কুসংস্কার
কুসংস্কার
: ১৯১
الَّذِينَ يَذْكُرُونَ اللَّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَىٰ جُنُوبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُونَ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَٰذَا بَاطِلًا سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ

যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে আল্লাহ্‌র স্মরণ করে এবং আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা করে, আর বলে, ‘হে আমাদের রব! আপনি এগুলো অনর্থক সৃষ্টি করেননি [১], আপনি অত্যন্ত পবিত্র, অতএব আপনি আমাদেরকে আগুনের শাস্তি হতে রক্ষা করুন।’

ফুটনোট

[১] সারকথা, আল্লাহ্ তা’আলার সৃষ্টি ও সৃষ্টজগতের উপর চিন্তা-গবেষণা করে তাঁর মাহাত্ম্য ও কুদরাত সম্পর্কে অবগত হওয়া একটি মহৎ ও উচ্চ পর্যায়ের ইবাদাত। সেগুলোর মধ্যে গভীর মনোনিবেশ করে তা থেকে কোন শিক্ষা গ্রহণ না করা একান্তই নির্বুদ্ধিতা। উল্লেখিত আয়াতের শেষ বাক্যে আল্লাহ্‌র নিদর্শনসমূহে চিন্তা গবেষণা করার ফলাফল বাতলে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে

(رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هٰذَا بَاطِلاً)

অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলার সীমাহীন সৃষ্টির উপর যে লোক চিন্তা-ভাবনা করে সে লোক সহজেই বুঝে যে, এসব বস্তু-সামগ্রীকে আল্লাহ নিরর্থক সৃষ্টি করেননি; বরং এসবের সৃষ্টির পেছনে হাজারো তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। সে সমস্তকে মানুষের সেবায় নিয়োজিত করে দিয়ে মানুষকে এ চিন্তা-ভাবনা করার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে যে, সমগ্র পৃথিবী তাদের কল্যাণের জন্য তৈরী করা হয়েছে এবং তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদাতের উদ্দেশ্যে। এটাই হল তাদের জীবনের লক্ষ্য। সুতরাং গোটা বিশ্ব-সৃষ্টি নিরর্থক নয় বরং এগুলো সবই বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহ রাববুল আলামীনের অসীম কুদরাত ও হেকমতেরই প্রকৃষ্ট প্রমাণ। উবাইদ ইবনে উমাইর বলেনঃ আমি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বললাম, রাসূলের সবচেয়ে আশ্চর্য কি কাজ আপনি দেখেছেন, তা আমাদেরকে জানান। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, এক রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, ‘হে আয়েশা, আমাকে আমার রবের ইবাদাত করতে দাও’। আমি বললাম, হে রাসূল, আমি আপনার পাশে থাকতে ভালবাসি এবং যা আপনাকে খুশি করে তা করতে ভালবাসি। তারপর আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওযু করলেন এবং সালাত আদায়ে নিবিষ্ট হলেন ও কাঁদতে থাকলেন। আমি বললাম, হে আল্লাহ্‌র রাসূল, আপনি কাঁদছেন অথচ আল্লাহ আপনার পূর্বাপর সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন? উত্তরে তিনি বললেনঃ আমি কি কৃতজ্ঞ বান্দা হব না? এ রাতে আমার উপর একটি আয়াত নাযিল হয়েছে, যে ব্যক্তি তা তেলাওয়াত করল এবং চিন্তা-গবেষণা করল না, তার ধ্বংস অনিবার্য। তারপর তিনি এ আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন। [সহীহ ইবনে হিব্বানঃ ৬২০]

: ১০৩
مَا جَعَلَ اللَّهُ مِنْ بَحِيرَةٍ وَلَا سَائِبَةٍ وَلَا وَصِيلَةٍ وَلَا حَامٍ ۙ وَلَٰكِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا يَفْتَرُونَ عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ ۖ وَأَكْثَرُهُمْ لَا يَعْقِلُونَ

বাহীরাহ্‌, সায়েবাহ্‌, ওছীলাহ্‌ ও হামী আল্লাহ্‌ প্রবর্তণ করেননি; কিন্তু কাফেররা আল্লাহ্‌র উপর মিথ্যা আরোপ করে এবং তাদের অধিকাংশই বুঝে না [১]।

ফুটনোট

[১] বাহিরাহ, সায়েবাহ, ওহীলাহ, হামী প্রভৃতি সবই জাহেলিয়াত যুগের কুপ্রথা ও কুসংস্কারের সাথে সম্পর্কযুক্ত বিষয়। এগুলোর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তাফসীরবিদদের মধ্যে বিস্তর মতভেদ রয়েছে। তবে আলোচ্য শব্দগুলোর মধ্যে প্রত্যেকটি বিভিন্ন প্রকারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়া সম্ভবপর। আমরা সহীহ বুখারী থেকে সায়ীদ ইবন মূসাইয়্যেবের ব্যাখ্যা উদ্ধৃত করছি- ‘বাহীরাহ’ এমন জন্তুকে বলা হয় যার দুধ প্রতিমার নামে উৎসর্গ করা হত এবং কেউ নিজের কাজে ব্যবহার করত না । ‘সায়েবাহ ঐ জন্তু যাকে প্রতিমার নামে আমাদের দেশে ষাঁড়ের মত ছেড়ে দেয়া হত। ‘হামী’ পুরুষ উট, যে বিশেষ সংখ্যক রমন ক্রিয়া সমাপ্ত করে। এরূপ উটকেও প্রতিমার নামে ছেড়ে দেয়া হত। ‘ওহীলাহ’ যে উষ্ট্রী উপর্যুপরি মাদী বাচ্ছা প্রসব করে। জাহেলিয়াত যুগে এরূপ উষ্ট্রীকেও প্রতিমার নামে ছেড়ে দেয়া হত । [বুখারী ৪৬২৩; অনুরূপ মুসলিম: ২৮৫৬] এসব কর্মকাণ্ড এমনিতেই শির্ক তদুপরি যে জন্তুর গোস্ত, দুধ ইত্যাদি দ্বারা উপকৃত হওয়া আল্লাহর আইনে বৈধ, নিজেদের পক্ষ থেকে শর্তাদি আরোপ করে সে জন্তুকে হালাল ও হারাম করার অধিকার তারা কোথায় পেল? বাস্তবে তারা যেন শরীআত প্রণেতার পদে নিজেরাই আসীন হয়ে গিয়েছিল । আরো অবিচার এই যে, নিজেদের এসব মুশরিকসুলভ কুপ্রথাকে তারা আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি ও নৈকট্যের উপায় বলে মনে করত । এর উত্তরে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ্ তা'আলা কখনও এসব প্রথা নির্ধারণ করেননি; বরং তাদের বড়রা আল্লাহর প্রতি এ অপবাদ আরোপ করেছে এবং অধিকাংশ নির্বোধ জনগণ একে গ্রহণ করে নিয়েছে । [ফাতহুল কাদীর, সা’দী] যারা এরূপ করে তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি । রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আমি আমর ইবন আমের আল-খুজায়ীকে জাহান্নামে তার নিজের অন্ত্র নিয়ে টানাটানি করতে দেখলাম। কেননা, সে প্রথম সায়েবাহ ছেড়েছিল । [বুখারীঃ ৪৬২৩-৪৬২৪, মুসলিমঃ ২৮৫৬, আহমাদঃ ২/২৭৫]

: ১৩১
فَإِذَا جَاءَتْهُمُ الْحَسَنَةُ قَالُوا لَنَا هَٰذِهِ ۖ وَإِنْ تُصِبْهُمْ سَيِّئَةٌ يَطَّيَّرُوا بِمُوسَىٰ وَمَنْ مَعَهُ ۗ أَلَا إِنَّمَا طَائِرُهُمْ عِنْدَ اللَّهِ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لَا يَعْلَمُونَ

অতঃপর যখন তাদের কাছে কোন কল্যাণ আসত, তখন তারা বলত, ‘এটা আমাদের পাওনা।’ আর যখন কোন অকল্যাণ পৌঁছত তখন তারা মূসা ও তার সাথীদেরকে অলক্ষুণে [১] গণ্য করত। সাবধান! তাদের অকল্যাণ তো কেবল আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে; কিন্তু তাদের অনেকেই জানে না।

ফুটনোট

[১] কুলক্ষণ নেয়া কাফের মুশরিকদেরই কাজ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কুলক্ষণ নেয়া শির্ক। [মুসনাদে আহমাদঃ ১/৩৮৯] যুগে যুগে মুশরিকরা ঈমানদারদেরকে কুলক্ষণে, অপয়া ইত্যাদি বলে অভিহিত করত।

২৭ : ৪৭
قَالُوا اطَّيَّرْنَا بِكَ وَبِمَنْ مَعَكَ ۚ قَالَ طَائِرُكُمْ عِنْدَ اللَّهِ ۖ بَلْ أَنْتُمْ قَوْمٌ تُفْتَنُونَ

তারা বলল, ‘তোমাকে ও তোমার সঙ্গে যারা আছে তাদেরকে আমরা অমঙ্গলের কারণ মনে করি [১]।’ সালেহ বললেন, ‘তোমাদের ‘কুলক্ষণ গ্রহণ করা’ আল্লাহ্‌র ইখ্‌তিয়ারে, বস্তুত তোমরা এমন এক সম্প্রদায় যাদেরকে পরীক্ষা করা হচ্ছে [২]।’

ফুটনোট

[১] তাদের উক্তির একটি অর্থ হচ্ছে এই যে, তোমার এ কর্মকাণ্ড আমাদের জন্য বড়ই অমংগলজনক প্রমাণিত হয়েছে। যখন থেকে তুমি ও তোমার সাথীরা পূৰ্বপুরুষদের ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে দিয়েছো তখন থেকেই নিত্যদিন আমাদের উপর কোন না কোন বিপদ আসছে। কারণ আমাদের উপাস্যরা আমাদের প্রতি নারাজ হয়ে গেছে। এ অর্থের দিক দিয়ে আলোচ্য উক্তিটি সেই সব মুশরিক জাতির উক্তির সাথে সামঞ্জস্যশীল, যারা নিজেদের নবীদেরকে অপয়া গণ্য করতো। সূরা ইয়াসীনে একটি জাতির কথা বলা হয়েছে। তারা তাদের নবীদেরকে বললোঃ “আমরা তোমাদের অপয়া পেয়েছি” [১৮] মূসা সম্পর্কে ফির‘আউনের জাতি এ কথাই বলতোঃ “যখন তাদের সুসময় আসতো, তারা বলতো আমাদের এটাই প্রাপ্য আর যখন কোন বিপদ আসতো তখন মুসা ও তার সাথিদের কুলক্ষুণে হওয়াটাকে এ জন্য দায়ী মনে করতো।” [সূরা আল-আ‘রাফঃ ১৩১]

[২] অর্থাৎ তোমরা যা মনে করছো আসল ব্যাপার তা নয়। আসল ব্যাপারটি তোমরা এখনো বুঝতে পারেনি। সেটি হচ্ছে, আমার আসার ফলে তোমাদের পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। যতদিন আমি আসিনি ততদিন তোমরা নিজেদের মূর্খতার পথে চলছিলে। তোমাদের সামনে হক ও বাতিলের কোন সুস্পষ্ট পার্থক্য-রেখা ছিল না। এখন তোমাদের সবাইকে যাচাই ও পরখ করা হবে। অথবা আয়াতের অর্থ, তোমাদের গোনাহের কারণে তোমাদেরকে শাস্তি পেতে হবে। [কুরতুবী]

৪১ : ১৬
فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ رِيحًا صَرْصَرًا فِي أَيَّامٍ نَحِسَاتٍ لِنُذِيقَهُمْ عَذَابَ الْخِزْيِ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا ۖ وَلَعَذَابُ الْآخِرَةِ أَخْزَىٰ ۖ وَهُمْ لَا يُنْصَرُونَ

তারপর আমরা তাদের উপর প্রেরণ করলাম ঝঞ্ঝাবায়ু [১] অশুভ দিনগুলোতে; যাতে আমরা তাদের আস্বাদন করাতে পারি জীবনে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি [২]। আর আখিরাতের শাস্তি তো তার চেয়ে বেশী লাঞ্ছনাদায়ক এবং তাদেরকে সাহায্য করা হবে না।

ফুটনোট

[১] এটা صاعقة এরই ব্যাখ্যা, যা পূর্বের ১৩ নং আয়াতে আদ ও সামুদের صاعقة বলে বর্ণিত
হয়েছে। صاعقة শব্দের আসল অর্থ অচেতন ও বেহুশকারী বস্তু। এ কারণেই বজ্রকেও صاعقة বলা হয়। আকস্মিক বিপদ অর্থেও শব্দটি ব্যবহৃত হয়। আদ সম্প্রদায়ের উপর চাপানো ঝড়ও একটি صاعقة ছিল। একেই এখানে رِمْحًيا صَرْصَرًا নামে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রচণ্ড ঝড়ো বাতাস বুঝাতে এ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কেউ কেউ বলেনঃ এর অর্থ মারাত্মক “লু” প্রবাহ; কেউ কেউ বলেন, এর অর্থ প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাতাস এবং কারো কারো মতে এর অর্থ এমন বাতাস যা প্রবাহিত হওয়ার সময় প্রচণ্ড শব্দ সৃষ্টি হয়। তবে এ অর্থে সবাই একমত যে, শব্দটি প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়। [দেখুন-তবারী] কুরআন মজীদের অন্যান্য স্থানে এ আযাব সম্পর্কে যেসব বিস্তারিত বর্ণনা আছে তা হচ্ছে, এ বাতাস উপর্যুপরি সাত দিন এবং আট রাত পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছিলো। এর প্রচণ্ডতায় মানুষ পড়ে গিয়ে এমনভাবে মৃত্যুবরণ করে এবং মরে মরে পড়ে থাকে যেমন খেজুরের ফাঁপা কাণ্ড পড়ে থাকে [আল-হাকিকাহ: ৭]। এ বাতাস যে জিনিসের ওপর দিয়েই প্রবাহিত হয়েছে তাকেই জরাজীর্ণ করে ফেলেছে [আযযারিয়াত: ৪২]। যে সময় এ বাতাস এগিয়ে আসছিলো তখন আদ জাতির লোকেরা এই ভেবে আনন্দে মেতে উঠেছিলো যে মেঘ চারদিক থেকে ঘিরে আসছে। এখন বৃষ্টি হবে এবং তাদের আশা পূর্ণ হবে। কিন্তু তা এমনভাবে আসলো যে গোটা এলাকাই ধ্বংস করে রেখে গেল। [আল-আহকাফ: ২৪, ২৫]

[২] দাহহাক বলেন, আল্লাহ তা'আলা তাদের উপর তিন বছর পর্যন্ত বৃষ্টিপাত সম্পূর্ণ বন্ধ রাখেন। কেবল প্রবল শুষ্ক বাতাস প্রবাহিত হত। অবশেষে আট দিন ও সাত রাত্রি পর্যন্ত উপর্যুপরি তুফান চলতে থাকে [দেখুন, বাগভী, ফাতহুল কাদীর]

0:00
0:00