৬] আবদুল্লাহ ইবনে-মসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ এই ঘটনার পর আমি বৃদ্ধকে কাফের অবস্থায় নিহত হতে দেখেছি। সে ছিল উমাইয়া ইবনে খালাফ ৷ [বুখারী: ৪৮৬৩] |

৫৯ : ১০
وَالَّذِينَ جَاءُوا مِنْ بَعْدِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلًّا لِلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ

আর যারা তাদের পরে এসেছে [১], তারা বলে, ‘হে আমাদের রব ! আমাদেরকে ও ঈমানে অগ্রণী আমাদের ভাইদেরকে ক্ষমা করুন এবং যারা ঈমান এনেছিল তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে বিদ্বেষ রাখবেন না। হে আমাদের রব! নিশ্চয় আপনি দয়ার্দ্র, পরম দয়ালু।’

ফুটনোট

[১] এই আয়াতের بعد অর্থে সাহাবায়ে কিরাম মুহাজির ও আনসারগণের পরে কিয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী সকল মুসলিম শামিল আছে এবং এ আয়াত তাদের সবাইকে “ফায়” এর মালে হকদার সাব্যস্ত করেছে। [ইবন কাসীর, ফাতহুল কাদীর] তবে ইমাম মালেক বলেন, যারা সাহাবায়ে কিরামের জন্য কোন প্রকার বিদ্বেষ পোষণ করবে বা তাদেরকে গালি দেবে তারা ‘ফায়’ এর সম্পপদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। [বাগভী]

৬২ :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَاةِ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَىٰ ذِكْرِ اللَّهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ ۚ ذَٰلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ

হে ঈমানদারগণ ! জুমু’আর দিনে [১] যখন সালাতের জন্য ডাকা হয় [২] তখন তোমারা আল্লাহর স্বরণে ধাবিত হও [৩] এবং কেনা-বেচা ত্যাগ কর, এটাই তোমাদের জন্য সর্বোত্তম, যদি তোমারা জানতে।

ফুটনোট

[১] এই দিনটি মুসলিমদের সমাবেশের দিন। তাই এই দিনকে "ইয়াওমুল জুম'আ' বলা হয়। এই দিনের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন হাদীসে এসেছে; যেমন, "আল্লাহ তা'আলা নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল ও সমস্ত জগৎকে ছয়দিনে সৃষ্টি করেছেন। এই ছয়দিনের শেষদিন ছিল জুম'আর দিন [মুসলিম: ২৭৮৯]

আরও এসেছে, “যে দিনগুলোতে সূৰ্য উদিত হয় তন্মধ্যে সবচেয়ে উত্তম দিন হচ্ছে, জুম'আর দিন। এই দিনেই আদম আলাইহিস সালাম সৃজিত হন, এই দিনেই তাকে জান্নাতে দাখিল করা হয় এবং এই দিনেই জান্নাত থেকে পৃথিবীতে নামানো হয়। আর কেয়ামত এই দিনেই সংঘটিত হবে।” [মুসলিম: ৮৫৪] আরও এসেছে, “এই দিনে এমন একটি মুহূর্ত আছে, যাতে মানুষ যে দো'আই করে, তাই কবুল হয় [বুখারী:১৯৩৫, মুসলিম: ৮৫২]

আল্লাহ তা'আলা প্রতি সপ্তাহে মানবজাতির সমাবেশ ও ঈদের জন্যে এই দিন রেখেছিলেন। কিন্তু পূৰ্ববতীর্ণ উম্মতরা তা পালন করতে ব্যর্থ হয়। ইয়াহুদীরা "ইয়াওমুস সাব্‌ত” তথা শনিবারকে নিজেদের সমাবেশের দিন নির্ধারিত করে নেয় এবং নাসারারা রবিবারকে। আল্লাহ তা'আলা এই উম্মতকে তওফীক দিয়েছেন যে, তারা শুক্রবারকে মনোনীত করেছে। অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “আমরা সবশেষে এসেও কিয়ামতের দিন অগ্রণী হব। আমরাই প্রথম জান্নাতে প্ৰবেশ করব। যদিও তাদেরকে আমাদের আগে কিতাব দেয়া হয়েছিল, আর আমাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদের পরে। কিন্তু তারা এতে মতভেদে লিপ্ত হয়েছে। অতঃপর আল্লাহ আমাদেরকে তাদের মতভেদপূর্ণ বিষয়ে সঠিক পথ দিয়েছেন। এই যে দিনটি, তারা এতে মতভেদ করেছে। অত:পর আল্লাহ আমাদেরকে এ দিনের সঠিক হেদায়াত করেছেন। তা হলো, জুম'আর দিন। সুতরাং আজ আমাদের, কাল ইয়াহুদীদের। আর পরশু নাসারাদের।” [বুখারী: ৮৭৬, মুসলিম: ৮৫৫]

সম্ভবত ইয়াহুদীদের আলোচনার পর পবিত্র কুরআনের জুম'আর আলোচনার কারণ এটাই যে, তাদের ইবাদতের যুগ শেষ হয়ে যাওয়ায় এখন কেবলমাত্র মুসলিমদের ইবাদতের দিনের প্রতি গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। আর তা হচ্ছে জুম'আর দিন। মূর্খতাযুগে শুক্রবারকে "ইয়াওমে আরূবা’ বলা হত। বলা হয়ে থাকে যে, আরবে কা'ব ইবনে লুয়াই সর্বপ্রথম এর নাম "ইয়াওমুল জুমুআ’ রাখেন। কারণ, জুম'আ শব্দটির অর্থ একত্রিত করা। এই দিনে কুরাইশদের সমাবেশ হত এবং কাব ইবনে লুয়াই ভাষণ দিতেন। সারকথা এই যে, ইসলাম পূর্বকালেও ক’ব ইবনে লুয়াই-এর আমলে শুক্রবার দিনকে গুরুত্ব দান করা হত। তিনিই এই দিনের নাম জুমআর দিন রেখেছিলেন। কিন্তু সহীহ হাদীসে পাওয়া যায় যে, “আদম আলাইহিস সালামের সৃষ্টিকে এই দিন একত্রিত করা হয়েছিল বলেই এই দিনকে জুম'আ নামকরণ করা হয়েছে।” [মুস্তাদরাকে হাকিম: ১/৪১২, নং: ১০২৮, সহীহ ইবনে খুযাইমাহ ৩/১১৮, নং: ১৭৩২, ত্বাবরানী: মুজামুল কাবীর ৬/২৩৭ নং ৬০৯২, মুজামুল আওসাত্ম: ১/২৫০, নং ৮২১, মাজমাউয যাওয়ায়িদ: ২/৩৯০]

[২] نودي অর্থ যখন ডাকা হয়। এখানে খোতবার আযান বোঝানো হয়েছে। [ফাতহুল কাদীর, বাগভী] সায়েব ইবনে ইয়াযীদ বলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগ, আবু বকর এবং উমরের যুগে জুম'আর দিনে ইমাম যখন মিম্বরে বসত তখন প্রথম আযান দেয়া হত। তারপর যখন উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর যুগ আসল এবং মানুষ বেড়ে গেল তখন তৃতীয় আহবানটি তিনি বাড়িয়ে দেন” [বুখারী: ৯১২]

[৩] আয়াতে বর্ণিত فاسْعَوْا শব্দের এক অর্থ দৌঁড়ানো এবং অপর অর্থ কোন কাজ গুরুত্ব সহকারে করা। এখানে এই অর্থ উদ্দেশ্য। কারণ, সালাতের জন্যে দৌড়ে আসতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন, “প্রশাস্তি ও গাম্ভীৰ্য সহকারে সালাতের জন্যে গমন কর।” [বুখারী: ৬৩৬, মুসলিম: ৬০২]

আয়াতের অর্থ এই যে, জুমআর দিনে জুমআর আযান দেয়া হলে আল্লাহর যিকিরের দিকে গুরুত্বসহকারে যাও। অর্থাৎ সালাত ও খোতবার জন্যে মসজিদে যেতে যত্নবান হও। যে ব্যক্তি দৌঁড় দেয়, সে যেমন অন্য কোন কাজের প্রতি মনোযোগ দেয় না, তোমরাও তেমনি আযানের পর সালাত ও খোতবা ব্যতীত অন্য কাজের দিকে মনোযোগ দিও না। এখানে যিকার’ বলে জুম'আর সালাত এবং এই সালাতের অন্যতম শর্ত খোতবাও বোঝানো হয়েছে। বহু হাদীসে জুম'আর দিনে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মসজিদে হাযির হওয়ার গুরুত্ব বর্ণিত হয়েছে। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যে জুম'আর দিনে জানাবত তথা অপবিত্র অবস্থা থেকে পবিত্র হওয়ার মত গোসল করবে, তারপর (প্রথম ঘণ্টায়) মসজিদে হাজির হবে সে যেন একটি উট কুরবানী করল। আর যে ব্যক্তি দ্বিতীয় ঘণ্টায় গেল সে যেন গরু কুরবানী করল। যে তৃতীয় ঘন্টায় গেল সে যেন শিংওয়ালা ছাগল কুরবানী করল। যে চতুর্থ ঘন্টায় গেল সে যেন মুরগী উৎসর্গ করল। যে পঞ্চম ঘন্টায় গেল সে যেন ডিম উৎসর্গ করল। তারপর যখন ইমাম বের হয়ে যায় তখন ফেরেশতারা (লিখা বন্ধ করে) ইমামের কাছে হাযির হয়ে যিকর (খুতবা) শুনতে থাকে।” [বুখারী: ৮৮১]

তাছাড়া এটা অনেকের নিকট দো'আ কবুল হওয়ার সময়। এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “জুম'আর দিনে এমন একটি সময় আছে কোন মুসলিম যদি সে সময়ে আল্লাহর কাছে কোন কল্যাণ চায় তবে অবশ্যই তিনি তাকে সেটা দিবেন”। [বুখারী: ৬৪০০]

৬৬ :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا تُوبُوا إِلَى اللَّهِ تَوْبَةً نَصُوحًا عَسَىٰ رَبُّكُمْ أَنْ يُكَفِّرَ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيُدْخِلَكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ يَوْمَ لَا يُخْزِي اللَّهُ النَّبِيَّ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ ۖ نُورُهُمْ يَسْعَىٰ بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَبِأَيْمَانِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا أَتْمِمْ لَنَا نُورَنَا وَاغْفِرْ لَنَا ۖ إِنَّكَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

হে মুমিনগণ ! তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা কার---বিশুদ্ধ তাওবা [১]; সম্ভবত তোমাদের রব তোমাদের পাপসমূহ মোচন করে দেবেন এবং তোমাদেরকে প্রবেশ করবেন জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। সেদিন আল্লাহ লাঞ্ছিত করবেন না নবীকে এবং তার সাথে যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে। তাদের নূর তাদের সামনে ও ডানে ধাবিত হবে। তারা বলবে, ‘হে আমাদের রব! আমাদের জন্য আমাদের নূরকে পূর্ণতা দান করুন এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন, নিশ্চয় আপনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।'

ফুটনোট

[১] তাওবার শাব্দিক অর্থ ফিরে আসা। উদ্দেশ্য গোনাহ থেকে ফিরে আসা। কুরআন ও সুন্নাহর পরিভাষায় তওবার অর্থ বিগত গোনাহের জন্যে অনুতপ্ত হওয়া এবং ভবিষ্যতে তার ধারে কাছে না যাওয়ার দৃঢ় সংকল্প করা। আয়াতে বর্ণিত نصوح শব্দটির বিভিন্ন অর্থ হয়ে থাকে। এক. যদি نصحة থেকে উদ্ভূত ধরা হয়, তবে এর অর্থ খাঁটি করা। আর যদি نصاحة থেকে উদ্ভূত ধরা হয়, তবে এর অর্থ বস্ত্র সেলাই করা ও তালি দেয়া। প্রথম অর্থের দিক দিয়ে "তাওবাতুন নাসূহ" এর অর্থ এমন তাওবা, যা রিয়া ও নাম-যশ থেকে খাঁটি-কেবল আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি অর্জন ও আযাবের ভয়ে ভীত হয়ে এবং গোনাহের কারণে অনুতপ্ত হয়ে গোনাহ পরিত্যাগ করা। দ্বিতীয় অর্থের দিক দিয়ে "তাওবাতুন নাসূহ" শব্দটি এই উদ্দেশ্য ব্যক্ত করার জন্যে হবে যে, গোনাহের কারণে সৎকর্মের ছিন্নবস্ত্রে তাওবা তালি সংযুক্ত করে। কোন কোন তাফসীরবিদ বলেনঃ “তাওবাতুন নাসূহ" হল মুখে ক্ষমাপ্রার্থনা করা, অন্তরে অনুশোচনা করা এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ভবিষ্যতে সেই গোনাহ থেকে দূরে রাখা। [দেখুন-কুরতুবী]

৭০ : ২২
إِلَّا الْمُصَلِّينَ

তবে সালাত আদায়কারীগণ ছাড়া [১] ,

ফুটনোট

[১] আয়াতে সালাত আদায়কারীদের গুণাবলী বৰ্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, যে সালাত আদায়কারী সর্বদা সালাত প্রতিষ্ঠাকারী। এখানে সালাত প্রতিষ্ঠার অর্থ ইবনে মাসউদ, মাসরুক ও ইবরাহীম নাখ‘য়ী এর মতে, সালাতকে তার ওয়াক্তে ফরয-ওয়াজিব খেয়াল রেখে আদায় করা। কোন কোন মুফাসসিরের মতে এখানে সালাত প্রতিষ্ঠার অর্থ, সমগ্ৰ সালাতেই সালাতের দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ রাখা; এদিক সেদিক না তাকানো। সাহাবী ওকবা ইবনে আমের বলেন, উদ্দেশ্য এই যে, যে ব্যক্তি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সালাতের দিকেই নিবিষ্ট থাকে এবং ডানে বামে ও আগে পিছে তাকায় না। [ইবন কাসীর]

৭০ : ২৩
الَّذِينَ هُمْ عَلَىٰ صَلَاتِهِمْ دَائِمُونَ

যারা তাদের সালাতে সর্বদা প্রতিষ্ঠিত [১] ,

ফুটনোট

[১] আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কাছে প্রবেশ করে এক মহিলা দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এ মহিলা কে? তিনি বললেন, অমুক (অন্য বর্ণনায় এসেছে, তার নাম ছিল হাওলা বিনতে তুয়াইত) তারপর তিনি তার প্রচুর সালাত আদায়ের কথা বলছিলেন –তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, থাম, তোমরা যা (সব সময়) করতে সক্ষম হবে ততটুকুই নিজের উপর ঠিক করে নিবে। আল্লাহ্র শপথ, যতক্ষণ তোমরা নিজেরা ক্লান্ত হবে না ততক্ষণ আল্লাহ্ও দিতে ক্ষান্ত হবেন না।” আর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে সেই কাজটি সবচেয়ে প্রিয় ছিল যা কেউ সব সময় করে। [বুখারী: ৪৩, মুসলিম: ৭৮৫, মুসনাদে আহমাদ: ৬/৫১, ২৩১] অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শা‘বান মাস ব্যতীত আর কোন মাসে এত বেশী সাওম পালন করতেন না। তিনি পুরো শা‘বান মাসই সাওম পালন করতেন। তিনি বলতেন, “তোমরা যে কাজ (সর্বদা) করতে সক্ষম হবে তাই করবে; কেননা, তোমরা বিরক্ত হলেও আল্লাহ্ (প্রতিদান প্রদানে) ক্ষান্ত হন না।” (অথবা হাদীসের অর্থ, তোমরা বিরক্ত না হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ্ বিরক্ত হন না। তখন বিরক্ত হওয়া আল্লাহ্র একটি গুণ হিসেবে বিবেচিত হবে, তবে যেভাবে তা তাঁর সম্মানের সাথে উপযোগী সেভাবে তা সাব্যস্ত করতে হবে। [মাজুমূ ‘ফাতাওয়া ইবন উসাইমীন: ১/১৭৪]) আর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে সে সালাতই সবচেয়ে প্রিয় ছিল যার আদায়কারী তা সর্বক্ষণ করতে থাকত। যদিও তার পরিমাণ কম হয়। তিনি নিজেও কোন কাজ করলে সেটা সবসময় করতেন।” [বুখারী: ১৯৭০]

৭১ : ২৬
وَقَالَ نُوحٌ رَبِّ لَا تَذَرْ عَلَى الْأَرْضِ مِنَ الْكَافِرِينَ دَيَّارًا

নূহ্ আরও বলেছিলেন, ‘হে আমার রব! যমীনের কাফিরদের মধ্য থেকে কোন গৃহবাসীকে অব্যাহতি দেবেন না [১]।

ফুটনোট

[১] আয়াতটির এক অর্থ হচ্ছে, যমীনে বিচরণকারী কাফেরদের কাউকে রেহাই দিবেন না। [মুয়াসসার] অপর অর্থ আপনি যমীনের বুকে কোন গৃহবাসী কাফেরকে অবশিষ্ট রাখবেন না। [জালালাইন] কাতাদাহ রাহেমাহুল্লাহ বলেন, তিনি ঐ সময় পর্যন্ত তাদের উপর বদদো’আ করেননি যতক্ষণ তার কাছে

اَنه، اِنْ يُّؤْمِنَ مِنْ قَوْمِكَ اِلَّا مَنْ قَدْاٰمَنَ فَلَا تَبْتَىِٕسْ بِمَاكَانُوْايِفْعَلُوْنَ

‘যারা ঈমান এনেছে তারা ছাড়া আপনার সম্প্রদায়ের অন্য কেউ কখনো ঈমান আনবে না। কাজেই তারা যা করে তার জন্য আপনি দুঃখিত হবেন না।’ [সূরা হূদ: ৩৬] এ বাণী তাকে শুনিয়ে দেয়া হয়েছে। যখন তিনি স্পষ্টই জানতে পারলেন যে, তারা আর ঈমান আনবেনা তখন তিনি এ দো‘আ করেছিলেন। [কুরতুবী]

৭১ : ২৮
رَبِّ اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِمَنْ دَخَلَ بَيْتِيَ مُؤْمِنًا وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَلَا تَزِدِ الظَّالِمِينَ إِلَّا تَبَارًا

‘হে আমার রব! আপনি ক্ষমা করুন আমাকে, আমার পিতামাতাকে এবং যারা মুমিন হয়ে আমার ঘরে প্রবেশ করে তাদেরকে এবং মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে; আর যালিমদের শুধু ধ্বংসই বৃদ্ধি করুন।’
ফুটনোট

৭৩ :
قُمِ اللَّيْلَ إِلَّا قَلِيلًا

রাতে সালাতে দাঁড়ান [১] , কিছু অংশ ছাড়া

ফুটনোট

[১] এখানে বিশেষভঙ্গিতে সম্বোধন করে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে তাহাজ্জুদের আদেশ করা হয়েছে। বিভিন্ন বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে, আলোচ্য আয়াতসমূহ ইসলামের শুরুতে এবং কুরআন অবতরণের প্রাথমিক যুগে অবতীর্ণ হয়েছে। তখন পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয ছিল না। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত মে‘রাজের রাত্ৰিতে ফরয হয়েছিল। এই আয়াতে তাহাজ্জুদের সালাত কেবল ফরযই করা হয়নি; বরং তাতে রাত্রির কমপক্ষে এক চতুর্থাংশ মশগুল থাকাও ফরয করা হয়েছে। আয়াতের মূল আদেশ হচ্ছে কিছু অংশ বাদে সমস্ত রাত্রি সালাতে মশগুল থাকা। এই আদেশ পালনার্থে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম অধিকাংশ রাত্রি তাহাজ্জুদের সালাতে ব্যয় করতেন। ফলে তাদের পদদ্বয় ফুলে যায় এবং আদেশটি বেশ কষ্টসাধ্য প্রতীয়মান হয়। পূর্ণ এক বছর পর এই সূরার শেষাংশ فَاقْرَءُوْاٰمَاتَيَسَّرَ مِنْهُ অবতীর্ণ হলে দীর্ঘক্ষণ সালাতে দন্ডায়মান থাকার বাধ্যবাধকতা রহিত করে দেয়া হয় এবং বিষয়টি ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিয়ে ব্যক্ত করা হয় যে, যতক্ষণ সালাত আদায় করা সহজ মনে হয়, ততক্ষণ সালাত আদায় করাই তাহাজ্জুদের জন্যে যথেষ্ট। [ইমাম মুসলিম এই বিষয়বস্তু আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণনা করেন, হাদীস নং: ৭৪৬]

৭৩ :
نِصْفَهُ أَوِ انْقُصْ مِنْهُ قَلِيلًا

আধা-রাত বা তার চেয়েও কিছু কম।
ফুটনোট

৭৩ :
أَوْ زِدْ عَلَيْهِ وَرَتِّلِ الْقُرْآنَ تَرْتِيلًا

অথবা তার চেয়েও একটু বাড়ান। আর কুরআন তিলাওয়াত করুন ধীরে ধীরে সুস্পষ্টভাবে [১];

ফুটনোট

[১] এখানে বলা হয়েছে যে, তারতীল সহকারে পড়তে হবে। ترتيل বলে উদ্দেশ্য হলো ধীরে ধীরে সঠিকভাবে বাক্য উচ্চারণ করা। অর্থাৎ কুরআনের শব্দগুলো ধীরে ধীরে মুখে উচ্চারণ করার সাথে সাথে তা উপলব্ধি করার জন্য গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনাও করতে হবে। [ইবন কাসীর] আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কুরআন পাঠের নিয়ম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, শব্দগুলোকে টেনে টেনে পড়তেন। উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ পড়ে বললেন যে, তিনি আল্লাহ, রাহমান এবং রাহীম শব্দকে মদ্দ করে বা টেনে পড়তেন।’ [বুখারী: ৫০৪৬] উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে একই প্রশ্ন করা হলে তিনি বললেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক একটি আয়াত আলাদা আলাদা করে পড়তেন এবং প্রতিটি আয়াত পড়ে থামতেন। তিনি ‘আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন’ বলে থামতেন। তারপর ‘আর-রাহমানির রাহীম’ বলে থামতেন। তারপর ‘মালিকি ইয়াওমিদ্দীন’ বলে থামতেন। [মুসনাদে আহমাদ: ৬/৩০২. আবু দাউদ: ১৪৬৬, তিরমিযী: ২৯২৭] হুযায়ফা ইবনে ইয়ামান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণনা করেন, একদিন রাতে আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সালাত পড়তে দাঁড়ালাম। আমি দেখলাম, তিনি এমনভাবে কুরআন তেলাওয়াত করছেন যে, যেখানে তাসবীহের বিষয় আসছে সেখানে তিনি তাসবীহ পড়ছেন, যেখানে দো‘আর বিষয় আসছে সেখানে দো‘আ করছেন এবং যেখানে আল্লাহ্র কাছে আশ্রয় প্রার্থনার বিষয় আসছে সেখানে তিনি আশ্রয় প্রার্থনা করছেন। [মুসলিম:৭৭২] আবু যার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণনা করেন, একবার রাতের সালাতে কুরআন তেলাওয়াত করতে করতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন এ আয়াতটির কাছে পৌঁছলেন “আপনি যদি তাদের শাস্তি দেন, তবে তারা আপনারই বান্দা। আর যদি আপনি তাদের ক্ষমা করে দেন, তাহলে আপনি পরাক্রমশালী ও বিজ্ঞ” তখন তিনি বার বার এ আয়াতটিই পড়তে থাকলেন এবং এভাবে ভোর হয়ে গেল। [মুসনাদে আহমাদ: ৫/১৪৯] সাহাবী ও তাবেয়ীগণেরও এই অভ্যাস ছিল। তাছাড়া, যথাসম্ভব সুললিত স্বরে তিলাওয়াত করাও তারতীলের অন্তর্ভুক্ত। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে নবী সশব্দে সুললিত স্বরে তেলাওয়াত করেন, তার কেরাআতের মত অন্য কারও কেরাআত আল্লাহ্ তা‘আলা শুনেন না। [বুখারী: ৫০২৩, ৫০২৪] তবে পরিস্কার ও বিশুদ্ধ উচ্চারণসহ শব্দের অন্তর্নিহিত অর্থ চিন্তা করে তদ্বারা প্রভাবান্বিত হওয়াই আসল তারতীল। অনুরূপভাবে সুন্দর করে পড়াও এর অংশ। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যে কুরআনকে সুন্দর স্বরে পড়ে না সে আমার দলভুক্ত নয়।’ [বুখারী: ৭৫২৭] অন্য হাদীসে এসেছে, “তোমরা কুরআনকে তোমাদের সুর দিয়ে সৌন্দর্যমণ্ডিত কর” [ইবনে মাজাহঃ ১৩৪২] আবু মুসা আল-আশ‘আরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু সুমিষ্ট স্বরে কুরআন পাঠ করতেন বিধায় রাসূল তার প্রশংসা করে বলেছিলেন, “তোমাকে দাউদ পরিবারের সুর দেয়া হয়েছে" ৷ [বুখারী: ৫০৪৮, মুসলিম: ৭৯৩] তাছাড়া হাদীসে আরও এসেছে, “কিয়ামতের দিন কুরআনের অধিকারীকে বলা হবে, তুমি পড় এবং আরোহন করতে থাক। সেখানেই তোমার স্থান হবে যেখানে তোমার কুরআন পড়ার আয়াতটি শেষ হবে।” [আবুদাউদ: ১৪৬৪, তিরমিয়ী: ২৯১৪]

৭৫ : ৩১
فَلَا صَدَّقَ وَلَا صَلَّىٰ

সুতরাং সে বিশ্বাস করে নি এবং সালাতও আদায় করে নি।

ফুটনোট

‘দ্বিতীয় রুকূ’

৭৬ : ২৫
وَاذْكُرِ اسْمَ رَبِّكَ بُكْرَةً وَأَصِيلًا

আর আপনার রবের নাম স্মরণ করুন সকালে ও সন্ধ্যায়।
ফুটনোট

২৬ : ২৬
قَالَ رَبُّكُمْ وَرَبُّ آبَائِكُمُ الْأَوَّلِينَ

মূসা বললেন, ‘তিনি তোমাদের রব এবং তোমাদের পূর্বপুরুষদেরও রব।’
ফুটনোট

৯৬ : ১০
عَبْدًا إِذَا صَلَّىٰ

এক বান্দাকে [১]- যখন তিনি সালাত আদায় করেন।

ফুটনোট

[১] বান্দা বলতে এখানে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বুঝানো হয়েছে। [কুরতুবী] এ পদ্ধতিতে কুরআনের কয়েক জায়গায় তার উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন “পবিত্র সেই সত্তা যিনি তাঁর বান্দাকে নিয়ে গিয়েছেন এক রাতে মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসার দিকে।” [সূরা আল-ইসরা: ১]। আরও এসেছে, “সমস্ত প্রশংসা সেই সত্তার যিনি তাঁর বান্দার ওপর নাযিল করেছেন কিতাব।” [সূরা আল-কাহফ: ১] আরও বলা হয়েছে, “আর আল্লাহ্র বান্দা যখন তাঁকে ডাকার জন্য দাঁড়ালো তখন লোকেরা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তৈরি হলো।” [সূরা আল-জিন: ১৯]

৯৬ : ১৯
كَلَّا لَا تُطِعْهُ وَاسْجُدْ وَاقْتَرِبْ ۩

কখনো নয়! আপনি তার অনুসরণ করবেন না। আর আপনি সিজ্দা করুন এবং নিকটবর্তী হোন [১]।

ফুটনোট

[১] এতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- কে আদেশ করা হয়েছে যে, আবু জাহলের কথায় কৰ্ণপাত করবেন না এবং সেজদা ও সালাতে মশগুল থাকুন। সিজদা করা মানে সালাত আদায় করা। অর্থাৎ হে নবী ! আপনি নিৰ্ভয়ে আগের মতো সালাত আদায় করতে থাকুন। এর মাধ্যমে নিজের রবের নৈকট্য লাভ করুন। কারণ, এটাই আল্লাহ্ তা‘আলার নৈকট্য অর্জনের উপায়। [কুরতুবী] রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “বান্দা যখন সেজদায় থাকে, তখন তার পালনকর্তার অধিক নিকটবর্তী হয়। তাই তোমরা সেজদায় বেশী পরিমাণে দো‘আ কর।” [মুসলিম: ৪৮২, আবুদাউদ: ৮৭৫, নাসায়ী: ২/২২৬, মুসনাদে আহমাদ: ২/৩৭০] অন্য এক হাদীসে আরও বলা হয়েছে, “সেজদার অবস্থায় কৃত দো‘আ কবুল হওয়ার যোগ্য” । [মুসলিম: ৪৭৯, আবু দাউদ: ৮৭৬, নাসায়ী: ২/১৮৯, মুসনাদে আহমাদ: ১/২১৯]

১০৭ :
فَوَيْلٌ لِلْمُصَلِّينَ

কাজেই দুর্ভোগ সে সালাত আদায়কারীদের,
ফুটনোট

১০৭ :
الَّذِينَ هُمْ عَنْ صَلَاتِهِمْ سَاهُونَ

যারা তাদের সালাত সম্বন্ধে উদাসীন,
ফুটনোট

১০৭ :
الَّذِينَ هُمْ يُرَاءُونَ

যারা লোক দেখানোর জন্য তা করে [১] ,

ফুটনোট

[১] এটা মুনাফিকদের অবস্থা। তারা লোক দেখানোর জন্যে এবং মুসলিম হওয়ার দাবী সপ্রমাণ করার জন্য সালাত পড়ে। কিন্তু সালাত যে ফরয, এ বিষয়ে তারা বিশ্বাসী নয়। ফলে সময়ের প্রতিও লক্ষ্য রাখে না এবং আসল সালাতেরও খেয়াল রাখে না। লোক দেখানোর জায়গা হলে পড়ে, নতুবা ছেড়ে দেয়। আর সালাত আদায় করলেও এর ওয়াজিবসমূহ, শর্ত ইত্যাদি পূর্ণ করে না। আসল সালাতের প্রতিই ভ্ৰক্ষেপ না করা মুনাফিকদের অভ্যাস এবং ساهون শব্দের আসল অর্থ তাই। সালাতের মধ্যে কিছু ভুল-ভ্ৰান্তি হয়ে যাওয়ার কথা এখানে বোঝানো হয়নি। কেননা, এজন্যে জাহান্নামের শাস্তি হতে পারে না। এটা উদ্দেশ্য হলে عَنْ صَلَاتِحِمْ এর পরিবর্তে فِىْ صَلَا تِهِمْ বলা হত। সহীহ হাদীস সমূহে প্রমাণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবনেও একাধিকবার সালাতের মধ্যে ভুলচুক হয়ে গিয়েছিল। [কুরতুবী, ইবন কাসীর]

১০৮ :
فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ

কাজেই আপনি আপনার রবের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করুন এবং কুরবানী করুন [১]।

ফুটনোট

[১] نحر শব্দের অর্থ উট কুরবানী করা। এর প্রচলিত পদ্ধতি হচ্ছে হাত-পা বেঁধে কণ্ঠনালীতে বর্শা অথবা ছুরি দিয়ে আঘাত করা এবং রক্ত বের করে দেয়া। গরু-ছাগল ইত্যাদির কুরবানীর পদ্ধতি যবাই করা। অর্থাৎ জন্তুকে শুইয়ে কণ্ঠনালিতে ছুরি চালিয়ে রক্ত প্রবাহিত করা। আরবে সাধারণতঃ উট কুরবানী করা হতো। তাই কুরবানী বোঝাবার জন্য এখানে نحر শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। মাঝে মাঝে এ শব্দটি যে কোন কুরবানীর অর্থেও ব্যবহৃত হয়। এ আয়াতে পূৰ্ববর্তী আয়াতে প্রদত্ত কাউসারের কারণে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ দু’টি কাজ করতে বলা হয়েছে। এক. একমাত্র আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে সালাত আদায়, দুই. তাঁরই উদ্দেশ্যে কুরবানী করা ও যবাই করা। [আদ্ওয়াউল বায়ান] কেননা, সালাত শারিরীক ইবাদতসমূহের মধ্যে সর্ববৃহৎ এবং কুরবানী আর্থিক ইবাদতসমূহের মধ্যে বিশেষ স্বাতন্ত্র্য ও গুরুত্বের অধিকারী। [বাদায়ি’উত তাফসীর]

0:00
0:00