তাযকীর - আল্লাহ তা'আলার স্মরণ
তাযকীর - আল্লাহ তা'আলার স্মরণ
: ১৫২
فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ وَاشْكُرُوا لِي وَلَا تَكْفُرُونِ

কাজেই তোমরা আমাকে স্মরণ করো [১], আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করব। আর তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও এবং অকৃতজ্ঞ হয়ে না।

ফুটনোট

[১] যিক্‌র আরবী শব্দ। এর বেশ কয়েকটি অর্থ হতে পারে – (১) মুখ থেকে যা উচ্চারণ করা হয়। (২) অন্তরে কোন কিছু স্মরণ করা। (৩) কোন জিনিস সম্পর্কে সতর্ক করা। শরয়ী পরিভাষায় যিক্‌র হচ্ছে, বান্দা তার রবকে স্মরণ করা। হোক তা তাঁর নাম নিয়ে, গুণ নিয়ে, তাঁর কাজ নিয়ে, প্রশংসা করে, তাঁর কিতাব তিলাওয়াত করে, তাঁর একত্ববাদ ঘোষণা করে, তাঁর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে অথবা তাঁর কাছে কিছু চেয়ে।

যিক্‌র দুই প্রকার। যথা - কওলী বা কথার মাধ্যমে যিক্‌র ও আমলী বা কাজের মাধ্যমে যিক্‌র। প্রথম প্রকার যিক্‌রের মধ্যে রয়েছে - কুরআন তিলাওয়াত, আল্লাহ্‌র সুন্দর সুন্দর নাম ও সিফাতসমূহের আলোচনা ও স্মরণ, তাঁর একত্ববাদ ঘোষণা ইত্যাদি। আর দ্বিতীয় প্রকারে রয়েছে - ইলম অর্জন করা ও শিক্ষা দেয়া, আল্লাহ্‌র হুকুম-আহকাম ও আদেশ-নিষেধ মেনে চলা ইত্যাদি। প্রথম প্রকার যিক্‌রের মধ্যে কিছু যিক্‌র আছে যা সময়, অবস্থা এবং সংখ্যার সাথে সম্পৃক্ত। যেমন, সকাল ও সন্ধ্যার যিক্‌র, সালাতের পরের যিক্‌র, খাওয়ার শুরু-শেষ, কাপড় পরিধান, মসজিদে প্রবেশ-বাহির ইত্যাদি সহ দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজ-কর্মের দোআ বা যিক্‌রসমূহ। যে সকল যিক্‌র অবস্থা, সময় ও সংখ্যার সাথে সম্পৃক্ত সেগুলোর সংখ্যা, সময় অথবা অবস্থা কোনটিরই পরিবর্তন করা জায়েয নেই। যে সকল যিক্‌র এ তিনটির সাথে সম্পৃক্ত নয় অর্থাৎ সাধারণ যিক্‌র, সেগুলো সময়, সংখ্যা অথবা অবস্থার সাথে সম্পৃক্ত করাও জায়েয নেই। ইমাম আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ বলেনঃ ‘মৌখিক যিক্‌রের জন্য কোন নির্দিষ্ট স্থানে একত্রিত হওয়া এবং নির্দিষ্ট শব্দ নির্ধারণ করা বিদ’আত। [ইবনুল হুমাম, শরহে ফাতহুল কাদীরঃ ২/৭২]

যিক্‌র এর ফযীলত অসংখ্য। তন্মধ্যে এটাও কম ফযীলত নয় যে,বান্দা যদি আল্লাহ্‌কে স্মরণ করে, তাহলে আল্লাহ্‌ও তাকে স্মরণ করেন। আবু উসমান নাহ্‌দী রাহেমাহুল্লাহ বলেন, আমি সে সময়টির কথা জানি, যখন আল্লাহ্ তা'আলা আমাদিগকে স্মরণ করেন। উপস্থিত লোকেরা জিজ্ঞেস করল, আপনি তা কেমন করে জানতে পারেন? বললেন, তা এজন্য যে, কুরআনুল কারীমের ওয়াদা অনুসারে যখন কোন মুমিন বান্দা আল্লাহ্‌কে স্মরণ করে, তখন আল্লাহ্‌ নিজেও তাকে স্মরণ করেন। কাজেই বিষয়টি জানা সবার জন্যই সহজ যে, আমরা যখন আল্লাহ্‌র স্মরণে আত্মনিয়োগ করব, আল্লাহ্ তা'আলাও আমাদের স্মরণ করবেন। সায়ীদ ইবনে যুবায়ের রাহিমাহুল্লাহ যিকরুল্লাহ'র তাফসীর প্রসঙ্গে বলেছেন যে, যিক্‌রের অর্থই হচ্ছে আনুগত্য এবং নির্দেশ মান্য করা। তার বক্তব্য হচ্ছেঃ “যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র নির্দেশের আনুগত্য করে না, সে আল্লাহ্‌র যিক্‌রই করে না; প্রকাশ্যে যতবেশী সালাত এবং তাসবীহই সে পাঠ করুক না কেন’। মূলত: যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তা'আলার আনুগত্য করে অর্থাৎ তাঁর হালাল ও হারাম সম্পর্কিত নির্দেশগুলোর অনুসরণ করে, সেই আল্লাহ্‌কে স্মরণ করে, যদি তার নফল সালাত ও সিয়াম কিছু কমও হয়। অন্যদিকে যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র নির্দেশাবলীর বিরুদ্ধাচরণ করে সে সালাত-সিয়াম, তাসবীহ্‌-তাহ্‌লীল প্রভৃতি বেশী করে করলেও প্রকৃতপক্ষে সে আল্লাহ্‌কে স্মরণ করে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেনঃ ‘যে ব্যক্তি যিক্‌র করে এবং যে ব্যক্তি যিক্‌র করেনা তাদের উপমা হচ্ছে জীবিত ও মৃতের ন্যায়’। [বুখারীঃ ২০৮]

অপর এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘তোমাদেরকে কি এমন একটি উত্তম আমলের সংবাদ দেব যা তোমাদের মালিকের নিকট অধিকতর পবিত্র, তোমাদের মর্যাদা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অধিকতর সহায়ক, স্বর্ন ও রৌপ্য ব্যয় করা থেকেও তোমাদের জন্য উত্তম, শত্রুর সাথে মোকাবেলা করে গর্দান দেয়া-নেয়া থেকে উত্তম? তারা বলল, হ্যাঁ অবশ্যই বলবেন। তিনি বললেন, যিকরুল্লাহ’। [তিরমিযীঃ ৫/৪৫৯]

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত এক হাদীসে-কুদসীতে আছে, আল্লাহ্ তাআলা বলেন, ‘বান্দা যে পর্যন্ত আমাকে স্মরণ করতে থাকে বা আমার স্মরণে যে পর্যন্ত তার ঠোঁট নড়তে থাকে, সে পর্যন্ত আমি তার সাথে থাকি’। [বুখারীঃ ৭৪০৫]

মুআয রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, "আল্লাহ্‌র আযাব থেকে মুক্ত করার ব্যাপারে মানুষের কোন আমলই যিক্‌রুল্লাহর সমান নয়’। যুন্‌নূন মিসর বলেনঃ ‘যে ব্যক্তি প্রকৃতই আল্লাহ্‌কে স্মরণ করে সে অন্যান্য সবকিছুই ভুলে যায়। এর বদলায় স্বয়ং আল্লাহ্ তা'আলাই সবদিক দিয়ে তাকে হেফাজত করেন এবং সবকিছুর বদলা তাকে দিয়ে দেন’।

: ১৯৮
لَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَنْ تَبْتَغُوا فَضْلًا مِنْ رَبِّكُمْ ۚ فَإِذَا أَفَضْتُمْ مِنْ عَرَفَاتٍ فَاذْكُرُوا اللَّهَ عِنْدَ الْمَشْعَرِ الْحَرَامِ ۖ وَاذْكُرُوهُ كَمَا هَدَاكُمْ وَإِنْ كُنْتُمْ مِنْ قَبْلِهِ لَمِنَ الضَّالِّينَ

তোমাদের রব-এর অনুগ্রহ সন্ধান করাতে তোমাদের কোন পাপ নেই [১]। সুতরাং যখন তোমরা ‘আরাফাত [২] হতে ফিরে আসবে’ [৩] তখন মাশ’আরুল হারামের [৪] কাছে পৌঁছে আল্লাহ্‌কে স্মরণ করবে এবং তিনি যেভাবে শিক্ষা দিয়েছেন ঠিক সেভাবে তাঁকে স্মরণ করবে। যদিও এর আগে [৫] তোমরা বিভ্রান্তদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে।

ফুটনোট

[১] বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে, জাহেলিয়াতের যুগে ওকায, মাজান্নাহ ও যুল মাজায নামে তিনটি বাজার ছিল। ইসলাম গ্রহণের পর হজের সময় সাহাবীরা সেই বাজারগুলোতে ব্যবসা করা গুনাহ বলে মনে করতে থাকলে আল্লাহ্‌ তা'আলা উক্ত আয়াত নাযিল করেন। অর্থাৎ হজের মৌসুমে সেসব স্থানগুলোতে ব্যবসা করা কোনো দোষের কাজ নয়। [বুখারী: ১৭৭০, ২০৯৮]

[২] আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আল্লাহ্ তা'আলা জিবরীলকে ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালামের কাছে প্রেরণ করে তাকে হজ করান। তারা আরাফাতে পৌছলে ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম বললেন, (عَرَفْتُ) বা আমি চিনতে পেরেছি। কারণ, জিবরীল ‘আলাইহিস সালাম ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালামকে এর পূর্বেই সেখানে একবার নিয়ে এসেছিলেন। আর সে জন্যই সেটার নাম হয় ‘আরাফাত’। [ইবনে কাসীর]

[৩] আব্দুর রহমান ইবনে ইয়ামুর আদ-দীলী বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘হজ হচ্ছে আরাফাত’। তিনি এ কথা তিনবার বললেন। তারপর বললেন, যে ব্যক্তি সুবহে সাদিক উদয় হওয়ার পূর্বেই আরাফায় আসতে সক্ষম হবে সে হজ পেল। আর মিনা হচ্ছে তিন দিন। সুতরাং যদি কেউ দুইদিনে তাড়াতাড়ি করলো তার কোন পাপ নেই এবং যে ব্যক্তি বিলম্ব করলো তারও কোনো পাপ নেই। ' [আবু দাউদ: ১৯৪৯, তিরমিয়ী: ৮৮৯, ইবনে মাজাহ: ৩০১৫, মুসনাদে আহমাদ: ৪/৩০৯,৩১০]

[৪] এখানে ‘মাশ'আরুল হারাম’ বলে মুযদালফা বোঝানো হয়েছে। কারণ, এ অংশ হারাম এলাকার ভিতরে। [ইবনে কাসীর]

[৫] এখানে ‘এর আগে’ বলে ‘হেদায়াত আসার পূর্বে’ বা ‘কুরআনের পূর্বে’ অথবা ‘রাসূল আসার পূর্বে’ এ তিনটি অর্থই হতে পারে। অর্থগুলো পরস্পর কাছাকাছি। [ইবনে কাসীর]

: ২০০
فَإِذَا قَضَيْتُمْ مَنَاسِكَكُمْ فَاذْكُرُوا اللَّهَ كَذِكْرِكُمْ آبَاءَكُمْ أَوْ أَشَدَّ ذِكْرًا ۗ فَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَقُولُ رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا وَمَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ خَلَاقٍ

অতঃপর যখন তোমরা হজ্জের অনুষ্ঠানাদি সমাপ্ত করবে তখন আল্লাহ্‌কে এভাবে স্মরণ করবে যেভাবে তোমরা তোমাদের পিতৃ পুরুষদের স্মরণ করে থাক, অথবা তার চেয়েও অধিক [১]। মানুষের মধ্যে যারা বলে, ‘হে আমাদের রব ! আমাদেরকে দুনিয়াতেই দিন’। আখেরাতে তার জন্য কোনও অংশ নেই।

ফুটনোট

[১] আতা বলেন, এর অর্থ হলো, শিশুরা যেমন পিতা মাতাকে সব সময় স্মরণ করে, তোমরাও হজ শেষ করার পর আল্লাহ্‌ তা'আলাকে তেমনি স্মরণ কর। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, জাহেলিয়াতে হজের সময় একত্রে বসে পরস্পরে বলাবলি করত যে, আমার পিতা একজন অতিথিপরায়ণ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সাধারণের ভালো কাজ করে দিতেন। তিনি মানুষের দিয়াত বা রক্তপণ আদায় করে দিতেন। তাই আল্লাহ্‌ তা'আলা এখানে আল্লাহ্‌র যিক্‌রকে তাদের পিতৃপুরুষের স্মরণের সাথে তুলনা করে বেশী বেশী করে যিক্‌র করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। [ইবনে কাসীর]

: ২০৩
وَاذْكُرُوا اللَّهَ فِي أَيَّامٍ مَعْدُودَاتٍ ۚ فَمَنْ تَعَجَّلَ فِي يَوْمَيْنِ فَلَا إِثْمَ عَلَيْهِ وَمَنْ تَأَخَّرَ فَلَا إِثْمَ عَلَيْهِ ۚ لِمَنِ اتَّقَىٰ ۗ وَاتَّقُوا اللَّهَ وَاعْلَمُوا أَنَّكُمْ إِلَيْهِ تُحْشَرُونَ

আর তোমরা গোনা দিনগুলোতে আল্লাহ্‌কে স্মরণ করবে। অতঃপর যদি কেউ তাড়াতাড়ি করে দুই দিনে চলে আসে তবে তার কোন পাপ নেই এবং যে ব্যক্তি বিলম্ব করে আসে তারও কোন পাপ নেই। এটা তার জন্য যে তাক্‌ওয়া অবলম্বন করে। আর তোমরা আল্লাহ্‌র তাকওয়া অবলম্বন কর এবং জেনে রাখ যে, তোমাদেরকে তাঁর নিকট সমবেত করা হবে।
ফুটনোট

: ২৩৯
فَإِنْ خِفْتُمْ فَرِجَالًا أَوْ رُكْبَانًا ۖ فَإِذَا أَمِنْتُمْ فَاذْكُرُوا اللَّهَ كَمَا عَلَّمَكُمْ مَا لَمْ تَكُونُوا تَعْلَمُونَ

অতঃপর তোমরা যদি বিপদাশংকা কর, তবে পথচারি অথবা আরোহী অবস্থায় সালাত আদায় করবে [১]। অতঃপর তোমরা যখন নিরাপদ বোধ কর তখন আল্লাহ্‌কে স্মরণ করবে, জেভাবে তিনি তমাদের শিক্ষা দিয়েছেন, যা তোমরা জানতে না।

ফুটনোট

[১] সালেহ বিন খাওয়াত ঐ ব্যক্তি থেকে বর্ণনা করেন যিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে ‘যাতুর রিকা’র যুদ্ধে সালাতুল খাওফ বা ভীতির সালাতে অংশ গ্রহণ করেছিলেন তার থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেনঃ (সাহাবাগণের) একদল সালাত আদায়ের জন্য তাঁর (রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর) সাথে কাতারবন্দী হয়ে দাঁড়ালেন এবং আরেক দল শক্রর মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকলেন। তিনি (রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রথমোক্ত দলের সাথে এক রাকাআত সালাত আদায় করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। মোক্তাদীগণ একা একা দ্বিতীয় রাকাআত পড়ে ফিরে গেলেন এবং শক্রর মুখোমুখী হয়ে দাঁড়ালেন। এবার অপর দলটি এসে দাঁড়ালে তিনি (রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদেরকে সাথে নিয়ে অবশিষ্ট (এক) রাকাআত আদায় করে বসে থাকলেন। (দ্বিতীয় দলের) মুক্তাদীগণ নিজে নিজে দ্বিতীয় রাকাআত শেষ করে বসলে তিনি তাদেরকে সংগে নিয়ে সালাম ফিরালেন। [বুখারীঃ ৪১২৯]

: ৪১
قَالَ رَبِّ اجْعَلْ لِي آيَةً ۖ قَالَ آيَتُكَ أَلَّا تُكَلِّمَ النَّاسَ ثَلَاثَةَ أَيَّامٍ إِلَّا رَمْزًا ۗ وَاذْكُرْ رَبَّكَ كَثِيرًا وَسَبِّحْ بِالْعَشِيِّ وَالْإِبْكَارِ

তিনি বললেন, ‘হে আমার রব! আমাকে একটি নিদর্শন দিন [১]। ’ তিনি বললেন, ‘আপনার নিদর্শন এই যে, তিন দিন আপনি ইঙ্গিত ছাড়া কথা বলবেন না [২] আর আপনার রবকে অধিক স্মরণ করুন এবং সন্ধ্যায় ও প্রভাতে তাঁর পবিত্রতা-মহীমা ঘোষণা করুন। ’

ফুটনোট

[১] প্রতিশ্রুত সেই সুসংবাদটি সম্পর্কে বিস্তারিত অবগতি এবং পুত্র জন্মগ্রহণের পূর্বেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশে মশগুল হওয়ার উদ্দেশ্যে যাকারিয়্যা ‘আলাইহিস সালাম নিদর্শন জানতে চেয়েছিলেন। [কাশশাফ; ফাতহুল কাদীর] আল্লাহ্‌ তা'আলা তাকে এ নিদর্শন দিলেন যে, তিন দিন পর্যন্ত তুমি মানুষের সাথে ইশারা-ইঙ্গিত ছাড়া কথা বলতে সমর্থ হবে না। এ নিদর্শনের মধ্যে সূক্ষ্মতা এই যে, কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে নিদর্শন চাওয়া হয়েছিল। আল্লাহ্‌ তা'আলা এমন নিদর্শন দিলেন যে, তাতে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা ছাড়া যাকারিয়্যা ‘আলাইহিস সালাম অন্য কোন কাজের যোগ্যই থাকবেন না [ফাতহুল কাদীর]

[২] এ আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, কথা বলতে অক্ষম হলে ইশারা-ইঙ্গিত কথার স্থলাভিষিক্ত হতে পারে। এক হাদীসে বর্ণিত আছে, নবী কারম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক দাসীকে জিজ্ঞেস করলেনঃ আল্লাহ্‌ কোথায়? উত্তরে সে আকাশের দিকে ইশারা করলে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ এ দাসী মুসলিম। তাকে আযাদ করে দাও। [মুসলিমঃ ৫৩৭]

: ১৯০
إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآيَاتٍ لِأُولِي الْأَلْبَابِ

আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টিতে [১], রাত ও দিনের পরিবর্তনে [২] নিদর্শনাবলী রয়েছে [৩] বোধশক্তি সম্পন্ন লোকদের জন্য।

ফুটনোট

বিশতম রুকূ‘

[১] অর্থাৎ আসমান এবং যমীন সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহ্ তা’আলার এক বিরাট নিদর্শন বিদ্যমান। এ দুয়ের মধ্যে অবস্থিত আল্লাহ্ তা’আলার অসংখ্য সৃষ্টিরাজিকেও এ আয়াত দ্বারা বুঝানো হয়েছে। এ বিরাট সৃষ্টজগতের মধ্যে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত প্রতিটি সৃষ্ট বস্তুই স্ব স্ব সৃষ্টিকর্তার নিদর্শনরূপে দাঁড়িয়ে আছে।

[২] চিন্তা-ভাবনার দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, দিন-রাত্রির আবর্তন। আয়াতে উল্লেখিত (اختلاف) শব্দটি আরবী পরিভাষায়, ‘পরে আসা’ এর অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সেমতে বাক্যের অর্থ হবে, রাত্রির গমন এবং দিবসের আগমন। আবার (اختلاف) শব্দ দ্বারা কম-বেশীও বুঝায়। যেমন, শীতকালে রাত্রি হয় দীর্ঘ এবং দিন হয় খাটো, গরমকালে দিন বড় এবং রাত্রি হয় ছোট। অনুরূপভাবে এক দেশ থেকে অন্য দেশে দিবস এবং রাত্রির দৈর্ঘ্যেও তারতম্য হয়ে থাকে। যেমন, উত্তর মেরুর সন্নিকটবর্তী দেশগুলোতে দিবাভাগ উত্তর মেরু থেকে দুরবর্তী দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশী দীর্ঘ হয়। এসব বিষয়ই আল্লাহ্ তা’আলার অপার কুদরাতের অতি উজ্জ্বল নিদর্শন।

[৩] (اٰية) এর বহুবচন হল (اٰيات)। শব্দটি কয়েকটি অর্থেই ব্যবহৃত হয়। যথা- মু’জিযাকে ‘আয়াত’ বলা হয়। অনুরূপভাবে, কুরআনের বাক্যকেও ‘আয়াত’ বলা হয়। তৃতীয় অর্থে দলীল-প্রমাণ ও নিদর্শনাবলীকে বুঝানো হয়ে থাকে। এখানে তৃতীয় অর্থেই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ এসব বিষয়ের মধ্যে আল্লাহ্ তা’আলার বিরাট নিদর্শনাবলী রয়েছে।

: ১৯১
الَّذِينَ يَذْكُرُونَ اللَّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَىٰ جُنُوبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُونَ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَٰذَا بَاطِلًا سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ

যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে আল্লাহ্‌র স্মরণ করে এবং আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা করে, আর বলে, ‘হে আমাদের রব! আপনি এগুলো অনর্থক সৃষ্টি করেননি [১], আপনি অত্যন্ত পবিত্র, অতএব আপনি আমাদেরকে আগুনের শাস্তি হতে রক্ষা করুন।’

ফুটনোট

[১] সারকথা, আল্লাহ্ তা’আলার সৃষ্টি ও সৃষ্টজগতের উপর চিন্তা-গবেষণা করে তাঁর মাহাত্ম্য ও কুদরাত সম্পর্কে অবগত হওয়া একটি মহৎ ও উচ্চ পর্যায়ের ইবাদাত। সেগুলোর মধ্যে গভীর মনোনিবেশ করে তা থেকে কোন শিক্ষা গ্রহণ না করা একান্তই নির্বুদ্ধিতা। উল্লেখিত আয়াতের শেষ বাক্যে আল্লাহ্‌র নিদর্শনসমূহে চিন্তা গবেষণা করার ফলাফল বাতলে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে

(رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هٰذَا بَاطِلاً)

অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলার সীমাহীন সৃষ্টির উপর যে লোক চিন্তা-ভাবনা করে সে লোক সহজেই বুঝে যে, এসব বস্তু-সামগ্রীকে আল্লাহ নিরর্থক সৃষ্টি করেননি; বরং এসবের সৃষ্টির পেছনে হাজারো তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। সে সমস্তকে মানুষের সেবায় নিয়োজিত করে দিয়ে মানুষকে এ চিন্তা-ভাবনা করার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে যে, সমগ্র পৃথিবী তাদের কল্যাণের জন্য তৈরী করা হয়েছে এবং তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদাতের উদ্দেশ্যে। এটাই হল তাদের জীবনের লক্ষ্য। সুতরাং গোটা বিশ্ব-সৃষ্টি নিরর্থক নয় বরং এগুলো সবই বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহ রাববুল আলামীনের অসীম কুদরাত ও হেকমতেরই প্রকৃষ্ট প্রমাণ। উবাইদ ইবনে উমাইর বলেনঃ আমি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বললাম, রাসূলের সবচেয়ে আশ্চর্য কি কাজ আপনি দেখেছেন, তা আমাদেরকে জানান। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, এক রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, ‘হে আয়েশা, আমাকে আমার রবের ইবাদাত করতে দাও’। আমি বললাম, হে রাসূল, আমি আপনার পাশে থাকতে ভালবাসি এবং যা আপনাকে খুশি করে তা করতে ভালবাসি। তারপর আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওযু করলেন এবং সালাত আদায়ে নিবিষ্ট হলেন ও কাঁদতে থাকলেন। আমি বললাম, হে আল্লাহ্‌র রাসূল, আপনি কাঁদছেন অথচ আল্লাহ আপনার পূর্বাপর সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন? উত্তরে তিনি বললেনঃ আমি কি কৃতজ্ঞ বান্দা হব না? এ রাতে আমার উপর একটি আয়াত নাযিল হয়েছে, যে ব্যক্তি তা তেলাওয়াত করল এবং চিন্তা-গবেষণা করল না, তার ধ্বংস অনিবার্য। তারপর তিনি এ আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন। [সহীহ ইবনে হিব্বানঃ ৬২০]

: ১০৩
فَإِذَا قَضَيْتُمُ الصَّلَاةَ فَاذْكُرُوا اللَّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَىٰ جُنُوبِكُمْ ۚ فَإِذَا اطْمَأْنَنْتُمْ فَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ ۚ إِنَّ الصَّلَاةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ كِتَابًا مَوْقُوتًا

অতঃপর যখন তোমরা সালাত সমাপ্ত করবে তখন দাঁড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করবে [১], অতঃপর যখন তোমরা নিরাপদ হবে তখন যথাযথ সালাত কায়েম করবে [২]; নির্ধারিত সময়ে সালাত কায়েম করা মুমিনদের জন্য অবশ্য কর্তব্য [৩]।

ফুটনোট

[১] ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, আল্লাহ্ তা’আলা যখনই কোন ফরয তার বান্দাদের উপর অবধারিত করে দিয়েছেন তখনই সেটার একটা সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তারপর যারা সেটা করতে সক্ষম হবে না তাদেরকে ভিন্ন পথ বাতলে দিয়েছেন। এর ব্যতিক্রম হচ্ছে, ‘আল্লাহর যিকর’। এই যিকর এর ব্যাপারে যতক্ষণ কেউ সুস্থ বিবেকসম্পন্ন থাকে, ততক্ষণ আল্লাহ তা’আলা কাউকে ওযর আপত্তি পেশ করার সুযোগ দেন নি । সর্বাবস্থায় তাকে যিকর করতে হবে। রাত-দিন, জল-স্থল, সফর-মুকীম, ধনী-দরিদ্র, সুস্থ-অসুস্থ, গোপন-প্রকাশ্য সর্বাবস্থায় আল্লাহর যিকর চালিয়ে যেতে হবে। এ আয়াতের এটাই ভাষ্য। [তাবারী, আত-তাফসীরুস সহীহ]

[২] মুজাহিদ বলেন, এর অর্থ যখন তোমরা নিরাপদ হবে এবং স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করবে, তখন পূর্ণরূপ সালাত আদায় করবে তাবারী অর্থাৎ কেউ যেন মনে না করে বসে যে, তাদের সালাত কমে গেছে বা কম পড়লেও চলবে।

[৩] এখানে নির্ধারিত সময় বলে, সালাতের জন্য আল্লাহ কর্তৃক প্রত্যেক সালাতের জন্য নির্ধারিত ওয়াক্তসমূহকে বোঝানো হয়েছে। এখানে সে ওয়াক্তসমূহ বলে দেয়া হয়নি। পক্ষান্তরে অন্য আয়াতে সেগুলোর বর্ণনা দেয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, “সূর্য হেলে পড়ার পর থেকে রাতের ঘন অন্ধকার পর্যন্ত সালাত কায়েম করুন এবং ফজরের সালাত। নিশ্চয়ই ফজরের সালাত উপস্থিতির সময়”। [সূরা আল-ইসরা: ৭৮]

পাশাপাশি হাদীসে সালাতের ওয়াক্তের বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘সালাতের প্রথম ও শেষ সময় রয়েছে। যোহরের সালাতের প্রথম সময় হচ্ছে যখন সূর্য হেলে যাবে। আর শেষ সময় হচ্ছে, আসরের ওয়াক্ত প্রবেশ করা পর্যন্ত। অনুরূপভাবে আসরের প্রথম ওয়াক্ত হচ্ছে, যখন এর ওয়াক্ত হবে। আর তার শেষ ওয়াক্ত হচ্ছে সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করা পর্যন্ত। তদ্রূপ মাগরিবের প্রথম সময় হচ্ছে যখন সূর্য ডুবে যায়। তার শেষ সময় হচ্ছে, যখন দিগন্ত রেখা চলে যায়। আর এশার প্রথম ওয়াক্ত হচ্ছে, যখন দিগন্ত রেখা চলে যায়। আর শেষ ওয়াক্ত হচ্ছে, মধ্য রাত পর্যন্ত। ফজরের প্রথম ওয়াক্ত হচ্ছে, যখন সুবহে সাদিক উদিত হয়। আর শেষ ওয়াক্ত হচ্ছে, যখন সূর্য উদিত হয়। [তিরমিযী: ১৫১]

: ২০৫
وَاذْكُرْ رَبَّكَ فِي نَفْسِكَ تَضَرُّعًا وَخِيفَةً وَدُونَ الْجَهْرِ مِنَ الْقَوْلِ بِالْغُدُوِّ وَالْآصَالِ وَلَا تَكُنْ مِنَ الْغَافِلِينَ

আর আপনি আপনার রবকে নিজ মনে স্মরণ করুন [১] সবিনয়ে, সশংকচিত্তে ও অনুচ্চস্বরে , সকালে ও সন্ধ্যায়।আর উদাসীনদের অন্তর্ভুক্ত হবেন না।

ফুটনোট

[১] স্মরণ করা অর্থ নামাযও এবং অন্যান্য ধরনের স্মরণ করাও। চাই মুখে মুখে বা মনে মনে যে কোনভাবেই তা হোক না কেন। সকাল-সাঝ বলতে সুনির্দিষ্টভাবে এ দু’টি সময়ও বুঝানো হয়ে থাকতে পারে। আর এ দু' সময়ে আল্লাহর স্মরণ বলতে বুঝানো হয়েছে সকালের ও বিকালের নামাযকে। [তাবারী] অনুরূপ অর্থে অপর সূরায় এসেছে, “এবং আপনার রবের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন সূর্যোদয়ের আগে ও সূর্যাস্তের আগে” [সূরা কাফ: ৩৯] পক্ষান্তরে সকাল-সাঁঝ কথাটা “সর্বক্ষণ" অর্থেও ব্যবহৃত হয় [কাশশাফ] এবং তখন এর অর্থ হয় সবসময় আল্লাহর স্মরণে মশগুল থাকা। এর উদ্দেশ্য বর্ণনা প্রসংগে বলা হয়েছে, তোমাদের অবস্থা যেন গাফেলদের মত না হয়ে যায়। দুনিয়ায় যা কিছু গোমরাহী ছড়িয়েছে এবং মানুষের নৈতিক চরিত্রে ও কর্মকাণ্ডে যে বিপর্যয়ই সৃষ্টি হয়েছে তার একমাত্র কারণ হচ্ছে, মানুষ ভুলে যায়, আল্লাহ তার রব, সে আল্লাহর বান্দা, দুনিয়ার জীবন শেষ হবার পর তাকে তার রবের কাছে হিসাব দিতে হবে।

: ৪৫
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا لَقِيتُمْ فِئَةً فَاثْبُتُوا وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ

হে ঈমানদারগন ! তোমরা যখন কোন দলের সম্মুখীন হবে তখন অবিচলিত থাক [১] এবং আল্লাহ্‌কে বেশি পরিমাণ স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও [২]।

ফুটনোট

[১] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক যুদ্ধে তিনি এ বিষয়টি বর্ণনা করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবন আবি আওফা বলেনঃ এক যুদ্ধে রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূৰ্য্য পশ্চিমাকাশে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন, তারপর ভাষণ দিতে দাঁড়ালেন এবং বললেনঃ হে মানুষগণ! তোমরা শক্রর সাথে সাক্ষাতের আকাংখায় থেকো না। আল্লাহর কাছে এর থেকে বিমুক্তি চাও। তারপরও যদি সাক্ষাত হয়ে যায় তখন ধৈর্যের সাথে টিকে থাক এবং মনে রেখ যে, তরবারীর ছায়ার নীচে জান্নাত। [বুখারীঃ ২৯৬৫, ২৯৬৬]

[২] এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা মুসলিমগণকে যুদ্ধক্ষেত্র এবং শক্রর মোকাবেলার জন্য এক বিশেষ হেদায়াত দান করেছেন। তন্মধ্যে প্রথম হচ্ছে, দৃঢ়তা অবলম্বন করা ও স্থির-অটল থাকা। মনের দৃঢ়তা ও সংকল্পের অটলতা উভয়টিই এর অন্তর্ভুক্ত। দ্বিতীয় হচ্ছে, আল্লাহর যিকর। আল্লাহর যিকর-এ নিজস্বভাবে যে বরকত ও কল্যাণ রয়েছে, তা তো যথাস্থানে আছেই, তদুপরি এটাও একটি বাস্তব সত্য যে, দৃঢ়তার জন্যও এর চেয়ে পরীক্ষিত কোন ব্যবস্থা নেই। সুতরাং দৃঢ়পদ থাকা ও আল্লাহর যিকর এ দু'টি বিজয়ের প্রধান কারণ। [সা’দী; আইসারুত তাফাসীর]

১৩ : ২৮
الَّذِينَ آمَنُوا وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُمْ بِذِكْرِ اللَّهِ ۗ أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ

‘যারা ঈমান আনে [১] এবং আল্লাহ্‌র স্মরণে যাদের মন প্রশান্ত হয়; জেনে রাখ, আল্লাহ্‌র স্মরণেই মন প্রশান্ত হয় [২];

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ তারা যে নিদর্শন চাচ্ছে তেমনি কোন নিদর্শন ছাড়াই যারা ঈমান আনে তাদের সম্পর্কে আলোচনা করা হচ্ছে।

[২] রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি তার প্রভুর স্মরণ অর্থাৎ যিকির করে আর যে করে না তাদের উদাহরণ হলো জীবিত এবং মৃত ব্যক্তির ন্যায়। [বুখারীঃ ৬৪০৭]

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেনঃ “যে ব্যক্তি প্রতিদিন একশতবার ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী’ পাঠ করবে, তার গুনাহ্ যদি সমুদ্রের ফেনাতুল্যও হয় তবুও আল্লাহ্ দয়া করে তা ক্ষমা করে দিবেন। [বুখারীঃ ৬৪০৫]

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, যে ব্যক্তি দিনে একশতবার ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুয়া ‘আলা কুল্লি শাইয়্যিন ক্বাদীর’ পড়ে সে ব্যক্তি দশটি দাস স্বাধীন করার সওয়াব পাবে, তার জন্য একশ’টি নেকী লিখা হবে এবং তার একশ’টি গুণাহ্ মিটিয়ে দেয়া হবে। ওই দিন সন্ধা পর্যন্ত শয়তান থেকে তার রক্ষা পাওয়ার ব্যবস্থা হবে এবং তার চেয়ে উত্তম আর কেউ হবে না। তবে যে ব্যক্তি এটা তার চেয়ে বেশী পড়ে সে ব্যতিত”। [বুখারীঃ ৬৪০৩]

১৮ : ২৩
وَلَا تَقُولَنَّ لِشَيْءٍ إِنِّي فَاعِلٌ ذَٰلِكَ غَدًا

আর কখনই আপনি কোন বিষয়ে বলবেন না, ‘আমি তা আগামীকাল করব,

ফুটনোট

চতুর্থ রুকু’

১৮ : ২৪
إِلَّا أَنْ يَشَاءَ اللَّهُ ۚ وَاذْكُرْ رَبَّكَ إِذَا نَسِيتَ وَقُلْ عَسَىٰ أَنْ يَهْدِيَنِ رَبِّي لِأَقْرَبَ مِنْ هَٰذَا رَشَدًا

‘আল্লাহ্ ইচ্ছে করলে’ এ কথা না বলে [১]। আর যদি ভুলে যান তবে আপনার রবকে স্মরণ করবেন [২] এবং বলবেন, ‘সম্ভবত আমার রব আমাকে এটার চেয়ে সত্যের কাছাকাছি পথ নির্দেশ করবেন। ’

ফুটনোট

[১] এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার উম্মতকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে, ভবিষ্যতকালে কোন কাজ করার ওয়াদা বা স্বীকারোক্তি করলে এর সাথে “ইনশাআল্লাহ' বাক্যটি যুক্ত করতে হবে। কেননা, ভবিষ্যতে জীবিত থাকবে কিনা তা কারো জানা নেই। জীবিত থাকলেও কাজটি করতে পারবে কিনা, তারও নিশ্চয়তা নেই। কাজেই মুমিনের উচিত মনে মনে এবং মুখে স্বীকারোক্তির মাধ্যমে আল্লাহর উপর ভরসা করা। ভবিষ্যতে কোন কাজ করার কথা বললে এভাবে বলা দরকারঃ যদি আল্লাহ চান, তবে আমি এ কাজটি আগামী কাল করব। ইনশাআল্লাহ বাক্যের অর্থ তাই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “সুলাইমান ইবনে দাউদ ‘আলাইহিমাস সালাম বললেনঃ আমি আজ রাতে আমার সত্তর জন স্ত্রীর উপর উপগত হব। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে- নব্বই জন স্ত্রীর উপগত হব, তাদের প্রত্যেকেই একটি ছেলে সন্তান জন্ম দেবে যারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করবে। তখন তাকে ফিরিশতা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন যে, বলুনঃ ইনশাআল্লাহ। কিন্তু তিনি বললেন না। ফলে তিনি সমস্ত স্ত্রীর উপর উপনীত হলেও তাদের কেউই কোন সন্তান জন্ম দিল না। শুধু একজন স্ত্রী একটি অপরিণত সন্তান প্রসব করল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ যার হাতে আমার প্রাণ, সে যদি বলত ইনশাআল্লাহ, তবে অবশ্যই তার ওয়াদা ভঙ্গ হত না। আর তা তার ওয়াদা পূর্ণতায় সহযোগী হত’৷ [বুখারীঃ ৩৪২৪, ৫২৪২,৬৬৩৯, ৭৪৬৯, মুসলিমঃ ১৬৫৪, আহমাদঃ ২/২২৯, ৫০৬]

[২] কোন কোন মুফাসসির বলেন, আয়াতের অর্থ হলো, যখনি আপনি কোন কিছু ভুলে যাবেন তখনই আল্লাহকে স্মরণ করবেন। কারণ, ভুলে যাওয়াটা শয়তানের কারসাজির ফলে ঘটে। আর মহান আল্লাহর স্মরণ শয়তানকে দূরে তাড়িয়ে দেয় যা পুনরায় স্মরণ করতে সাহায্য করবে। এ অর্থটির সাথে পরবর্তী বাক্যের মিল বেশী। অপর কোন কোন মুফাসসির বলেন, এ আয়াতটি পূর্বের আয়াতের সাথে মিলিয়ে অর্থ করতে হবে। অর্থাৎ আপনি যদি ইনশাল্লাহ ভুলে যান। তবে যখনই মনে হবে তখনই ইনশাআল্লাহ বলে নেবেন। [দেখুন, ইবন কাসীর]

২০ : ১৪
إِنَّنِي أَنَا اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدْنِي وَأَقِمِ الصَّلَاةَ لِذِكْرِي

আমি আল্লাহ্ আমি ছাড়া অন্য কোন হক ইলাহ নেই। অতএব আমারই ইবাদাত করুন [১] এবং আমার স্মরণার্থে সালাত আদায় করুন [২]।

ফুটনোট

[১] লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে যে, এটা ছিল প্রথম নির্দেশ, যা একজন নবীর প্রতি আল্লাহ জারি করেছেন। সে হিসেবে প্রত্যেক মানুষের উপর প্রথম ওয়াজিব ও কর্তব্য হল এ কালেমার সাক্ষ্য দেয়া। [ইবন কাসীর]

[২] এখানে সালাতের মূল উদ্দেশ্যের উপর আলোকপাত করা হয়েছে। সালাত কায়েম করুন, যাতে আমাকে স্মরণ করতে পারেন। [ইবন কাসীর] অর্থাৎ মানুষ যেন আল্লাহ থেকে গাফেল না হয়ে যায়। আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক জড়িত করার সবচেয়ে বড় মাধ্যম হচ্ছে সালাত। সালাত প্রতিদিন কয়েকবার মানুষকে দুনিয়ার কাজকারবার থেকে সরিয়ে আল্লাহর দিকে নিয়ে যায়। কোন কোন মুফাসসির এ অর্থও নিয়েছেন যে, সালাত কায়েম করো, যাতে আমি তোমাকে স্মরণ করতে পারি, যেমন অন্যত্র বলা হয়েছেঃ “আমাকে স্মরণ করো আমি তোমাকে স্মরণ রাখবো" [সূরা আল-বাকারাহঃ ১৫২] [ফাতহুল কাদীর] কোন কোন মুফাসসির এ আয়াতের অর্থ করেছেন, যদি কোন সালাত ভুলে যায় যখনই মনে পড়বে তখনই সালাত পড়ে নেয়া উচিত। [ফাতহুল কাদীর] এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “কোন ব্যক্তি কোন সময় সালাত পড়তে ভুলে গিয়ে থাকলে যখন তার মনে পড়ে যায়। তখনই সালাত পড়ে নেয়া উচিত। এছাড়া এর আর কোন কাফফারা নেই।” [বুখারীঃ ৫৭২ মুসলিমঃ ৬৮০, ৬৮৪] অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ঘুমানোর কারণে কারও সালাত ছুটে গেলে অথবা সালাত আদায় করতে বেখবর হয়ে গেলে যখনই তা স্মরণ হয় তখনই তা আদায় করা উচিত; কেননা মহান আল্লাহ বলেন: “আর আমার স্মরনার্থে সালাত কায়েম করুন”। [মুসলিম: ৩১৬] এ সমস্ত হাদীসে এ আয়াতটিকে দলীল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যা এ তাফসীরের যথার্থতার উপর প্রমাণবহ। অন্য এক হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হয়, যদি আমরা সালাতের সময় ঘুমিয়ে থাকি তাহলে কি করবো? জবাবে তিনি বলেন, “ঘুমের মধ্যে কোন দোষ নেই। দোষের সম্পর্ক তো জেগে থাকা অবস্থার সাথে। কাজেই যখন তোমাদের মধ্যে কেউ ভুলে যাবে অথবা ঘুমিয়ে পড়বে তখন জেগে উঠলে বা মনে পড়লে তৎক্ষণাৎ সালাত পড়ে নেবে। ” [তিরমিযীঃ ১৭৭. আবু দাউদঃ ৪৪১]

২০ : ১২৪
وَمَنْ أَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنْكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَىٰ

‘আর যে আমার স্মরণ থেকে বিমুখ থাকবে, নিশ্চয় তার জীবন-যাপন হবে সংকুচিত [১] এবং আমরা তাকে কিয়ামতের দিন জমায়েত করব অন্ধ অবস্থায় [২]।

ফুটনোট

[১] এখানে যিকর-এর অর্থ কুরআনও হতে পারে এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামও হতে পারে, যেমন- অন্য আয়াতে ذِكْراًرَّسُوْلاً বলা হয়েছে। [কুরতুবী। তবে অধিকাংশের নিকট এখানে কুরআন বোঝানো হয়েছে। সারমর্ম এই যে, যে ব্যক্তি কুরআনের বিধি-বিধান থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে, কুরআনের নির্দেশের আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়; অন্যদের থেকে হিদায়াত গ্ৰহণ করে, তার পরিণাম এই যে, তার জীবিকা সংকীর্ণ হবে। [ইবন কাসীর] কুরআনের ভাষ্যে ঐ সমস্ত লোকদের জন্য সংকীর্ণ ও তিক্ত জীবনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে, যারা আল্লাহর কুরআন ও তাঁর রাসূলের প্রদর্শিত পথে চলতে বিমুখ হয়। কিন্তু কোথায় তাদের সে সংকীর্ণ ও তিক্ত জীবন হবে তা নির্ধারণে বেশ কয়েকটি মত রয়েছেঃ

এক) তাদের দুনিয়ার জীবন সংকীর্ণ হবে। তাদের কাছ থেকে অল্পে তুষ্টির গুণ ছিনিয়ে নেয়া হবে এবং সাংসারিক লোভ-লালসা বাড়িয়ে দেয়া হবে। যা তাদের জীবনকে অতিষ্ট করে তুলবে। ফলে তাদের কাছে যত অর্থ-সম্পাদই সঞ্চিত হোক না কেন, আন্তরিক শান্তি তাদের ভাগ্যে জুটবে না। সদা-সর্বদা সম্পদ বৃদ্ধি করার চিন্তা এবং ক্ষতির আশঙ্কা তাদেরকে অস্থির করে তুলবে। কেননা, সুখ-শান্তি অন্তরের স্থিরতা ও নিশ্চিন্ততার মাধ্যমেই অর্জিত হয়; শুধু প্রাচুর্য্যে নয়। [দেখুন, ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর]

দুই) অনেক মুফাসসিরের মতে এখানে সংকীর্ণ জীবন বলতে কবরের জীবনকে বোঝানো হয়েছে। [ইবন কাসীর] অর্থাৎ তাদের কবর তাদের উপর সংকীর্ণ হয়ে যাবে বিভিন্ন প্রকার শাস্তির মাধ্যমে। এতে করে কবরে তাদের জীবন দুর্বিষহ করে দেয়া হবে। তাদের বাসস্থান কবর তাদেরকে এমনভাবে চাপ দেবে যে, তাদের পাঁজর ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং مَعِيْشَةً ضَنْكًا -এর তাফসীরে বলেছেন যে, এখানে কবর জগত ও সেখানকার আযাব বোঝানো হয়েছে। [মুস্তাদরাকে হাকিমঃ ২/৩৮১ নং- ৩৪৩৯, ইবনে হিব্বানঃ ৭/৩৮৮, ৩৮৯ নং- ৩১১৯] তাছাড়া বিভিন্ন সহীহ হাদীসে কবরের যিন্দেগীর বিভিন্ন শাস্তির যে বর্ণনা এসেছে, তা থেকে বুঝা যায় যে, যারা আল্লাহ, কুরআন ও রাসূলের প্রদর্শিত দ্বীন থেকে বিমুখ হবে, কবরে তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “মুমিন তার কবরে সবুজ প্রশস্ত উদ্যানে অবস্থান করবে। আর তার কবরকে ৭০ গজ প্রশস্ত করা হবে। পূর্নিমার চাঁদের আলোর মত তার কবরকে আলোকিত করা হবে। তোমরা কি জান আল্লাহর আয়াত (তাদের জন্য রয়েছে সংকীর্ণ জীবন) কাদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে? তোমরা কি জানো সংকীর্ণ জীবন কি? সাহাবায়ে কেরাম বললেনঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভাল জানেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: তা হল কবরে কাফেরের শাস্তি। যাঁর হাতে আমার জীবন, তার শপথ করে বলছি- তাকে ন্যস্ত করা হবে ৯৯টি বিষাক্ত তিন্নিন সাপের কাছে। তোমরা কি জান তিন্নিন কি? তিন্নিন হল ৯৯টি সাপ । প্ৰত্যেকটি সাপের রয়েছে ৭টি মাথা। যেগুলো দিয়ে সে কাফেরের শরীরে ছোবল মারতে থাকবে, কামড়াতে ও ছিড়তে থাকবে কেয়ামত পর্যন্ত। [ইবনে হিব্বানঃ ৩১২২, দারেমীঃ ২৭১১, আহমাদঃ ৩/৩৮, আবু ইয়া'লাঃ ৬৬৪৪, আবদ ইবনে হুমাইদঃ ৯২৯, মাজমাউয-যাওয়ায়েদঃ ৩/৫৫]

[২] অর্থাৎ তাকে কেয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় হাশার করা হবে। এখানে অন্ধ অবস্থার কয়েকটি অর্থ হতে পারে- (এক) বাস্তবিকই সে অন্ধ হয়ে উঠবে। (দুই) সে জাহান্নাম ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবে না। (তিন) সে তার পক্ষে পেশ করার মত কোন যুক্তি থেকে অন্ধ হয়ে যাবে। কোন প্রকার প্রমাণাদি পেশ করা থেকে অন্ধ হয়ে থাকবে। [দেখুন, ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর] তখন তার পরবর্তী আয়াতের অর্থ হবেসে বলবেঃ হে আমার রব! আমাকে কেন আমার যাবতীয় যুক্তিহীন অবস্থায় হাশর করেছেন? আল্লাহ উত্তরে বলবেনঃ অনুরূপভাবে তোমার কাছে আমার নিদর্শনসমূহ এসেছিল, কিন্তু তুমি সেগুলো ত্যাগ করে ভুলে বসেছিলে, তাই আজকের দিনেও তোমাকে যুক্তি-প্রমাণহীন অবস্থায় অন্ধ করে ত্যাগ করা হবে, ভুলে যাওয়া হবে। কারণ এটা তো তোমারই কাজের যথোপযুক্ত ফল। [ইবন কাসীর]

২৪ : ৩৬
فِي بُيُوتٍ أَذِنَ اللَّهُ أَنْ تُرْفَعَ وَيُذْكَرَ فِيهَا اسْمُهُ يُسَبِّحُ لَهُ فِيهَا بِالْغُدُوِّ وَالْآصَالِ

সে সব ঘরে [১] যাকে সমুন্নত করতে [২] এবং যাতে তাঁর নাম স্মরণ করতে আল্লাহ্‌ নির্দেশ দিয়েছেন [৩], সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে [৪],

ফুটনোট

[১] পূর্ববর্তী আয়াতে আল্লাহ্‌ তা‘আলা মানুষের অন্তরে নিজের হেদায়াতের আলো রাখার একটি বিশেষ দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন এবং শেষে বলেছেনঃ এই নূর দ্বারা সে-ই উপকার লাভ করে, যাকে আল্লাহ্‌ চান ও তাওফীক দেন। [ইবন কাসীর] আলোচ্য আয়াতে এমন মুমিনদের আবাসস্থল ও স্থান বর্ণনা করা হয়েছে যে, এরূপ মুমিনদের আসল আবাসস্থল, যেখানে তারা প্রায়ই বিশেষতঃ পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের সময় দৃষ্টিগোচর হয়- সেসব গৃহ, যেগুলোকে উচ্চ রাখার জন্য এবং যেগুলোতে আল্লাহ্‌র নাম উচ্চারণ করার জন্য আল্লাহ্‌ তা‘আলা আদেশ করেছেন। এসব গৃহে সকাল-সন্ধ্যায় অর্থাৎ সর্বদা এমন লোকেরা আল্লাহ্‌ তা‘আলার পবিত্ৰতা বর্ণনা করে, যাদের বিশেষ গুণাবলী পরবর্তী আয়াতে বর্ণিত হচ্ছে। অধিকাংশ তাফসীরবিদের মতে এসব গৃহ হচ্ছে মসজিদ। অধিকাংশ মুফাসসিরগণ এ তাফসীরকেই অগ্ৰাধিকার দিয়েছেন। [দেখুন-কুরতুবী, বাগভী]

[২] কোন কোন মুফাসসির এর অর্থ নিয়েছেন মু‘মিনদের ঘর এবং সেগুলোকে উন্নত করার অর্থ সেগুলোকে নৈতিক দিক দিয়ে উন্নত করা, নৈতিক মান রক্ষার জন্য তাতে মসজিদের ব্যবস্থা করা। এ অর্থের সমর্থনে আমরা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে একটি হাদীস পাই যাতে তিনি বলেছেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে বাসগৃহের মধ্যেও মসজিদ অর্থাৎ সালাত আদায় করার বিশেষ জায়গা তৈরী করার এবং তাকে পবিত্র রাখার জন্য আদেশ করেছেন। [ইবনে মাজহঃ ৭৫৮, ৭৫৯]

তবে অধিকাংশ মুফাসসির এ “ঘরগুলো”কে মসজিদ অর্থে গ্রহণ করেছেন এবং এগুলোকে উন্নত করার অর্থ নিয়েছেন এগুলো নির্মাণ ও এগুলোকে মর্যাদা প্ৰদান করা। “সেগুলোর মধ্যে নিজের নাম স্মরণ করতে আল্লাহ্‌ নির্দেশ দিয়েছেন।” এ শব্দগুলো বাহ্যত মসজিদ সংক্রান্ত ব্যাখ্যার বেশী সমর্থক দেখা যায়। তখন আয়াতের অর্থ হবে, আল্লাহ্‌ তা‘আলা মসজিদসমূহকে সমুন্নত করার অনুমতি দিয়েছেন। অনুমতি দেয়ার মানে আদেশ করা এবং উচ্চ করা মানে সম্মান করা। উচ্চ করার দু’টি অর্থ করা হয়ে থাকে-

[১] ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেনঃ উচ্চ করার অর্থ আল্লাহ্‌ তা‘আলা মসজিদসমূহে অনৰ্থক কাজ ও কথাবার্তা বলতে নিষেধ করেছেন।
হাসান বসরী রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ رِفْعُ مَسَا جِدَ বলে মসজিদসমূহের সম্মান, ইযযত ও সেগুলোকে নাপাকী ও নোংরা বস্তু থেকে পবিত্র রাখা বুঝানো হয়েছে। আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, “মসজিদে থুথু ফেলা গোনাহ আর তার কাফফারা হলো তা দাফন করা, মিটিয়ে দেয়া”। [বুখারীঃ ৪১৫, মুসলিমঃ ৫৫২]

[২] ইকরিমা ও মুজাহিদ বলেনঃ رفع বলে মসজিদ নির্মাণ বুঝানো হয়েছে; যেমন কা‘বা নির্মাণ সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছেঃ

وَ اِذْ يَرْ فَعُ اِبْرٰحٖمُ الْقًو اعِدَمِنَ الْبَيْتِ

এখানে رفع قو اعد বলে ভিত্তি নির্মাণ বুঝানো হয়েছে। উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেনঃ আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, “যে আল্লাহ্‌র জন্য মসজিদ বানায়, আল্লাহ্‌ তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর বানাবেন”। [বুখারীঃ ৪৫০, মুসলিমঃ ৫৩৩]

প্রকৃত কথা এই যে, تُرْفَعَ শব্দের অর্থ মসজিদ নির্মাণ করা, পাক-পবিত্র রাখা এবং মসজিদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা ইত্যাদি সবই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। [দেখুন-তাবারী, ইবন কাসীর, কুরতুবী] এ কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম রসুন ও পেঁয়াজ খেয়ে মুখ না ধুয়ে মসজিদে গমন করতে নিষেধ করেছেন। উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেনঃ “আমি দেখেছি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে ব্যাক্তির মুখে রসুন বা পেঁয়াজের দুৰ্গন্ধ অনুভব করতেন, তাকে মসজিদ থেকে বের করে ‘বাকী’ নামক স্থানে পাঠিয়ে দিতেন এবং বলতেনঃ যে ব্যাক্তি রসুন-পেঁয়াজ খেতে চায়, সে যেন উত্তম রূপে পাকিয়ে খায় যাতে দুৰ্গন্ধ নষ্ট হয়ে যায়।” [মুসলিমঃ ৫৬৭]

[৩] আবু উমামাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বৰ্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ “যে ব্যাক্তি গৃহে অযু করে ফরয সালাত আদায়ের জন্য মসজিদের দিকে যায়, তার সওয়াব সেই ব্যক্তির সমান, যে ইহরাম বেঁধে গৃহ থেকে হজ্জের জন্য যায়। যে ব্যাক্তি এশরাকের সালাত আদায়ের জন্য গৃহ থেকে অযু করে মসজিদের দিকে যায়, তার সওয়াব উমরাকারীর অনুরূপ। এক সালাতের পর অন্য সালাত ইল্লিয়্যীনে লিখিত হয় যদি উভয়ের মাঝখানে কোন অপ্রয়োজনীয় কাজ না করে।” [আবু দাউদঃ ৫৫৮] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেনঃ “যারা অন্ধকারে মসজিদে গমন করে, তাদেরকে কেয়ামতের দিন পরিপূর্ণ নূরের সুসংবাদ শুনিয়ে দাও।” [আবু দাউদঃ ৫৬১, তিরমিযীঃ ২২৩]

[৪] আল্লাহ্‌র নাম স্মরণ করা দ্বারা এখানে তাসবীহ (পবিত্রতা বর্ণনা), তাহমীদ (প্ৰশংসা বর্ণনা), নফল সালাত, কুরআন তিলাওয়াত, ওয়াজ-নসীহত, দ্বীনী শিক্ষা ইত্যাদি সর্বপ্রকার যিকর বুঝানো হয়েছে। [তাবারী, সা‘দী, মুয়াসসার]

২৪ : ৩৭
رِجَالٌ لَا تُلْهِيهِمْ تِجَارَةٌ وَلَا بَيْعٌ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ وَإِقَامِ الصَّلَاةِ وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ ۙ يَخَافُونَ يَوْمًا تَتَقَلَّبُ فِيهِ الْقُلُوبُ وَالْأَبْصَارُ

সেসব লোক [১], যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় কোনটিই আল্লাহ্‌র স্মরণ হতে এবং সালাত কায়েম ও যাকাত প্রদান হতে বিরত রাখে না, তারা ভয় করে সে দিনকে যেদিন অনেক অন্তর ও দৃষ্টিসমূহ উল্টে যাবে।

ফুটনোট

[১] এখানে رجال শব্দের মধ্যে ইঙ্গিত আছে যে, মসজিদে উপস্থিত হওয়ার বিধান আসলে পুরুষদের জন্য, নারীদের জন্য গৃহে সালাত আদায় করা উত্তম। [বাগভী, কুরতুবী] মুসনাদে আহমাদে উম্মে সালমা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বর্ণিত হাদীসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ “নারীদের উত্তম মসজিদ তাদের গৃহের সংকীর্ণ ও অন্ধকার প্রকোষ্ঠ”। [মুসনাদে আহমাদঃ ৬/২৯৭]

৭২ : ১৭
لِنَفْتِنَهُمْ فِيهِ ۚ وَمَنْ يُعْرِضْ عَنْ ذِكْرِ رَبِّهِ يَسْلُكْهُ عَذَابًا صَعَدًا

যা দ্বারা আমরা তাদেরকে পরীক্ষা করতে পারি। আর যে ব্যক্তি তার রবের স্মরণ হতে বিমুখ হয় তিনি তাকে দুঃসহ শাস্তিতে প্রবেশ করাবেন।
ফুটনোট

৭৩ :
وَاذْكُرِ اسْمَ رَبِّكَ وَتَبَتَّلْ إِلَيْهِ تَبْتِيلًا

আর আপনি আপনার রবের নাম স্মরণ করুন এবং তাঁর প্রতি মগ্ন হোন একনিষ্ঠভাবে [১]।

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ আপনি সমগ্র সৃষ্টি থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে কেবল আল্লাহ্র সন্তুষ্টিবিধানে ও ইবাদতে মগ্ন হোন। এর সাধারণ অর্থে ইবাদতে শির্ক না করাও দাখিল এবং নিজের সমস্ত কর্মকাণ্ডে তথা উঠাবসায়, চলাফেরায় দৃষ্টি ও ভরসা আল্লাহ্র প্রতি নিবদ্ধ রাখা এবং অপরকে লাভ-লোকসান ও বিপদাপদ থেকে উদ্ধারকারী মনে না করাও দাখিল। দুনিয়া ও দুনিয়ার সবকিছুকে পরিত্যাগ করে আল্লাহ্র কাছে যা আছে তৎপ্রতি মনোনিবেশ করাও এর অর্থের অন্তর্গত। কিন্তু এই تبتل তথা দুনিয়ার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ সেই رهبانية তথা বৈরাগ্য থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন কুরআনে যার নিন্দা করা হয়েছে এবং হাদীসে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। কেননা, শরীয়াতের পরিভাষায় رهبانية বা বৈরাগ্য এর অর্থ দুনিয়ার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করা এবং ভোগ সামগ্ৰী ও হালাল বস্তুসমুহকে ইবাদতের নিয়তে পরিত্যাগ করা। পক্ষান্তরে এখানে যে সম্পর্কচ্ছেদের আদেশ করা হয়েছে, তা এই যে, বিশ্বাসগতভাবে অথবা কাৰ্যগতভাবে আল্লাহ্র সম্পর্কের উপর কোন সৃষ্টির সম্পর্ককে প্রবল হতে না দেয়া। এ ধরণের সম্পর্কচ্ছেদ বিবাহ, আত্মীয়তার সম্পর্ক ইত্যাদি যাবতীয় সাংসারিক কাজ-কারবারের পরিপন্থী নয়; বরং এগুলোর সাথে জড়িত থেকেও এটা সম্ভবপর। রাসূলগণের সুন্নত; বিশেষতঃ রাসূলকুল শিরোমণি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সমগ্র জীবন ও আচারাদি এর পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। আয়াতে تبتل শব্দ দ্বারা যে অর্থ ব্যক্ত করা হয়েছে, মূলত তা হলো সকল ইবাদত একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ্র জন্য করা এবং এর মাধ্যমে একমাত্র তাঁরই মুখাপেক্ষী হওয়া। [দেখুন, কুরতুবী]

৭৬ : ২৫
وَاذْكُرِ اسْمَ رَبِّكَ بُكْرَةً وَأَصِيلًا

আর আপনার রবের নাম স্মরণ করুন সকালে ও সন্ধ্যায়।
ফুটনোট

0:00
0:00