বিজয়
বিজয়
: ৮৯
وَلَمَّا جَاءَهُمْ كِتَابٌ مِنْ عِنْدِ اللَّهِ مُصَدِّقٌ لِمَا مَعَهُمْ وَكَانُوا مِنْ قَبْلُ يَسْتَفْتِحُونَ عَلَى الَّذِينَ كَفَرُوا فَلَمَّا جَاءَهُمْ مَا عَرَفُوا كَفَرُوا بِهِ ۚ فَلَعْنَةُ اللَّهِ عَلَى الْكَافِرِينَ

আর যখন তাদের কাছে যা আছে আল্লাহ্‌র কাছ থেকে তার সত্যায়নকারী [১] কিতাব আসলো; অথচ পূর্বে তারা এর সাহায্যে কাফেরদের বিরুদ্ধে বিজয় প্রার্থনা করতো, তারপর তারা যা চিনত যখন তা তাদের কাছে আসল, তখন তারা সেটার সাথে কুফরী করল [২]। কাজেই কাফেরদের উপর আল্লাহ্‌র লা’নত।

ফুটনোট

[১] এ আয়াতাংশে বলা হয়েছে যে, তারা তাকে জানতে ও চিনতে পেরেছে। তার সপক্ষে বহু তথ্য-প্রমাণ সে যুগেই পাওয়া গিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী সাক্ষ্য পেশ করেছেন উম্মুল মুমিনীন সাফিয়্যাহ রাদিয়াল্লাহু আনহা। তিনি নিজে ছিলেন একজন বড় ইয়াহুদী আলেমের মেয়ে এবং আরেকজন বড় আলেমের ভাইঝি। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মদীনা আগমনের পর আমার বাবা ও চাচা দু’জনেই তার সাথে সাক্ষাত করতে গিয়েছিলেন। দীর্ঘক্ষণ তার সাথে কথাবার্তা বলার পর তারা ঘরে ফিরে আসেন। এ সময় আমি নিজের কানে তাদেরকে এভাবে আলাপ করতে শুনিঃ চাচা বললেন, আমাদের কিতাবে যে নবীর খবর দেয়া হয়েছে, ইনি কি সত্যিই সেই নবী? পিতা বললেন, আল্লাহ্‌র কসম, ইনিই সেই নবী। চাচা বললেন, এ ব্যাপারে তুমি কি একেবারে নিশ্চিত? পিতা বললেন, হ্যা। চাচা বললেন, তাহলে এখন কি করতে চাও? বাবা বললেন, যতক্ষণ দেহে প্রাণ আছে এর বিরোধিতা করে যাব। [দালায়েলুন নাবুওয়াহ লিল বাইহাকী, সীরাতে ইবনে হিসাম]

[২] নবী রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আগমণের পূর্বে ইয়াহুদীরা তাদের পূর্ববতী নবীগণ যে নবীর আগমনবার্তা শুনিয়ে গিয়েছিলেন তার জন্য প্রতীক্ষারত ছিল। তারা দো'আ করত তিনি যেন অবিলম্বে এসে কাফেরদের প্রাধান্য খতম করে ইয়াহুদী জাতির উন্নতি ও পুনরুত্থানের সূচনা করেন। মুহাম্মাদ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নবুওয়াত লাভের পূর্বে মদীনাবাসীদের প্রতিবেশী ইয়াহুদী সম্পপ্রদায় নবীর আগমনের আশায় জীবন ধারণ করত, মদীনাবাসীরা নিজেরাই এর সাক্ষী। যত্রতত্র যখন তখন তারা বলে বেড়াতঃ ঠিক আছে, এখন প্রাণ ভরে আমাদের উপর যুলুম করে নাও। কিন্তু যখন সেই নবী আসবেন, আমরা তখন এই যালিমদের সবাইকে দেখে নেব। মদীনাবাসীরা এসব কথা আগের থেকেই শুনে আসছিল। তাই নবী রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথা শুনে তারা পরস্পর বলাবলি করতে লাগলঃ দেখ, ইয়াহুদীরা যেন তোমাদের পিছিয়ে দিয়ে এ নবীর দ্বীন গ্রহণ করে বাজী জিতে না নেয়। চল, তাদের আগে আমরাই এ নবীর উপর ঈমান আনব। কিন্তু তারা অবাক হয়ে দেখল, যে ইয়াহুদীরা নবীর আগমন প্রতীক্ষায় দিন গুনছিল, নবীর আগমনের পর তারাই তার সবচেয়ে বড় বিরোধী পক্ষে পরিণত হল। [দেখুন, মুসনাদে আহমাদ ৩/৪৬৭, তাফসীর ইবনে কাসীর]

: ৭৩
وَلَئِنْ أَصَابَكُمْ فَضْلٌ مِنَ اللَّهِ لَيَقُولَنَّ كَأَنْ لَمْ تَكُنْ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُ مَوَدَّةٌ يَا لَيْتَنِي كُنْتُ مَعَهُمْ فَأَفُوزَ فَوْزًا عَظِيمًا

আর তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ হলে, যেন তোমাদের ও তার মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই এমনভাবে বলবেই, ‘হায়! যদি তাদের সাথে থাকতাম তবে আমিও বিরাট সাফল্য লাভ করতাম [১]।’

ফুটনোট

[১] মুজাহিদ বলেন, এ আয়াত ও পূর্ববর্তী আয়াতে যাদেরকে বলা হয়েছে, তারা হচ্ছে, মুনাফিক। যারা সাহাবাদের সাথে মিশে থাকত। [আত-তাফসীরুস সহীহ] যুদ্ধের ঘোষণা শোনার সথে সাথেই তাদের মধ্যে গড়িমসি শুরু হত। এরপর যদি মুসলিমদের কোন বিপদ হতো, তখন তারা বলত যে, তাদের সাথে না থাকাটা আমাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে আশীর্বাদস্বরূপ। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে যে, এ অবস্থায় তারা খুশীও প্রকাশ করত। আল্লাহ বলেন, “তোমাদের মঙ্গল হলে তা তাদেরকে কষ্ট দেয় আর তোমাদের অমঙ্গল হলে তারা তাতে আনন্দিত হয়”। [সূরা আলে-ইমরান :১২০]

“আপনার মংগল হলে তা ওদেরকে কষ্ট দেয় এবং আপনার বিপদ ঘটলে ওরা বলে, “আমরা তো আগেই আমাদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করেছিলাম” এবং ওরা উৎফুল্ল চিত্তে সরে পড়ে” [আত-তাওবাহ্‌: ৫০] পক্ষান্তরে যখন মুসলিমদের কোন বিজয়ের কথা শুনত, তখন তারা বোল পাল্টিয়ে ফেলত যাতে করে যুদ্ধলন্দ সম্পদে ভাগ বসাতে পারে। যদিও মুসলিমদের বিজয় তাদের মনের জ্বালা বাড়িয়ে দেয়। [আদওয়াউল বায়ান]

: ১৪১
الَّذِينَ يَتَرَبَّصُونَ بِكُمْ فَإِنْ كَانَ لَكُمْ فَتْحٌ مِنَ اللَّهِ قَالُوا أَلَمْ نَكُنْ مَعَكُمْ وَإِنْ كَانَ لِلْكَافِرِينَ نَصِيبٌ قَالُوا أَلَمْ نَسْتَحْوِذْ عَلَيْكُمْ وَنَمْنَعْكُمْ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ ۚ فَاللَّهُ يَحْكُمُ بَيْنَكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ۗ وَلَنْ يَجْعَلَ اللَّهُ لِلْكَافِرِينَ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ سَبِيلًا

যারা তোমাদের অমঙ্গলের প্রতীক্ষায় থাকে, তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের জয় হলে বলে, ‘আমরা কি তোমাদের সাথে ছিলাম না’। আর যদি কাফেরদের কিছু বিজয় হয়, তবে তারা বলে, ‘আমরা কি তোমাদের বিরুদ্ধে প্রবল ছিলাম না এবং আমরা কি তোমাদেরকে মুমিনদের হাত থেকে রক্ষা করিনি?[১]’ আল্লাহ কেয়ামতের দিন তোমাদের মধ্যে বিচার মীমাংসা করবেন এবং আল্লাহ কখনই মুমিনদের বিরুদ্ধে কাফেরদের জন্য কোন পথ রাখবেন না। [২]

ফুটনোট

[১] এটিই প্রত্যেক যুগের মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য। মৌখিক স্বীকারোক্তি ও ইসলামের গণ্ডীর মধ্যে নামমাত্র প্রবেশের মাধ্যমে মুসলিম হিসাবে যতটুকু স্বার্থ ভোগ করা যায় তা তারা ভোগ করে। আবার অন্যদিকে কাফের হিসাবে যে স্বার্থটুকু ভোগ করা সম্ভব তা ভোগ করার জন্য তারা কাফেরদের সাথে যোগ দেয়। তাদেরকে বলেঃ আমরা মোটেই গোঁড়া বা প্রতিক্রিয়াশীল অথবা মৌলবাদী-বিদ্বেষপরায়ণ মুসলিম নই। মুসলিমদের সাথে আমাদের নামের সম্পর্ক আছে কিন্তু আমাদের মানসিক ঝোঁক, আগ্রহ ও বিশ্বস্ততা রয়েছে তোমাদের প্রতি। চিন্তা-ভাবনা, আচার-ব্যবহার, রুচি-প্রকৃতি ইত্যাদি সবদিক দিয়ে তোমাদের সাথে আমাদের গভীর মিল। তাছাড়া ইসলাম ও কুফরীর সংঘর্ষে আমরা তোমাদের পক্ষই অবলম্বন করব।

[২] এ আয়াতের অর্থ এ নয় যে, দুনিয়াতে কোন কাফের ঈমানদারদের উপর বিজয়ী হবে না। কারণ, এটার মূলকথা আখেরাতের সাথে সম্পৃক্ত। আয়াতের শুরুতেই ‘কিয়ামতের দিন’ উল্লেখ করার মাধ্যমে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর নিকট এক লোক এসে বলল যে, এ আয়াতে আল্লাহ্ বলেছেন, “আল্লাহ কখনই মুমিনদের বিরুদ্ধে কাফেরদের জন্য কোন পথ রাখবেন না” অথচ কাফেররা মুমিনদের উপর বিজয়ী হচ্ছে। তখন আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আয়াতের প্রথমাংশের দিকে তাকাও। সেখানে বলা হয়েছে, ‘কিয়ামতের দিন’। সুতরাং কিয়ামতের দিন আল্লাহ কখনই মুমিনদের বিরুদ্ধে কাফেরদের জন্য কোন পথ রাখবেন না। [মুস্তাদরাকে হাকিম: ২/৩০৯; দ্বিয়া আল-মাকদেসী, আল-আহাদিসুল মুখতারাহ ২/৪০৬-৪০৭, হাদীস নং ৭৯৩]

তবে ইমামগণ এ আয়াত থেকে দুনিয়াতে এ মাস’আলা নিয়েছেন যে, কোন কাফের কোন মুমিনের ওয়ারিশ হয় না। [আত-তালিকুল মুমাজ্জাদ আলা মুওয়াত্তা ইমাম মুহাম্মাদ]

: ৫২
فَتَرَى الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ يُسَارِعُونَ فِيهِمْ يَقُولُونَ نَخْشَىٰ أَنْ تُصِيبَنَا دَائِرَةٌ ۚ فَعَسَى اللَّهُ أَنْ يَأْتِيَ بِالْفَتْحِ أَوْ أَمْرٍ مِنْ عِنْدِهِ فَيُصْبِحُوا عَلَىٰ مَا أَسَرُّوا فِي أَنْفُسِهِمْ نَادِمِينَ

সুতরাং যাদের অন্তরে অসুখ রয়েছে আপনি তাদেরকে খুব তাড়াতাড়ি ওদের সাথে মিলিত হতে দেখবেন এ বলে, ‘আমরা আশংকা করছি যে, কোন বিপদ আমাদের আক্রান্ত করবে’ [১]। অতঃপর হয়ত আল্লাহ বিজয় বা তাঁর কাছ থেকে এমন কিছু দেবেন যাতে তারা তাদের অন্তরে যা গোপন রেখেছিল সে জন্য লজ্জিত হবে [২]।

ফুটনোট

[১] মুজাহিদ বলেন, এখানে যাদের অন্তরে অসুখ রয়েছে বলে মুনাফিকদেরকে বোঝানো হয়েছে। তারা ইয়াহুদীদের সাথে গোপন শলা-পরামর্শ ও তাদের খাতির করে কথা বলতে সাচ্ছন্দ বোধ করে। অনুরূপভাবে তারা তাদের সন্তানদের দুধ পান করাতেও অভ্যস্ত। এমতাবস্থায় তাদের আন্তরিক সম্পর্ক ইয়াহুদীদের সাথেই থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তাই তারা সবসময় ভাবে যে, ইয়াহুদীদেরই বিজয় হবে। আর তখন তাদের কাছ থেকে তারা বাড়তি সুবিধা পাবে। [তাবারী]

[২] মুসলিমরা সে বিজয় দেখেছিল। সুদ্দী বলেন, সে বিজয় হচ্ছে, মক্কা বিজয়। [তাবারী] কাতাদা বলেন, এখানে বিজয় বলে আল্লাহর ফয়সালা বুঝানো হয়েছে। তাবার কাতাদা আরও বলেন, মুনাফিকরা তখন ইয়াহুদীদের সাথে তাদের যে গোপন আঁতাত, ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও তাদের বিরুদ্ধাচারণ ও এতদসংক্রান্ত যাবতীয় কার্যকলাপের জন্য লজ্জিত হবে । [তাবারী]

: ১১৯
قَالَ اللَّهُ هَٰذَا يَوْمُ يَنْفَعُ الصَّادِقِينَ صِدْقُهُمْ ۚ لَهُمْ جَنَّاتٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ۚ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ ۚ ذَٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ

আল্লাহ্‌ বলবেন, ‘ এ সে দিন যেদিন সত্যবাদিগণ তাদের সত্যের জন্য উপকৃত হবে,তাদের জন্য আছে জান্নাত যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত।তারা সেখানে চিরস্থায়ী হবে; আল্লাহ্‌ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট [১]; এটা মহাসফলতা [২]।’

ফুটনোট

[১] আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি। এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ জান্নাত পাওয়ার পর আল্লাহ তা'আলা বলবেনঃ বড় নেয়ামত এই যে, আমি তোমাদের প্রতি সন্তুষ্ট; এখন থেকে কখনো তোমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হব না। [বুখারী: ৬৫৪৯; মুসলিম: ১৮৩]


[২] এটিই মহান সফলতা। স্রষ্টা ও পরম প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জিত হয়ে গেলে এর চাইতে বৃহত্তর সফলতা আর কি হতে পারে? আল্লাহ তা'আলা অন্য আয়াতে এর জন্যই বলছেন যে, "এরূপ সাফল্যের জন্য আমলকারীদের উচিত আমল করা" [সূরা আস-সাফফাত: ৬১] আরও বলেন, “ আর এ বিষয়ে প্রতিযোগীরা প্রতিযোগিতা করুক” [আল-মুতাফফিফীন: ২৬]

: ১৬
مَنْ يُصْرَفْ عَنْهُ يَوْمَئِذٍ فَقَدْ رَحِمَهُ ۚ وَذَٰلِكَ الْفَوْزُ الْمُبِينُ

‘সেদিন যার থেকে তা সরিয়ে নেয়া হবে ,তার প্রতি তো তিনি দয়া করলেন [১] এবং এটাই স্পষ্ট সফলতা [২]।’

ফুটনোট

[১] বলা হয়েছে, হাশর দিবসের শাস্তি অত্যন্ত লোমহর্ষক ও কঠোর হবে। কাতাদা বলেন, এখানে যা সরানোর কথা বলা হচ্ছে, তা হচ্ছে শাস্তি। কারো উপর থেকে এ শাস্তি সরে গেলে মনে করতে হবে যে, তার প্রতি আল্লাহর অশেষ করুণা হয়েছে। [তাফসীর আবদির রাযযাক]

[২] অর্থাৎ এটিই বৃহৎ ও প্রকাশ্য সফলতা। কুরতুবী এখানে সফলতার অর্থ জান্নাতে প্রবেশ। কারণ, শাস্তি থেকে মুক্তি ও জান্নাতে প্রবেশ ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

:
إِذْ تَسْتَغِيثُونَ رَبَّكُمْ فَاسْتَجَابَ لَكُمْ أَنِّي مُمِدُّكُمْ بِأَلْفٍ مِنَ الْمَلَائِكَةِ مُرْدِفِينَ

স্মরণ কর, যখন তোমরা তোমাদের রব-এর নিকট উদ্ধার প্রার্থনা করছিলে, অতঃপর তিনি তোমাদের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন যে, ‘অবশ্যই আমি তোমাদেরকে সাহায্য করব এক হাজার ফিরিশ্‌তা দিয়ে, যারা একের পর এক আসবে।’
ফুটনোট

: ১০
وَمَا جَعَلَهُ اللَّهُ إِلَّا بُشْرَىٰ وَلِتَطْمَئِنَّ بِهِ قُلُوبُكُمْ ۚ وَمَا النَّصْرُ إِلَّا مِنْ عِنْدِ اللَّهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ

আর আল্লাহ এটা করেছেন শুধু সুসংবাদ স্বরূপ এবং যাতে তোমাদের অন্তরসমূহ এর দ্বারা প্রশান্তি লাভ করে; আর সাহায্য তো শুধু আল্লাহর কাছ থেকেই আসে; নিশ্চয় আল্লাহ প্রবল পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
ফুটনোট

: ১৯
إِنْ تَسْتَفْتِحُوا فَقَدْ جَاءَكُمُ الْفَتْحُ ۖ وَإِنْ تَنْتَهُوا فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ ۖ وَإِنْ تَعُودُوا نَعُدْ وَلَنْ تُغْنِيَ عَنْكُمْ فِئَتُكُمْ شَيْئًا وَلَوْ كَثُرَتْ وَأَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُؤْمِنِينَ

যদি তোমারা মিমাংসা চেয়ে থাক,তাহলে তা তো তোমাদের কাছে এসেছে ; আর যদি তোমারা বিরত হও তবে তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর, কিন্তু যদি তোমরা আবার যুদ্ধ করতে আস তবে আমরাও আবার শাস্তি নিয়ে আসব। আর তোমাদের দল সংখ্যায় বেশী হলেও তোমাদের কোন কাজে আসবে না। আর নিশ্চয় আল্লাহ মুমিনদের সাথে আছেন [১]।

ফুটনোট

[১] এ আয়াতে পরাজিত কুরাইশ কাফেরদের সম্বোধন করে একটি ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যা মুসলিমদের সাথে মোকাবেলা করার উদ্দেশ্যে কুরাইশ বাহিনীর মক্কা থেকে বের হওয়ার সময় ঘটেছিল। ঘটনাটি এই যে, কুরাইশ কাফেরদের বাহিনী মুসলিমদের সাথে যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে প্রস্তুতি নেয়ার পর মক্কা থেকে রওয়ানা হওয়ার প্রাক্কালে বাহিনী প্রধান আবু জাহল প্রমূখ বায়তুল্লাহর পর্দা ধরে প্রার্থনা করেছিল। আর আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, এই দো'আ করতে গিয়ে তারা নিজেদের বিজয়ের দো'আর পরিবর্তে সাধারণ বাক্যে এভাবে দোআ করেছিলঃ ইয়া আল্লাহ! উভয় বাহিনীর মধ্যে যেটি উত্তম ও উচ্চতর, উভয় বাহিনীর মধ্যে যেটি হেদায়াতের উপর রয়েছে এবং উভয় দলের যেটি বেশী ভদ্র ও শালীন এবং উভয়ের মধ্যে যে দ্বীন উত্তম তাকেই বিজয় দান কর। [মুসনাদে আহমাদঃ ৫/৪৩১]

এই নির্বোধেরা এ কথাই ভাবছিল যে, মুসলিমদের তুলনায় আমরাই উত্তম ও উচ্চতর এবং অধিক হেদায়াতের উপর রয়েছি, কাজেই এ দোআটি আমাদেরই অনুকূলে হচ্ছে। আর এই দো-আর মাধ্যমে তারা কামনা করছিল, আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে যেন হক ও বাতিল তথা সত্য ও মিথ্যার ফয়সালা হয়ে যায়। তাদের ধারণা ছিল, যখন আমরা বিজয় অর্জন করব, তখন এটাই হবে আল্লাহ্ তা'আলার পক্ষ থেকে আমাদের সত্যতার ফয়সালা। কিন্তু তারা একথা জানত না যে, এই দোআর মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে তারা নিজেদের জন্য বদদোআ ও মুসলিমদের জন্য নেকদোআ করে যাচ্ছে। যুদ্ধের ফলাফল সামনে আসার পর আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে বলে দিলেন (وَاَنَّ اللهَ مَعَ الْمُؤْمِنِيْنَ) অর্থাৎ আল্লাহ যখন মুসলিমদের সাথে রয়েছেন, তখন কোন দল তোমাদের কিইবা কাজে লাগতে পারে?

১৪ : ১৫
وَاسْتَفْتَحُوا وَخَابَ كُلُّ جَبَّارٍ عَنِيدٍ

আর তারা বিজয় কামনা করলো [১] আর প্রত্যেক উদ্ধত স্বৈরাচারী ব্যর্থ মনোরথ হল [২]।

ফুটনোট

[১] এ আয়াতে কারা বিজয় কামনা করল এ ব্যাপারে দু’টি মত রয়েছে। এক, এখানে রাসূলগণই বিজয় কামনা করেছিলেন। দুই, কাফেরগণ উদ্ধত ও কুফরী এবং শির্কী ব্যবস্থাপনার উপর থাকা সত্ত্বেও নিজেদের জন্য বিজয় কামনা করল। [ফাতহুল কাদীর] এ অর্থের সমর্থনে অন্যত্র বর্ণিত একটি আয়াত পেশ করা যায় যেখানে বলা হয়েছে যে, কাফেররা তাদের দো’আয় বলেছিলঃ “হে আল্লাহ্! এগুলো যদি আপনার কাছ থেকে সত্য হয়, তবে আমাদের উপর আকাশ থেকে পাথর বর্ষণ করুন কিংবা আমাদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তি দিন।” [সূরা আল-আনফালঃ ৩২]

আবার কোন কোন মুফাসসিরের মতে, এটি উভয় সম্প্রদায়েরই কামনা হতে পারে। [কুরতুবী; ফাতহুল কাদীর]

[২] (جبار) অর্থ, নিজের মতকে প্রাধান্যদানকারী এবং অপরের উপর নিজের মত চাপানোর প্রয়াস যিনি চালান। হক্ক গ্রহণের মানসিকতা যার নেই। অন্যত্র আল্লাহ্ তা’আলা এ ধরনের লোকদের পরিণতি সম্পর্কে বলেছেনঃ “আদেশ করা হবে, তোমরা উভয়ে নিক্ষেপ কর প্রত্যেক উদ্ধত কাফিরকে, যে কল্যাণকর কাজে প্রবল বাধাদানকারী, সীমালংঘনকারী ও সন্দেহ পোষণকারী। যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র সংগে অন্য ইলাহ্ গ্রহণ করতো তাকে কঠিন শাস্তিতে নিক্ষেপ কর।” [সূরা ক্কাফঃ ২৪-২৬]

তদ্রুপ হাদীসেও এসেছে, “কিয়ামতের দিন জাহান্নামকে নিয়ে আসা হবে। তখন সে সমস্ত সৃষ্টিজগতকে ডেকে বলবে, “আমাকে প্রত্যেক সীমালঙ্ঘনকারী, উদ্ধতের ব্যাপারে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।” [তিরমিযীঃ ২৫৭৪]

২১ : ১০৫
وَلَقَدْ كَتَبْنَا فِي الزَّبُورِ مِنْ بَعْدِ الذِّكْرِ أَنَّ الْأَرْضَ يَرِثُهَا عِبَادِيَ الصَّالِحُونَ

আর অবশ্যই আমরা ‘যিকর’ এর পর যাবূরে [১] লিখে দিয়েছি যে, যমীনের [২] অধিকারী হবে আমার যোগ্য বান্দাগণই।

ফুটনোট

[১] زبور শব্দটি একবচন, এর বহুবচন হলো زُبُر। এর অর্থ কিতাব। [কুরতুবী; ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর] দাউদ আলাইহিস সালাম-এর প্রতি নাযিলকৃত বিশেষ কিতাবের নামও যাবুর। এখানে 'যাবুর' বলে কি বোঝানো হয়েছে, এ সম্পর্কে বিভিন্ন উক্তি আছে। কারো কারো মতে ذكر বলে তাওরাত আর زبور বলে তওরাতের পর নাযিলকৃত আল্লাহর অন্যান্য গ্ৰন্থসমূহ বোঝানো হয়েছে; যথা ইঞ্জিল, যাবুর ও কুরআন। আবার কোন কোন মুফাসসিরের মতে ذكر বলে লওহে মাহফুয زبور বলে নবীদের উপর নাযিলকৃত সকল ঐশী গ্ৰন্থই বোঝানো হয়েছে। [ইবন কাসীর]

[২] অধিক সংখ্যক তফসীরবিদের মতে এখানে যমীন বলে জান্নাতের যমীন বোঝানো হয়েছে। কুরআনের অন্য আয়াতও এর সমর্থন করে। তাতে বলা হয়েছে “তারা প্রবেশ করে বলবে, প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাদের প্রতি তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছেন এবং আমাদেরকে অধিকারী করেছেন এ যমীনের; আমরা জান্নাতে যেখানে ইচ্ছে বসবাস করব।” সদাচারীদের পুরস্কার কত উত্তম!” [সূরা আয-যুমারঃ ৭৪] এটাও ইঙ্গিত যে, যমীন বলে জান্নাতের যমীন বোঝানো হয়েছে। কারণ দুনিয়ার যমীনের মালিক তো মুমিন-কাফের সবাই হয়ে যায়। এছাড়া এখানে সৎকর্মপরায়ণদের যমীনের মালিক হওয়ার কথাটি কেয়ামতের আলোচনার পর উল্লেখ করা হয়েছে। কেয়ামতের পর জান্নাতের যমীনই তো বাকী থাকবে।

তবে কোন কোন মুফাসসির বলেন, এখানে যমীন বলে বর্তমান সাধারণ দুনিয়ার যমীন ও জান্নাতের যমীন উভয়টিই বোঝানো হবে। জান্নাতের যমীনের মালিক যে এককভাবে সৎকর্মপরায়ণগন হবে, তা বর্ণনা সাপেক্ষ নয়। তবে এক সময় তারা এককভাবে দুনিয়ার যমীনের মালিক হবে বলেও প্রতিশ্রুতি আছে। কুরআনের একাধিক আয়াতে এই সংবাদ দেয়া হয়েছে। এক আয়াতে আছেঃ “যমীন তো আল্লাহরই। তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছে সেটার উত্তরাধিকারী করেন এবং শুভ পরিণাম তো মুত্তাকীদের জন্য। ” [সূরা আল-আরাফঃ ১২৮] অন্য আয়াতে এসেছেঃ “তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে আল্লাহ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে, তিনি অবশ্যই তাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধিত্ব দান করবেন” [সূরা আন-নূরঃ ৫৫] আরও এক আয়াতে আছেঃ “নিশ্চয় আমরা আমার রাসূলগণকে এবং মুমিনগণকে পার্থিব জীবনে এবং কেয়ামতের দিন সাহায্য করব। ” [সূরা গাফেরঃ ৫১] ঈমানদার সৎকর্মপরায়ণেরা একবার পৃথিবীর বৃহদংশ অধিকারভুক্ত করেছিল। জগদ্বাসী তা প্রত্যক্ষ করেছে। দীর্ঘকাল পর্যন্ত এই পরিস্থিতি অটল ছিল। [ইবন কাসীর]

২২ : ৪১
الَّذِينَ إِنْ مَكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ ۗ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِ

তারা [১] এমন লোক যাদেরকে আমরা যমীনের বুকে প্রতিষ্ঠিত করলে সালাত কায়েম করবে [২], যাকাত দেবে এবং সৎকাজের নির্দেশ দেবে ও অসৎকাজে নিষেধ করবে; আর সব কাজের চুড়ান্ত পরিণতি আল্লাহ্‌র ইখতিয়ারে।

ফুটনোট

[১] এই আয়াতে তাদেরই বিশেষণ উল্লেখ করা হয়েছে, যাদেরকে তাদের ভিটেমাটি থেকে বিনা কারণে উচ্ছেদ করা হয়েছে। এজন্যেই আবুল আলীয়া বলেন, এখানে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের কথা বলা হয়েছে। [ইবন কাসীর] হাসান বসরী বলেন, তারা হচ্ছে এ উম্মতের সে সমস্ত লোক, যারা কোন জায়গা জয় করলে সেখানে সালাত কায়েম করে। ইবন আবী নাজীহ বলেন, এখানে শাসকদের উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। দাহহাক বলেন, এটা এমন এক শর্ত যা আল্লাহ্‌ তা'আলা যাদেরকে রাষ্ট্র ক্ষমতা প্ৰদান করেছেন তাদের উপর আরোপ করেছেন। [কুরতুবী] উমর ইবন আবদুল আযীয বলেন, এটি শুধু গভর্ণরের দায়িত্ব নয়, এটা গভর্ণর ও যাদের উপর তাকে গভর্ণর বানানো হয়েছে তাদের সবার দায়িত্ব। আমি কি তোমাদেরকে গভর্ণরের উপর কি দায়িত্ব আর গভর্ণরের জন্য তোমাদের উপর কি দায়িত্ব সেটা জানিয়ে দেব না? গভর্ণরের দায়িত্ব হচ্ছে, তোমাদের উপর আল্লাহ্‌র হকের ব্যাপারে তোমাদেরকে পাকড়াও করা। আর তোমাদের কারও দ্বারা অপর কারও আক্রান্ত হলে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে তার হক আদায় করা। আর যতটুকু সম্ভব তোমাদেরকে সহজ সরল সঠিক পথে পরিচালিত করা। আর তোমাদের উপর ওয়াজিব হচ্ছে, আনুগত্য করা। তবে জোর করে নয়। অনুরূপভাবে প্রকাশ্য কথার বিপরীতে গোপনে ভিন্ন কথা না বলা। [ইবন কাসীর] আতিয়্যাহ আল-আওফী বলেন, এ আয়াতটি অন্য একটি আয়াতের মত। যেখানে বলা হয়েছে, “তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে আল্লাহ্‌ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে, তিনি অবশ্যই তাদেরকে যমীনে প্রতিনিধিত্ব দান করবেন, যেমন তিনি প্রতিনিধিত্ব দান করেছেন তাদের পূর্ববতীদেরকে”। [সূরা আন-নূরঃ ৫৫]

আয়াতে বলা হয়েছে যে, আমি তাদেরকে যমীনে প্রতিষ্ঠিত করলে তারা তাদের ক্ষমতাকে সালাত কায়েম করা, যাকাত আদায় করা, সৎকর্মের আদেশ ও অসৎকর্মে নিষেধের কাজে প্রয়োগ করবে। এই আয়াত মদীনায় হিজরতের অব্যবহিত পরে তখন নাযিল হয়, যখন মুসলিমদের কোথাও পূর্ণ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল না। কিন্তু আল্লাহ্‌ তা'আলা তাদের সম্পর্কে পূর্বেই বলে দিলেন যে, তারা ক্ষমতা লাভ করলে তা দ্বীনের উল্লেখিত গুরুত্বপূর্ণ কার্য সম্পাদনে ব্যয় করবে। এ কারণেই ওসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেনঃ ثَنَاءٌ قَبْلَ بَلاَء অর্থাৎ আল্লাহ্‌ তা'আলার এই এরশাদ কর্ম অস্তিত্ব লাভ করার পূর্বেই কর্মীদের গুণ ও প্রশংসা করার শামিল। [আত-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর] এরপর আল্লাহ্‌ তা'আলার এই নিশ্চিত সুসংবাদ দুনিয়াতে বাস্তব রূপ লাভ করেছে। চারজন খোলাফায়ে রাশেদীন এ আয়াতের বিশুদ্ধ প্রতিচ্ছবি ছিলেন। [কুরতুবী] আল্লাহ্‌ তা’আলা তাদেরকেই ক্ষমতা দান করলেন এবং কুরআনের ভবিষ্যদ্বাণীর অনুরূপ তাদের কর্ম ও কীর্তি বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, তারা তাদের ক্ষমতা এ কাজেই ব্যয় করেন। তারা সালাত প্রতিষ্ঠিত করেন, যাকাতের ব্যবস্থা সুদৃঢ় করেন, সৎকাজের প্রবর্তন করেন এবং মন্দ কাজের পথ রুদ্ধ করেন।

[২] সালাত কায়েম করার অর্থ হলোঃ সময়মত, সালাতের সীমারেখা, আরকান ও আহকামসহ জামা‘আতের সাথে আদায় করা।

৩০ :
فِي أَدْنَى الْأَرْضِ وَهُمْ مِنْ بَعْدِ غَلَبِهِمْ سَيَغْلِبُونَ

কাছাকাছি অঞ্চলে [১]; কিন্তু তারা তাদের এ পরাজয়ের পর শীঘ্রই বিজয়ী হবে,

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ পারস্যের অনুপাতে রোমকদের সবচেয়ে কাছের জনপদে রোমকগণ পারসিকদের হাতে পরাজিত হয়েছে। [তাবারী]

৩০ :
فِي بِضْعِ سِنِينَ ۗ لِلَّهِ الْأَمْرُ مِنْ قَبْلُ وَمِنْ بَعْدُ ۚ وَيَوْمَئِذٍ يَفْرَحُ الْمُؤْمِنُونَ

কয়েক বছরের মধ্যেই [১]। আগের ও পরের সব ফয়সালা আল্লাহরই। আর সেদিন মুমিনগণ খুশী হবে [২],

ফুটনোট

[১] এই সূরায় রোমক ও পারসিকদের যুদ্ধের কাহিনী আলোচিত হয়েছে। এই যুদ্ধে উভয়পক্ষই ছিল কাফের। তাদের মধ্যে কারও বিজয় এবং কারও পরাজয় বাহ্যতঃ ইসলাম ও মুসলিমদের জন্যে কোন কৌতুহলের বিষয় ছিল না। কিন্তু উভয় কাফের দলের মধ্যে পারসিকরা ছিল অগ্নিপূজারী মুশরিক এবং রোমকরা ছিল নাসারা আহলে কিতাব। ফলে এরা ছিল মুসলিমদের অপেক্ষাকৃত নিকটবতী। [ইবন কাসীর]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মক্কায় অবস্থানকালে পারসিকরা রোমকদের উপর আক্রমণ পরিচালনা করে। হাফেজ ইবনে হাজার প্রমুখের উক্তি অনুযায়ী তাদের এই যুদ্ধ শাম দেশের আযরু"আত ও বুসরার মধ্যস্থলে সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধ চলাকালে মক্কার মুশরিকরা পারসিকদের বিজয় কামনা করত। কেননা, শির্ক ও প্রতিমা পুজায় তারা ছিল পারসিকদের সহযোগী। অপরপক্ষে মুসলিমদের আন্তরিক বাসনা ছিল রোমকরা বিজয়ীত হোক। কেননা, ধর্ম ও মাযহাবের দিক দিয়ে তারা ইসলামের নিকটবর্তী ছিল। [ সা'দী] কিন্তু হল এই যে, তখনকার মত পারসিকরা যুদ্ধে জয়লাভ করল। এমনকি তারা কনষ্টাণ্টিনোপলও অধিকার করে নিল এবং সেখানে উপাসনার জন্যে একটি অগ্নিকুণ্ড নির্মাণ করল। এই ঘটনায় মক্কার মুশরিকরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল এবং মুসলিমদেরকে লজ্জা দিতে লাগল যে, তোমরা যাদের সমর্থন করতে তারা হেরে গেছে। ব্যাপার এখানেই শেষ নয়; বরং আহলে কিতাব রোমকরা যেমন পারসিকদের মোকাবেলায় পরাজয় বরণ করেছে, তেমনি আমাদের মোকাবিলায় তোমরাও একদিন পরাজিত হবে। এতে মুসলিমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত হয়। [সা'দী] সূরা রূমের প্রাথমিক আয়াতগুলো এই ঘটনা সম্পর্কেই নাযিল হয়েছে। এসব আয়াতে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে যে, কয়েক বছর পরেই রোমকরা পারসিকদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হবে।

আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু যখন এসব আয়াত শুনলেন, তখন মক্কার চতুস্পার্শ্বে এবং মুশরিকদের সমাবেশ ও বাজারে উপস্থিত হয়ে ঘোষণা করলেন, তোমাদের হর্ষোৎফুল্ল হওয়ার কোন কারণ নেই। কয়েক বছরের মধ্যে রোমকরা পারসিকদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করবে। মুশরিকদের মধ্যে উবাই ইবনে খালফ কথা ধরল এবং বলল, তুমি মিথ্যা বলছ। এরূপ হতে পারে না। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, আল্লাহর দুশমন, তুই-ই মিথ্যাবাদী। আমি এই ঘটনার জন্যে বাজি রাখতে প্ৰস্তুত আছি। যদি তিন বছরের মধ্যে রোমকরা বিজয়ী না হয়, তবে আমি তোকে দশটি উষ্ট্রী দেব। সবাই এতে সম্মত হল। একথা বলে আবু বকর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে উপস্থিত হয়ে ঘটনা বিবৃত করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি তো তিন বছরের সময় নির্দিষ্ট করিনি। কুরআনের এই জন্যে بضع শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। কাজেই তিন থেকে নয় বছরের মধ্যে এই ঘটনা ঘটতে পারে। তুমি যাও এবং উবাইকে বল যে, আমি দশটি উষ্ট্রীর স্থলে একশ উষ্ট্ৰী বাজি রাখছি, কিন্তু সময়কাল তিন বছরের পরিবর্তে নয় বছর এবং কোন কোন বর্ণনা মতে সাত বছর নির্দিষ্ট করছি। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু আদেশ পালন করলেন এবং উবাইও নতুন চুক্তিতে সম্মত হল। তিরমিয়ী: [৩১৯৩,৩১৯৪] বিভিন্ন হাদিস থেকে জানা যায় যে, হিজরতের পাঁচ বছর পূর্বে এই ঘটনা সংঘটিত হয় এবং সাত বছর পূর্ণ হওয়ার পর বদর যুদ্ধের সময রোমকরা পারসিকদের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করে।

[২] অর্থাৎ যেদিন রোমকরা পারসিকদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হবে, সেদিন আল্লাহর সাহায্যের কারণে মুসলিমরা উৎফুল্ল হবে। বাক্যবিন্যাস পদ্ধতির দিক দিয়ে বাহ্যতঃ এখানে রোমকদের সাহায্য বোঝানো হয়েছে। তারা যদিও কাফের ছিল, কিন্তু অন্য কাফেরদের তুলনায় তাদের কুফর কিছুটা হাল্কা ছিল। কাজেই আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদেরকে সাহায্য করা অবান্তর নয়। বিশেষতঃ যখন তাদেরকে সাহায্য করলে মুসলিমরাও আনন্দিত হয় এবং কাফেরদের মোকাবিলায় তাদের জিত হয়। [সা'দী]।

৩০ :
بِنَصْرِ اللَّهِ ۚ يَنْصُرُ مَنْ يَشَاءُ ۖ وَهُوَ الْعَزِيزُ الرَّحِيمُ

আল্লাহর সাহায্যে। তিনি যাকে ইচ্ছে সাহায্য করেন এবং তিনিই প্রবলপরাক্রমশালী, পরম দয়ালু।
ফুটনোট

৩২ : ২৮
وَيَقُولُونَ مَتَىٰ هَٰذَا الْفَتْحُ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ

আর তারা বলে, 'তোমরা যদি সত্যবাদী হও, তবে বল, কখন হবে এ বিজয় [১]?'

ফুটনোট

[১] তাফসীরকার মুজাহিদ আলোচ্য আয়াতে বিজয় এর অর্থ কেয়ামতের দিন বলে বর্ণনা করেছেন। [ইবন কাসীর; বাগভী] কাতাদাহ বলেন, এখানে فتح বলে বিচার ফয়সালাই বোঝানো হয়েছে। [আত-তাফসীরুস সহীহ] আল্লামা শানকীতী বলেন, কারণ, কুরআনের বহু আয়াতে এ শব্দটি বিচার-ফয়সালা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন শু'আইব আলাইহিস সালাম এর যাবানীতে এসেছে, “হে আমাদের রব! আমাদের ও আমাদের সম্পপ্রদায়ের মধ্যে ন্যায্যভাবে মীমাংসা করে দিন এবং আপনিই শ্রেষ্ঠ মীমাংসাকারী।” [সূরা আল-আশরাফ: ১৮৯] [আদওয়াউল বায়ান]

৩২ : ২৯
قُلْ يَوْمَ الْفَتْحِ لَا يَنْفَعُ الَّذِينَ كَفَرُوا إِيمَانُهُمْ وَلَا هُمْ يُنْظَرُونَ

বলুন, 'বিজয়ের দিন কাফিরদের ঈমান আনা তাদের কোন কাজে আসবে না এবং তাদেরকে অবকাশও দেয়া হবে না [১]'।

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ যখন আল্লাহর আযাব এসে যাবে এবং তাঁর ক্ৰোধ আপতিত হবে, তখন কাফেরদের ঈমান কোন কাজে আসবে না। আর তাদেরকে তখন আর কোন সুযোগও দেয়া হবে না। যেমন অন্য আয়াতে এসেছে, “অতঃপর তাদের কাছে যখন স্পষ্ট প্রমাণাদিসহ তাদের রাসূলগণ আসলেন, তখন তারা নিজেদের কাছে বিদ্যমান থাকা জ্ঞানে উৎফুল্ল হল। আর তারা যা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করত তা-ই তাদেরকে বেষ্টন করল। অতঃপর তারা যখন আমাদের শাস্তি দেখল তখন বলল, ‘আমরা একমাত্র আল্লাহর উপর ঈমান আনলাম এবং আমরা তাঁর সাথে যাদেরকে শরীক করতাম তাদের সাথে কুফরী করলাম।’ কিন্তু তারা যখন আমার শাস্তি দেখল তখন তাদের ঈমান তাদের কোন উপকারে আসল না। আল্লাহর এ বিধান পূর্ব থেকেই তাঁর বান্দাদের মধ্যে চলে আসছে এবং তখনই কাফিররা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।" [সূরা গাফির: ৮৩-৮৫]

৪৮ :
إِنَّا فَتَحْنَا لَكَ فَتْحًا مُبِينًا

নিশ্চয় আমরা আপনাকে দিয়েছি সুস্পষ্ট বিজয় [১],

ফুটনোট

[১] অধিকাংশ সাহাবী, তাবেয়ী ও তাফসীরবিদদের মতে সূরা ফাতহ ষষ্ঠ হিজরীতে অবতীর্ণ হয়, যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উমরার উদ্দেশ্যে সাহাবায়ে কেরামকে সাথে নিয়ে মক্কা মুকাররম তাশরীফ নিয়ে যান এবং হারাম শরীফের সন্নিকটে হুদাইবিয়া নামক স্থান পৌঁছে অবস্থান গ্ৰহণ করেন। হুদাইবিয়া মক্কার বাইরে হারামের সীমানার সন্নিকটে অবস্থিত একটি স্থানের নাম। আজকাল এই স্থানটিকে সুমাইছী বলা হয়। ঘটনাটি এই স্থানেই ঘটে। এই ঘটনার এক অংশ এই যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় স্বপ্ন দেখলেন তিনি সাহাবায়ে কেরামসহ মক্কায় নিৰ্ভয়ে ও নির্বিঘ্নে প্রবেশ করছেন এবং ইহরামের কাজ সমাপ্ত করে কেউ কেউ নিয়মানুযায়ী মাথা মুণ্ডন করেছেন, কেউ কেউ চুল কাটিয়েছেন এবং তিনি বায়তুল্লাহ প্রবেশ করেছেন ও বায়তুল্লাহর চাবি তার হস্তগত হয়েছে। এটা সূরায় বর্ণিত ঘটনার একটি অংশ। নবী-রাসূলগণের স্বপ্ন ওহী হয়ে থাকে। তাই স্বপ্নটি যে বাস্তবরূপ লাভ করবে, তা নিশ্চিত ছিল। কিন্তু স্বপ্নে এই ঘটনার কোন সন, তারিখ বা মাস নির্দিষ্ট করা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে স্বপ্নটি মক্কা বিজয়ের সময় প্রতিফলিত হওয়ার ছিল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন সাহাবায়ে কেরামকে স্বপ্নের বৃত্তান্ত শুনালেন, তখন তারা সবাই পরম আগ্রহের সাথে মক্কা যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে দিলেন। সাহাবায়ে কেরামের প্রস্তুতি দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও ইচ্ছা করে ফেললেন। কেননা, স্বপ্নে কোন বিশেষ সাল অথবা মাস নির্দিষ্ট ছিল না। কাজেই এই মুহূর্তেই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনাও ছিল। কিন্তু মক্কার কাফেররা তাকে মক্কা প্রবেশে বাধা দান করে। অতঃপর তারা এই শর্তে সন্ধি করতে সম্মত হয় যে, এ বছর তিনি মদীনায় ফিরে যাবেন এবং পরবর্তী বছর তিনি উমরা করতে আসবেন। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে অনেকেই বিশেষত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এ ধরনের সন্ধি করতে অসম্মত ছিলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই সন্ধিকে পরিণামে মুসলিমদের জন্যে সাফল্যের উপায় মনে করে গ্রহণ করে নেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন উমরার এহরাম খুলে হুদাইবিয়া থেকে ফেরত রওয়ানা হলেন, তখন পথিমধ্যে এই পূর্ণ সূরা অবতীর্ণ হয়। এতে বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর স্বপ্ন সত্য এবং অবশ্যই বাস্তবরূপ লাভ করবে। কিন্তু তার সময় এখনও হয়নি। পরে মক্কা বিজয়ের সময় এই স্বপ্ন বাস্তবরূপ লাভ করে। এই সন্ধি প্রকৃতপক্ষে মক্কা বিজয়ের কারণ হয়েছিল। তাই একে প্রকাশ্য বিজয় বলে ব্যক্ত করা হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ও অপর কয়েকজন সাহাবী বলেন: তোমরা মক্কা বিজয়কে বিজয় বলে থাক; কিন্তু আমরা হুদাইবিয়ার সন্ধিকেই বিজয় মনে করি। জাবের রাদিয়ালাহু আনহু বলেন: আমি হুদাইবিয়ার সন্ধিকে বিজয় মনে করি। বারা ইবনে আযেব বলেন: তোমরা মক্কা বিজয়কেই বিজয় মনে কর এবং নি:সন্দেহ তা বিজয়; কিন্তু আমরা হুদাইবিয়ার ঘটনার বাইয়াতে রিদওয়ানকেই আসল বিজয় মনে করি। এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি বৃক্ষের নীচে উপস্থিত চৌদ্দশত সাহাবীর কাছ থেকে জেহাদের শপথ নিয়েছিল। [বুখারী: ৪২৮, মুসলিম: ৭৯৪]

৪৮ : ১৮
لَقَدْ رَضِيَ اللَّهُ عَنِ الْمُؤْمِنِينَ إِذْ يُبَايِعُونَكَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ فَعَلِمَ مَا فِي قُلُوبِهِمْ فَأَنْزَلَ السَّكِينَةَ عَلَيْهِمْ وَأَثَابَهُمْ فَتْحًا قَرِيبًا

অবশ্যই আল্লাহ মুমিনগণের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন, যখন তারা গাছের নীচে আপনার কাছে বাই’আত গ্ৰহণ করেছিল [১], অতঃপর তাদের অন্তরে যা ছিল তা তিনি জেনে নিয়েছেন ; ফলে তিনি তাদের উপর প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাদেরকে আসন্ন বিজয়ে পুরস্কৃত করলেন [২] ;

ফুটনোট

[১] হুদাইবিয়া নামক স্থানে সাহাবায়ে কিরামের কাছে যে বাই’আত নেওয়া হয়েছিল এখানে তা উল্লেখ করা হচ্ছে। এই আয়াতে আল্লাহ তা’আলা এই শপথে অংশগ্রহণকারীদের প্রতি স্বীয় সন্তুষ্টি ঘোষণা করেছেন। এ কারণেই একে “বাই‘আতে-রিদওয়ান” তথা সন্তুষ্টির শপথও বলা হয়। [দেখুন-সাদী] জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, হুদাইবিয়ার দিনে আমাদের সংখ্যা ছিল চৌদ্দশত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন “তোমরা ভূপৃষ্ঠের অধিবাসীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। [বুখারী: ৩৮৩৯, মুসলিম: ৩৪৫৩] অন্য হাদীসে এসেছে, যারা এই বৃক্ষের নীচে শপথ করেছে, তাদের কেউ জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। [মুসলিম: ৪০৩৪]

[২] এই আসন্ন বিজয়ের অর্থ সর্বসম্মতভাবে খাইবার বিজয়। [কুরতুবী, সাদী, বাগভী]

৪৮ : ১৯
وَمَغَانِمَ كَثِيرَةً يَأْخُذُونَهَا ۗ وَكَانَ اللَّهُ عَزِيزًا حَكِيمًا

আর বিপুল পরিমান গণীমতে [১], যা তারা হস্তগত করবে; এবং আল্লাহ প্রবল পরাক্রমশালী, হিকমতওয়ালা।

ফুটনোট

[১] এতে খাইবরের যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বোঝানো হয়েছে। [ফাতহুল কাদীর, কুরতুবী]

৪৮ : ২৭
لَقَدْ صَدَقَ اللَّهُ رَسُولَهُ الرُّؤْيَا بِالْحَقِّ ۖ لَتَدْخُلُنَّ الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ إِنْ شَاءَ اللَّهُ آمِنِينَ مُحَلِّقِينَ رُءُوسَكُمْ وَمُقَصِّرِينَ لَا تَخَافُونَ ۖ فَعَلِمَ مَا لَمْ تَعْلَمُوا فَجَعَلَ مِنْ دُونِ ذَٰلِكَ فَتْحًا قَرِيبًا

অবশ্যই আল্লাহ তাঁর রাসূলকে স্বপ্নটি যথাযথভাবে সত্যে পরিণত করে দিয়েছেন [১], আল্লাহর ইচ্ছায় তোমরা অবশ্যই মসজিদুল-হারামে প্রবেশ করবে নিরাপদে --- মাথা মুণ্ডন করে এবং চুল ছেঁটে, নিৰ্ভয়ে। অতঃপর তিনি (আল্লাহ) জেনেছেন যা তোমরা জান নি। সুতরাং এ ছাড়াও তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন এক সদ্য বিজয়।

ফুটনোট

[১] হুদাইবিয়ার সন্ধি চূড়ান্ত হয়ে গেলে একথা স্থির হয়ে যায় যে, এখন মক্কায় প্রবেশ এবং (উমরাহ) পালন ব্যতিরেকেই মদিনায় ফিরে যেতে হবে। বলাবাহুল্য, সাহাবায়ে কেরাম উমরাহ পালনের সংকল্প রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর একটি স্বপ্নের ভিত্তিতে করেছিলেন, যা এক প্রকার ওহি ছিল। এখন বাহ্যতঃ এর বিপরীত হতে দেখে কারও কারও অন্তরে এই সন্দেহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে লাগল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর স্বপ্ন সত্য হলো না। অপরদিকে কাফের-মুনাফিকরা মুসলিমদেরকে বিদ্রুপ করল যে, তোমাদের রাসূলের স্বপ্ন সত্য নয়। তখন এই আয়াত নাযিল করে তাদের প্রশ্নের জবাব দেয়া হয়। আয়াতের অর্থ এই যে, আল্লাহ তাঁর রাসূলকে স্বপ্নের ব্যাপারে সাচ্চা দেখিয়েছেন। যদিও এই সাচ্চা দেখানোর ঘটনা ভবিষ্যতে সংঘটিত হওয়ার ছিল; কিন্তু একে অতীত পদবাচ্য ব্যক্ত করে এর নিশ্চিত ও অকাট্য হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। অর্থাৎ মসজিদে-হারামে প্ৰবেশ সংক্রান্ত আপনার স্বপ্ন অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে; কিন্তু এ বছর নয়- এ বছরের পরে। স্বপ্নে মসজিদে হারামে প্রবেশের সময় নির্দিষ্ট ছিল না। পরম ঔৎসুক্যবশতঃ সাহাবায়ে কেরাম এ বছরই সফরের সংকল্প করে ফেললেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-ও তাদের সাথে যোগ দিলেন। এতে আল্লাহ তা'আলার বিরাট রহস্য নিহিত ছিল, যা হুদাইবিয়ার সন্ধির মাধ্যমে বিকাশ লাভ করে। সেমতে সিদিকে আকবর রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রথমেই উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর জওয়াবে বলেছিলেনঃ আপনার সন্দেহ করা উচিত নয়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর স্বপ্ন কোনো সময় ও বছর নির্দিষ্ট ছিল না। এখন না হলে পরে হবে। [বুখারীঃ ২৫২৯]

৪৮ : ২৮
هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَىٰ وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ ۚ وَكَفَىٰ بِاللَّهِ شَهِيدًا

তিনিই তাঁর রাসূলকে পথনির্দেশ ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন, অন্য সমস্ত দ্বীনের উপর একে জয়যুক্ত করার জন্য। আর সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।
ফুটনোট

৪৯ : ১৩
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَىٰ وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا ۚ إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ ۚ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ

হে মানুষ! আমরা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে [১], আর তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমারা একে অন্যের সাথে পরিচিত হতে পার [২]। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সে ব্যাক্তিই বেশী মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে বেশী তাকওয়াসম্পন্ন। নিশ্চয় আল্লাহ্‌ সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত।

ফুটনোট

[১] আল্লাহর এ বাণীটিই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার বিভিন্ন বক্তৃতা ও উক্তিতে আরো স্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন। যেমন-মক্কা বিজয়ের সময় কাবার তাওয়াফের পর তিনি যে বক্তৃতা করেছিলেন তাতে বলেছিলেনঃ “সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর যিনি তোমাদের থেকে জাহেলিয়াতের দোষ-ত্রুটি ও অহংকার দূর করে দিয়েছেন। হে লোকেরা! সমস্ত মানুষ দু’ ভাগে বিভক্ত। এক, নেককার ও পরহেজগার যারা আল্লাহর দৃষ্টিতে মর্যাদার অধিকারী। দুই, পাপী ও দুরাচার যারা আল্লাহর দৃষ্টিতে নিকৃষ্ট। অন্যথায় সমস্ত মানুষই আদমের সন্তান। আর আদম মাটির সৃষ্টি।” (তিরমিয়ী: ৩১৯৩]

অনুরূপভাবে, বিদায় হজ্জের সময় আইয়ামে তাশরীকের মাঝামাঝি সময়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বক্তৃতা করেছিলেন। তাতে তিনি বলেছিলেন, “হে লোকজন! সাবধান তোমাদের আল্লাহ একজন। কোন অনারবের ওপর কোন আরবের ও কোন আরবের ওপর কোন অনারবের কোন কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের ও কোন শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণঙ্গের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই আল্লাহভীতি ছাড়া। তোমাদের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশী আল্লাহভীরু সেই আল্লাহর কাছে সর্বাধিক মর্যাদাবান। আমি কি তোমাদেরকে পৌঁছিয়েছি? তারা বলল, আল্লাহর রাসূল পৌঁছিয়েছেন। তিনি বললেন, তাহলে যারা এখানে উপস্থিত আছে তারা যেন অনুপস্থিত লোকদের কাছে এ বাণী পৌঁছিয়ে দেয়।” [মুসনাদে আহমাদ: ৫/৪১১]

অন্য হাদীসে এসেছে, “তোমরা সবাই আদমের সন্তান। আর আদমকে মাটি দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছিল। লোকজন তাদের বাপদাদার নাম নিয়ে গর্ব করা থেকে বিরত হোক। তা না হলে আল্লাহর দৃষ্টিতে তারা নাক দিয়ে পায়খানা ঠেলে এমন নগণ্য কীট থেকেও নীচ বলে গণ্য হবে।” [মুসনাদে বায্‌যার: ৩৫৮৪]

আর একটি হাদীসে তিনি বলেছেনঃ “আল্লাহ তা'আলা কিয়ামতের দিন তোমাদের বংশ ও আভিজাত্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন না। তোমাদের মধ্যে যে বেশী আল্লাহভীরু সে-ই আল্লাহর কাছে সর্বাধিক মর্যাদার অধিকারী”। [ইবনে জারীর: ৩১৭৭২] আরো একটি হাদীসের ভাষা হচ্ছেঃ “আল্লাহ তা'আলা তোমাদের চেহারা-আকৃতি ও সম্পদ দেখেন না, বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও কাজ-কর্ম দেখেন ৷” [মুসলিম: ২৫৬৪, ইবনে মাজাহ: ৪১৪৩]

[২] কোন কোন মুফাসসিরের মতে, বড় বড় গোত্রকে شعون আর তার চেয়ে ছোট গোত্রকে قباىٔل বলা হয়। অপর কারও মতে, অনারব জাতিসমূহের বংশ পরিচয় যেহেতু সংরক্ষিত নেই সেহেতু তাদেরকে شعون বলা হয় এবং আরব জাতিসমূহের বংশ পরিচয় সংরক্ষিত আছে, তাদেরকে قباىٔل বলা হয়। [দেখুন-কুরতুবী, ফাতহুল কাদীর]

৪৭ :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ تَنْصُرُوا اللَّهَ يَنْصُرْكُمْ وَيُثَبِّتْ أَقْدَامَكُمْ

হে মুমিনগণ ! যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর, তবে তিনি তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পা সমূহ সুদৃঢ় করবেন।
ফুটনোট

৫৭ : ১০
وَمَا لَكُمْ أَلَّا تُنْفِقُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلِلَّهِ مِيرَاثُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۚ لَا يَسْتَوِي مِنْكُمْ مَنْ أَنْفَقَ مِنْ قَبْلِ الْفَتْحِ وَقَاتَلَ ۚ أُولَٰئِكَ أَعْظَمُ دَرَجَةً مِنَ الَّذِينَ أَنْفَقُوا مِنْ بَعْدُ وَقَاتَلُوا ۚ وَكُلًّا وَعَدَ اللَّهُ الْحُسْنَىٰ ۚ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ

আর তোমাদের কি হলো যে, তোমরা আল্লাহর পথে ব্যয় করছ না? অথচ আসমানসমূহ ও যমীনের মীরাস [১] তো আল্লাহ্‌রই। তোমাদের মধ্যে যারা বিজয়ের আগে ব্যয় করেছে [২] ও যুদ্ধ করছে,তারা (এবং পরবর্তীরা) সমান নয় [৩]। তারা মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ তাদের চেয়ে যারা পরবর্তী কালে ব্যয় করেছে ও যুদ্ধ করেছে। তবে আল্লাহ্‌ উভয়ের জন্যই কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন [৪]। আর তোমারা যা কর আল্লাহ্‌ সে সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত।

ফুটনোট

[১] ميراث অভিধানে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত মালিকানাকে বলা হয়ে থাকে। এই মালিকানা বাধ্যতামূলক মৃত ব্যক্তি ইচ্ছা করুক বা না করুক, ওয়ারিশ ব্যক্তি আপনাআপনি মালিক হয়ে যায়। এখানে নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের উপর আল্লাহ তা'আলার সার্বভৌম মালিকানাকে ميراث শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করার রহস্য এই যে, তোমরা ইচ্ছা কর বা না কর, তোমরা আজ যে যে জিনিসের মালিক বলে গণ্য হও, সেগুলো অবশেষে আল্লাহ তা'আলার বিশেষ মালিকানায় চলে যাবে। [সা’দী, কুরতুবী] এক হাদীসে এসেছে, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন, একদিন আমরা একটি ছাগল যাবাই করে তার অধিকাংশ গোশত বন্টন করে দিলাম, শুধু একটি হাত নিজেদের জন্যে রাখলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ বণ্টনের পর এই ছাগলের গোশত কতটুকু রয়ে গেছে? আমি আরয করলামঃ শুধু একটি হাত রয়ে গেছে। তিনি বললেনঃ গোটা ছাগলই রয়ে গেছে। তোমার ধারণা অনুযায়ী কেবল হাতই রয়ে যায়নি। [তিরমিয়ী:২৪৭০]

কেননা, গোটা ছাগলই আল্লাহর পথে ব্যয় হয়েছে। এটা আল্লাহর কাছে তোমার জন্যে থেকে যাবে। যে হাতটি নিজের খাওয়ার জন্যে রেখেছ, আখেরাতে এর কোন প্রতিদান পাবে না। কেননা, এটা এখানেই বিলীন হয়ে যাবে। আয়াতের আরেকটি অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর পথে অর্থ খরচ করতে গিয়ে তোমাদের কোন রকম দারিদ্র বা অস্বচ্ছলতার আশংকা করা উচিত নয়। কেননা, যে আল্লাহর উদ্দেশ্যে তা খরচ করবে তিনি যমীন ও উর্ধ জগতের সমস্ত ভাণ্ডারের মালিক। আজ তিনি তোমাদেরকে যা দান করে রেখেছেন তাঁর কাছে দেয়ার শুধু ঐ টুকুই ছিল না। কাল তিনি তোমাদেরকে তার চেয়েও অনেক বেশী দিতে পারেন। [ইবন কাসীর] একথাটাই অন্য একটি স্থানে এভাবে বলা হয়েছে, “হে নবী, তাদের বলুন, আমার রব তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার জন্য ইচ্ছা অঢেল রিযিক দান করেন এবং যার জন্য ইচ্ছা তা সংকীর্ণ করে দেন। আর তোমরা যা খরচ করা তার পরিবর্তে তিনিই তোমাদেরকে আরও রিফিক দান করেন। তিনি সর্বোত্তম রিযিক দাতা।” [সূরা সাবা: ৩৯]

[২] অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে, এখানে মক্কা বিজয় উদ্দেশ্য। [তাবারী; ইবন কাসীর; জালালাইন; মুয়াসসার] তবে কারও কারও মতে, এর দ্বারা হুদায়বিয়ার যুদ্ধ বোঝানো হয়েছে। [সা’দী]

[৩] আল্লাহর পথে ব্যয় করার প্রতি জোর দেয়ার পর পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর পথে যা কিছু যে কোন সময় ব্যয় করলে সওয়াব পাওয়া যাবে; কিন্তু ঈমান, আন্তরিকতা ও অগ্ৰগামিতার পার্থক্যবশত সওয়াবেও পার্থক্য হবে। বলা হয়েছেঃ

لَا يَسْتَوِي مِنكُم مَّنْ أَنفَقَ مِن قَبْلِ الْفَتْحِ وَقَاتَلَ

অর্থাৎ যারা আল্লাহর পথে ধনসম্পদ ব্যয় করে তারা দুই শ্রেণীতে বিভক্ত। (এক) যারা মক্কা বিজয়ের পূর্বে বিশ্বাস স্থাপন করত আল্লাহর পথে ব্যয় করেছে। (দুই) যারা মক্কা বিজয়ের পর মুমিন হয়ে আল্লাহর পথে ব্যয় করেছে। এই দুই শ্রেণীর লোক আল্লাহর কাছে সমান নয়; বরং মর্যাদায় একশ্রেণী অপর শ্রেণী থেকে শ্রেষ্ঠ। মক্কা বিজয়ের পূর্বে বিশ্বাস স্থাপনকারী, জেহাদকারী ও ব্যয়কারীর মর্যাদা অপর শ্রেণী অপেক্ষা বেশী। কারণ, অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতিতে তারা আল্লাহ তা'আলার জন্য এমন সব বিপদাপদের সম্মুখীন হয়েছিলো যার সম্মুখীন অন্য গোষ্ঠীকে হতে হয়নি। মুফাসসিরদের মধ্যে মুজাহিদ, কাতাদা এবং যায়েদ ইবনে আসলাম বলেনঃ এ আয়াতে বিজয় শব্দটি যে ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছে সেটি হচ্ছে মক্কা বিজয়। আমের শা'বী বলেনঃ এর দ্বারা হুদায়বিয়ার সন্ধিকে বুঝানো হয়েছে। অধিকাংশ মুফাসসির প্রথম মতটি গ্রহণ করেছেন। [কুরতুবী; ইবন কাসীর]

[৪] অর্থাৎ পারস্পরিক তারতম্য সত্বেও আল্লাহ তা'আলা কল্যাণ অর্থাৎ জান্নাত ও মাগফিরাতের ওয়াদা সবার জন্যেই করেছেন। এই ওয়াদা সাহাবায়ে-কেরামের সেই শ্রেণীদ্বয়ের জন্যে, যারা মক্কাবিজয়ের পূর্বে ও পরে আল্লাহর পথে ব্যয় করেছেন এবং ইসলামের শক্ৰদের মোকাবিলা করেছেন। এতে সাহাবায়ে-কেরামের প্রায় সমগ্র দলই শামিল আছে। তাই মাগফিরাত ও রহমতের এই কুরআনী ঘোষণা প্রত্যেক সাহাবীকে শামিল করেছে। [সা’দী]

শুধু মাগফিরাতেই নয়;

رَضِىَ اللّٰهُ عَنْهُمْ وَرَضُوْاعَنْهُ [সূরা আত-তাওবাহঃ ১০০]

বলে তাঁর সস্তুষ্টিরও নিশ্চিত আশ্বাস দান করেছেন।

১১০ :
إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللَّهِ وَالْفَتْحُ

যখন আসবে আল্লাহ্র সাহায্য ও বিজয় [১]

ফুটনোট

[১] আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, যখন এ সূরা নাযিল হলো তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূরাটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়লেন এবং বললেন, “মক্কা বিজয়ের পর আর কোন হিজরত নেই।“ [মুস্তাদরাকে হাকিম: ২/২৫৭] এ সূরায় রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওফাত নিকটবর্তী হওয়ার ইঙ্গিত আছে। এক বর্ণনায় আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা উবায়দুল্লাহ্ ইবনে উতবাকে প্রশ্ন করে বলেন, কোন পূর্ণাঙ্গ সূরা সবশেষে নাযিল হয়েছে? উবায়দুল্লাহ্ বলেন, আমি বললাম: “ইযা জাআ নাসরুল্লাহি ওয়াল ফাতহ’। তিনি বললেন, সত্য বলেছ। [মুসলিম: ৩০২৪] ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, সূরা আন-নাসর বিদায় হজে অবতীর্ণ হয়েছে। এরপর

اَلْيَوْمَ اَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ

[সূরা আল-মায়িদাহ: ৩] আয়াত অবতীর্ণ হয়। অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাত্র আশি দিন জীবিত ছিলেন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবনের যখন মাত্র পঞ্চাশ দিন বাকি ছিল, তখন কালালাহ্ সংক্রান্ত [সূরা আন-নিসা: ১৭৬] আয়াত অবতীর্ণ হয়। অতঃপর পঁয়ত্রিশ দিন বাকী থাকার সময়

لَقَدْ جَآءَكُمْ رَسُوْلٌ مِّنْ اَنْفُسِكُمْ عَزِيْزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيْصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْ مِنِيْنَ رَءُوْفٌ رَّحِيْمٌ

আয়াত অবতীর্ণ হয় এবং একুশ দিন বাকি থাকার সময়

وَاتَّقُوا يَوْمًا تُرْجَعُونَ فِيهِ إِلَى اللَّهِ ۖ ثُمَّ تُوَفَّىٰ كُلُّ نَفْسٍ مَّا كَسَبَتْ وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ

[সূরা আল-বাকারাহ: ২৮১] আয়াত অবতীর্ণ হয়।


[১] এ ব্যাপারে প্রায় সকলেই একমত যে, এখানে বিজয় বলে মক্কা বিজয় বোঝানো হয়েছে। [মুয়াসসার, ইবন কাসীর] আর বিজয় মানে কোন একটি সাধারণ যুদ্ধে বিজয় নয়। বরং এর মানে হচ্ছে এমন একটি চুড়ান্ত বিজয় যার পরে ইসলামের সাথে সংঘর্ষ করার মতো আর কোন শক্তির অস্তিত্ব দেশের বুকে থাকবে না এবং একথাও সুস্পষ্ট হয়ে যাবে যে, বর্তমানে আরবে এ দ্বীনটিই প্রাধান্য বিস্তার করবে। [দেখুন, আদ্ওয়াউল বায়ান]

১১০ :
وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُونَ فِي دِينِ اللَّهِ أَفْوَاجًا

আর আপনি মানুষকে দলে দলে আল্লাহ্র দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবেন, [১]

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ লোকদের একজন দু’জন করে ইসলাম গ্ৰহণ করার যুগ শেষ হয়ে যাবে। তখন এমন এক যুগের সূচনা হবে যখন একটি গোত্রের সবাই এবং এক একটি বড় বড় এলাকার সমস্ত অধিবাসী কোন প্রকার যুদ্ধ-বিগ্রহ ও চাপ প্রয়োগ ছাড়াই স্বতস্ফুৰ্তভাবে মুসলিম হয়ে যেতে থাকবে। মক্কা বিজয়ের পূর্বে এমন লোকদের সংখ্যাও প্রচুর ছিল, যারা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর রেসালত ও ইসলামের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত বিশ্বাসের কাছাকাছি পৌছে গিয়েছিল। কিন্তু কুরাইশদের ভয়ে অথবা অন্য কোন কারণে তারা ইসলাম গ্রহণ থেকে বিরত ছিল। মক্কাবিজয় তাদের সেই বাধা দূর করে দেয়। সেমতে তারা দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করতে শুরু করে। সাধারণ আরবরাও এমনিভাবে দলে দলে ইসলামে দাখিল হয়। আমর ইবনে সালামাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, “মক্কা বিজয়ের পরে প্রতিটি গোত্রই রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে এসে ঈমান আনার ব্যাপারে প্ৰতিযোগিতা শুরু করে। মক্কা বিজয়ের আগে এ সমস্ত গোত্রগুলো ঈমান আনার ব্যাপারে দ্বিধা করত। তারা বলত, তার ও তার গোত্রের অবস্থা পর্যবেক্ষণ কর। যদি সে তার গোত্রের উপর জয়লাভ করতে পারে তবে সে নবী হিসেবে বিবেচিত হবে”। [বুখারী: ৪৩০২] [বাগাবী]

১১০ :
فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَاسْتَغْفِرْهُ ۚ إِنَّهُ كَانَ تَوَّابًا

তখন আপনি আপনার রবের প্ৰশংসাসহ তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন, নিশ্চয় তিনি তাওবা কবুলকারী [১]।

ফুটনোট

[১] একাধিক হাদীস ও সাহাবীর উক্তিতে আছে যে, এ সূরায় রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওফাত নিকটবর্তী হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত আছে। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আমাকে বদরী সাহাবীগণের সাথে তার কাছে প্রবেশাধিকার দিয়েছিলেন। তারা এটাকে মনে-প্ৰাণে মেনে নিতে পারছিলেন না। তারা বলেই ফেলল, একে আবার আমাদের সাথে কেন? আমাদের কাছে তার সমবয়সী সন্তান-সন্ততি রয়েছে। তখন উমর বললেন, তোমরা তো জান সে কোথেকে এসেছে। তারপর একদিন তিনি তাদের মজলিসে তাকে ডেকে পাঠালেন। আমি বুঝতে পারলাম যে, তিনি আমাকে তাদের মাঝে ডেকে আমাকে তাদের সাথে রাখার ব্যাপারটি স্পষ্ট করারই ইচ্ছা পোষণ করেছেন। অতঃপর উমর বললেন, তোমরা মহান আল্লাহ্র বাণী, “ইযা জাআ নাসরুল্লাহি ওয়াল ফাতহ” সম্পর্কে কি বল? তাদের কেউ বলল, আমাদের বিজয় লাভ হলে যেন আমরা আল্লাহ্র প্রশংসা ও তাঁর কাছে ক্ষমা চাই তা-ই বলা হয়েছে। আবার তাদের অনেকেই কিছু না বলে চুপ ছিল। তখন তিনি আমাকে বললেন, হে ইবনে আব্বাস! তুমি কি অনুরুপ বল? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, তাহলে কি বল? আমি বললাম, এটা তো রাসূলের মৃত্যুর সময়, যা তাকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ্ বলেন, “যখন আল্লাহ্র সাহায্য ও বিজয় এসে যাবে”, আর এটাই হবে আপনার জীবন শেষ হয়ে যাওয়ার আলামত, “সুতরাং আপনি আপনার রবের সপ্ৰশংস তাসবীহ পাঠ করুন এবং তাঁর কাছে ক্ষমা চান; কেননা তিনিই তো তাওবা কবুলকারী”। তখন উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, তুমি যা বললে তা ছাড়া এ সূরা সম্পর্কে আর কিছু আমি জানি না।” [বুখারী: ৪৯৭০] সুতরাং সূরার অর্থ হচ্ছে, আপনার দুনিয়াতে অবস্থান করার উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে গেছে, তাবলীগ তথা পৌছে দেওয়ার দায়িত্ব পালিত হয়েছে। অতএব, আপনি তাসবীহ ও ইস্তেগফারে মনোনিবেশ করুন। [ইবনুল কায়্যিম: ইলামুল মুয়াক্কিয়ীন, ১/৪৩৬] আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন: এই সূরা নাযিল হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক সালাতের পর এই দো‘আ পাঠ করতেন

سُبْحَا نَكَ اللّٰهُمَّ رَبَّنَا وَ بِحِمْدِكَ، اللّٰهُمَّ اغْفِرْلِيْ

[বুখারিঃ ৭৯৪, ৮১৭, ৪২৯৩, ৪৯৬৭, মুসলিম: ৪৮৪, আবু দাউদ: ৮৭৭, ইবনে মাজাহ: ৮৮৯] অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শেষ বয়সে বেশী বেশী আগত দো‘আ পাঠ করতেনঃ

سُبحَانَ اللّٰهِ وَ بِحَمْدِهِ، أَسْتَغْفِرُ اللّٰهَ وَأَتُوْبُ إِلَيْهِ

[মুসলিমঃ ৪৮৪, মুসনাদে আহমাদ: ৬/৩৫] অনুরূপভাবে উম্মে সালামাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন, এই সূরা নাযিল হওয়ার পর তিনি উঠাবসা, চলাফেরা তথা সর্বাবস্থায়

سُبْحَانَ اللّٰهِ وَبِحَمْدِهِ

এই দো‘আ পাঠ করতেন। তিনি বলতেন, আমাকে এর আদেশ করা হয়েছে। অতঃপর প্রমাণস্বরূপ সূরাটি তেলাওয়াত করতেন। [তাবারীঃ ৩৮২৮৪]

0:00
0:00